Wednesday, December 27, 2023

চড়ুইভাতি

কাল তুমুল আনন্দে কেটেছে দিন। কেন আনন্দ যদি বলো তাহলে আমি বলব নেশায় ছিলাম বলে।
মদ, গাঁজা, তামাকজাত বস্তু, কোকেন এসবের বাইরে সে নেশা। এতই তূরীয় সে আনন্দ, রাত দুটো অব্দি অর্থহীন আনন্দে ডুবে সাড়ে নটায় খোঁয়ারি কেটেছে। ও হ্যাঁ কী যেন বলছিলাম, আনন্দ। তা সে আনন্দ যজ্ঞের উপাদানে খুব বিজ্ঞাপিত কিছু ছিল না তেমন। আমবাগানে চট, পুরোনো শতরঞ্চি, ছাতা পরা মাদুরে থেবড়ে বসে রাধাবল্লভী আর আলুরদম, বাড়ির বানানো মাফিন, কফি চা খাওয়া।  পিকনিক বাস্কেটে সকাল সকাল সব কিছু গুছিয়ে তুলছে কেউ, মজা পুকুরের পাশে কাঠপিঁপড়ের কামড় খেয়ে ঘুমোচ্ছে কেউ। রোদ পড়া মাঠটায় শুকনো গোবরের পাশে অত্যন্ত অদক্ষ চারজন মিলে ব্যডমিন্টন খেলা। এবং ফের অকারন হাসিতে লুটোপুটি খাওয়া।
আমাদের ইস্কুল কলেজে লাইফ স্কিল শেখায় না। তাই আনাড়ি হাতে পাতা, ঘুঁটে কাঠ ঠেসে দিই উনুনে। উনুন নিভে যায়। পরিত্রাতা হয়ে আসে রান্নামাসী যার বাড়ি এখানেই। উনুনের ধোঁয়ায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে যায়, তারপরেও মহানিন্দে আগুনে কাবাব ঝলসাই, সসেজ সেঁকি। সসেজ, কাবাবের কেউ কেউ উনুনে পড়ে যায়, ছাইমাখা সে মাংসও জলে ধুয়ে ফের সেঁকে খাওয়া হয়। ধুলোয় ধোঁয়ায় এলার্জির কথা মনেও পড়েনা। মনে পড়েনা, স্বাস্থ্যবিধির কথাও। তারপর আগুন নিভু নিভু হয়ে এলে রসুন, কাঁচালংকা ঠাসা বেগুন পোড়ানো হয়। টমেটোও। শীতের পড়ন্ত বেলায়, কলাপাতায় ধোঁয়াওঠা ভাত, বেগুন পোড়া  মুরগীর মাংস আর চাটনি। 
তারপরেও অদ্ভুত চড়ুইভাতি, অদ্ভুত দিন শেষ হয়না। বয়সের হিসেবে তাদের এত অকিঞ্চিকর জিনিসে খুশী হবার কথাই না। কিন্তু তারা হয়তো বড় হয়নি। না হলে রোদ নেমে যাওয়া বিকেলে অমন করে হাসিতে লুটোপুটি খেতে খেতে কান ফিসফিসের মতো বালখিল্য খেলায় মজবে কেন! যাই বলো কান ফিসফিস বড় মজার খেলা। আম আঁটির ভেপু হয়ে যায় কাঠবেবুন। আয়না ভরা দিন হয়ে যায় আয়নায় অশরীরী।  স্বপ্নে পাওয়া দিন হয়ে যায় স্বপ্নাদেশে ঠাকুর পোষা।
ক্রমে গাছতলার আশ্রয় ছেড়ে ঘরে ফিরি। কয়েকজন তখনও নেশায় টইটম্বুর।কম্বল কাড়াকাড়ি করে তারা বই পড়ে, বা সবাই মিলে ফের আইস এজ দেখতে বসে। তারপর নাইন্টিজের যত অদ্ভুত গানের ভিডিও দেখতে দেখতে ফের অর্থহীন মানেহীন হুল্লোড়। নেশায় ছিলাম বলেই মনে হয়। এ নেশায় বুঁদ হতে কী যে লাগে তাও জানিনা, যে পারে সে পারে আর কি। ওই ফিরতি পথে ভাতের হোটেলটার মতো। সে ভাতের হোটেলটা অদ্ভুত। একটা কুকুর একটা বিড়াল একটা মানুষ বুড়ো একটা মানুষ বুড়ি। কুকুর বেড়াল কেউই পোষা না। কিন্তু তাদের মেজাজেই বুড়ো বুড়ি অস্থির। আমাদের খুব নালিশ করল, বেড়ালটার দুধে জল মেশালে বেড়াল আর সে দুধ খাবে না, আর ভাত ফুরিয়ে গেলে যদি অন্য হোটেল থেকে ভাত এনে দেওয়া হয়, তাহলে আর কুকুরটা সে ভাত খাবে না! নালিশ করতে করতেই কুকুর বিড়াল দুজনকেই ডেকে বিস্কুট খাওনো হল।
বলছিলাম না আনন্দের নেশায় কী যে লাগে কেউ জানে না, খুঁজে পেলে মানিক পেলে না পেলে নাই।













Saturday, December 9, 2023

লন্ডন ডায়রি (দুই)


যে বাড়িতে আছি,  ফাউস্তো বলে একটা কুকুর আছে। আমি কুকুর ভালোবাসিনা। তা এ কুকুরটা খুবই ভালো। তেড়ে আসেনা, হাঁকডাক লাফ ঝাঁপ কিচ্ছু করে না। বাবুরাম সাপুড়ের কাছে ট্রেনিং নেওয়া কিনা জানিনা। অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড। এর মালিক একজন স্প্যানিশ ভদ্রলোক, আপাতত দেশে গেছে। সে এতদিন স্প্যানিশ খাবার খেয়েছে। এখন বাঙালী খাবার খেয়ে খেয়ে হেংলু হয়ে গেছে রীতিমতো।  শুরুতে এসেছিলাম যখন, বেশী কাছে আসতো না, একদুদিন যেতে এখন খুব ঘুর ঘুর করে। আমি ঘরে বসে কাজ করি দরজা দিয়ে উঁকি মারে।তারপর যেই ছবিবতুলতে ফোন তাক করি তুরতুর করে পালায়। আবার দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে। আর আছে একটা ছোট ছেলে, তার এখনো সব দাঁত বেরোয়নি, ফোকলা দাঁতে হয় হাসে না হয় চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচায়। আর  সিঁড়ির রেলিং এ ঝুলে ঝুলে চেঁচায়,  "পাস্তো, পাস্তো"। এরা দীর্ঘদিনের প্রবাসী বাঙালী। ফলে বাঙালী সুলভ সু ও কু দুই অভ্যাসই কিঞ্চিৎ কম। এরা পরিশ্রমী, উদ্যমী এবং রিস্ক নিতে পারে। আবার একই সাথে দৈনন্দিন বাঁচার মধ্যে টিপিক্যাল রিগ্রেসিভ আচরণ, চিন্তা। মানে দশজন অতিথি ডাকলে একজন গুরুত্বপূর্ণর জন্যে আলাদা খাতির করে আলাদা ব্যবস্থা করা,  বা নিজেদের মধ্যে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর বিষয়ে উদাসীন। বাড়ির কর্তা ভয়াবহ সব কন্সপিরেসি থিওরি বিশ্বাস করে।যেমন মনমোহন সিং পাকিস্তানে গিয়ে সমস্ত অফিসারদের ডিটেল দিয়ে এসেছিল। বাড়ির গিন্নি অনসাইটে এসেছিল, সেই সূত্রে কর্তাও এসেছে, এবং চাকরির চেষ্টায় থেকেছে বেশ খানিক দিন। তারপর চাকরি পেয়ে, এক গাদা লোন নিয়ে ফস করে বাড়ি কিনে ফেলেছে, তাই ভাড়া দিয়ে খানিক সুরাহার চেষ্টায় আছে আরকি। এরাও আমাদের মতোই গুরুদ্বোয়ারায় খেতে যায় খুব। টাকা পয়সা বাঁচে তাতে। অবশ্য মুখে বলে পাঠ শুনতে যাই। 

ফাউস্তো বা পাস্তো

লন্ডন শহরের টিউব যতটা সুসংবদ্ধ,  পরিষ্কার ভাবে ডিরেকশন দেওয়া বাসটা আমার মনে হয়েছে একটু কম তার তুলনায়। টিউবে চাইলেও হারানো যাবে না এতটাই ক্লিয়ার করে বোঝানো। সেখানে একটা বাস স্টপ খুঁজতে গেলে মনে হয় যেন নিজেকে লিভিংস্টোন।  সিটিম্যাপার বলে একটা অ্যাপ হয় যেটা খুবই কার্যকরী এখানে। কোথাও থেকে কোথাও যাওয়ার জন্যে, সময়, ভাড়া,  পিকাডেলি বা বেকারলু, সেটার নর্থবাউন্ড না সাউথবাউন্ড সব বলে দেওয়া থাকে। বাসের ক্ষেত্রে সাম হাউ ব্যাটা ভালো লোকেট করতে পারেনা। ময়ূরাক্ষীর স্কলারশিপের ফান্ডটা তোলার জন্যে আমাদের ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন যেতে হত। সে জিনিস আকছাড় আছে এদিকে আমরা ম্যাপে খুঁজে যেটায় যেতে চাইতাম ভারী ঘুরপাক খেতে হল। সিঙ্গাপুরে সিঙ্গাপুর আই,  মাদাম ত্যুসো দেখেছি আগে। ইউএসেও মাদাম তুসো ঘোরা। হপ অন হপ অফ বাসেও আমার চড়া ছিল।  তা সত্ত্বেও একসাথে ঘুরবো বলে এখানে ফের আমিও টিকিট কেটেছিলাম।  তা দুজন মিলে যে হপ অন হপ অফে চড়ে এমন চড়কি পাক খেলাম, এ মনে হয়না আর কারোর সাথে হয়। ভুল বাসে স্টপেজে নেমে (এটায় পুরোটা আমাদের দোষ ছিল না অবশ্য),  প্রায় মিনিট চল্লিশেক হেঁটে মাদাম ত্যুসোয় পৌঁছেছি। হাঁটা তো না,  হাঁটা ছোটা মিলিয়ে একরকম বলা যায়। মাঝে শর্টকাট করছিলাম এক পার্ক দিয়ে, এক ভদ্রলোক খুবই সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন কোনটা দিয়ে যেতে হবে। যদিও আমরা ভালো বুঝিনি। আরো খানিক গিয়ে আবার কাউকে জিজ্ঞেস করেছি। লোকজন হেল্পফুল। আমার ধারনা ছিল ইংরেজরা নাক উঁচু হয় হয়তো। তা তো দেখলাম না তেমন? রাস্তা ঘাট চেনে না এমন লোক প্রচুর আছে তবে কেউই কিন্তু দুর্ব্যবহার করেনি। আমি এই ২০২৩ এ দাঁড়িয়েও মানুষকে বেশী ভরসা করি অ্যাপের থেকে তাই অনেক সময়েই হয়েছে, টিউবে যে চেঞ্জটা সিটিম্যাপার করতে বলছে আমার নিজের মনে হয়েছে অন্য স্টেশন থেকে করলে বেটারা হবে, এবং লোককে জিজ্ঞেস করে দেখেছি তারাও সেটাই বলছে। বাসে আবার মাঝে মাঝে ড্রাইভারদের ডিউটি শেষ হয়ে গেলেবাস ওখানেই থেমে যায়। মানে এখানে লেবার ল খুব স্ট্রং।ফলে ওভারটাইম করাটা খুব চালু ব্যপার না। ফলে ধরা যাক নিউটাউন থেকে বাস ছেড়েছে ,রুবি তে গিয়ে তার আট ঘন্টা  কাজ শেষ হয়ে গেল। আর বাসটা হয়তো যাবার কথা কসবা অব্দি তাও রুবিতে বাস থেমে যাবে।  অন্য ড্রাইভার আসবে এই ড্রাইভার ওখানেই থেমে অপেক্ষা করবে ,প্যাসেঞ্জারদের বলবে আপনারা অন্য বাসদেখে নিন! মানে সব কিছুরই দুটো দিক থাকে আর কি ।ওহ বলিনি না?এখানকার বাস ট্রেন মেট্রো সব জায়গায় একই কার্ড কাজ করে।সুবিধেটা ভাবো , বর্ধমান থেকে লোকালে এসে সেক্টর ফাইভ মেট্রো যাবার জন্যে আবার অন্য টিকিট কাটার দরকার নেই। 




