Sunday, January 19, 2020

ফির লে আয়া দিল...মজবুর কেয়া কিজে

"ফির লে আয়া দিল, মজবুর কেয়া কিজে....রাস না আয়া রেহনা দূর কেয়া কিজে..."

এই লাইনটাই মনে হয় ঠিক আমার গ্রামের বাড়িতে   যাবার রাস্তায় পড়লে, যখন থেকে হাওয়ার গন্ধ বদলে যায়, জমির আল ধরে হাঁটা হয়, অন্যরকম একটা হাওয়া এসে বয়ে যায়। খুব বেশী আবেগ বোধহয় নেই আমার, আমার সারাদিন কাজের ফাঁকে মনে পড়ে গ্রামের বাড়ির কথা, এমনও না, কিন্তু এলেই ভারী একটা অন্যরকম হয়। সে আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না কেমন। 

"আরে পাইলট, কখন এলি?" "কেমন আছিস"?  "আজ থাকবি তো"? এসব কথা খুব বেশী শোনা হয় না বলেই হয়ত। আমাদের বাড়িতে বিস্তর লোক থাকতো এক সময়, জেলেদের হাঁড়ির মত হাঁড়িতে ভাত বসাতে হত, এখন সেই বাড়িতে জনা পাঁচেক লোক থাকে। শীত প্রায় চলেই গেছে, জল মিষ্টি মুখে দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে মাঠে। চড়া রোদের মধ্যেই পিঠে মেশিন নিয়ে একজন আলুতে ওষুধ দিচ্ছে। জানুয়ারি মানে বাংলায় মাঘ মাস, এখনই হাওয়ার ধরনটা দেখো! যেন বসন্ত আর অপেক্ষা করতে নারাজ! আরে ওইটা কি হুশ করে চলে গেল? ভাম না খাটাশ? মোটা মত লেজ, কুকুরের মত দেখতে। মাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। 

একগাদা ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করে উড়ে গেল, ঠিকই তো, এমন জায়গায় এসে ফোন দেখা মোটেও কাজের কথা না। আচ্ছা ওই হলুদ পাখিটা কি ফেলাকাকা? "কোকিল মনে হচ্ছে, পাতকো কোকিল"।  অ্যাঁ কোকিল! হলুদ রঙের! ধুস নির্ঘাত  অন্য কোনো পাখি। এহ না মানুষের বইটা না পড়ে ফেলে রাখা খুবই খারাপ করেছি। দূর থেকে ভুটভুট করে পাম্পের শব্দ আসছে, জমিতে জল সেঁচা হচ্ছে। আমাদের এবারে সর্ষে বোনেনি? হয়ত  অন্য কোনো মাঠে হয়েছে।

 জুতো খুলে মাঠে নামি, কাদা মেখে এগোই,আমগাছটার কাছে যাব, সেই গরমে আমায় আম দিয়েছিল, তারপর থেকে কাছে এসে কথা তো দূর মিনিমাম থ্যাঙ্কিউটাও দিইনি। 

থ্যাংক ইউ হে, মনে আছে আমায়? সেইই যে  সেইই বছর আমায় আম দিলে, কচি আমডালটা কই? দু বছরে এত বড় হয়ে গেছে? দুই না তিন? কথা বলবে না নাকি হে? আমি তো সব জায়গার সব গাছকে বলেছিলাম তোমায় জানাতে, আমি কী করব বলো, বন্যা হল একবার, একবার তো আমি এলামই না। না না অজুহাত হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা শোনো তবে,  আমি সত্যিইই চেয়েছিলাম, তবু আসিনি, আসা হয়নি। মানুষদের নানান রকম থাকে জানোই তো, সব চাওয়া পাওয়া মেলে না যে।  হয়ত আমার আরো বেশী করে চাওয়া উচিত ছিল, যাতে দেখা করতে আসা যায়।

ছাতারে গুলো চুপ করে গেছে। র‍্যাট্যাট্যাট করে করে একটা কাঠবিড়ালী ডাকছে খালি। আমগাছেরা গম্ভীর হয়, আরো মন দিয়ে বলতে হবে। একটা পাতা ছুঁয়ে চোখ বুজে বললাম, থ্যাংক ইউ,  সত্যি সত্যি।  তারপরেই সেই হাওয়াটা আবার দিলো, যে হাওয়াটায় মাথার চুল এলোমেলো হয়, বুকের ভার নেমে যায়, চোখ বোজা যায় আরামে।

" তুমি আমাদের ঘর বানিয়ে দেবে? "

কচি গলায় ডাক শুনে চমক ভাঙে।  দু তিনটে বাচ্ছা মেয়ে। রঙীন ফুলের মত। 

কীরে? তোরা কী করছিস এখানে?

