Tuesday, December 26, 2017

নবাবখানায় নবাবি (শেষ পর্ব)


(আগের পর্বের পর অনেকটাই দেরী হলো ক্ষমা করে দেবেন যারা পড়েছেন। আগের পর্ব এখানে রইলো যদি কেউ মনে করতে চায় 
নবাবখানায় নবাবি)


কাবাব পরোটা খেয়ে মন ঠান্ডা করে আমরা ভাবতে লাগলাম কোথায় যাওয়া যায়। অল্প করে খেয়েছি, মানে রাতে প্ল্যান আছে লাল্লার বিরিয়ানি খাবার, সেটাও ভাবতে হবে। লাল্লা হলো একমাত্র হিন্দু যে , সে সময় মুসলমান সুদক্ষ বাবুর্চির সাথে টক্কর দিয়ে বিরিয়ানি বানিয়েছিলো, অবান্তর থেকে জেনেছি এটা অবশ্য, আর এর রেটিং রিভিউও গুগল করে যা দেখেছি অসাধারণ।  রেসিডেন্সি যাওয়া যায় কিন্তু আমরা খানিক টায়ার্ড, রেসিডেন্সি ঘোরার এনার্জি তেমন হবে না। তাই ভাবলাম ছত্তর মঞ্জিল বলে একটা দেখার জিনিস দেখাচ্ছে গুগলে সেটা দেখি, তারপর গোমতীর তীরে বসে কান চুলকাই খানিক। খেয়ে দেয়ে অবশ্যই হাঁটতে হয়, নইলে লাল্লার বিরিয়ানি পেটে ঢোকার জায়গা পায়না, লখনৌ এর গলি রাস্তা দেখা যায়না। সুতরাং আমরা আড্ডা মারতে মারতে আমিনাবাদ থেকে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, জমজমাট অঞ্চল।  কচুরি, চাট ,জুতো পালিশ, টোটো, গোবর, ত্রিমুখী ট্রাফিক ও মানুষ সব মিলিয়ে বেশ হন্ডুরাস ব্যাপার। সফেদ বেরাদরি বন্ধ ,রিনোভেশন চলছে। ছত্তর মঞ্জিলের খোঁজ কেউই বলতে পারছে না। পুলিশ না, উকিল না, চা ওলা না, সাইকেল আরোহী না। শেষে জুতোপালিশের আসরে মজিলিসি বুড়ো বলে দিলো। ছত্তর মঞ্জিলের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে যখন চনমন করছি কোনটা আসলে ছাতার মঞ্জিল রে বাবা, একজন লোক বলে দিলো, 'ছত্তর মঞ্জিল তো এহি হ্যায়, দরোয়াজা উস তরফ যাইয়ে মিল যায়েগা'। যাক!


