Monday, May 17, 2021

নয় পাহাড়ের উপত্যকায়(তিন)

 ধরা যাক সাতটা একই মানসিকতার ছেলে মেয়ে,দিন রাত ভার্চুয়ালি আড্ডা মেরে, এক বছর বন্দী থেকে কাটিয়েছে, ভয় কাটিয়ে তারপর বেরিয়েই পড়েছে। বলতে পারেন মূর্খামি, কিন্তু সিচুয়েশন তখন এরকম বিগড়ে যায়নি, আমাদের নেতা মন্ত্রীরা আগামী পাঁচ বছর "কাজ" করবে বলে এভাবে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়নি তখনো। নিয়ম কানুন পালন করে ঘুরে বেড়ালে অত ভয় ছিলো না তখনো অব্দি, যখন আমরা প্ল্যান করছিলাম সেই ফেব্রুয়ারিতে৷ আজ্ঞে হ্যাঁ, ডেটাটা একবার দেখে নেবেন গালমন্দ করার আগে। যাই হোক মার্চের শেষের দিকে আবার করোনার প্রকোপ বাড়তে থাকলো, কিন্তু তেমন কিছু না তখনো, তাই আমরা স্প্রে নিচ্ছিলাম ব্যাগে, নিজেদের চাদর, বালিশে কভার। খালি দেখা হয়নি, উখরুল জায়গাটার ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক অবস্থা। এবার বয়সেরও তো একটা দোষ আছে নাকি? তারা হাইক করবে,  পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে লম্বা শ্বাস নেবে এই স্বপ্নে মশগুল। সেই জায়গাটা আসলে শীতের জায়গা না গরমের,  টেম্পারেচার কতটা নামে, জঙ্গী হামলা হয় কিনা সেসব নিয়ে মাথা ঘানাতে বয়ে গেছে তাদের। বলতে পারেন, এসব আঠারো উনিশে মানায়,  এ বয়সে এত ইন্টারনেটের সুবিধায় এ জিনিস বোকামি। অবশ্যই, কিন্তু বোকামি ছাড়া জীবন বড় পানসে না? 


লোকটাক থেকে ইম্ফল হয়েই উখরুল যেতে হবে। ইম্ফলে কাংলা ফোর্ট দেখে আমরা উখ্রুল যাবো। কত প্ল্যান আর গ্রুপ কল করেছি এই বেড়ানোর আগে, বেড়ানো বেড়ানো উৎসাহ অনেকে বলে বেড়ানোর থেকেও ভালো, আমার অবশ্য বেড়ানোই বেশী ভালো। কাংলা ফোর্ট অনেকটা জায়গা জুড়ে, বার্মিজ আক্রমন ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারপর ইংরেজাসুর দের সাথে লড়াইয়ে ধ্বংস হয়ে যায় প্রায়।  ইতিহাসের ছাত্র আমি নই, কিন্তু ইতিহাস আমার বড় ভালো লাগে। এইসব রাস্তা, ভাঙা বাড়ি জুড়ে এক সময় সেপাই সান্ত্রী হেঁটে বেড়িয়েছে, গমগম করেছে লোকজন। হয়তো এই তালা বন্ধ স্রেফ চামসা গন্ধওয়ালা মন্দিরের সামনে এই যে এই স্রেফ থাম হয়ে গুলো রয়ে যাওয়া জায়গাটাতেই পুরোহিতের দাপট দেখা যেত। কোথাও কোনো লোক নেই, অস্বাভাবিক নির্জন চারদিকটা।কটা কাঠঠোকরার কাঠ খোদাইয়ের আওয়াজ  কিংবা একটা না দেখা পাখির ডাক ছাড়া কিচ্ছু নেই। রোদ বেশ চড়া এখনই, এ মন্দিরে আর পুজো হয়না স্বাভাবিকভাবেই।  আশেপাশের গাছের ছায়ার,  কোনোরকমে রয়ে যাওয়া গোলা গুলির ক্ষত সহ দেওয়াল এখন পাহারা দেয় নির্বাসিত ভবনকে। ওই প্রান্তে একটা মিউজিয়াম আছে,  সেখানে এদের রাজাদের দেখছিলাম, বিরাট বিরাট নানান মাপের সব গোঁফ

 