"দেখোনা, আমাদের ঘর তৈরী করছি আর ভেঙে যাচ্ছে খালি।" 

তারপর দেখা যায়, সমস্ত কিছু ছড়িয়ে ফেলা, ভেঙে ফেলা অগোছালো একটা লোক কঞ্চি বাঁধা গাছের গায়ে লাল নীল ওড়না, চটের বস্তা এসব চাপিয়ে ঘর বেঁধে দিচ্ছে তাদের। ঘরের ব্যবস্থা হতেই রান্না বসাতে ব্যস্ত হয়ে গেল।নেমতন্নও ছিল বইকি। কিন্তু ওই আর কি, মহারাজের এসব সয় না যে। পা চালাই ফের। একটা বুড়ি একগাদা কাঠকুটো নিয়ে নড়বড় করে চলেছে। এক বার নামিয়ে ফের নতুন বোঝা নিতে এলো। সাদা শাড়ি কোনোমতে প্যাঁচানো গায়ে। এই বয়সেও এত বোঝা বইতে হয়? মলি পাগলি নিশ্চিন্তে গাছের নীচে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। পাগলদের আর নির্বান পাওয়া লোকেদের তফাৎ কিছু নাই মনে হয়। 

বাড়ির ছাদে এলেই পুরোনো শীতের কথা মনে আসে হুড়মুড় করে। লেপ রোদে দেওয়া দুপুর, কমলালেবুর দুপুর, দিদিদের কয়েতবেল মাখা দুপুর, নীচে বালির পাহাড় করা থাকতো সে সময়, ঘর বানাবার কী একটা প্ল্যান হয়েছিল।আচ্ছা আমি বরাবরই ভীতু মনে হয়, কই কখনো তো ছাদ থেকে বালিতে লাফ মারিনি। কী হত এমন হাত পা ভাঙতো হয়ত।যাকগে,  নস্টালজিয়ায় বাঁচতে আমি তেমন ভালোবাসিনা।যা গেছে তা যাক। বরং আলসেতে ঠেস দিয়ে দেখি   ধলিগাইটা একলা দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে, ওই দিকে নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তালফোঁপরার ঢিপি।মেজদাদাকে বললে ছাড়িয়ে দেবে। বলব না যদিও। কিন্তু এই যে চাইলেই পাবো এই নিশ্চিন্ততাটা বড় জরুরি জীবনে।



খাবার ডাক পড়ে। সাজিয়ে গুছিয়ে বড় যত্ন করে খেতে দেয় দুই জ্যেঠিমা মিলে। ঘরের তৈরী গাওয়া ঘি থেকে ঘরের বানানো আমসত্ত্ব, বড় ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে সবেতে। একবার এক বন্ধু বলছিল, পরের জন্মে, সে কিছুতেই মানুষ হতে চায় না। কেন যে এ বারেই হয়েছে সে জানেনা কিন্তু যদি হবার চয়েসেই দেওয়া হয়, সে মানুষ হবেনা। আমি বলেছিলাম, আমারও মনে হয় আগের জন্মে নির্ঘাত কোনো বদ কুত্তা ছিলাম আমি। মানে এত বিস্কুট খেতে ভালোবাসি দেখেই মনে হয়। হয়ত কোনো এক বেখেয়ালে ভুল করে বলে ফেলেছিলাম, "শালা মানুষে এত বিস্কুট খেতে পায় পরের জন্মে মানুষ হলে ভালো হয়"।তারপরেই এই দুর্দশা, মানুষ হবার এত হ্যাপা সইতে হচ্ছে!
কিন্তু এই যে এত মানুষের এত অকারণ  ভালোবাসা আমি পাই, শুধু মানুষ কেন গাছেদেরও পেয়েছি,কেউ না জানুক আমি জানি সে কথা....এত মায়া এত ছায়া এসব বড়ই মহার্ঘ্য জিনিস। হ্যাঁ সফল সুদর্শন ঝকঝকে পুরুষ আমি নই কিন্তু আমার পাওয়ার ঝোলাটাও কম না...প্রতিদিনের খারাপের মধ্যে যে ভালোটুকু, সে দিয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে বলে ফেলাই যায় হয়ত, পরের বারেও মানুষ হলে এত ভালোবাসা পাবার ঝোলা নিয়েই মানুষ হলে মন্দ হয়না।


