Monday, February 14, 2022

চাঁদ দেখতে.. গোপালপুর রম্ভা

আমাদের উঠলো বাই তো ঘুরতে যাই এমন না, আমাদের হল ওহ আগের উইকেন্ড বাড়িতে ছিলাম এবারেরটায় না বেরোলে কেমন করে হবে! পড়াশোনা, কাজ, সব গোল্লায় পাঠিয়ে আমরা ঘুরতে চলে যাই। আমাদের "উন্নতি" হয়না, আনন্দ হয়। এবার কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু সে সময়টাও আমরা আনন্দ করে কাটিয়ে দিই।  এমন না আমরা খুব "অফবিট" জায়গা খুঁজে ঘুরতে যাই। আজকাল অফবিটে যা ভীড় অর্থে পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ত ভীড় কম! কদিন আগেই হিমাচল ঘুরে এসেছি, পকেটে টান পরে কিনা বলতে পারবো না, আমার ঝোলায় ক মুঠো চাল আছে সে দেখে আমি বেড়াতে বেরোইনা, ঝোলার খবর নিতে যাওয়ার সময়টা বরং পথের খবর নেওয়া জরুরি বোধ করি। পরে সে যা হবে দেখা যাবে কিন্তু দিন ফুরোলে জিরোনো ছাড়া গতি থাকবে না। মুশকিল অন্য জায়গায়, ছুটি মেলে না সহজে। শহরে জ্যোৎস্না দেখে দেখে বা বলা ভালো না দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত। তাই ঝুপ ঝুপ করে পূর্ণিমা দেখে টিকিট কাটা। একটু নিরিবিলি, বিশেষ কিছু "করার" নেই তাই তাই গোপালপুর আর রম্ভা। গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা দিন ছুটি পাওয়া যেতে পারে, সুতরাং, ঘরে কে থাকে আর। 

হাওড়া স্টেশনে সাউথের ট্রেন ধরার জন্য দাঁড়ালে বেশ অদ্ভুত একটা ফিলিং হয়। এই যে দাঁড়িয়ে আছি সামনেই ছোট ছোট প্লাস্টিকের চাদর পেতে আলাদা আলাদা পরিবার বসে। রাতের খাওয়া চলছে দিব্যি স্টেশনের মেঝেতে বসেই। আমি কি একটু উন্নাসিক হয়ে গেছি? আমি কিছুতেই পারবো না। অবশ্য আমার বাতিক একটু আছে বরাবরই অস্বীকার করে লাভ নেই। কিংবা সেরকম দায়ে পড়ে গেলে খেয়েও নেব কে জানে। খাওয়া দাওয়ার পর বাসন মাজাও হচ্ছে কাছে কল থেকে। এরই মাঝে কেউ ঘুমোচ্ছে প্রেমসে, ব্যাগ পোঁটলা কিচ্ছুর চিন্তা না করেই। ট্রেনের সময় সমাগত, এঞ্জিনের পরে পরেই জেনারেল সম্ভবতঃ,  ভীড়ে থিকথিক করছে সেখানটা। কোভিড এর ভয় মিডিয়ার বাইরে বরাবরই কম, এসব জায়গায় আরো কম স্বাভাবিক ভাবেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেকেন্ড ওয়েভ খানিক মাথা নামিয়েছে। আমাদের আলাদা আলাদা জায়গা পড়েছে এবারে। আমার সাইড লোয়ারের সাথে কেউ সিঙ্গল সাইড আপার থাকলে বদলে নেবো এই আশায় ছিলাম। তা আমার পাশে সাইড আপারে যিনি এলেনে তিনি তো এন্ট্রি নিলেন একেবারে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির খুব খারাপ নকল ভার্শনের মতো। রাত  এগারোটায় সানগ্লাস পকেটে পুরে ধীরে সুস্থে জানালেন,  না তার পক্ষে সম্ভব না কোথাও যাওয়া। বেশ বেশ। এবারে ট্রেনে আবার সবাচ্ছা পরিবারের ভীড় বেশী। আমার ট্রেনে বাচ্ছা থাকলে একটু আতংকই লাগে। অধিকাংশ বাবা মা মুগ্ধ কাজল পরে থাকে। ময়ূরাক্ষীর সিটটাও লোয়ার ছিল, ফলে একজনকে আমার সাইড লোয়ার দিয়ে তার মিডল বার্থটা নেওয়া গেল, কিন্তু কপালগুনে উলটো দিকে একটি বছর চার পাঁচেকের বাচ্ছা সহ পরিবার।  রাত এগারোটায় ট্রেন ছাড়লো, তার মিনিট দশ পনেরো পর ধীরে সুস্থে তারা বাচ্ছাকে খাওয়াতে বসল, বাচ্ছা খাবে মোবাইল দেখতে দেখতে, অবশ্যই লাউডস্পিকার অন থাকবে ফোনের। তারপর ঘন্টাখানেক পর বাচ্ছার বাবা মা খাবে, তারও খানিক পর বাচ্ছার বিছানা করে ঘুম পারানো অব্দি সেই মোবাইল তারস্বরে বাজবে। মোটামুটি একটা দেড়টা অব্দি এসব চলল। ওবাবা সাত সকালে সেই ছানা নাগাড়ে চেঁচিয়ে সবাইকে তুলে দিলেন। তারপর ঘন্টাখানেক মোবাইলে ভিডিও চালিয়ে,  সবাইকে বিরক্ত করে তিনি নিদ্রা গেলেন! 

