Tuesday, December 25, 2018

এদিক সেদিক

বারবিকিউতে পয়সা তোলার জন্য মনের জোরে পেটকে বস্তার মত করে গিলেছি। ভিখিরিপনা বলতে পারেন, কিন্তু মহারাজদের ওইরকমই নিয়ম। মাঝে এলিয়ে পড়েছিলাম, নাভিশ্বাস উঠে গেছে ভেবে ওয়েটাররা সাবান জল এনেদিল, আহা হাত ধোবার জন্য না, খেয়ে বমি করার জন্য। তা বমি করে খেলেও হয় ভাবতে ভাবতেই আরো খানিক খেয়ে নিয়েছি। পাশের টেবিলে লোক বদল হল, আমি আর উঠিনা...শেষে কিরকম কড়া চোখে দেখতে লাগলো যখন আমায় ওয়েটাররা, আর আমারও ভুঁড়ি যখন থুতনি বেয়ে এসে টেবিলে পড়ব পড়ব হলো আমিও উঠে পড়লাম।

যাই হোক এত খেয়ে কোনোরকমে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ারেস্ট কোথায় বিনা পয়সায় গা এলানো যায় দেখলাম। তা ময়দানটাই বেস্ট এ আর বলার কি! কিন্তু ময়দানে ঢোকার আগে দেখি একটা দরজা হাফ খোলা, বড়লোকদের বাগানওলা বাড়ির মত। আমি ভুঁড়ি নিয়ে ঢুকবো কিনা ভাবছি, আটকে গেলে টানাটানিতে লাগবে খুব। দোনোমনা করে ঢুকিই গেলুম। আরিব্বাপ্রে একটা সাজানো গোছানো পার্ক তো! মাঠে ঘুমোলে মেরে তাড়াবে নাকি?

এখানে লোকে প্রেম করতে আসে। একা শুলে মারবে এমন না নিশ্চয়ই? ভারী নিঃঝুম দুপুর এখন চারদিক। শীতের হাওয়ার টান আছে শীত নেই। আলতো রোদে পাঁচিলের ঘুপচিতে একটা কুকুর ঘুমুচ্ছে দিব্যি আরামে। ওইদিকে কতকগুলো মালী বাগান সাজাচ্ছে। নানান দিকে নানান রকম প্রেম, ওই যে কোলেকোলে প্রেম, মানে প্রেমিকাকে কোলে তুলে নিয়েছে আর কি। আর ওই যে দন্ডায়মান হয়ে গাছে ঠেস দিয়ে, স্ট্যান্ডিং প্রেম...আচ্ছা এদের পায়ে ব্যথা করে না?

সিপাহি আগে....ফরোয়ার্ড মার্চ... মানে মুখোমুখি ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে ফরোয়ার্ড ব্লক আর পিছন্দিকে হেলে গেছে দুজনেই, ব্যাকোয়ার্ড স্ট্রেচ....প্রেম করলে ব্যয়াম জানা জরুরি দেখছি রীতিমতো!

নানারকম দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। মালী এসে তাড়া দিলো, হেই ওঠো ওঠো, এটা ঘুমাবার জায়গা নাকি! লেহ্! যাকগে এমনিতেও বেলা পড়ে গেছে এরপর ঘুমোলে কানে ঠান্ডা ঢুকে যাবে। ফের রাস্তায়, হরেক কিসিমের মানুষ দিয়ে কোলকাতার বিকেলবেলা ঠাসা। একটা ট্যাক্সিওয়ালা উদাস মুখে বসে আছে। আচ্ছা অ্যাম্বাসেডর এর ডিকিতে কি নির্লিপ্ত বস্তা থাকে? সব ট্যাক্সিওয়ালা গুলোই কেমন সন্ন্যাসী ভাব নিয়ে বসে থাকে, কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই!

