Wednesday, September 18, 2019

বিশ্বকর্মা

বিশ্বকর্মা তো অত খাতির পাওয়া ঠাকুর না, নতুন জামা জুতো, সারারাত আলো কিচ্ছু না। রিকশাওয়ালাদের নতুন গেঞ্জি পরে তদারকি করা ঠাকুর, মেশিন আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঠাকুর।  রাস্তায় বেরোতেই দেখি সব গাড়ি, রিকশা, অটো ঝকঝক তকতক করছে৷ কেউ কলাগাছ বেঁধে কেউবা ফুলমালা,  কেউ চকমকে কাগজ দিয়ে সাজিয়েছে নিজেদের গাড়ি৷ আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা চালকল আছে, মানে বড়সরো না, গ্রামের লোকজনই খোরাকির ধান ভাঙাতে আসে। সেখানেও আজ পুজো হয়, আর কদিন বাদেই পুজো এলো বলে। আকাশে একটাও ঘুড়ি নেই দেখলাম, হয়ত উড়বে পরে কখনো। কিংবা উড়বেই না, নিউ জেনারেশন মেঘেরা ঘুড়ি পছন্দ করেনা হয়ত।

আমার দুঃখিনী গাড়িটা ধুলো ময়লা পরাই আছে। আমি ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাসী না,  তাই আমার অবিশ্বাসের মূল্য চুকিয়ে আমার গাড়ি ম্লান মুখে চারদিক দেখতে দেখতে যায়। আচ্ছা আচ্ছা মন খারাপ করিসনি, এই সপ্তাহেই ঝাঁ চকচকে করে তুলবো খুব করে। অফিসে বেসমেন্টে মেশিন আছে যেখানে ওখানে বিশ্বকর্মা পুজো হয় প্রতিবছরেই। আলপনা আঁকা, সাজানো পুজো পুজো গন্ধওয়ালা বেসমেনড়ে খিচুড়ি আর আলুরদম খাওয়াচ্ছে। আমার এই সব জায়গায় আসলেই খুব ইচ্ছে করে কোর সেক্টরে চাকরি করতে। প্ল্যান্টে কাজ করতাম বেশ, ফ্যাক্টরির মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দুপুরে খেতে আসতাম। রাতে ঝুপ করে রাত নামতো, সকাল হত তাড়াতাড়ি। 

বিশ্বকর্মা মনে হয় সেই ছেলেটার মত, আনস্মার্ট, ইংরাজিতে অদক্ষ, কিন্তু কাজটা জানে খুব। ঝলমলে শহরে তেমন পাত্তা পায়নি, কাউকে জানাতেই পারেনি সে কতটা পারে,তারপর নিজেও ভুলে গেছে সে কতটা পারতো....

Friday, September 13, 2019

ফিরতি পথে

কাল সকাল নটায় আপিস গেছি আর ফিরেছি ভোর চারটেয়। ভোর রাতের কোলকাতা যে কীইই মায়াবী কি আর বলব। রাস্তাঘাট কোনো সময়েই একদম ফাঁকা হয়না, কিছু গাড়ি কিছু বাইক থাকেই ঠিক, কিন্তু জেগে থাকা লোক প্রায় নেই হয়ে যায়, কুকুরগুলো অবদি মরার মত ঘুমোয়।

  আমার কাজ মিটে গেল পৌনে তিনটের দিকে, এমন রাতজাগা রাত তো খুব বেশী আসে না। তাই বাকিরা বেরিয়ে গেল, আমি হাঁটা লাগালাম খানিক, রাতে প্রজেক্টের পহায় ম্যালা খাওয়া হয়ে গেছে।খেতে গিয়ে দেখি কিই ভীড় কিই ভীড়। বুধবারের রাতে এত লোক সেক্টর ফাইভের রেস্তোরাঁয় ভাবা যায় না। হরেক কিসিমের লোক,  দল বাঁধা ছেলে, হুইস্কি আর তন্দুরি নিয়ে, বিয়ারের বোতল সামনে দুই কপোত কপোতি। তো সেই সব খাওয়া হজমও হবে।ওইদিকে এক একটা পাতলা অন্ধকার, মেঘ দেখা যায় আকাশে, কলসেন্টারের সামনে খালি এক মেয়ে সিগারেট ফুঁকছে। এ পাড়ায় নেড়ির প্রকোপ নেই, দু তিনটে যা আছে তারা রাতের বেলা বাঘ হয়ে যায় না। হাঁটতে হাঁটতে গোদরেজ বিল্ডিং এর পাশ দিয়ে ভেড়ির দিকে আগিয়েছি। 

