Monday, April 30, 2018

হঠাৎ বৃষ্টি

দিনের বেলায় সন্ধে নেমে এসেছে, কড়ক্কড়াত করে বাজ। ওই ওই ঝড় উঠলো, ফলওয়ালা বিশে ছুটে দড়ি এনে বাঁধতে গেলো, ওই একটা কাদের জামা উড়ে গেলো। দরজার পাল্লা গুলো দড়াম করে পড়ছে, মায়ের রান্নাঘরে আলো...একটা পায়রা উড়তে গিয়ে ভেবলে গেছে, তারপর এক দৌড়ে আমাদের বাড়ির কার্নিশে। ছেলেটা ছটফট করে ওঠে, এই ঝড়, অন্ধকার বৃষ্টিতে তো ও বাড়িতে থাকতে পারে না। 
" মা তোমার শশা, টমেটো কিছু এনে দিতে হবে? দাও না এনে দিচ্ছি।"
- ভিজতে যাবি বলে না? না আমার কিচ্ছু লাগবে না,তুই চানে যা। অফিস যেতে হবে না? মাছের ডিম ভেজেছি খেয়ে চান করতে যা। 
- আমি এক্ষুনি চলে আসবো তো, এক্ষুনি আসছি দাঁড়াও না।
বোতাম না আটকানো জামা গলিয়ে জুতো পরে সে, ছেলেটার মা দরজায় দাঁড়িয়ে বলতে থাকে এতো বাজ পরছে এ সময় কেউ বাড়ির বাইরে যায়? কথা বললে শোনে না....

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। রাস্তাঘাট ফাঁকা, দোকানগুলোয় শাটার নামিয়ে লোকে বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায়। ফুলওয়ালির ফুল গুলো ঝড়ে জলে রাস্তায় অঞ্জলি হয়ে পড়ে আছে, সব্জিওলার ট্রলিভ্যানে একা একা ভিজছে কুমড়ো, পটল, লালশাক। তুমুল হাওয়ায়, ঠান্ডা বৃষ্টির ঝাপটায় ফাঁকা রাস্তা ধরে ছেলেটা সটান হেঁটে যায়, সকলের অবাক চোখ, ঝোড়ো হাওয়ার দাপট উড়িয়ে। দূর থেকে রেডিওয় যাও পাখির মিউজিকটা বাজছে তখন.....

একটা ফুল গাছের ট্রলি একা একা ভিজছে, গাছ বিক্রেতা মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত দূরে। গন্ধরাজ গাছের পাতায় মুখ নামিয়ে কী যেন বলে ছেলেটা....ফের এগিয়ে যায়। কে যেন ধমকে বলে, 'এই ছেলে বাড়ি যা, বাজ পড়ছে এত, কেউ বাইরে ঘোরে?'
ছেলেটার আপাদমস্তক ভেজা, চশমার কাচ ঝাপ্সা, হঠাৎ একটা গাড়ির হর্ণে চমক ভাঙে, ফিরতি পথ ধরে......অনেকদূর এসে গেছে, অফিস যেতে হবে তো......

বাড়ি ফিরতে এক জোড়া উদ্বিগ্ন মুখ দরজা খুলে দেয়, "যা যা আগে চান করে নে ভালো করে, ফের জ্বর বাধাবি......"
এই জন্যই ছেলেটার পালানো হয় না আর।

Tuesday, April 24, 2018

এই যে হেথায় ...

আচ্ছা এটা টিপিক্যাল ন্যাকা গপ্পো। এবার কথা হলো প্রেম টেম তেমন চলে না। তাও চেষ্টা করলুম। 
*******************************
"কী হয়েছে এখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে?"

হুটার লাগানো গাড়ি থেকে খাকি পোশাকের লোকটা হাঁক দেয়।

কিচ্ছু না স্যার, দেখুন, না হলুদ ফুল দিয়ে প্রপোজ করেছি বলে হ্যাঁ বলছে না। তখন থেকে হাঁটু মুড়ে বসে থেকে থেকে বাত হয়ে গেলো হাঁটুতে। পুরো রাস্তায় তো খালি হলুদ আর বেগুনী ফুলের গাছ বলুন,লাল ফুল পাবো কোত্থেকে?

এ্যাঁ!! ইয়ার্কি মারছো? কই দেখি গাড়ির কাগজ দেখি।
"গাড়ির কাগজ সব ক্লিন আছে স্যার, নো পার্কিং কেস দেবো না আইপিসি টু নাইন্টি ফোর?"

- গাড়ির কাগজ সব ঠিক পাবেন স্যার।মুশকিল তো ফুল নিয়ে। নিয়ে যান আমায় থানাতেই নিয়ে যান, তবে স্যার বলে দিচ্ছি আমিও কেস করবো, ওই মেয়েটাই তো ল পাশ করেছে, রাস্তার পাশে একটা লাল ফুলের গাছ নেই!!

ইয়ার্কি হচ্ছে হ্যাঁ ইয়ার্কি মারছো? দেবো পাবলিক অবসিনিটি কেস? 
- লাল হলুদ বরাবর বদেদের রঙ আমিও জানি স্যার। এ মেয়েকে কে বোঝাবে? বল্লুম ওরে চাট্টি সবুজ পাতা দিচ্ছি আমার মেরুন গাড়ি মানিয়ে যাবে। তা ফস করে বলে দিলো ছাগল জানেন? ওই জন্যই নাকি সবুজ পাতার দিকে ঝোঁক!