Sunday, January 12, 2020

ঘুরপাক

এমন শীতকালের দুপুরে বাড়ি থাকা উচিত না মোটেও, কতদিন হয়ে গেল স্রেফ বেরোতে চাই বলেই বেরোনো হয় না। কাল পূর্ণিমা ছিল, অফিসের আমাদের টিমের ছেলেপুলেরা মিলে মোচ্ছবের জন্যে জড়ো হয়েছিলাম মধ্যমগ্রামে একজনের ফ্ল্যাটে। যাবার পথেই চাঁদটা দেখেছি, গোল্লা মার্কা, ডানদিক দিয়ে সাথে সাথে যেতে যেতে সামনে এসে বাঁ দিক নিল। চারদিক এত আলো তার থাকা না থাকায় তেমন কিছু প্রভেদ হয়না। এমন করে করে পূর্ণিমা চলে যাবে আমি বুড়ো হয়ে যাব কিন্তু আমার আর একটা আদিগন্ত মাঠে সভ্যতার আলোহীন জায়গায় চাঁদের আলো মাখা হবে না। সে যেন একজন্ম আগের কথা,  পূর্ণিমার রাতে পাহাড়ে চড়া, হরিণ দেখা। এই হুল্লোড়ে মেতে যেতেও খারাপ লাগবে না জানি কারন বিশে আছে। টংলিং এর বিশে না, এ রক্তমাংসের মানুষ, প্রচন্ড স্মার্ট, প্রচন্ড শার্প, যে কোনো আসর জমাতে ওস্তাদ। মুখচোরা, আনস্মার্ট আমি এই ধরনের লোক ওয়ালা জমায়েতে খুশী, আমার দিকে ফোকাস থাকবে না, সাক্সেস্ফুল পার্টির জন্যে আমার চিন্তা থাকবেনা। বিশে তো ওর আসল নাম না, ছোটমোট করে বলছি। যার ফ্ল্যাটে গেছি তার বারান্দায় একটা নারকেল গাছ লুটিয়ে এসে পড়ে, চাঁদের আলো অবশ্য আসার সুযোগ পায় না, এপার্টমেন্ট কম্পলেক্স এটা,  একগাদা আলো জ্বেলে রাখা আছে। হুল্লোড়ের কমতি ছিল না কিছু, ছেলেগুলো পার্ক স্ট্রীট ঘুরে দর করে হুকো অব্দি এনেছে। 

মাঝরাতের পর যখন আসর শেষের দিক, গ্লেনলিভেটের বোতলখানা নিঃশেষ হয়ে কোনের দিকে লুকিয়ে গেছে, ছাদে যাই চুপিচুপি একাই। হ্যাঁ এইবার বেশ চাঁদ দেখা যায় বটে। আহা চারদিক চুপচাপ তারমধ্যে চাঁদের আলোয় বিরাট একটা ছাদ....আরেকটু চারদিকের অকারণ বিজলিবাতি নিভে গেলেই পরীরা নামত। নেহাত পরী দেখতে নেই মানুষের, আমি নেমে আসি। আহা বড় ভালো একটা দিন গেলো....সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গুনগুন করছিলাম, কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া।হঠাৎ নিজের মনেই হেসে ফেলি, এ গানের লাইনের সাথে আমার মোটেই মেলেনা। নিজের কাছে সত্যি লুকিয়ে লাভ নেই, আজীবন আমি অনেক কিছু চেয়েছি, চাই....ভালোবাসা অবশ্যই চাই, তবে একরকম ভালোবাসাই খালি তা না। এ ছাড়া ভালো থাকা, ভালো ঘোরা,  মেলা জিনিস....সেদিন এক দাদা বিশেকে বলছিল, "কেন দেশ ছাড়ছিস বেকার, যতই পয়সা হোক সেই তো মনে হবে কম পড়ছে, আরেকটু হলে ভালো হত। তার চেয়ে এখানে বন্ধু বান্ধব পোষ্য গাঁজা নিয়ে ভালোই তো আছিস।" গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে দেশ, বিদেশ....কেউ কেউ না ছুটে পারে না। 

সকালে ঘুম ভাঙা চোখেই মনে হয় পালাতে হবে।মদের গ্লাস, হুঁকো পেরিয়ে.... অনেকদিন শীতের রোদে চুল শুকোনো বুড়ি, ব্যা ব্যা করে ডেকে চলা ছাগলছানা, নদীর ধারে নৌকা সারানো, দেখতে দেখতে পথ চলা হয়নি.....