এদিকে আলো কম, ঘুটঘুটে না হলেও বেশ ভালোই অন্ধকার। ইচ্ছে করছিল খুব, পাশের আলের রাস্তা ধরে যাই। সাধক মানুষ হলেও অঘোরী তো না,  মানুষের ইয়েতে অন্ধকারে পা পড়লে আনন্দ হবে না ভেবে এ যাত্রা ক্ষান্ত দেওয়া গেল। 

ঘুম চটকে গেছে, আচ্ছা এমনিই কোলকাতা পাক খেলে কেমন হয়? বাহন যখন আছেই? শুনশান রাস্তায় জলের পাইপ সারানোর কাজ হচ্ছে, কোথাও কোথাও রাস্তা সারাবার কাজও। সিগন্যাল গুলোও রাতের বেলা বেশ এক্টিভ হয়ে গেছে, সেই বিচ্ছু বাচ্ছা গুলো হয়না? দিনে ঘুমায় রাতে এনার্জেটিক হয়ে যায়? অমনি। সারাদিন তিন মিনিট লাগে যে কাজ করতে এখন দেখি দশ সেকেন্ডে হচ্ছে। 

কোলকাতায় বড় আলো মশাই। এত আলোয় খালি দেখা যায়,  মশারী টাঙিয়ে ফুটপাথে আরামে ঘুমোচ্ছে কেউ, এই তিনটেতেই রাস্তায় রিকশা বিয়ে বেরিয়েছে কেউ কেউ৷ ভিক্টোরিয়ার পরীটাকে দেখে আসলেও হয়, একা একা কেমন দাঁড়িয়ে আছে? নাকি ঘুরছে? নাকি সুযোগ পেয়ে মাঝরাত্তিরে  উড়ে গেছে, বন্ধুরা তো জ্যোৎস্না ছাড়া আসেওনা, গল্প করার খেলা করার লোক নেই। জ্যোৎস্না ছাড়া পরীদের পৃথিবীতে আসা বারন, কিন্তু কোলকাতার কালো পরী একদিন বেভুলে চলে এসেছিল। ঠিক বেভুলে না,  ভালোবেসেই, কাকে সেইই জানে,  কেন ভালোবেসেছিল সেটা অবশ্য সেও জানে না সবাইয়েএ মতই। না তাদের মেলেনি অবশ্য, কিন্তু তার আর ফেরার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছিল। নিজেরও খানিক অভিমান ছিল, আর ছিল অনেকটা গোপন ভালোবাসা,  নিজেও জানত না সে কথা। ভালোবাসা অভিমান হয়ে জমাট বেঁধে নিজেকে ভিক্টোরিয়ার পাথরে আটকে দিল। যাব নাকি তাকেই দেখতে এই অন্ধকারে? কালো পরীর চোখ দিয়ে জল পড়ে হয়ত এমন রাতে....থাকগে যে জল মোছাতে পারিনা সে জলের সাক্ষী না থাকাই ভালো।

কাঁকুরগাছি, ধর্মতলা হয়ে গিরীশপার্ক দিয়ে ফিরে ফের রাজারহাট নিউটাউন এসেছি। এলোমেলো পাক খাচ্ছি খালি, আমার তো কোথাও যাবার নেই....

