Monday, November 23, 2020

হাওয়া বদল

 রানীগঞ্জ এসেছি কদিন হলো। আমার ওয়ার্কস্টেশন সমেত। পুরো সপ্তাহটা এখান থেকেই কাজ করে ফিরবো। যাইহোক,তো কেমন মনে হচ্ছে শীতের শুরুতে পশ্চিমে হাওয়া বদল করতে এসেছি আমরা! শনিবার এসে বিকেলে বাজার থেকে টুকিটাকি সব জিনিস যেমন দড়ি, তালা, মগ, শুকনো লংকা এসব এনেছি।নরম রোদে সকাল হয় একটু দেরীতে,কিচিরমিচির পাখির ডাকে। বারান্দায় চেয়ার পেতে চা খাই, একটা লোক হরেক রকম মাছ এনে বিক্রী করে যায়,এক দুটো প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় সকালে নরম রোদে ডানায় ঝিলিক তুলে। শুকনো পাতার রাশিতে মচমচ আওয়াজ করে কাজের মেয়েটি, শিবানী, আসে। ওরা তিন বোন এক ভাই, সবার নামই ঠাকুর দেবতার নামে। বোকাসোকা আছে খানিক, নিজের মনে ঘুরে ঘুরে কাজ করে,  চা নিয়ে আরাম করে বসে পাঁউরুটি ডুবিয়ে চা খায়। সকালে রোদের ওম নিয়ে তাজা হয়ে বেরিয়ে টুকটাক বাজার আনি,তারপর কাজে বসি। রান্নাঘর থেকে ছোঁকছাঁক আওয়াজ আসে। গতকাল বিকেলে দামোদরের চরে গেছিলাম। দ্বারকনাথ ঠাকুরের বানানো কার এন্ড টেগোর কোম্পানির জেটির ভগ্নাবশেষ আর মন্দির ডানদিকে, আমরা ভুল করে বাঁদিকে শ্মশানে পৌঁছে গেছিলাম। শেষ বিকেলের গোলাপী আলোয় চিতার ধোঁয়া মিশে যাচ্ছিল। ছায়াছায়া অন্ধকার নেমে আসছিলো চারদিক জুড়ে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি অষ্টমীর চাঁদ উঠেছে চমৎকার। কোয়ার্টারটা একদম লাস্ট বাড়ি, তারপর ঝোপঝাড় গাছপালা। এই বাড়িটায় আমরা  ছাড়া আর কেউ থাকেওনা। মূলতঃ শিফটিং করতেই এসেছি আমরা। কারন বাড়িরটার ভগ্নদশা। দেওয়াল ফুঁড়ে গাছের শিকড়, বর্ষাকালে ড্যাম্প দিয়ে জল আসে।  অন্যবাড়িটার আশেপাশে লোক থাকে ভালোই হবার কথা।তাও আমাদের মন খারাপ করে বাড়িটার জন্য, সামনের আমগাছে শুয়ে থাকা কাঠবিড়ালিটার জন্য, পাশের ঝাউগাছটায় যেটায় হাওয়া দিলে শোঁ শোঁ আওয়াজ হয় সেটার জন্য, এই নির্জনতাটার জন্য।ওই বাড়িটাকে সাফসুতরো করে মুভ করাটায় নানান অছিলায় ডিলে হয়ে চলে। এখানে বাজার হাটে দেহাতি বা ব্যবসায়ী লোকেদের ভীড়। বাড়িগুলো অদ্ভুত শ্রীহীন। নীচে গুদাম উপরে বাস। পাকা দোতলা তিনতলা বাড়ি কিন্তু দেখতে কেমন যেন। ঘর দিয়ে বাড়িতে ঢোকার পর উঠোন। আর দেহাতি বস্তিটা আর পাঁচটা গরীব বস্তির মতোই, শুয়োর ঘোরাঘুরি করা।  

ফল দারুণ মেলে এখানে, স্টীলের জিনিসও খুব। রাস্তা দিয়ে সকালবেলা সেদিন যাচ্ছিলাম যখন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে ফুচকা, চাটের ঠেলা নিয়ে লোক বসে খোলা ড্রেনের সামনে। সকাল নটায় দিব্যি ফুচকা চাট খাচ্ছে লোকে। অবশ্য আমি ব্রেকফাস্টে চপ মুড়ি খাই আরাম করে গ্রামের বাড়ি গেলে। মাস্ক টাস্কের বালাই নেই কারো। আখ খাচ্ছে কটা ছোট ছেলে মেয়ে। এই রাস্তাটার নাম রাহুল সাংকৃত্যায়ন মার্গ! শূয়োত ঘোরা এ রাস্তাটায় এ নাম কে কী কেন কেউ জানেও না।  ভাবে হয়তো বড় কোনো পলিটিশয়ান ছিলো! দুপুরবেলা বাজার এলাকাটা তারে তারে জড়িয়ে যাওয়া জটের চেহারা নেয়। অজস্র টোটো, সাইকেল, বাইক, স্কুটি মানুষ ঠেলা আর মশলার গন্ধে একটা ঘূর্ণী তৈরী হয়। 


