Thursday, June 29, 2017

জল জঙ্গল পাহাড়ের গল্প (২)

হোং হোয়াং ছো টাইপ একটা গুরুগম্ভীর মন্ত্রের আর প্যাঁপ্পোর পোঁ আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। পর্দা সরিয়ে দেখি দিব্যি ছিমছাম একটা রোদ বেরিয়েছে। মেঘের সমুদ্রে পাহাড়ের চড়া পড়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে। দূরে সান্দাকফু দেখা যাচ্ছে নাকি, আমি অবশ্য ওটা মেঘ বলে ভুল করছিলাম। আবার ফের মেঘ করে আসতে নেমে গেলাম। মঠের পাশেই একটা পাহাড়ে ধাপ কেটে চাষের ক্ষেত। ভোরের কুয়াশায় মেঘে জড়ানো সে রাস্তা এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরী করেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি উপেক্ষা করে একটু এগিয়েই ফের ফিরে আসতে হলো, পিডি ভাই এসে গেছে ব্রেকফাস্ট করতে হবে, বেরোতে হবে। 

ভার্সে যাওয়ার জন্য বন্ধুর গাড়িতে দুজন হেল্পার, আমি আরেকটা যে ছেলে ছিলো সে  মিলে ওঠা গেলো। হেল্পার দুজনের একজনের না মিংমা শেরপা আরেকজনের নাম খুব কঠিন মতো, বাচ্ছা শেরপা বলাই সহজ বরং। মিংমা কম কথার মানুষ,  এমনি সময়ে সে গাইড হয় বটে ডেন্টামের রাস্তার কিন্তু বর্ষায় হবে না কিছুতেই। আসল কারনটা পরে জেনেছিলাম অবশ্য। সে যাই হোক, রেঞ্জার কিছুতেই গাইড ছাড়া ভার্সে থেকে ডেন্টাম যেতে পারমিশন দিলো না। কি আর করা! সই সাবুদ সেরে এগোনো গেলো। সঙ্গের ছেলেটা সদ্য কলেজ শেষ করেছে বেরিয়েছে একা কিন্তু বেজায় ভীতু দেখলাম। মিংমা আর বাচ্ছাকে কম করেও বিশ বার জিজ্ঞেস করলো,  আচ্ছা বর্ষাকাল তোমরা সবাই নেমে গেছো এ জঙ্গলে তো ভালুক আসতেই পারে না? হ্যাঁ, ও দাদা আসতে পারেনা? প্রথমটা মজা পাচ্ছিলাম পরে বিরক্ত হচ্ছিলাম। এরম প্যানপ্যানে ছেলে বাড়ির খুঁটো ছেড়ে আসে কেন কে জানে! আমি একটু তফাতে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিলাম। ছেলেটার আবার নার্সিজিজম সিন্ড্রোম আছে। থেকে থেকে ছবি তুলে দিতে বলে। আর সে ছবি আবার তার পছন্দও হয়না। শেষে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে, পর পর বেশ কিছু খারাপ ছবি তুলে দিলাম যাতে আর না দেয়। ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট কিন্তু লম্বা সময়ের শান্তি।
মেঘ কুয়াশা ঢাকা রাস্তা, বর্ষার জল পেয়ে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠেছে। ফার্ন গুলো চকচকে সবুজ হয়ে আছে। রাস্তার ধারে নাম না জানা বুনো ফুল ফুটে আছে। পাতায় জলে রাস্তাটা পিচ্ছিল হয়ে আছে।সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোতে হয়। সারা জঙ্গল সরগরম হয়ে আছে পাখির ডাকে, ঝিঁঝির আওয়াজে। কোলকাতায় ইঁট কাঠ এর মধ্যে বসে হাওয়া তবু এক আধবার পাওয়া যায় কিন্তু এই যে জঙ্গুলে বুনো গন্ধ আহ কতদিন পরে পারফিউম, খাবার, আবর্জনা এসবের বাইরে কোনো গন্ধ পেলাম। খুব শান্তি লাগছে,  ফোনে টাওয়ার নেই তাই ফোন চেক করার বদরোগও নেই। বাড়িতে বলেই এসেছি টাওয়ার থাকবে না আর কেউ চিন্তা করবে না ফোনে না পেলে।
এলোমেলো খচাং খচ করে ছবি তুলছি, আস্তে আস্তে এগোচ্ছি। ওরা খানিকটা এগিয়ে গেছে। কুয়াশা মাখা জঙ্গল এক অদ্ভুত আদিমতা তৈরী করেছে। কি এক গভীর রহস্য যেন লুকিয়ে আছে, পথ ছেড়ে বেপথে পা দিয়ে দেখলেই যেন খোঁজ পাওয়া যাবে তার। 

