Sunday, December 26, 2021

আনাচ কানাচ

শীতের শুরুতে এখানে বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়ে যায়। এ বছর এখনো পড়েনি। এখানে মানে বাংলা বিহারের বর্ডারের এক ছোট শহর যেখানে আছি।  ওয়ার্ক ফ্রম হোম অপশনটা আমার জন্য ভালোই হয়েছে। দিব্যি কল নিতে নিতে দেখতে পাই চিড়িকদাসের খুড়তুতো নাতি জানলার কার্নিশে বসে বাদাম খাচ্ছে, সেদিন তো ঘরেই এসেছিল আলাপ করতে। কিংবা নীল রঙের পাখিটা টুইটুই ডেকে ফুরুত করে উড়ে যায়। এ বাড়িটাও ভাঙাচোরা, আগেরটার মতো না হলেও ছাদে লম্বা লম্বা ঘাস, ড্রেনেজ পাইপের ফাঁকে বা জানলার কার্নিশে হলদে রঙের ফুল ফুটেছে। কিন্তু সে সব সমস্যা বলে আমাদের মনেই হয়না। নিজের অবস্থায় অখুশী থাকলে বা অভাববোধ থাকলে উন্নতি হয়,  আমাদের উন্নতি হবে না মনে হয় কখনো। আমরা দিব্যি এসব ছোটখাটো জিনিস পাত্তা না দিয়ে হাঁড়িচাঁচা কিংবা দোয়েল এর আনাগোনা দেখি, নীল রঙের প্রজাপতিটার ছবি তুলতে পারছি বলে কুঁইকুঁই করি, বাড়ির সামক্নে কামিনী ফুলের গাছটায় সাদা হয়ে আছে ফুলে, রাতের বেলা বেরিয়ে প্রানভরে গন্ধ নিই বারান্দা চেয়ার পেতে বসে। 
এমনিতে এ জায়গাটা গরু আর ষাঁড়দের স্বর্গ বলা যায়। ইচ্ছে মতো হাঁটে দুলকি চালে, যেখানে খুশী গোবর ছড়ায়। এখানকার মানুষও মোটামুটি ওই পর্যায় এর উদাসীন করে ফেলেছে, পুরো শহরটাই যেন ডাস্টবিন, যেখানে খুশী থুতু ফেলা স্বাধীন নাগরিকের অধিকার। তবে সবে মিলে একসাথে আছে ভালোই৷ এই তো সেবার একজনের টোটোতে গরুতে মাথা গলিয়ে দিয়েছিল। ভেবেছে সেও যাবে হয়ত একটু হাওয়া খেতে। টোটোওয়ালা না না পয়সা না দিলে নেই ভাব নিয়ে তাড়িয়ে আবার চলতে লাগল। 