- ম্যাডাম এদিকে আসুন তো, আপনার বাড়িতেও খবর দিতে হবে। আর একে তো ছাড়া যাবেই না। পুলিশের সাথে ইয়ার্কি মারার ফল বুঝবে। বেশী রস হয়েছে না, তিনটে ডান্ডা খেলে বুঝে যাবে।

- স্যার মারবেন ফাইন কিন্তু ইয়ে বাড়ির লোক ডাকতে গেলে তো আমায় জেল থেকে বেরিয়ে ওকে নিতে আসতে হবে! মানে উনি আমার বাড়িতেই আগামীকাল থেকে থাকছেন কিনা। 
- মানে? সোজাসুজি কথা বল, থাবড়া মেরে সিধে করে দেবো।

- আহা আজ আমদের বিয়ে কিনা। আসলে বছর দুই আগে এনাকে এখানেই প্রপোজ করেছিলাম কিনা, আর সেবারেও হলুদ দিয়েই, ওই লালের অভাবেই আর কি, না নানা বিজেপি না দুবছর আগে বিজেপি কই। তা ইনি বললেন বিয়েটা হবার আগেও যদি লাল ফুল দিয়ে প্রপোজ করে দিই ক্ষমাঘেন্না করে দেবেন আরকি। কত কষ্ট করে আজ বাড়ি ভর্তি লোকের মাঝে বেরিয়েছি স্যার...তা কপাল দেখুন লাল ফুলের বদলে লাল বাতি চলে এলো।

-- বিয়ে!! স্ট্রেঞ্জ!!! বিয়ের দিন আপনারা এসব করছেন!! মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাননা?

- মিথ্যে কেন হবে এই দেখুন, স্যান্ডো গেঞ্জি এতো নতুন হয়? আর এই গলায় চেন আমি পরবো হ্যাঁ? আর ওই ওকে দেখুন না এ রকম চেড়ী মার্কা সাজ বিয়ের জন্য ছাড়া কেউ সাজে? বিশ্বাস না হলে রিসেপশনে ইনভাইট করছি আপনাকে আর ম্যাডাম যদি বরযাত্রী বাড়াতে রাজি হন রাতেই চলুন না। মেনু ফাটাফাটি স্যার, নো বিরিয়ানি চাঁপ, পাতুরি, মালাইকারি, ইলিশ যাতা ব্যাপার। হোক নাকি?

- যান যান। অন ডিউটি আছি। আর এসব করবেননা। বিয়ে করতে যান।

-যাচ্ছি স্যার পাঁচটা মিনিট। ওই মেয়ে এবার হ্যাঁ বলবি কি??

- না বলে উপায় কি, গাধা কোথাকার। একটা লাল ফুল দিতে পারিস না এসেছিস বিয়ে করতে। সারাজীবন তুইই মশারি টাঙাবি এর শাস্তিতে।

Saturday, April 21, 2018

উড়োচিঠি (চার কিংবা পাঁচ)

কেমন আছো? অনেকদিন গ্যাপ দিলাম না? আমি জানি তুমি আমার চিঠির অপেক্ষায় থাকো, আমার চিঠি ডাকবাক্সে পড়ুক না পড়ুক ঠিক পাও তুমি। মন ভালো নেই বুঝলে, সে অবশ্য আমার পুরোনো রোগ। চারপাশের লোকজন থেকে পালানোর সময় হয়ে গেছে মনে হয়। জানোই তো আমার কিছু সয় না, বেশী মায়া বেশী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ফোর্সড সন্ন্যাসী আর কি। যাকগে এবারের চিঠি ইজ নো মোর ঘ্যানঘেনে। বৈশাখের তীব্র রোদে পুড়িয়ে দিক সমস্ত পুরোনো মনখারাপ।

জানো সেদিন একটা গলি দিয়ে হাঁটছিলাম। যেমন হাঁটি এ গলি সে গলি হঠাৎ দেখি একটা বাড়ি, আম গাছ কাঁঠাল গাছ আর এক চিলতে বাগান সহ, কেমন করে কে জানে এই গিজগিজে ভীড়ের শহরে টিকে আছে। আর আশ্চর্য কি জানো ওই বাড়ির ছাদে দেখি মাদুর পেতে দু চারজন রয়েছে! অবাক না? এখনো বুঝি লোকে গরমকালের সন্ধ্যেবেলা ছাদে গিয়ে তারা দেখে?

বাড়িটার পাশ দিয়ে আসতে আসতেই ডাল পিঁয়াজভাজার গন্ধ পাচ্ছিলাম। গন্ধ বড় অদ্ভুত জিনিস। অমনি আমি সেই ছোটবেলার গরমের রাত্তির, সন্ধ্যেগুলোয় পৌঁছে যাচ্ছিলাম। হ্যারিকেনের আলো, বিকেলবেলায় গা ধুয়ে এসে মা এর গান গাইতে বসা, কিংবা দিদিভাইদের বাড়িতে অ্যানুয়ালের পরের ছুটিতে গল্পের বই পড়া, তাসের রঙ মেলানো। নাহ ট্রাম্প করতে শেখার বয়স তখন হয়নি আর বড় হয়েও শেখা হয়নি সে জিনিস।

গরমকালের দুপুর গুলো কেমন নিঝুম হয় জানো তো? আমি দুপুরবেলাতেও দোতলার ঘরে যেতে পারতাম না, ভয় পেতাম, ভীতু ছিলাম তখনো এখনকার মতোই কিনা।