হুড খোলা দোতলা বাস থেকে

আই অ্যাম গ্রুট

লন্ডনের বিখ্যাত লাল বাস

লন্ডন আই


ইন্ডিয়ান টাইমে অফিস করি। অফিসে ম্যানেজার ছাড়া আর কাউকে বলিনি বাইরে এসেছি। অফিস শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। দিন দুই পরেই আবহাওয়া বদলে গেল। ঠান্ডা,  বৃষ্টি ভেজা আবহাওয়া। অফিসের পর একদিন বেরিয়েছি। র‍্যান্ডম হাঁটতে হাঁটতে একটা কবরখানায় পৌঁছলাম। পঞ্চাশ একশো বছর আগের সব কবর। মেঘলা দিনে,  বড় বড় গাছের নীচে শুয়ে আছে সব, কারোর ছেলে কারোর মেয়ে, কারোর বাবা কারোর মা, কারোর স্বামী কারোর স্ত্রী কিংবা কারোর কেউ না...।এরকম জায়গায় শেষ শোওয়াটা মন্দ না। আচ্ছা মরায় মানুষের ভয় কি পার্থিব সুখ ছাড়ার জন্যে নাকি এমন একা একা বিষন্ন বিকেল কাটাবার জন্যে? একা হয়তো আমরা ভাবি ,ওখানে হয়তো একাকীত্বটাই বেশী চাহিদার! কবরখানায় এরপর আরো গেছি অনেক জায়গায়, কিন্তু এই দিনেরটা যেন বেশী মনে দাগ রেখে গেছে। মেঘলা দিনের জন্যেই নাকি কে জানে!




বাড়ির কাছেই একটা পার্ক আছে, আগের পর্বতেই বলেছিলাম পার্ক মানে চৌকোনো উঠোন নয়। কোনোকোনোদিন ওখানে যাই হাঁটতে । এই পাড়াটা দেশীয় লোক বেশী বলেইকিনা কেজানে , মাঠ গুলো বা রাস্তা গুলো তুলনামূলক ভাবে একটু কম পরিষ্কার ।মানে বাকি জায়গাগুলোর তুলনায় আর কি। এখানেও ঘেটো ব্যপারটা চলে কিন্তু খুব। মানে বাংলাদেশী পাড়া , পাকিস্তানি পাড়া , ভারতীয় পাড়া ।ভারতীয়দের মধ্যে পাঞ্জাবীদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশী।এই একটা জাতি , মাটি কামড়ে লড়াই জানে বটে। পার্কের কথা বলছিলাম্না, সেদিন হাইড পার্কে ভারী চমৎকার একটা দৃশ্য দেখলাম। লাইভ মিউজিক হচ্ছিল স্টেজে। তা বুড়ো বুড়ো কাপলরা দিব্যিকাপল ডান্স করল।আমাদের তো ভালোবাসা দেখানোই অন্যায় , আরসারা জীবনন্যের জন্যে বলি দিয়ে বুড়ো বয়স ফ্রাস্ট্রেশন মেটানোর বা আপশোষ করার বয়স ,তাই অন্যরকম কিছু দেখে ভারী ভালো লাগলো। 


 




ছুটির দিন গুলো ব্যাগে স্যান্ডউইচ, কেক, বিস্কুট, মুড়ি, চিপ্স জলের বোতল ছাতা, হুডি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ফিরে দেখি কোনোদিন বারো তো কোনোদিন পনেরো কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে। নিজেরই বিশ্বাস হয়না। হ্যাট আমি এত হেঁটেছি! টিউবে পাউন্ড বেশী লাগে সময় কম, আর বাসে সময় বেশী পাউন্ড কম। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বেরোলে বাস মন্দ না মাঝে মাঝে। দোতলা লাল বাসের সামনের সিট দখল  করে বসো, সামনের মসৃন হর্ণ বিহীন রাস্তা, পাতা ঝরা রাস্তা, ছবির মতো বাড়ি দেখতে দেখতে যাও। বাসে হোক কি টিউবে দুই জায়গাতেই মানুষ প্রচুর দেখা যায়। নানান ভাষাভাষী। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করি কোন ভাষী। এ আমার এক নিজস্ব খেলা। দু চারটে জার্মান শব্দ জানি টুকটাক, musse, brauche শুনে আন্দাজ করি জার্মান। সেদিন এক হেব্বি সুন্দরী মহিলা উঠেছিল টিউবে। মাখনের মতো পা, টিকালো নাক, কালো চোখ। ভাবছি ইজিপশিয়ান বা তুর্কি কিনা। সাও শব্দটা শোনা গেলো তারপর তার ইংরেজির টানটা খানিক শুনে আন্দাজ করলাম স্পেনীয়। আরেকদিন,  বাসে এক বুড়ি উঠলো। তারপরের স্টপ থেকেই এক বুড়ো।সে একেবারে গপ্পোবাজ বুড়ো। আর কথা বলে এরকম ভাবে, " হ্যালো জন, হাউ আর ইউ জন?ওহ হোয়াট আ লাভলি ওয়েদার, রাইট জন? " যাইহোক, বুড়ির নাম অ্যাঞ্জেলিনা, গপ্পোবাজ জনের আরেক পরিচিতও ছিল, তার নামও জন। অ্যাঞ্জেলিনাকে শোনানোর জন্যই কিনা কে জানে, অন্য জনকে খুব গল্প শোনালো, ওর অল্প বয়সের, আরো কত বকবক করলো। এদিকে বুড়ি দেখি বেশ মিচকি মিচকি হাসছে সামনের সিটে বসে। 


সারাদিন অফিস করে, তারপর ঘুরে ফের এসে রান্না করে খেতেও তো কই অসুবিধে হয়না? এর কারন কি? মনে হয় আবহাওয়া একটা কারন।  আরেকটা কারন কি দৈনন্দিন অস্থিরতা কম? মানে আমি জানি অমুক ট্রেন বা অমুক বাস এতটার সময়েই আসবে। কখন বাস আসবে বা কখন ট্রেন তার অনন্ত অপেক্ষায় থাকার দরকার নেই। কি জানি?! হর্ণ নেই বলে শব্দদূষণ কম সেটাও এফেক্ট ফেলতে পারে। বক্তব্যটা বাড়াবাড়ি মিনে হতে পারে কিন্তু কিছুদিন আগে দেখছিলাম এটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে এবিং আমার বক্তব্যের সমর্থনেই রিপোর্ট এসেছে। শব্দদূষণ আমাদের মানসিক ভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে।

সোনালীদির ছেলে লন্ডনের ডাক্তার।  একদিন অফিসের দিনেই সকালে গিয়েছিলাম। ভারী সুভদ্রলোক। আমারই বয়সী হবে কিন্তু আমার মতো ন্যালাক্ষেপা ক্যাবলা না, ঝকঝকে একই সাথে বিনয়ী। ডাক্তার মানুষ ,তাও তার ব্যস্ত সময়ের মাঝে কফি খাওয়া হল এক কাপ করে। যারা যত বড় হয় তারা তত কম এবং অখাদ্য খায়। সত্যি! দুটূকরো শসা কি এক বাটি দই দিয়ে লাঞ্চ সারে কেউ, বা তেল মশলা হীন সেদ্ধ মতো খাবার। এদিকে আমার মতো অলম্বুষরা খায় বেশ ময়দার লুচি, রাবড়ি, ক্ষীর। ফলে আশিকভায়া খেলো দুধ চিনি ছাড়া এক কাপ কালো কফি বা সংক্ষেপে কাক, আর আমি দুধ চিনি দেওয়া ল্যাটে। আশিকের হাসপাতাল থেকে টিউবের রাস্তাটা ভারী চমৎকার।  আসলে হাসপাতালটা  হ্যামস্টেড হিথের কাছেই।এখানে আসবো আমরা একদিন।  চড়াই-উৎরাই রাস্তা, পাশে অনেক পুরোনো জমকালো এক গির্জা। রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায় বেঞ্চ। অফিসের দিন বলে আমার সাথে ল্যাপটপ ছিল। বেঞ্চে বসে খানিক্ষন কাজ করলাম। রাস্তায় কোলাহল নেই তাই কাজের অসুবিধেও নেই। 