ঘুরতে ঘুরতে শহরে অন্যদিকটা চলে এসেছি। এখানটা ঠিক শহর না, শহরতলি। অন্ধকার নেমে আসতে ঠান্ডাও নেমে এসেছে খানিক এদিকটায়। ধোঁয়াশা আর অন্ধকারের আলোয়ান গায়ে মেখে চায়ের দোকানে দিব্যি আড্ডা বসেছে। 
"নারদ কে ছিলো জানো?"
- তুমি বলো না? 
- আগে বলো জানো কিনা। কই রে নবা, চা টা কই....

ওদিকে সব্জির বাজার জমে উঠেছে," মটরশুঁটি সত্তর টাকা? কদিন হয়নে রে তোর?"

সবজি বাজার পার করলে বুড়োটে মিষ্টির দোকান, দানাদার, রসগোল্লা আর পান্তুয়ার গামলা নিয়ে টিমটিম করে দাঁড়িয়ে। দোকানের মানানসই ভাঙা বেঞ্চ, ঘোলাটে চশমা পরা বুড়ো। পাশেই তেলেভাজার দোকান জমজমাট। দুটো বউ খুব করে ধনেপাতার বড়া ভাজছে। লোকটা হাতে হাতে চা দিচ্ছে।

রাত নামছে,কুয়াশায় মাখামাখি হিম লাগা রাত। আচ্ছা এই রকম রাতে কোলকাতার রাস্তায় পার্কে গাছেদের যে মিটিং বসে তাতে মিটিং মিনিটস বানাতে হয়? এক দুটো গাড়ি চলে যাবার আগের মুহুর্তে যে রসিকতা হয়েছিলো, গাড়ি যাবার সময় মিউট করে রেখে ফের চালু হয়?

গাছগুলো যেন বুঝতে পারে আমার বক্তব্য, মিচকি হাসলো কি?পা চালাই....

Monday, December 24, 2018

মাধুকরী

একপাশে ছোট ছোট বাড়ির মাথা দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোপ খোপ আল দিয়ে আলাদা করা মাঠ, জায়গায় জায়গায় ধান কাটা হয়ে গেছে, আর একদিকে কাদা মাটির চড় নিয়ে বয়ে চলা রায়মঙ্গল। তার বুকে একটা দুটো নৌকা কখনো কখনো।

এরকম একটা জায়গার ছবিই দেখছিলাম কবে যেন, কোন সময় জানিনা কিন্তু এই নদীর ধার এই গ্রামের ধারের রাস্তা, এই আলসে দুপুরে ছোট পুকুরে জাল টানার শব্দ এ আমি চিনি, প্রিমনিশন কিনা জানিনা কিন্তু আমাকে এখানে আসতেই হত। রবিবারের শীতের মেঘলা দিন, হিসেব কষা লোকের জন্য আদর্শ ল্যাদ রবিবার। বাজার করা স্কিপ করে দাও, খিচুড়ি খাও শীতের ফুলকপি দিয়ে আর গায়ে কম্বল চাপিয়ে একঘুম। কিন্তু ঋকানন্দের যে ঘরে সয় না, বুকের মধ্যে ছটফট নদীর সাথে থাকতেই হবে, বেরোতেই হবে। তাই এই বেরিয়ে পড়া। কোথায় যাচ্ছি সঠিক জেনে বেরোইনি, সায়েন্স সিটির পাশের রাস্তা ধরে টাকি থেকে ফিরেছিলাম যেদিন সেদিনই ঠিক করেছিলাম, ওই গাছ পালা ছাওয়া চমৎকার রাস্তাটা ধরে আরো অনেক খানি আমায় যেতে হবে। নদীর কাছে।