আমরা গুটি গুটি এগিয়ে দেখলাম হ্যাঁ লেখা আছে বটে। কিন্তু দরজা জানলা সব বন্ধ কেন? কেউ আসেনা? আমাদের ট্রেসপাসিং এর চার্জ দেবে নাকি? দুজন সিকিউরিটি গার্ড বসে ছিলো, বললাম ভিতরে যাওয়া যাবে না? জানালো রিনোভেশন চলছে, কিন্তু আমাদের বলল চাইলে আমরা যেতে পারি তবে সাপখোপ থাকতে পারে। আমরা তার পরেও যাবো স্বাভাবিক। পিছন দিয়ে একটা দরজা খোলা খালি। জনমানবশূন্য, পড়ে থাকা একটা টিনের উপর মচমচ শব্দ করে তিন মক্কেল ঢুকলাম। বিরাট একটা ঘর, শব্দহীন। ঘরের মধ্যে দিয়েই সিঁড়ি উঠে গেছে, আমরা উঠলাম এক এক করে। এখানে বোধহয় ওষুধের ল্যাবরেটরি ছিলো, ওষুধ ওষুধ গন্ধ। সরু গলি ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, ধুলোর উপর পা এর ছাপ এঁকে। কত নবাবের হাতে পড়েছে এ বিল্ডিংখানা, শুরু হয়েছিলো নবাব গাজিউদ্দিন হায়দারকে দিয়ে তার ছেলে নাসিরুদ্দিন হায়দার শেষ করে কিন্তু ব্যবহার সাদাত আলি খান থেকে আমাদের ওয়াজিদ আলি শাহ সকলেই করেছে। কোনো এক ঘরে হয়ত এমন দুপুরে জোরদার তাস পাশার দান বসতো বা দোতলার এদিকটা হয়ত চাকবাকরদের আড্ডার জায়গা ছিলো কে জানে। এরকম কোনো এক দুপুরে নবাবের কোনো দাস দাসী এই বারান্দা পাশ এর ঘুপচিতে দাঁড়িয়ে প্রেম করতো। ফিসফিস হাসির আওয়াজ যেন এক্ষুনি শোনা যাবে ওই মোড়টা ফিরলেই। কাল ভুলভুলাইয়াতে নবাব বেগম দের সাথে ফেলুদাও ছিলো,  কিন্তু এই ছত্তর মঞ্জিল যা এখন প্রায় পোড়ো বাড়ি, কোন ওষুধের পরীক্ষাগার হয়ে পড়েছিলো এখানে সেই সব ইতিহাসের পাতায় না আসা সব লোকজন যেন চলে এসেছে। বাড়িটা যেন ভারী দুঃখী হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে,  আমরা চাইলে সে এক্ষুনি সে গল্প শোনাবে।

কিন্তু আমরা তিনটে যুবক গেছি, আমাদের সে ইতিহাসে কান পাতার থেকে নতুন কিছু খোঁজ বেশী পাত্তা পাবে স্বাভাবিক। আমরা এদিক সেদিক ঘুরে একটু চেষ্টা করলাম পৌঁছতে ওই ছাতার মতো অংশে যার কারনে এ বাড়ির এমন নাম। গোলকধাঁধা টাইপ বাড়ি হতো কিনা আগেকার দিনে,  নবাবি হাভেলিতে আমরা খুঁজে পাইনি সে ছাতার মাথা। কিন্তু মন টন ভারী অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিলো, উদাস, কেমন একটা। শেষে বেরিয়ে এলাম।  এলোমেলো কথা বলে বলে হেঁটে চললাম গোমতীর দিকে।

গোমতীর ধারে যাবার জন্য যাকেই জিজ্ঞেস করি বলে এই তো সামনে গেলেই। তা যাওয়া যাক সামনে। তখন আমরা বড়ই ক্লান্ত। অনেক্ষণ হাঁটার পর দেখি গোমতী নদীর ধার। সত্যি বলতে আমরা খুবই হতাশ, আসলে একটা খালও বলা যায় তাকে। হতাশায় রাগ হবার থেকে হাসি কেন জানি বেশী পায়, বন্ধুরা থাকলে। আমরাও খানিক হাসলাম। একটা বাঁদর জল খাচ্ছে দেখি একটা বাড়ির ছাদে ট্যাঙ্কএর মধ্যে মুখ ডুবিয়ে। দেখে আমাদেরও তেষ্টা পেয়ে গেলো। ওখান থেকে কান চুল্কানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তন চক মোড়ে হাজির হলাম। এখানে একটা পার্ক আছে, বেগম হজরত মহল পার্ক। তা সেখানে গিয়ে একটু জিরোবো ভেবে ঢুকতে যাবো সে দেখি তার ঢোকার মুখ পৌঁছতে একগাদা হাঁটতে হবে! আর হাঁটবোনা ব্যাস! হজরত বিবি মহাল চোখে থাক আমার পদধূলি না পড়াই ভালো বিবেচনা করে অটো ধরা গেলো । চৌক যাবো। ওখানেই থাকবো ঠিক করেছি ।

