Friday, November 26, 2021

মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে

 নষ্ট ব্যপারটা একেকজনের কাছে একেকরকম। মাস গেলে বিশাল বড় কোনো পদে থাকা লোকের কাছে এক সপ্তা কাজ না করর ঘুরে বেড়ানো হল সময় নষ্ট, কারোর কাছে গান শোনা সময় নষ্ট কারোর কাছে গান হীন দিন মানে নষ্ট।  এত নষ্টের কথা এলো কারন, সেদিন শিমলা ম্যালে যেই না ঝুপ্পুস করে মেঘ নেমে এলো আর তারপর পরেই বৃষ্টি, কানে এলো, 'এরকম আবহাওয়া বেড়াতে এসে দিনটাই মাটি'। আমাদের অবশ্য মোটেও মনে হল না নষ্ট হল কিছু। দিব্যি মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল চারপাশটা, তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে সেই কতকালের পুরোনো সব স্থাপত্য উঁকি দিচ্ছে, একদুজন স্থানীয় লোক দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে,চারপাশটা বিলকুল ফাঁকা।জুতো ছেড়ে এখন আমার মোজা ভিজেছে টের পাচ্ছি, শীতে কাঁপছি তার মধ্যে ফূর্তিটা আসছে কোত্থেকে হ্যাঁ? 



আসলেই আনন্দ ব্যপারটার জন্য কোনো উপকরণই পর্যাপ্ত না আবার অপর্যাপ্তও না। কতদিন হয়েছিল আমার মনের ভিতরটা কেমন ভেজা খড় হয়ে পড়েছিল। কিছুতেই লম্বা সময়ের আনন্দ আর হয় না। কিছুতেই আগুন জ্বলে না। তারপর ট্রেনের ভোর এলো, চা, নাস্তা- ব্রেড অমলেট, আলুপরোটার হাঁকডাক, চলন্ত গাছপালায় রোদ দেখতে দেখতে ভিতরের ভেজা খড়টা যে শুকোতে শুরু করেছে তা সত্যি বলতে খুব একটা টের পাইনি। মনের ব্যপার স্যপারই আলাদা মশাই, কখন পাক খেতে খেতে পাহাড়ের উপর আর কখন নীচে টের পাওয়াই যায় না! সে যাক বেড়ানোর গল্পে এসব অবান্তর কথা। তা অবশ্য সত্যি বলতে আমার লেখায় বাঁধ ছিলোও না কখনো তেমন, সাহিত্য না এ স্রেফ কিবোর্ডে টাইপ আর কি।


ট্রেনে করে বাংলা পার হয়েও কিন্তু মনে হচ্ছিলো না ভূ-প্রকৃতি খুব বদলেছে, জলাশয় কম চোখে পড়ছে বা পড়ছে না, তা বাদ দিলে সবুজ ক্ষেত খামার পুরোটাই সঙ্গ দিলো তো দিব্যি। আর আশ্চর্যের বিষয় দেখলাম ট্রেন যখন ব্রিজে ওঠে আর গুমগুম আওয়াজ হয় ঠিক ছোটবেলার মতই উত্তেজনা হয় নদী দেখার। বহু বহু দিন পর ট্রেনে এমন লম্বা জার্নি,  অত সময় পাওয়াই যায় না এখন। মাঝে মাঝে যখন পুরোনো কারোর লেখা পড়ি তিন মাস হাওয়া বদলে কিংবা এক সপ্তাহ আগে থেকে বিয়ে বা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যেত, তাদের ক্ষতি তো কিছু হত না কাজে, আমরা স্ক্রাম স্ক্রাম খেলায় কিই যে মহৎ কাজ  করে দিচ্ছি কে জানে!