এসময় হঠাৎ বনে হাওয়া দিয়ে গেলো, পাতায় জমে থাকা জল শিশির টুপটুপ করে ঝরে পড়লো গায়ে মাথায়। গাছেদের সমাজ মানে জঙ্গল যে অনেক উন্নত সে তো আমি জানিই। আমার মনের কথা টেলিপ্যাথিতে নিশ্চিত বুঝেছে, তাই এ আদর।
ঝুম হয়ে একটা ভেজা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।হঠাৎ শুনি খোকাটি মিংমা আর বাচ্ছা শেরপার সাথে হাঁক দিচ্ছে ভাই কোথায় গেলিরে। ধ্যার বাবা দিতে হয় এটার কানের গোড়ায়। আমি যদি ভালুকের পেটেই যাই যেতে দে তো বাবা শান্তিতে। যাকগে তক্ক করে খালি মেজাজ নষ্টই হবে তাই কথা না বাড়িয়ে ফের এগোলাম।

মেঘের আড়ালে ওই যে বাড়িটা ওটাই বুঝি গুরসকুঞ্জ? বেজায় ভালো তো? বরদার গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। আহা একটা পেত্নী টেত্নী থাকলে খারাপ হতো না। মুশকিল হলো আমি শরীরকে একটা যন্ত্রই ভাবি, আর ব্রেনকে তার কন্ট্রোলার। হতে পারে সেই মস্তিষ্কএর অনেক কিছুই অজানা আমাদের কিন্তু তাই বলেই একটা এক আউন্সের আত্মা জাতীয় কিছু ভুস করে শরীর থেকে শরীরে বিরাজমান হয়ে বেড়াবে এ আমি ভাঙ খেয়েও হজম করতে পারবো না। তাই পেত্নী যে আসবে না তা আমার জানাই।  তাতে কি,  আমি যখন একা একা এখানে ঘুরবো রাক্ষুসে গাছ, রহস্যময় কুয়াশা, কোনো বিদেহিনী, সাপের মাথার মণি সব আবিষ্কার করব।

চা খেয়ে বেরোনো গেলো। খোকাটি আমার সাথেই আসছিলো, কিন্তু বকবক করে কানের মাথা খাচ্ছিলো বলে আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ভাই তুই ওদিকটা যা আমি এদিকটা একটু একা ঘুরে আসি। বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই কি বলল আমায়!! বলে, ভাই তুই এরকম চুপচাপ আছিস কথা বলছিস না বেশী সুইসাইড ফাইড করে ফেলিস যদি তাই একা ছাড়ছিনা, মানে বুঝতেই পারছিস আমিও এসেছি এক সাথে কেস খেয়ে গেলে!! শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝলাম না, বললাম,  ভাই আমার বাড়ির কাছে গঙ্গা আছে মেট্রো আছে সেসব ছেড়ে এখানে আসব কেন বলতে পারিস? তুই চল তোকে মিংমার সামনে রেখে আমি ঘুরতে বেরোই তাহলে আমি মরলেও তোকে খুনের দায়ে কেউ ধরবে না!!
তাকে ছেড়ে এসে নিজের মনে এগোচ্ছি,  দেখি একটা লাল আর একটা সাদা কুকুর আমার পিছন পিছন আসছে। মহা ঝঞ্ঝাট!  আমায় কি মহাপ্রস্থান এর যুধিষ্ঠির ঠাওরালো নাকি সব? নকুলকে কাটাই তো ডবল ধর্মরাজ! আমি আবার একটু অধার্মিক কিনা তাই ধর্মরাজদের নিজের আশেপাশে ঠিক ভালো চোখে দেখিনা। উদাস মুখে আড়চোখে দেখলাম ব্যাটারা চলে গেলো হেঁউমেঁউ করে। যাক বাবা! রাস্তায় ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে, বোঝাই যায় টুরিস্টকাল শেষ। একটা স্ট্রবেরীর মতো দেখতে ফল। বর্ষাকাল ছোট ছোট পাখি জন্মেছে অনেক। কিচিরমিচির করে ডেকে ডেকে ওড়া প্র‍্যাক্টিস করছে। আমি দু এক বার ছবি তোলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ও আমার দ্বারা হবার না। তার চেয়ে এই এখানটায় শুই লম্বা হয়ে পাথরের উপর। নীচে গাছ পালার ফাঁকে গুরসকুঞ্জ দেখা যাচ্ছে। জঙ্গলের আওয়াজ মাথার উপর নেমে আসা মেঘ নিয়ে আমি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।  টুপটুপ করে বৃষ্টি শুরু হতে ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে হাঁটা দিলাম।  খিদেও পেয়েছে মন্দ না।   (ক্রমশ...)