 মালাই লস্যির দোকান দেখে এতোক্ষনের গোমতি খাল, হন্টন হতাশা সব বেরোনোর পথ পেয়ে গেলো আমরা দোকানে ঢুকে গেলাম । মালাই লস্যি , কুলফি খেয়ে মন প্রান একটু জুড়িয়ে হোটেল খুঁজতে বেরোনো । আমাদের এবারের ঘোরা সে কলেজ টাইপ ঘোরা , অর্থাৎ ঝকঝকে হোটেল তকতকে বাহন এসব না , মিনিমাম ভাড়ায় বডি ফেলার জায়গা পাবো যেখানে সেখানেই ঢুকবো । তাই এক দুটো ধর্মশালা দেখে সে গুলোতেও ট্রাই মারা গেলো । ধর্মশালায় সত্যি বলতে থাকিনি কখনো , যাই হোক এবারেও সে ইচ্ছে পুরন হলো না , জায়গা নেই । আরেক জায়গায় গেলাম , মোটামুটি সস্তার হোটেল কিন্তু তারা ডাবল বেড্রুম তিনজনকে দেবে না , সমু হেভভি খচে মচে বলল আমরা গুঁতিয়ে টুঁতিয়ে থেকে গেলে আপনাদের কি মশাই , তা তেনারা পাত্তা দিলেন না অবশ্য অগত্যা আরো একশো টাকা বেশী খচ্চা করে তিনজনের থাকার ঘরটাই নেওয়া হলো । আমি আর সৌরভ খানিক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । উঠে দেখি পৌনে সাতটা , আরে চল চল লাল্লা তো বন্ধ হয়ে যাবে।





লখনৌ চৌকের বিখ্যাত গলি , আলো ঝলমলে গলির শুরুতে হরেকরকম মিষ্টির দোকান , জামা কাপড়ের দোকান , ছোট্ট খাট্টো স্টেশনারি গুডস এর দোকান  সবরকম আছে । ঠেলা গাড়ির ভীড়ও আছে সে গলিতে । গলি ধরে এগোতে থাকলে ক্রমে হইহট্টগোল কমে আসে , দু পাশের মিষ্টির দোকানের চাকচিক্য কমে যায়  কিন্তু টাটকা ভাবটা কমে না , খুপরি ঘরে বসে উকো ঘসে চশমা আঁটা বুড়ো । রাস্তার দিকে নজর করে চলতে গেলে গোবর এড়ানো যায় কিন্তু তাহলে আবার দু পাশের হরেক জিনিস নজর এড়িয়ে যায় । এ বড় সমস্যার , রাস্তায় নজর দিয়ে সাবধানে এগোতে চাও নাকি মন ভরিয়ে চোখ জুড়িয়ে যেতে চাও উপভোগ করতে করতে । প্রথমটায় তুমি নিরাপদে পৌঁছবে দ্বিতীয়তে কাদা মেখে কিন্তু ক্লান্তি এড়িয়ে । আমি দুইয়েই নজর রাখছিলাম ফলে খুব তাড়াতাড়ি এগোনো যাচ্ছিলো না । হঠাৎ দেখি রাস্তা একটু নীচু , আর নর্দমা ছাপানো জল , আশেপাশে বাড়ি এখন , দোকান পাট নেই খুব , অতি সাবধানে লাফ মেরে মেরে নর্দমার জল পার করে , একটা চলন্ত গরুকে কাটিয়ে অবশেষে মেন রোডে ওঠা গেলো । একজঙ্কে জিহজ্ঞেস করে রাস্তা কনফার্ম করে নিলাম , সে সাথে এটাও বলে দিলো , "জলদি যাইয়ে জনাব ও তো খতম হো যাতা হ্যায় । হাঁ বানাতা লেকিন বড়িয়া" । শুনে উৎসাহে টগবগিয়ে স্পীড বাড়িয়ে দিলাম । এই তো লাল্লা । কি আছে ? শামী কাবাব , মাটন কোর্মা , মাটন বিরিয়ানি নেওয়া গেলো । অপেক্ষা অপেক্ষা । এইতো । 