রাস্তাটা সত্যিই বড় ভালো, মসৃন পিচ, দুইধারে গাছের পাঁচিল। একদিক দিয়ে একটা খাল বইছে, খালের ওদিকে কলাবাগান। এগোতে এগোতে ক্রমে রাস্তার দুধার বদলায়। ফুলকপি, সর্ষেবোনা চাষের ক্ষেত, পেরিয়ে এখন খালি ভেড়ির জল। একটা লোক সাদা পাউডার এর মত কী যেন ছড়াচ্ছে জলে। ওদিকের ভেড়িতে একটা লোক নৌকা ঠেলছে নিজে জলে দাঁড়িয়ে। আমার এইরকম হুটহাট বেরোনোয় গন্তব্যর থেকে রাস্তা জরুরী থাকে। এই বিস্তীর্ণ আকাশ, বিস্তীর্ণ জলাভূমির মাঝখান দিয়ে কালো চকচকে রাস্তা ধরে ছুটে চলায় যেমন আনন্দ হয়, তেমনই হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়তেই যেন আনন্দ। আমার তো সব সময়েই তাই। ছুটতে ছুটতে ছুটতে যখন ফিনিশিং লাইনের মুখে আমার আর খেলতে ভালোলাগেনা, ইচ্ছে করে আমার স্বপ্নের সেই জায়গাটা, একটা বটগাছের কোলে, নদীর ধারে আমার আস্তানায় বসে থাকবো। জানি ও আমার সইবে না বেশীক্ষন। নিস্তরঙ্গ একটানা জীবন ভালোলাগলে রবিবারের সকালে রাস্তায় থাকতাম না।

কোথা থেকে কোথায় চলে গেছি। আসলে এ সেই অর্থে ভ্রমণ কাহিনী তো না। চলার গল্প। বাইরে বেশ ঠান্ডা আছে। কোলকাতা ফেলে এসেছি বোঝা যায়। রাস্তায় নানান রকম ফেস্টুন টাঙানো আছে। কেউ একজন জনপ্রতিনিধি আসবেন, তার জন্যে। নানান রকম অঞ্চল থেকে নানান রকম লোক তাকে স্বাগত জানায়;আড়ি পদবীর একজন, কাইজার নামের একজন। আচ্ছা কাইজার কী জানে তার নামের মানে? আর আড়ি বেশ ছোটবেলায় বলত, আমি আড়ি আর তার বান্ধবী বলত আমি ভাব?

এ জায়গার নাম গুলোও বেশ। ঘুষাঘাটা। কবে কারা ঘুষোঘুষি করেছিল কে জানে! মীনাখাঁ। নেমে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে মীনা খাঁ কে ছিলেন? কী করতেন? সামনে একটা মোটর ভ্যানে এক মিঁয়া চলেছেন তার কালো কাপড়ে মোড়া বিবিকে নিয়ে। ভারী যত্ন করে মাঝে মাঝে কাপড়ের তলা থেকে খাবার নিয়ে বাচ্ছাকে আর বাচ্ছার বাপকে কি যেন দিচ্ছে। আমি পাশ কাটিয়ে যাই। এলাহী মালিক লেখা বাসকে পিছনে ফেলে।

পথের সাথী বলে সরাইখানা টাইপ হয়েছে আজকাল। হিসি করতে গেছি সেখানে, দেখি থাকার জন্য বিস্তারিত নির্দেশিকা। " আমরা ভদ্র দম্পতিদের থাকতে দিই" থেকে "ম্যারেজ সার্টিফিকেট থাকা জরুরী", " একলা মহিলার প্রতি শালীন ব্যবহার করবেন"। বাপ্রে সরাইখানা না নীতিশাস্ত্রমালা। ওখানে যিনি পয়সা নিচ্ছিলেন, সেই দিদিকে জিজ্ঞেস করলাম নদী কোথায়? ধামাখালিতে? 
- হ্যাঁ। কেন? নদী খুঁজছ কেন?
- এমনিই...নদী দেখবো।
- ও। আসলে অনেকে মনে দুঃখ নিয়ে নদীতে যায়,তাই, খুঁজছ কেন জানতে চাইছি।