ছুটির একদিনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গন্তব্যের থেকে চলার পথ আমাদের কাছে কম আকর্ষনীয় নয়। তাই হুট করে থেমে জঙ্গলের মধ্যে এক আশ্চর্য ঝালমুড়িওয়ালার কাছে দাঁড়াই। কাঁপা কাঁপা হাতে বুড়ো মেখে দেয়, ঝাল কমাতে  পাশের মন্দিরের সামনের টিউবওয়েল থেকে ঢকঢক করে জল খাই জামা ভিজিয়ে। কিংবা দাঁড়িয়ে পড়ি কোনো চায়ের দোকানে, আলগোছে রাজনৈতিক চর্চা শুনতে শুনতে চেখে দেখে স্থানীয় কেক বিস্কুট। ফের চলতে থাকি,  যতক্ষন না আমাদের আটকে দেয় বুনো ফুলে ঢাকা কোনো বাড়ি, কে থাকতো এখানে কিংবা কে থাকে? জানতে যাই না,  পুরোটা না জানাই ভালো। তারপর পৌঁছে যাই সুতানের জঙ্গলে। পিকনিক পার্টি এসেছে একটা, উব উব ডিজে নেই বটে কিন্তু এই জঙ্গলে কোলাহল ভালো লাগে না। হয়ত দলে এলে আমরাও তাইই করতাম। তার চেয়ে জঙ্গলের পথে পথে চলাই ভালো। কখনো পিচকালো রাস্তা কখনো লাল মোরাম। কাঠ কুটো তুলে নিয়ে চলেছে বউ আর তার ছোট দুটো ছেলে মেয়ে। এদের গ্রামটায় যাবে? চলো। দিব্যি ছিমছাম একটা গ্রাম। জঙ্গলের একদম গা লাগোয়া, খুবই সামান্য উপকরণ নিয়েই বেঁচে আছে। ভালো না মন্দ তা বলার আমি কে। তবে মন্দিরটা চমৎকার।  স্রেফ একটা ছাউনিয়াছে, মাটির দাওয়ায়। ভগবান যদি থাকে তো সে এরকম খোলামেলাতেই থাকতে ভালোবাসবে, ওই ঘুপচি ঘরের ধূপের ধোঁয়ার চেয়ে এ স্বাভাবিক বুদ্ধিটা ভগবানে বিশ্বাসীদের হয়না কেন?! এক বুড়ো চাদর জড়িয়ে লাঠি হাতে হেঁটে চলেছে রোদের দিকে, একটা মানুষের ছানা এক বালতি জলে খুব মন দিয়ে চান চান খেলা করছে। একটা ছাগল ছানা এক মনে পাতা চিবুচ্ছে। মাচায় শিম ফলে আছে। দুপুরবেলার সময়, খাটিয়ায় আরাম করে কেউ কেউ খেতে বসেছে। তথাকথিত সভ্য চোখে রাস্তায় খাওয়া যেমনই হোক আমার চোখে মন্দ লাগে না। দিব্যি আরামে খাওয়া। আজকাল প্রায়ই আমার মনে আমাদের এই অবিরাম ছুটে চলার সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। চলার নামই জীবন এসব সাদা কালো সরিয়ে যদি একবার দেখি, সারাক্ষন এমন উন্মাদনার জালে  পড়েছি যে আমাদের আর শুধু বিরিয়ানিতে মন ওঠে না, তার সাথে এক হাতা চকলেট সস ঢেলে আরো অন্যরকম করতে হয়। আমি হয়ত খুব বেশী সরল করে দিলাম, বলতে যেটা চাইছি আমাদের কেন আরো আলো আরো বাতাসে সুখ আমাদের যেন হয়না। যাক এসব কথা, সত্যি কথা স্বীকার করা ভালো আমিও এরকম একটা জায়গায় জীবন কাটাতে পারবো কি? 
তালবেড়িয়া ড্যাম এর মত এমন সুন্দর জায়গা প্রায় মিস করেই যাচ্ছিলাম। রাস্তার চায়ের দোকান, মা ছেলেতে চালায়, মা সিঙারার পুর ভরছে আর ছেলে চা বানাচ্ছে। সেখান থেকেই খবর পেলাম কিলোমিটার দশেকের মধ্যেই আছে তালবেড়িয়া ড্যাম। পড়ন্ত দুপুরের গাঁ পেরিয়ে ড্যামের কাছে পৌঁছে দেখি তখনো ড্যামের চারিদিকের পিকনিক পার্টিদের দুপুরের খানার ইন্তেজাম হয়ে ওঠেনি। একদম কৃষ্ণানুগামী এসেছে তাদের রাধা কৃষ্ণকে সোয়েটার পরিয়ে।  