Sunday, September 8, 2019

ভুটের বন্ধু

একটা কেন্নো গুটিগুটি এগোচ্ছে, বারান্দা পেরিয়ে মেঝেতে ঢুকে পড়ল। আমি দেখছি আর একটু পরেই এটা ঘরে ঢুকে পড়বে, আর আমি মাকে বলব। তার আগে না, বললেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। বৃষ্টির জন্যে ঘরের মধ্যে মেলে রাখা কাপড় জামা, সবাই হাঁকপাঁক করবে,  আমি সেই ফাঁকে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে কেন্নোটার গায়ে ধরব,গোল্লা পাকিয়ে যাবে, আমি ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাব। সেই সুযোগে, নৌকাটাও ভাসিয়ে দিয়ে আসবো। এরা খালি পড়া পড়া করে। আমার পড়তে ভালো লাগে না। আমি কিছু বুঝতে পারিনা ফিজিক্স এর অংক, আমি গ্রামার এ ঠেক খাই। আমি পড়াশোনায় খারাপ, তাই সারাদিন বকুনি খাই। নৌকাটা ভাসাতে পারলেই হবে, ওই নৌকা ঠেক খাবে এদিক সেদিক, তারপর ভাসতে ভাসতে ঠিক পৌঁছে যাবে কোনো এক অজানা দেশে। আমি জানি এসব হয়না কিছু, আমি তো আর ছোট নেই যে জানব না এসব! কিন্তু আমার তাও ভাবতে ভালো লাগে,  একটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ড কি আর নেই, যেখানে ফিজিক্স নেই, আইয়াইটি নেই, বাবার কলিগের ছেলের ভালো মার্কস নেই।

যা ভেবেছিলাম,  ধুন্ধুমার লেগেছে। আমি এক পা দু পা করে বাইরে। আমাদের আবাসনটায় আমাদের বাড়িটা সবার শেষে, আমাদের বাড়ির পাশেই ভ্যাট, তারপর কুকুর গুলো থাকে, গেট পেরোলে ফুটপাথের লোকগুলো। আজ বৃষ্টিতে আর বেরোয়নি কুকুরগুলো, কেয়ারটেকারের ঘরের পাসে গুটিয়ে শুয়ে আছে, আমি পেরিয়ে যাই। এখানে কোথাও পুকুর নেই, আমার মামারবাড়ির ওখানে আছে। কত পুকুর, এরকম বৃষ্টির দিনে মামার বাড়ির ছাদ থেকে জল সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে লাল রোয়াকে এসে নকশা করে যায়।বৃষ্টি সমানে হয়েই চলেছে, ভিজে যাচ্ছি আমি, জানি বাড়ি ফিরলেই বকুনি খাব, আমার জন্যে কত কষ্ট করে সব তারপরেও আমার মন নেই পড়ায় এসব বলে। বড় হলে আমি ঠিক করেছি এদের থেকে পালিয়ে চলে যাব, আমি ও পাড়ার তাপস,গুড্ডু ওদের মত সোনা রূপোর দোকানে কাজ করব। বড়লোক হওয়া যাবে না  হয়ত কিন্তু বড়লোক হলেই বা কি এমন চতুর্বর্গ হবে! ওই তো বাবার বন্ধুরা, সব খালি বলে সুগার কোলেস্টেরল এই খাব না সে খাব না। ফুহঃ।  সেদিন বিয়েবাড়িতে আমি দশটা মিষ্টি খাচ্ছি দেখে বিশুকাকুর ন্যাকা মেয়েটা তো প্রায় মুচ্ছোই যায় আর কি! তারচেয়ে পয়সা জমিয়ে আমি নতুন নতুন দেশে যাব, সেখানে কিছু মিছু করে পয়সা জমিয়ে আবার নতুন দেশে। খালি বড় হওয়ার যা অপেক্ষা৷ 

