Tuesday, December 25, 2018

এদিক সেদিক

বারবিকিউতে পয়সা তোলার জন্য মনের জোরে পেটকে বস্তার মত করে গিলেছি। ভিখিরিপনা বলতে পারেন, কিন্তু মহারাজদের ওইরকমই নিয়ম। মাঝে এলিয়ে পড়েছিলাম, নাভিশ্বাস উঠে গেছে ভেবে ওয়েটাররা সাবান জল এনেদিল, আহা হাত ধোবার জন্য না, খেয়ে বমি করার জন্য। তা বমি করে খেলেও হয় ভাবতে ভাবতেই আরো খানিক খেয়ে নিয়েছি। পাশের টেবিলে লোক বদল হল, আমি আর উঠিনা...শেষে কিরকম কড়া চোখে দেখতে লাগলো যখন আমায় ওয়েটাররা, আর আমারও ভুঁড়ি যখন থুতনি বেয়ে এসে টেবিলে পড়ব পড়ব হলো আমিও উঠে পড়লাম।

যাই হোক এত খেয়ে কোনোরকমে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ারেস্ট কোথায় বিনা পয়সায় গা এলানো যায় দেখলাম। তা ময়দানটাই বেস্ট এ আর বলার কি! কিন্তু ময়দানে ঢোকার আগে দেখি একটা দরজা হাফ খোলা, বড়লোকদের বাগানওলা বাড়ির মত। আমি ভুঁড়ি নিয়ে ঢুকবো কিনা ভাবছি, আটকে গেলে টানাটানিতে লাগবে খুব। দোনোমনা করে ঢুকিই গেলুম। আরিব্বাপ্রে একটা সাজানো গোছানো পার্ক তো! মাঠে ঘুমোলে মেরে তাড়াবে নাকি?

এখানে লোকে প্রেম করতে আসে। একা শুলে মারবে এমন না নিশ্চয়ই? ভারী নিঃঝুম দুপুর এখন চারদিক। শীতের হাওয়ার টান আছে শীত নেই। আলতো রোদে পাঁচিলের ঘুপচিতে একটা কুকুর ঘুমুচ্ছে দিব্যি আরামে। ওইদিকে কতকগুলো মালী বাগান সাজাচ্ছে। নানান দিকে নানান রকম প্রেম, ওই যে কোলেকোলে প্রেম, মানে প্রেমিকাকে কোলে তুলে নিয়েছে আর কি। আর ওই যে দন্ডায়মান হয়ে গাছে ঠেস দিয়ে, স্ট্যান্ডিং প্রেম...আচ্ছা এদের পায়ে ব্যথা করে না?

সিপাহি আগে....ফরোয়ার্ড মার্চ... মানে মুখোমুখি ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে ফরোয়ার্ড ব্লক আর পিছন্দিকে হেলে গেছে দুজনেই, ব্যাকোয়ার্ড স্ট্রেচ....প্রেম করলে ব্যয়াম জানা জরুরি দেখছি রীতিমতো!

নানারকম দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মালী এসে তাড়া দিলো, হেই ওঠো ওঠো, এটা ঘুমাবার জায়গা নাকি! লেহ্! যাকগে এমনিতেও বেলা পড়ে গেছে এরপর ঘুমোলে কানে ঠান্ডা ঢুকে যাবে। ফের রাস্তায়, হরেক কিসিমের মানুষ দিয়ে কোলকাতার বিকেলবেলা ঠাসা। একটা ট্যাক্সিওয়ালা উদাস মুখে বসে আছে। আচ্ছা অ্যাম্বাসেডর এর ডিকিতে কি নির্লিপ্ত বস্তা থাকে? সব ট্যাক্সিওয়ালা গুলোই কেমন সন্ন্যাসী ভাব নিয়ে বসে থাকে, কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই!

ঘুরতে ঘুরতে শহরে অন্যদিকটা চলে এসেছি। এখানটা ঠিক শহর না, শহরতলি। অন্ধকার নেমে আসতে ঠান্ডাও নেমে এসেছে খানিক এদিকটায়। ধোঁয়াশা আর অন্ধকারের আলোয়ান গায়ে মেখে চায়ের দোকানে দিব্যি আড্ডা বসেছে। 
"নারদ কে ছিলো জানো?"
- তুমি বলো না? 
- আগে বলো জানো কিনা। কই রে নবা, চা টা কই....

ওদিকে সব্জির বাজার জমে উঠেছে," মটরশুঁটি সত্তর টাকা? কদিন হয়নে রে তোর?"

সবজি বাজার পার করলে বুড়োটে মিষ্টির দোকান, দানাদার, রসগোল্লা আর পান্তুয়ার গামলা নিয়ে টিমটিম করে দাঁড়িয়ে। দোকানের মানানসই ভাঙা বেঞ্চ, ঘোলাটে চশমা পরা বুড়ো। পাশেই তেলেভাজার দোকান জমজমাট। দুটো বউ খুব করে ধনেপাতার বড়া ভাজছে। লোকটা হাতে হাতে চা দিচ্ছে।

রাত নামছে,কুয়াশায় মাখামাখি হিম লাগা রাত। আচ্ছা এই রকম রাতে কোলকাতার রাস্তায় পার্কে গাছেদের যে মিটিং বসে তাতে মিটিং মিনিটস বানাতে হয়? এক দুটো গাড়ি চলে যাবার আগের মুহুর্তে যে রসিকতা হয়েছিলো, গাড়ি যাবার সময় মিউট করে রেখে ফের চালু হয়?

গাছগুলো যেন বুঝতে পারে আমার বক্তব্য, মিচকি হাসলো কি?পা চালাই....

Monday, December 24, 2018

মাধুকরী

একপাশে ছোট ছোট বাড়ির মাথা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোপ খোপ আল দিয়ে আলাদা করা মাঠ, জায়গায় জায়গায় ধান কাটা হয়ে গেছে, আর একদিকে কাদা মাটির চড় নিয়ে বয়ে চলা রায়মঙ্গল। তার বুকে একটা দুটো নৌকা কখনো কখনো।

এরকম একটা জায়গার ছবিই দেখছিলাম কবে যেন, কোন সময় জানিনা কিন্তু এই নদীর ধার এই গ্রামের ধারের রাস্তা, এই আলসে দুপুরে ছোট পুকুরে জাল টানার শব্দ এ আমি চিনি, প্রিমনিশন কিনা জানিনা কিন্তু আমাকে এখানে আসতেই হত। রবিবারের শীতের মেঘলা দিন, হিসেব কষা লোকের জন্য আদর্শ ল্যাদ রবিবার। বাজার করা স্কিপ করে দাও, খিচুড়ি খাও শীতের ফুলকপি দিয়ে আর গায়ে কম্বল চাপিয়ে একঘুম। কিন্তু ঋকানন্দের যে ঘরে সয় না, বুকের মধ্যে ছটফট নদীর সাথে থাকতেই হবে, বেরোতেই হবে। তাই এই বেরিয়ে পড়া। কোথায় যাচ্ছি সঠিক জেনে বেরোইনি, সায়েন্স সিটির পাশের রাস্তা ধরে টাকি থেকে ফিরেছিলাম যেদিন সেদিনই ঠিক করেছিলাম, ওই গাছ পালা ছাওয়া চমৎকার রাস্তাটা ধরে আরো অনেক খানি আমায় যেতে হবে। নদীর কাছে।

রাস্তাটা সত্যিই বড় ভালো, মসৃন পিচ, দুইধারে গাছের পাঁচিল। একদিক দিয়ে একটা খাল বইছে, খালের ওদিকে কলাবাগান। এগোতে এগোতে ক্রমে রাস্তার দুধার বদলায়। ফুলকপি, সর্ষেবোনা চাষের ক্ষেত, পেরিয়ে এখন খালি ভেড়ির জল। একটা লোক সাদা পাউডার এর মত কী যেন ছড়াচ্ছে জলে। ওদিকের ভেড়িতে একটা লোক নৌকা ঠেলছে নিজে জলে দাঁড়িয়ে। আমার এইরকম হুটহাট বেরোনোয় গন্তব্যর থেকে রাস্তা জরুরী থাকে। এই বিস্তীর্ণ আকাশ, বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাঝখান দিয়ে কালো চকচকে রাস্তা ধরে ছুটে চলায় যেমন আনন্দ হয়, তেমনই হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়তেই যেন আনন্দ। আমার তো সব সময়েই তাই। ছুটতে ছুটতে ছুটতে যখন ফিনিশিং লাইনের মুখে আমার আর খেলতে ভালোলাগেনা, ইচ্ছে করে আমার স্বপ্নের সেই জায়গাটা, একটা বটগাছের কোলে, নদীর ধারে আমার আস্তানায় বসে থাকবো। জানি ও আমার সইবে না বেশীক্ষন। নিস্তরঙ্গ একটানা জীবন ভালোলাগলে রবিবারের সকালে রাস্তায় থাকতাম না।

কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি। আসলে এ সেই অর্থে ভ্রমণ কাহিনী তো না। চলার গল্প। বাইরে বেশ ঠান্ডা আছে। কোলকাতা ফেলে এসেছি বোঝা যায়। রাস্তায় নানান রকম ফেস্টুন টাঙানো আছে। কেউ একজন জনপ্রতিনিধি আসবেন, তার জন্যে। নানান রকম অঞ্চল থেকে নানান রকম লোক তাকে স্বাগত জানায়;আড়ি পদবীর একজন, কাইজার নামের একজন। আচ্ছা কাইজার কী জানে তার নামের মানে? আর আড়ি বেশ ছোটবেলায় বলত, আমি আড়ি আর তার বান্ধবী বলত আমি ভাব?

এ জায়গার নাম গুলোও বেশ। ঘুষাঘাটা। কবে কারা ঘুষোঘুষি করেছিল কে জানে! মীনাখাঁ। নেমে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে মীনা খাঁ কে ছিলেন? কী করতেন? সামনে একটা মোটর ভ্যানে এক মিঁয়া চলেছেন তার কালো কাপড়ে মোড়া বিবিকে নিয়ে। ভারী যত্ন করে মাঝে মাঝে কাপড়ের তলা থেকে খাবার নিয়ে বাচ্ছাকে আর বাচ্ছার বাপকে কি যেন দিচ্ছে। আমি পাশ কাটিয়ে যাই। এলাহী মালিক লেখা বাসকে পিছনে ফেলে।

পথের সাথী বলে সরাইখানা টাইপ হয়েছে আজকাল। হিসি করতে গেছি সেখানে, দেখি থাকার জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকা। " আমরা ভদ্র দম্পতিদের থাকতে দিই" থেকে "ম্যারেজ সার্টিফিকেট থাকা জরুরী", " একলা মহিলার প্রতি শালীন ব্যবহার করবেন"। বাপ্রে সরাইখানা না নীতিশাস্ত্রমালা। ওখানে যিনি পয়সা নিচ্ছিলেন, সেই দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম নদী কোথায়? ধামাখালিতে? 
- হ্যাঁ। কেন? নদী খুঁজছ কেন?
- এমনিই...নদী দেখবো।
- ও। আসলে অনেকে মনে দুঃখ নিয়ে নদীতে যায়,তাই, খুঁজছ কেন জানতে চাইছি।

বোঝো! আবার! আচ্ছা আমায় দেখলে কি সুইসাইডাল মনে হয়? নাকি একা একা ঘুরে বেরাই বলেই? যাকগে। তাকে আস্বস্ত করে বেরোলাম ফের। ধামাখালীর আগে রাস্তা এখনো তৈরী হচ্ছে৷ রাস্তা বানানো দেখতেও আমার ভারী ভাল্লাগে। কিন্তু এখন তো নদী দেখবো আগে। 
ধামাখালী জায়গাটা ছোট্ট গঞ্জ মতন জায়গা। গঞ্জ শব্দটা এখন আর ব্যবহার হয়না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে বইতে যত গঞ্জ পড়ে যেমন কল্পনা করেছি এটা তেমন জায়গা। বাস গুলো সব এসে এসে এখানেই থেমে যায়। একটা গেস্ট হাউজ আছে পর্যটন বিভাগের। তার বাগানে দুটো নধর কুকুরছানা একটা রুমাল নিয়ে খানিক উস্তুম খুস্তুম লড়াই করে নিলো। শেষ অব্দি যেমন সব বোকারা করে, রুমাল ফেলে নিজেরা লড়াই করা শুরু করলো।



এখান থেকে ফেরী করে করে এ ঘাট সে ঘাট, সে গাঁ, করা যায়। তিন টাকা টিকিট কাটতে গিয়ে টিকিটবাবুর মাথা খেয়ে নিয়েছি। কোথায় যায়? সন্দেশখালী? আর? বড় তোষপুর, ছোট তোষপুর। আমি প্রথমে বড় তোষপুরকে পরিতোষপুর শুনেছি। ভাবছি অবাক হয়ে, পরিতোষ বলে একটা লোক হয়ত এখানে বসতি গড়েছিলো। তোষপুরের লোকেরা ভারী খুশিতে থাকে? আগেকার হাতে টানা নৌকাগুলোতে মোটর লাগিয়ে নেওয়া নৌকা। সে নৌকায় সবাই ওঠে, সাইকেল, মোটর সাইকেল, শিশু, বুড়ো, বাদামওলা, ছোলামাখা ওলা। রায়মঙ্গলে কামট থাকার গল্প পড়েছি কত্ত। কামটে এসে কুচ করে হাত পা কেটে নিয়ে যায় কেউ টেরও পায়না। জায়গাটা লাল হয়ে যায় খালি। আমি হাত দিলাম জলে, কই কামট? বাচ্ছা, মানে একেবারে দুধের বাচ্ছা, তাদেরকে বুকে নিয়েই নৌকার সরু দেওয়ালে বসেছে, প্রাণে ভয় নেই এদের দেখি। অবশ্য এ অঞ্চলে ভয় থাকলে বাঁচাও যাবে না।

সন্দেশখালীতে অফিস কাছারি আছে শুনেছি, তাই ওখানে নামার মানেই নেই। লাস্ট স্টপ ছোট তোষপুর ওখানেই নামা যাক। ঘাটের কাছে একটা মিষ্টির দোকান, আর এক দুটো দোকান আছে ব্যাস। ধামাখালিতে হোটেল মোটেল ছিল। নদীর পাশেই বাঁধ, তার দুধারে কয়েকঘর করে করে লোক। আসল গ্রাম হুইই ওই দিকে। ভ্যান যায়। আমি হাঁটা দিই নদীকে পাশে রেখে। অভাবী মানুষদের বাস এখানে কিন্তু গরীব না, মানে বোঝাতে পারলাম না না? ধরো পাকা বাড়ি নেই, কিন্তু পেটে ভাত নেই বা মনে শান্তি নেই এমন গরীব না। । দিব্যি রোদে বসে কেউ উকুন বাছছে, কেউ রোদ পিঠ করে খেতে বসেছে। এক বাড়ি থেকে রেডিওর বা টিভির আওয়াজ আসছে। প্রায় প্রতি ঘরেই গরু বা ছাগল বা শুয়োর পোষা আছে৷ একটা ছাগল ছানার আবার আমায় ভারী পছন্দ করে ফেলেছে। আরে এ তো আমার সাথে সাথেই আসছে, আরে কতদূর যাবি রে? হারিয়ে যাবি তো! আমি কিন্তু ফিরবো না এ পথে। আমি থমকালে সেও থমকায়, আমি চললে সেও।ওরে বাবা সামনে একটা বড় মোরগমশাই যে! 'ও মানুষ দাদা তুমি থামলে কেন, চলো না। আমায় যদি ঠুকরে দেয়!'
আচ্ছা আচ্ছা চল যাচ্ছি। মোরগ, বড় শুয়োর সব পার হয়ে অনেকটা রাস্তা আসার পর, যখন ছাগল ছানাটা বুঝেছে এ পাড়া তার একেবারেই পরিচিত না, বেজায় ভয় পেয়েছে। ম্যা ম্যা ব্যা ব্যা করে সে কীই কান্না। ' ও মা তুমি কোথায় গেলে? আমি তো হারিইয়েই গেছি, আমায় নিতে এসো না'। 
ভারী মুশকিল হলো তো! ওই তো আরো কটা ভেড়া আর ছাগল চড়ছে, ওদের সাথে ভিড়ে গেছে। যাক! না হলে এর জন্যেই আমায় ফিরতে হত!