বোঝো! আবার! আচ্ছা আমায় দেখলে কি সুইসাইডাল মনে হয়? নাকি একা একা ঘুরে বেরাই বলেই? যাকগে। তাকে আস্বস্ত করে বেরোলাম ফের। ধামাখালীর আগে রাস্তা এখনো তৈরী হচ্ছে৷ রাস্তা বানানো দেখতেও আমার ভারী ভাল্লাগে। কিন্তু এখন তো নদী দেখবো আগে। 
ধামাখালী জায়গাটা ছোট্ট গঞ্জ মতন জায়গা। গঞ্জ শব্দটা এখন আর ব্যবহার হয়না। কিন্তু ছোটবেলা থেকে বইতে যত গঞ্জ পড়ে যেমন কল্পনা করেছি এটা তেমন জায়গা। বাস গুলো সব এসে এসে এখানেই থেমে যায়। একটা গেস্ট হাউজ আছে পর্যটন বিভাগের। তার বাগানে দুটো নধর কুকুরছানা একটা রুমাল নিয়ে খানিক উস্তুম খুস্তুম লড়াই করে নিলো। শেষ অব্দি যেমন সব বোকারা করে, রুমাল ফেলে নিজেরা লড়াই করা শুরু করলো।



এখান থেকে ফেরী করে করে এ ঘাট সে ঘাট, সে গাঁ, করা যায়। তিন টাকা টিকিট কাটতে গিয়ে টিকিটবাবুর মাথা খেয়ে নিয়েছি। কোথায় যায়? সন্দেশখালী? আর? বড় তোষপুর, ছোট তোষপুর। আমি প্রথমে বড় তোষপুরকে পরিতোষপুর শুনেছি। ভাবছি অবাক হয়ে, পরিতোষ বলে একটা লোক হয়ত এখানে বসতি গড়েছিলো। তোষপুরের লোকেরা ভারী খুশিতে থাকে? আগেকার হাতে টানা নৌকাগুলোতে মোটর লাগিয়ে নেওয়া নৌকা। সে নৌকায় সবাই ওঠে, সাইকেল, মোটর সাইকেল, শিশু, বুড়ো, বাদামওলা, ছোলামাখা ওলা। রায়মঙ্গলে কামট থাকার গল্প পড়েছি কত্ত। কামটে এসে কুচ করে হাত পা কেটে নিয়ে যায় কেউ টেরও পায়না। জায়গাটা লাল হয়ে যায় খালি। আমি হাত দিলাম জলে, কই কামট? বাচ্ছা, মানে একেবারে দুধের বাচ্ছা, তাদেরকে বুকে নিয়েই নৌকার সরু দেওয়ালে বসেছে, প্রাণে ভয় নেই এদের দেখি। অবশ্য এ অঞ্চলে ভয় থাকলে বাঁচাও যাবে না।

সন্দেশখালীতে অফিস কাছারি আছে শুনেছি, তাই ওখানে নামার মানেই নেই। লাস্ট স্টপ ছোট তোষপুর ওখানেই নামা যাক। ঘাটের কাছে একটা মিষ্টির দোকান, আর এক দুটো দোকান আছে ব্যাস। ধামাখালিতে হোটেল মোটেল ছিল। নদীর পাশেই বাঁধ, তার দুধারে কয়েকঘর করে করে লোক। আসল গ্রাম হুইই ওই দিকে। ভ্যান যায়। আমি হাঁটা দিই নদীকে পাশে রেখে। অভাবী মানুষদের বাস এখানে কিন্তু গরীব না, মানে বোঝাতে পারলাম না না? ধরো পাকা বাড়ি নেই, কিন্তু পেটে ভাত নেই বা মনে শান্তি নেই এমন গরীব না। । দিব্যি রোদে বসে কেউ উকুন বাছছে, কেউ রোদ পিঠ করে খেতে বসেছে। এক বাড়ি থেকে রেডিওর বা টিভির আওয়াজ আসছে। প্রায় প্রতি ঘরেই গরু বা ছাগল বা শুয়োর পোষা আছে৷ একটা ছাগল ছানার আবার আমায় ভারী পছন্দ করে ফেলেছে। আরে এ তো আমার সাথে সাথেই আসছে, আরে কতদূর যাবি রে? হারিয়ে যাবি তো! আমি কিন্তু ফিরবো না এ পথে। আমি থমকালে সেও থমকায়, আমি চললে সেও।ওরে বাবা সামনে একটা বড় মোরগমশাই যে! 'ও মানুষ দাদা তুমি থামলে কেন, চলো না। আমায় যদি ঠুকরে দেয়!'
আচ্ছা আচ্ছা চল যাচ্ছি। মোরগ, বড় শুয়োর সব পার হয়ে অনেকটা রাস্তা আসার পর, যখন ছাগল ছানাটা বুঝেছে এ পাড়া তার একেবারেই পরিচিত না, বেজায় ভয় পেয়েছে। ম্যা ম্যা ব্যা ব্যা করে সে কীই কান্না। ' ও মা তুমি কোথায় গেলে? আমি তো হারিইয়েই গেছি, আমায় নিতে এসো না'। 
ভারী মুশকিল হলো তো! ওই তো আরো কটা ভেড়া আর ছাগল চড়ছে, ওদের সাথে ভিড়ে গেছে। যাক! না হলে এর জন্যেই আমায় ফিরতে হত!