***************************************

কিছু পেতে ইচ্ছে হলে তার জন্যে এফোর্ট দিতে হয়, না ভুল বললাম, বিনা প্রচেষ্টায় পাওয়া যায়না তা না,  বাপ ঠাকুর্দার উত্তরাধিকার মেলে, সেটা এনক্যাশ করাই যায়। তবে নিজের কিছু ইচ্ছে,শখ লক্ষ্য থাকলে তা বিনা আয়াসে মেলেনা। বেরিয়ে পড়া হচ্ছেনা বলে কাল কাটিয়ে আপশোষ করা আমার সয়না। তাছাড়া আমি ভালো করে দম নিতেও পারছিলাম না যেন, শীতকালটা নিষ্ফলা কেটে যাবে? জমিতে নেমে মাঠের ঘ্রাণ নেব না কিংবা দুম করে বেরিয়ে সারাদিন যথেচ্ছ ভাবে চা, কাঠিভাজা কিংবা রাস্তায় বানানো গজা খেয়ে জিনসের পকেটে হাত মুছে হুট করে উড়ে যাওয়া কোনো পাখি দেখে দাঁড়িয়ে যাব না তাও কি হয়! সুতরাং সপ্তাহান্তের একগাদা কাজ ফের পেন্ডিং করে দিয়ে বেরিয়ে পড়তেই হল। কোথায় যাব জানিনা, বেলাও হয়েছে মেলা, তবে আমার একটা কম্ফোর্ট রাস্তা আছে, দুপাশে ভেড়ি, গাছপালা মফস্বলি বাজার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার স্পেশাল একটা ডায়লেক্ট সমৃদ্ধ সে জোন। বাসন্তী হাইওয়ে।

 কোথাও পৌঁছতেই হবে এমন চিন্তা নিয়ে বেরোইনি বলেই হুট করে একটা রাস্তা দেখে মনে হল, এটা কোথায় যায়? গিয়েই দেখা যাক। আরিব্বাস রে, এত কাছে এমন একটা জায়গা আছে? খালের পাশ দিয়ে সার সার নারকেল গাছ, এদিকে পিকনিক স্পট ভাড়া হয় মনে হয়, রাস্তাটা ঢালাই রাস্তা। একটা বেঁটে মত গাছে একটা ফিঙে বসে দোল খাচ্ছে। দেখেই হাত কামড়াতে ইচ্ছে হল, এহ ক্যামেরাটা নিয়ে বেরোলামনা কেন! ধুর ধুর এইসব হিসেব করে বেরোনো কি আর আমার হয়! আমার গন্তব্য মাঝরাস্তায় ঠিক হবে, গাড়ির জ্বালানী যে ভরতে হবে হঠাৎ খেয়াল হবে, ক্যামেরার বদলে চোখ আর মোবাইল ভরসা হবে, এ এতই স্বাভাবিক নিজেকে আর গালমন্দ করিনা। বেকার করেই বা কী হবে! এ বয়সে কি আর শোধরাবার, তার চেয়ে যা আছে তাই নিয়েই ঘর করে নিই। ভারী নিরবিলি এলাকাটা, পিকনিক এবং তজ্জন্যে নিয়োজিত উব উব উব সিজন কেটে গেলে একদিন আসতে হবে আবার। গরমকালে এত বক দেখতে পাবো না হয়ত কিন্তু বটের হাওয়া তখনও থাকবে। আরে তাই তো, বট গাছ কতদিন পর দেখলাম! ভাবো!  বট, অশ্বত্থ, পিপুল আমাদের দেশী গাছ অব্দি আর দেখতে পাইনা সহজে হ্যাঁ, খালি শিকড়হীন ছায়াহীন সব গাছ।ফিঙে দোয়েল, বক দেখতেও কি আর পাই সহজে! তিনটে গোলাপি মতন ছানা শূয়োর গুটগুট করে ভেড়ীর বাঁধ ধরে চলেছে। একটা পিকনিক পার্টির পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি ফিশ ফিঙ্গার নামিয়েছে, একগাদা লোভ দিয়ে গেলাম মাইরি। একাবোকা অতিথি মানুষকে চাট্টি ফিশ ফিঙ্গার দিয়ে আপ্যায়ন করা সেই সংস্কৃতি আজকালকার ছেলে ছোকরারা আর মানছে না দেখছি। ভাবলাম এট্টু সেসব সোনালীদিন মনে করিয়ে দিই, থাক বাবা চেলা কাঠ নিয়ে তাড়া করলেই চিত্তির হবে। 