একটা বেনে বৌ শিরীষ গাছের ডালে বসে টুকটুক করে ডেকেই পালালো। ওই দূরে একটা নৌকা যাচ্ছে কোথায় যেন। নিজেদের পুকুরে জাল ফেলছে দাড়িওয়ালা একজন। আর তাকে ঘিরে কয়েকজন। শীতের দুপুর গড়িয়ে চলেছে। ধানের গাদায় শুয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে একজন। ফুরুত করে দুটো ছোট্ট পাখি লাফালাফি করছে। তিনটে রাজহাঁস পুকুরে নেমে আরাম করে স্নান সারছে। স্নান সেরে ফিট বাবু হয়ে ডানা ঝেড়ে, টুকটুক করে হেঁটে ফিরছেন ওই যে। ভারী রাজকীয় ভঙ্গী কিন্তু। বাঁদিকে মা মুরগীটা তার ছানা গুলোকে নিয়ে দানা খুঁটছে। চারদিকে বড় শান্তির ছবি। আমার খিদে পাচ্ছে, অনেক্ষণ হাঁটছি কিনা। আচ্ছা এ রাস্তা ধরে পৌঁছয় কোথায়?

আরো অনেকখানি হাঁটলে আতাপুরের ঘাট পড়বে, একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো। আতাপুরের ভূত বলে একটা গল্প ছিলো না? ওই ঘাট থেকে নৌকা মিললেও মিলতে পারে ধামাখলী ফেরার। না পেলে? দেখা যাবে খন। আতাপুরের ঘাট দেখতে ইচ্ছে করছে। একটা ছোট্ট ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, পার হয়ে হাঁটছি হনহন। নৌকায় রঙ করছে এক বুড়ো, আর তার ছেলে। টায়ার নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে একটা ছেলে, আমি হাত বাড়িয়েছি যেই অমনি ভুরু কুঁচকে টায়ার খানা সরিয়ে দে দৌড়। একটা ছাগলকে ভড়কি দিলাম, ব্যা ব্যা আওয়াজ করে। দুটো হাঁস পাখায় মুখ গুঁজে গেঁড়িঘুম দিচ্ছে। ওইতো একটা দোকান মত। ওটাই আতাপুরের ঘাট মনে হয়।

ঘাটে একটা নৌকায় মাল উঠছে। শেষ নৌকা চলে গেছে, আর ধামাখালী যাবার নৌকা পাবো না। তাহলে? যে ভ্যান থেকে মাল নামছিলো তারাই নিয়ে গেলো, ভাড়া নিয়ে, ধুচনোখালী না কী যেন নামের একটা জায়গায়। ওখান থেকে ফের ভ্যান, এবার গ্রামের মধ্যে দিয়ে, পিচের রাস্তা ধরে। দু ধারে সাজানো গাছ, ঝকঝকে রাস্তা। এহ বৃষ্টি এল এক দু ফোঁটা, ঠান্ডা হাওয়া, শীতের বেলা পড়ে গেছে।

খিদে পেয়েছে। কী খাই? তুষখালির বাজারে, মিষ্টির দোকান থেকে সিঙারা, বোঁদে আর তার পাশের দোকান থেকে চানাচুর কিনে ঠোঙায় হাত দিয়ে দিয়ে সব কিছু দিয়ে মুড়ি। নদীর পাড়ে বসে বসে৷ এক দুটো নৌকা এলো, গেলো। আতাপুরের ওদিকের গ্রাম গুলোয় যাওয়া হলো না, আজ থাকতে হত তাহলে। এহ কবে এমন হবে, ফেরার কথা না ভেবে গ্রামের পর গ্রাম, নদীর পর নদী পার হয়ে হয়ে যাব।

অনেক ক্ষন পর অন্ধকার হবার মুখে নৌকায় উঠে ফিরতি পথ নিয়েগি। যদি বলো কী দেখার আছে? আমি তো এক কথায় উত্তর দিতে পারবো না। কিছুই নেই হয়তো। যদি জিজ্ঞেস করো কেন বেরোই এমন, তারও উত্তর জানা নেই। কিন্তু ওই নদী পাশে নিয়ে শীতের দুপুরের গ্রামটা, ছোট্ট ছাগল ছানাটা, ঝোপের পাশে মৌতাত করে সিগারেট খাওয়া ছেলেটা, তুষখালির বাজারে আমার সিঙারা চানাচুর বোঁদে মুড়ি দিয়ে লাঞ্চ করাটা আমার পাথেয়। সবার পথ এক না, সবার পাথেয়ও এক না। তাই আমি বলতে পারবো না, ঠিক কী আছে, ওই মরা রোদের গ্রামটায়....রাস্তাটায়..আমার পাথেয় টুকু রাখা আছে খালি এই জানি।









Wednesday, December 19, 2018

হারানে

হারিয়ে ফেলাটাও আর্ট মশাই। মানে প্রথমে সেটা থাকে বদভ্যাস,পরে সেটা দীর্ঘদিন মজুত হলে হয়ে যায় অভ্যাস, আরো দীর্ঘদিন হলে হয়ে গেলো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য.... সেটাকে নিপুন দক্ষতায়,অন্যকারো না করতে পারার লেভেলে এক্সিকিউট করে গেলে হয়ে গেলো শিল্প। তা হারানো ব্যাপারটাকে আমি বদভ্যাস থেকে, নিত্যদিনের সঙ্গী অভ্যাস করে ফেলেছিলাম সেই ইস্কুলে থাকতেই। রোজই কিছু না কিছু করে খাতা, সিলেবাস, পেন ইত্যাদি হারানোর অভ্যাস হয়ে গেছিলো নিত্যসঙ্গী। ক্রমে কিশোর বয়স এলো, বই খুলে অমুকের চিরকুটের মানে, শিরিনের ওড়না, পিয়ালীর চোখ চেপে ধরা.... ইত্যাদি ভাবতে গিয়ে আর পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখে বারবার ব্লাডার খালি করতে গিয়ে সময় হারানো ব্যাপারটা আমার নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবেই বইতে হলো।
আলাদা মেজাজ আলাদা ধরন, ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি...সুতরাং আমি হারানে, সময় হারানোর পর আমি বন্ধু হারানোর পর্যায় উত্তীয় হয়েছি...কারোর সাথে বদমেজাজের কারনে তো কারোর সাথে কথা হারিয়ে, হারিয়ে ফেলা। ঐতিহ্য মেনেই আমি হারানো গুলোকে হজম করছিলাম। নতুনের ধাক্কায় তো পুরোনো ঐতিহ্য হারাতে দেওয়া যায়না!
ক্রমে দেখলাম, হারানোয় আমার সাথে অনেকেই পাল্লা দিচ্ছে! অবাক ব্যাপার প্রকৃতিও! নীল রঙ হারিয়ে গেলো আকাশ থেকে, ধোঁয়াটে রঙে অভ্যেস হল, পাখির ডাকে বৈচিত্র্য হারালো, কাক রইলো। বর্ষাকালে কেঁচো হারালো, জমা কালো জল রইলো....হারাতে হারাতে, রোজ তিনি আমার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাপারটা শিল্পের পর্যায় নিয়ে যাচ্ছেন। দুম করে সেদিন শুনি একটা আস্ত নদীই হারিয়ে ফেলেছে। তা ভালো তার নদী সে মেরে ফেলবে না ফুঁসে উঠে সব ভাসিয়ে দেবে তার ব্যাপার। কিন্তু এ লড়াইতে আমি তো মশাই কুটির শিল্প হয়ে যাচ্ছি হ্যাঁ। তো সেদিন একটা আমগাছের সাথে কথা হচ্ছিলো, কথা মানে কি আর মানুষের ভাষায় নাকি! আমি বলে যাই বলে যাই আর সে বাচ্ছাদের কথা শুনছে ভঙ্গীতে শুনে যায়। তা সে করতেই পারে; বয়সে, দেখায়, জ্ঞানে, সবেতেই বড় সে। আমি বলছিলাম হারানোর গল্প আমার। সবই হারায় আমার, আমার যত্ন নেই বলে না কিছু সয় না আমার? সে দেখাচ্ছিলো, যার হারাচ্ছে তার তো হারাচ্ছেই কিন্তু যে হারিয়ে যাচ্ছে তারও কি কম যাচ্ছে নাকি? এই যে মানুষগুলো হারিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে....দাঁড়াও দাঁড়াও, হারিয়ে যাচ্ছে মানে? সে আবার কি? গিজগিজ করছে মানুষ, থিকথিক করছে মানুষ আর তুমি বলছ হারিয়ে যাচ্ছে?
কথা হচ্ছে সব মনে মনেই, কারন গাছেরা তো টেলিপ্যাথি বোঝে, ওদের চিৎকৃত ভাষার দরকার হয়না। আমার চেঁচামেচিতে, গাছটা হাসলো...হারাচ্ছেই তো, একটা করে গাছ৷ নদী হারাচ্ছে মানে মানুষও তো টিকে থাকার অধিকার হারাচ্ছে। তাছাড়া, তোমার মনে হয়না, মানুষ ক্রমে নিজের সাথে কথা বলতে পারা হারাচ্ছে, রঙ বেরঙ মন হারিয়ে রোবট হচ্ছে?
লস কার হচ্ছে হে হ্যাঁ?
ঠিকই তো....কিন্তু যন্ত্রণাটা, যার হারালো তার? এই দেখোনা, ছোট থেকে সময় হারিয়ে হারিয়ে এখন তো আর মাত্রাও বুঝি না। তোমাদের যে হারাচ্ছে সব যন্ত্রণা হয়না?
উঁহু, আমরা অত সহজে বিচলিত হইনা। হারালে হারাবে, থাকলে থাকবে....হারাই হারাই ভয়ে যে ওই দূরে ছেলেটা কেমন নদীতে সাঁতরে মাছ ধরছে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে সেটা মিস করে যাচ্ছ তো? হুঁ যত্ন করলে খানিক থাকে বটে জিনিস...কিন্তু অত যত্নে যাকে রাখতে হয় তাকে হারিয়ে ফেলাই ভালো বুঝলে? চিন্তাহীন, ভারহীন হয়ে দিব্যি লাগবে....
গাছ ব্যাটা তো বলেই খালাস....আমার হিসেবী মন, খালি আঁক কষে কত টাকা হারিয়ে গেছে, কত মানুষ হারিয়ে গেছে, কত সময় হারিয়ে গেছে....আমি হারানো শিল্পপতি হিসেবে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি এমন একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। এমন সময় ভারী ক্যাচোর ম্যাচোর করে এক দঙ্গল পাখি মাথার উপর দিয়ে গেল....আচ্ছা এরকমই একবার কবে যেন হয়েছিলো না? এরকমই শীতের দুপুরের এক ঝাঁক পাখি উড়তে দেখেছিলাম না? একই ফ্রেম মনে হচ্ছে, জলের ধারে...দুপুরে....সে কোন জন্মে না এজন্মে কে জানে?
হারায় যা তাই কী তবে ফিরে ফিরে আসে?

Friday, December 7, 2018

সাংসারিক

তুমি কী বলে দশটা মিষ্টি খেলে? হ্যাঁ এত বয়স হলো কান্ডজ্ঞান হলো না? কালকেও একটা প্যান্ট বাতিল করেছে, ছত্রিশ কোমর আর হয়না। বলি একটু লজ্জা নেই গো তোমার?

- ওরকম চেঁচাচ্ছ কেন! অত গুলো মিষ্টি বানিয়েছিলে কেন যদি না খাবো?

- বানিয়েছি বলে কপকপ করে সব খাবে হ্যাঁ!

-বেশ করেছি! আর তোমার জন্যেই আমার ভুঁড়ি বাড়ছে, ভুঁড়ি নিয়ে তোমার ইভা ব্রাউন মা যদি ফের বলে না, দেখো একবার।

- হুহ আমারই তো দোষ সবসময়।

- হ্যাঁ হ্যাঁ তোরই দোষ রে ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ। তুই না বানালেই খেতাম না।

- কিইই!! আমি ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ? মচ্চিমুলো করে খাওয়াচ্ছি কিনা বাবুর তেল বেড়েছে কত। আমি ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ হলে তুমি লাউসেদ্ধ।

- লাউসেদ্ধ? লাউসেদ্ধ বললে আমায়! তুমি, তুমি হলে চানাচুরের পচা বাদাম, ফ্রিজে রাখা রসগোল্লা।

- অ তাই তো?

- হ্যাঁ তাই!! শোনো এ শর্মা কথা গেলে না বুঝেছ?

- ভেবে বলো কিন্তু, আবারও বলছি। ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ, রসগোল্লা, পচা বাদাম সব আমিই তো?

- হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিইই।

- আমার মা ইভা ব্রাউন? বাবা হিটলার?

- হ্যাঁ। যেরকম ভাবে বিয়ের সময় বাগড়া দিয়েছিল তাতে অন্য কিছু হতেই পারে না।

- বেশ, শুনে রাখো, রাতে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুরদম করব ভেবেছিলাম, তা আমি, মা বাবা খাবো তুমি মুড়ি খেয়ে ভুঁড়ি রক্ষা কোরো আর হ্যাঁ বাইরের ঘরে নিজের বালিশ কাঁথা নিয়ে চলে যেও।

- মা বাবা মানে!!! তোমার বাবা মা আসছেন নাকি! হ্যাঁ! আর বাইরের ঘরে শোবো মানে কি! আমার নিজের বালিশে না শুলে হয়না।

- থাক! তোমার আর হার্ট অ্যাটাকের দরকার নেই। মা বাবা মানে তোমার মা বাবার কথাই হচ্ছে৷ আর বালিশ দিয়ে দেব বলেছি তো, খুব অসুবিধে হলে বোলো আমি না হয় ওঘরে মা এর কাছে গিয়ে শোবো...

- আহ সব ব্যাপারে অত জলদি ডিসিশন নাও কেন গিন্নী। আমি তো খালি বলছিলাম, অত মিষ্টি খাওয়া ঠিক হলো না, রাতে ইয়ে চারটে কচুরি দিও? কেমন? আর মা বাবা কে রাতে বিরক্ত করার কি...এই দেখো, নতুন থ্রিলার কিনেছিলাম, রাতে পড়বে না?

- তাহলে ওই ফ্রিজের ঠান্ডা...

- না না ওসব আবার তুমি হতে পারো..আমিই তো ওসব। তুমি তো কড়াইশুঁটির কচুর আলুরদম...কই দেখি...

-থাক হয়েছে...বুড়ো বয়সে লাজ শরম কিছু নেই!

- বুড়ো!! ইয়ে গিন্নী প্রমান চাই বুঝি...

- মরণ!

Wednesday, November 28, 2018

পথে পথে

একদম অন্ধকার হবার পর পরেই চাঁদ ওঠে না, একটা দুটো তারা ঘুম ভেঙে আড়মোড়া মেলে। টর্চ আছে পকেটে, কিন্তু অন্ধকার গায়ে মেখে হাঁটতে দিব্যি লাগছে। শীত পড়তে শুরু করেছে, বাংলায় এটা কোন সময়? অঘ্রাণ না? হাড় কাঁপানো ঠান্ডা কিছু না, তবে ঠান্ডা আছে। সাপের ভয় নেই, আর মহারাজদের চোর ডাকাতের ভয় থাকার কথাও না, তবে আর টর্চ কী হবে!

হনহন করে হাঁটছিলাম, যেখানে আছি সেই আলো শেষ হলেই অন্ধকার ঘুটঘুটে। অন্ধকারটা চোখে সইলেই আর ঘুটঘুটে থাকেনা, আকাশে একটা আলো থাকেই। সেই আলোতে গাছপালা গুলো বড় অন্যরকম লাগে, বাঁ পাশে একটা জলা, সকালেই দেখেছিলাম। ডান পাশে কী কে জানে! খানিক হেঁটে দেখি একটা পাড়ায় পৌঁছে গেছি। ডান বাম দুদিকে রাস্তা, একদিক ধরে এগোচ্ছি হনহন করে, টুকরো টাকরা কথা কানে আসছে, হিন্দি না, বাংলাই, ডায়ালেক্ট অন্য। সীমান্তবর্তী এই জায়গার লোকগুলো এখনো শহুরে ধুলোয় ঢাকা পড়েনি। তেষ্টা পেয়েছে বেশ, ও কাকা টিউবওয়েল আছে কাছাকাছি?