Sunday, June 25, 2017

জল জঙ্গল পাহাড়ের গল্প

প্রেমে পড়া ব্যাপারটা কে কিভাবে বোঝে জানিনা,  আমি বুঝি বিরহে। মানে প্রেমে পড়েছি এটা বুঝতেও আমায় তার থেকে দূরে যেতে হয়। পাহাড় ব্যাপারটা যেমন , খুব ইনটারেস্টিং লাগেনি ছোটবেলায়, এক তো আমার বমি পেতো পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে, তায় একই রকম দৃশ্য মনে হতো। সব মিলিয়ে পাহাড়ের থেকে সমুদ্রেই ছিলো বেশী পছন্দের বা জঙ্গল। এমন কি উত্তরাখন্ড এর অমন চমৎকার দৃশ্যপট,  গ্যাংটক বা পেলিং থেকে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা ( দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমি কখনোই দেখতে পাইনি) কিছুই আমার মন কাড়তে পারেনি। প্রেমে পড়েছিলাম  হিমালয় এর চেয়ে অনেক কম কুলীন রকিজের। কলোরাডোতে দু বছর থাকতে থাকতেই কখন পাহাড়ের প্রেমে পড়েছি টের পাইনি। পেলাম ওখান থেকে ফিরে আসার সময়, ফিরে আসার পরে।
দেশে ফিরেছি আট মাস হয়ে গেছে এর মাঝে একবারও পাহাড়ে যাইনি। বেশ কিছুদিন ধরে মন খারাপ করছে আর পাহাড়ে হাঁটছি দেখছি। মার্চের অযোধ্যা যাওয়া হলো না, এপ্রিলের রডোডেনড্রন দেখা হলো না ভার্সেতে। শেষমেশ দুত্তোর নিকুচি করেছে যাবোই পরের সপ্তাতেই যাবো বলে কচাত করে ট্রেনের টিকিট কাটা। স্বাভাবিকভাবেই ওয়েটিং লিস্ট কিন্তু ভাগ্য ভালো সঞ্জয়দা সে টিকিট কনফার্ম করে দিতে পারবে জানিয়েছিলো। টিকিট কেটেছিলাম টংলু ট্রেক করবো বলে। একা একা পাহাড়ে হাঁটছি স্বপ্ন দেখতে দেখতে কোড করছি, ফেসবুক করছি, আড্ডাচ্ছি, পারলে এ সপ্তাতেই চলে যাই। হঠাৎ পাহাড়ে গোলমাল শুরু হয়ে গেলো। বনধ অবরোধ কিছুই বাকি নাই। টংলু দার্জিলিং শহরে না পড়লেও ওই রাস্তাতেই। তবু আমি জানি আমি যাবো। অফিসে বাড়িতে সব জায়গায় বলছি আমি দার্জিলিং তো যাচ্ছিনা অসুবিধে হবেনা। বুকিং তো কোথাওকার নেই একা মানুষ কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়েই যাবে এ আশায়। তাছাড়া এখন তো জানিও না কোথায় যাচ্ছি, মনে মনে কিন্তু জানি টংলু যাওয়া চাপ আছে। অল্টারনেট হিসেবে জয়ন্তী মহাকাল ট্রেক করা যায় কিন্তু জঙ্গল বন্ধ থাকবে আর উপায় হলো ভার্সে ট্রেক করা। ভার্সে মার্চ এপ্রিলেই ভালো কারন রডোডেনড্রনের সময়, তাছাড়া আকাশও ক্লিয়ার থাকে সে সময়। কিন্তু বর্ষায় পাহাড় জঙ্গলের আলাদা মজা আছে।
টিকিট লাস্ট মোমেন্টে কনফার্ম হবে এমারজেন্সি কোটায় মানে যদি হয়, কোথায় যাচ্ছি এখনো জানিনা,  পাহাড়ে নাকি বেজায় গন্ডগোল, শিলিগুড়ির মুখেই আটকে দিলে আর কিছু বলার নেই। এরকম অবস্থায় ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে নিতে গিয়ে খেয়াল পড়লো আমি রুক্স্যাক কিনিনি, জুতো জোড়াও ঠিক বর্ষায় হাঁটার উপযুক্ত না। তা এতো ভেবে চললে তো হয়েই যেত। জোঁক ইত্যাদি অগ্রাহ্য করে বর্ষায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করার কথাই ভাবতাম না। সুতরাং চলো মুসাফির উঠাও গাঁঠরি, ইয়ে মানে ব্যাকপ্যাক।

