Sunday, January 23, 2022

আমলামেথি আর বিদ্যেধরী

সড়াৎ করে টার্ণটা নেওয়ার পর থেকেই রাস্তাটা খারাপ হতে শুরু করেছিল। তাও গুগল ম্যাপকে ভরসা করেই বেঁকেছিলাম। এখন তো একেবারে ফাটা বাঁশে আটকে যাওয়া কেস রে ভাই।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বিশ্রী আবহাওয়া। লেপমুড়ি দিয়ে ভূতের গল্প পড়ো, মাঝে মধ্যে একটু কফি খেলে। দুপুরে কচ্ছপের মতো অতি কষ্টে বেরিয়ে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খেলে ব্যস। আর কিচ্ছু করা শাস্ত্রে মানা। কিন্তু মাঝে মাঝে শাস্ত্রের নিয়ম অগ্রাহ্য করাও মহারাজ ঋকানন্দের নিয়ম৷ লম্বা পাড়ি দেওয়া হয়নি অনেকদিন, জলের শব্দ শোনাও হয়নি কত্তদিন। এই বছরের একুশটা দিন কেটে গেছে আমি আপিস করেছি, খেয়েছি, আড্ডা মেরেছি, ঘুমিয়েছি, পড়েছি, উদ্ভট ভিডিও দেখেছি কিন্তু নিঝুম দুপুরে নদীর ছলাৎ ছলাৎ শুনিনি, নতুন মানুষ দেখিনি, পথের ধারে হঠাৎ থেমে চায়ের দোকানের সস্তার কেকে আমেজ করে কামড় দিইনি, হুট করে আসা বৃষ্টিতে কিংবা শেষ বিকেলের সূর্য মাখিনি। পথ আমার সব শক্তির আধার, আমার ভালো থাকার ওষুধ। তাই আমার উপায় ছিল না  আজ লেপমুড়ি দিয়ে জিরোবার।

যাওয়ার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু ট্যুরিস্ট প্লেসে ঠিক যেতে চাইছিলাম না। একটু হলেও নাগরিক উল্লাস তফাৎ থাক। আবার নদীও চাই,  সমুদ্র বা পাহাড় তো বললেই পাওয়া যায় না। সুতরাং গুগলবাবুকে একটা গাঁ এর ঠিকানা দেওয়া হল। আমলামেথি। কেমন সুন্দর নাম না? নাম শুনেই প্রেমে পড়ে গেছিলাম আসলে। তা গুগলের মনে হয় অত ভালোলাগেনি। ওই যে ওর কথা না শুনে শুরুটা অন্য রাস্তা নিয়েছিলাম তাতেই তার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে মনে হয়। শুরুতে বলছিলাম না, ওই চুড়িবাজার থেকে টার্ণ নিয়ে খানিকদূর ভারী সরুরাস্তা দিয়ে এগোনোর পর দেখি একটা দরগার পাশে মেলা মতো বসেছে, আর সেই দু পাসের পসরার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে জায়গা আছে তাকে যদি রাস্তা বলা যায় তবে সে রাস্তায় ওইদিক থেকে একটা টেম্পো আর বড় লরি ঢুকে এসেছে। এদিকে আমার বাঁ দিকে গরম জিলিপির কড়াই, ডানদিকে এক বাইকওয়ালা আরাম করে চিনেবাদাম সওদা করছে। সবাই অপেক্ষা করছে কখন তার কেনা শেষ হবে সে গেল, এরপরেই সাঁত করে কটা ভ্যান ঢুকে ব্যাপারটা বেশ খোলতাই করে দিল। একদিকে খাদ আর উটের দ হয়ত নেই কিন্তু গরম জিলিপির কড়াই, লরি,আর কাঁচা রাস্তার কম্বোটাও কম না। কী করে যে পার হলাম সে দ তা আমারও মনে নেই। আমার হাতেই স্টিয়ারিং ছিল কিন্তু ও পথ দিয়ে আমি মানে এই আমিই পেরিয়েছি!!

এই বীর ভাব কিন্তু বেশীক্ষন রইলনা। গুগল ম্যাপ আজ আমাদের বেশ অ্যাডভেঞ্চারে নামাবেন স্থির করেছেন। দু কদম যেতে না যেতে তিনি আরেকটি বাজারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। শুক্রবার না হলেও শনিবারের হাটও বেশ রমরমাই৷ মাছ,সবজি, গামছা, দাদের মলম আর তার সাথে রাস্তা সবার মানে আমারও মান্র আমার সাইকেলের এই ভাবনায় কিছু মানুষ সাইকেল রেখে দিয়েছে। সেসব সদিয়ে যাও বা পেরোলাম,  একটা সরু এমন রাস্তায় ঢোকালো, যার একদিকে পুকুর,একদিকে খাটাল বা বাড়ির দেওয়াল! আর ভরসা করা গেল না। আমার সনাতনধর্ম বেঁচে থাক, মানুষ ডেকে জানা গেল আর কিলোমিটার দুই এই রাস্তা সইলে মেন রাস্তায় ওঠা যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে এসব খারাপ সময়গুলো পার হলে কিন্তু ম্যাজিক মেলে, আর খারাপ রাস্তাতেই  মেলে। এই যেমন দেখোনা, ভেড়ির ধারে গাড়ি থামিয়ে, হাঁটতে মন্দ লাগছে নাকি? রোদ বেরোয়নি ঠিক কথা কিন্তু এই যে পানকৌড়ি কাদাখোঁচা আরো কত চেনা অচেনা পাখি উড়ছে। আরো কতক্ষন পরে ফের রওনা দিলাম। কত লোকে পথ চিনিয়ে দিল এদিক না ওদিক, রাস্তায় নামলে রাস্তা চিনতে আর কঠিন কি। ।