হুই উদিকে বাঁয়ে আছে, বেসসি না দু কদম দূরে। হুঁ। জল খেয়ে একটু এগিয়েছি, এদিকটা বাড়িগুলোর পিছন দিক, গরু দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে, একটা মুদির দোকান টিমটিমে আলো জ্বলা, সেখানে শাকপাতা থেকে চিপ্স সবই মেলে। মুদির দোকান পেরোলেই একটা মাঠ, মাঠের ওপাশে গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লাল চাঁদ উঠছে তখন। এরপর আস্তে আস্তে সাদা হবে, মাথার উপর উঠবে।

হাতে বেলুন নিয়ে লোকজন ফিরছে, এদের আজ রাস মেলা আছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে দেখি, মেলা না ঠিক, রাস মন্দিরকে ঘিরে কিছু মাটির মূর্তি বানিয়েছে, অল্প স্বল্প আলো দিয়ে সাজিয়েছে, বাচ্ছা, মেয়ে, পুরুষ সব হামলে পড়ে তাইই দেখছে আনন্দ করে৷ মন্দিরে সংকীর্তন চলছে, খোল করতাল বাজিয়ে, ইস্কনের মন্দিরের মত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে না। আমার ভক্তি নেই, ঘুরে ঘুরে আলগোছে দেখছি। এহে মোবাইলটা আছে বটে কিন্তু ওয়ালেট তো নাই, কিছুই খেতে পাবো না তো তাহলে! ঠিক আছে এমনিতেও কিছু নেই মনে হয়। ওই দিকে কিসের জটলা হচ্ছে? উঁকি মেরে দেখতে গিয়েই হাতে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে পায়েস ধরিয়ে দিলো। চারিদিকে অজস্র খালি কাপ পড়ে আছে এই জন্যেই বুঝি?

পায়েসের কাপ নিয়ে মুশকিলে পড়লাম। আমি খেতে ভালোবাসি, কিন্তু আমি তো হিমু কিংবা নীললোহিত না, ঋকানন্দের সারাদিন না খেলেও চলে কিন্তু ভালোবাসার খাবার খারাপ স্বাদের আমার সয় না। আমার অনেক কিছুই সয় না, সে আলাদা কথা কিন্তু এই পায়েস নিয়ে এখন আমি কী করি? অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গরীব মানুষেরা পায়েস যেটা বানায় সে বেশ খারাপ হয়। চাল সেদ্ধ করে পরে দুধ মেশায়। তাও মুখে দিয়ে দেখলাম, হুঁ, খারাপ। এবার? ফেলে দিলেই হয় কিন্তু এতো লোক আহ্লাদ করে করে আগ্রহ নিয়ে যা খাচ্ছে তা ছুঁড়ে ফেলতে পারি এমন জোরও নেই।

আরো খানিক এদিক সেদিক ঘুরে, দেখি একটা কুকুর। যাক একেবারে ফেলা গেলো না। ভীড়টা পেরিয়ে ফিরতি পথ ধরেছি। বাঁধানো রাস্তাটা পার হলেই একা গাছটা দিয়ে চাঁদের আলো নেমেছে। পূর্ণিমার আলোয় জায়গাটা ঝকঝক করছে। খানিকটা গেলেই নদী। শীতকালের নদী, পাথর বেশী জল কম। কিচ্ছু না থাকলেও যেমন জীবন আবার দুহাত ভরা থাকলেও জীবন;তেমনই জল থাকলেও নদী কম থাকলেও নদী...জল একেবারে শুকিয়ে না গেলেই হলো। অবশ্য মরা নদী অত খারাপ না যতটা নোংরায় খাল হয়ে যাওয়া নদী খারাপ।

কুয়াশা নেমেছে রাত বাড়তে, সাদা নদীর চর, এক পৃথিবী চাঁদের আলো। আশেপাশের গাছ গুলো সতর্ক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে, একটু পরেই পরী নামবে এখানে। সে পরীদের সাথে দেখা হলে মুশকিল, আর ঘোর কাটবে না, ঘুরে ঘুরে মরতে হবে সারা জীবন। কোত্থাও তিষ্ঠানো যাবে না। পরীদের ধরে ফেললে আরো মুশকিল, ধরলেই তারা মানুষ হয়ে একশো হাজার বছর আটকে যাবে। না আমি পরী ধরতে চাইনা, এমন মায়াময় রাতে, নদীর ধারে বন পাহাড়ের উপর যার থাকার কথা, টিউবলাইটের আলোয় ল্যাপটপ দেখবে সে এ আমি ভাবতে পারিনা। আমার হাত ঝলসে যাবে আমার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।

চাঁদের আলোয় নেশা হয়, ঝিম ধরা নেশা, এইরকম খোলা প্রান্তে, নদীর ধারে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের আওয়াজে, গাছেদের চোখের দৃষ্টিতে সে নেশা বড় তীব্র হয়। মনে হয় সব ফেলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাই। আর ফেরার কী দরকার....

কিন্তু আমার সে জীবনও সইবে না আমি জানি, আমায় ফিরে ফিরে আসতে হবে আবার যেতে হবে.....

Tuesday, November 20, 2018

একদিন বেলায়

এদিকটা কেউ আসেনা। ভাঙা জিনিসপত্র পড়ে থেকে থেকে ঘাস বেড়ে উঠেছে এলোমেলো। কদম গাছের ডালে একটা পাখি বাসা বেধেছে, পার্থেনিয়ামের ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ছে দিব্যি। আচ্ছা প্রজাপতিদের শ্বাসকষ্ট হয়না, এলার্জি হয়না? এই হলুদ প্রজাপতি গুলোর টাইগার প্রিন্ট ছাপ, লাল সুতোর বিড়ি না কি যেন নাম। যাকগে আমার কি! দুটো সারস লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ভাবছে আজ কাবাব খাবো না কাচের বয়ামের কেক খাবো?

রোদের তেজ আছে, আবার নেইও। মানে ফেসবুকের মতন আলগা সম্পর্কে থাকলে গায়ে লাগে না তেমন কিন্তু একটু বেশীক্ষন থাকলে গা চিড়বিড় করে। দুটো কাঠবিড়ালী ব্যস্ত ভঙ্গীতে বাদাম না কী যেন খাচ্ছে, কদম গাছের ডাল থেকে টুপ করে একটা কদম পড়লো। কদম বর্ষাকালের ফুল না? 
অথচ নোংরা নেই তেমন, সাধারনত পিছন দিক গুলোয় যা হয়েই থাকে। আমার একটু ভীড় এড়ানো দিকগুলোয় হেঁটে বেড়াতে দিব্যি লাগে, ঝুম হয়ে বসে থাকলেও মন্দ না। দূরে ফ্লাইওভার দিয়ে বাস গাড়ি সাঁই সাঁই বেরিয়ে যাচ্ছে....এমন সময় সে এলো।

খুব ভয়ানক বুড়ো একজন। মনে হয় দু কদম হেঁটে তিন কদম পা দিলেই মরে যাবে এক্ষুনি। খক খক করে কাশছে, মাঝে মাঝে থুতু ফেলছে। এ কেন এলো এখানে! আমার একার রাজত্বে দখলদারী! চলে যাবে ভেবে সরে এসে বসলাম। গেলো না। ভালো করে তাকিয়ে দেখি লোকটার সারা গায়ের মাকড়সার ঝুলের মতো কুয়াশা। নভেম্বরের রোদ সে কুয়াশা ভেদ করতে পারে না যেন। থুতু, বুড়ো, কুয়াশা কিছুই ভাল্লাগেনা আমার, আমি সরে এসে বসি।

তাতে লাভ কিছুই হয়না দেখি। কুয়াশাটা দিব্যি ডালপালা লাভ করেছে পাশের ছাতিম গাছটা জড়িয়ে, ধোঁয়ার মত করে। কুয়াশার সাথে কথা বলা মুশকিল, তায় সে যদি আবার জ্যান্ত কুয়াশা হয়। আমি তবু যেতে পারছি না এখান থেকে। ওইদিকে একটা চা এর দোকান আছে, তার পাশে একটা ছানা নেড়ি কুকুর এসে উঁকি মারছে কুয়াশার পাশ দিয়ে।

বুড়ো মাথা নীচু করে চা এর ভাঁড়ে বিস্কুট ডুবোচ্ছে, লাঠি আঁকাবাঁকা, পাশে শোয়ানো। পুরো জায়গাটার পাশ থেকে একফালি রোদ উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে কী ব্যাপার। দু হাত দিয়ে দিয়ে কুয়াশা সরিয়ে ভাবছে একটু চা এ চুমুক দেবে কিনা। কিন্তু এন্ট্রি পাচ্ছে না মোটেও।

এদিকে কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে ঘাস গুলো, গাছগুলো বিরক্ত করছে আমায় বেজায়। রোদের এন্ট্রি নেই যেখানে, ঋকানন্দও নেই সেখানে। কিন্তু জ্যান্ত কুয়াশা তো সোজা জিনিস না, সে এতোক্ষনে বেশ স্বাস্থ্য বানিয়েছে। বুড়ো আরো যেন বুড়ো হয়ে গেছে। পাঁচিল এর শেষ সীমায় একটা বন্ধ ঘর আছে, বুড়োর পাশটাতেই। ব্যাটা কুয়াশাটা বুড়োর দাড়ি, ঝোলা, বন্ধ ঘর পেয়ে মাথা নেড়ে গান গাইছে আবার। ধুত্তোর ছাই ওদিকে আবার ছানা কুকুরটা তাকাচ্ছে দেখো! কুকুর আমি মোট্টে ভালোবাসিনা। তায় আমার এমন সাধের জায়গায়। কিন্তু অমন খিদে খিদে, দাওনা চোখে, ছোট কুকুর ছানাও মোটে ভালোনা।

একিরে বাবা! এ ব্যাটা তো খেতেও পারেনা। ওই দেখো, ওর মা টা তো সব খেয়েই নিলো। আর বোকাটা গুঁড়ো গুলো খাচ্ছে। মা কুকুরটার পেটে মনে হয় এক কুয়ো সমান খিদে। যা তুইই খা।
আরে রোদটার একটু গায়ে গত্তি লেগেছে , বুড়োটার জামা থেকে কুয়াশা গলে চাএর ভাঁড়ে পড়ছে....

Sunday, November 18, 2018

গুঁড়ো গুঁড়ো রঙ

সারি সারি একইরকম মুখ দেখতে বাকিদের কিরকম লাগে আমি জানিনা, আমার ভারী খারাপ লাগে। এই কারনে, আমি শাটলে যেতে খারাপবাসি, দুপুরে একা খেতে চাই৷ কিন্তু এমন কপাল, বেশীরভাগ দিনই আমার পাশের কিংবা সামনের চেয়ার গুলো আমার চেনা কারোর চোখে পড়ে যায়। চেনা মানে রোজই, "তুমি কোথায় থাকো" টাইপ চেনা, আরো সরেস হয় ম্যানেজার সুলভ কাউকে দেখলে! তাদের এড়িয়ে অন্য জায়গা বসাও মুশকিল আবার তাদের সাথে বসাও.... কত কাঁহা তক, শেয়ার বাজার, ক্লাউড, ডিজিটাল মার্কেট, ইত্যাদির আলোচনা শোনা যায়! 
শাটলে উঠলেও দেখি, অভিব্যক্তিহীন কতকগুলো অবয়ব, চোখ বোঝা,কানে হেডফোন বা হাতের মোবাইলে চোখ! অথবা, কিচ্ছু না করে কেমন উৎসাহহীন চোখে তাকিয়ে, কিছুই চোখে পড়ছে না তাদের বোঝাই যায়, তা সে চোখ যতই বাইরের দিকে মেলে থাক। আমি মানছি রোজ রোজ অফসে ইন্টারেস্টিং কিছুই থাকে না, উৎসাহ নিয়ে আমি নিজেও অফিস যাই না। কিন্তু অফিসের বাইরের সময়টাও যে অফিসের জন্যই বয়ে যাচ্ছে!
যাকগে তার সময় তার চোখ তার জিভ...আমি এত পরিপাটি ভীড়ে ক্লান্ত হয়ে একা একা চা খেতে গেছি সেদিন, বিশুর দোকানে এ সময়টা একটু ফাঁকা। বিস্কুট ডিস্ট্রিবিউটর ছেলেটা খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে দোকানে দোকানে, বৌদির দোকানে এসে ফলওয়ালার নামে নালিশ করছে কচুরির দোকানের লোকটা। একইরকম লোক সেই, পাঁচিলের এপাড়ে আর ওপাড়ে, শুনতে চাইনা তাও কত কথা কানে এসেই যায়, এতো আনইন্টারেস্টিং, মনেও থাকে না। ক্লান্ত হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, হুট করে দেখি আমার বুক পকেটে কী একটা পড়লো!

শিরীষ গাছটা থেকে, একটা হলুদ রঙের ফুল, পাতা টাতা ঝরিয়ে, সে ব্যাটা এখন সন্ন্যাসী হচ্ছে, তারই মাঝে একটা হলুদ ছোট্ট ফুল, আমায় দিয়েছে, গিফট। বেশ কাকা বেশ, থ্যাংক ইউ। আমি যত্ন করে বুক পকেটটা সামলে আপিস ঢুকলাম ফের।

মেট্রোয় বসে আছি ঠ্যাঙ মেলে। তেমন ভীড় নেই, দুপুরের মেট্রো। এক সার অর্ধমৃত লোক বসে, হেডফোন গুঁজে, ফোনের দিকে তাকিয়ে, চোখ মেলে কিন্তু মরা মাছের চোখের মত তাকিয়ে...এরই মাঝে দেখি একটা মোটামুটি মলিন জামা পরা, একটা দাঁত নেই, বিস্মিত চোখে মেট্রোর স্টপেজ লেখা আলো জ্বলা বোর্ডটা দেখছে। প্রতিটা সবুজ থেকে নীল হয়ে লাল এর জার্ণিটা দেখছে আর খুশীতে একশো আলো জ্বলে উঠছে চোখে, ছেলেকে ডেকেও দেখালো একবার। ছেলে দেখলো বটে, তেমন আনন্দ পেলো না, কারনটাও বুঝিয়ে গেলো, হ্যাঁ এরকমই তো হবে! 
বাবা একটু অপ্রতিভ হলো বটে, কিন্তু বিস্ময়টা গেল না। দেখতে দেখতে আমার স্টপেজ এসে গেল। আগের দিনের গেঞ্জিটাই পরেছিলাম। পাশ দিয়ে যাবার সময়, বিস্ময় না মরে যাওয়া একটা লোককে ভাবলাম আমার কালকের গিফটটা দিয়ে যাই, পকেটে হাত দিয়ে দেখি সে গিপ্ট কখন পড়ে গেছে কোথায়!

আরো অজস্র উপহারের মত এ উপহারটাও হারিয়ে গেছে কখন। হলুদ ফুলটায় কী লেখা ছিলো কে জানে, আর জানার কোনো উপায়ও রইলো না! 
ময়দানে তখন সূর্য ডুবছে, একটা একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে দেখছে, প্রেমিক প্রেমিকাদের উত্যক্ত করা চা ওলা কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, যত্রতত্র পাপড়ি চাট খেয়ে ময়দানটাকে ডাস্টবিন বানানো লোকজন কেমন ময়দানের ঘাস গুলো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে।

তার মধ্যেই একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখছিলো, কেমন করে মানুষগুলো আবছা হয়ে আসছে, গাছে গাছে পাখিগুলো সন্ধ্যেবেলার আসর বসাতে শুরু করছে....
আমার হাতের মুঠো থেকে মেট্রোয় পাওয়া বিস্ময়টা বুড়োর মুখে ঢেলে দিলাম। আমার কাছে থাকলে ফের হারিয়ে যাবে হয়ত, তার আগেই বুড়ো র কাছে জমা থাক। যদি কেউ আসে কোনোদিন নিতে...কিংবা একদিন রাতে হয়তো শ্বাস ছাড়ার সাথে উড়িয়ে দেবে, আর পরদিন কোলকাতার সবার মধ্যে রেনুর মতো বিস্ময় গুঁড়ো মিশে মিশে যাবে....