চা না,  একটা ফিশ ফিঙ্গার না, যা যা তোদের রাজহাঁসে তাড়া করবে হুহ্। চলেই যাব যা। রাস্তায় একটা কালীমন্দির পড়েছিল, মনের দুঃখে ভিতরে নজর চালিয়ে দেখে নিলাম পুজো টুজো হয়েছে কিনা, অন্তত একটা নকুলদানা জুটতো।  নাহ্ ছেলে ছোকরাগুলোর ভক্তি টক্তি মোট্টে নেই! আরে পুজো কর ভোগ দে না হলে খামোখা মন্দির বানিয়ে লোভ দেখাবার কি! যত্তসব ইয়ে, যাকগে আমিও হ্যাংলা নাকি। আরো খানিক এগোই, স্পীড দিচ্ছিনা বেশী, বেশী জোরে ছুটলে চারপাশের অনেক কিছু মিস হয়ে যায়, আমার তো প্রথম হবার চাহিদা নেই, আমার বরং চারপাশ থেকে রঙ রূপ রস নেবার আছে। চলতে চলতে হঠাৎ মনে হয় আচ্ছা চন্দ্রকেতুগড় গেলে কেমন হত? সেটা অবশ্য বসিরহাট এর ওদিকে না? গুগল বলছে এখান থেকেও যাওয়া যাবে, তিরিশ কিলোমিটার মত মোটে।  এরাস্তায় অনেকবার এর আগে এসেছি, ঝড়খালি অব্দি গেছি কখনো, কখনো সন্দেশখালী,বড় আর ছোট পরিতোষপুর। মালঞ্চ যাবার আগেই চৈতল এর ওখান থেকে বাঁয়ে নিতে হবে, কিন্তু এই রাস্তাটাই যে বড় ভালো লাগছে?

এ দ্বন্দ্ব মনে হয় আমার সর্বক্ষনের, সারাজীবনের সঙ্গী হবে। এ দ্বন্দ্ব মিটলেই আমার মুক্তি হয়ে যাবে আমি জানি। যে রাস্তায় চলেছি তা যতক্ষন আমায় রঙ রূপ রসের জোগান দিয়ে চলেছে, মনের আরাম দিয়ে চলেছে ইচ্ছে করে না সে রাস্তা ছাড়তে। মিস হয়ে যায় অনেক অনেক কিছু তাতে,  কিন্তু আমি নাচার। আজ থাক বাঁয়ের রাস্তাটা আজ অতটা টানছেনা যতটা সামনের রাস্তাটা, দুধারের ভেড়ি নিয়ে টানছে। সুতরাং স্টিয়ারিংএ মোচড় পড়ে না, চলতে চলতে মালঞ্চর আগে একজন বলল, বসিরহাট দিয়ে ঘুরেও বেঁড়াচাপা পৌঁছনো যাবে। বেশ বেশ, তাই যাব খন। মালঞ্চতে একটা লোক ছোট্ট একটা ভ্যানে মিষ্টি বেচছিলো গতবার, কী খেয়েছিলাম মনে নেই, লোকটাকে মনে আছে আর তার হাসিটা। তাকে পেলামনা আর, কোথায় চলে গেছে কে জানে। চা খেয়ে কাঠিভাজা আর গুড়কাঠি চিবোতে চিবোতে ফের চলা শুরু। চেনা চেনা নামগুলো দেখে ভারী আনন্দ হচ্ছে, এসব জায়গা নাকি খুব গোলমেলে। গোলমেলে তো বটেই, আমায় কেমন বেঁধে ফেলেছে, এই রাস্তাটা, কেমন ফিরে ফিরে আসতেই হয়। হঠাৎ করে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি সবুজ আর হলুদের রঙে ক্যানভাস ঢেকে গেছে। 