হ্যামস্টেড হিথ জায়গাটা একটা ছোটখাটো টিলা বলা যায়। দূরে লন্ডন শহরের স্কাইলাইন দেখা যায়৷ কিটসের বাড়ি এই হ্যামস্টেড হিথেই।  বিকেল বেলা দুজন পৌঁছলাম যখন প্রচুর নানান বয়সী মানুষ, কুকুর জড়ো হয়েছে, যদিও কোনো হট্টগোল নেই।নিজেদের মধ্যে কথা বলছে অন্যকে বিরক্ত না করে। কুকুর ভারতেও আজকাল বহু মানুষ পোষে কিন্তু এরকম দায়িত্ব নিয়ে যথারীতি না বেশীরভাগ সময়েই। এরা প্রতিদিন, কুকুরকে দৌড় করায়, পটি করলে তুলে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে। আর কুকুরগুলোও ভারী সুশিক্ষিত। অন্যকে তেড়ে যাওয়া নেই, অবাধ্যতা নেই।গাছপালা, জলাশয় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একিটা ট্রেইল পৌঁছে দেয় টিলার চুড়োয়। এরকম জায়গায় থাকলে রোমান্টিক কবি হবে স্বাভাবিক মনে হয়। আমরা টিলার উপর সবুজ ঘাসে বসে রইলাম। আমাদের পেটেন্ট খাবার, পাঁউরুটি, ডিম আর চিজ  খাবার পর এক বাক্স নিমকি বের করেছি। অমনি একটা নীল সাদা পাখি এসে হাজির৷ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, সচরাচর বুনোদের মানুষের খাবার দিতে নেই৷ নিমকি মানুষের জন্যেই এত খারাপ এমন সুন্দর পাখিটাকে দেবো যদি পালক ঝরে যায়! ভাবতে ভাবতে একটা ছোট টুকরো দিয়েছি।ওবাবা সে তো তার বেজায় ভালো লেগেছে। তুরতুর করে নেচে নেচে হাঁটছে আর তাকাচ্ছে। আর একটা কি দেবে না? একটা ছোট টুকরোই স্রেফ! আরো একটা দেওয়া গেল। ফূর্তি তার দেখে কে। আর কোথাও যাচ্ছেই না। গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। ভাবখানা,  আর না যদি দেয় আমিও যাবো না দেখি কতক্ষন না দিয়ে পারে। আরো দুটো দেওয়া হল। একদম পাশটিতে বসে নেচে নেচে খেয়ে তারপর সে গেল,  অন্য পাড়ায় মাধুকরী করতে। এদিকে আমাদের মতো তো সবাই না, খেয়ালও করেনি, বুঝতেও পারেনি যে ও কি চায়। এদিক ওদিক ঘুরে উড়াল দিলো।



ক্রমে আলো কমে গেল, হাওয়ার জোর বাড়লো,  লন্ডন শহরের সব আলো জ্বলে উঠলো। সন্ধ্যের  আলো আর অন্ধকারের অবাস্তবতা নিয়ে আমরাও উঠলাম। 






Thursday, October 12, 2023

ইউকে ডায়রি (এক)

বেড়ানোর গল্প ঠিক কখন শুরু হয়? ব্যগ গোছানোর সময়, স্বপ্ন দেখার সময় না পৌঁছে যাবার পর? কে জানে! সে ছিল একটা গরমের সকাল, যখন জানা গেলো, ময়ূরাক্ষী চার্লস ওয়ালেস ফেলোশিপ পেয়েছে। আমাদের এবারের ঘোরার গল্পটা মনে হয় সেই সময় থেকে শুরু। তিন সপ্তাহের কাজ করার জন্যে, যাওয়া আসা থাকা খাওয়ার অল্প একটু ওরা দেবে বাকিটা তোমার নিজের। সে অর্থে আমাদের মতো ট্যাঁকখালির রাজাদের,  "চল তবে একই সাথে ঘুরেও আসি" বলাটা মানায় না বটে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিমান আমাদের অতিবড় সাপোর্টারও বলবে না। সুতরাং, কড়া ব্যাকপ্যাকিং প্ল্যান করা শুরু হল, যা আমাদের বয়সের সাথে হয়তো খুব উপযুক্ত নয়, কিন্তু কী আর করা। মোটামুটি ওই তিন সপ্তাহ আমিও ওখান থেকে কাজ করবো, আর ময়ূরাক্ষীও নিজের কাজ করবে। ছুটির দিন গুলোয় ঘুরে বেড়াবো। আর শেষে এক সপ্তাহ দুজনেই ছুটি নিয়ে না হয় ঘুরে বেড়াবো। তিন সপ্তাহে দুজনের কমন ছুটির দিন ওই রবিবার গুলোই হবে, তাই আরো এক দুখানা ছুটি দুজনেই নিয়ে নেবো খন!


বেড়ানোর গল্পের আগের এ ভনিতাটুকু দরকার, কারন এরপরে মাস দুই আমাদের সংগ্রামের কাহিনীটুকুও লিখে রাখি৷ নিজেরাও কখনো বড় হলে ফিরে দেখে অবাক হবো হয়তো। ভিসা খরচ তো স্ট্যান্ডার্ড,  আমাদের দেশ থেকে পশ্চিমের দেশে যাবার মূল খরচ তো দুটো জায়গায়। যাওয়া আসার টিকিট আর থাকার খরচ। বাকিটা তবু খানিক নিজের হাতে থাকে। অতয়েব সস্তার ফ্লাইট আর সস্তার থাকার জায়গা খোঁজা শুরু হল। কোলকাতা থেকে সব ফ্লাইট কেন জানিনা সাত আট হাজার টাকা বেশী হয়। দুজনের সেটা তারমানে চোদ্দো পনেরো হাজার বেশী হয়ে যাবে। সুতরাং অনেক পারমুটেশন কম্বিনেশন করে মুম্বই থেকে যাওয়াই সাব্যস্ত হল। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের কপাল নিয়ে আমাদের খুবই নিশ্চিত কিছু বিষয়ে। আমাদের তাড়া থাকলে আমাদের লাগেজ সব চেয়ে শেষে আসে, আমাদের টাইট স্কেডিউল থাকলে ফ্লাইট ডিলে বা রিস্কেডিউল হয় (ইন ফ্যাক্ট এইবারেও যাবার সময় চার ঘন্টা ডিলে হয়েছিল ফ্লাইট)। সুতরাং আমাদের মাঝে অনেকটা সময় লে ওভার রাখতে হবে মুম্বই নামা আর ওঠার মাঝে। সে আমরা মেনে নিয়েছি, যাবার দিন আমি মুম্বই এয়ারপোর্টে বসে কাজ করেছি আর ফেরার দিন দুজনে গল্প করে, ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি। পনেরো হাজার আমাদের জন্যে অনেকই। 

মুম্বাইতে বসে থাকতে থাকতে

পরের ত্রাহিমাম দশা হল বাড়ি পেতে। চেনা,  আধচেনা, বন্ধু, এক্স কলিগ কাউকে বাকি রাখিনি বলতে যে এক মাসের জন্যে একটা ঘর ভাড়া পাওয়া যায় কিনা। ব্যপার হল বিএনবি পাওয়া যায় বটে। কিন্তু বিএনবির লোকেশন খুব দূর হয়ে যাচ্ছে, আমরা যে জায়গায় চাইছি তার তুলনায়। সেন্ট্রাল লন্ডনে থাকার কথা ভাবাও যায়নি, কিন্তু তাতেও বিএনবির খরচা অনেক বেশী পড়ে যাচ্ছিলো , আমাদের বাজেটের তুলনায়। নানান অ্যাপ আছে ঘর খোঁজার সেসবে আবার সমস্যা হল, ডিপোজিট চায়। দেখিনি শুনিনি ফস করে অগ্রিম ডিপোজিট চাইলে আমাদের বুক শুকোয় বটে। টাকাটা নিয়ে চুপচাপ কেটে পড়লেও আমার কিচ্ছুই করার থাকবেনা। শেষে যাবার দিন দশেক আগে যখন আমাদের প্রায় সব আশা শেষ তখন মরীয়া হয়েই একটা ঘর ঠিক করা গেলো, অল্প খানিক অগ্রিম দিয়ে। এই ঘর খোঁজার সময় বেশ অভিজ্ঞতা হয়েছে বটে।অনেক পরিচিত বন্ধুরা তাদের পরিচিতদের হদিশ দিয়েছিল। তাদের কেউ কেউ বলেছে এ সময় কেন যাচ্ছি, কেউ বলেছে এত কম বাজেটে লন্ডনে থাকা যায় না, সেভিংস ভেঙে বাজেট বাড়াও (সেভিংস ভাঙা ছাড়া আমাদের মতো লোকের বাজেট আসবেই বা কোত্থেকে)। এক জুনিয়র তো ভয়ে কন্ট্যাক্ট করাই বন্ধ করে দিয়েছিল, অথচ তার আগে অব্দি নিয়মিত বাজে বকতে ফোন করতো! কেউ কেউ তাদের বাজেটের হিসেবে বলেছে আরে এ তো থ্রো অ্যাওয়ে প্রাইস নিয়ে নাও। ধন্যবাদ তাকে, এই থ্রো অ্যাওয়ে প্রাইস লব্জটা আমাদের জীবনে বেশ একটা বিনোদনের জিনিস হয়েছে। বাজেটের বাইরে কিছু দেখলেই বলি, আরে নিয়ে নে থ্রো অ্যাওয়ে প্রাইসে দিচ্ছে! তবে সব চেয়ে সেরা বিনোদন দিয়েছিল একজন, একটা হোটেলের ঠিকানা দিয়েছিল। যার দাম অনেকটা ওই, রুটি খেতে পায়না তো কেক কিনে খাক এর মতো।  তবে ভালো অভিজ্ঞতাও কম না। যেমন,  এক দাদার বন্ধু আমাদের বিনামূল্যে তার বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ওঁর বাড়িটা ময়ূরাক্ষীর  কাজের জায়গা থেকে সুবিধাজনক দূরত্বে ছিলনা কিন্তু এই বলাটা আমাদের হৃদয় ভরিয়ে দিয়েছিল। আরেক বন্ধুর বন্ধুর থেকেও উষ্ণ ব্যবহার পেয়েছিলাম। পৌঁছে যাবার পর খোঁজও নিয়েছিল।