Thursday, November 1, 2018

সাপব্যাঙ গল্প


"কই একটু চা দেখি, চা খেয়ে ছেলেটার জন্যে একটা ইঁদুর ধরে আনি।"

  - পারবো না যাও তো। সারাদিন খেটে খেটে আমার খোলস ছেড়ে গেলো এই গরমকালেই। সারাদিন জ্বালাতন। এই চা দাও রে, এই ব্যাঙের রোস্ট করে দাও রে, এই একটু পোকা ভাজা দাও রে। কেন যে মরতে তোমায় বিয়ে করেছিলাম, জীবনটা শেষ হয়ে গেলো!

 ত্রিভঙ্গ বাবু, ওনার স্ত্রী আঁকাচোরা দেবী আর ওনাদের ছেলে ক্রিসক্রশ, ছোট্ট সাপ পরিবার, একসাথে একটা নরম গরম গর্তে থাকেন। শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। সকালে একটু চা বিস্কুট খেয়ে খোকা কুশুকে পোকা ধরা,  নেতিয়ে পড়ে থাকা, গাছ বাওয়া,  ছোটা এসব শেখান। বেশী না ওই অল্প আধটু। তারপর বেরোন পোকা ব্যাঙ বা ইঁদুর ধরতে। বলতে নেই, আঁকাচোরা দেবীর রান্নার হাত থুড়ি লেজ ভালো বড়। আজকাল ওনার একটু ভুঁড়ি মতো হয়েছে।

মাথার উপরের খড়ম ছাপটা একটু চুলকে নিয়ে কালো লেজে ঠেস দিয়ে বসে ত্রিভঙ্গ বাবু বললেন," আহা রাগ করছ কেন।থাক থাক,  আচ্ছা কই আমার বাজারের থলেটা দাও। কই রে কুশু, আজ কি পোকা খাবি? "
রান্নাঘর থেকে আঁকাচোরা বেরিয়ে এলো, "কবে এমন হয়েছে যে চা পাওনি, অত কেত নেওয়ার কি হ্যাঁ, চা বসিয়েছি, চা খেয়ে বাজার যাও।"

চা খেয়ে ত্রিভঙ্গ,  ছেলেকে নিয়ে বেরোলো। গরমকালটাই যা ফূর্তির কাল, ছেলেকে নিয়ে আজ সাঁতার কাটতে যাবে। আঁকাচোরাও আসবে খানিক পরে। ছেলেটা হয়েছে অন্যরকম,  ওর বয়সী সব সাপ যখন পাখির ডিম জোগাড় করে আনে ও তখন লেজ বাজিয়ে গান গায়। ত্রিভঙ্গর সমস্যা হলো, ছেলেকে ও বেজায় ভালোবাসে। এতোদিনে অন্য সাপ হলে গর্ত থেকে দূর করে দিতো, কিন্তু কুশু মানুষের রক্ত দিয়ে নেশা করেনা, পাখির ডিমের খোলা পুড়িয়ে নেশাও নেই, খালি নিজের মনে থাকে বলেই দূর করা যায়!

ত্রিভঙ্গরা যেখানে থাকে আশেপাশে সাপ নেই তেমন, বিপদে আপদে ডাক্তার বদ্যির দরকার হলে তারা তিন গাছের ছায়া পেরিয়ে যায়। ওখানে একটা ভাঙা বাড়িতে বদ্যি সাপ থাকে। আশেপাশে আরো অনেকেই থাকে। বেশ পশ এলাকা, শুকনো খটখটে। আসলে ত্রিভঙ্গ নিজেও একটু অন্যরকম, তাই হয়তো পশ এলাকায় আস্তানা মেলেনি।তবে ত্রিভঙ্গ নিজের মতো করে ভালোই আছে। রবিবার করে ভালো পাখির ডিম কিংবা ব্যাঙ পেলে আর নদীতে সাঁতার কাটতে পেলে খারাপ থাকারও কারন নেই খুব কিছু। সাধারণত জলের সাপদের একটু নীচু চোখেই দেখা হয়। কিন্তু ত্রিভঙ্গের এসবে খুব কিছু এসে যায় না, আঁকাচোরারও না। আঁকাচোরাও ভারী ভালো মেয়ে,   বাদলার দিনে গর্তে জল ঢুকে গেলো, কি কোনোদিন  পিঁপড়ে অব্দি মিলল না,  ত্রিভঙ্গকে ও উত্যক্ত করেনা। নেই তো কী আর করা যাবে,  এরকমই মনোভাব।

সেদিন জলে খানিক দাপাদাপি করে পাথরের উপর শুয়ে জল শুকোচ্ছে তিনজনে। কে বেশী লেজ দিয়ে দাপিয়েছে সে নিয়ে খানিক হাসি তামাশাও হচ্ছে। তারপর ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা গেছে জঙ্গলে একটু ঘুরতে। এটা শুধু ওদের নিজেদের সময় কিনা,  কুশুকে নিয়ে যায় না সাথে, আর কুশুও বোকা মানুষের বাচ্ছা না যে চ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে সব জায়গায় বাপ মা এর সাথে যাবে বলে!

শুয়ে শুয়ে একটা নতুন সুর ধরার চেষ্টা করছে কুশু, গাছের সাথে হাওয়ার কথা বলার শব্দটা যদি সুরে ধরা যায়, তার সাথে নদীর মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট করলে জমে যাবে না ব্যাপারটা? কুশুর গলায় সুর টুর নেই তেমন, তাই একা একা থাকলেই সে গান গায়। এই করেই তার বন্ধু বান্ধবও কম। একে মূল শহরের থেকে দূরে থাকে, তায় রোগাটে ছোটখাটো চেহারা, তায় আসর জমাতে পারেনা বন্ধু হবে কেমন করে? বন্ধু তো হয় খেলার মাঠে না হলে শিকার করতে গিয়ে রাস্তায়। পাখির ডিম বা ইঁদুর সে বেশীর ভাগ সময়পারে না ধরতে, ছড়িয়ে লাট করে ফেলে, লজ্জায় সে বাকিদের থেকে আড়ালে শিকার করার চেষ্টা করে। আর নিজেকে সঙ্গ দিতে গান শোনায়। গান গাইতে তার ভালো লাগে এদিকে সুর নেই বলে তার ধারনা। যদিও সে ধারনা ভুল। গান বাজনা সে ভালোই করে।

গান গাইতে গাইতে খেয়াল ছিলোনা আশেপাশে কি হচ্ছে,হটাৎ দেখে, পাশের পাথরেই একটা কালোকোলা ব্যাঙ যে!!ব্যাঙটাও ভারী ভ্যাবলা তো! দেখছিস পাশে সাপ বসে আছে, তুই কি বলে তার গান শুনতে এসেছিস!! শুধু তাই না, আস্পদ্দা দেখো একবার, ব্যাঙটা সাপের দিকে তাকিয়ে বলে কিনা, "আহা থামলে কেন, সুরটা তো প্রায় ধরে ফেলেইছিলে, আরেকটু হলেও বোঝা যেত গাছেদের গান!

কুশু হতভম্ব হয়ে বলল," হ্যাঁ আসলে ওই মনটা একটু সরে গেলো, ব্যাস সুরটাও পাশ কাটিয়ে গেলো। কিন্তু তুমি মানে তোমার ভয় করছে না? "

-ভয় করবে কেন হে খোকা!! তোমার থেকে বয়সে বড় কিনা আমি অত তোমার মতো ভয় পাই না।  এই তো কাল রাতে হিসি পেলো, একাই একাই কাজ সেরে এলাম। তুমি নির্ঘাত এখনো, মাকে ডেকে নিয়ে যাও? খ্যা খ্যা গ্যাঙোর গ্যাঙা গ্যাঙ।

- আহ থামো তুমি। আমি মোটেও মাকে ডাকিনা। আমি রাতে উঠিইনা। এই তো মা বাবা  মিলে জঙ্গলে গেছে, আমি কি ভয় পাচ্ছি?

- হুঁ তা অবশ্য পাওনি বটে।

-তবে? ভয় পাচ্ছোনা কেন এই কারনেই জিজ্ঞেস করছি, তুমি ব্যাঙ আমি সাপ, কপ করে খেয়ে নিলে কি করবে হ্যাঁ?

- ওহো! এই জন্যে! দূর! ওতে ভয় পাবার কি! তুমি খেতে এলে আমিও ফাইট দেবো! তারপর না হয় মরেই যাবো। এতো ভেবে লাভ আছে নাকি! আজই তো একটা পোকা খেতে গিয়ে একটা বিষ মাকড়সার কামড় খাচ্ছিলাম প্রায়, আরেকটু হলেই প্যারালাইসিস  হয়ে যেত। তাহলে আর ভয় করে কি করবো হে, তার চেয়ে বরং ফূর্তিতে কাটাই যটা দিন পাই।
তা মারবে নাকি?  হবে নাকি ফাইট?

- ইয়ে না মানে আমার আর তোমায় মারতে ইচ্ছে করছে না। বলছি চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক নাকি?

-আরে! বলো কি নন্দলাল! বন্ধু মিলে গেলো সুরের সাথে? এ যে বড় ভালো ব্যাপার হলো।  তোমার মনটা বেশ তো। চলো, আমিই খাওয়াবো কফি, তা নাম কি তোমার?

- আমার নাম ক্রিসক্রশ, ডাক নাম কুশু। তোমার নাম কি? তুমিও গান গাও মনে হচ্ছে। কফি খেতে খেতে একটা গান শোনাও না?

- আমার ভাই একটাই নাম, ভালো নাম ডাক নাম সব একটা। ঘাপুস। হবে হবে, গান তো হবেই।

তারপর তারা দু মক্কেলে কফি খেয়ে আড্ডা দিয়ে গান গেয়ে,  যখন আইস্ক্রীম খাচ্ছে,  কুশু দেখে ওর বাপ মা ফিরছে। ওদিকে অন্ধকার নামলো বলে। কুশু মহা বিপদে পড়েছে, ঘাপুসকে কোথায় লুকোবে? পালিয়ে গিয়েও লাভ হবে না, ঘাপুসের থাকাটা ওরা টের পেয়েছে তো বটেই।

"বুঝলি ঘাপুস, পালিয়ে না গিয়ে,  চল ফেস করি, আমার বন্ধুকে আমি মরতে দেবো না। তাছাড়া বাবা মা ভালো, ঠিক বুঝবে।"

ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা এসে পড়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে একবার ঘুপুসকে দেখেই, আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কুশু তাড়াতাড়ি আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, "বাবা, প্লিজ ওকে মেরো না। ও আমার বন্ধু। ঘুপুস নাম ওর। দারুন ভালো গান গায়।"

ত্রিভঙ্গবাবু তো অবাক! "বন্ধু!! সে আবার কি কথা! খাদ্য খাদক কখনো বন্ধু হয় নাকি! "

- তা হয়না। কিন্তু  ঘাপুস তো আমার খাদ্য না৷

-ঘুপুস না হোক, ওর বাপ মা ভাই বেরাদর তারা তো আমাদের খাদ্য?

 -বেশ,আমি আজ থেকে ব্যাঙ খাওয়া ছেড়ে দিলাম।

- আরে সে কি কথা! প্রোটিন পাবি কোত্থেকে তাহলে? গায়ে জোর হবে কি করে? খাবি কি?

- সে না হয় আমি পোকা খেয়ে চালাবো। আর ইয়ে বাবা,  আমি ভাবছি,  ধান আর ডাল চাষ করবো। ভাত ডাল খেলেই গায়ে জোর হবে, কার্বস, প্রোটিন দুইই পাবো।

শুনে তো আঁকাচোরা আর ত্রিভঙ্গ মুচ্ছো যায় প্রায়!  আঁকাচোরা গালে লেজ দিয়ে অবাক হয়ে বলে, "ওরে,  সে তো মানুষের কাজ!  কোনোদিন শুনেছিস সাপে চাষ করে? বেকার অত খাটবি যদি আনন্দ করবি কখন? "

কুশু বলে, "কেউ করেনি তো কি? আমরা করি। তাছাড়া আমরা কি জমাব নাকি, একটু করে চাষ করে খেয়ে নেবো ব্যাস।তারপর তো শীতকাল চলেই আসবে। আর একদম কিছু না হলে, ইঁদুরকে বলবো, ওকে খাবোনা বদলে চাল ডাল দিক। ব্যাস।"
ঘাপুস এতোক্ষন চুপ ছিলো, এবার সে বলল, খারাপ আইডিয়া না কিন্তু কাকু, চলো ট্রাই নিয়ে দেখাই যাক না? কি বলো? না পোষালে তো আমি রইলামই,  খেয়ে নিও।

ত্রিভঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলল, " থাক,  ছেলের বন্ধুকে খাবো এমন উচ্ছন্নেও যাই নি আমরা।রাত হচ্ছে, চলো সব ঘরে যাই, তুমি যাও বাড়ি আজ। কাল বাকি কথা হবে।"

ঘাপুস গ্যাঙোর গ্যাঙা করে হেসে বলে, "ও কাকু, বাড়ি থেকে তো চলে এসেছি। আমি এখন বড় হয়েছি কিনা,  তাই দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, এমন সময় কুশুর সাথে দেখা।"

আঁকাচোরা এগিয়ে এসে বললেন, "উদ্ধার করেছ, এই টুকু বয়স বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন! চল ঘরে চল। রাতে পোকা টোকা যা আছে খেয়ে উদ্ধার করো।

অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষনে। নদীর জলে সূর্যের লাল আভাটা মিলিয়ে গেছে। এক ঝাঁক পাখি সারাদিনের কথা বার্তা সারছে গাছে। কে কোথায় কী দেখেছে, কী খেয়েছে এসব।মাছেদের দল ঘুমাবার জন্য বিছানা খুঁজছে শ্যাওলার ফাঁকে।চারজনের দলটা গর্তে ফিরে গেলো।

ত্রিভঙ্গ বাবুরও এখন চাষবাসে মন হয়েছ।

Sunday, October 28, 2018

বাড়িটার গল্প

সে এক পাড়া। এককালে সব একই পরিবারের ছিলো, ক্রমে লোক বাড়ে, খুড়তুতো থেকে জ্ঞাতি হয়, তারপর পাড়ার লোক। দু ভাই এ হয়তো দু যুগ কথা নেই, তাদের ছেলেরা দশমীর কোলাকুলি করে। তো সেরকম এক পাড়ার গল্প। 

বাড়িটা পাড়ার এক কোনে, এটাই আসলে শুরুর বাড়ি। তারপর যা হয় ছানা পোনা আন্ডা বাচ্ছা বাড়তে থাকে, নতুন বাড়ি হয়ে, ছেলে মেয়েরা এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ে, বাড়িটার বয়স বাড়ে, বৃদ্ধ হয়।

বুড়ো হলে হরেক জ্বালা, এই আজ এখানে চুন সুরকির দেওয়াল ভেঙে পড়ছে, ওই কাল কড়িকাঠের পাশ থেকে ঘুন পোকার আওয়াজ আসছে। তা এতো ডাক্তার বদ্যি আর কে করে, সকলেরই নিজের ঘর হয়ে গেছে, বাড়িটা আস্তে আস্তে অথর্ব হয়েএ শয্যা নেওয়া ভাঙা বাড়ি হয়ে পড়ে। তার ছাদ ভেঙে পড়ে, দেওয়া ধ্বসে যায়। মানুষরা না থাকলে কি হবে, বাড়ির মধ্যে নতুন নতুন আগন্তুক জুটে যায় ঠিকই। মৌমাছি বোলতা চাক বানায়, ইঁদূর ছুঁচোয় ফুটবল খেলে, ঘর গেরস্থালী পাতায়। বাড়িটা দেখে। আজকাল সে নির্লিপ্ত হয়ে গেছে, এক জীবনে কম দেখা হয়নি তো তার। কিন্তু বাড়ির বর্তমান বাসিন্দাদের এ নির্লিপ্তিতে আপত্তি আছে খুব। তারা খুব চেষ্টা করে বাড়িটার সাথে গল্প করতে, যদি একটু হেসে ওঠে তাদের সাথে।