সেদিন কি মারটাই না মারলো,  কী না পড়ার বই এর বদলে মোবাইলে গোপাল ভাঁড় দেখছিলাম। কী এমন ক্ষতি হয় তাতে? বাড়ি থেকে পালাবো ভেবেছি, বইবের ব্যাগে একটা জামা,  পাঁচশো টাকা আর দুটো বিস্কুটের প্যাকেট। ব্যাস আর কি চাই! আজ সারাদিন ধরে মায়ের সব কাজ করে দিয়েছি, অনলাইনে মাসকাবারি অর্ডার দেওয়া, বাবার মোবাইলটা সারিয়ে দেওয়া, সব। চুপচাপ পড়তেও বসেছি।বিকেলেই বেরিয়ে যাব কিনা তাই ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ফিরব যখন সবার জন্যে এত এত গিফট নিয়ে আসব। নতুন নতুন দেশ দেখতে হলে এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত। 

সুতরাং, ভুটে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।কোলকাতার রাস্তায় বৃষ্টিতে মজার থেকে সাজাই বেশী, তবে তাও ভুটের বৃষ্টিতে ভিজতে দিব্যি লাগে। নোংরা জল ছিটিয়ে ছপছপ করতে করতে সে চলল। আরে এদিকের রাস্তাটা তো আমি অর্থাৎ শ্রীল শ্রীযুক্ত ভুটের আসাই হয়নি। অবশ্য স্কুল টিউশন আর বাড়ি ছাড়া কোথাইই বা যাই। না এখানে সত্যি কথাই লিখি, মাঝে মাঝে ইস্কুলের ক্লাস পালিয়ে সুইমিংপুলের পাড়ে গিয়েও বসি।  সুইমিংপুলের নামটা আর বললাম না, বাড়ি ফেরার পর আর যাওয়া যাবে না শেষে! 

নোংরা জল গায়ে লাগলে বাবা মা খুব চেঁচায়, এখন যা লাগছে দেখলে অজ্ঞানই হয়ে যেত হয়ত। আমি শুনেছি, বাবা অনেক বড় চাকরি করে, যদিও কক্ষনো বলেনা, কিন্তু আমি তো আর গাধা না রে বাবা, আমার জামা, জুতো, আমাদের ফ্ল্যাট দেখলেই আমি বুঝি। পড়াশোনা করলে আমিও নাকি এমন হতে পারব, কিন্তু বাবা তো আরামে থাকে না। রোজ রাতে অফিসের কল থাকে, ট্যুরে যায়,  সেখানে নাকি ঘুরতেও অয়ায়না,  খালি মিটিং করে। তাই জন্যেই তো আমি ঠিক করেছি, আমি গ্লোব ট্রটার হব। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো। এমনিতেও পড়াশোনা আমার মাথায় ঢোকেনা, এইই ভালো।

"কেবল পেটে বড় ভুখ না খেলে নাই কোনো সুখ...",  খিদে পেয়েছে।  তা সত্যি বলতে খিদে আমার বেশ ভালই পায়, যখন তখন পায়। একটা বিস্কুটের প্যাকেট তো কখন উড়ে গেছে। কিছু মিছু কাজ দেবে না কেউ? চলতে চলতে কত কিই না দেখা যায়। খিদে না পেলে আরো মন দিয়ে দেখতাম অবশ্য। দেশ ছাড়ার উপায়টা কঠিন। আমার ভূগোল বই খুবই খারাপ লাগে কিন্তু গুগল ম্যাপ বেশ লাগে। তাতে এটা ওটা সার্চ করে যা দেখলাম, ভুটান বা নেপাল যাওয়া যেতে পারে সহজে। ট্রেনে জেনারেলে উঠে পড়লেই হল। বাকিটা তো অ্যাডভেঞ্চারে।
খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসেগেছি বুঝতে পারছিনা। মোবাইল থাকলে লোকেশন ট্র‍্যাক করা যেত। অবশ্য লোকেশন ট্র‍্যাক করেই বা কি হবে।  আমি যে হাওড়া বা শিয়ালদার কোনো ট্রেনে চেপে বসিনি, আমি তো এমনিই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি এদিকে। বাবা আসলে ঠিকই বলে, আমার কোনো ফোকাস নেই। 