কুয়েতে লে ওভার ছিল, এয়ারপোর্টে বাংলাদেশী, চীনা, আর আরব শেখদের দেখা যায় বেশী। বাংলাদেশী দু রকম দেখলাম, এক,  মহিলারা পুরো আগাপাশতলা ঢাকা, চোখ দুটি ছাড়া। দুই, মহিলারা স্বাভাবিক পোশাক পরা। আরব শেখদের ব্যপারটা আলাদা। তাদের পুরুষরা সাদা জোব্বা মাথায় লাল টুপি, আর তাদের বউ হল, হয় বোরখা মোড়া বা, শুধু মুখ টুকু খোলা। যাদের মুখটুকু খোলার সুযোগ আছে, তারা খুব প্রসাধন চড়িয়েছে। ওইটুকুতেই  শখ পূরণ আর কি!  ফেরার সময় আরেক মজার জিনিস দেখেছিলাম। আমাদের দেশে যেমন তীর্থস্থানে লোকেরা খালি গায়ে, বা চাদর জড়িয়ে, বা অনেক সময় মন্দিরের পাশে চেঞ্জ করে যায়, শেখগুলো এয়ারপোর্টেই চান টান সেরে, গায়ে কোমরে সাদা তোয়ালে জড়িয়ে জেদ্দা চলেছে। আর প্রতিটা এরকম শেখের বউরাই কালো জোব্বায় আগাপাশতলা ঢাকা। পুরুষদের আব্রু থাকতে নেই আর মহিলাদের আব্রুর একেবারে হদ্দমুদ্দ। ঝাঁ চকচকে আধুনিক এয়ারপোর্টে, প্রাচীন মনোভাব থুড়ি আজকাল তো সংস্কৃতি বলা দস্তুর এসবকে, দেখলে বেশ বোঝা যায় তেলের ক্ষমতা। 

কুয়েতে ভোর

লন্ডনে সেপ্টেম্বরে গেলে মানুষ এক ব্যাগ সোয়েটার নেবেই। ঠান্ডা হবে খুব নির্ঘাত। আর ঠান্ডা!! গরমে অস্থির। ইমিগ্রেশনে রীতিমতো কোলকাতার মতো ঘামের গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। চারদিকে প্রচুর বাংলাদেশী,  বাংলায় সাইনবোর্ড অব্দি লেখা। কুয়েতেও ছিল অবশ্য। ওখানে দেখেছিলাম  টয়লেটে বাংলা হিন্দি আর ইংরেজিতে লেখা বেসিনে পা ধোবেননা। হিথরোয় ভীড় খুব, কিন্তু সুসংবদ্ধ।  ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কির ব্যপার নেই।  দুটো জিনিস হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে শুরু হবে আর আগামী একমাস সর্বত্রই দেখবো, এক   এই ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা, ধাক্কাধাক্কি না করে ট্রেন থেকে আগে নামতে দিয়ে তারপর ওঠা  হোক বা যে কোনো জিনিসের জন্যেই হোক। এর আগে ইউএসে , সিঙ্গাপুরে সর্বত্রই এটা দেখেছিলাম অবশ্য। আমাদের কেন নিয়মানুবর্তীতা নেই? স্কুলে শেখানো হয় না তা তো না। আমার বেশ মনে আছে , লাইন করে প্রেয়ারের পর ক্লাসে যেতে হত । সব স্কুলে কি তাই হয় না? আর দুই নাম্বার হল, এই লোক সামলানো, ঝাড়পোঁছ করা, সিকিউরিটি ইত্যাদিতে দক্ষিন এশিয়ার লোক না হোলে আফ্রিকান লোক বেশী। সাদা চামড়া কম।  যাইহোক, রাতে বাড়িওয়ালা একটা টেবিল ফ্যান দিয়েছিল ভাগ্যিস। যদিও ভোরে গা শির শির করছিল।




টায়ার্ড কিন্তু উৎসাহের কম নেই


বাড়ির সামনে
  

বাড়িওয়ালা একজন প্রবাসী বাঙালী। জন্মকর্ম বেনারস, লখনৌ, পুনে এসব জায়গায়। এই পরিবারটার সাথে থাকা আরেক অভিজ্ঞতা। আসছি সে কথায়। যাইহোক, বাড়িওয়ালার কাছেই জেনেছিলাম কাছাকাছি গুরুদ্বোয়ারা আছে। ফ্লাইট ডিলে, ২৪ ঘন্টার বেশী হয়ে গেছে ভালো করে ঘুমোইনি। সুতরাং গুরুদ্বোয়ারাতে রাতে খেতে গেলাম, রান্না করার আর দম ছিল না। ম্যাগি বানালে হত হয়তো, ওটা থাক, পরে আরো আতান্তরে পড়লে হবে খন।প্রচুর খাওয়ায় গুরুদ্বোয়ারাতে। পোলাও, রুটি, চানা, কালিডাল, বেগুনের তরকারি, দই, পায়েস। এই গুরুদ্বোয়ারা কিন্তু যারা ব্যকপ্যাকিং করতে চায়, তাদের জন্যে বড় ভালো জায়গা।  আমার খুবই অবাক লাগে, এরা ফ্রিতে এত সার্ভিস দেয় কিভাবে? মানে খাওয়ানোতে একটা বড় খরচ তো আছেই, কিন্তু অমলিন ভাবে লোকের এঁটো পরিষ্কার করে চলে, খাবার বানায়। ভক্তি ব্যপারটা বড় অদ্ভুত, ভালো মন্দ কত কীই যে করাতে পারে। 


সকাল সকাল উঠে চা বিস্কুট পাঁউরুটি খেয়ে, ঝোলায় পাঁউরুটি ডিম কলা পুরে(রাতেই কিনে এনেছি) শুরু হল আমাদের ঘোরা। ছুটির দিনগুলোয় শহর চষে ফেলার ইচ্ছে আছে। কটা দিন মূলধন, যতটা পারা যায় দেখে নিই। আজ সারাদিনে সাড়ে তেরো কিলোমিটার হেঁটেছি৷ ঘুরেছি মূলতঃ সেন্ট্রাল লন্ডন। তাও বেশ খানিক বাকি আছে। কাল খানিক হবে। বাকি আবার অন্য কোনোদিন। 

টিউবে চড়ার অভিজ্ঞতা কালকেই, এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি যাবার সময়। খুব নতুন অভিজ্ঞতা কিছু না আমার। এরকম মসৃন জালের মতো ট্রেন আমি আগে চড়েছি কিন্তু নতুন দেশে সব কিছুই ফের ভালো লাগে। আমার এমনিতেই বুদ্ধি কম বলেই হয়তো, সহজে আনন্দিত, বিস্মিত ভালো লাগায় বুঁদ হতে পারি। তা নতুন অভিজ্ঞতা হোক কি পুরোনো।  আজও টিউবে করেই যাওয়া আসা। মাঝে একবার বাসও নিয়েছি। দোতলা লাল বাস।  টিউবের তো নানান লাইন আছে, আমাদেরটা পিকাডেলি লাইন, এটা নাকি, ১৬০ বছর আগের। ভাবো একবার, আমাদের দেশে যখন হারামজাদারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে নিজেরা "দায়িত্ব" নিয়ে জ্বালাতন শুরু করেছে, নিজেদের দেশে এমন চমৎকার জিনিস চালু করেছে। যাইহোক, নিজেদেরও দোষ দিই, কতটুকু আমরা করেছি এতদিনে। এতদিনে আমরাও কি এরকম জালের মতো একটা নেটওয়ার্ক তৈরী করতে পারতাম না? টাকার জন্যে সবটা আটকায় তা নয় কিন্তু, কিছু জিনিসের জন্যে মন মানসিকতা লাগে স্রেফ। ধরো, এই যে ডিসেবলড মানুষদের জন্যে ইউকে বলো ইউএস বলো সব জায়গায় র‍্যাম্প থাকে,  না হলে, পাটাতন বেরিয়ে আসে বাস থেকে, হুইল চেয়ার ওঠার জন্যে, এটার জন্যে কি খুব টাকা পয়সার দরকার হয়? আমাদের এমপ্যাথি কম খানিক। "নিজের গাড়ি করে যাবেন এত অসুবিধে থাকলে" এ জিনিস আমাদের মতো গরীব দেশেই মানায় বুঝি! যাকগে, টিউবের সিটগুলোর মাঝে হাতল থাকায় আমার মতো লোকেদের জন্যে ভালো। নাহলে দাদা চেপে বসুন করে বড় চেপ্টে যাই।


টিউবে





অস্থায়ী ঠিকানায়

ট্যাঁকের জোর না থাকলে স্যন্ডম্যান ট্যুরটা বেজায় ভালো ব্যপার। টিপস বেসড ট্যুর হয় এদের। অলি গলি ঘোরায়, সহজ সুবিধেজনক জায়গা থেকে, ভীড় এড়িয়ে বিখ্যাত জায়গা গুলো দেখায়, গল্প শোনায়। সব গল্প তো আর গুগল করলেই মিলবে না।  আর এই ট্যুর গাইডদের সেন্স অফ হিউমার চমৎকার হয়। আমাদের ঘোরাবে, হার্বি। সে ভারী মজার লোক। গল্প করে অ্যাক্টিং করে সময়টা জমজমাট করে তুলল।সারা রাস্তা নানান গল্প নানান ইতিহাস,  ম্যাজিক দেখিয়ে চলল। আসলে সে ছিল স্ট্রীট পারফর্মার।বয়স হয়েছে, হাঁটুর জোর কমে গেছে, তাই এখন ট্যুর গাইড হয়েছে। হাঁটার স্পীড দেখে মনে হবেনা অবশ্য যে এর পায়ের জোর কমেছে। ট্রাফালগার স্কোয়ারে এসে অভিনয় করে গল্প শোনালো কেমন করে অ্যাডমিরাল নেলসন মরে যাওয়ার আগে বলেছিল দেশে মাটি পেতে চায়, সমুদ্রে ডুবতে চায়না। নাবিকেরা মদের পিপের মধ্যে পুরে তাকে এনেছিল বটে কিন্তু মুশকিল হল, সেই মদের মায়া ছাড়াতে কেউই পারেনি, সবাই সেই মরা ডোবানো মদই স্ট্র দিয়ে টেনে খেয়ে, জেনারেলের দেহের বদলে চাটনি এনে হাজির করেছিল ইংল্যান্ডে। গল্প শুনে চারদিকে সাহেব মেমরা চোখ কপালে তুলছে যখন ফোকাস ঘুরিয়ে দিল সিংহের দিকে। "এই দেখো আমাদের জাতীয় পশু সিংহের মূর্তি, কিন্তু ব্রিটেনে সিংহ তো বললেই পাওয়া  যাচ্ছে না, সুতরাং এডউইন ল্যানসিয়ার যখন দায়িত্ব পেলো স্কাল্পচার বানাবার, দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলো কবে একটা সিংহ মরবে চিড়িয়াখানায়।  সে বেচারি আর জানবে কী করে তার মরার জন্যেও মানুষে বসে থাকে। ফলে বছর দুই বেঁচেই নিল। কিন্তু মরা সিংহ তো রানীর শাসন শোনেনা, ফলে কাজ শেষ হবার আগেই সে গেল পচে। ল্যান্ডসিয়ার তখন বাড়ির বেড়ালের পা এর মতো করে এর সিংহের পা বানালো, পিছনটা বানালো তার অ্যালসেশিয়ানের আদলে আর মুখটা,  হ্যাঁ মুখটা সিংহের মতোই বটে। সুতরাং দেখে নাও, আমাদের জাতীয় পশুর মূর্তি আসলে, বিড়াল, কুকুর আর সিংহের গোঁজামিলে তৈরী"। ন্যশনাল আর্ট গ্যালারিতে একবার একজন চুরি করেছিল, প্রোটেস্ট করার জন্য। চমৎকার গল্পটা শোনাবার আগে বলল, "জানোই তো, আমরা সব সুন্দর আর্ট বানিয়েছে যে সব দেশ,  সেই সব  দেশে গিয়ে বলি, ওহ বানিয়েছ বটে কিন্তু তুমি আর আর্টের কি বুঝবে! ও জিনিস  আমায় দিয়ে দিতে হবে, কারন তুমি বানালেও আমি খুব আর্ট বেটার বুঝি।" সত্যি বলতে এর পরেও হার্বির ফ্যান না হয়ে থাকা যায় না মশাই!