এমন সময় এক চড়াই দম্পতি এলো সে বাড়ির ঘুলঘুলিতে। কর্তা চড়াইটা একটু ছোট খাটো আর  গিন্নী চড়াইটা একটু মোটাসোটা। সবে বিয়ে হয়েছে তাদের। বিয়ের পর চড়াইরা মা বাবার সাথে থাকেনা, আলাদা সংসার পাত্তেই হবে, আর আজকাল থাকার জায়গার দাম খুব বেড়ে গেছে। মানুষেরা ঘুলঘুলি রাখেনা, গাছ কেটে দেয়। সব অগ্নিমূল্য তাই। কর্তা চড়াইটা সারাক্ষন গান গাইছে শিস দিয়ে নইলে খাই খাই করছে নইলে চেঁচাচ্ছে এমনি এমনি মোট কথা বাড়িতে হুলুস্থুল ফেলেছে একটা। সে বোলতার সাথে আলাপ করে দিব্যি রোজ বিকেলের স্ন্যাক্স হিসেবে পোকা জোগাড় করে ফেলেছে, মোমাছির সাথে মান্থলি মধুর জোগান নিয়েছে, গিন্নীর আবার মধু না হলে রুটি খেতে অসুবিধে হয়।  ইঁদুরের পিঠে চেপে সেদিন বাড়িটার গায়ে গজিয়ে ওঠা বটের কোটরে ঢুঁ মেরে এসেছে। এসব করে টরে, তার নজরে পড়েছে বাড়িখানা। 

চড়াই এর জন্যে বাড়িটায় বেশ একটা সাড়া পড়েছে আগেই বলেছি। বাড়িটা নিজের দুঃখ ঝেড়ে একটু একটু করে জেগে উঠছিলো। তাছাড়া উপায়ই বা কি, চড়াই এর জ্বালাতন কম নাকি! এতো হুড়ুমদুড়ুম করে চুপ করে থাকাই মুশকিল।  সেই কোনকালে, যখন বাড়ির বউ গুলো কাজ সেরে বিকেল বেলা চুল বাঁধতে বসতো তার ভিতরের রকে, আর গল্প তামাশায় হেসে উঠতো তখন যেমন বাড়িটা প্রশ্রয়ের হাসি হাসতো এখনও তো মৌমাছি আর বোলতার গুনগুনে তেমনই প্রশ্রয় আসে। সত্যি বলতে, গরমের দুপুরে জানলা দরজা বন্ধ করে একতলার ঘরে গার্হস্থের শান্তির ঘুমের ছোঁয়া, কিংবা উৎসবের দিনের মেয়ে বউদের আড্ডায়, কিংবা টিমটিমে আলোর সন্ধ্যেবেলার নির্জন রেডিওর খবরের আওয়াজে যেমন বাড়িটা বুঝতো নিজেকে তেমনই এই চড়াই, ইঁদুর, বোলতা, মৌমাছি কিংবা ওই ভাঙা দেওয়ালের নীচে শুয়ে থাকা সাপেদের মাঝেও তো নিজেকে পায়। অন্য ভাবেই হোক না। মানুষগুলোর চোখে সে অশতিপর বৃদ্ধ, যাকে দিয়ে আর কিছুই হবে না, প্রায় মৃতই কিন্তু এদের চোখে বেঁচে আছে তো দিব্যি। 

এই ট্রানফরমেশনটা হয়েই বড় সুখে আছে বাড়িটা।   জানলায় নতুন গজানো বটের চারাটাকে আতা গাছ টার গল্প শোনায়, এই বাড়িরই দক্ষিনের ঘরের জানলার ঠিক পাশেই ছিলো। ভারী বন্ধু ছিলো... তারপর একদিন মরে গেলো না মেরে দিলো মনে পড়ে না আজ আর। তারপর সেই তেঁতুল গাছটা, হনুমানে এসে লম্ফঝম্প করতো ফলের সময়ে, জামরুল গাছটা, ভারী নরম স্বভাবের ছিলো অল্প বয়সে। এখন না হয় খানিক বয়স হয়ে গম্ভীর হয়েছে। আর ছিল একটা জাম গাছ, উত্তর দিকে, খস খস আওয়াজে কত কথা শোনাতো। সে সব কথা বলার নয়ও। 

একটা একটা করে পুরাতন ইঁট ভাঙে, পুরোনো পাঁজরা খসিয়ে বাড়িটা একটা একটা করে নতুন কাউকে থাকতে দেয়...আশ্রয় দিতে সে অঙ্গীকারবদ্ধ, মানু্ষ হোক কি গাছ, সাপ হোক কি ইঁদুর.....ফিসফিসিয়ে গল্প বলে নতুনদের হাসতে হাসতে চুন চুরকি খসিয়ে ফেলে তবু বাড়িটা বেশ দিব্যি আছে কিন্তু।

Friday, October 26, 2018

কোজাগরী

আমাদের বাড়িতে, মানে গ্রামের বাড়িতে, লক্ষ্মী পুজো হতো যখন ভারী মন কেমন করতো। এ কেমন পুজো, আওয়াজ নেই, রোশনাই নেই, দুগগা পুজোয় আসা একগাদা আত্মীয়দের কেউই প্রায় নেই!

আমাদের ঠাকুর হয়, হাতির পিঠে, হাতে ধানের ছড়া নিয়ে। ঠাকুরদালানের চত্বরের অংশটা ছাড়া আর আলো বলতে চাঁদ। ছোট বেলায় চাঁদের আলো অত কিছু আনন্দ দিতো না, হিম পড়া শুরু হয়ে যায়, মা মাথা ঢাকা দিতে বলে। এখানে মানে ঠাকুরদালানে, পুজো হলে মা আরেকটা পুজো করে, ঘরেতে। দোতলার মস্ত ঘরের মধ্যেই মস্ত ঘেরা বারান্দা, একা একা সেই বারান্দা পেরোতে ভয় করে, সেই খানে চৌকি পেতে, সিংহাসনে মায়ের সব ঠাকুরেরা থাকতো। সত্যনারায়নের সিন্নি ছাড়া বাকিদের মধ্যে লক্ষ্মীর কথা মনে আছে। দিদিরা আলপনা দিয়ে দিতো সুন্দর করে, মা নিজে নিজেই পুজো করতো। আমি একটু বড় হতে ভোগটা বানাতাম। আজ আমাদের বাড়িতে শুকনো খাবার মানে ভাত/খিচুড়ি জাতীয় কিছু হয় না, তাই আমি চিঁড়েতে ডাবের জল, গুড়, মুড়কি, নারকেল কুড়ো এইসব দিয়ে কাঁসার বড় জামবাটিতে ভোগ বানিয়ে দিতাম।

মা পাঁচালী পড়তো কিনা মনে পড়ছেনা, তবে কোজাগরী মানে বলে দিয়েছিলো মনে আছে দিব্যি। আমি মায়ের কাছে বসে বসে শুনতাম, একটা সাদা প্যাঁচায় চেপে লক্ষ্মী ঠাকুর আসবে রাত্রে বেলা, কে জাগে দেখবে, অশান্তি হওয়া ঘর এড়িয়ে শান্ত শিষ্ট ঘরে। আমি দক্ষিণের বারান্দার ঘুলঘুলিতে(পায়রাদের বসার জন্য বানানো হয়েছিল) , নাক লাগিয়ে কুয়াশা মাখা ধোঁয়া ধোঁয়া মাঠে চাঁদের আলোয় খুঁজতাম কোথায় সেই প্যাঁচাটা.....

আজ অফিস থেকে ফেরার পথে দেখছি আলোয় ঝলমলে শহরে কোজাগরি চাঁদের এন্ট্রিই নেই তো প্যাঁচার! হঠাৎ করে মন খারাপ হলো, একটা মেয়ে যেন তার পরিচিত জায়গায় টাইম ট্রাভেল করে অন্য সময়ে গিয়ে পড়েছে কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না.....আহারে। আজ সারারাত হয়তো এই হিম মাথায়, চাঁদের আলোর রাস্তা খুঁজে ফিরবে, কে জেগে আছে কে জানে!

Sunday, October 21, 2018

পুজোর গল্প

এবারে পুজোয় কোলকাতায় থাকতে হয়েছিলো বেশীর ভাগ দিন। দশমীতে গিয়েছিলাম খালি । সেসব নিয়েই গল্প খানিক।

*****************************************************************************

পঞ্চমী

"পঞ্চমীতে কি করছিস? অনেক দিন দেখা হয়না, চলে আয় নরক গুলজার করি"। উস্তুম খুস্তুম আড্ডা, মাটন বিরিয়ানি, মিষ্টি খেয়ে ল্যাদ ট্যাদ খেয়ে বিকেলে নেহাত যখনই গা তুলতে হলো ভাবলুম একটু ঘুরে দেখি। ঋকানন্দের সফরনামা চালু না হলে আর চলে নাকি! 
বন্ধুবান্ধব ছাড়া একা একাই বেরিয়েছিলা। সল্টলেক জায়গাটা আমার ভারী ভাল্লাগে, গাছপালা, ঝকঝকে রাস্তা নিয়ে কেমন চুপ করে বসে থাকে।

একা একা একটু তফাতে থেকে উৎসব দেখতে আমার দিব্যি লাগে। এই যে বাবা মা ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তার দোকানের প্লাস্টিকের চেয়ারে তরিবত করে চাউমিন খাচ্ছে, ওই যে একটা বাবা তার ছেলের হাত ধরে আসছে, ছেলে বলছে, "বাবা, ঠাকুর আমার দিকেই চেয়েছিলো না?" একটা বাচ্ছা ছেলে তার পসরা সাজিয়ে বসেছে, বেলুন, ক্রাউন, শিং। শিংটা সে নিজেই একটা পরে নিয়েছে। হাফপ্যান্টুল, খালি গায়ে লাল শিং, চমৎকার লাগছে। আমার একটা ক্যাপ বন্দুক কিনতে ইচ্ছে করছিলো। নাহ থাক! ঋকানন্দ জানে সব ইচ্ছের জিনিস পেতে নেই....

আইস্ক্রীম, চিকেন, রোল, পান, বিরিয়ানি, ফুচকা কি যে নেই। ডাইনোসর পেরিয়ে তবে দুগগা ঠাকুর, হুঁ হুঁ বাওয়া, এ মোটেও গৌরি না, যে বাপের বাড়ি এসেছে, উনি হলেন ডাইনোসর মর্দিনী। বাচ্ছা গুলো ডাইনোদের ভয় দেখাচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে, যেমন আমরা দেখাই না ফেসবুকে? অমনি।

উল্টোডাঙায় ফলওয়ালা আর সব্জিওয়ালার পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হলো যেন পুজো এসেছে বলে কিছু নেইই, আশেপাশে যা হচ্ছে বেবাক ইগ্নোর করে নিজেদের মধ্যে বাজার নিয়ে আলোচনা চলছে। একটা ঘেয়ো কুকুর গজিয়ে ওঠা চাউমিন সেন্টারের পাশে শুয়েছিলো, তার অবশ্য পুজো দিব্যি রোল চাউমিনে চলছে। তেলেঙ্গাবাগানে এরা এটা কি করতে চেয়েছে হ্যাঁ? আমি আবার গোদা মানুষ তো, এমনিতেই ছোট হাত বড় মুখ দুর্গামূর্তি বুঝিনা, তায় থিম গুলো তো আধুনিক কবিতার মতোই দুর্বোধ্য ঠেকে।

হাঁটতে হাঁটতে সেল্ফি ভীড়ে ক্লান্ত লাগে...ঝপাং করে একটা অটোয় উঠেছি, দুটো সিট ফাঁকা এখনো তাও অটো দাঁড়াচ্ছেনা কোথাও। জ্যাম নিয়ে অটোওলাও বিরক্ত হয়ে পড়েছে, 'ছুটি নেবে কবে ঠাকুর দেখতে?' 'অষ্টমী নবমী তো যেতেই হবে ভাই, বউ ছেলেটার পুজো আর নষ্ট করা যায়! লোকসান হবে, হোগগে, বচ্ছরকার দিন, কি বলো হ্যাঁ?' মাঝ রাস্তায় একটা ছেলে হাঁইমাই করে অটো থামালো, তাকিয়ে দেখি তার গার্ল্ফ্রেন্ড রাস্তার ধারে একটা ল্যাম্পপোষ্টের নীচে বসে পড়েছে, নির্ঘাত নতুন জুতোয় ফোস্কা! 
অটোয় উঠে শুনতে পাই বলছে, 'খুব কষ্ট হচ্ছে না রে? আসলে বুঝতে পারিনি এতোটা হাঁটা রে....সরি'।
মেয়েটার গলা ভেসে আসে, 'আহ সরি কেন....গাধা কোথাকার'। 
ফিক করে হাসলো কিনা দেখিনি অবশ্য।

আরো নতুন পুরোনো গল্প তৈরী হোক পুজোয়, আনন্দে, ভালোবাসায়....


*************************************************************************
ষষ্ঠী

উফফ এই ফোনের আর ডিএসেলার ক্যামেরা! সারাক্ষন দুমদাম দাঁড়িয়ে ভীড় বাড়াচ্ছে!প্যান্ডেলগুলোয় ঠাসাঠাসি ভীড়ে, যাদেরই ফোন/ক্যামেরা নিয়ে দুর্গার/থিমের/নিজের/ফুলপিসির/নরেনকাকার/খেন্তিসোনার ছবি তুলতে দেখেছি হাত নাড়িয়ে দিয়েছি....


***************************************************************************
সপ্তমী

পাড়ার প্যান্ডেলে এতক্ষন "চিতাতেই সব শেষ চলছিলো" --- সপ্তমীর রাতের উপযুক্ত গানই বটে!

ও হ্যাঁ সকালে চলছিলো, "পালকিতে বউ চলে যায়, হায় রে শরমে মন ভরে যায়" -- এ গানটার তাৎপর্য কি? মানে পালকিতে বউ গেলে শরমে মন ভরবে কেন? বউ দেখে লজ্জা? ভাগ্যিস গানটা পুরুষ কন্ঠে না, তাহলে ফুলশয্যায় তো বিরাট চাপ ছিলো!


কিংবা ওই উপরোক্ত চিতাতেই সব শেষ কি শরমে জর্জরিত হয়ে হতাশার ফুলশয্যার পরের দিনের গান?

******************************************************************************
অষ্টমী

লুচিতে ডুবে ছিলাম কিনা তাই বিকেলের পঁচানব্বই এর পল্লীর পাঁচ মাইল হাঁটাও মাফ করে দিয়েছি।
তবে সন্ধি পুজো নিয়ে একটা ভাবনা মনে এসেছিলো ঃ
মাঝরাত পেরিয়ে গাল্ফেন এর বাড়ির দোরগোড়ায় হতে পারে শ্বশুর এর সাথে দেখা হওয়াকেই সন্ধিক্ষন বলা হয়ে থাকে!

তারপর উভয়েই উভয়ের দিকে তাকিয়ে(এই উভয় মাল্টিপল, গাল্ফেন এর সাথে এক দফা ও হতে পারে শ্বশুরের সাথে এক দফা), ফ্যাকাশে হাসির ক্ষনটিই সন্ধিপুজো!