এক চামচ মুখে তুলেই ......আমাদের এতক্ষনের সব উৎসাহ, লাফালাফির  বেলুন চুপসে গেলো । এটা কি দিয়েছে রে ভাই । এরই এতো নাম!! কি খারাপ খেতে কি বলব আর! ডালডা মেরেছে বিরিয়ানিতে একগাদা , স্বাদও অতি খারাপ , শামী কাবাবে ছোলার ডালটাই দিয়েছে , মাটনের কুচো দিতে ভুলে গেছে , মাটন কোর্মা আসলে জিরের ঝোল । আমরা স্তব্ধ, সৌরভ অধিক শোকে পাথর । ও আবার খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বড়ই সেন্সেটিভ , খারাপ বিরিয়ানি দিলে ওর কাছে ধর্ম অবমাননা হয় । আমি আর সমুও হতাশ বটে তবে আমরা এ ব্যাপারে অত চাপাতি টাইপ না , সৌরভের থম্থমে মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছি দুজন । বললাম চল একটু রাবড়ি খেয়ে নিই রাস্তার দোকান থেকে , আর কিই বা খারাপ হবে আজ এর থেকে । নাম করা দোকানের থেকে তো বেশী হতাশ করবে না । সৌরভ জানিয়ে দিলো সে কিচ্ছু খাবে না , স্রেফ কোল্ডড্রিংস খাবে , সমু বলল তা রাতে তো খিদে পেয়ে যাবে এক ছড়া কলা কিনে নিই নাকি?
নেহাত লখনৌতে আজকাল আর পিস্তল তলোয়ার, সুলভ না , তাই সমু এ যাত্রায় বেঁচে গেলো আর কি । তো পরের দিন সকালে তো তারিনীখুড়োর সেই বিখ্যাত দিলখুশা প্যালেসে যাবোই , আমি বললাম , তা ওখানেই ডুয়েলটা হয়ে যাবে নাকি? আর  ইয়ে আম্পায়ার আমিও আছি , ক্যামেরাটাই না হয় বাজি হবে? এই সব কথা বলতে বলতেই রাবড়ি নিয়ে নিয়েছি ,সৌরভও ।রাবড়ি মুখে দিয়ে মন মেজাজ সত্যিই ভালো হয়ে গেলো । আহাহা কি  বানিয়েছে হে , হ্যাঁ এতো দেবভোগ্য জিনিস । পেট ঠুসে খেয়ে দেখি রাবড়ির পাশেই আরেকটা কি যেন আছে , সেটা আর তিনটে না নিয়ে একটাই নিলাম, মানুষের পেট তো!
কি বলব আর দিনটাই খুব গোলমেলে , মানে সন্ধ্যেটা , মালাইটা আসলে মিষ্টি কম একটা জিনিস । হতাশার বালুচরে একা একা আজো গান গাই ইত্যাদি ...

সকাল বেলা উঠে  দেখি ও দু মক্কেল উঠে কুস্তি করছে! হ্যাঁ রে ভাই ডুয়েলটা দিলখুশায় লড়লে কেমন হয়? । লখনৌ নবাবি মেজাজে চলে বোঝা গেলো । সক্কাল সাতটায় কোনো দোকানই খোলা নেই , একটু চা না পেলে মন টন ভাড়ি সুড়সুড় করতে থাকে । তা সোজা দিলখুশা যাবার অটো পাওয়া যায়না চৌক থেকে , পাওয়া যায় হজরতগঞ্জ অব্দি ,ওখান থেকে ফের যেতে হয় । তা হজরতগঞ্জ যাবার অটোও পাওয়া যাচ্ছে না মাইরি ! মানে সবাই বলছে আগে সে আগে সে , কি রে ভাই আগে যেতে যেতে তো হজরতগঞ্জই পৌঁছে যাবো!
কিরকম যেন আমাদের খান্না টাইপ জায়গাটা , এক কাপ অতি অখাদ্য চা খেয়ে যাওয়া হজরতগঞ্জ এর অটোয় ওঠা গেলো । ওখান থেকে নেমে গুগল ম্যাপ বলছে আর তিন কিলোমিটার , তা হাঁটাই যায় , এরকম মন নিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে খেতে খেতে এগোচ্ছি ...একটা অটো খুব দেখি বলছে কোথায় যাবে কোথায় যাবে ? বলা হলো...অস্বাভাবিক দরাদরিতে অটোওলা খুব নিমরাজী হয়ে রাজী হলো ।