গরমকালের ছুটি তো আর হয়না, বড় হয়ে গেছি পেল্লায়, এপ্রিল মে এর গরমে স্লিপার ট্রেনে চড়ে লম্বা জার্নি না করতে পারার মতো বুড়োও বটে। কী দ্রুত বদলে যায় না দৃশ্যপট আর সঙ্গে আমরা? তোমার আমার সব গল্প কথা কেমন অলীক মনে হয়। আচ্ছা টাইম মেশিন কিংবা ওয়ার্মহোলে করে ওই জোনে চললে কি এখনো দেখা যাবে আমাদের? 
কী এলোমেলো বকছি তাই না? তা কোন চিঠিটাই বা গুছিয়ে লিখে উঠতে পারলাম, বলতে পারলামই বা কই গুছিয়ে কিছু কোনো কিছু তোমায়। পরের জন্মে খুব সাহসী হবো বুঝলে, আর শীর্ষেন্দুর গল্পের দুবলা লোক না সন্তুর মতো পারদর্শী কেউ হবো। সোজাসুজি তাকিয়ে দাবী জানাবো, উত্তরের....

ভালো থেকো।

Monday, April 16, 2018

নতুন বছর পুরোনো গল্প...

ভালোবাসা কথাটা ক্রমে অলীক হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু আমি তো ভালোবাসাতেই বিশ্বাস রাখি বেশী। চারদিকের এই খারাপ ঘটনা, এই ভয়াবহতা সত্যেও আমি এখনো মানুষে বিশ্বাস করি এখনো বিশ্বাস শব্দে বিশ্বাস রাখি। হতে পারে আমি বোকা, আকাট কিংবা উটপাখি কিন্তু খারাপ জিনিস বেশী বইতে নেই, তাতে খারাপের ওজন বেড়ে যায়। নতুন বছরে আমি সেই পুরোনো ভালোবাসার গল্পই বলবো ফের।

কোলকাতা শহরেই ভালোবাসা এদিক সেদিক এতো থাকে, পায়ে হেঁটে না ঘুরলে ধরা যায় না ঠিক। মেডিকেলের সামনে একটা কুকুরকে জড়িয়ে ধরে একটা ভিখারি মেয়ে খুব করে বকে দিচ্ছে দেখি, কেন ও আগের দিন খেতে আসেনি, তাই জন্যই তো অন্য কুকুরে এসে খেয়ে গেলো। আর কুকুরটা খুব আরাম করে সে আদুরে বকুনি খাচ্ছে ^_^ । না মশাই কুকুর আমি ভালোবাসিনা, বরং খারাপই বাসি, ব্যাটারা আমায় দেখলেই ধাওয়া করে কিনা, কিন্তু দূর থেকে দেখতে মন্দ লাগে না বটে, আর এ তো দুই সঙ্গীর আদর আহ্লাদ, তা কি খারাপ লাগতে পারে?

চাঁদনির মেট্রো পেরিয়েই ফুটপাতে একটা মশারি টাঙিয়ে একটা ছোট্ট পুচকে শুয়ে আছে দেখি, আর তাকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে তার দুই বীর বাহাদুর দাদা, খালি গায়ে, নেংটি পরে। দু দাদার ছোটটার নাক দিয়ে সর্দি বেরোচ্ছে এদিকে, প্যান্টুলও কিঞ্চিৎ ঢিলে, দুই খানা মাত্র হাত, কোনটাকে সামলায়, দাদার কাছ থেকে গাড়িটাও কব্জা করতে হবে, কী করে যে কি হয়! কিন্তু দু মক্কেলের চোখের জোর কম নাকি, এক সমুদ্দুর ভালোবাসা নিয়ে ভাইকে পাহারা দিচ্ছে, একটা মাছির সাহস থাকে বসে দেখুক দিকি! 
এই ফুটপাতে থাকা, বাচ্ছা কাচ্ছা সংসারও আমার ভয়ানক অপছন্দ মশাই তাই বলে তো আর এদের ভালোবাসাটা উপেক্ষা করা যায়না নাকি?

আমি এসেছিলাম চাঁদনিতে একটা কাজে। আমার ভালোবাসা, চিনি ছড়ানো মালাইতে। মালাই খেয়ে হাঁটতেই হয়, না হলে পেটের মধ্যে মালাই এর প্রমোটারি রাজ শুরু হয়ে যেতে পারে। তা হাঁটছি হাঁটছি, দেখি আমার সামনে দুই মক্কেল চলেছে। দুই তরুণ তরুণী। বয়স মশাই ইয়ে কিঞ্চিৎ বেশীই, মানে ঠিক কাঠফাঠা রোদে ঘুরে প্রেম করার বয়সী না আর কি। ম্যালা প্যাচাল পেড়ে লাভ নাই মশাই ওই কাঠফাটা রোদে হেঁটে যাওয়া প্রেম আমি পঁচিশ-আঠাশের পর দেখিনি বেশী। যাই হোক, সরু ফুটপাথ, পিছন পিছন চলেছি, যথারীতি নির্লজ্জ ছেলেটা দেখি টুক করে মেয়েটা চুমু খেয়ে নিলো সেই ভীড় রাস্তাতেই, আর মেয়েটা কি যেন বলল মাথা নিচু করে, না দেখতে পেলেও আমি জানি পেল্লায় লজ্জা পেয়েছে সে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি, হঠাৎ ছেলেটা হা হা করে আশপাশের সবাইকে সচকিত করে হেসে উঠলো, কানে এলো বলছে, সত্যি বল, এই বয়সে বাড়িতে লুকিয়ে, অফিস কেটে দুজন প্রেম করছি কোনো মানে হয়! পরকীয়া করলেও না হয় বোঝা যেত!
আজকের রোদটা চড়া উঠেছিলো খুব, গরমও ফাটিয়ে পড়েছিলো, দেখ না দেখ ওদের কথায় একটু কমে গেলো না গরমটা?