 কালকা স্টেশনটা ভারী চমৎকার। খুব বড় কিছু না, কিন্তু ঝকঝকে। পুরোনো দিনের মত করে সাজানো টয় ট্রেনের সামনের স্টেশনের অংশ। এক গাদা পাখি শেষরাতের যাত্রী, হকার সবার মিলিত হাঁকডাকের সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাতে লেগেছে। আরে আবার বৃষ্টি এলো দেখছি!এমনিতেই কোভিডের কারনে মা বাবাইকে নিয়ে বহুদিন বেরোইনা, তাছাড়া আমার বাবা পাহাড়ে একটু ভয় পায় তবু পাহাড়ে এসেছি। এর মধ্যে বৃষ্টি ভয় দেখায় খানিক। উত্তরাখন্ডে বিপর্যয় চলছে, আমরা যখন হিমাচলের দিকে পা বাড়িয়েছি, হালকা চিন্তা আছেই।তার মধ্যে বেরোনোর দিন সকালে মায়ের হাতে গায়ে ফুটন্ত জল পড়েছে। আর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এত চিন্তা  সমেতও চিন্তা গুলো তেমন হুল ফোটাতে পারছে আনন্দে। মানে এই যে শিবালিক ছাড়ল, আমাদের পাশে পাহাড়ের দেওয়াল আর মায়েদের ওদিকে দিব্যি বিস্তীর্ণ এলাকা তাতেও কি দমলাম নাকি(অথচ আমরা আমাদের সিট ছেড়ে এসেছি ওদিকের)। ছেলেমানুষ হয়ে টাকমাথা টিটিকে বলা গেল সিট বদলাতে, সে ব্যাটা ঝিমুলো তবু শুনলো না, মানুষ এমতাবস্থায় কী করে? চুপ করে বসে থাকে আর যা পাওয়া যায় তাই দেখে কিংবা মন খারাপ করে তো? আমরা দুজন একটুও না দমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম চারপাশ, জানলায় নাক ঠেকিয়ে কিংবা দরজা খুলে দেখলাম কেমন টানেলে ঢুকছে ট্রেন বা পুলের উপর দিয়ে বাঁক নিচ্ছে! তারপর দেখি একজন লোক ভালো দিকের জানলায় বসে ঘুমোচ্ছে, তার সিটে বসতেই বাপ্রে কী ঘুম পেলো!!! মানে অবস্থাটা ভাবুন, আপনাকে বললাম দাদা আপনি ঘুমোচ্ছেন তাহলে আমি এখানে বসি? বসে আমি পাঁচমিনিটের মধ্যে ঢুলতে শুরু করলাম!! একে কাউকে সিট বদলাতে বলাই আমাদের কাছে দুঃসাহসিকতম কাজ তায় সেই সিটের মর্যাদা না রাখে ঘুমিয়ে পড়ায় লজ্জায় আমাদের  আমাদের জন্য সীতার পাতালপ্রবেশ এর মতো কিছু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তা কলিকালেও এসব আছে হে, অবিশ্বাসীর দল, না হলে ফস করে বারোগ স্টেশনটা চলে আসতো না। কালকা শিমলার এই যাত্রাপথের মাঝে মাঝেই ছবির মতো সুন্দর সব স্টেশন পড়ে। শিভালিক এক্সপ্রেস সব জায়গায় থামে না এই একটি স্টেশনেই থামে। বারগের আগে একটা স্টেশন দেখেছিলাম পাহাড়ের বাঁকে,  ট্রি হাউস আছে একটা।ওখানে থেকে যাবার ইচ্ছে মনে আসতে আসতেই পরের টানেলে চলে গেছি। বারগে খাবার দাবার পাওয়া যায়। সেইইই কোন ভোরে উঠেছি, সিধে কালকা অব্দি জায়গা পাইনি বলে চন্ডিগড়ে নেমে কামরা বদলে আবার একই ট্রেনে উঠে আসা। খিদে পাবে না হ্যাঁ! আর এরকম একটা বৃষ্টি ধোয়া ঝকঝকে স্টেশনে যদি চা, ভেজ কাটলেট, (আসলে কাটলেটের আকারে আলু টিক্কি বলা যায়, যদিও খেতে চমৎকার) ,  চানা বাটোরা(সাত সকালে অম্বলের ভয় ছিল কিন্তু এ জিনিস আলাদা খানিক আমাদের এখানকার থেকে) ইত্যাদি মেলে তাকে না করলে পাপ লাগে। খামোখা পাপের পথে যাবার থেকে খাওয়াই ভালো। 



তারপর তো টানেলের অন্ধকার,  বনের পথের মধ্যে দিয়ে দিয়ে পৌঁছনো গেল আরেক ঝকঝকে সুন্দর স্টেশনে। আহাহা এমন সুন্দর করে রাখতে তো খুব পয়সা লাগে না, আমরা অসুন্দর করে রাখি কেন? 







বিকেলে বৃষ্টি এলো যখন,  তখনই শুনছিলাম আশপাশ থেকে হা হুতাশ। কারো কারো নষ্ট হল আর আমাদের মতো কারো কারো মেঘ জড়িয়ে হাঁটা হল। শিমলা ম্যালে সবাইই গেছে মনে হয়, ইনফ্যাক্ট সকলেই আমায় বলেছিল শিমলায় না যেতে কিছুই নেই। আমি এখনো হাঁ করা টাইপ গেঁয়ো ভূত বলেই হয়ত আমার খারাপ কিছু লাগেনি। দিব্যি ঝকঝকে তকতকে ম্যালের রাস্তা, বেকারি, পুরোনো স্থাপত্য পাশে পাশে। বৃষ্টিতে মেঘেতে লোকজন কম ছিল সেটা একটা আহ্লাদের ব্যপার ছিল তবে আমার পরের দিন বিকেলে ফের গিয়েও দিব্যি লেগেছে। চার্চের মাথায় শেষ বিকেলের আলো,কিংবা সন্ধ্যের মুখে ঝুপঝুপ করে জ্বলে ওঠা স্ট্রীট লাইট,  অন্য স্বাদের বেকারি, ছোট্ট ক্যাফের বাইরে বসে চায়ে চুমুক মন্দ লাগার অপশনই নেই। 





 