কয়েকজন তরুন ড্যামের ঠান্ডা জলেই সাঁতার দেবার তোড়জোড় করছে।ড্যামটার চারধারে ঘন সবুজ শাল পিয়ালের বন। একটা নিম গাছের নীচে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে রোদ মাখতে মাখতে দেখছিলাম কেমন একদলের রান্না শেষ হচ্ছে, একদলের নিরামিষ রান্না চলছে, কারোর মাংসের ঝোল নামল বলে।  একই জায়গা হরেক মানুষ হরেক পছন্দ। সৌভাগ্যক্রমে উব উব ডিজে পার্টি নেই বলেই অসহনীয় লাগছে না।  রাতে যখন এসব জায়গায় জ্যোৎস্না হবে কেমন ভেসে যাবে ভাবতে গিয়ে দেখি পড়ন্ত রোদেও কম ভাসেনি। 
তারপর ফের পথ ডাক দেয়, পথের ধারে খেজুর গুড়ের ভাটি। ইলেক্ট্রিসিটি নেই স্বাভাবিক ভাবেই এসব অস্থায়ী জায়গায়, সন্ধ্যে হলেই শুয়ে পড়ো আর সকাল হলেই উঠে খেজুর রস নামিয়ে জ্বাল দাও। মিঠে গন্ধে জায়গাটা আমোদিত হয়ে থাকে। লোভী মানুষ, থমকে যাই, আঁজলায় করে গুড় খাই। আবার কখনো মেচা সন্দেশ এর সারিসারি দোকান দেখলেও দাঁড়িয়ে যাই। চায়ের দোকান থেকে খেজুড় গুড় হয়ে মেচা সন্দেশ চলার পথ একটানা আর হয় কই।
ডিসেম্বরের শেষ, শীতের শুরু। বাপ্রে বাপ ঠান্ডা পড়েছে। পাশের কোয়ার্টার কদিন খুব পরিষ্কার হল, এক দম্পতি এসে থাকছে। যা কিছু বিনা পয়সায় মেলে তার দাম আমরা দিইনা। জ্যোৎস্না মাখতে ছাদে উঠেছিলাম, চাঁদের আলো থৈ থৈ করছে, নারকেল গাছের ফাঁকে, দেবদারু গাছের গোড়ায়, ভাঙা কার্নিশে। আর কোথাও কোনো আওয়াজ নেইঝালি ইলেক্ট্রিক আলো গুলো ব্যাঘাত ঘটায়, তাও গাছের ফাঁকে ফাঁকে এড়ানো যায়। চাঁদের চারদিন আলো জ্বালার কোনো মানেই নেই। আমাদের ভাঙা চোরা কোয়ার্টারে অভাববোধ না থাকার কথা বলছিলাম না, তা সেসব আমাদের ঘরে টুক করে ঘুরে যাওয়া কাঠবিড়ালী, লেবু গাছে ওড়াউড়ি করা প্রজাপতি, কামিনী গাছে দোল খেয়ে যাওয়া দোয়েল এদের জন্যই।  সেদিন গাছ কাটা লোক এসেছিল, হুড়ুমদুড়ুম করে গাছ এর ডাল কেটে "শোভা" বাড়াতে গিয়ে গাছ গুলোকে ন্যাড়াই করে দিয়েছে প্রায়। কাঠবিড়ালি, নীল প্রজাপতি, দোয়েল কেউইই আজকাল আসছে না। আসবেই বা কোথায়! অমন ঘন কাঁঠাল গাছ, কামিনী গাছ, লেবু গাছ কিচ্ছুই কি আর ভালো রেখেছে। ওদের ঘরবাড়ি আমরা রাখতে পারিনি। যে লোকটা গাছ কাটছিল, সে এত কিছু বোঝে না ভাবে না, তার মনে হয় ভালো লাগে না এ কাজ তাই নির্দয় হয়ে গাছ সাফ করে। রাতেরবেলা চুঁইয়ে চুঁইয়ে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ে, কাটা পড়া জায়গা গুলোয়, একটু একটু করে সেরে ওঠে। গাছ সাফ করে ফেলবো এ ভাবনাই বড় বেশী দাম্ভিক। কেটে কুটে সব শেষ করে ফেলে মানুষও যখন শেষ হয়ে যাবে জঙ্গল ফের নিজেকে খুঁজে নেবে মানুষ না থাকলেই। সে সময় গুলোতেও এরকম মায়া মায়া জ্যোৎস্না এসে সারা চরাচর ধুয়ে দেবে, ভাঙা কার্নিশ বেয়ে হয়েত কোনো ফ্রেমে হঠাৎ আটকে পড়া হাসি আহ্লাদ লুটোবে। কে বলতে পারে! 