চাঁদনিতে আমার কাজ হয়নি আজ, আবার যেতে হবে, ভালোই হবে, মালাই খাওয়া যাবে আর, চারদিকের অবিশ্বাস আর ঘেন্নার মধ্যে আমার বুড়ো শহরে একটু হাওয়া বাতাস পাওয়া যাবে না হয়। ^_^

নতুন বছরে ভালোবাসায় কাটুক সবার। ভালো হোক।

Wednesday, April 11, 2018

কোলকাতায়...

রোজকার রাস্তা ধরে মাঝে মাঝে আমি যখন অন্যভাবে আসি যাই, হাঁ করে গিলতে গিলতে আসি চারদিক। আমার বন্ধুরা বলে এ শহরে আর হবার কিছুই নেই, বাকি শহরগুলোয় অন্তত কাজ আছে, এখানে সে টুকুও নেই। মিথ্যে না হয়তো, কাজ থাকলে কি আর ওই যে চারদিক খাঁ খাঁ করা মাঠে একটা মাত্র গাছের তলায় আরাম করে লোক দুটো শুয়ে থাকতে পারে এই বেলা দশটায়! কিন্তু আমি আসলে এ শহরের উপযুক্তইই, ওরকমই আধ খ্যাঁচরা, অসফল, হেরো ছেলে। শীর্ষেন্দুর গল্পের চরিত্রের মতো। তাই জন্যই হয়তো কোলকাতা আমার খারাপ লাগে না, বিগড়ে যাওয়া ওয়ার্ক কালচার, ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশ, ঘেমো আবহাওয়া সব যেন আমায় কিছুই করতে পারেনা।

আমি দেখি কেমন একলা গাছে একটা সারস বসে আরাম করছে, মন্দিরতলার চাতালে গামছা বিছিয়ে শুয়ে আছে চারপাঁচজন, ফাঁকা রাস্তায় বর বউ মিলে খেলনাপাতির মতো দোকান সাজিয়েছে আর একটা বুড়ো মানুষ একমনে কাগজ পড়ছে সামনে বসে। সামনের মোড় পেরোলে গরম পিচ গলিয়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে কাজ করছে একজন। গোলাপী, লাল ফুল গুলো ঝরে গেছে, বসন্ত শেষ, গরমের পাল্লা শুরু হয়ে গেছে।

অফিসে ঢোকার পর সামনের রাস্তা দিয়েই সবাই যায়, পিছনের দিকে একটা রাস্তা আছেছে, একটু ঘুরে, কিন্তু ছায়া ছায়া। বোকাগুলো দু পা ঘুরে গেলে গাছেদের মধ্যে দিয়ে যাওয়া যায় জানেই না, বোকার মতো রোদ থেকে বাঁচতে হনহন করে চলে যায়। এই দিকে গাছ গুলো দিব্যি হাসিখুশি, একটা মালি খালি জল দেয় মাঝে মাঝে, আর রোগা রোগা গাছ গুলো মাথা দুলিয়ে হাসে।

এই গরমের আঁচে পুড়তে থাকা শহরেও এতো ভালোলাগা ছড়িয়ে থাকে আনাচে কানাচে...যেমন ওই সেদিন মেট্রোয় হাসি হাসি মুখে অনুযোগ করা ছেলেটা, "বড্ড খাটাস জানিস", কিংবা একরত্তি ছেলেটাকে সামলাতে হিমশিম দেখে মেয়েটাকে সামনের অচেনা ছেলেটা জায়গা ছেড়ে দেয়।

গরমকালের উষ্ণতা আর এই শহর দুইই আমার মতো ডিফেক্টিভ শাড়ি সেলে পাওয়ার মতো মহারাজদের জন্য...সফল যারা হতে চায় না তাদের জন্য। ^_^

Sunday, April 8, 2018

মাঠাংবুরুর গল্প

মাঠাংবুরু ইজ ব্যাক এগেইন ^_^
(ইয়ে পুরোটা না একটুই)
**********************
"শোনো হে মাটি থেকে আকাশ যেমনই দেখাক, ও ভারী শুকনো আর স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা"।
- শুকনো আবার স্যাঁতসেঁতে একসাথে!! দ্যাখ ব্যাটা পিঁপড়ে কাজ করে করে আলা হয়ে যাচ্ছি আর তুই আবোলতাবোল বকা শুরু করেছিস? এখন যা দেখি,কাজ কাম করতে দে, ঘুমোতে দে।
- ওরে ব্যাটা মানুষ, আমার গল্প বাজারে ছেড়ে খুব তো পিঠ চাপড়ানি খেয়েছিস হ্যাঁ, অম্নি ভাও বেড়ে গেলো না?
উপরের কথা গুলো আমার সাথে মহারাজের। আমি রে বাবা আমি, মাঠাংবুরু। মানুষ হলেও মহারাজ আমার বন্ধু মানুষ হয়ে পড়েছে, তাই আসি আমি এখানে প্রায়ই, আড্ডা মারতে। ওর থেকেই শুনলাম আমার গল্প শুনতে চেয়েছে কেউ কেউ। 
আমি তো বাউণ্ডুলে পিঁপড়ে, আমি এদিক সেদিক করেই বেড়াই, আমায় পিঁপড়ে সমাজে আর নেবে না হয়ত, কারণ আমি নিয়ম ভাঙা কাজ করি। কি করবো আমার খালি খাবার খোঁজার কাজ ভাল্লাগেনা আর। ফুলের পাপড়িতে বসে দোল খেতে খেতে সেদিন যখন একটা বড় গোল্লা বৃষ্টি এসে পড়লো আর আমি হড়কে পড়লাম আমার মনে হলো কোত্থেকে আসে ওই জল, দেখে আসা যায় না?
যেমন ভাবা তেমন কাজ। মাঠাংবুরু বেরিয়ে পড়লো। আমার তো তাড়া নেই কিছু, পৌঁছবার না ফেরার না, তাই ঘুটুংটিং ঘুটুংটুং করে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম প্রথমে বাতাসার দোকানে। বাতাসা আজকাল ভালো স্বাদ হচ্ছে না হে, একটু চেটে দেখি কোন বজ্জাত পিঁপড়ে আগেই চেটে গেছে! যাকগে যাক, একটু রাবড়ি খেয়েই রওনা দেবো। মন মেজাজ ভালো নেই বিশেষ, পাশের বাড়ির আমার হতে পারতো পিঁপড়েনী ওপাড়ার লম্বুকোটং কে নিয়ে নৌকা চড়ে ঘুরতে গেছে।