শুক্রবার দিন সকালেই দার্জিলিং এর পরিবেশ আরো খারাপ হয়ে উঠলো সুতরাং ভার্সের রুটটা দেখে নিলাম একবার। অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে যাবো। সেই মতো গাব্দা ব্যাগ নিয়ে অফিসে হাজির,  অফিসে পৌঁছে খেয়াল হলো আমি ক্যামেরা আনিনি,  পাওয়ার ব্যাঙ্কটাও না। অতএব ফের বাড়ি।
ঘটনাচক্রে আজ আষাঢ় এর পয়লা।  যক্ষ টক্ষ ভেবে মেঘভায়া আবার না থাবড়া লাগায়,  "গতবার খুব খাটিয়েছিলি ভাই ইয়ার্কি পায়া ফের আয়া" বলে।

ভার্সের রাস্তা এম্নিই খুব পপুলার টুরিস্ট স্পট না তায় অফ সিজন। জোড়থাং অব্দি গাড়ি পেলাম না।  একটা গ্যাংটক যাবার গাড়িতে বসে মল্লি। মল্লিতে নেমেই মন টন ফুরফুরে হয়ে গেলো। কি চমৎকার নীল আকাশ, পাহাড়ে মেঘ নেমে আসছে নীচ দিয়ে তিস্তায় বর্ষার ঘোলা জল বয়ে চলেছে। আমার কোথাও পৌঁছনোর তাড়া নেই তাই চুপ করে রাস্তার ধারে খানিক্ষন বসে রইলাম। সৌগতদা ফোন করে খোঁজ নিলো ওয়েস্ট বেঙ্গল পেরিয়ে গেছি কিনা, সব সহি সালামত আছে কিনা।




পিঠে ব্যাগ গলায় ক্যামেরা ট্যুরিস্ট ছাড়া আর কি কিন্তু এ সময় পাহাড়ে ট্যুরিস্ট তাও এরকম অফরুটে! লোকজন দেখি নেপালি ভাষায় কিসব বলছে আমায় দেখে, যাকগে মরুগগে আমায় নিয়ে গেলেই হলো জোড়থাং।

মল্লি থেকে জোড়থাং এর রাস্তা খারাপ। বৃষ্টি পড়ছে না,ধূলো উড়ছে। পাশে একটা বাঙালী, টুরিস্ট না, ব্যাবসার কাজে এসেছে, যথারীতি বাঙালসুলভ কৌতূহল। কত বয়েস, কি করি, একা কেন, বিয়ে করলে আর একা ঘুরতে হয়না, বউ থাকলে কত ভালো লাগে এসব জায়গা এইসব শুরু হলো। বোর হচ্ছি বোঝাতে কানে হেডফোন গুঁজতেও পারছিনা, এক তো চার্জ যথা সম্ভব বাঁচাতে হবে তাছাড়া গাড়ির সিট একেবারে টাইট ফিট। নড়া চড়া করার উপায় নাই। খুব অভদ্রভাবে জানলা দিয়ে বাইরে থাকিয়ে রইলাম শেষঅব্দি।