একটা মলিন দোকানের সামনে লুঙিপরে উবু হয়ে বিড়িবাঁধছে একজন। তার দোকানের সামনেই থামা গেল। পায়ে পায়ে জমির ধারে এগিয়ে যাই, রঙের সমারোহ তো চলতে চলতেই দেখেছিলাম, এখন নাকে এলো ভুলে যাওয়া কোন ছেলেবেলার ঘ্রান। সর্ষেফুলের গন্ধ, মাটির গন্ধ। আহাহা। বুক ভরে শ্বাস টানি, মাটির এই গন্ধটা বুকে যেতেই যে শান্তিটা হল, আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। একটা বউ আসছে একটা মা ছাগল আর আর একটা মানুষ আর একটা ছাগলের ছানা নিয়ে। শান্ত দুপুর। দূরে রাস্তা দিয়ে সাইকেলে কেউ কেউ চলে যাচ্ছে। মনের মধ্যে অনেকটা আরাম পুরে নিয়ে ফের চলা শুরু। এবার ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, তিনটে দশ, নাহ আজ আর চন্দ্রকেতু গড় যাওয়া যাবে না। যদিও একজন বলেছে ভেবিয়া শ্মশানের ওখান থেকে শর্টকাট আছে একটা, তাও থাক, বরং নদীর দেখে আসি একটু। সুতরাং আবার সেই টাকি।

টাকি পৌঁছে হাত কামড়াচ্ছি। কেন এলাম!  পিকনিক মাইক, থিকথিকে ভীড়। কোনোরকমে পার্কিং এরিয়া থেকে বেরিয়েই হনহন করে হাঁটছি যতটা সম্ভব এই ভীড় পার হওয়া যায়। পিকনিক মানেই মাইক আর বক্স মাস্ট না? কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছেনা, কোনো দল মদ খেয়ে টাল, কেউ বেলা পৌনে চারটের সময় বেশীরভাগ জায়গায় খেতে বসেছে সবে। আমি গেঁয়ো কিনা, আমার পিকনিক মানে, দল বেঁধে রান্না করে মাংস ভাত খাওয়া। সে সব মনে হয় এখন চলে না, তাছাড়া মাংস এমন কিছু মহার্ঘ্য না আজকাল, আরো আইটেম তো চাইই। হনহন করে মেন জেটি পেরিয়ে যাই। আরো অনেকটা হাঁটলে আমি জানি একটা মাচা পড়বে, সেখানে বসে থাকব না হয় খানিক। কিন্তু এত আওয়াজ আর লোক, উহ কী ভুলটাই না করলাম। চলতে চলতে একজন ডাক দেয়, হাত নৌকায় চড়বে? হাত নৌকায় আমার বরাবরের টান, তাছাড়া ভুটভুটিতে এত আমোদপ্রেমী মানুষের ভীড় আমার সইবে না। সুতরাং মিঠুনের (নামটা পরে জেনেছি) নৌকায় আধঘন্টার কড়ারে ওঠা গেল। বাপ ছেলে দুজন দুদিকে বসল, আমি মাঝে। আসলে মাছ ধরা নৌকা, শীতে মাছ মেলেনা তেমন তখন লোক নিয়ে ঘুরিয়ে আনে। নৌকা চলরে শুরু হতেই আওয়াজের দাপট কমে আসে। মিঠে রোদে শান্তি লাগে বড়। বাংলাদেশের বাঁধ ব্যবস্থা থেকে, মিঠুনের পারিবারিক খবর সব রকম গল্প হয় ইছামতীর বুকে। কোলকাতা মিঠুনের বাবার ভালো লাগেনা, অসুখের জন্যে থাকতে হয়েছিল বটে। আমায় বর্ষায় গেলে টাটাকা ইলিশ খাওয়াবে, হোটেলে ওঠারও দরকার নেই ওর ঘরেই সব  ব্যবস্থা হয়ে যাবে আমার। এত ভালোবাসা আমি পাই প্রতিবার ইছামতীর তীরে আমার ঝোলা ভরে যায়।আমার অপটু হাতের দাঁড় দিয়ে মিঠুন হাসে, আমার নাগরিক স্বার্থপর বলেনা ওর বোনেদের শ্বশুরবাড়ির দিকে গেলে আমার বাড়ি যেন যায়। মাটির সাথে থাকা এই মানুষগুলো আরেকটু বেঁচে থাক, ভালোবাসার বড় অভাব, বড় বেশীভিতর থেকে খালি হয়ে গেছি, পরের বার যেন ওই রকম করেই আমিও ডাক দিয়ে যেতে পারি।