আর্মি এলাকা, অটোওলাও ভালো জানে না এই দিলখুশা  বাগটা কোথায় । এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে সে হাওয়া। চারিদিকে প্রচুর গাছ , লোক টক নেই , তার মধ্যেই একজন মর্নিং ওয়াকে বেরোনো লোককে ধরে দিক নির্দেশ পেয়ে এগোচ্ছি । 


রোব্বারের সকাল দেখি ক্যাম্প খাট পেতে এক আর্মি অফিসার বসে আছে আরাম করে আর দুই অধস্তন ছোট্ট স্টল মতো করে চা বানানোর তোড়জোড় করছে । ওনাকে জিজ্ঞেস করতে বলে আরে জনাব ইয়ে পুরা রোডই তো দিলখুশা হ্যায় আপকো জানা কাঁহা হ্যায়? ইত্না সারা প্যালেস হ্যায় কিসি এক কোঁ পসন্দ কর লো না। যাই হোক  যাঁরা চা বানাচ্ছিলো তাড়াতাড়ি বলল হ্যাঁ আছে বটে একখান ওইযে ওইটে ।







এখানে নবাবরা আগে শিকার করতো , মানে এই মহলে থাকতো আর এর পেয়াদারা তাড়া দিয়ে নিয়ে আসতো আরকি শিকারদের। এখন অবশ্য লোকে ব্যায়াম করে এখানে । ভাবার চেষ্টা করছিলাম ঠিক কোন জায়গাটা সেই ডুয়েল হয়েছিলো?  কিচির মিচির করে পাখির ডাকে সেই ছমছমে পরিবেশটা ঠিক আসছিলো না অবশ্য। তবে ভালো লাগছিলো বেশ । চারিদিকে গাছপালা , পাখি , রোদ ...একটা দুটো লোক হুহুম না হুহুম্না করে ইঁট ফিট নিয়ে ব্যায়াম করছে । পুরোনো প্যালেসের নকশা, ভেঙে যাওয়া থাম ...ওদিকে এক ঝাঁক টিয়া আলোচনা সভা বসিয়েছে , কিরে আজ কোথায় ভালো ফল টল দেখলি , এই মানুষ গুলোর মাথায় কি কিচ্ছু নেই যে সব ফলের গাছ কেটে রেখে দিয়েছে , যন্তন্না মশাই ।

আমরা নানান কোন থেকে ছবি তুলে ঘাস মেপে দেখারচেষ্টা করলাম , যদি ভুল করে কোনো পিস্তল বা গুপ্তধন মেলে । গুপ্তধন ঠিক না তবে একটা নতুন জিনিস জানলাম। পাখি আমি খুব কম চিনি , একটা পাখি ডাকছিলো , সমুকে জিজ্ঞেস করতে যখন বলল ওটা মেয়ে কোকিল আমি তো পুরো চমকে গিয়ে আলজিব গিলে ফেলার জোগাড় । ছেলে কোকিল মেয়ে কোকিল আলাদা দেখতে হতে পারে তাই বলে ডাক টা এমন সম্পূর্ণ আলাদা আর আমি এত কম জেনে দিব্যি বেঁচেও আছি!!।


এবার যাবো রেসিডেন্সি। রেসিডেন্সি মানেই একটা বেশ রোমাঞ্চ হয় মনের মধ্যে । সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের জবরদস্ত ধাক্কা দিয়েছিলো এই রেসিডেন্সি অধিগ্রহন করে । পারেনি শেষ অব্দি কিন্তু ফাইটটা? সেটা কম নাকি! 