রাবড়ি খেতে হয় খুব সাবধানে, আমাদের পিঁপড়েদের জীবন খুবই বিপদসংকুল। এই ধরোনা কেন রাবড়ি এমন ভালো জিনিস কিন্তু আনমনে একটু বেশী ভালোবেসে ডুব দিতে গেলেই চিত্তির। আমাদের দলপতি কুরুণ্ডিয়া খুবই কর্মপটু, আমাদের শুরু থেকেই শিখিয়ে দিয়েছে তাই আমাদের দলের কেউই বেশী লোভ করতে গিয়ে ডুবে যায়নি কখনো তা রাবড়ি হোক কি গুড়, পাশের দলে গেছিলো শুনেছি। আমি অবশ্য তখন খুব ছোট।

রাবড়িতে মুখ ডুবিয়ে চুকচুক করে খেয়ে ফের রওনা দিলাম। কি করে বৃষ্টির খবর আনা যায় কে বলে দেবে আমায়? ওই জলের গোলা কে বৃষ্টি বলে মানুষেরা আমি শুনেছি। আমার গল্প তোমাদের ভাষাতেই বলবো, তোমাদেরকে বলছি যখন। মাটির উপর দিয়ে চলেছি, কত রোদের পথ পার হলাম খেয়াল রাখিনি, আসলে বৃষ্টির খবর আনতে যাচ্ছিলাম বটে কিন্তু রাস্তায় যে গাছ পাহাড় নদী দেখছি তাদের সাথে গল্প করছি আর ভুলে যাচ্ছি সব। 
মানুষদের কত কী লাগে বাপ্স রে! মস্ত একখানা গুবড়ে পোকা টাইপ কিসে একটা যেন করে এক ঝাঁক মানুষ কোথায় যাচ্ছে যেন, রাস্তায় এ ওকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে সব, মাঝে মাঝে ওই বড় পোকার মতোর জিনিস গুলো ধাক্কা দিচ্ছে হুশ হুশ করে কি যেন বলছে। আমরা পিঁপড়েরা বাপু অমন হুড়োতাড়া করিনা। কাউকে ধাক্কা দেবোই বা কেন, সবাইই তো চিনির দানা নেবে।

হাঁটতে হাঁটতে একটা লাল চোখো গিরগিটির সাথে দেখা হলো। লাল চোখ দেখে ভয় পাবার কিছু নেই, ও খুবই লাজুক, অচেনা কাউকে দেখলেই রঙ বদলে বদলে মিশে যায় যাতে ওকে আর কেউ না দেখে, কেউ না জানে। অনেক্ষণ চলেছি তো খুব তেষ্টা পেয়েছিলো, খিদেও, তাই একটা ফুলের মধ্যে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙতে দেখি একটা নদীর ধারে শুয়ে আছে, একটা নীল মাছ এসে এসে আমার ফুলটার গায়ে নাক দিয়ে ঢুঁসো মেরে যাচ্ছে। আসলে হয়েছিলো কি আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর নীল পাখি এসে ওই ফুলে মধু খেতে গেছে তারপর, ফুলটা পড়েছে জলে, ভাসতে ভাসতে এসে হাজির হয়েছি এখানে।

নীল মাছ খুবই ভালো ছেলে, আমার মতোই। আমি ভালো এ কথাটা মহারাজ না লিখলে পরের বার কোনো গল্পই আর বলব না বলে দিলাম। যাই হোক নীল মাছকে বললাম কি করে বৃষ্টি হয়? কোত্থেকে আসে? ও ভালো বলতে পারলো না, তবে আমায় পাহাড়-নদীর গল্প শোনালো।

তো সেবার সারা পাহাড়পুরে শোরগোল পড়ে গেলো। ঘটনা হলো যে যেমন তার মতোন কাউকে ভালোবাসাই দস্তুর। তাইই হয়ে এসেছে এতদিন। তা সেবার একটা নদী প্রেমে পড়ে গেলো একটা পাহাড়ের। পাহাড় স্থির, অচঞ্চল তাই সে ইউজুয়ালি ভালোবাসে গাছেদের কিংবা পাখিদের, যারা হয় ওর বুকেই রয়ে যায় অথবা ঘর বাঁধে। তা আমাদের গল্পে তো এ হলো গিয়ে গোলমেলে পাহাড়। সে মেঘ মাখে গায়ে, বৃষ্টিতে ভেজে, গাছের ছায়ায় শান্ত হয়, পাখিদের গান শোনে আর ভালোবাসে নদীকে। মানে যাকে বলে, একেবারে অ্যাঙ্গেলের হদ্দমুদ্দ, ত্রিকোণ টিকোন তো বাচ্ছা।ভালোবাসায় মানুষের একার অধিকার না!