Saturday, December 11, 2021

মহারাজ, একি সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে (পর্ব দুই)

"বাইরেটা একবার দেখ রে গিয়ে"।
তড়াক করে উঠে ঘুমভাঙা চোখে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই স্থির হয়ে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়ালে অনতিদূরেই হিমালয়ের বরফ ঢাকা চুড়ো। সামনে বিয়াস নদী বয়ে চলেছে। মনে  হয় চুপ করে দাঁড়িয়ে এই  জীবনকে, এই আকাশ বাতাস  পাহাড় নদীকে, প্রনাম জানাই। রোজকার না পাওয়াগুলো ঠান্ডা হাওয়ায় উড়ে যায়, বুকের ভিতরটা শান্ত শীতল হয়ে দাঁড়ায়।




 


রাজা শৌখিন, রুচিবান ছিল মানতেই হবে।  কী দেখবো সেটা তো আসলেই নিজের উপর তাই একই জল হাওয়ায় পুষ্ট হয়েও সবাই সব দেখতে পায় না।  যাই হোক, অমন সটান সতেজ সকালে স্নোক্যাপ মাউন্টেউন, উপত্যকা আর কাঠ আর পাথদের তৈরী রাজপ্রাসাদ এ নিয়েই এমন বিভোর হয়ে গেলাম, ধুত্তোর রিভার র‍্যাফটিং করার ম্যালা জায়গা আছে ও পরে করব খন বলে কাটিয়ে দিয়েছি। একটা চমৎকার মন্দির আছে, সে মন্দিরে ঠাকুর দেবতা নেই, একটা পাথর আছে।  হিমাচল তো শুধু স্নো ক্যাপ মাউন্টেইন দেখার জায়গা না, এখানকার লৌকিক অলৌকিক বিশ্বাস, গল্পগাথা, আচার আচরণ সব মিলিয়ে আলাদা একটা অনুভূতি তৈরী করে দেয়। এখানেও গল্প শোনা গেল, এই নাগগরের এই শিলাটা নাকি এক ঝাঁক মৌমাছি নিয়ে এসেছিল। দেবতা আর দানবদের যুদ্ধে দেবতারা হেরে যাচ্ছিলো প্রায় টায়ার্ড হয়ে। তাই তারা রূপ বদলে মৌমাছি হয়ে এই শিলাকে এখানে সরিয়ে আনে আর নিজেদের শক্তি রিচার্জ করে নেয়। প্রতি বছর আশপাশ সব গ্রাম থেকে দেবতাদের নিয়ে আসা হয় ( যুগ বদলেছে, এখন দেবতারা নিজেরা আসতে পারে না),  এইখানে নিজেদের রিচার্জ করে নেবার জন্য। হিমাচলের দেবতাদের গল্প গুলো একটু আলাদা না? এরকম রিচার্জ এর গল্প আমি শুনি অন্য কোথাও। আর্য অনার্যদের যুদ্ধ ইতিহাস কি খানিক লুকিয়ে থাকে এসব গল্পে? যাকগে এদের আচারটা বেড়ে খেতে, স্থানীয় কি একটা স্পব্জি দিয়ে বানায়।  আলুর পরোটাটাও চমৎকার।  আমরাও রিচার্জ করে নিলাম।

নাগ্গ‌রের মন্দির। দেবতার মূর্তি নেই , শিলা খন্ড আছে, যেখানে রিচার্জ করে দেবতারা!