উইজার্ড হার্বি


এটাই নাকি ডায়গনালির উৎস

জায়গায় জায়গায় বড় বড় পার্ক। আমাদের দেশের উঠোনের মতো না, বিশাল এলাকা নিয়ে বড় বড় গাছ, ফুটবল মাঠ, টেনিস কোর্ট, হাঁটার জায়গা অথচ কোনোটাই জায়গাটাকে সম্পূর্ণ  কৃত্রিম করে ফেলেনি। আমাদের দেশে লোভ বেশী না বাঁচতে না জানার অজ্ঞতা বেশী? হার্বির সাথে ঘোরার পর থুতুহীন, কুকুরের হাগুহীন, গুটখার পিকহীন  ঘাসে বসার লোভ সামলানো গেলো না। বড় গাছের ছায়ায়, কাঠবিড়ালিদের সাথে সবুজ ঘাসে আরামে বসে থাকার আনন্দই আলাদা। অনেকক্ষন ধরে বসে বসে করা সস্তার লাঞ্চ (পাঁউরুটি, ডিম কলা) । আসলে খাবারের থেকেওই দুজনে বসে বসে এলোমেলো বকবক করা, শিশুর কৌতূহলে কাঠবিড়ালি দেখার আনন্দটা বেশী। হেঁটে বেড়াই গাছের মধ্যে দিয়ে দিয়ে। হুট করে উঠে পড়ি বাসে কংবা ট্রেনে। চিনতে না পেরে, এক দু স্টপেজ আগে নেমে পড়ি। সবই নতুন তাই খারাপ লাগে না কিছুই। পা টনটন করে, তারপর যেই দেখতে পাই হুট করে ১৬৬৫ সালের চার্চ টুক করে ঢুকে পড়ি। এ যাত্রায় আমাদের ফক্কা পকেট সামলাতে খাবার দাবার বাইরে খুব কমই খেয়েছি। ইচ্ছে সামলেছি। আর নিজেদের বলেছি বড় হলে খাবো বল? 

রাজহাঁস এমনিই গর্বিত হয় এ তায় খুব রাগী মত ছিল


হার্বির গল্প শুনতে শুনতে পোজও দেওয়া যায়


বাকিংহাম প্যালেসে সে সময় চেঞ্জ অফ গার্ড হচ্ছিল


্সেন্ট জেমস পার্ক

সেইন্ট জেমস পার্ক



Tuesday, July 18, 2023

কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো

ট্রোল করাটা সব চেয়ে সহজতম কাজ মনে হয়। এক গ্রুপে এক ভদ্রলোক জানতে চেয়েছেন, চার্লস ডিকেন্সের বই কেমন, পড়া শুরু করতে চাই। মানছি, চার্লস ডিকেন্সের নামটা গুগল করলেই পেতেন। তাও,  একটু ধৈর্য্য ধরে বলে দিলেই মিটে যেত,  বদলে কিছু মানুষ বিদ্রুপ শুরু করলেন। যাকগে, ছায়ার সাথে কুস্তি করার মানেও নেই। চার্লস ডিকেন্স শুনে ছোটবেলার কথা মনে এলো হুট করে। যদিও স্মৃতিটা ডিকেন্স নয়, আলেকজান্ডার ডুমার বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে।আসলে স্মৃতিরা বেজায় গোলমেলে। যে জিনিস ভাবি ভুলেই গেছি তাও রয়ে যায় দিব্যি আর যা মনে করি খুব স্পষ্ট তা দেখি আবছা। আসলে এই বিদ্রুপ,  ইত্যাদির প্রেক্ষিতেই মনে এলো আরো। আমি গেঁয়ো মানুষ, তখনো কথার জড়তা কাটেনি, শহুরে আদব কায়দাও রপ্ত হয়নি তেমন। আর আমি ছিলামই একটু অড ম্যান আউটের অড ম্যান। ফলে বন্ধু বান্ধব ছিল না মোটেও। বন্ধু বলতে লাইব্রেরির বইগুলো। পড়ার নেশা আগেই তৈরী হয়ে গেছিল, তাই তার সুবিধে ছিলোই একটা। তো হাতে এলো একদিন কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো। রাত নেই দিন নেই, লুকিয়ে চুরিয়ে পড়ে চলেছি বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, হেরে গিয়ে ফিরে আসার গল্প, সাহসের গল্প, প্রতিশোধের গল্প।  পড়তাম আর ভাবতাম আমিও এরকম একদিন বদলা নেবো সবার। এখন শুনলে হাসি পেতে পারে, যদিও আমার পায়না,  কারন সেই সময় সেই বিদ্রুপ সেই অপমানগুলো কষ্টকর ছিল বইকি! অপমান,  বিদ্রুপ এরপরেও সেদিনকার হাবা বালক বহুবার পাবে কিন্তু তখন সে বড় হয়েছে খানিক, তাছাড়া ইউজড টুও হয়ে গেছে। নাহ অপমান কারোরই কম্ফোর্ট জোন হয়না, কিন্তু সারভাইভাল শিখে যায়। সে সময় আমি জানতাম না, কিন্তু কাউন্ট অফ মন্টিক্রিস্টো আমায় বাঁচিয়েছিল। অন্তত ঘুরে দাঁড়ানো যায় সেটা তো বটেই। কোনো হারই শেষ কথা নয় সেটাও। 

Tuesday, July 4, 2023

নতুন পাড়ায়

লেখালিখির পাট প্রায় উঠেই গেছে। সময় পাচ্ছিনাটা বললে নিজের কাছে ভালো সাজা যায় বটে, কিন্তু নিজের কাছে তো অন্তত শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তাই এক্ষেত্রে বলা ভালো,  যে একটা কিছু গোলমাল তো হয়েছে বটেই, লিখতে আমার ভালো লাগে কারন আমি যা লিখি তা কোনো ভাবেই সাহিত্য টাইপ কিছু না, প্রাচীনকালে মানুষ যেমন নিজের ভাব ফুটিয়ে তুলতো হিজিবিজি অক্ষরে সেরকম যা মনে আসে, কিংবা যা দেখি তাইই লিখি। শিল্পের নিয়ম হচ্ছে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করা। স্রেফ মাটির তাল রেখে দিলেই তো মূর্তি হয়না, কিংবা আঁকাচোরা কিছু একটা বানিয়ে দিলেই বিরাট শিল্পকলাও হয়না সুতরাং এ স্রেফ এমনিই বকে যাওয়া। তাও এক দুজন বন্ধু বান্ধব পড়ে, কেন কে জানে তাদের ভালোও লাগে! কিন্তু লিখতে শুরু তো করেছিলাম নিজের জন্যেই। নিজের চাট্টি বুদবুদ কাটা কথা বলার জায়গা মিলেছিল বলেই তবে কেন লিখছি না কিছু? লেখার বস্তুর অভাব আমার যদি হয় বলতে হবে আমার একটা অংশ মৃত। কারন আমি তাহলে কিছু দেখছিনা বা কিছু ভাবছিনা। সেটা হলে তো মশাই চিন্তার ব্যপার। জোম্বি নিয়ে সারা জীবন ঘর করা খুব চিত্তির। তা লেখার বস্তুর অভাব ঘটে না। মনে মনে বিড়বিড় করিনা কখনো তাও না। তাহলে? তাহলে আমার মনে হয় আদি অকৃত্রিম ল্যাদ।  কিন্তু কারন যাই হোক, তাকে সরাতে তো হবেই। কথা বলা দরকার, নিজের কথা গুলোও বলা দরকার কেউ না শুনলেও।

বাড়ি বদল করা মানে কী বলব আর হারকিউলিসের সেই  গোয়াল পরিষ্কার করার কাজের সমান। বাড়ি বদলানো জরুরি ছিল, কিন্তু তাই বলেই এত কাজ অ্যাঁ! গেরস্ত ঘরদোর মানে যদি পনেরো কুড়ি বস্তা বাজে কাগজ, কাপ ডিশ জামা কাপড় থাকে তবে আমি সন্ন্যাসী হওয়াই প্রেফার করছি আবারও। কী নেই! মানে কী না ফেলেছি! ২০০৭ সালের রাজমিস্ত্রীর হিসেব, প্রাক্তন গার্ল্ফ্রেন্ডের পাঠানো চিরকুট, বর্তমানকে লেখা প্রেমপত্র, প্রাক্তন(-১) গার্ল্ফ্রেন্ডের এর পাঠানো কার্ড, প্রাক্তন(-২) এর পাঠানো বই, হতে পারতো কেউ এর পাঠানো অমুক, এক কোটি বছর আগের ডাক্তার দেখানোর প্রেসক্রিপশন!মায়ের শাড়ির সংখ্যা দেখে ভিরমি খাচ্ছি, তুলে রাখা কাপডিশ দেখে অজ্ঞান, বাতিল কিন্তু মায়া করে রেখে দেওয়া জিনিস দেখে বিষন্ন হবো না বিরক্ত ভাবছি। মানে সে এক ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম অবস্থা। ওদিকে নতুন বাড়ির কাজ যে করছে সে হল একেবারে ভগবানের এগারোতম অবতার, হয়ে যাবে সব হয়ে যাবে কিন্তু কিছুই আর শেষ করে উঠতে পারেনা। এদিকে চোখের আড়াল হলেই মা বাবাই চুপচাপ যত রাজ্যের বাজে জিনিস ব্যাগে পুরে রেখে দিচ্ছে! 