তো সুর্য একটু গম্ভীর লোক, নিজের কাজের বাইরে অত হিসেব রাখে না, সময় করে আলো জ্বালায়, সময় করে কাজ শেষে পালায়। কোথায় পালায় আমি জানিনা মশাই, কেউই জানেনা। অন্য কোনো ব্রহ্মান্ডে আলো জ্বালাতে যায় কিনা, নাকি সূর্যের বেশ ত্যাগ করে জ্যোৎস্না মাখে সেসব আমার জানা নেই। মেঘ, বৃষ্টি, হাওয়া, মাটি, গাছ কেউই জানেনা। পাহাড়টা ছিলো একবগগা টাইপ, কিরম যেন একটা রুক্ষ ভাব, মাঝে সাঝে হেসে উঠে গল্প করতো বটে হাওয়া কিংবা গাছেদের সাথে কিন্তু হুট করেই ফের চুপ। তখন ছানা পাখিটা অব্দি কিচিরমিচির করতে ভয় পেতো, মা পাখির বুকের মধ্যে ঢুকে যেত চুপটি করে। বাবা পাখি মা পাখি আর ছানা চারটে পাখি, ওরা থাকতো সটান খাড়া গাছটা আছে না? ওরই একটা ছোট্ট কোটরে, কতবার বরফে ঝড়ে ওদের ঘর ভেঙেছে, তবু অদ্ভুত মায়ায় ওরা ছেড়ে যায়নি। আর ছিলো একটা হাসিখুশী ফ্যাকাশে গোলাপী রঙের ফুলের গাছ। হেসে হেসে গল্প করতো সবার সাথে, কিন্তু খুব বেশী পাত্তা পেতো না। আর ছিলো ঝাঁকালো মাথার একটা ফলের গাছ, কী ফল কে জানে পাখিরা খুব খেতো আর তাই খুব পপুলার ছিলো। হেব্বি আড্ডাবাজ, মাথা টাথা ঝাঁকিয়ে পাখিদের গল্প বলতো, পাহাড়ের সাথে ফুক্কুড়ি করতো, মোদ্দা কথা জমিয়ে রাখতো সারা পাড়া।

তো এমনই এক দিনে সেবার মুষলধারে বৃষ্টি আর ঝড়, পাহাড় পাড়া লন্ডভন্ড, পাখিদের অতদিনের ঘর দোর ভেঙে গেলো, ছোট যে নদীটা বইতো তিরতির করে সে এতো জল টল সামলাতে না পেরে ভাসিয়ে দিলো আশেপাশের সব নুড়ি পাথর, যে লাল নীল মাছগুলো খেলে বেড়াতো তাদেরও কোথায় ভাসিয়ে দিলো। অমন ঝাঁকড়ামাকড়া গাছটা দুড়ুম করে পড়ে গেলো, পাহাড়টাও হয়ে গেলো ক্ষতবিক্ষত। সে এক হন্ডুরাস ব্যাপার যকে বলে। তারপর একদিন প্রলয় ট্রলয় থামলে দেখা গেলো পাহাড় পাড়া ঘেঁটে ঘ। পাহাড়ের চুড়োয় এক খাবলা মেঘ আটকে আছে, গাছের ডালে পাখির পালক লেগে, ঝাঁকড়া গাছ টাকলা হয়ে গেছে, নদীটা আর স্বচ্ছতোয়া নেই, গাছের পাতায়, পাথরে বালিয়ে ঘোলাটে, সূর্য্যটা চমৎকার উঠেছে বটে কিন্তু হাওয়াটা দিচ্ছে ভারী মন কেমন করে করে। গোলাপী, হলুদ ফুল গুলো ঝরে পড়ে আছে ইতস্তত। ঝরনা টরনা গুলো ঝোরা হয়ে বইছে আর পাহাড়টা হয়ে গেছে ন্যাড়া, খোবলা খোবলা।