জোড়থাংেও বেশ ভালোই গরম দেখছি। এটা আসলে একটা জংশন টাইপ। সব জায়গাতে গাড়ি যায় এখান থেকে, মানে ওয়েস্ট সিকিমের নানান জায়গায়। গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করছি এদিক সেদিক, একটা গাড়ির লোক কোথায় যাবো জেনে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, 'ও ওখ্রে? পিডি ভাই যাবে গাড়ি আছে। দাঁড়াও ফোন করো তো এ নাম্বারে। তার নাম নামডিং। দিব্যি ফূর্তিবাজ লোক। আমার ফোন থেকে কল করে পিডিভাইকে খানিক চমকালো, 'কি হে গাড়ি কই তোমার হ্যাঁ? খালি ফাঁকিবাজি, ফাইন নেবো'।  যাহোক পিডিভাই তখন গাড়ি সারাচ্ছিল। গাড়িতে ব্যাগ রেখে আমি চক্কর খেতে বেরোলাম। গাড়ি সারাতে সময় নেবে।
চারদিক পাহাড় ঘেরা ছিপছিপে জনপদ। গাছপালার মধ্যে মেঘ এসেছে একদিকে অন্যদিকে ঝকঝকে নীল আকাশ। এরম আকাশ কোলকাতায় কেন দেখা যায়না কে জানে। অবস্থান গত কারন হবে বোধহয়। ছোট ছোট দোকান, বেকারির জিনিস বেশি দেখছি। আমার খিদে পেয়েছে কিন্তু কি খাবো বুঝতে পারছিনা। ভাত খাবার ইচ্ছে নাই, মোমো বলছে ভেজ হবে খালি। এদিকে আমার ভেজ খাওয়া মানা,  দীক্ষা নেওয়া আছে কিনা। শেষব্দি একটা কোল্ড কফি কিনে কেক খেতে খেতে এগোলাম খানিক। বেশী দূরে যেতেও ভরসা হচ্ছে না, আদতে তো সেই শহুরে সন্দেহবাতিক লোক। পাহাড়ের ইনোসেন্স আর পাবো কোথায়। ব্যাগ টা গাড়িতে আছে, যদি গাড়ি ছেড়ে দেয় এইসব আজেবাজে চিন্তা টুকটুক করে হানা দিচ্ছে দেখি। নিজেকেই এক ধমক লাগালাম, ভাগ ব্যাটা কি আছে তোর ব্যাগে হ্যাঁ,  গামছা টর্চ মোমবাতি লাইটার ব্রাশ জ্যাকেট রেনকোট (তাও তোর মাপের) নিয়ে কার কি হবে রে পাগলা। ব্রিজ অব্দি ঘুরে এলাম। একটা মাত্র মিষ্টির দোকান আর সেটাও কোনো বাঙালীর না একজন মাড়োয়ারি ভদ্রলোক ভুঁড়ি বাগিয়ে বসে।
পিডি ভাই বেশ হাসিখুশি লোক। নামডিং কে বলল আরে বাচ্ছা পেসেঞ্জার নিয়ে এসেছ দেখি। তার গাড়িতে আরো দু তিনজন উঠলো। বকবক করতে করতে চললাম। চলতে চলতে দেখি নীচে রঙ্গিতের উপর ড্যাম না কি হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতে বলে আরে সিকিম তো সুইজারল্যান্ড হচ্ছে জানোনা। আমি একটু বোকা হাসি হাসছি, মানে হবে হয়ত, হতেই পারে। দেখি বলে আরে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, নির্বাচনী প্রচারের সময় বলল আমাদের ঘর সিকিমকে সুইজারল্যান্ড বানাবে তারপর সুইজারল্যান্ডএ নিজের ঘর বানিয়ে নিলো, হোলো না সিকিম ইজ সুইজারল্যান্ড? বলে আমার দিকে চোখ মটকে দিলো।