আমরা অনেকেই ভাবি পাহাড়ে গিয়ে থাকবো ঠিক একদিন, পাহাড় দেখবো, ছবি আঁকবো বা গান গাইবো বা বাগান করব এরকম কিছু। তা আমরা ভাবি আর রুশ সাহেব নিকোলাস রোইরিখ নানান কাজকর্ম করে, হিমালয়ের প্রেমে পড়ে সস্ত্রীক নাগগরে বাড়ি বানিয়ে রইলেন। সে বাড়ি আর ছবি গুলো মিউজিয়াম করে দিয়েছে তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।  আমি ছবিটবি তেমন বুঝিনা, তাও আমার বেজায় ভালো লাগল। আর বাড়িটার কথা আর কি বলব, পাহাড়ের গায়ে গাছপালা ঘেরা দোতলা কাঠের বাড়ি।দোতলার স্টাডি কিংবা বারান্দা থেকেই হিমালয় দর্শন হবে। এদিক সেইক দেখতে দেখতে  পাক খেয়ে খেয়ে নীচে নেমে সমাধির জায়গাটায় পৌঁছেছিলাম। ইচ্ছে করে একটু নীচে সমাধিস্থল পছন্দ করেছিলেন মনে হয়। অযথা ভীড় হবে না, এতটা পাহাড় বেয়ে নামতে হবে বলে, এদিকে পাতা আর ফুল ঝড়ে পড়বে।  মানুষ মরলেই সব শেষ, কারন আদতে এটা যন্ত্র কিন্তু যন্ত্রের তো মেমারিও থাকে। মানে ভিডিও বা ফটো জিনিসটার সাথে অপরিচিত একজন লোকের কাছে সেটা ভূত বলেই মনে হবে, অন্য ডাইমেনশন থেকে কেউ এসে আমায় কিছু বললে সেটা আমার কাছে অলৌকিক অবিশ্বাস্য কিংবা ভৌতিক বলে মনে হবে। তেমনই মানুষ মরে গেল সেই যন্ত্রের ছাপ কোথাও একটা রয়ে গেল কিংবা আসলে অন্য ডাইমেনশনে অন্য জগত শুরু হল? গাছ, পাহাড়, নীল আকাশ, নদী, পাখির ডাক শুনতে শুনতে শুয়ে থাকার বহু পুরোনো  ইচ্ছেটা জোরদার হচ্ছিল। পাক মেরে মেরে ফেরার পথে দেখি একটা বেঞ্চে একজন পাহাড়ি মহিলা শুয়ে আছেন আরামে। ঝাঁটপাট দেওয়া হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে আর কি চাই!


দু বছর ধরে টানা ঘরে বসে কাজ করে ফিটনেসের বারোটা বেজে গেছে। একশ মিটার উঁচুতে মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে জিভ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। রাস্তাটা যথারীতি গাছে ছাওয়া, চড়াই এর মাথায় একটা এই মস্ত লোমওয়ালা কুকুর বসে আছে  অভ্যর্থনা করতে। নিকোলাস আর হেলেনা দুজনেরই একখান করে পালকি ছিল,  ভারতীয় চাকর বাকরেরা বয়ে আনত তাই বুড়ো বয়সেও থাকতে কষ্ট  হয়নি। কে বলতে পারে হয়ত পালকিতে চড়েই মিনিমালিজমের তত্ত্ব আওড়াতেন, যেমন দামী এসইউভিতে চড়ে ইউটিউব ভিডিওতে মিনিমালিজমের তত্ত্ব আওড়ানো হয়। তবে যাই হোক  রোইরিখ সাহেব আর তাঁর স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকার কারন অনেক, আধ্যাত্মিকতা, অভিযান, শিল্প, শান্তির প্রচার, সব মিলিয়ে মানুষটা বেশ একটা ছাপ রেখে গেছেন।