তা মশাই দুক্ষু টুক্ষু নিয়ে পড়ে থাকা মানুষের স্বভাব, এদের না। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে? কোই পরোয়া নেহি, তাই ফের ওই লণ্ডভণ্ড পাড়াতেই ফের পাখিদের জমায়েত শুরু হয়, শেকড়ে শেকড়ে চুমু টুমু খেয়ে গাছ গুলো হয়ে ওঠে ফুরফুরে, হাওয়ার সাথে ফুক্কুড়ি করে, মেঘটা ফের ডানা মেলে, পাহাড়টা আবার গান গায়, নদীটা আবার শান্ত হয়ে বইতে থাকে। এরকমই কোনো এক রাতে বা সকালেই গন্ডগোলটা হয়ে যায়। হয়েছিলো কি একটা মাছ আটকে গেছিলো কি করে যেন পাহাড়ের খাঁজে, তা বেজায় ছটফট করছিলো এক আঁজলা জলে। তা মাছেদের তো পলক থাকে না তাই কাঁদতেও পাচ্ছে না, তাছাড়া কান্নাকাটি করতে গেলে একটু আধার লাগে। আধার বুঝলে না? আরে জলে কাঁদলে তফাৎ হবে কি করে? কান্না আলাদা করবে কি করে? ওদিকে হয়েছে কি মাছগিন্নী তো সকাল থেকে অস্থির হচ্ছে, কত্তা বাজার করে আনবে চাট্টি প্ল্যাঙ্কটন ছানাপোনা মিলে ভোজ হবে, তারপর সবাই মিলে যাবে আউটিং এ। তা কোথায় কি। কত্তা আর আসেন না। মাচগ কত্তা সংসারী মাছ, দুম করে পালিয়ে সমুদ্দুরে চলে গেছে এমনও হতে পারে না, তাহলে? বিপদ আপদ বলতে তো এখানে কিছু নেই, বড় মাছ নেই, হাঙর নেই গেলো কই তবে? গিন্নী মাছ খুব করে পাখনা টাখনা নেড়ে নদীকে জানালো। নদী এদের যকে বলে ল্যান্ডলেডি, এদের খেয়াল রাখতেই হয় না হলে নদীতে আর কেউ থাকবে না। গেলো সে স্রোতের উলটো দিকে খোঁজ নিয়ে নিয়ে পাহাড়ের সেই ফোকরে। গিয়ে দেখে মাছ কত্তার যায় যায় অবস্থা। নদী তো রেগে পারলে সুনামী হয়ে যায়। খুব করে পাহাড়এর কান টান মুলে দেবে ভেবে খামচি মেরে এক খাবলা পাথর ধরেছে। তো খুব খানিক ঝগড়াঝাঁটি আমার মাছ তোর কি, আমার খোপরে এসেছে আমি কী করবো করে উস্তুম খুস্তুম লড়ল দুজন। তারপর? তারপর মাছ পেলো ছাড়া আর নদী গেলো আটকে। পাহাড়ের বুকেই আটকে তো গেলো, দুজনের ডেটিং চলল খুব, এ কাঁদলে ও থামায় ও বকলে এ চা করে আনে, যেমন হয় আর কি।

এদিকে নদীরতো আটকে থাকলে চলে না, নদীর ধারের গাছ গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে, মাছ গুলো রোগা হয়ে যাচ্চে, নুড়ি পাথরের ধার নাই আর। আর সত্যি বলতে নদীটারও বোরিং লাগা শুরু হয়েছে, তার তো এক জায়গায় থাকতে ভালো লাগার কথাও না, ওদিকে পাহাড়ও এতো গতিময় জিনিস ধরে রাখতে পারছে না। সুতরাং তারা বিচ্ছেদ খুঁজে নিলো, এখনকার ছেলেমেয়েদের মতোই মিউচুয়াল ব্রেকাপ, দেখো পোষাচ্ছে না আমাদের ঠিক, চলবে না বুঝলে? বলে নদী গেলো ফিরে আপন পথে, পাহাড়ও শ্বাস ফেলে বাঁচলো।

কিন্তু দুনিয়াদারি কি আর এতো সোজা রে ভাই। এই যে আমি মাঠাংবুরু, চিনির দানা খুঁজে বেরানো কাজ যার, বেরিয়েছিলাম বৃষ্টির খোঁজ নিতে, এখন নীল মাছেদের থেকে শুনছি পাহাড় নদীর কথা! তো যাই হোক, হলো কি কিছুদিন তো দুজনেই খুব ফূর্তি হলো, নিজের নিজের জীবনে ফিরে। পাহাড় করলো ফের মেঘ, বৃষ্টি, গাছ, পাখিদের সাথে ফ্লার্টিং আর নদীও গাছ, হাওয়া, পাখিদের সাথে। কিন্তু অনেক অনেক দিন চলার পর পাহাড় দেখে পাঁজর খানা কেমন যেন খালি খালি ঠেকে, কী যেন নাই কী যেন নাই। নদীও যেন চলতে গিয়ে ক্লান্ত বোধ করে, সামনেই সমুদ্দুর যেন তার বিশাল বুক নিয়ে ডাকছে আশ্রয় দিতে। নদী আর পারে না, সমুদ্রেই মিশে যায়। তাও অনেক অনেক গভীরে যেখানে সমুদ্রে মধ্যেও এক টুকরো নদী থাকে, সেই খানে নদী অপেক্ষা করে থাকে, একটা পাথুরে রুক্ষ পাহাড়ের।

হাওয়া ছিল এদের দুজনেরই বুজুম ফ্রেন্ড যারে বলে। তা ও খুবই মুচকি মুচকি হেসে আগাগোড়া দেখে গেছে, এবার যখন বুঝলো সময় হয়েছে, পাহাড়কে নিয়ে চলল। একটু একটু করে। পুরো পাহাড় কি আর এক সাথে নিয়ে যাওয়া যায় নাকি, হাওয়া তো আর হনুমান না রে বাবা। তাছাড়া, একই ফর্মে থাকলে তো আবার গন্ডগোল হবে, তোমাকে কিছু পেতে গেলে তার জন্য প্রস্তুত তো হতেই হবে নাকি? এই যে আমি বাউণ্ডুলে মাঠাংবুরু হয়েছি তার জন্য যে আমায় পিঁপড়ে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে(মনে হয়), কেউ ভালো চোখে দেখে না আমায় পিঁপড়েদের মধ্যে, এও তো প্রস্তুতিই নাকি? ঘরের টান না কাটলে কি বাইরে বেরোনো যায়?