" অ্যাই ওঠো, এখানে ঘুমোচ্ছ কে তুমি?"
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কার যেন ডাকে ঘুম ভাঙলো! অ্যাঁ আশেপাশে তো কই কিছু নেই! এ জায়গাটাও একটু অন্যরকম লাগছে কেন? 
"কে তুমি? তোমার নাম কি? "
ভূত নাকি রে বাবা? চঙমঙ করে চারদিক চেয়ে দেখি একটা নেংটি ইঁদুর খালি দুপায়ে ভর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।  এইই কথা বলছে নাকি? 
আমি ভারী অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মানুষের মত কথা বলতে পারো?" 
ইঁদুরটা ভারী অবাক হয়ে বলল, " সে আবার কি! মানুষের মত হবে কেন! আমি আমার মতই কথা বলছি তো!" 
অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখি, সত্যিই তাই! আমি ইঁদুরের কিচমিচ বুঝতে পারছি!! ধুস এরকম হয় নাকি! আমি নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছি, এক্ষুনি বাবা কান ধরে পড়তে বসিয়ে দেবে। আবার পড়াশোনার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল। এবার নাইন হয়ে গেল, এরপরেই নাকি ঠিক হয়ে যায় আমি বড় হয়ে বিদেশে এইইই বড় চাকরি করব না এখানে চা এর দোকান দেব! 
ওদিকে ইঁদুরটা দেখি কি সব কিচমিচ করছে, কান পাততে দেখি বলছে, "তোমার বুঝি খিদে পেয়েছে? মুখটা এমন শুকনো কেন?"

যেই না বলা খিদের কথা, অমনি পেটটা খিদেদে গুড়গুড় করে উঠলো।  আমি তাও খুব গম্ভীর মুখেই বললাম, "না খিদে পায়নি আমার। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছিই বা কি করে?"
সত্যি বলতে আমার ভয় করছে, কিন্তু নাইনে পড়া ছেলের ভয় পাওয়াটা দেখানো যায়না। ইঁদুরটা মনে হয় বুঝে ফেলেছে আমার ভয় পাওয়াটা, এক্ষুনি খিল্লি করবে ঠিক। আশ্চর্যের ব্যপার ইঁদুরটা খিল্লি করলো না, খুব নরম গলায় বলল, "দেখো তুমি আশ্চর্য হয়েছ খুব আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন হয়েছ আশ্চর্য আমি জানিনা, আমরা তো সবাই সবার কথা বুঝতে পারি, এটাই তো স্বাভাবিক ব্যপার। আর তোমার খিদে পেয়েছে এও আমি টের পাচ্ছি তো, কেমন ম্লান হয়ে গেছে তোমার মুখটা, সুখ দুঃখ সবই টের পাওয়া যায় তো।  তোমার বাড়ি কোথায়? চলো আগে কিছু খাওয়া যাক। "
আমি অবাক হয়েছি এতই,  আমার আর ভয় করছে না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। যদি এটা স্বপ্নও হয়,  এটা ভয়ের স্বপ্ন না, তবে চলুক যেমন চলছে।

সুতরাং ইঁদুরের সাথে চলা শুরু হল আমার। গল্প করতে করতে বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ওর নাম লটপট। লটপট নামটা এমন মজার নাম ভারী ভালো লেগে গেল। একটা সিং থাকলেই এর সাথে কেমন,  হাতে লাঠি,  লাঠির আগায় পুঁটলি নিয়ে চলা ইঁদুরের ছবি মনে আসে। ওকে বলতে ওও হেসে ফেলল। কথায় কথায় যা বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে যা বোঝা যাচ্ছে না, তবে সম্ভবত এ জায়গাটা আমার চেনা পৃথিবী না। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড মনে হয়। এখানে সবাই সবার কথা শোনে বুঝতে পারে। 

-হ্যাঁরে লটপট, খেতে কোথায় নিয়ে চলেছিস? আমার কাছে মোটে পাঁচশো টাকা আছে।

- অ্যাঁ টাকা? টাকা কি? ও  দিয়ে কী হবে?