এ গাড়িটা শেয়ারের গাড়ি, সব শরিকি জিনিসের মতোই ভারী ক্যাজ হাবভাব। আমারো তাড়া নেই গাড়িরও। একজন বাড়িতে ব্যাগ ফেলে এসেছে সুতরাং দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা উচিত। একজনের একটা বস্তা নিয়ে যেতে হবে উপরে( আহা উপরে মানে স্বর্গে না রে বাবা,  ওখ্রেতে),  তাই গাড়িটা একটু ঘুরিয়ে নিলো। একজনের বাজারে একটু কাজ আছে তাহলে কি তাকে ফেলে চলে যাবে নাকি? তারপর সে যাবে কিভাবে? সুতরাং সেখানে হল্ট, চা পানি খাও না।  চারদিকে মেঘ নেমে এসেছে, বেকারির গন্ধ আসছে দেখো খাও হাত পা ছাড়াও। এমনি ট্যুরে এলে হয়ত বিরক্ত লাগত কিন্তু আমার বিরক্ত লাগছে না। ঘুরছি এলোমেলো, গল্প গুজব তেমন হচ্ছে না কারন ইচ্ছে করছে না। আকাশ দেখছি, নদী দেখছি। এরকম টুকটুক করে পৌঁছে গেলাম একসময়। তখন সূর্য নেমে গেছে। মেঘ নেমে এসেছে চারদিকে। পিডি ভাই আমায় ওর বাড়ি নিয়ে গেলো আগে তারপর ও ওর বোনের হোমস্টেতে নিয়ে যাবে।
পিডি ভাই এর বাড়িতেও হোমস্টের ব্যাবস্থা আছে। বাবা মা, বউ বাচ্ছা মিলে সংসারী মানুষ পিডি ভাই এর এরকম একা একা বাউণ্ডুলে ট্যুরিস্ট দেখে খুব অবাক লাগছে বুঝতে পারছি।  খালি বলছে 'একা একা এত্ত দূরে চলে এলে হ্যাঁ বাহ বাহ। আমিও ট্রেক করেছি একবার'। ওর বাড়িটা একটু নীচে, পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে হয়, আলু ভুট্টার চাষ করেছে একটা কুকুর বাঁধা। সব মিলিয়ে সম্পন্ন পাহাড়ি।  চা খেতে দিলো। এখানে বলে না আমি বেশীর ভাগ জায়গায় দেখেছি চা এর মধ্যে একগাদা চিনি আর দুধ দিলে সেটা খাতিরের চা বলে ধরা হয়। এখানেও দিলো ওরম গরম দুধের সরবত।  চা না বলে তাকে যদি মালাই কুল্পি বল্লেও চলে এমন জিনিসও জ্যাক ড্যানিয়েল খাচ্ছি মুখে খাই তবুও।
একটা আপেল গাছ বসিয়েছে পিডি ভাই, কলকে ফুলের মতো কি একটা বুনো ফুল ফুটেছে পাশেই একটা জংলা গাছে, সারি সারি ভুট্টা ফলে আছে, ফুল হীন রডোডেন্ড্রন গাছ দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে মন ভালো হতে শুরু করেছে। বেশীক্ষন বসিনি,  মনস্ট্রিতে প্রার্থনা শুরু হয়ে যাবে, বোনের ওখানে পৌঁছতে হবে।
মনস্ট্রীতে পৌঁছতে পৌঁছতে সুর্য্য আরো নেমে গেছে।চারদিকে মেঘের ফাঁকে অল্প আলো আসছে। ভোঁ ভোঁ, প্যাঁ পোঁ করে নানান রকম আওয়াজ আর প্রার্থনা সঙ্গীত ভেসে আসছে। এর আগে আমি কখনো প্রার্থনার সময় কোনো গুম্ফায় থাকিনি। ব্যাগটা ঘরে রাখতে গিয়ে জানলাম আমার মতোই আরেকটা ছেলে একা একা এসেছে ট্রেকে। হাই হ্যালো টাইপ করে তাড়াতাড়ি চা নিয়ে গেলাম গুম্ফায়। সাধারণত পুজোর সময় কিছু খাওয়া মানা থাকে বলে আমি ইতস্তত করছিলাম ঢুকবো কি ঢুকবোনা বলে,  কিন্তু আমায় দেখে বাচ্ছা লামা গুলোই ডেকে নিল। ওরা একটা কাপে গরন জল খায় আর প্রেয়ার করে!!  এর যে কি মানে কে জানে। যাই হোক আমি চা হাতে একদিকে পা মুড়ে বসেছি। হ্রুম ক্রুম করে অদ্ভুত দর্শন বাজনা বাজছে আর মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে। যার পুজো হচ্ছে সে ভদ্রলোজ বেশ ভয়াল দর্শন, কি যেন নাম বলল ভুলে গেছি। বুদ্ধদেবের শান্ত রূপ বোধায় পুজোর জন্য পারফেক্ট না। হিন্দু ধর্ম বৌদ্ধ ইনফ্লুয়েন্স যেমন বৌদ্ধও তাই বোধহয়। আমাদের কালী যেরম ভয়াল দর্শন (সে শ্যামাসংগীত এ যতই নরম সরম করে প্রকাশ করুক, হাতে কাটা মুন্ডু নিয়ে জিভ বের করা কাউকে দেখলে অপরিচিত কারোর কাছে ভয় না লাগার কিছু নেই, আমাদের অভ্যেস হয়ে চোখ সয়ে গেছে তাই) ওদেরও বহু আরধ্য এরম ভয়ানক রূপের। গুম্ফার ভিতর আলো অল্প, লোডশেডিং চলছিলো, বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সঙ্গে বাজনা আর তিব্বতি ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ সব মিলিয়ে অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ। নেহাত লামারা সবাই বাচ্ছা তাই নাহলে ভিতরে বসে থাকতে ভয় লাগতো হয়ত।