ব্যাকগ্রাউন্ড দামামা ধ্বনি--- তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরন যাত্রা যেদিইইইইন যাবে


*******************************************************************************
নবমী

একা একা কোলকাতায় পুজো কাটবে বলে মন খারাপ করেছিলাম পুজোর আগে। তা সাধক মানুষের কি আর লোকের অভাব হয়, কেউ না হলেই নিজেই নিজের জন্য জুটে যায়। কাল অব্দি টই টই করে, খেয়ে, আড্ডা মেরে এমন অবস্থা আজ এক বন্ধুর বাড়ি মাটনের নিমন্ত্রণ ইগ্নোর করে দুপুরে ঘরে ঘুমাবো ঠিক করেছি।

এদিকে সকাল থেকেই মন খারাপ বেজায়। গ্রামের বাড়িতে আজ মাছ ধরতে আসে সকালে, অষ্টমীর লুচি খেয়ে আপোষ করেছি বলে মা তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্টেই মাছ ভেজে দেবে। তার আগে নবমীর চিঁড়ে ভোগ প্রসাদ। তারপর মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়াবো, সাইকেল নিয়ে কিংবা পায়ে হেঁটে। আড্ডা। দুপুরে জমিয়ে খেয়ে একটু পুজোবার্ষিকি পড়ব তারপর ফের পালাবো এদিক সেদিক....সেই সন্ধে নামার মুখে বাড়ি আসবো...প্রতিবারেই মা কিংবা জেঠিমা বলবে, 'উহঃ রোদে ঘুরে ঘুরে পুড়ে গেছিস তো'।

এখানে আমি বাজার করে এনে দিলেই মিঠুদি বানিয়ে দিতো হয়তো কিছু, আমি একা আছি বলে ছুটি নেয়নি, কিন্তু ইচ্ছে করেনা....লস্ট চাইল্ডের বাচ্ছাটার মতো না না করতে ইচ্ছে করে খালি। কিন্তু আমি জানি এ ভাবে থাকলে আরো খারাপ লাগবে, বিকেলে বন্ধুর বাড়ি যাবার আগে তাই একটু পাড়া টহল দিতে গেছি।

একটা পুজো মন্ডপে দেখি ঠাকুরটা দিব্যি ভালোমানুষের মতো দেখতে, ভীড়ও নেই। টেবিল ফ্যানের সামনে বসে পড়েছি। ওদিকে কি যেন প্রসাদ দিচ্ছে, চাইবো? নাহ! বাড়িতে কিনা সেধে দিয়ে যায় ধনাদা, বেছে বুছে খেজুর, চিঁড়েভোগ, লুচি,নাড়ু...বেপাড়ায় নবমীর দিন চাইতে বাধে। চুপ করে বসে আছি, দেখি একটা লোক শালপাতার বাটিতে, একটু লুচি,সুজি, চালকলা মাখা দিয়ে গেলো। এরা বুঝি চাল্কলা মাখা খায়? দুধচিঁড়ে না? যাকগে। এও ভারী ভালো খেতে। আরে, শাল্পাতার বাটিতে দুখানা খেজুরও আছে দেখছি!


মনের আনন্দে একটা মশালা ছাঁচ খেতে খেতে বাড়ি এসে শুকতারা পড়ছি...শুভ নবমী। আজকের দিনটাই তো আর পুজো...আনন্দে কাটুক সবার।।

******************************************************************************
দশমী

'রাখাল ছেলে! রাখাল ছেলে! বারেক ফিরে চাও, 
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?' 
'ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ 
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা; 
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া, 
সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা 
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না!' 

-জসীমউদ্দিন







শুভ বিজয়া


Sunday, September 30, 2018

হারিয়ে গিয়ে...

 সেদিন আনমনে হাঁটছিলাম। কলেজ স্ট্রীট যাবো বলে বেরিয়েছি, সীতারাম ঘোষ লেন থেকে ঢোকার পর  কোনদিকে যাচ্ছি খেয়াল না করেই হাঁটছিলাম। রাস্তাগুলো এখানে পরে সারানো হয়েছে, উঁচু হয়েছে আর বাড়িগুলো নীচু হয়ে গেছে। আচ্ছা এইরকম ঝুপসি জানলার একতলার ঘরগুলোয় কারা থাকে? আলো ঢোকে? আরিব্বাস কি চমৎকার একটা বারান্দা, এহে ভেঙে পড়বো পড়বো হয়ে গেছে তো। কেউ সারায় না মনে হয়। 

দুপুর খুব এখন। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়, একটা দুটো ছোট ট্রাক যাচ্ছিলো জিনিসপত্র নিয়ে,  তাদেরও আর দেখা যাচ্ছে না কই। 
এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, এ গলিটা আমি চিনিনা। মানে চিনি হয়তো কিন্তু অচেনা লাগছে খুব। এই রাস্তার ধারে এতো ফাঁক ফাঁকা জায়গা ছিলো বুঝি? বাড়ি গুলোও অতটা পুরোনো না। একটা কাক ডাকছিলো কাছে কোথায়, জল তেষ্টা পেয়েছিল হয়তো, কই সেটাকেও তো আর দেখতে পাচ্ছিনা। একটা নেড়ি কুকুরও নেই কোত্থাও। কোথায় যেন কাঁসি ঘন্টার আওয়াজ। আমার ভারী জল তেষ্টা পেয়েছে। রাস্তায় এর ওর কাছে দরজা ধাক্কিয়ে জল আজ থেকে পনেরো বছর আগে খেতাম ঠিকই, তবে এরকম এখন আর করি না। হঠাৎ করে হোঁচট খেয়েছি জোর। হাঁটুর কাছটা গেলো মনে হয়।

"ওই তো,  ওই তো ছোটকত্তা ফিরেছে।" 

একটা বাড়িতে পুরোনো দিনের পোশাক পরা কিছু লোক। আমি কাউকে চিনতে পারছি না এদের, একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি, অবশ্য এরাও আমায় নিয়ে ব্যস্ত না তেমন, একটা ছোট ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। ওই লোকটা মনে হয় ওর বাবা, গম্ভীর মুখ খুব। আর ওই পিরান পরা বয়স্ক কিন্তু শক্ত চেহারার লোকটা মনে হয় ওর ঠাকুর্দা। ওই খেঁটো ধুতি পরা লোকটা... উমম চাকর মনে হয়। আরো সব লোকজন। আরে পুজোর মন্ডপ দেখছি। দুর্গা পুজো এসময়? এখন তো বৈশাখ মাস! এরা এতো পুরোনো দিনের জামা পরে, ওই দিকে কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে, এক মাথা ঘোমটা টানা। কিরকম গোলমাল লাগছে। সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে নাকি? 

"যাও গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে নাও। এক্ষুনি খ্যামের পুজো শুরু হলো বলে। মা এর জন্যেই আজ কোনো বিপদ আপদ ঘটেনি। যাও। " 

বাপরে কি দাপট। এরা কারা? এদের বাড়িতে এরকম ঢুকে  গেছি চোর টোর ভেবে না মারধর করে! কিন্তু পুজো কেন এসময়? শ্যুটিংই হবে, কিন্তু ক্যামেরা ট্যামেরা কিছু নেই কেন? কিছু বুঝতে পারছিনা। এহে হাঁটুটা কেটে গেছে অনেকখানি! একটু তুলো পেলে ভালো হতো। ভালো ব্যাথা করছে তো হাঁটতে গেলে। একটু বসে যাই এই সিঁড়ির কোনায় একটু। 

"তুমি কে?"

রিনরিনে গলায় কেউ জিজ্ঞেস করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা। আমি তড়িঘড়ি বলতে গেলাম,  'আমি চলে যাচ্ছি, তোমাদের শ্যুটিং এ ঢুকে পড়েছিলাম মনে হয়, আমি দুঃখিত, আসলে পা টা একটু কেটে গেছে কিনা।'

ছেলেটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দেখি। এর পরনেও ধুতি। পুরোনোদিনের কোনো গল্পের শ্যুট হচ্ছে মনে হয়। 

"আমি তোমার কথা ভালো বুঝতে পারছিনা, তুমি বরং এসো আমার সাথে। এদিক দিয়ে এসো, নাহলে কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে"। 

কী মুশকিল, কেন মুশকিল কিছু বুঝলাম না। কোনো বিপজ্জনক কিছু চলছে নাকি? কিন্তু এই ভরদুপুর বেলা,  কোলকাতা শহরে, কলেজ স্ট্রীট চত্বরে আমায় কেউ বিপদে ফেলবেই বা কেন! বাচ্ছাও না, বড়লোকও না। পুরোনো একটা টিশার্ট আর জিন্স,  ওয়ালেটে একশোটা টাকা কিডন্যাপ করতে চাইলেও করবে না কেউ কারন ঘেমে নেয়ে গা থেকে যা খুশবাই ছাড়ছে আমিই চমকে চমকে উঠছি। যাক এতো ভেবে কি করবো আর যাই বরং এর সাথে। 

ছেলেটার পিছন পিছন তিনতলায় এলাম। উত্তর কোলকাতার পুরোনো বাড়ির খড়খড়ি লাগানো জানলা দরজা। এরকম জানলা আমার ভারী ভাল্লাগে।

" তুমি কে? এটা কিরকম পোষাক? তোমার হাতে এইটা কি?"

কিরকম পোষাক মানে? ছেলেটা কি অপ্রকৃতিস্থ?  গোলমাল লাগছে। নিকুচি করেছে হাঁটুর ব্যাথার। বেরোই এখান থেকে। মোবাইলটা চেক করতে গিয়ে দেখলাম সুইচড অফ হয়ে আছে, অন হচ্ছে না।পড়ে গেছিলাম যখন তখনই গেছে মনে হয়।

"আরে তোমার পা অনেকটা কেটে গেছে দেখছি, দাঁড়াও আমি ছাদ থেকে গাঁদা পাতা নিয়ে আসছি। 

গাঁদা পাতা!! এ কে! মানে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?  ডেকে বললাম, 'এই শোনো, তোমার কাছে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?'

" ডেটল কি?"

বারো তেরো বছরের ছেলে ডেটল জানে না! না আগে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার। ওদিকে সে গাঁদা পাতা আনতে গেছে।  তিনতলার একদিকটা ছাদ।  আমি ছাদে গিয়ে পুরো ঘেঁটে গেলাম। আশপাশটা যা দেখছি আর যাই হোক ২০১৮ সালের কোলকাতা শহর না। কিরকম একটা সন্দেহ হলো।

'এই এদিকে এসো জলদি, আজ কত তারিখ? '

কথাবার্তায় যা বুঝলাম আমার তো আক্কেল গুড়ুম!   বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদ, পরিশ্রান্ত, হোঁচট ঠিক কিসে কী হয়েছে আমি জানিনা, কিন্তু আমি সম্ভবত কোনো ওয়ার্ম হোলে পড়ে গেছিলাম। আমি  ২০১৮ সালের বদলে ১৯৩৩ সালের শরৎকালে পৌঁছে গেছি! এদের কাউকে আমি চিনি না, এরা আমার কোনো রিলেটিভ না কিন্তু প্রকৃতির কোন রহস্যে আমি আর আমার চেনা জগতে নেই! ভয় পেলাম, ফিরবো কি করে? আমি যদি এক হাজার বার ওই কাজ গুলো ফের করিও আবার আমার জায়গায় ফিরতেও পারি নাও পারি। না ফেরার সম্ভাবনাই বেশী কারন ওয়ার্ম হোলের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে এতোক্ষনে।

দরদর করে ঘামছিলাম, আমার মুখ চোখ দেখে বুঝি ছেলেটা কিছু আন্দাজ করেছিলো। এর মধ্যে সে আমায় যত্ন করে গাঁদা পাতা এনে লাগিয়ে দিয়েছে। ছেলেটার মুখটা ভারী মায়াবী, চোখ দুটো কেমন যেন এইখানে নেই অন্য কোথাও। ক্রমে আলাপ জমে গেলো। ভালো নাম বলল,  দুলাল, এমনিতে খোকা, ছোটকত্তা এইসব বলেই ডাকে। একমাত্র ছেলে না হলেও, এ বাড়ির ছোট ছেলে বলে কথা।  তবে ওর নাকি এসব ভালো লাগেনা। এইটুকু বয়স কিন্তু বেশ ঝরঝরে পরিনত কথাবার্তা।  বন্ধু বান্ধব নেই বিশেষ। এক তো বড়লোক বাড়ির ছেলে, পড়ে গেলে কেউ তুলে ধরে অবস্থা,  তায় ও নিজেও একটু অন্তর্মুখী। পড়াশোনা করে নানান জিনিস নিয়ে, গাছেদের সাথে ভালো রকম আলাপ আছে। আর একটা জিনিস পারে বলল। খুব ফিসফিস করে, পাছে কেউ শুনে ফেলে এমন ভাবে। 

"আমি না বাঁশীতে সুর তুলতে পারি।" 

'আরে বাহ এতো দারুন ব্যাপার। কিন্তু কত্তা এ জিনিস লুকোনোর কি? এতো খুব ভালো ব্যাপার। ' 

আমার মনের আশংকা অস্থিরতা সরিয়ে রেখেই বললাম। চিন্তা করে তো কিছু করতে পারবো না।  বরং যে পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি সেটাই জানা যাক! এক নিমেষে আমার জগত বদলে যাবার আগে অব্দি তো জানতাম না, কত কি প্ল্যান করে রেখেছিলাম, প্যারামাউন্টে সরবত খেয়ে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরবো আজ জলদি। মা কী যেন বানাচ্ছে বলছিলো....

"তুমি জানোনা,  আমাদের তো সবাই ব্যবসা করে। আমাদের তাই শিখতে হয়, আমি তো ব্যবসা করতে  চাইনা নতুনদাদা, আমি বাঁশী বাজাতে চাই। আমি অনেক দূরে একটা নদীর ধারে বাঁশী বাজিয়ে মেঘ নামাতে চাই, পাহাড়ে উঠে গান গেয়ে গাছেদের শোনাতে চাই, জাহাজে চড়ে নাম না জানা দেশে যেতে চাই। এরা আমায় খুব ভালোবাসে আমি জানি কিন্তু আমি যে এখানে থাকতে পারবোনা। আমাকে যেতেই হবে জানো, আমি স্বপ্ন দেখি নৌকায় শুয়ে শুয়ে আমি ভেসে চলেছি, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আমি চলে যাই তাই মাঝে মাঝেই। ধরা পড়ে যাই। আরেকটু বড় হলে আমি আর ধরা পড়বো না দেখো। " 

আমি আমার কথা বললাম। আমারও ভালো লাগত না বাড়িতে থাকতে। কিন্তু যেই টের পেয়েছি আর হয়তো কোনোদিন মাকে দেখতে পাবো না, নিজের বই গুলোয় হাত দিতে পারবোনা, বাবার বকুনি খাবো না...আমার মন কেমন করছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার লজ্জা লাগছিলোনা ওইটুকু ছেলের কাছে এরকম অকপট স্বীকারে। যেন আমি জানি, ও তামাশা করবে না। কিন্তু এখানে তো থাকা হবে না আমার। বললাম সে কথা। সে ছেলে তৎক্ষনাৎ বলল, আমিও যাবো তোমার সাথে চলো।  

আরে না, ধরা পড়লে কী হবে? তাছাড়া আমি কি করবো কোথায় যাবো কিছুই জানিনা। এ সময়টা আমি চিনিনা। এরকম ভাবে হয়নাকি? সেও শুনবে না, তার বক্তব্য আমি তো যেতামই যাবোই। তোমার সাথে নাও না। আমার তো বন্ধু নেই কেউ। পিছনের খিড়কি দরজা দিয়ে চলে যাবো, এখন অষ্টমীর আরতি হবে সবাই ব্যস্ত। কেউ টের পাবে না। চলো না।

তারপর? তারপর সত্যি সত্যি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শহরের কোলাহল ফেলে দুজন অসমবয়সী বন্ধু, অচেনা জগতে চলল। হাওড়া স্টেশন একেবারেই অন্যরকম। একটা ট্রেনে চড়ে বসেছি দুজন। ওদের বাড়ি থেকে আসার সময়েই আমার পোশাক বদলে নিয়েছি,  তাই কেউ তাকাচ্ছেনা তেমন। দু ভাই যেন বেরিয়েছে। সকালে তখন একটু একটু আলো ফুটছে, আমরা একটা স্টেশনে নেমে পড়েছি। লোকজন খুব কম বলে মনে হচ্ছে আমার। না বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম।  দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আমরা এমনি হাঁটা শুরু করেছি। খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমি বা দুলাল কেউইই কিছু করতে পারিনা। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর আর যখন পারছি না, একটা গ্রামে এক বাড়িতে একটু জল চাইলাম। বেলা প্রায় দশটা হবে, মুখ দেখে কিছু মনে হলো কিনা কে জানে! প্রশ্ন করল এক গাদা, আমরাও বানিয়ে বানিয়ে, আত্মীয়রা বাবা মা মারা যাবার পর তাড়িয়ে দিয়েছে ইত্যাদি গল্প বলে দিলাম। জল এর সাথে একটু মুড়ি আর বাতাসা পাওয়া গেলো। গপগপ করে খেয়ে ফের পা চালালাম।

অনেক অনেকটা হাঁটার পর একটা নদী দেখে তার পাশে পৌঁছে দুজনেই থেবড়ে বসে পড়েছি। খানিক জিরিয়ে নিচ্ছি চোখ বুজে। অনেক্ষন বিশ্রাম নেবার পর, দুলাল বাঁশী বের করে ফুঁ দিলো। আহা বড় ভালো বাজায় ছেলেটা এ বয়সেই। মন থেকে ক্লান্তি মুছে যায়, খিদে ভুলে যাওয়া যায়।

সত্যি তো ভোলা যায় না। খিদে পেয়েছে যখন বেশ খানিক, দেখি ক্যাপ্টেন চলো যাওয়া যাক,  কিছু খাবারের জোগাড় তো করতে হবে নাকি? পয়সা এখনো কিছু আছে, দুলালেরই টাকা, নিয়ে এসেছিল, টিকিট কেটেও ছিলো কিছু। কিন্তু এই জনহীন মাঠে দোকানই বা কোথায় খাবারই বা কোথায়! 