ড্রাইভার ব্যাটা খালি তাড়া দিচ্ছে, রাস্তায় কোথাও খাবো তো নাকি? মনিপুরি খাবারের একটা দোকানে দাঁড় করালো ব্যাটা, তা সে একেবারেই আমাদের রাস্তার ভাতের হোটেল। তফাৎ এই ডালহৌসি পাড়ায় বা রাজারহাট -সেক্টর ফাইভের রাস্তার খাবারের দোকানে গন্ধেই খাই খাই মনে হয় এখানে তেমন কিছু হল না বরং দোকানটা একটু কেমন কেমনই লাগলো, আর কোনো লোক নেই কিছু নেই স্রেফ একটা টেবিল কটা চেয়ার। সম্মিলিত আপত্তিতে সে জায়গায় মধ্যাহ্নভোজন স্থগিত করা তো হল, ড্রাইভারের কেন জানিনা মন মেজাজ বিগড়ে গেলো তাতে! ভয় টয় দেখালো, রাস্তায় আর কিছু পাওয়া যাবে না বলে।পাত্তাও দিলাম না, পাওয়া গেলে যাবে না গেলে না যাবে। খানিক এগোলেই রাস্তাটা চমৎকার হয়ে যায়, দুধারে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের পারে পাহাড়, রাস্তার দুধার সবুজ গাছে ছাওয়া। লোকজন বেশ কম এখানে।ছোট ছোট টিনের চালের বাড়ি মাঝে মধ্যে, সে সব বাড়ির কোথাও রেস্টুরেন্ট বলে লেখা থাকলেও খাবার মেলেনা। হয় দেখা যায় কত্তা মদ খেয়ে ঝিমুচ্ছে না হলে বলে দেয় এসব কাপলদের জন্য খালি। বোঝো! এমন তো কোত্থাও দেখলাম না, স্রেফ কাপলদের জন্য রেস্তোরাঁ?  আসলে অন্যকিছুই হবে হয়তো। হঠাৎ এক বাঁকের মুখে দেখা যায় রোড সাইড ক্যাফে নামে জ্বলজ্বল করছে একখানা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেস্তোরাঁ! তব্বে! বলেছিল যে কিচ্ছু মিলবে না? হুঁ হুঁ বাওয়া আমাদেরও টেলিপ্যাথির জোর আছে। 









ক্রমে রাস্তা চড়াই হতে থাকে, পাহাড়ের পাশ দিয়ে রাস্তা, নীচে খাত, পিছনে দূরে ফেলে আসা ইম্ফল উপত্যকা।  আর কোনো গাড়ি নেই কোথাও আমরাই চলেছি। নিস্তব্ধ চারদিক, এদের এক্সটেন্ডেড দোলের কাজ চলছে বলেই। রাস্তা বাড়ানো চলছে, পাহাড়গুলো প্রায় মিশিয়ে দিয়ে দিয়ে। দেখে মন খারাপ হয়, একটা একটা পাহাড় তো পুরো ন্যাড়া, যে কটা গাছ আছে তাও শোকে দুঃখে শুকিয়ে গেছে। গাছ কাটা শুধু না পাহাড় কাটাও চলছে পুরোদমে।একটা পাহাড়, সে কতদিন ধরে কত পোকা, কত গাছ কত প্রানীকে জায়গা দিয়েছে এতদিন সে সব শেষ! এত চওড়া রাস্তা কেন দরকার!!? বড় মায়া লাগছিলো, আমি আসলে মনে করি আমাদের এ জগত প্রানময়। আমাদের আশেপাশে পাহাড়, নদী, মাটি, জল সবাই টের পায়, তাদের নিজেদের ভাষা, বোধ সব কিছু আছে। জ্যোৎস্না রাতে পাহাড় জঙ্গল সব যখন ভেসে যায় আলোয়, আশপাশে কোনো মানুষ থাকেনা তারা সজীব হয়ে ওঠে, সে কথা হয়তো কোনোদিন মানুষ শুনতে কিংবা বুঝতে পারবে না। এলোমেলো ভাবনার মাঝেই দেখি কখন যেন আমরা উঠে এসেছি আরো উঁচুতে, বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছে। ড্রাইভার থামলো একবার। আমরাও হাত পা ছাড়াতে কেউ কেউ নেমেছি, দেখি বন্দুক কাঁধে একজন পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেলো গাছপালার ভিতরে। শিকারী?  এখনো আছে? ফের চলা শুরু, খানিক এগোতেই,  মুখ বাঁধা দুজন হাত নেড়ে থামাতে বলল গাড়ি। চেকিং হবে? এদিকে অনেক উগ্রপন্থী আছে বলে হয়তো। কিন্তু এমন সিভিল ড্রেসে কেন? সারথি  দেখি ভয় পাওয়া মুখে স্যার স্যার বলে কিসব বলছে। গাড়ির পিছনে আমাদের সুটকেস দেখালো। তারপর ঘাড় নাড়িয়ে ছেড়েও দিল। চুপচাপ খানিক দূর যাওয়ার পর জানালো, মিলিটারি না মিলিট্যান্টের হাতে পড়েছিলাম! অ্যাঁ! বলো কি নন্দলাল! পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওই রাস্তাটা খুবই বিপজ্জনক,  ভাগ্যিস জানা ছিলো না আগে তাহলে হয়তো সুখী ভীতু মধ্যবিত্ত ট্যুরিস্ট দল পা রাখতো না ওই পথে আর একটা অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ে প্রানভরে নিঃশ্বাস নেওয়াও হত না।