আশপাশে খুব কিছু দেখার ছিলো না সে মুহুর্তে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, পরের দিন ভার্সে যাবো সে প্ল্যানিং করতে ভিতরে গেলাম প্রার্থনা শেষ হতে। আমার প্ল্যান ছিলো,  হিলি থেকে ভার্সে ট্রেক করে ভার্সেতে থাকা। পরেরদিন ডেন্টাম নামবো ভার্সে থেকে ট্রেক করে ডেন্টাম। ওই রাস্তাটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, ছোট খাটো কিছু পাহাড়ি নালা পেরোতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো এটা বর্ষাকাল, তাই কতটা গাইড বা রেঞ্জার রাজী হবে বলা মুশকিল। বর্ষা কাল প্রজননকাল পশু পাখিদের, ফলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেলে তাদের অসুবিধে হবেই। ধরা যাক মা ভাল্লুকি ছানাপোনা সহ পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে, আমি পড়লাম সামনে। এবার ভালোবেসে কি রে ছোকরা খবর কি, বলে হ্যান্ডশেক করলেই চিত্তির। যাই হোক কাল ভাবা যাবে সে কথা, আপাতত এটা জানানো হলো ভার্সে যাচ্ছিই আর ওখানে থাকবোও। আরেকটি যে ছেলে এসেছে সেও যাবে। হোটেল তো বন্ধ করে বন্ধু শেরপা নেমে এসেছে, ফলে দুজন লোক দিয়ে আমাদের সাথে পাঠাবে ফের ভার্সের ট্রেকার্স হাট গুরসকুঞ্জ খুলতে। কথাবার্তা বলতে বলতেই 'বেহেনজি' খাবার নিয়ে এলো। ভাত ডাল তরকারি মুলোর আচার আর মুরগির ঝোল। ছোট ছোট চালের গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত তরকারি অমৃত সমান,  তাকে উপেক্ষা করে কাল কি করা হবে সে আলোচনা আর যেইই পারুক আমি পারিনা। সুতরাং আঅাক্রমঅঅন। আমি এমনিতে কিঞ্চিত কম খাই, মানে একবারে অনেকটা খেতে পারিনা।    কারোর বাড়ি গেলে ভারী বিব্রত হই, তাঁরা ভাবেন তাদের খাবার বোধহয় পছন্দ হয়নি বা আমি লজ্জা পাচ্ছি। তা হোটেলে রেস্তোরাঁতে সে চাপ হয়না, কে কি খাচ্ছে কে দেখে। কিন্তু এ দূর দেশে এরম দিদি থাকে জানব কিভাবে। আমাদের খেতে দিয়ে উনি আর ওনার দুই বোনঝি পরিবেশন করছিলেন। আমার খাওয়া দেখে রীতিমতো হাঁ হাঁ করে বকে দিলেন। একে তো একা একা এরকম এসেছি তাতে যদি না খাই ঠিকমতো কিভাবে চলবে, দুবলা হলে হাঁটবোই বা কিভাবে সুস্থই বা থাকবো কিভাবে! সত্যি কথা বলতে কি, পরের বাঁক গুলো দেখা যায়না বলেই বোধায় জীবন এত ইন্টারেস্টিং। কোন পাহাড়ে আলো ছায়ায় আমার জন্য এমন স্নেহের ভান্ডার, এমন ভালোবাসার বকুনি বসে আছে কে জানত। কিছু জোরের কাছে হারতে মন্দ লাগে না তা সে তুমি যতই গোঁয়ার হও....
(ক্রমশ)