গ্রামের দিকে শরৎকালের রাতে হিম পড়া শুরু হয়ে যায়। ছোট ছেলেটাকে হিমে ভিজতে দেওয়া যায়না। অন্ধকার নামার আগেই লোকালয়ে পৌঁছতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রামে পৌঁছনো গেলো। একজনের মুখেই জানা গেলো, নবমীর রাতে যাত্রা বসেছে বারোয়ারি তলায়। সবাই সেখানেই চলেছে। একটু জল পাওয়া যাবে কোথাও? খাবার তো চাইতে পারিনা দুজনের কেউই। যে লোকটা যাত্রার খবর দিচ্ছিল,  সেইই বলল পুজোর মন্ডপে গেলেই জল মিলবে, তবে তার আগে যে কোনো বাড়িতে চাইলেই হবে, ওর বাড়ি এখানে নয়, গ্রামের অন্যদিকে। 

পা চালিয়ে পৌঁঁছনো গেলো। সন্ধ্যারতির প্রসাদ দিচ্ছিলো, মুড়কি, বাতাসা আর নাড়ু। পেটে খানিক শান্তি হতে দুজনে যাত্রার আসরের দিকে চললাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে, আমাদের দুজনের কারোরই এতো পরিশ্রম করার অভ্যেস নেই। যাত্রা শুরু হতে বিস্তর দেরী। ঘুম তাড়াতে দুলাল বাঁশীতে ফুঁ দিলো, টুকটাক সুর তুলছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একজন আমাদের সামনে এলো।

  - এই ছোঁড়া তুই বাঁশী বাজাস?

দুলাল ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম কেন বলুন তো? 

  - আপনি কে? 
  - ওর দাদা। 
  - আপনাদের তো এ তল্লাটে দেখেছি বলে মনে হয়না। 
  - না আমরা এ গ্রামের না।
  - অ। শুনুন মশাই। আপনার ভাইটিকে দেখতে বেশ, বাঁশিও বাজাতে পারে টুকটাক দেখছি। যাত্রাদলে দিয়ে দিন। মাসে পাঁচটাকা করে পাবে, খাওয়া, বছরে একজোড়া ধুতি।
  - না না ও যাবেনা।  
  - ভেবে দেখুন। এ গ্রামের জমিদারের সাথে আমার চেনা আছে, ঝামেলার কিচ্ছু নেই।

ঝামেলার যে কিছু একটা আছে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে। আমি তাড়াতাড়ি,  আচ্ছা দাদা ভেবে জানাচ্ছি, বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। দুলালও চটপট উঠে পড়েছে। আমরা যাত্রার আসর থেকে, স্টেশন কোন দিকে জেনে হাঁটা দিয়েছি। 


স্টেশন এ গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেকের দূরত্বে। কিছু করার নেই, লোকটার হাসি আমার ভালো লাগেনি। এখানে জোরজুলুম করলে কিছুই করতে পারবো না। দুলালও দেখলাম টের পেয়েছে, বলল, "আমি পারবো নতুন দাদা। চলো"।  অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে, রাস্তা ভুল করে,  হাঁটাহাঁটি খুবই বিপজ্জনক।  তাও আবার যে রাস্তা চিনিই না। তাই আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যাত্রার আসর থেকে দূরের কোনো ঘরের রোয়াকে যদি আজ রাত টুকু কাটানো যায় চেষ্টা করা যাক। দু তিনটে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো, চার নম্বর বাড়িটা একটু সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি। সে বাড়িতে গিয়েই আগে সে বাড়ির কর্ত্রীকে দেখতে পেয়ে সাস্টাঙ্গে প্রনাম করে বললাম, 'মা আজ রাত টুকু দু ভাইকে থাকার অনুমতি দিন, আমরা কুটুম বাড়ি যেতে গিয়ে রাস্তা হারিয়েছি। স্টেশন যাবো, কিন্তু এ রাতে আর যাওয়া যায় না। তাছাড়া ভাইটা আমার আর হাঁটতেও পারছেনা'। 

সেকি কথা! বচ্ছরকার দিন! নিশ্চয়ই বাবারা। তোমার ভাই এর বয়সী আমার নাতি আছে, তাদের আসার কথা ছিলো, আসতে পারেনি। থাকো তোমরা। বছরকার দিনে দুটো মুখে দাও। কাল সকালে যেও।
গরম ভাত, ঘি, বেগুনভাজা, ডাল, তরকারি, মাংস,  এতো কিছু জুটবে আমরা নিজেরাও ভাবিনি। দুজন চোখাচোখি করে নিলাম,  খেয়ে হাত মুখ ধুয়েই  বাড়ির কর্তা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। আসলে আগেই চেয়েছিলেন, বাড়ির গিন্নীর আপত্তিতে করতে পারেননি। কোথায় বাড়ি, কুটুমবাড়ি কোথায়, আসার পথে যে সব স্টেশন চোখে পড়েছিলো তাদের একটার নাম বলেও ওনার সন্দেহ খুব একটা গেলো না। কাদের বাড়ি, কি নাম। আমি দেখলাম বেশী প্রশ্ন মানেই বিপদ। তাছাড়া দুলাল অত ভালো বানিয়ে বলতেও পারেনা। কিছু গোলমাল বেঁফাস বললেই মুশকিল। তাড়াতাড়ি গিন্নিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, বড় ক্লান্ত লাগছে আসলে অনেকটা হাঁটা হয়েছে কিনা।

ব্যাস ও কথাতেই কাজ হলো। বউ এর কটমট চোখের সামনে কোন কালে কেইই বা টিকেছে। সকাল সকাল উঠেই বিদায় নিয়েছি। বেশীক্ষণ থাকা মানেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।  আমার কথা শুনলে তো পাগল বলবে। দুলালকে অল্প আধটু বলেছি। ওর কাঁচা মন,  তাই অত অবিশ্বাস করেনি। স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেন আসছেই। ট্রেনে ফাঁকা। দশমীর দিন এ সময় আর কে ট্রেনে থাকবে! দুলালকে বললাম,  'এবারে তোকে দিয়ে আসি বুঝলি, আরেকটু তৈরী হয়ে বেরোতে হবে, নিজের মতো থাকতে গেলে আগে নিজেকে তৈরী করতে হয়। তুই আমি কেউইই তেমন তৈরী না।তবে আমার তো থাকার উপায় নেই। তোকে পৌঁছে দিয়ে আমায় খুঁজতে বেরোতে হবে, যদি আমি বাড়ির পথ খুঁজে পাই।'

দুলালের চোখ ছলছল। তর্ক ও করতে পারে না। আমায় ওর বাঁশীটা দিয়ে বলল, "এটা রাখো তুমি নতুনদাদা। আবার আসবে তো?"
 ওর বাড়ির কাছে আসতেই, সোরগোল পড়ে গেলো। 
"ছোটকত্তা ফিরেছে "। 
" একটা লোক সাথে,  অ্যাই কে আছিস একে ধর,  এ তো মেজকত্তার কামড়জামা। চোর ব্যাটা, ছেলে ধরা, আমাদের ছোটকত্তাকে ভুলিয়ে নে গেছিলো, মার ব্যাটাকে"। 

কে যেন আমায় খুব জোর একটা মারলো মাথায়, চোখে অন্ধকার দেখছি, তেষ্টা পাচ্ছে খুব, মুখ থুবড়ে পড়ছি....পড়ছি...

"কী হয়েছে ভাই? মৃগী না গাঁজা? 

চারদিকে ছোটখাটো জটলা, বিকেলের রোদ পড়েছে ভাঙা বাড়িটার গায়ে।
চারদিকের নোংরায়, কোলাহলে বুঝলাম আমি ফিরে এসেছি আবার আমার চেনা শহরে। তবে কি সব স্বপ্ন ছিলো? 

তাকিয়ে দেখি আমার পরনে, ধাক্কাপাড় ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর একটা আড়বাঁশী।

Thursday, September 27, 2018

বাদলা দিনে মনে পড়ে ...

"বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান"।
বৃষ্টি বাদলার দিন হলেই আমার তিন চারটে র‍্যান্ডম কবিতা গল্প মনে পড়ে যায়। একই বয়সের না, আলাদা সময়কার। কালো করে আকাশ, সিঁড়ির বন্ধ জানলা বেয়ে জল এসে দালান থৈ থৈ। আমার কাগজের নৌকা ডুবে গেছে সেইই কখন, লেবু গাছের গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে৷ আমি নীচের ঘরে আবছা অন্ধকারে, 'কবে বিষ্টি পড়েছিলো, বান সে এলো কোথা', ভাবতাম, কল্পনায় যেন দেখতাম অন্ধকার আলো নিভু নিভু ঘরের দৃশ্য।

আরেকটা গল্প মনে পড়ে যায়, ক্ষীরের পুতুলে, সেই দুয়োরাণী বাঁদর ছেলেকে ঘুম পাড়ায়, বাইরে তখন খুব ঝড় জল।

আরেকটা গল্প ছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় এর মনে হয়। কয়েকজন বন্ধু বিকেলে জড়ো হতো ক্লাবে, চা মুড়ি চপ খেতো, এরকম একদিন বৃষ্টি বাদলার দিনে যারা জড়ো হয় তারা সব মানুষ না!

তিনটে বিসদৃশ জিনিস মনে পড়ে কেন কে জানে! সাথে এলোমেলো করে বৃষ্টির দিনের ছবি, সে ছবিতে কেন্নোর দালানে উঠে আসা আছে, অফিস যাবার নাম করে বেরিয়ে ইচ্ছে করে ভিজে বাড়ি চলে আসা আছে, তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা কাচে বাইক চালানো আছে, একটা বাচ্ছা ছেলের ভিজে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে আসা আর তার মা এর গামছা দিয়ে মুছিয়ে দেবার পর প্রথমবার আদা দিয়ে সত্যিকারের চা খাওয়া আছে।

বৃষ্টি মানে ভূতের গল্প এই জন্যই কি? ভূত মানেই তো অতীত, ছেঁড়া খোঁড়া ঝলমলে হিংস্র নরম অতীত।

*******************************************************************************

একা একা সময় কাটাতে স্টুলিশ খেলছিলাম। হঠাৎ আলো কমে এলো, হুড়োহুড়ি করে একরাশ মেঘ ছুটে এলো কোথা থেকে। দিনদুপুরে রাতদুপুর হয়ে গেলো। জানলা খুলে হাঁ করে দেখছিলাম চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেলো, ফলওয়ালা তার ঠ্যালাগাড়ি ফেলে পালিয়েছে, রাস্তায় একটাও লোক নেই আর। সাদা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে আর একটাও লোক নেই....এমন অপচয় বড় কষ্ট দেয়।

আমার নীচে নামা বারন, অবশ্য বারন না হলে আমি এতোক্ষন একটা কাচের ঘেরার মধ্যে বসে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জানলা দিয়ে ঝাপ্টা আসছে, আমার চুল, বিছানা বালিশ ভিজে যাচ্ছে, বাবাই বকবে এক্ষুনি। 
হঠাৎ করেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় গোলমাল হয়ে যায়, একটা একানে ছেলে টিউশন শেষে হাঁটা লাগিয়েছে, এখানে তার বন্ধু বান্ধব নেই তেমন। অবশ্য কোথায়ই বা ছিলো। বাসের ভাড়া বাঁচিয়ে সিগারেট কিনবে, নতুন শখ, খালের ধারে ভাঙা পাঁচিলে তার দেশলাই লুকোনো আছে, ব্যাগে রাখলে ধরা পড়ে যাবে।

হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আসে। একা একা হাঁটা দেখেই সঙ্গী হয় বোধহয়। ছেলেটার ছাতা নেই, ব্যাগে পরীক্ষার খাতা, সে পরীক্ষায় সে সব চেয়ে কম পেয়েছে। মন খারাপে, একলায় মাখামাখি ব্যাগে বৃষ্টি ঢুকে দেখে। মেঘ নেমে এসে উড়িয়ে দেয় সব। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে ভীতু হাতে সিগারেট ধরায়, ভয়ের চোখে দেখে আশেপাশে কেউ আছে কিনা!

রাতের বেলায়, সব থেমে যাবার পর টেবিল ল্যাম্পের আলোয় নদী আঁকে সে খাতায়। আঁকতে সে পারে না মোটেও একটাই আঁকা জানে, একটা নদী, নদীর ধারে ঝাঁকড়া গাছ, দূরে একটা বাড়ি, কয়েকটা পাখি আর সূর্য। আঁকতে আঁকতে কখন যেন নদী, গাছ সব তার মধ্যে ঢুকে যায়। পরীক্ষার কম নাম্বার, একলা কোচিং কিচ্ছু যেন আর ছুঁতে পারে না তাকে।

".....জানলাটা খোলা, দরজা হাট করা, সব ভিজে গেলো, আবার শরীর খারাপ না বাধালেই না?"

যাই।

Tuesday, September 25, 2018

শরত তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

চেকাপের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে কি আহ্লাদ যে হলো কী আর বলি। শরতের রোদে ধোয়া আকাশ, প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা চলছে। রাস্তায় হরেক কিসিমের লোক। জুতো জামা পরে আপিস যাচ্ছে কেউ তো কেউ সাইকেল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।  এসিটা অফ করে জানলার কাচ নামিয়ে দিতে বলব? বাইরের হাওয়া খেতে ইচ্ছে করছে বেজায়। আচ্ছা থাকগে বললে যদি না করে দেয় দুঃখ হবে, আজ বেশ ঝলমলে দিন আজ দুঃখ পাওয়া যাবে না। 

ভিয়াইপির ধারে বড় বড় গাছ গুলোয় কি করেছে কে জানে পাতা টাতা ঝরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেমন মনমরা হয়ে। এমন পুজো পুজো দিনে কারো মন খারাপ হলে ভাল্লাগেনা, ওর পাতা গজিয়ে যাক প্লিজ। আরে এই গাছটায় কচি কচি সবুজ দেখা যাচ্ছে না? হ্যাঁ হ্যাঁ। আরে আরে এই গাছটায় তো অনেক সবুজ পাতা জন্মেছে, "প্রাণ আছে এখনো প্রাণ আছে"।  মন ভালো দিন। 

এইরে গাড়িটা বেমক্কা ঘোরাচ্ছে কেন? যাকগে আমার কি, আমার বরং ভালো। বেশী বেশী ঘোরা যাবে। হাঁ করে করে বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে গাছ দেখছি,  ফ্লাইওভার থেকে একটা বাড়ির মাথায় লেখা উচ্চ বিদ্যালয় লেখা দেখছি, আরিব্বাস ওই বাড়িটার ছাদে কত্ত গাছ লাগিয়েছে। একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ লাগাবো বাড়িতে। 

ডাক্তার আসেনি, মাকে বললাম এই পাশের দোকানে চা খেয়ে আসছি একটু। একটা চা দেবেন দাদা? বলে, যেই গোল নোনতা বিস্কুট নিতে গেছি, 'আমায় বলো কি চাই, হাত দিচ্ছো কেন'!  আমি কি চোর নাকি! খাবোই না শালা তোর দোকানে। বললাম, ও তাই, আচ্ছা থ্যাংক ইউ আমার লাগবে না চা। 

রেগে গিয়ে গটমট করে হেঁটে এগিয়েছি। নাহ, রাগ করে মেজাজ খারাও করা যাবে না। আরে এই মিষ্টির দোকানটায় ঢুঁ মারি তো। আরিব্বাস রে পোস্তকদম্ব মানে বহরমপুরের রসকদম্ব।  
আমদই দেখছি,  বাহ বাহ। মা দইবড়া ভালোবাসে, কালাকাঁদটা ভালো মনে হচ্ছে। বাহ বেশ উজ্জ্বল আবিষ্কার হলো তো আজ। 

মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখি আকাশে একটা লাল ঘুড়ি উড়ছে, বেশী উঁচুতে ওড়েনি তখনো৷ এখনো ল্যাতপ্যাত করছে কিন্তু ওড়াচ্ছে যে ছানাটা তার মুখের ভাব বলেই দিচ্ছে আজ আকাশে নীল লাল সব রঙের ছবিই আঁকা হবে। 

আজ রঙের মেলার দিন। আজ তো হবেই। 😊😊

Friday, September 21, 2018

মানভৌতিক

সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। সারদিন শুয়ে বসে কাটাই বলেই হয়তো রাত নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয় না।  মশারির জট থেকে বেরিয়ে টয়লেট ঘুরে এসে জল খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। মন টন ভয়ানক খারাপ,  কাল বাড়িতে এক গাদা লোক আসবে কিন্তু আমার কি তাতে আমার তো সে সব্বার আগে পেঁপে ভাতে কুমড়ো ভাতে,  চিকেন স্টু। অবশ্য একটা সুবিধে আছে, শরীর খারাপ বলে ইচ্ছে না হলেই বকবক করতে হবে না। 

একা একা সাতপাঁচ ভাবছি,  দেখি এসির জলে একটা কাগজের নৌকায় বসে একটা এক আঙুলে ভূত আমায় ডাকছে, "কী হলো হে? মাঝ রাত্তিরে এমন ছলছল নয়নে ব্যাগড়া দিচ্ছো কেন হে?" 