একটা বেনে বৌ শিরীষ গাছের ডালে বসে টুকটুক করে ডেকেই পালালো। ওই দূরে একটা নৌকা যাচ্ছে কোথায় যেন। নিজেদের পুকুরে জাল ফেলছে দাড়িওয়ালা একজন। আর তাকে ঘিরে কয়েকজন। শীতের দুপুর গড়িয়ে চলেছে। ধানের গাদায় শুয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে একজন। ফুরুত করে দুটো ছোট্ট পাখি লাফালাফি করছে। তিনটে রাজহাঁস পুকুরে নেমে আরাম করে স্নান সারছে। স্নান সেরে ফিট বাবু হয়ে ডানা ঝেড়ে, টুকটুক করে হেঁটে ফিরছেন ওই যে। ভারী রাজকীয় ভঙ্গী কিন্তু। বাঁদিকে মা মুরগীটা তার ছানা গুলোকে নিয়ে দানা খুঁটছে। চারদিকে বড় শান্তির ছবি। আমার খিদে পাচ্ছে, অনেক্ষণ হাঁটছি কিনা। আচ্ছা এ রাস্তা ধরে পৌঁছয় কোথায়?

আরো অনেকখানি হাঁটলে আতাপুরের ঘাট পড়বে, একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো। আতাপুরের ভূত বলে একটা গল্প ছিলো না? ওই ঘাট থেকে নৌকা মিললেও মিলতে পারে ধামাখলী ফেরার। না পেলে? দেখা যাবে খন। আতাপুরের ঘাট দেখতে ইচ্ছে করছে। একটা ছোট্ট ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, পার হয়ে হাঁটছি হনহন। নৌকায় রঙ করছে এক বুড়ো, আর তার ছেলে। টায়ার নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে আসছে একটা ছেলে, আমি হাত বাড়িয়েছি যেই অমনি ভুরু কুঁচকে টায়ার খানা সরিয়ে দে দৌড়। একটা ছাগলকে ভড়কি দিলাম, ব্যা ব্যা আওয়াজ করে। দুটো হাঁস পাখায় মুখ গুঁজে গেঁড়িঘুম দিচ্ছে। ওইতো একটা দোকান মত। ওটাই আতাপুরের ঘাট মনে হয়।

ঘাটে একটা নৌকায় মাল উঠছে। শেষ নৌকা চলে গেছে, আর ধামাখালী যাবার নৌকা পাবো না। তাহলে? যে ভ্যান থেকে মাল নামছিলো তারাই নিয়ে গেলো, ভাড়া নিয়ে, ধুচনোখালী না কী যেন নামের একটা জায়গায়। ওখান থেকে ফের ভ্যান, এবার গ্রামের মধ্যে দিয়ে, পিচের রাস্তা ধরে। দু ধারে সাজানো গাছ, ঝকঝকে রাস্তা। এহ বৃষ্টি এল এক দু ফোঁটা, ঠান্ডা হাওয়া, শীতের বেলা পড়ে গেছে।