রেসিডেন্সিতে খুব ভীড় কিছু না , ঝকঝকে দিন , টাঁকশাল থেকে কোনো ডাক্তার বা কর্নেলের থাকার জায়গা , বেগমদের মহাল, মসজিদ সব গুলোই দেখছি আগ্রহ নিয়ে , যেখানে বিদ্রোহীরা গোলা ছুঁড়েছিলো , তার পাশেই হার্ট সাইনে কোনো জোড়ার নাম । ঘুঘু চড়া বলে একটা কথা আছে , মানে ভিটেয় ঘুঘু চড়া মানে সেখানে আর কেউ থাকে না , সবাই ভিটেচ্যুত বা বংশ শেষ , তা এখানে মসজিদের সামনেও ঘুঘু চড়ছে দেখি এক ঝাঁক , নবাব আমল শেষ তা জানান দিতে দিতে।














অনেক গুলো কাঠবেড়ালী ব্যস্ত ভঙ্গীতে খাবার খাচ্ছে , এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেলো ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে । 



রেসিডেন্সির ইতিহাসটা খুব সুন্দর করে অবান্তরে লেখা আছে আমি ফের লিখলাম না আর কষ্ট করে । মিউজিয়ামের মধ্যে রাজাদের ছবির সাথে চোখ টানে রানী হজরত মহল এর ছবি । সতেরশো সাতান্ন-আটান্ন সালে এক মহিলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছে , যুদ্ধ করছে , হেরে গিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক দেশে পালিয়ে যাচ্ছে এ অবাক করে বইকি ।
 অস্ত্র শস্ত্র দেখা গেলো না , রিনোভেশন এর কল্যানে বন্ধ । 


আমাদের খিদে খিদে পেয়েছে , কাল থেকে লাল্লার শোক আমাদের ভয় দেখাচ্ছে , তবু খাচ্ছি না , দস্তরখোয়ানে বাজি রেখে বসে আছি। হজরত মহল এ ঘুর ঘুর করছি বৃষ্টি এলেন । একটু কমতে অটো বাইরে বেরিয়ে অটো ধরতেই উড়িবাপ্রে কি বৃষ্টিটাই না এলো । হজরতগঞ্জের পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি ভিজেই গেলাম প্রায় । মুখোমুখি দুইখান দোকান , অবান্তর থেকে এও জানা ছিলো , কিন্তু সে সময় লাঞ্চ টাইম শুরু হয়নি তাই বলা যাচ্ছে না কোনটা আসল । এদিক ওদিক ভেবে যেটা অরিজিনাল বলে মনে হচ্ছে সেটাতেই ঢুকে পড়লাম । বৃষ্টির কারনেই খদ্দের এর ভীড় শুরু হয়নি এখনো , চেয়ারে টেবিলে ভিজে গেঞ্জি জাঙ্গিয়া শুকোচ্ছে , উঁহু নাক কুঁচকোলে চলবে না , বাইরে এতো বৃষ্টি এরা যাবেই বা কোথায় পরবেই বা কি । বসে বসে আড্ডা মারছি আর মনে মনে ভাবছি কি জানি এরাও হয়তো খুব খারাপ বানাবে , কফিনের শেষ পেরেক । সমু বলেছে এখানে ধাক্কা খেলে সোজা নৌসিজানে চলে যাবে কিন্তু সে সময়টাই কি আর  পাবো ? যেরকম বৃষ্টি শুরু হয়েছে । এমন সময় ফোনে মেসেজ এলো সৌরভের , রোদ বেরোচ্ছে । আহা সত্যি সত্যি রোদ নাকি , মানে আমাদের কপালে কথা হচ্ছে রে বাবা । 
আমার ফেরার টিকিট কনফার্ম ছিলো না , সমুর ল্যাবে নাকি এক সেট বিছানা পাতাই থাকে সেখানে দুদিন কাটিয়ে যাবো টিকিট কনফার্ম না হলে । সঞ্জয়দাকে বলা ছিলো তাও লাল্লার হাল্লায় আমরা কোথাও কোনো ভরসা রাখতে অক্ষম । যাই হোক টিকিট কনফার্মেশনের মেসেজ ঢুকলো যা হোক। 
সে সময়েই অর্ডার নিতে এলো । আমরা দুরুদুরু বক্ষে খুবই সামান্য , মানে প্রায় কিছুই না বলা যায় এই দু প্লেট বিরিয়ানি , এক প্লেট চিকেন কালিমির্চ , এক প্লেট বটি কাবাব অর্ডার দিয়ে ভারত পাকিস্থান ম্যাচের ফাইনাল দেখার উত্তেজনা নিয়ে বসে আছি । 