ভুন্টুরে পার্বতী আর বিয়াস মিলে গেছে, আমরা পার্বতী নদীর ধার ধরে ধরে কাসৌল এর দিকে যাচ্ছি। পার্বতী নদীটাও একটা কিশোরী মেয়ের মতো বইছে,  আর দূরে বরফ পাহাড়ের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। আহা, আকাশটা বেজায় নীল,আর হাওয়াটাও তেমনই তকতকে। এখানেই থেকে গেলে হয় না? হিমাচলে আরো অনেকবার আসতে হবে। এই উদার করা প্রকৃতি থেকে কতদূরে বাস করি, "লক্ষ্য শূন্য লক্ষ বাসনা"। খুব একটা ধার্মিক না বলেই হয়ত মনিকরণ তেমন মনে দাগ রাখেনি যতটা কসৌল আর তার চারপাশটা রেখেছে। যদিও শিখদের এই অক্লান্ত পরিশ্রম দেখলে শ্রদ্ধা করতেই হয়। কোনো আলাবেজার নেই, বড়লোক গরীবলোক যেমনই হও একই মাটিতে বসে একই খাবার খেতে হবে। আমাদের কিছু কিছু ধর্ম সংঘ আছে যারা ডোনেশনের উপর খাবারের বা প্রসাদের তফাৎ করে। এদের সেসব নেই, এটাই বড় আনন্দ দিয়েছে। ফিরতি পথে কুলুতে একটা বৈষ্ণোদেবীর মন্দির আছে। সে মন্দির তিন তলায়, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মা দেখলাম উঠেও গেল। ভয় পাচ্ছিলাম,মা এর পায়ের হাল খুবই খারাপ, তাও উঠে গেল দিব্যি। ধর্ম বা ভগবান ব্যপারটা যদি কোনোদিন প্রমানিত হয়ে যায় কিছু নেই ফক্কা সেদিন ওই লোকগুলোকে অল্টারনেট কিছু দিতে হবে,  না হলে সে প্রমান না করে দেওয়াই ভালো। 





ওই মন্দিরের উলটো দিকেই নদীর ধারে একটা চা ওয়ালার থেকে চা খেতে খেতে দেখছিলাম, বিকেলের সূর্য আলো ছায়ার খেলার খেলছে পাহাড়ের উপর। কাজকাম শেষ আজকের মতো, শাটডাউন করার আগে একটু আড্ডা দেওয়া আর কি। দুপুরে খেতে দাঁড়িয়েছিলাম একজায়গায়, একটা ছোট্ট চায়ের দোকান, স্থানীয় কিছু বিস্কুট, লজেন্স, ম্যাগি, ডিম নিয়ে যেমন হয় আর কি। ইন্টারেস্টিং হচ্ছে তার কাছে এক থলি আখরোট আছে, আর পিছনে নিজস্বে একটা তিরতিরে ঝর্ণা, উনুনের পাশে বসে আখরোট ভরে ঠোঙায়, আর ঝর্ণা থেকে জল ভরে আনে মাঝে মধ্যে উঠে। সেই সময়টা আমি হয়ত বসে বসে রেভিনিউ ক্যালকুলেট করি কিংবা অটোমেট করি কোনো ক্যালকুলেশন। জীবনটা এমন সোজা সরল হলে হয়ত আমার ভালোলাগত না, একজায়গায় বসে শান্ত হয়ে থাকাটা তো শিখলামই না এ জীবনে কিন্তু তাও এইসব এতাল বেতাল জীবন ছেড়ে প্রকৃতির মধ্যে ডুবে যাওয়ার ইচ্ছেটা যেন আরো বেড়ে যায় গাছপালা, পাহাড়, নদীর কাছে এলে। 
আমাদের চা খাওয়া শেষ, সূর্যও ডুবি ডুবি, মানালী যাওয়ার আগে একটা শাল ফ্যাক্টরিতে ঢুঁ মারা হয়েছিল। শাল কেনার জন্য না, কাজ কেমন করে করে দেখতে। যে পরিমান ডেডিকেশন দেখলাম, যিনি করছিলেন কাজটা সেই ভদ্রলোকের  বাপ্রে বাপ। কবে যে আমার এরকম ডেডিকেশন হবে, তাহলে তারের বাজনা শেখার শখটা তাহলে মিটবে। নদীর জলের, বাতাসের আওয়াজের সুর তুলতে পারবো বেশ।

 