ভারী রাগ ধরে গেলো। ও আবার কি আমার ঘর আমার বারান্দা,  চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছি ফস করে আমারই এসির জলে নৌকা বাওয়া ভূতে আমায় চোখ রাঙাবে! কলিকাল কি শেষের পথে নাকি? 

বললুম, 'তোমার তাতে কি হে? আর ব্যাগরা দিচ্ছি মানে? আমি কি গান গাইছি নাকি?'
  - মন খারাপ তো করছ। আমাদের ভূতেদের এসব নেগেটিভ চিন্তা ভারী ক্ষতিকর। আর ও আবার কি একজন ভদ্রমহিলাকে এরকম ভাবে বলতে লজ্জা করে না হ্যাঁ? ভূত বলে কি মহিলা নই!
  - 
 মহিলা! এ মহিলা? এ কুচো একটা ভূত তার আবার মহিলা না পুরুষ কে বুঝবে বাওয়া! সে কথাই বললাম। ওব্বাবা এক আঙুলে হলে কি তেজ কম না। অবশ্য স্বাভাবিক মহিলা ভূত আমার বোঝা উচিতই ছিলো। 

"কুচো ভূত আবার কি? লজ্জা করে না?  শোনো আমি তোমারই বয়সী বুঝেছ? আমি আসলে আসলে, বামন বলতে পারো। আমাদের ভূত সমাজে যেমন হওয়া উচিত মেয়েদের, কুচকুচে কালো, বা ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা, ভয় পাওয়ানো মুখ, এই আলিশান চেহারা কিছুই আমার না। বয়স বেড়েছে এদিকে চেহারা ঠিক ছোটই রয়ে গেছে। তাই আমি একা একাই থাকি। অবশ্য আমার তাতে অসুবিধে হয়না, মানুষদের ঘরবাড়িতে এই আলোর শহরেও অনেক ছায়া ছায়া জায়গা খুঁজে নিয়েছি ,  ফলে রোজ রোজ নতুন জায়গা থাকার জন্যে আমার। তাছাড়া কুকুর বেড়ালে আর ভয় খায়না আমায় বেশ রাতের বেলা আড্ডা মেরে কাটে। "

শুনে মনটা খারাপ হলো একটু। আমিও তেমন লম্বা চওড়া সা-জোয়ান চেহারার না, খেলতে পারিনা, গাইতে পারিনা, পড়াশোনায় দড় না, আমারও তেমন বন্ধু নাই।  আমিও নিজের মতোই ঘুরে ঘুরে বেরাই। বাপী, লাল্টু, চাঁদুরা খেলেতে গেলে দুধ ভাত করে দেয়। আমার মন খারাপ করে। 

  - আহা মন খারাপ কোরোনা, ভূতেদের গল্প বলো বরং। আমারও তেমন বন্ধু নেই, তুমি বন্ধু হয়ে যাও। 
  - ভূতেদের গল্প আর কি। তোমাদের মতোই সব,  একটু আলো একটু কালো এইসব দিয়ে তৈরী। এই তো আজ রাতেই জলসা বসবে বটতলায়।  যাবে নাকি? 
  - আমি? আমি কী করে যাবো? আমার বাড়ি থেকে বেরোনো মানা তো।  তাছাড়া এই রাতে বাড়ি থেকে বেরোনো যায় নাকি!
  - ওহ তুমি বুঝি খুব ভালো ছেলে? মানে দুধুভাতু ছেলে?
  - দুধুভাতু আবার কি! মেরে তোমার পেত্নীগিরি ঘুচিয়ে দেবো। একটা কথা বলতে জানে না এসেছে আবার। শোনো তোমায় না পাত্তা দেয়না কেউ তোমার স্বভাবে বুঝেছ? 
  -  নখ দাঁত বেরিয়ে গেলো তো অমনি? অবশ্য আমারও ভুল তোমার দুর্বল জায়গায় আমিই আগে খোঁচা মেরেছি। সরি হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ হয়তো, আমার দোষেই কেউ বন্ধু নেই আমার। আচ্ছা আমি যাই এখন। ভালো থেকো। 
  - আরে সরি সরি।  দুঃখ পেওনা। আমারও এই স্বভাব জানো ফস করে রেগে যাই। ওরম চলে যাওয়া কি হে। তুমি  শাঁকচুন্নি ফ্রেন্ড বলে কথা, বন্ধুদের উপর রাগ করলে চলে!
  - আচ্ছা রাগ করলাম না যাও। ভুল আমারও ছিল। তোমার সাথে কথা বলে ভারী ভাল্লেগছে। যা বলছিলাম, যাবে ভূতেদের জলসায়? না না বাড়ির গেট খুলতে হবেনা। তুমি খালি আমার হাতটা ধরো আমি নিয়ে যাবো। ভয় পাবে না কিন্তু।
  - ইয়ে ভূতেদের গা নাকি ভারী ঠান্ডা হয় শুনেছি। আমার আবার শীতে ভারী সমস্যা হয়। 
  - আরে এইটা একটা কথা নাকি! তুমিও যেমন। ওরা তো সব মরা ভূত। আমি তো জ্যান্তো শাঁকচুন্নি। আমার হাত ধরে দেখো, অমন ভুতুড়ে না। 
  - আরে তাই তো! 

তারপর আমি টুংলুর মানে ওর নতুন বন্ধু হওয়া শাঁকচুন্নির হাত ধরে আকাশে সাঁই করে উড়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত অবশ্য তারপর একটা প্রকান্ড আর্ধেক তৈরী হয়ে পড়ে থাকা বাড়ি যাকে অট্টালিকাই বলা যায় তার কাছে এনে ফেললো। এ জায়গাটা চিনি মনে হচ্ছে না? বলতে গেলাম টুংলুকে, বলল হুঁ সবই এদিক সেদিক করেই নেওয়া তো৷ অত চেনা খুঁজতে যেওনা, তা দেখছো তাইই দেখো। 

আসর তখন জমে উঠেছে। গীটার হাতে খুলি নাচিয়ে গান গাইছে এক ছোকরা ভূত।ওই দেখো ওইযে হ্যান্ডু ছেলেটা গান গাইছে খুলি নাচিয়ে, খুব ঝাড়ি মারি বুঝলে।
আহাহা কি তার রূপ! চোখটা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে একবার, খুলিটা খুলে নিয়ে পাক খেয়ে নিলো! একেই নাকি পছন্দ! ভুতুড়ে পছন্দ কি আর এমনি বলে! 
-তা একে এতো পছন্দ যখন সাহস করে প্রোপোজ করলেই পারতে। 
  - পাগল নাকি! ঝাড়ি মারতে পছন্দ মানেই প্রপোজ করার মতো নাকি। ভারী ক্যাবলা হে তুমি যাই বলো।
  আমি কথা বাড়ালুম না। এখানে ঝগড়া করে তারপর এখানেই ফেলে পালালেই চিত্তির। ভুতুড়ে আসর মন্দ না কিন্তু। বেশ অনেক ক্ষন গান বাজনা শুনে, টংলু বলল চলো কিছু খাওয়া যাক। প্রথমবার আমাদের পাড়ায় এলে। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম, কি না কি খেতে দেবে। ভূতেদের ডেলকেশি হয়তো থাবা থাবা শুঁটকি, সে জিনিস দিলেই কেস।  বললাম, না না,  চলো বরং এবার ফেরা যাক নাকি?
টংলু বলল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? 
আমি তাড়াতাড়ি জানালাম,  যে সেরকম কোনো ব্যাপারই না।
  - তাহলে আর কি চল। খেয়ে একটু ভেড়ির ধারে ঘুরে ফেরা যবে খন। 

ভয়ে ভয়ে একটা আর্ধেক শেষ হওয়া বাড়ির ন্যাড়া ছাতে বসলাম। চারিদিকটা জ্যোৎস্নায় অদ্ভুত মায়াময় লাগছে। এতো উঁচু থেকে সবটা দেখা যাচ্ছে আবছায়ায়,  একটা প্রায় অপরিচিত শাঁকচুন্নির পাশে ন্যাড়া ছাতে বসে আছি খেয়াল থাকে না। মন কেমন করে। যেন কোন আদিন কাল  থেকে সবাই এরকম রাত জাগে, ওই যে রাতচরা পাখিটা কি বলে গেলো তা যেন গাছটা শুনতে পেলো বুঝতে পেল। চমক ভাঙলো টংলুর ডাকে। "এই যে মহারাজ, এই নাও।" আরে! এ যে তন্দুরি। ভাগাড়ের নাকি? টংলু যেন আমার মনের কথা শুনতে পেয়েই বলল," আরে ঘাবড়িওনা, তোমাদের মতো ভাগাড়ের সন্ধানে ঘুরিনা। তোমরা যখন বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ ভাবো বর্তমানটা তো মরে যায় তখন আমরা সেইখান থেকে যা মন চায় তুলে নিই। সে যাক তুমি এতো ভেবোনা, খাও। "

আরাম করে তন্দুরি খাওয়া গেলো দুজনে। শুঁটকি ওদের ডেলিকেশিই বটে তবে আমি থাকায় আর ওটা বের করেনি। ভাগ্যিস! তন্দুরি খেয়ে একটা দুই  বেখাপ্পা মানুষ আর ভূত মিলে ভেড়ির হাওয়া খেয়ে ,  চাঁদের আলো মেখে ফের আস্তানায় ফিরে গেলো।

তারপর? তারপর আবার কি হে! দুজন বেঠিক মানুষ-ভূতের দারুন বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তারা আড্ডা মারে, বই গান এক্সচেঞ্জ করে, ঘুরে বেড়ায়। ওহো তোমরা বুঝি সেই প্রেম আর বিয়েতে আটকে গেছো? তারা পেল্লায় বন্ধু হয়েছে এটুকু জেনেই আমি খুশ, মানুষ ছেলে আর শাঁকচুন্নি ভূতে বাকি গল্পটা কেমন করে এগোবে তা আমি জানিনা বাপু, ছেলে মেয়ে মিলে বন্ধুত্ব তো হেব্বি হয় দেখলুম। বাকি অত রংমিলান্তি খুঁজোনা বাপু।

Sunday, September 16, 2018

অলীক চিঠি



লীলা মজুমদার ক্ষমা করে দেবেন আশা করি।

*************************************
প্রিয় পানু,

এ চিঠিটা পড়েই গিলে নিস। চারিদিকে গুপ্তচর গিজগিজ করছে। এক্ষুনি জেনে যাবে সব। শোন আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, কাউকে বলিনি এখনো। কাউকে মানে আবার ভাবিস না গরুর কথা বলছি। হ্যা হ্যা হ্যা। সেদিন এর কথা মনে আছে তোর? বোঁচা কেমন বোকা বনেছিলো কাউ নিয়ে। যাকগে সেসব। 

বুঝলি সেদিন মাঝ্রাতে চারদিক সব চুপচাপ, ভোঁওওও আওয়াজ করা মোটরবাইক, বিটলে কুকুর গুলো ভৌ ভৌ কিচ্ছু নেই। চৌকিদারের লাঠির আওয়াজটাও না। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এই শরীর খারাপের জন্য জানিসই তো বাড়িতে স্বাধীনতা বলে কিচ্ছু নেই, মশারীর মতোন খারাপ জিনিস টাঙিয়ে দিয়ে যায় রোজ। শুধু কি তাই, বিকেলে ছানা দুপুরে পেঁপে আর কুমড়ো রাতে চিকেন স্টু....দিন খুব খারাপ যাচ্ছে ভাই। একটু সেরে উঠলেই একটা কাবাবের দোকান দেখে রেখেছি। খেতে যাবো হ্যাঁ? আর আর অ্যামাজনে একটা রিমোট কন্ট্রোল কার দেখেছি, একদম ফেরারি, ওটা কিনবো ভেবেছি, জন্মদিনে আরো কিছু পয়সা জমিয়ে একটা রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টারও কিনবো। তারপর এরকম মাঝরাতে বারান্দা থেকে হেলিকপ্টার নামাবো কেমন? 

আরে আসল কথাটাই বলিনি দেখছি। একটা ছোট ভূতের ছানা ধরার প্ল্যানে আছি, একবার ধরতে পারলেই হেলিকপ্টার টায় ঢুকিয়ে দেবো। সেদিন রাতে ঘুম ভাঙলো তো তারপর বারানাদায় গিয়ে ওই ভূতের ছানাটাকে দেখলুম। এক আঙুলের মতো সাইজ,  দেখি ব্যাটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আমার বারান্দা থেকে। তার আগে অব্দি আমার মন খুব খারাপ ছিল, এবারে আমার জামা কিনতে যাওয়া হবে না, পুজোয় চিকেন রোল খাওয়া হবে কিনা কে জানে, ঘুরতেও যেতে পারবো না কতদিন কিন্তু ভূতের ছানাটার কসরত দেখেই প্ল্যান করে ফেলেছি বুঝলি। একে রোজ ছায়ার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে বশ করে ফেলবো। তারপর পুষতে পারলেই, তোর কাছে পাঠাবো বুঝলি।  সেই সবুজ পাথরটা পরিষ্কার করে রাখিস, ওইখানে বসে বাকি প্ল্যান করবো। 

ভূতের ছানাটা ছায়া ছাড়া আর কি খেলে তাড়াতাড়ি বশ হবে বলিস তো৷ পুরোনো ক্যাপ বন্দুকের ধোঁয়া দেবো? আর একটু খানি ডাল্ডার  টিনে রাখলে কি ভালো থাকবে? বিশদে আলোচনা সামনাসামনি হবে।  কাউকে বিশ্বাস নেই, ভূতের ছানাটা খুব বেশী কথা বলছে না  তাই বুঝতে পারছিনা বাঙালী না বিলেতি। বিলেতি হলে আবার মুশকিল।

বিঃদ্রঃ -  চিঠি লেখার পর একটা আপডেট আছে,  ভূতের ছানাটা লায়ন ক্যাপ শুনে চকচকে চোখে দেখছিলো।

ভালো থাকিস, আর এ চিঠি পরেই গিলে নিস কিন্তু। শিগগিরই দেখা হবে। 

- গুপী