কোলকাতার আমার রাস্তার ধারের বাড়ির কোলাহল হঠাৎ যেন এক চুমুকে কেউ টেনে নিয়েছে এ বাড়িতে। সন্ধ্যে নামলেই ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসে। দূর থেকে মালগাড়ি কিংবা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের হুইসেল। দুপুর গড়ালেই শীতের বেলা ফুরোনো টের পাওয়া যায়, যদিও শীত এখনো আরামদায়ক এখানে। একটা জিনিস খেয়াল করেছি, সরকারি কোয়ার্টারে আলো খানিক মিইয়ে থাকে। যত জোরালো আলোই লাগাও না কেন। সেই মিয়োনো আলোয় দূর থেকে দেহাতি গান ভেসে আসে। সে গান যেমন একঘেয়ে যেমন বেসুরো। যারা এ গান শুনে বড় হবে তারা গান মানে বন্দুকের নলই ভাববে!রাতে কখনো বারান্দায় গেলে ঠান্ডা বাতাস ঝকঝকে আধফালি চাঁদের আলো নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে ধরে।  ঘুম নেমে আসে আমগাছের ডালে, কার্ণিশে,  ড্যাম্প ধরা দেওয়ালে, কম্বলের ওমে।





Saturday, November 7, 2020

কোজাগরী

 কোজাগরী, কে জাগরী...কেউ জেগে আছে কিনা দেখতে একটা মেয়ে সবার দোরে দোরে ফিরছে, এই ঘোর অমানিশায় জ্ঞান বিদ্যা শক্তি দৃঢ়তা নিয়ে কেউ জেগে আছে কিনা জানতে....এতো শক্ত শক্ত কথা অবশ্য বুঝতাম না কিছুই। লক্ষ্মীপুজো মানে হিম হিম রাতে ম্যাড়মেড়ে পুজো। ঢাক ঘন্টা কিচ্ছুর আওয়াজ হবে না,  হিম লেগে যাবার ভয়ে  জ্যোৎস্নায় ধোয়া পৃথিবী দেখা হয়নি আমার চৌহুদ্দির বাইরে। তারপর কবে থেকে কে জানে চাঁদ দেখতে পেলাম আর নেশা লেগে গেল। গোল্লামতো চাঁদটা উঠলে ঘরে থাকলেই আমার ভারী আপশোষ হয়, একটা চাঁদের আলো মাখা রাত নষ্ট হয়ে গেলো, জলের ধারে, ফাঁকা মাঠে, পাহাড়ে না হলে তো আলো মাখা যায় না। ছাদে উঠে দেখেছি হাজারটা আলোর মাঝে মন খারাপ করে চাঁদ সরে থাকে সে আলো মাখা যায়না। তাছাড়া ছাদ থেকে চাঁদের আলোয় বা বৃষ্টির জলে ভেজা আমার পোষায় না তেমন। লক্ষ্মীপুজো বলতে সবার খিচুড়ি আর নাড়ু মনে হয় কিংবা আলপনা, আমার কাছে আরেকটা চাঁদের দিন। অনেকদিন থেকে তাক করেছি কোজাগরী চাঁদের আলোয় ভিক্টোরিয়া কেমন দেখায়। সত্যিকারের পরীরা নেমে আসে কি?  কিংবা কে জেগে আছে খোঁজ নেওয়া মেয়েটা পেঁচা নিয়ে ঘুরে যায় বন্দী পরীর কাছে। পরীদের অমন দেখা যায়না সে কথা বুঝি ভুলে গেছিলাম।  তাই রেড রোড দিয়ে আর আর পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার দিয়ে খুব খানিক চক্কর কেটে গাছের ফাঁক দিয়ে ভিক্টোরিয়া দেখা গেলো,  কিন্তু চাঁদের আলো তেমন মাখা হলনা। সারা শহরের হাসপাতাল বাদে সব আলো বন্ধ করে রাখা উচিত মশাই পূর্নিমার রাতে। পাঁচবার পাক খাবার পর আশপাশের ভূতগুলো অব্দি সন্দেহজনক ভাবে তাকাচ্ছে দেখে পালিয়ে এক বন্ধুর বাড়ি খুব কড়া নেড়ে নেড়ে পালিয়ে এসেছি। পরে বলে দেবোখন আমার পোষা ভূতেরা করছিল।


লক্ষীপুজোর রাত পার হয়ে যায়, চাঁদ ক্ষইতে শুরু করে আর ফস করে হাওয়াটা কেমন বদলে যায়। শীতকাল অত ভালো না যে যাই বলুক। হ্যাঁ মটরশুঁটির কচুরি মেলে,  নলেন গুড়, পিঠে মোয়া কিন্তু তাও গরমকালের একটা আলাদা কেত আছে, অমন গুটিশুটি মেরে থাকে না। তাছাড়া এই হাওয়াটায় বাড়িতে বসে থাকা আরো খারাপ। এই সময়ের দুপুরবেলা হেঁটে কিংবা গাড়িতে কিংবা যাতে ইচ্ছে যেখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়। নৌকায় করে অজানা কোনো গঞ্জ, ভটভটি চড়ে ধূলো খাওয়া বিকেল।


আমার যে আর এই হিসেব কিতাব করতে মন চায় না,  মনের মধ্যে কে জেগে আছো ডাক আসে বার বার...ফস করে চলে যাওয়া আর হয় না...