- বলিস কি!  টাকা জানিস না? ওরে মানুষদের তো টাকা দিয়েই সব রে। টাকা না থাকলে কিচ্ছু হবে না। খাওয়া, পরা, থাকা, বেড়ানো কিচ্ছু না।

- সে কিরে! এরকম কখনো শুনিনি তো! আমাদের এখানেও তো মানুষ আছে। টাকা হয়না তো তাদের! আমাদের এখানে ভালো কাজ গোনা হয়। ধর,  তোর খিদে পেয়েছে, খাবার নেই।  এবার তোকে কেউ খাওয়ালো। সেটার পয়েন্ট হল, সেই পয়েন্ট দিয়ে তুই তোর পছন্দের কিছু করতে পারবি। আবার তোকে তো রোজ রোজ এমনি খাওয়ালে তোর লাভ হবে না কারন তোর আত্মিক উন্নতি হচ্ছেনা। হ্যাঁ তুই যদি বিজ্ঞানী,  বা শিল্পী হতিস যা গাছ লাগানো লোক তাহলে তোকে তোর খাবার চিন্তা করার দরকার হত না। গাছেরাই তোকে খাওয়াতো। তাহলে,  তোকে রোজ খাওয়ালে কিন্তু পয়েন্ট বাড়বে না, বরং তোকে যদি এমন কিছু কাজে নেওয়া গেল যাতে তোর নিজের  আত্মিক উন্নতি হবে বা বাকিদের তাহলে পয়েন্ট অনেক বেশী। তাছাড়াও আরো জটিল ব্যাপার আছে। 

- পয়েন্ট ট্র‍্যাক করে কে? নাহলে তো যে কেউ মিথ্যে বলতে পারে?

- তা পারে না। এখানে ট্র‍্যাক হয় অটোমেটিক্যালি। মানে তুই জন্মালি যখন, কোনো গাছের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। গাছেরা তো খুব প্রাচীন বিচক্ষণ,  তাদের একটা পদ্ধতি আছে তারা ওই ছোট বয়সেই সবার মধ্যে ভালোবাসা, আর মায়া তৈরী করে দেয় শিকড় দিয়ে। ব্যাস ও হলেই হল, বাকিটা এমনিই হয়ে যায়।

- মানে এই যে আমি কিচ্ছু পারিনা, ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, ইতিহাস, ভূগোল আমাকেও এখানে কেউ দুচ্ছাই করবে না? আমি যদি গাছ লাগাই, গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করি, হাওয়ায় গান ভাসাই আমার পয়েন্ট হবে, আমায় সবাই ভালোবাসবে আর ভালো বলবে? 

- আরি বাপ্রে গাছেদের স্থান সবার উপরে এখানে।  আর হাওয়ায় গান ভাসালে  তো হয়েই গেল। তুই তাহলে সবার ভালোবাসা পাবি। 

- আর যে এসব কিচ্ছু করেনা, অন্যের জিনিস কেড়ে নেয়,জুলুম করে সে? তাকে কি মেরে ফেলা হয়?

- এখানে অমন সহসা কেউ করে না বুঝলি। তাও কারোর যদি ভালোবাসার তার কেটে যায়,  অমন হয়ে যায়, তাকে আমরা জঙ্গলে একা একা ছেড়ে দিই।

- বাঘে খেয়ে নেয় বুঝি তাকে?