এদিকে ট্রেন চলতে চলতে দেখি পাহাড় আর হ্রদের মাঝখানের একরাস্তায় এনে ফেলেছে। বাঁ পাশের জানলা দিয়ে তাকালে দেখি ছোট ছোট পাহাড়, আর ডানদিকে তাকালে চিল্কা। ভারী সুন্দর ওই রাস্তাটা। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, জানলার কাচ দিয়ে টুপটাপ চল পড়ছে, বৃষ্টি ধোয়া কাচ দিয়ে নীল চিল্কা দেখা যাচ্ছে। এসেই পড়লাম প্রায় আর একটু পরেই নামবো। ট্রেনের  জায়গাও অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে, ভুবনেশ্বরেই যা নামার নেমে গেছে, বাকিরা সেই দক্ষিন ভারতেই চলেছে। চিকিৎসার কারনেই যায় মূলতঃ,  বাক্স প্যাঁটরা বেশী থাকে, তাদের চোখে মুখে হালকা একটা উদ্বেগ। ব্যবসা বা চাকরির জন্য যাচ্ছে যারা তারা অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক।  আমার মানুষ দেখতে বেশ লাগে। আজকাল মাস্কের কারনে মুখ ঢাকা থাকে ফ্লাইটে, কিন্তু ট্রেনে এত কেউ মানে না। দিব্যি মাস্ককে চোখের ফেট্টি করে যেতেও দেখি, কোভিডে ভয় প্রথম দফায় পেয়েছে লোকে কিন্তু এখন আর সাধারণ মানুষের ক্ষমতা নেই ভয় পাওয়ার। 

ব্রহ্মপুরে নামার লোক বেশী নেই। ট্যুরিস্ট তো কেউ নামলো না, স্থানীয় মানুষ নামলো কয়েকজন। স্টেশনটা বেশ ঝকঝকে তকতকে, ছোট্ট স্টেশন হলে একটা লিফট আছে। বুড়ো কিংবা পায়ের সমস্যায় থাকা মানুষগুলোর কথা ভেবেছে সেটাই ভালো ব্যপার। আমাদের সাথে লাগেজ খুব বেশী না, তবে গোপালপুরে আমরা ঘুরতে এসেছি পুরোনো দিনের মতো হোটেল বুক না করে, আর এখানে হোটেল তেমন কেতের কিছুতে থাকবো এমন প্ল্যানও নেই, তাছাড়া এই কোভিডের চক্করে ট্রেনে লাগেজ দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে এক্সট্রা চাদর বইতে হয়। তাও দরাদরি করে অটোয় না ওঠার মত লাগেজ না। গোপালপুরে যেখানে নামাবে সেখানেই বিচ শুরু, আর হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল। দিব্যি ছিমছাম জায়গা। তবে যে হোটেলে শুরুতে ঢুঁ মারতে গেছি সেখানে একটা ১৭ সিটার গাড়ি এসে থেমেছে, আর যেখানেই থাকি বাপু এখানে না এই বলে  এদিক সেদিক করে একটা হোটেলে আস্তানা গাড়া গেল। সমুদ্রের ধারের হোটেল, এসি আছে যদিও আমাদের লাগবে না, বাথরুমও পরিষ্কার,ঘর দোরও একটু আগে মুছে গেছে কড়া ফিনাইলের গন্ধই বলে দিচ্ছে। সস্তায় ঘুরবো বলে এসেছি এর চেয়ে বেশী আর কিই বা চাই। 