মানালীতে ফের গাড়ি খারাপ হয়ে গেল যোগীন্দরজির। ব্যাটা মনিকরণ থেকে টার্ণটা নেবার সময়েই ঠোকা লাগিয়েছিল, অ্যাক্সেল গেছে ভেঙে। গাড়ির ঝামেলাটা এ বারে চলবে মনে হচ্ছে। পৌরানিক জায়গা গুলো কেমন দিব্যি জায়গাদখল করে দাঁড়িয়ে আছে। হিড়িম্বা মন্দির, ঘটোৎকচ মন্দির, বশিষ্ঠ কুন্ড আর মন্দির, মনু মন্দির। আমাদের দেশের ইতিহাস আর পুরানে বিরোধ আছে একটা,  আমি বলছিনা সব কটা পুরানই হুবহু সত্যি কিন্তু এই যে বশিষ্ঠ বা মনু বা হিড়িম্বা কিংবা ঘটোৎকচ এদের মন্দির আছে তার একটা রূপ আছে হয়ত এরা এক্সিস্ট করত। দেবতা বা দানব হিসেবে না, মানুষ হিসেবেই। আমরা সবাইকেই পুজো করে ঠাকুর বানিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যজিৎ এর কোনো গল্প সিনেমার বিরুদ্ধে একটা কথা বললেই যেরকম রে রে করে তেড়ে আসে তাতে এদেরও মূর্তি বানিয়ে, ধূপ ধুনো মন্ত্র দিয়ে পুজোও শুরু হল বলে,  সুতরাং সে হিসেবে বলছি না কিন্তু এই যে হিমাচলের রাম সীতাকে অবিকল একটা মিষ্টি দুটো হিমাচলি বলে দেখা যাচ্ছে, এই যে একটা গ্রামের দেবতা অন্য গ্রামে নিয়ে গিয়ে একসাথে উৎসব হচ্ছে এসবের পিছনের ইতিহাস নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষনা হয়, আমিই খবর রাখিনা। হিড়িম্বা দেবী হিসেবে পুজো এখানেই হয় স্রেফ। সারা ভারতে রাক্ষসী, এখানে দেবী। আমি শুনেছি দুর্যোধনের পুজোও হয় এদিককারই কোনো গ্রামে।  একদিন নিশ্চিত জানা যাবে কেন ঘটোৎকচের পুজো শিং লাগানো গাছে হয়, বশিষ্ঠমুনির মূর্তি এমন কালো কষ্টিপাথরে কেন। বশিষ্ঠ মূর্তির  চোখ গুলো জ্বলজ্বলে, ছবি তোলা বারন, মন্দিরের কাজ ভারী সুন্দর । মনুর মূর্তিটা তেল সিঁদুরে ক্ষরে গেছে কে ছিল কেমন দেখতে কিছুই বোঝা যায়না। কিন্তু জায়গার বেশ একটা ব্যপার আছে। ঘিঞ্জি সরু রাস্তা বসতি পেরিয়ে প্যাগোডা ধাঁচের মন্দিরটা, একটু উঁচুতে তাই চারদিক চমৎকার দেখা যায়। মন্দিরের বাইরে এক বুড়ো আর একটা বাচ্ছা বসে ছিল আপন মনে, একজন বলিরেখায়, ভাবনায় আর একজন চিপসের প্যাকেট হাতে আনন্দে।মনুর মন্দিরে এই কম্বোটাই স্বাভবিক বটে। মনুসংহিতা যেমনই হোক, মনুর নৌকার গল্পটা চমৎকার।  মনুর আলয় থেকেই নাকি মানালী নাম,  এখানে গল্প কোথায় শেষ আর সত্যি কোথায় শুরু বোঝা দুষ্কর বটে। 

ছেলের মন্দির (ঘটোৎকচ এর মন্দির । এরকম প্রাকৃতিক হওয়াই উচিত ছিল বটে ওরকম বীরের )
মা এর মন্দির (হিড়িম্বা দেবীমন্দির)



ঐ যে কালো মত মূর্তিটা বশিষ্ঠের(চুরি করে তোলা ছবি কিনা তাই এমন)

মনু মন্দির


(ক্রমশ)

আগের পর্ব এইখানে