খিদে পেয়েছে। কী খাই? তুষখালির বাজারে, মিষ্টির দোকান থেকে সিঙারা, বোঁদে আর তার পাশের দোকান থেকে চানাচুর কিনে ঠোঙায় হাত দিয়ে দিয়ে সব কিছু দিয়ে মুড়ি। নদীর পাড়ে বসে বসে৷ এক দুটো নৌকা এলো, গেলো। আতাপুরের ওদিকের গ্রাম গুলোয় যাওয়া হলো না, আজ থাকতে হত তাহলে। এহ কবে এমন হবে, ফেরার কথা না ভেবে গ্রামের পর গ্রাম, নদীর পর নদী পার হয়ে হয়ে যাব।

অনেক ক্ষন পর অন্ধকার হবার মুখে নৌকায় উঠে ফিরতি পথ নিয়েগি। যদি বলো কী দেখার আছে? আমি তো এক কথায় উত্তর দিতে পারবো না। কিছুই নেই হয়তো। যদি জিজ্ঞেস করো কেন বেরোই এমন, তারও উত্তর জানা নেই। কিন্তু ওই নদী পাশে নিয়ে শীতের দুপুরের গ্রামটা, ছোট্ট ছাগল ছানাটা, ঝোপের পাশে মৌতাত করে সিগারেট খাওয়া ছেলেটা, তুষখালির বাজারে আমার সিঙারা চানাচুর বোঁদে মুড়ি দিয়ে লাঞ্চ করাটা আমার পাথেয়। সবার পথ এক না, সবার পাথেয়ও এক না। তাই আমি বলতে পারবো না, ঠিক কী আছে, ওই মরা রোদের গ্রামটায়....রাস্তাটায়..আমার পাথেয় টুকু রাখা আছে খালি এই জানি।