সে সব দিন যে পেরিয়ে এসেছি লিখতে গিয়েই অবাক হচ্ছি। চিমটি কেটে দেখছি ঠিক আমিই, আমরাই এ সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলাম? তারপর এলো ডি ডে। রাশি রাশি কার্টুন ভরছে, উঠছে, নামছে। পঞ্চাশটা মতো কার্টুন বাক্স থেকে জায়গার জিনিস জায়গায় রাখাই কী সোজা কাজ নাকি! এ কাজ আমি আমার জীবদ্দশায় অন্তত আর করতে চাইনা। প্রতিদিন আমি আর ময়ূরাক্ষী আড়াইটায় ঘুমোচ্ছি, সাড়ে সাতটায় উঠে পড়ছি।তাছাড়া গোটা পঁচিশেক গাছ, যার মধ্যে চার পাঁচটা বড় বড় গাছ, নিম, কারিপাতা, জবা ইত্যাদি।  একটা জবাকে রাখতে পারলাম না, ওটাই বড্ড বেদনার  তবে এর মধ্যে সবচেয়ে সময় লেগেছে কিন্তু সব চেয়ে আনন্দ দিয়েছে আমাদের ছোট্ট স্টাডিরুমটা গুছোতে। দিন তিনেক সময় নিয়েছিলাম মনে হয়, নাকি চারেক যাই হোক, সারা মেঝেতে ছড়ানো ছেটানো বই, সকালে দরজা খুললেই সেইই ছোটবেলায় লাইব্রেরিতে যেমন গন্ধ পেতাম তেমন গন্ধ পাচ্ছি...আহাহা। নতুন বাড়ি যা হয় আর কি, রাতে শুয়ে বৃষ্টি নামলেও ছুটে গিয়ে ব্লাইন্ডস ভিজলো কিনা দেখছি, জল, দাগ লাগলেই মুছছি। বুড়ো হলে নিজেদের নিয়ে খুব হাসাহাসি করবো নির্ঘাত। আদেখলার ঘটি হল দশা আর কি। 

জায়গাটা মূল শহর থেকে বেশ দূরেই। তায় ছোট। তবে আমাদের চারজনেরই  সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে। কারন অনেক অনেক গাছ আছে ক্যাম্পাসের মধ্যে। কোনো অংশে দুধারে চাঁপা গাছের সারি, কোনো অংশে দুধারে শাল, কিংবা কোথাও বকুল, কোথাও জারুল। সবুজ ঘাসে চাও তো বসে নাও একটু, চিড়িক চিড়িক করে একটা কাঠবিলাই চলে যাবে ছুটে। কিচিরমিচির করে পাখির ডাক শুনতে পাবে। পিছন দিকের গেট পেরোলেই একদম গ্রাম, বাঁশ ঝাড়টার সমেত। সাইকেলে করে চক্কর কেটে দুধ দই মিষ্টি কিনি, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকানের খোঁজ করি। এক সপ্তাহে আত্মীয়রা এলো। আত্মীয় কুটুমদের অবশ্য তেমন সুবিধের লাগেনি। একে তো নতুন বাসস্থান বেজায় ছোট, তায় শহর থেকে এত্ত দূর, সব মিলিয়ে তারা হতাশই প্রায়। তাও নেহাত ভদ্রলোক বলেই তেমন কিছু বলেনি মুখের উপর, নেহাত মুখ ফস্কে যতটুকু বলে ফেলেছে ততটাই আর কি। 

আশপাশের দোকানদাররা বেশীরভাগ মুসলমান না হলে নস্কর, পাল, বিশ্বাস, মন্ডল পদবীর, খুকুমনি বিবি, শহিদুল মোল্লা, নাজমুল হোসেন, রুকমিনা বেগম, অর্জুন নস্কর, সঞ্জয় মন্ডল, মাধব পাল  ইত্যাদি। সেদিন বিকেলে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম। আগে যাইনি এদিকটায়, সাইকেল থাকায় সুবিধে হয়েছে। দেখতে পাচ্ছি কেমন শিরীষ গাছগুলো সন্ধ্যের মুখে পাতা মুড়ে ফেলেছে। এরকম যে হয় জানতামই না। প্রজ্ঞাকে বলতাম সচারাচর এরকম।  মানে এই চারপাশের গাছপালার কিংবা পাখি নিয়ে প্রশ্ন থাকলে। কিংবা শহরেই পাশেই গ্রামগুলোর আর্থ সামাজিক যে বদল গুলো সেসব নিয়ে। অহেতুক গালগল্প আর কোনোদিন হবে না, কেমন দুম করে নেই হয়ে যায় মানুষে। যতদিন থাকে, আলগা হয়ে থাকি, যেই মানুষে চলে যায় সুতোয় টান পড়ে। অবান্তর কথা হোক কিংবা কেজো আলাপ আর কখনোই কিছু হবে না একটা মানুষের সাথে, এ সত্য দুম করে সামনে আসলে নড়ে যেতে হয় বটে। কিন্তু সত্যিই কি নড়ে যাই? প্রজ্ঞার চলে যাওয়ার পড়ে মনে পড়েছে বহুবার, কিন্তু বাকি কিছু তো থেমে থাকেনি। থাকেও না মনে হয়। কতলোকে জাজ করলো ওকে কেন ওই কেন সেই, যেন জীবৎকালে ওর ধার দেনা বিল সব মেটাতো তারা, ওর জুতোয় পা গলিয়ে কেউ দেখেনি, ওর রাস্তায় কেউ হাঁটেনি তবু কথার শেষ নেই। শিরীষ গাছ গুলোর আয়ূ আর কদ্দিন কে জানে! এদিকেও রাস্তা বাড়বেই শিগগিরই,  গাছেদের ভোট নেই, সুতরাং রাস্তা চওড়া করতে জবরদখল হওয়া জমির পুনরুদ্ধারের বদলে গাছ উড়িয়ে দেওয়া সহজ।

 একটা একা বোকা চায়ের দোকানে দাঁড়াই ভীড়ওয়ালা দোকান, পেঁয়াজির গন্ধ উপেক্ষা করে। কিন্তু বউটি হতাশ মুখে জানায়, "না বাপ চা নেই, কারেন্টে হয় কিনা। অন্য কিছু খাবে, খাও না? " মনটা ভালো নেই, এগিয়ে যাই।  তারপর আরো একটা দোকান জোটে, একলা বেঞ্চে বসে চা খাই। দোকানদার ছেলেটা মুখে খৈনি ঠেসে বসে। বসে থাকি চুপ করে অনেক্ষন। তারপর ফের একটা দমকা হাওয়া দেয়, উঠে পড়ি।  আরেকদিন বেরোবো, ওইই যে বাঁয়ের রাস্তা ধরে যাবো বেশ। কিংবা সোজাই চলে যাবো আরো অনেকদূর। আকাশের দিকে চোখ পাতি গাছেদের শামিয়ানা ভেদ করে, ফিবোনাচ্চি সিরিজে পাখি উড়ে গেল, মেঘের ফাঁক দিয়ে টকটকে আল আলো দেখা যাচ্ছে।.... "না চাহিতে মোরে যা করেছ দান আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ..."

Saturday, April 22, 2023

উৎসবে-জীবনে

একশো আশী ডিগ্রি চোখ ঘোরালে চোখে পড়ে আম গাছ থেকে আম ঝুলছে, কাঁঠাল ঝুলছে কাঁঠাল গাছ থেকে, একটা বসন্তবৌরি সজনে গাছে বসে, তারপর সারি দিয়ে দিয়ে নারকেল গাছ। একটা বাঁশের মাচায় শুয়ে আছি। চোখ একটু নামালে দেখা যায় প্রজাপতি উড়ছে, একটা কাঠপিঁপড়ে আমার পায়ের উপর উঠছে কামড়ালেই হয়ে গেল। লাল গরু জাবর কাটা ছেড়ে ঠ্যাঙ মুড়ে বসে ঝিমুচ্ছে।তার পাশে সাদা বাছুরটা মুখ দিয়ে দিয়ে গা চুলকুচ্ছে। পিত্তিপুকুরের জল শুকিয়ে কচুরিপানাও শিকুয়ে গেছে। দূরে তিল গাছের সাদা ফুল দেখা যাচ্ছে। চোখ বুজলে হরিনাম সংকীর্তন এর আওয়াজ থেকে ফোকাস সরাতে পারলে কানে আসবে পাখি ডাকছে। ওই হরিনামের বাড়িতে খেতে যাবো, হাঁড়ি বারনের নেমতন্ন। মানে রান্না যেন না করা হয়, সপরিবারের নেমতন্নকে গ্রামে হাঁড়ি বারন বলে।বাড়িতে আসা আত্মীয় কুটুম সমেত সকলে এসো। খিদে পেয়েছে বলেই পাখির আওয়াজের বদলে কীর্তনেই বেশী কান চলে যাচ্ছে। কীর্তনীয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছে, কে যেন বলছে, আমায় শাপ দিলে তো,  দেখো আমিও বলে যাই, তুমিও এই বিরহ ভোগ করবে আয়ান ঘোষের স্ত্রী হয়ে জন্ম নেবে, বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরা চলে যাবে ভগবান। 
কালীপুজোয় গ্রামে এসেছি। আজ আবার ঈদ। রাস্তা জুড়ে উৎসবমুখী মানুষ দেখতে দেখতে এলাম। এই চড়া রোদে দেখি কেউ কেউ ভেলভেটের কালো কুর্তা পরে বেরিয়েছে। মেয়েদের  পোশাকে নানান রঙের মেলা হলেও ছেলেদের বেশীরভাগ সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা না হলে কালো পাঞ্জাবি পাজামা। বয়স্ক লোক লোকে লুঙি। ফেজ টুপিরও কতরকম বাহার। কারো সবুজ, কারো ক্রীম, কারো চুমকি দেওয়া ঝলমলে। জুতোর বাহারও কম না, কালো পাঞ্জাবি পরুয়াদের কালো কুতো বেশীরবাগ, জড়ির কাজ করা কারোর কারো। আরে আদে বাইকটায় দেখো,  চারটে আছে তিনটে ভেবেছিলা। দুটো এমন ক্ষুদে আর একই রঙের পাঞ্জাবিতে মিশে গেছে। সামনের বাইকের ছেলেটার আবার দু লেয়ারের চুল! একটায় কালো রঙার একটায় লাল, লালটা পতপত করে উড়ছে। মুখে পান কিংবা জর্দা ছোট ছোট ছেলেদেরও,ছুঁচোলো উঁচিয়ে রাখা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এহেহে এ বেচারার বাইক গেছে বিগড়ে, মাথার চুমকি দেওয়া ফেজ টুপি এখনো ঝলমলাচ্ছে কিন্তু রোদে তার মুখ মলিন, বাইক টেনে এগোতে হচ্ছে কিনা। কটকটে গোলাপী জামা পরা একটা ছেলে জামা উড়িয়ে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল। মেয়েদের ঘাগরা হয় যে কাপড়ের ওই কাপড়ের ঝলমলে জামা, টিকলি পরা ছোট মাঝারি সব মেয়ে চলেছে। একজায়গায় জলের বোতল আর একলিয়ার্স দিলো। আহাহা আরো কয়েক জায়গায় মিষ্টি দেবে না? কিশোররা ও কিশোরীরা সব টোটোয়, যুবক ও বৃদ্ধরা বাইকে। যুবতী কিংবা বয়স্কা দেখলাম না রাস্তায়, ওদের কোথাও যাবার নেই? 