জায়গাটা খুবই ছোট্ট আর শান্ত। ভাতের হোটেল আছে,  যেখানে সস্তায় ভাত ডাল তরকারি মাছ মেলে, ছোটখাটো চাউমিন ইত্যাদির দোকান। সব মিলিয়ে একদম নিরালা একটা সমুদ্রতীরস্থ গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে পান্থনিবাসের দিকে এগোচ্ছিলাম। রাস্তায় লোক নেই বিশেষ, পান্থনিবাস মনে হয় বালিয়াড়ি বাঁচাতেই একটু ভিতরের দিকে বানিয়েছিল। মুশকিল রাতের বেলা ঝাউবন পেরিয়ে সমুদ্রে যেতে দেয় না। তাই এটাকে আমরা থাকার জন্য ভাবিনি। কিন্তু জায়গাটা এমনিতে ভারীসুন্দর। লোকজন নেই, ঝাউবন পেরিয়ে বালিয়াড়ি টপকে সমুদ্রের ধারে উল্টোনো নৌকার পাশে গিয়ে বসা গেল।  সমুদ্রের সাথে প্লেটোনিক প্রেমে আমার চলে না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র বুকের মধ্যে ভরে নেওয়ার স্থৈর্য আসেনি এখনো, তাই জল দেখলেই নামতে ইচ্ছে করে, পায়ের তলার বালিগুলো তিরতির করে বয়ে যায় আঁকড়ে ধরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাতে এই বয়সেও আনন্দ পাই। একটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে একা একা, দূরে এই অবেলাতেও কটা ছেলে জলে নেমেছে।সমস্ত জায়গাটা শান্ত নিঝুম মতো। ওই দূরে দুটো মাঝি ছায়ায়  জিরুচ্ছে। জলে নামাই যাক নাকি? বিকেল হয়ে এসেছে তাতে কি? 
এদের আজ কী যেন উৎসব আছে। এই কার্তিকের পূর্ণিমা উপলক্ষ্যেই। অমন ফাঁকা সমুদ্র সৈকত খানিক বাদেই লোকে লোকে ভরে গেল। তবে এখানকার ভীড়ের চরিত্র কিঞ্চিৎ আলাদা মনে হল। নিজেদের মধ্যে গল্প, আনন্দ করছে বটে, কিন্তু উচ্চকিত কোলাহল যা বিরক্ত করে অন্যকে তা বিশেষ টের পেলাম না। মেলায় মূলতঃ ঝালমুড়ির স্টল, আর না হলে প্লাস্টিকের খেলনা। ভীড়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকলে চোখে পড়বে, ভাঙা এক পরিত্যক্ত  বাড়ি চারিদিকের সাজানো  হোটেলের পাশে দিব্যি দাঁড়িয়ে। এখানে আকাশ এত নীল, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ এতোই জোরালো তার মালিন্য চোখে পড়েনা, বরং মনে হয় যেন ইতিহাস কী বলতে চায়, কান পাতলেই শোনা যাবে কিংবা হয়ত যাবে না। সেসব পেরোলে আরো নানাব রকম পসরা সাজিয়ে লোক বসেছে। ভারী চমৎকার একটা স্থানীয় খাবার খেলাম। অনেকটা ভাপা দই এর মত। শালপাতায় দেয়, দিব্য খেতে। রাস্তাতেও মেলার রেশ। দুপুরে যে ফাঁকা শুনশান রাস্তা দেখেছিলাম বিকেলে তাই ভরন্ত গাছের মতো হয়ে গেছে। খাওয়ার দোকান, মানুষ, আনন্দ। আচ্ছা একটু তফাৎ থেকে দেখে, মানে আমরা যেমন কোনো উই এর ঢিপি,বা মাছের ঝাঁক, কিংবা পিঁপড়ের সারি দেখি, আমাদের যদি কেউ এরকম ভাবে দেখে কিরকম লাগে তার? ঘিনঘিনে? মজার? ভয়ের? 
পূর্নিমা দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু চাঁদ আমাদের ভাসাতে রাজী না এবারে।থেকে থেকেই বৃষ্টি আসছে টিপটিপ করে, মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ। একটু রাতে মেঘ কাটতে শীতের কামড় উপেক্ষা করে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেক্ষন। সীবিচ ফাঁকা হয়ে গেছে ততক্ষনে। জোরালো আলো লাগানো আছে বটে, কিন্তু সমুদ্রে চাঁদের আলো বোঝা যায় বেশ। কেউ কোথাও নেই তেমন। অনেক অনেক পরে পায়ে ব্যথা হয়ে নীচে এসে দুখানা চেয়ার পেতে বসা গেল, একটা শুনশান সমুদ্রের হাওয়া, চাঁদ আর সমস্ত ক্লান্তি উড়িয়ে পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকার আরাম নিয়ে। 
(ক্রমশঃ)