আবারও একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। এবারে আবার একদিকে খাল একদিকে খেতিজমি।বৃষ্টি এলো ঝমঝম করে এর মধ্যেই।একটা ন্যাংটো খোকা ছাতা মাথায় দৌড়ে গেল, দুটো ছোট মেয়ে  ছুটতে ছুটতে বৃষ্টি মাখছে, একটা ছোট ছেলে তার ছোট ছাগল ছানা বুকে জাপটে নিয়ে মাথা বাঁচাতে যাচ্ছে। পথের ধারে কত অজস্র দৃশ্য তৈরী হয় সেসম দু চোখে নিয়ে এই বিপজ্জনক রাস্তায় চলতেও অসুবিধে হয়না। বৃষ্টি থেমে যায় আচমকাই, দূরে দবুজমাঠ আরো তকতকে হয়ে করে দিয়ে৷ একজনকে জিজ্ঞেস করি রাধারাণীপুর জায়গাটা কোথায়?  কেউ চেনে কেউ চেনে না, তবে আছে ঠিক। আসলে চলার নেশাতেই চলছি, পৌঁছতেই হবে এমনও কিছু নেই। তবুও পথচলতি লোক উপযাচক হয়েই বলে দেয়,  কেউ বলে আগিয়ে দেবো চলো। পথের ধারে এর কুড়িয়ে পাওয়া ধন থাকে আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছেই করে না তাই।


আমলামেথি নামের মতোই জায়গাটা। মস্ত গাছের নীচে ছোট্ট দোকান, দুপুরের খাওয়া চলছে তখন। রাস্তায় থেমে চা বিস্কুট খেয়েছিলাম এক জায়গায়। বাপ গিয়েছিল খেতে, সদ্য গোঁফের রেখা গজানো ছেলে সামলাচ্ছিল দোকান।ভাত খাওয়া থামাতে ভাল্লাগেনা কারো, তার চেয়ে চলো নদীর কাছেই বরং। বিদ্যেধরী নদীর কাছে কতবার এলাম এই নিয়ে? কী জানি! এক নদীতে তো একের বেশীবার আসাও যায় না। দুপুরের খেয়ায় ছাগল, বাইক, সাইকেল, ডাব সবই চলেছে ওইপারে। অত বাছবিছার চলে না এদিকে। ছাগলও বাধ্য ভারী, চারটি কাঁঠালপাতা দেওয়া আছে, চিবিয়ে চলেছে আপন মনে। ওইপারে পৌঁছে বাঁধ ধরে হাঁটা শুরু  করেছি।  বাঁধের ধারের গাঁ টা শীতের দুপুরে ঝিমোচ্ছে। মাঝে মাঝে মোরগের কোঁকরকোঁ, গরুর হাম্বা,  কিংবা ছাগলের ম্যা ম্যা ভেসে আসে। বাঁ হাতে বিদ্যেধরী ছলাৎ ছলাৎ করে সঙ্গ দিচ্ছে। একটা মোহনচূড়া পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা না কি যেন ধরছে। মোটকা একটা শালিখ তার সাথে ভাব জমাতে যাচ্ছে। মোহনচূড়ার মত সুন্দর পাখি পাত্তা দেবে কেন,  উড়ে উড়ে পালাচ্ছে। মাছরাঙা আর একটা ঘুঘু বসে আছে চুপটি করে ইলেকট্রিক তারে। একটা মৌটুসী আকন্দ গাছে দোল খেয়ে নিল। একটা বাঁশপাতি উড়ে গেল। ক্যামেরাটা আনিনি, আসলে খুব প্ল্যান করে বেরোইনি তো। বেরোতে হবে, এই তাড়না থেকেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। খুব অসুবিধেও বোধ করছিনা। দিব্যি ভারমুক্ত হেঁটে যাওয়া। একটা বৌ কোলের ছেলে নিয়ে নতুন বাছুরএর  তদারকি করতে গেল। ঝপঝপ করে জল ঢালছে মাথায় একটা ছেলে। ক্যাঁচক্যাঁচ করে টিউবয়েলের আওয়াজ আসছে। পাশের পুকুরের একঝাঁক হাঁস আরাম করে সাঁতার দিচ্ছে। ফিরতে ইচ্ছেই করছে না। হেঁটে চলেছি কতক্ষন দেখিনি, কতদূর এলাম কে জানে। "কাদের বাড়ি এসেছ? কোথায় যাবে?" জাল সারাতে সারাতে হাঁক দেয় কেউ। গ্রামের পথে এভাবে খোঁজ নেওয়া স্বাভাবিক। উত্তর দিয়ে এগোই। রোদ পরে আসছে ক্রমেই। ফিরতে হবেই। একবার ঠিক আসবো, পিছুটান না রেখে। যেখানে অন্ধকার নামবে সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে নিয়ে কিংবা না জুটিয়ে নিয়ে। পথের দেবতা কবে আমায় তেমন ভাবে নিয়ে বেরোবে কে জানে....