চোখ মেলে দেখি, ওদিকে হরিনাম বাড়িতে সবাই ছুকছুক করছে কখন কীর্তন শেষ হবে। শুনতে পাচ্ছি কীর্তনে প্রভু এখন ভোগ খাচ্ছে। জল প্রদান হচ্ছে নতুন ভান্ডে....হয়ে এলো আশা করা যায়। হ্যাঁ হ্যাঁ ওইতো সেবা করো সেবা করো বলে কানছে। অবশ্য আমি প্রভু হলে বলতুম," ব্যাটা মাছ নিদেন গেঁড়ির ঝাল দিচ্ছিস না আর এদিকে সেবা করো নিজগুনে বলছিস!!অন্তত গুগলির ঝাল দিতে পারতিস।" অবশ্য দই মিষ্টি আছে শুনতে পেয়েছি।  এবার ভোগ মন্দিরের দরজা বন্ধ করবে...কিন্তু নাহ কিন্তু গৌরহরি সেবা করছেনা বলে, নাকি কৃষ্ণও করবে না। জ্বালাতন মশাই। তা গৌরহরি খাচ্ছে নাইই বা কেন! আমিই গৌরহরি সেজে নেবো নাকি অ্যাঁ। ইরিবাবা এবার আবার বলছে বলছে সবাই এখন সবাই মিলে অযোধ্যায় যাবো কলিযুগ থেকে দু মিনিটের জন্য! নাহ বেচারা কীর্তনীয়ারও খিদে পেয়েছে দেখছি!

মোটা চালের গোল গোল ভাত, শুক্তো, ডাল, ভাজা, তরকারি,  আমের, চাটনি,লাল দই, মিষ্টি। ম্যান্ডেটারি জমি দর্শনে বেরোতে হয় এত খেয়েছি! বাদাম, তিল,  পাট বোনা হয়েছে। দুয়েক জায়গায় পটল। সবুজে সবুজ হয়ে আছে চারদিক। সবুজেরই শেড এত রকম, আমগাছের আম গুলোকে মনে হচ্ছে টুনি বালব জ্বলছে যেন। বাঁশবাগানের নীচে শুকনো বাঁশপাতা পরে গালিচা মতো হয়ে আছে। উবু হয়ে নিড়ানি দিচ্ছে একজন। দুটো মেয়ে খালপাড়ে আম না কি যেন মাখা খাচ্ছে। চারদিকে ঘন দুপুর। আলের উপর দিয়ে সড়সড় করে একটা হলুদ ডোরাকাটা কানা মেটুলি চলে গেল। দুটো ছাগলে আরাম করে ঢুঁসোঢুঁসিকরছে। গামছা পেতে একটা লোক নারকেল গাছের নীচে ঘুমোচ্ছে। বাপ ব্যাটায় খালের জলে পাম্প লাগাচ্ছে।
"কোথায় যাচ্ছিস রে দুপুরবেলা"।
-কোত্থাও না,  তোরা কি করছিস?
-ছিঁচতে হবে নে?এক ফোঁটা বিষ্টি হলুনিতো। 

এসব কথা আলগোছে পেরিয়ে হেঁটে যাই, কোথায় যাই জানিনা। কিংবা জানি। আমি সেইই আমগাছটার কাছে যাচ্ছি, যে আমায় একবার আশ্রয় দিয়েছিল অনেকদিন আগে, যখন খুব অস্থির ছিলাম। আর এমনিই উপহার দিয়েছিল দুটো আম। না চাইতেই, যেন খানিক আদর দেখাতেই। তাকে থ্যাংকইউ বলা হয়নি,কত বছর হয়ে গেছে যাওয়াও হয়নি। গাছেরা রাগ করেনা, তবু অকৃতজ্ঞতার লজ্জা নিয়ে যাই। সেই ছোট পাতার ডালটা এখন বড় হয়ে গেছে, মোটা হয়ে যাওয়া চোখে তাকে চিনতে পারিনা আর। বিড়বিড় করে, মনে মনে, জোরে জোরে কথা বলি। কতদিনের পুরোনো গাছ, নিজেদের মধ্যে কতদূর দূর অব্দি কানেক্টেড শিকড়ে শিকড়ে। অস্থিরতা, অকারণ মনখারাপ সমর্পণ করে দিলেই হল না। কানেকশন তৈরী করতে হয়, বুঝতে হয় বোঝাতে হিয়। গাছেরা জ্ঞানী বলেই সেই বোঝানো সহজ। অনেকক্ষণ পরেও পাত্তা দেয়না, একটা পাতাও কাঁপেনা। অনেক অনেক পরে মন খারাপ করে চলে আসবো ভাবছি। কোথাও কিছু নেই, দমকা হাওয়ায় একটা ফলভরা ডাল নড়ে ওঠে। আদর ছুঁড়ে যায় গায়ে মাথায়...আমি চাইতে আসিনি কিছুই তবুও পেয়ে যাই। এই
হঠাৎ হাওয়া দেওয়ায়, গাছের পাতা নড়ায় গাছ আমার কথা বুঝতে পেরেছে শুনে হাসবে তোমরা, কিন্তু বারবার একই ঘটনা ঘটলে তাকে কোইন্সিডেন্স বলা যায় কি? যেদিন মানুষ গাছেদের সাথে কথা বলতে পারবে আরো সহজে তখন জানবে এ আমার আত্মপ্রবঞ্চনা নয়, মনের  ভুল নয়। 

রাতের বেলা যাচ্ছিলাম কোথায় যেন...নিকষ অন্ধকার চারদিক, তবুও যেন অন্ধকার নয়। একটা আবছা আলো আছে চোখ সয়ে গেলেই। আমাদের পুজোর আলো শেষ যেখানে, সেখানের পরই যেন ফিল করতে পারি অপুর ক্লস্ট্রোফোবিক কেন লাগতো গ্রামে। এক জায়গায় স্থির থাকা আমার সইবে না আবার খুব উদ্দামতাও সয়না..ঠিক কী চাই তা জানতেই মনে হয় এ জীবন কেটে যাবে।


 







Sunday, April 16, 2023

ছুটিতে ছুটোছুটি (ঔরঙ্গাবাদ )

"অ্যাই বিস্কুট খাবি নাকি? " 
"যা তোর বাবাকে ডেক্কে নিয়ে আয় না, সব শেষ হয়ে গেল যে "। 
" ও ভাইয়া চায়ে মিলেগা?"

যে কোনো ট্যুরিস্ট স্পট হল মানুষ দেখার আদর্শ জায়গা। ইলোরার শান্ত প্রাচীন গুহা ছেড়ে বেরোতেই, হই হই লোকজন। সব ওখানেই ছিল,  বেলাশেষে বেরিয়েছে।  চায়ের দোকান খুব নেই এ চত্বরে, একটা সবেধন নীলমনি  দোকান দেখে চা বানাতে দিয়ে জুত করে বসে মানুষ দেখছি। নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছি না,  পাছে "ও আপনারাও বাঙালী, কোথা থেকে আসছেন, কতদিন থাকবেন...." ইত্যাদি শুরু হয়। এমনিতেই আমরা অসামাজিক মতো, তায় ভীতু মানুষ এত দাপুটে লোকেদের থেকে ডিস্ট্যান্স রেখে বসাই ভালো। শুরুর কথা গুলো ওরকম একটা দলই বলছিলো। চুক চুক করে শুনছি, আর নিজেদের মধ্যে তাকাতাকি করছি," বাপরে কী দাপঅট"।  ইলোরার প্রাচীনকাল যেমন উপভোগ করি,  তেমনই তফাৎ থেকে বর্তমানের এই কলরবও কম উপভোগ করি না, স্বীকার করতে বাধা নেই। সত্যি বলতে বাঁদরদের কিচিরমিচির আর মানুষদের কিচিরমিচির খুব তফাৎ নেই, নিরাপদ দূরত্ব থেকে দুইই দেখতে মজা লাগে। 
সৌরভ আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, ওই অত চড়াই উৎরাই ভাঙার জন্যই, যে আজ ও বিরিয়ানি খাবেই খাবে। এমনিতে বেড়াতে গিয়ে আমরা যা পাই তাই খাই টাইপ। আর যেখানেই যাবো বিরিয়ানি খেতে হবে এমনও না আমাদের কিন্তু  আওরাঙ্গাবাদের নিউ সাগর হোটেলের বিরিয়ানির খুব নাম শুনেছিলাম। সুতরাং ওটা আমাদের লিস্টেই ছিল। ফিরতি পথে দেখলাম সারিসারি ধাবা গুলোয় আলোজ্বলা শুরু হয়ে গেছে। একটা রাজস্থানী ধাবা ভারীচোখ টানছিল, যেন একটুকরো রাজস্থানের গ্রাম। 

এখানের অটোওয়ালারা কী নাটুকেরে ভাই! একজনকে দাম জিজ্ঞেস করেছি, অস্বাভাবিক দাম বলায়, না বলেছি। ও বাবা সে আবার যাওয়ার সময় বলে গেলে, এত বড় হোটেলে কত টাকা দাও আর অটোওয়ালাদের দিতেই যত আপত্তি। প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই দেয় আর কি! নিউ সাগর থেকেও ফেরার সময়ও, লোকটা নাকি বোঝেনি আমাদের হোটেল, তাই ভুল ভাড়া বলেছে। সে কী অভিমান,  ছেড়ে দিন আমার ভুল আমায় আর ভাড়া দিতেই হবে না!! আলাদাই!  যাই  হোক নিউ সাগরের খাবার দাবার চমৎকার ছিল, ঝাল ছিল অবশ্য। কালকেও বিস্তর হাঁটাহাঁটি আছে। এইটুকু ঘুষ দিতেই হত আমার সঙ্গের দুই মক্কেলকে। এবারে ঘোরায় এত ছুটোছুটি তার মধ্যেও এই যে এক ঝলক শহর দেখা হয়ে গেল এও বেশ কিন্তু। এদিক সেদিক গলি বাজার ঘুরে নিউ সাগরে যখন এনে ফেলেছিল অটোওয়ালা দাদা, ততক্ষনে বিরিয়ানির বদলে মাথার যন্ত্রণায় আধমরা হয়ে নেতিয়ে পড়েছি। 
সৌরভের চিকিৎসা খুব সিম্পল, মাথা ব্যথা? জল খা। জল যাকে খেতে বলছে সে হয়তো কুঁজো খালি করে ফেলল, কমেনি? আচ্ছা তাহলে খিদে পেয়েছে। খেয়ে তার পেট ফেটে যাবার জোগাড়,  কমেনি? আচ্ছা হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়িস! সহজ সরল চিকিৎসা পদ্ধতি আর কি। 

ঠাকুমার সৌধ দেখে নাতির সাধ হল মায়ের নামে সৌধ করবে। আমাদের মতো টানাটানি তো আর তাদের ছিল না, ইচ্ছে হয়েছে করে ফেলো। লাগে টাকা দেবে কোষাগার। সুতরাং ঔরঙ্গজেবের ছেলে আজিম শাহ মা দিলরাজ-বানু-বেগমের স্মৃতি সৌধ বানালো যা কিনা অবিকল তাজমহলের মতো দেখতে। ডুপ্লিকেটের বাজারদর কম তাই সারা তাজের সমতুল জনপ্রিয়তা নেই এর।  তবে ডুপ্লিকেট হোক যা হোক, দেখতে ভালোই লাগে। আমাদের লোভী মন, ভিতরে মাজারের উপর প্রচুর নোট দেখে ভাবনা আসে এহে চাট্টি তুলে নিলেই হয় টাইপ। অত অমন করার কিছু নেই৷ নোট তুলে নেওয়া হয় নিয়মিত ব্যবধানেই, না হলে কয়েক বছর আগের বাতিল নোট নেই কেন!