নদীর ধার ধরে আরো খানিক হেঁটে ফিরতি পথ ধরি, আকাশে তখন লালের নানান শেডের কেরামতি চলছে। সুয্যিদেবের গাল্ফেন হয়ত লিপস্টিক পছন্দ করতে গেছেন! মীনাখাঁ বাজারে থেমে চা খেতে গিয়ে  কি খেয়াল হল চাউমিনের অর্ডার দেওয়া গেল। বাপ্রে এ চাউমিন, না আমার ফ্রেন্ডলিস্ট! মানে সর্ষের তেলে ভাজা সে চাউমিনে বাদাম থেকে ধনেপাতা, জিরেগুঁড়ো থেকে ভিনিগার কী নেই!! সভয়ে চেয়ে দেখি, পাশের ছেলেটা কাগজের উপর ভেজিটেবল চপ নিয়ে তাতে আধ হাতা কুমড়োর সস, সোয়াশ কাসুন্দি, পাঁচ বিঘে জমির শশা, গাজর সব উপুর করে দিয়েছে। নিজের প্লেটটা তাড়াতাড়ি আড়াল দিয়ে হামহাম করে খেয়ে নিলাম। কী দরকার বাবা, আমার প্লেটের দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছিল, হয়ত ক্ষেতের লাউ টাউও কিছু আছে দিতে চায়! 

ভেবেছিলাম চাঁদের আলো মেখে ফিরব। কিন্তু চাঁদ উঠলো যতক্ষনে আমি কোলকাতার আলোজ্বলা রাস্তায়। চাঁদটা যেন চোখ মেরে বলছে,  অতই সোজা নাকি হে, এক যাত্রায় সব পেয়ে যাবে..."আমায় নিয়ে ঘুরতে হলে আবার বেরোতে হবে,  সব কিছু পেয়ে গেলে বাঁচতে ইচ্ছে করবে নাকি? পরেরবারের জন্যে খানিক বাকি রইল না হয়।তদ্দিন যা পেলে আজ, তা নিয়ে উটের কুঁজ বানিয়ে নাও, তেষ্টায় কাজে দেবে।"

Wednesday, January 1, 2020

হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার

কাল এক বন্ধুর বাড়ি জড়ো হয়েছিলাম কয়েকজন। আড্ডা মেরে খেয়ে দেয়ে হুট করেই ইচ্ছে হয়েছিল আরেক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে সারপ্রাইজ দেবার। কাল মদ টদ খাওয়ায় হবে জেনেই গাড়ি নিয়ে বেরোয়নি, এক বন্ধু তার সাইকেল বের করল, সাইকেলের পিছনে বসে মাতাল, হুল্লোড়ে মানুষ আর কুকুরের পাল সামলে মিনিট কুড়ির কোলকাতার রাস্তা। ভারী অদ্ভুত লাগছিল, আজ থেকে এক নতুন দশক শুরু হল। এক দশক আগে এরকম মাঝরাতে সাইকেলে করে বেরোবো এ ভাবতেই পারতাম না।জীবনের এই যে বাঁক গুলো দেখা যায়না,  স্পীডে গাড়ি চলতে চলতে বাম্পার চলে আসে, মনে হয় অনন্ত খারাপ রাস্তা খালি আছে সামনে, তারপর কখন যেন ফের রাস্তা মসৃন হয়ে যায়, দুপাশে গাছ দিয়ে ঢাকা রাস্তায় ঢুকে পড়া যায় আচমকাই, এতেই বাঁচাটা বড় রোমাঞ্চকর মনে হয়। এরকমই কোনো পয়লা জানুয়ারি একলা বরফঢাকা এয়ারপোর্টে বসে কেটেছিল, কোনোটায়  বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রনায়, কোনোটায় মা পরের দিন মটরশুঁটির কচুরি করবে সেই আনন্দে,আবার কোনোটা কিচ্ছু না স্রেফ আরাম করে ঘুমিয়ে। 