Sunday, June 11, 2017

গরমকালে

শীত যখন গরমকে চমকায়, মেরে পাস কড়াইশুঁটিরর কচুরি হ্যায়, পিকনিক হ্যায়, লেপের আরাম হ্যায়, মোয়া হ্যায় তেরে পাস কুমড়ো, ঢ্যাঁড়শ আর ঘাম ছোড়কে ক্যা হ্যায় রে পাগলা? তখন গরমকাল একটা উদাস হাসি দিয়ে বলে, দুপুরববেলার ঘুঘুর ডাক হ্যায়, রাতের দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া হ্যায় আর সর্বপরি আম হ্যায় রে পাগলা আম হ্যায়।
তিনবছর জমিয়ে আম না খাওয়ার শোক এ বছর গরম কাটিয়েছে। হুলিয়ে আম হয়েছে আর আম সেবা করছি (সাধক তো তাই খাই না, সেবা করি মাত্র)। সকালে চিঁড়ে দই আম লিচু, দুপুরে শেষপাতে খান দুই আম, রাতেও শেষ পাতে সেম ব্যাপার। আলাবেজার নাই কোনো। আর আমাদের গাছে এবার তেরে আমও হয়েছে সাধুসেবার জন্য।
আমার বাবা যেহেতু আমার থেকেও বেশী একবগগা হবে স্বভাবিক। প্রতি সপ্তায় গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে, নিজের হাতে লাগানো গাছের আম নিয়ে আসার জন্য। আমি দু একবার বলার চেষ্টা করেছি, কি দরকার কুড়ি টাকা কেজি আম তো এবার। তাতে আমি কত অপদার্থ তাই কুঁড়েমি করে নিজের গাছের আমের স্বাদ কে বাজারের আমের স্বাদের সাথে তুলনা করি, তা জানিয়ে বড়বাবু । যেন বাজারে আম আসে মঙ্গল গ্রহ থেকে!!
সাতসকালে উঠে তাই এট্টু চা পানি খেয়েই ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে যেতে হলো। মাত্র দশটা বাজে এরমধ্যেই বাজারে আর মাছ নাই!! অদ্ভুত তো! এরপর খালি ব্যাগে ফিরে গেলে ভদ্রলোক বলবেন, আমি জানতাম। ও বাজার করে মাছ আনবে তাহলেই হয়েছে! প্রায়ই আনি সেসব পরিসংখ্যান তখন খালের জলে ভেসে যাবে।
মরা মাছ নিয়ে যাওয়া যাবে না। আরে বাবা মাছ তো মেরেই খাওয়া হবে নাকি? ভাজলে কি সেটা জ্যান্ত থাকে? কে বলবে এসব হুহ। চিংড়ি গুলো লাল হয়ে গেছে, এ জিনিস পচা তা আমিই বলে দিতে পারি। 
উপায় কি? ওই খোকা ইলিশ আমি কিনবো না, এইত্তো পেয়েছি। কই মাছ মরেনি। আহা ভাগ্যিস! আর এই যে গুড়জাওলি মাছ। এ মাছ তো মরাই হয়। সবজি আর মাছ দুটো আলাদা হাতে থাকলে নিজের পিঠ নিজে চাপড়াবো কিভাবে, তাই এক হাতে নিয়ে (মনে করে ঘরে ঢোকার আগে আলাদা করে নিতে হবে), নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। ওয়াহ পাগলা ওয়াহ।
পুরোনো আনন্দমেলা খুলে বসেছি , দুলেন্দ্র ভৌমিক , সঞ্জীব, অদ্ভুতুড়ে । বড়মায়া জড়ানো কৈশোর ছিলো । এখনো আছে নিশ্চয় , তবে এখনকার বাচ্ছারা ভারী স্মার্ট তাদের বন্ধু লাগে কিনা কে জানে। আমি ওই কৈশোরে স্বপ্ন দেখতাম , হারাধনের মতো , বুলেটের মতো বন্ধু হবে, পাগলা সাহেবের কবর খুঁজে পাবো কোনোদিন, আমার মতো এলেবেলে লোকেও নির্ঘাত কিছু একটা করে ফেলবে ।
করতে পারিনি কিছু কিন্তু স্বপ্ন দেখাটা শিখে গেছি , তাই আমার এখোনো ঘুম না এলে ওষুধ লাগে না, স্বপ্ন লাগে, যে স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না হয়ত কিন্তু সে নিয়ে কি আসে যায় ।
দুপুরে খাঁ খাঁ রোদ আমার বড় প্রিয়...গরমের দুপুর, সঞ্জী্‌ শীর্ষেন্দু , অভিযান স্বপ্ন , আম লিচু সব মিলিয়ে গরম কালটাই ভালোবাসি বেশী ।