ওয়েটার কাকা প্লেট সাজিয়ে গেলো । চিকেন কালিমির্চে থাবা বসালাম ......এবং এবং আহা আহা হামিনস্ত । ভয়ানক ভালো । বিরিয়ানি টাও চমৎকার । বটি কাবাবও । ব্যাস আমরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনতা আরো চিকেন কালিমির্চ , গলৌটি কাবাব লে আও  করে বস্লাম ।


 খানা শেষে কোনো রকমে হেঁটে হেঁটে লখনৌএর শোহন হালুয়া কিনতে গেলাম । বৃষ্টি তখন থেমে গেছে , রোদ উঠেছে । আরিব্বাস রে কেজিতে করে মিষ্টি বিক্রি করে এখানে ।আচ্ছা তাই সই বলে বাড়ির জন্য প্যাক করা হলো । কিন্তু কাল যে স্বর্গীয় রাবড়ি খেয়েছিলাম আরেকবার খাবো না? লখনৌ ছাড়ার আগে? নামী দোকানে খাইনি তাই গলি দোকান খুঁজতে খুঁজতে চললাম বাস স্ট্যান্ডের আশে পাশে । গলির পর গলি পেরোচ্ছি , হরেকরকম দোকান , মিষ্টির বেশী , সবাই বলছে রাবড়ি আগে যাও আগে যাও ...এই করতে করতে এক দোকান পাওয়া গেলো । বসতেই সেকিই আপ্যায়ন । আইয়ে আইয়ে ব্যায়ঠিয়ে । বসলুম । খাতিরদারি আরো দেখাতে জল দিয়ে গেলো। জল দিয়ে গেলো মগে করে!!! 

মগ মানে চান করার বা ইয়ে করে জল দেওয়ার মগ । তা ওঁয়ারা থেকে এনেছিলেন সে মগ আমি জানিনা অবশ্য । মুখ চাওয়াচায়ি করছি , হাসাটা খুব অভদ্রতা হবে ভেবে চেপে চুপে বসে আছি । রাবড়ি খেয়ে বেরিয়ে আসার সময় বসে এলাম পানিকা ডাব্বা বড়িয়া থা জি ।

এবার ফেরার পালা । বাস ধরে কানপুর , ওখান থেকে রাজধানী । বাস এলো । এই বাসটা সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার । সিপাহিরা লাঠি চালিয়েছিলো , আর বাসের সামনের কাচটা ভেঙে নেই হয়ে গেলো । তা অত খুঁতখুঁত কিসের তোমার হে? দিব্যি ওপেন এয়ার  বাহন , ফ্রেশ বৃষ্টি ভেজা বাতাশ খেতে খেতে যাও না । সুতরাং আমরা সেই বাসেই চড়ে বসলাম । সামনের উন্মুক্ত বাতায়ন মাঝে মাঝেই কাছের গুঁড়ো ফ্রি দিচ্ছে । 





লখনৌ শহরটা যেন অনেকটা বাউলের আলখাল্লা ,  কোথাও  ছেঁড়া  কোথাও ফুটো , ইতিহাসের তাপ্পি পড়েছেছে  এলোমেলো আর এরই মাঝে একটা একটা আবহমান গান যেন সে আলখাল্লা বয়ে নিয়ে চলেছে। ফের আয়েঙ্গে জনাব , রাবড়ি খাবো , দিলখুশায় বসে টিয়াপাখি দেখবো , ভুল্ভুলাইয়াতে হারাবো , দস্তরখোয়ানের খাবারে মজব , আড্ডা দেবো রাস্তায় , আসব আবার ঠিক ।