 রাত দেড়টা বলে মনেই হয়না!! এত লোক এত গাড়ি। একটা ছেলে মাতাল হয়ে তার বাবাকে চেঁচিয়ে বলছে, "ঘরেএএ ঢোক বলছি, চল ঘরে চল"।  আর তার বাবা তাকে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে চলেছে, সংলাপ অদলবদল হয়ে গেছে আর কি মদের প্রভাবে। একত্রিশে ডিসেম্বর মানেই মদ খেতে হবে আর তারপর এরকম ছড়াতে হবে এমন নিয়ম কবে হল কে জানে! একটা গলিতে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলাম, রাস্তা গোলমাল করায়, দেখি এক গাড়ি ছেলে মেয়ে মিলে গাড়ি থামিয়ে, অসংলগ্ন ভাবে কী সব যেন বলছে। এক মোড়ে কিছু লোক খামোখা বাওয়াল দিয়ে দিল একটা খালি ট্যাক্সিকে, কেন যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোককে হর্ণ দেবে! মাতালদের পাশ কাটিয়ে চলেছি আমরা। সাইকেল দেখে কেউই কিছু বলছেনা,খালি একপাল কুত্তা তাড়া করে আসা ছাড়া। বাপ্স কামড়ে দেবে নাকি! পায়ের গুলিটা তাক করেই ছুটছে যে! একটা পুলিশের গাড়ি টহল দিচ্ছে। উৎসবের রাতে এদের জ্বালা বাড়ে।

সকালের রোদে চোখ খোলে, ঘুম পুরো না হওয়ার জ্বালা নিয়ে। বন্ধুরা মিলে হইচই করে লুচি বানাই, ট্যারাব্যাঁকা, শক্ত, খড়মড়ে লুচিই হেব্বিই স্বাদ আনে নলেন গুড়ের সাথে। আহা এমন রোদ মাখা সকালে নলেন গুড়ের সঙ্গতে যে সকাল শুরু হয় তা খারাপ হতে পারেনা। একটা কাক এসে বসে জানলায়, এই নে তুইও একটা খা গুড়ে মাখা লুচি, বচ্ছরকার দিন বলে কথা! রাস্তাঘাট, বাস, সব ফাঁকা ফাঁকাই। অফিস পাড়া শুনশান করছে। অটোটা একটু দূরে নামিয়ে দিয়েছে, হাঁটছি। ভাতের ঝুপড়ি বা ঝুপ্স অধিকাংশই বন্ধ। একটা চা পাঁউরুটির দোকানে দেখি একটা লোক আর মেয়ে উদাস হয়ে বসে আছে। আজ বিক্রীবাটা নেই মোটে। রোজটা গেল। ছুটি নিলেই পারতো তো? একদিন বেশ মেয়ের বা ছেলের সাথে কাটাতে যে ইকোপার্ক কিংবা চিড়িয়াখানা,  এমন উদাস হয়ে বসে না থেকে। আসলে আমাদের মধ্যে ভালো থাকা অপরাধ এ ছোটবেলা থেকে গুঁজে দেওয়া হয়, "দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছিস, ভালোইই তো আছিস",  "ওর আর কি, বিয়ে থা হয়নি, দিব্যি আছে",  "ওদের ঘোরাঘুরির সমস্যা কি, বাচ্ছাকাচ্ছা হয়নি, ভালোইইই আছে"।  সব কটা "ভালোইই" একটা অদ্ভুত সুরে শ্লেষের সাথে বলা! যেন ভালো থাকাটাই দোষের। সারাক্ষণ "খুব চাপে আছি" বললেই তুমি দায়িত্বশীল কর্মঠ একজন মানুষ। 

এত চাপ নিয়ে বেঁচে কি হবে! বুড়ো হাড়ে পাহাড় বাইতে পারবেন না, লজেন চিবিয়ে আরাম পাবেন না, নদীর জলে নামলে ঠান্ডা লাগবে, সুগারে নলেন গুড় নিষিদ্ধ হয়ে যাবে আর ফোকলা দাঁতে মাংসের হাড় চিবিয়ে সুখ হবে না। এই নতুন বছরটা উদযাপনের হোক না, ভালোবাসার, ভালোথাকার। শুভেচ্ছা রইলো।