Wednesday, December 19, 2018

হারানে

হারিয়ে ফেলাটাও আর্ট মশাই। মানে প্রথমে সেটা থাকে বদভ্যাস,পরে সেটা দীর্ঘদিন মজুত হলে হয়ে যায় অভ্যাস, আরো দীর্ঘদিন হলে হয়ে গেলো সংস্কৃতি, ঐতিহ্য.... সেটাকে নিপুন দক্ষতায়,অন্যকারো না করতে পারার লেভেলে এক্সিকিউট করে গেলে হয়ে গেলো শিল্প। তা হারানো ব্যাপারটাকে আমি বদভ্যাস থেকে, নিত্যদিনের সঙ্গী অভ্যাস করে ফেলেছিলাম সেই ইস্কুলে থাকতেই। রোজই কিছু না কিছু করে খাতা, সিলেবাস, পেন ইত্যাদি হারানোর অভ্যাস হয়ে গেছিলো নিত্যসঙ্গী। ক্রমে কিশোর বয়স এলো, বই খুলে অমুকের চিরকুটের মানে, শিরিনের ওড়না, পিয়ালীর চোখ চেপে ধরা.... ইত্যাদি ভাবতে গিয়ে আর পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র দেখে বারবার ব্লাডার খালি করতে গিয়ে সময় হারানো ব্যাপারটা আমার নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবেই বইতে হলো।
আলাদা মেজাজ আলাদা ধরন, ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি...সুতরাং আমি হারানে, সময় হারানোর পর আমি বন্ধু হারানোর পর্যায় উত্তীয় হয়েছি...কারোর সাথে বদমেজাজের কারনে তো কারোর সাথে কথা হারিয়ে, হারিয়ে ফেলা। ঐতিহ্য মেনেই আমি হারানো গুলোকে হজম করছিলাম। নতুনের ধাক্কায় তো পুরোনো ঐতিহ্য হারাতে দেওয়া যায়না!
ক্রমে দেখলাম, হারানোয় আমার সাথে অনেকেই পাল্লা দিচ্ছে! অবাক ব্যাপার প্রকৃতিও! নীল রঙ হারিয়ে গেলো আকাশ থেকে, ধোঁয়াটে রঙে অভ্যেস হল, পাখির ডাকে বৈচিত্র্য হারালো, কাক রইলো। বর্ষাকালে কেঁচো হারালো, জমা কালো জল রইলো....হারাতে হারাতে, রোজ তিনি আমার সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যাপারটা শিল্পের পর্যায় নিয়ে যাচ্ছেন। দুম করে সেদিন শুনি একটা আস্ত নদীই হারিয়ে ফেলেছে। তা ভালো তার নদী সে মেরে ফেলবে না ফুঁসে উঠে সব ভাসিয়ে দেবে তার ব্যাপার। কিন্তু এ লড়াইতে আমি তো মশাই কুটির শিল্প হয়ে যাচ্ছি হ্যাঁ। তো সেদিন একটা আমগাছের সাথে কথা হচ্ছিলো, কথা মানে কি আর মানুষের ভাষায় নাকি! আমি বলে যাই বলে যাই আর সে বাচ্ছাদের কথা শুনছে ভঙ্গীতে শুনে যায়। তা সে করতেই পারে; বয়সে, দেখায়, জ্ঞানে, সবেতেই বড় সে। আমি বলছিলাম হারানোর গল্প আমার। সবই হারায় আমার, আমার যত্ন নেই বলে না কিছু সয় না আমার? সে দেখাচ্ছিলো, যার হারাচ্ছে তার তো হারাচ্ছেই কিন্তু যে হারিয়ে যাচ্ছে তারও কি কম যাচ্ছে নাকি? এই যে মানুষগুলো হারিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে....দাঁড়াও দাঁড়াও, হারিয়ে যাচ্ছে মানে? সে আবার কি? গিজগিজ করছে মানুষ, থিকথিক করছে মানুষ আর তুমি বলছ হারিয়ে যাচ্ছে?
কথা হচ্ছে সব মনে মনেই, কারন গাছেরা তো টেলিপ্যাথি বোঝে, ওদের চিৎকৃত ভাষার দরকার হয়না। আমার চেঁচামেচিতে, গাছটা হাসলো...হারাচ্ছেই তো, একটা করে গাছ৷ নদী হারাচ্ছে মানে মানুষও তো টিকে থাকার অধিকার হারাচ্ছে। তাছাড়া, তোমার মনে হয়না, মানুষ ক্রমে নিজের সাথে কথা বলতে পারা হারাচ্ছে, রঙ বেরঙ মন হারিয়ে রোবট হচ্ছে?
লস কার হচ্ছে হে হ্যাঁ?
ঠিকই তো....কিন্তু যন্ত্রণাটা, যার হারালো তার? এই দেখোনা, ছোট থেকে সময় হারিয়ে হারিয়ে এখন তো আর মাত্রাও বুঝি না। তোমাদের যে হারাচ্ছে সব যন্ত্রণা হয়না?
উঁহু, আমরা অত সহজে বিচলিত হইনা। হারালে হারাবে, থাকলে থাকবে....হারাই হারাই ভয়ে যে ওই দূরে ছেলেটা কেমন নদীতে সাঁতরে মাছ ধরছে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে সেটা মিস করে যাচ্ছ তো? হুঁ যত্ন করলে খানিক থাকে বটে জিনিস...কিন্তু অত যত্নে যাকে রাখতে হয় তাকে হারিয়ে ফেলাই ভালো বুঝলে? চিন্তাহীন, ভারহীন হয়ে দিব্যি লাগবে....
গাছ ব্যাটা তো বলেই খালাস....আমার হিসেবী মন, খালি আঁক কষে কত টাকা হারিয়ে গেছে, কত মানুষ হারিয়ে গেছে, কত সময় হারিয়ে গেছে....আমি হারানো শিল্পপতি হিসেবে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি এমন একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। এমন সময় ভারী ক্যাচোর ম্যাচোর করে এক দঙ্গল পাখি মাথার উপর দিয়ে গেল....আচ্ছা এরকমই একবার কবে যেন হয়েছিলো না? এরকমই শীতের দুপুরের এক ঝাঁক পাখি উড়তে দেখেছিলাম না? একই ফ্রেম মনে হচ্ছে, জলের ধারে...দুপুরে....সে কোন জন্মে না এজন্মে কে জানে?
হারায় যা তাই কী তবে ফিরে ফিরে আসে?