বাপরে বাপ এত ঠান্ডা লাগছে কেন? উখরুল জায়গাটা খুব ছোট কিছু না, প্রোমোট করা হয়না তাই না হলে গ্যাংটক এর হাইটের এই জায়গাটার আয়তন বা এখানে থাকা জনবসতি বেশ ভালোই। তাছাড়া নর্থ ইস্টের অনাঘ্রাতা সবুজের  জড়ামড়ি তো আছেই। কিন্তু আপাতত তো কেঁপে অস্থির হয়ে গেলাম হে! আমরা হাবার মতো, হাফ প্যান্ট স্যান্ডো গেঞ্জি নিয়ে এসেছি ট্রেক করতে এদিকে ভোরে এখানে তাপমাত্রা হয় চোদ্দো পনেরোর মতো এই সময়ে! বাহ বাহ, খুব পড়াশোনা করেছি উখরুল নিয়ে। রাস্তা বিপজ্জনক জানিনা, কত হাইটে জানিনা, টেম্পারেচার কেমন থাকে জানিনা। তারমধ্যে হোটেলের মালিক(মালিক আসল্ব তার বউ সে নিজেকে মালিক বলতে চায় বলে খানিক হাবভাব দেখায়, এদিকে কিছুই পারে না)  খুব ভয় দেখালো, ওই ট্রেক করতে তোমাদের সাত ঘন্টা লাগবে। এরকম প্ল্যান কেন করেছ ইত্যাদি। ভারী রাগ হয়ে গেল। এরকম ডিমরালাইজিং লোক বিরক্ত লাগে। এবং সত্যি বলতে অতক্ষন লাগেও না। লোকটার নিজের ফিটনেস মাইনাসে তাই হয়তো সবাইকে ওই ভাবেই ভাবে! যাকগে মরুকগে, কাল বেরোবো তারপর দেখা যাবে, আপাতত ওই যে টিমটিমে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানটা, ওইটায় ঢুঁ মারি। শীতের পোশাক এক দফা না কিনলে তো হবেই না। বেরোনোই যাচ্ছে না এত ঠান্ডায়! গুড ফ্রাইডে বলে আসলে চারিদিক বন্ধ, ওই একটিই খোলা ছিলো যাও কিনা বন্ধ হতে চলেছে, আর লোকটার তো আজ প্রায় লটারি লেগে গেছে। এক সাথে সাতটা বিক্রী হবে এক দিনে!  কালকে দোকান গুটিয়ে সমতলে না নেমে যায়! 


জানলা থেকে একটা চার্চ আর বাজারটা দেখা যায়, সাতটা বাজতেই রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য।  অন্ধকারে, শান্ত শহরটাকে দেখতে মন্দ লাগে না। নির্জনিতা এখানে সত্যিই অনুভব করার মতো। রাতে শুলে নিজের কানের মধ্যেকার শোঁ শোঁ আওয়াজ শোনা যায়। তারপর ঘুম ভাঙে মোরগের ডাকে, তখনো অন্ধকার চারিদিকে, একটু একটু করে সকাল হতে দেখি, কতদিন পর ভোর দেখলাম। হুড়মুড়িয়ে বেরোনো গেলো, লম্বা হাঁটা বাকি সামনে...