- না না, সে আবার কি!  বাঘ অমন মানুষ খায়না। বাঘেদের তো আলাদা খাবার আছে। জঙ্গলে থেকে থেকে ওর মধ্যে আবার ভালোবাসা ফিরে আসে। শিকড় লেগে যায় মনে।

অবাক হচ্ছিলাম, তাও বড় ভালো লাগছিল সব।  আহা কিই ভালো কিই ভালো। এখানেই থেকে গেলে হয়। লটপট আর ভুটে মিলে পৌঁছলাম এক জায়গায়। মিষ্টি এখানেও সব একইরকম পাওয়া যায়। আসলেই তো একই জায়গা খালি অন্য ডাইমেনশনে। দুজনে মিলে খুব খানিক কালাকাঁদ, সরপুরিয়া,  সরভাজা, কেশর রসমালাই,  রাবড়ি খেয়ে চললাম আবার। মনে ফূর্তি থাকলে আমি গান গাই মন্দ না, একটা নদীর ধারে, সবুজ মাঠের উপর আধশোয়া হয়ে গান গাইছি, লটপট বাজনা বাজাচ্ছে, ওই দেখো একটা হনুমান, ল্যাজ ঝুলিয়ে আরাম করে বসে শুনছে। আরো চারটে ছেলে মেয়েও জুটেছে দেখছি। গান টান গেয়ে শেষ হতে না হতেই এক পশলা বৃষ্টি এসে গেল। কাদায় মাটিতে মাখামাখি হয়ে খুব খেলাও হল। কাদা মাটি মেখে হুড়োহুড়ি করতে এত ভালো লাগে? জানাই ছিল না তো! 

দিন কেটে যায়  খেলে,হুল্লোড়ে, আনন্দে। আমি চমৎকার রাঁধতে শিখেছি। বন্ধুদের খাওয়াই, গল্প করি। গান গাই। আমি নাকি খুব ভালো।  এমন করে কেউ কখনো বলেনি আগে। আহা আমাদের পৃথিবীটাও এমন হত যদি। পৃথিবী বলতেই মনে পড়ে গেল, মা এর কথা। অমনি আমার মন খারাপ করতে লাগলো খুব। বৃষ্টি ভালো লাগে না, গান ভালো লাগে না, নদীতে ঝাঁপাই জুড়তে ভালো লাগেনা। খালি কান্না পায়। 
আমার বন্ধুরা ডেকে ডেকে সাড়া পায়না। শেষে একদিন লটপট টেনে নিয়ে গেল বুড়ো বটের কাছে। বটদাদা আমায় আদর করে ডেকে নিল ঝুরির মাঝে।

- মাকে মনে পড়ছে? 

- হুঁ।

- এখানে আত আলো,  এত গান তাও ভালো লাগছে না?

- না আমি বাড়ি যাব।

- আচ্ছা বেশ। তুই এত ভালো তোর মন খারাপ হলে আমাদের সবার কষ্ট হয় তো। তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। কখনো যদি খুব কষ্ট হয় অস্থির লাগে আমায় বলিস নিয়ে আসবো। 

- তোমায় বলব কি করে? ওখানে তো তোমাদের দেখাই যায়না! 

- দেখার দরকার নেই তো। আয়, তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি। 

বটদাদা শিখিয়ে দিয়েছে আমায়। আসার আগে বন্ধুদের জন্যে কষ্ট হচ্ছিল খুবই, তবে আনন্দও হচ্ছিল, মাকে দেখবো বলে। বটদাদাই আমায় পৌঁছে দিল কেমন করে যেন।  যেইখানে বসেছিলাম সেই খানে।  কতদিন কেটে গেছে এর মাঝে কে জানে। আমি এ কদিনেই অনেক বড় হয়ে গেছি। আমি জানি আমি কী পারি। আমি আনন্দে থাকতে জানি এখন থেকে। গাছেদের সাথে কথা বলা শিখে গেছি,  দুঃখ হলেই বলে দিতে পারি তাদের। পালাবোনা আর। এরাই আসলে বাঁচতে জানেনা। আমি জানি, আমি বড় হলে নদীর পাড়ে একটা ঘর বানাবো, গাছে ঘেরা। আমার মত আরো অনেক হেরে যাওয়া দুঃখী অপদার্থ ভুটেকে শিখিয়ে দেব। ওই দুনিয়া থেকে লটপট বেড়াতে আসলে তাকে দেখাবো তার বন্ধু তাকে ভোলেনি, তার জন্যে জায়গা বানিয়ে দিয়েছে এখানে।