Friday, December 7, 2018

সাংসারিক

তুমি কী বলে দশটা মিষ্টি খেলে? হ্যাঁ এত বয়স হলো কান্ডজ্ঞান হলো না? কালকেও একটা প্যান্ট বাতিল করেছে, ছত্রিশ কোমর আর হয়না। বলি একটু লজ্জা নেই গো তোমার?

- ওরকম চেঁচাচ্ছ কেন! অত গুলো মিষ্টি বানিয়েছিলে কেন যদি না খাবো?

- বানিয়েছি বলে কপকপ করে সব খাবে হ্যাঁ!

-বেশ করেছি! আর তোমার জন্যেই আমার ভুঁড়ি বাড়ছে, ভুঁড়ি নিয়ে তোমার ইভা ব্রাউন মা যদি ফের বলে না, দেখো একবার।

- হুহ আমারই তো দোষ সবসময়।

- হ্যাঁ হ্যাঁ তোরই দোষ রে ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ। তুই না বানালেই খেতাম না।

- কিইই!! আমি ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ? মচ্চিমুলো করে খাওয়াচ্ছি কিনা বাবুর তেল বেড়েছে কত। আমি ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ হলে তুমি লাউসেদ্ধ।

- লাউসেদ্ধ? লাউসেদ্ধ বললে আমায়! তুমি, তুমি হলে চানাচুরের পচা বাদাম, ফ্রিজে রাখা রসগোল্লা।

- অ তাই তো?

- হ্যাঁ তাই!! শোনো এ শর্মা কথা গেলে না বুঝেছ?

- ভেবে বলো কিন্তু, আবারও বলছি। ফ্রিজের ঠান্ডা মাছ, রসগোল্লা, পচা বাদাম সব আমিই তো?

- হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিইই।

- আমার মা ইভা ব্রাউন? বাবা হিটলার?

- হ্যাঁ। যেরকম ভাবে বিয়ের সময় বাগড়া দিয়েছিল তাতে অন্য কিছু হতেই পারে না।

- বেশ, শুনে রাখো, রাতে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুরদম করব ভেবেছিলাম, তা আমি, মা বাবা খাবো তুমি মুড়ি খেয়ে ভুঁড়ি রক্ষা কোরো আর হ্যাঁ বাইরের ঘরে নিজের বালিশ কাঁথা নিয়ে চলে যেও।

- মা বাবা মানে!!! তোমার বাবা মা আসছেন নাকি! হ্যাঁ! আর বাইরের ঘরে শোবো মানে কি! আমার নিজের বালিশে না শুলে হয়না।

- থাক! তোমার আর হার্ট অ্যাটাকের দরকার নেই। মা বাবা মানে তোমার মা বাবার কথাই হচ্ছে৷ আর বালিশ দিয়ে দেব বলেছি তো, খুব অসুবিধে হলে বোলো আমি না হয় ওঘরে মা এর কাছে গিয়ে শোবো...

- আহ সব ব্যাপারে অত জলদি ডিসিশন নাও কেন গিন্নী। আমি তো খালি বলছিলাম, অত মিষ্টি খাওয়া ঠিক হলো না, রাতে ইয়ে চারটে কচুরি দিও? কেমন? আর মা বাবা কে রাতে বিরক্ত করার কি...এই দেখো, নতুন থ্রিলার কিনেছিলাম, রাতে পড়বে না?

- তাহলে ওই ফ্রিজের ঠান্ডা...

- না না ওসব আবার তুমি হতে পারো..আমিই তো ওসব। তুমি তো কড়াইশুঁটির কচুর আলুরদম...কই দেখি...

-থাক হয়েছে...বুড়ো বয়সে লাজ শরম কিছু নেই!

- বুড়ো!! ইয়ে গিন্নী প্রমান চাই বুঝি...

- মরণ!