ঔরঙ্গাবাদেও কিছু কিছু গুহা আছে। সেসব গুহায় হীবযান, মহাযান, বজ্রযান সবের প্রভাবও আছে। যেহেতু আজ ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টে ওঠার প্ল্যান আছে, আর কাল বিস্তর হাঁটাহাঁটি হয়েছে (টু বি প্রিসাইজ গতকাল ১০ কিলোমিটার হেঁটেছি),  তাই আজ ভেবেছিলাম,  বেশী চাপ নেবো না। গাড়ি পুরোটা যাচ্ছে না, রাস্তার কাজ চলছে, তাই  এখানেও হাঁটতে হবে ভালোই।  রাস্তায় আবার চটের বস্তা চাপা দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছে। সে বস্তার যা খুশবাই বাপরে! এই গুহাগুলোর তেমন পপুলারিটি নেই, মানে ইলোরার মতো, তাই ভীড় কম।  দু চারজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে প্রেম করতে আসে,  তাও এত সিঁড়ি ভাঙতে হয় বেশী আসে না। বেশ জায়গাটা৷ এখানে আসলে বোঝা যায় কেন সে প্রাচীন আমলে এই জায়গাটা নির্বাচন করেছিল শিল্পীর দল। মানে তখনও চারপাশ এমন জনবহুল হয়ে ওঠেনি হয়ত কিন্তু ভাবতে ইচ্ছে করে সেই সময়েও হয়ত আকাশ এমনই নীল ছিল, মাথার উপর টিয়ার দল এমনই ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে পাড়ি দিতো। গুহা অব্দি পৌঁছতে হাঁফ ধরে বটে কিন্তু পৌঁছনোর পর ভারী ভালো লাগে। এমন গাছের ছায়ায় মোড়া পাহাড়, ঝকঝকে একটা দিন, কটা কাঠবিড়ালি তুড়ুক তুড়ুক করে খেলে বেড়াচ্ছে, খারাপ লাগার অবকাশও নেই খুব। 
এই গুহাগুলো দুটো ভাগে ভাগ করা আছে। বাঁদিকের গুলোয় বজ্রযান প্রভাব কম যা বুঝলাম, ডানদিক ধরে খানিক এগোলে একটা জমকালো গুহা মেলে। বারান্দা ওয়ালা গুহাটায় প্রায় সব কটা দেওয়ালেই কাজ আছে। বুদ্ধ এখানে সিংহের উপর আসীন। কেন জানিনা, পড়াশোনা নেই। এছাড়া বজ্রযানের প্রভাবেই কিনা কে জানে নানা রকম দেবীর মূর্তির সংখ্যা বেড়েছে। 


ঔরঙ্গাবাদ ফোর্টে গিজগিজ করছে মানুষ, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সরু সরু অন্ধকার সিঁড়িগুলো দিয়ে যাবার সময় বিকট পিলে চমকানো আওয়াজ করছে। স্কুলের বাচ্ছাগুলো অনেক ভালো, তাদের টিচাররা যেমন বলে দিয়েছে তেমনই করছে, যথাযথ লাইন মেনে যাচ্ছে। সমস্যা বড় বাঁদরগুলোকে নিয়ে। বাঁদর মানে সত্যি বাঁদরও অনেক আছে।  মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পরে তাদের কাজকর্ম দেখতে হয়, এমনই চিত্তাকর্ষক।  একটা একদম গেঁড়ি মতো বাঁদরছানা এদিক সেদিক দোল খেতে খেতে,  বেশ খানিক উঁচুতে দুর্গের একটা অংশে লাফ মেরে উঠে পরেছে। উঠেছে তো উঠেছে,  আর তো সে নামতে পারে না।কারন আশপাশে আর কিছু সাপোর্ট নেই। ভয় পেয়ে মুখ মলিন করে বসে আছে। পাশে গাছটা অব্দি ঝাঁপাবার ক্ষমতা তার নেই। ওদিকে ওই গাছে তখন আরো  দুটো ছানা দোল খাচ্ছিলো। সে দুটো এটার চেয়ে একটু বড়, ওই লোয়ার নার্সারি আর প্রথম শ্রেনীর মধ্যে যতটুকু তফাৎ আর কি। তা বড়রা যেমন হয়, খুব দোল খাচ্ছে, এক এক বার লাফ মেরে ওই উঁচুটায় উঠেও যাচ্ছে, প্রবল কসরত করতে হলেও নেমেও আসছে। খানিকটা ভরসাও দেওয়া হচ্ছে যেন, ওরে পারবি, একবার লাফ দিয়েই দেখ না। এদিকে ক্ষুদেটার ভয় আর ভাঙে না, সত্যিই ওর পক্ষে মুশকিল। আশেপাশে বড়রাও কেই নেই, ক্লাস ওয়ানের গুলোর পক্ষে ওকে রেস্কিউ করাও সম্ভব না। বিরাট টেনশের সিরিজে আটকে গেছি, কী হয় কী হয়।  দুর্গবিজয় মাথায় ওঠে প্রায়। শেষ অব্দি যা হয়, সাহস করে ঝাঁপিয়েই পড়লো আর হাঁচোড়পাঁচোড় করে গাছের ডাল ধরেও ফেললো! তারপরেই তুরতুর করে ছুট ছুট! "বাপরে ওদের সাথে আর মেশে! দাঁড়া না আজ মাকে বলব, তোদের সাথে গিয়ে কেমন বিপদে পড়েছিলাম!"
ওদিকে আর একজন তখন কার থেকে ছিনিয়ে আনা একটা সিঙারা জুত করে বসে খাচ্ছে। পাশে একজন তার ছানাকে গলায় ঝুলিয়ে উদাস মুখে বসে। ভাবখানা, "এহ ভালো দাঁও মেরেছে ? একটুও দেবে না সিঙারা? এর যা চেহারা বাপ্রে, লড়াই করে তো আর পারবো না, দেখাই যাক  একটু বসে, যদি দেয়! তা সিঙারাওয়ালার ওসব ভাবাবেগ নেই। জানে এ মহিলা স্রেফ সিঙারার লোভেই কাছে এসেছে, সুতরাং আরাম করে তারিয়ে তারিয়ে সে সিঙারা শেষ করল। তারপর,  জল খেতে গেল, যেখানে "ড্রিংকিং ওয়াটার" লেখা সেখান থেকেই। এবং কল ঘুরিয়ে জল নেই দেখে অন্য জায়গার অপরিশ্রুত জল না খেয়ে লেজ নেড়ে চলে গেল। হনুমান হলেও কলেরার ভয় আছে যথেষ্ট! 
সিঙারা খোর

একটুও কি দেবে না?

লোকগুলো গাধা নাকি! এখানে ড্রিংকিং ওয়াটার লেখা ওখানের নোংরা জল খাচ্ছে!


হাঁচোড়পাঁচোড় করে দুর্গজয় করা হল। রাস্তায় কত রকম মানুষ দেখলাম। বছর কুড়ি বাইশের৷ বাপ আরো ছোট, অত্যন্ত রোগা মা, তাদের বাচ্ছাকে নিয়ে এসেছে।  এ দুর্গ যখন তৈরী হয়েছিল,  লোকেশন বুঝেই তৈরী হয়েছিল। দূর দূর অব্দি ফাঁকা প্রান্তর, সৈন্যদল আসলেই কামান দাগা যাবে। সেসব কারন, সেসব সৈন্য, সেনাপতি, অস্ত্র সব মরে হেজে গেছে। এখন সেখানে একটি মানবক আর দুটি মানব চড়া রোদ, অর্থনৈতিক অবস্থা উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা উদযাপন করছে। কিংবা কোনো ফোকরে, যেখান থেকে নজর রাখা হত স্রেফ কে আসছে কে যাচ্ছে, সেখানে নিবিড় ভাবে বসে স্বপ্ন বুনছে, প্রাকৃতিক শোভা দেখছে। ইতিহাসে এদের কথা লেখা থাকবে না, কে কবে যুদ্ধ জিতেছিল, কে কবে হেরেছিল, কার সাথে কে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সেটুকুই লেখা থাকবে, বড্ডজোর আধুনিক ইতিহাসের ধারা মেনে, কোন সময়ে কোন কাজ কিভাবে সে সময়ের ডেমোগ্রাফি বা সম্পর্ক বদলে দিয়েছিল সেই অব্দি। কিন্তু একদম ধর্তব্যের মধ্যে না আনা মানুষও কেমন করে জীবন উপভোগ করতো তা স্রেফ এই রোদ ঝকঝকে দিন, আর এই দুর্গ মনে রেখে দেবে। কে জানে রাত হলে সবাই চলে যাবার পর, ওদের ইতিহাস খাতায় ওরা কোনটা লিখে রাখে, অকারণ হাসি না কঠিন লড়াই....


ওই যে উঁচু পাহাড়টা ...ওইটেয় উঠবো






দুর্গ জয়ের পর


দুর্গ জয় করে হাসি মুখে পোজ দিতে হয়





এককালের বিরাট ক্ষমতাশালী...




উঁচু থেকে চারপাশ



রাস্তাও বটে , নজরদারীর জায়গাও বটে