হিমাচল ট্যুরিজম এর ব্যবহার, সার্ভিস,  হোটেলের মেইন্টেন্যান্স সব কিছু এত চমৎকার লেগেছে বলার না। আর হিমাচলি থালিটার কথা না লিখলে খুব খারাপ হবে। কুমড়ো যদি এত ভালো করে বানানো যায় তবে এরম বিশ্রী করে খাওয়ানো হয় কেন এরকম একটা প্রতিবাদী প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে। আর ওয়ালনাট পাইটার কথা বলিনি বুঝি? থাক বলে বেশী কষ্ট টস্ট দিয়ে লাভ নেই। একখান ছবি দিয়ে যাই বরং। 


শিমলা থেকে মানালির রাস্তাটা এইই লম্বা। পাহাড়ে আমার গা গুলোয়, কিন্তু মান্ডি পেরোনোর পর থেকে যেই রাস্তার পাশ দিয়ে বিয়াস দেখতে পেলাম অমনি রাস্তা সারাই এর ধূলো উপেক্ষা করে কাচ নামিয়েছি আর অমনিই আমাদের ড্রাইভার যোগীন্দরজি বিড় বিড় করে জানালো ক্লাচ কাজ করছে না! বোঝো!  কিন্তু ওই যে খড়টা শুকোতে শুরু করেছে বলেই হয়ত, তেমন কিছু বিরক্তি হল না। গাড়ি খারাপ হতেই পারে, আমাদের আজ মনিকরন ঘুরে যাবার কথা ছিল তা হবে না আর সত্যি বলতে কি ভালোই হয়েছে। এত  লম্বা পথ একদিনে পাড়ি দিয়ে আবার এদিক সেদিক ঘোরা কষ্টকর হয় তাছাড়া অমন করে   আর যাই হোক পাহাড়, তাও আবার হিমালয়ের মত পাহাড় ঠিক উপভোগ করা যায় না। যে জায়গায় গাড়ি খারাপ হয়েছিল, রাস্তার কি সব কাজ চলছিল, সে কি ভয়ানক ধূলো। তাও আমার হাঁচি টাঁচি শুরু হল না কিচ্ছু। বিয়াস উচ্ছল কিশোরীর মত বইছে। আকাশটা কি নীল! 


কদ্দিন থাকবে এসব কে জানে! মানুষ যেভাবে পাহাড় কেটে চার লেনের রাস্তা বানাতে শুরু করেছে তাতে মনে সন্দেহ লাগে। পাহাড় কাটলে আমার ভারী দুঃখ হয়। কত শিকড় পাথর ,পোকামাকড় মরছে বলে শুধু না, পাহাড় নিজেই ভীষন জ্যান্ত একটা জিনিস। তাকে কেটে কুটে মিলিয়ে দিলে মায়া লাগে,  দুঃখ হয়। একটা লোক খুব চানা বিক্রী করছিল। ধূলোমাখা চানার আলাদা স্বাদ হত অবশ্যই কিন্তু অজানা ধরনের মোয়াও তো বিক্রী হচ্ছিল। জিনিসটা তোফা খেতে কিন্তু কী দিয়ে তৈরী জানতে পারলাম না।  যোগিন্দরজি হঠাৎ ডেকে বলে দেখ দেখি কেমন ফের কাজ করছে ক্লাচ!বোঝো! এ গাড়ি না প্রডাকশন সার্ভার একবার কাজ করে একবার না!  শেষে তার মালিক অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল, ফের উজিয়ে মান্ডি গিয়ে নতুন গাড়িতে করে নতুন রাস্তা ধরা গেল। নতুন রাস্তা কারন এই নতুন ড্রাইভার শৌখিন মানুষ, ধুলোভরা রাস্তার থেকে ঘুরে যাওয়া তার পছন্দের। লম্বা লম্বা পাহাড় পেরিয়ে যেতে যেত চোখে পড়ে আইআইটির মস্ত ক্যাম্পাস নদীর ধারে। সন্ধ্যে নামার মুখে এক পাল ভেড়া আমাদের সামনেই ঘরে ফেরে। 


কুল্লু উপত্যকায় নদীর আওয়াজ শুনতে পেলাম দেখার উপায় নেই, সন্ধ্যে নেমে গেছে, দেখতে পাবো কাল। উফফ সে যা সুন্দরী দর্শনেই প্রেম হবে কিন্তু সে সব তো পরে। এখন অন্ধকারে একটা বিশাল রাজবাড়ির সামনে  নামিয়ে দিল।  অল্প আলোয় হোটেলের বিশাল কাঠের দরজা পেরিয়ে পেরিয়ে একটা একটা মহল পেরিয়ে আমাদের ঘরে পৌঁছনো গেল। মস্ত ঘর,  দোতলা ঘর,ঝোলাবারান্দা, পাথরের বাথরুম। সব মিলিয়ে রাজকীয় ব্যপার বটে। তবে রাজার মেজাজ টের পেয়েছিলাম পরের দিন সকালে।(ক্রমশ)