তাই হাওয়া আস্তে আস্তে ক্ষওয়াতে লাগলো পাহাড়কে, কষ্ট হলো দুজনেরই, কিন্তু আর যে কোনো উপায় নেই! একটু একটু করে হাওয়া সেই ধুলো পাহাড় নিয়ে গিয়ে জমা করলো সমুদ্রের বুকে, অনেক গভীরে।

তারপর একদিন এলো যখন পাহাড় ফের জেগে উঠলো, আগের মতো তার কিছুই নেই প্রায়। একটু খানি মাথা বের করে সে আকাশ দেখে, হাওয়ায় শ্বাস নেয়, পাখিদের গল্প শোনে। আর তার গলা অব্দি জড়িয়ে থাকে সেই নদীটার জল। তোমরা বলবে অত বড় সমুদ্রে সেই নদীটার জল আলাদা হলো কী করে? তা তোমরা মানুষ কিনা এসব বুঝবে না, সব নদী আলাদা হয় হে, মিশে গিয়েও আলাদাই থাকে বুঝলে। যাকগে, আর সেই পাহাড় নদীতে ছোট ছোট লাল নীল মাছ ঘুরে ঘুরে খেলে, লাল হলুদ নীল প্রবাল তাদের বুকে আরাম করে।

নীল মাছের গল্প শেষ হলো, আমি বললাম আমায় ওই পাহাড়ে নিয়ে যাবে? পাতার ভেলায় আমি ঠিক পৌঁছে যাবো, ওরা যদি আমায় মেঘের কাছে পৌঁছে দেয়? 
নীল মাছ রাজী হলো। কিন্তু তারপরের গল্পটা পরে বলব আবার, মহারাজ আমার শুঁড় ধরে টেনেছে মশাই, আমি রেগে গেছি হুহ।

Sunday, April 1, 2018

রবিবার

পান বিড়ির দোকানের বিহারিটার গুমটির নীচের ফোকরে মেয়েটা আর বউটা থাকে, আর উপরে ও। মেয়েটা আগে দোকানের সামনের ড্রেনে হিসি করতো, তারপর একদিন দেখা গেলো টলমল করে নাকে সর্দি আর চোখে জ্যাবড়া কাজল পরে বাবার দোকানে উঠে এসেছে আর এটা সেটায়য় হাত দিচ্ছে। ক্রমে সন্ধ্যেবেলায় বই দেখা গেলো গুমটির নীচের তলায়, বউএর ঘোমটা একটু দূরে হটলো, দোকানের রেডিওটা একই ভাবে পুরোনো নতুন গান শোনায়....

রবিবারের সকাল আর নেই বেলা হয়ে গেছে, মাছওলার হাঁড়িতে এক দুটো মাছ মরে পড়ে আছে, নীল ডুমো মাছি উড়ছে লালচে হয়ে যাওয়া চিংড়ি গুলোয়।মাংসের দোকানে লম্বা লাইন, আনন্দ পালক ছাড়াচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে চায়ে চুমুক। বাজারের পাশ দিয়ে চলে গেলে একটা গলি পড়ে, কিসের যেন একটা কারখানা আছে, ঘট ঘটাং করে আওয়াজ হয় সারাদিন, পাশেই একটা সদ্য রঙ করা বাড়ি থেকে নাটকের আওয়াজ ভেসে আসছে। একটা মেয়ে অনুযোগ করছে কী যেন আর ছেলেটা গম্ভীর হয়ে কী সব বলছে, এখনো রবিবারের সকালে নাটক হয় আর বাড়িতে এমন গমগম করে সে নাটক চলে?
দুটো বিড়াল ছানা বাড়িটার গেটের গ্রিলে খেলে বেড়াচ্ছে, আমি দিন কতক আগেও দেখেছি এসে এ বাড়িতে আওয়াজ ছিলো না, প্রাণ ছিলো না তেমন, বিড়াল ছানা দুটো ঠিক টের পেয়েছে বাড়িটা জেগে উঠেছে ঘুম ভেঙে।

একেকদিন হয় বড় তীব্র বড় অস্থির। সব কিছু ভেঙে চুরে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পিছুটানহীন হয়ে। ছেলেটার ফতুয়ার বোতাম খোলা, পদক্ষেপ এলোমেলো, যেন রাস্তায় কী আছে তার জানার দরকার নেই, কোথায় যাচ্ছে বাজারে না এটিএমে খোঁজ রাখার ফুরসত নেই।
-ফুলগাছ আছেএএএ.....
ভ্যানে করে গাছ নিয়ে বুড়ো লোকটা হাঁক দিয়ে যায়। সম্মোহিতের মতো ছেলেটা এগিয়ে যায়, গাছের পাতায় আলতো হাত দেয়।

তারপর দেখা যায়, উদভ্রান্ত ভাব সরে গিয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন চোখে শ্যাওলা পরা একটা বেলফুলের টব বুকের মধ্যে নিয়ে ছেলেটা বাড়ি ফিরছে। বাজার থেকে তার কী কী নেওয়ার ছিলো ভুলে গেছে সে, তার বাড়ির লোকে জানে সে ভেটকি মাছ আনতে গিয়ে ফুল গাছ এনে ফেলে সে এমন। বাড়িতে ঢুকে বারান্দায় আগের বেল ফুলের গাছটায় নতুনটাকে ছুঁইয়ে দিয়ে বলে এই দেখ তুই একা না আরেক জন আছে, কদিন খেয়াল রাখতে পারবো জানিনা...তুই তোর মতো করে ফুল ফোটাস.....