Wednesday, November 30, 2022

কোনো একদিন...

অক্টোবর ন তারিখে লাস্ট পোস্ট দিয়েছি এখানে। তারপর এক মাসেরও বেশী সময় কেটে গেছে,  আমার হাড়েও পঁয়ত্রিশ হেমন্তের পাতা পড়েছে। মাঝে কিছু খুচরো লিখেছি বটে কিন্তু তা এখানে দেওয়া হয়নি। অথচ এখানেই দেওয়া উচিত ছিল। ব্লগ শুরু করেছিলাম এরকমই এক পাতা ঝরা সময়ে। বিদেশে থাকতে হাতে লম্বা সময় থাকতো, সেটাই কথা না শুধু,  নতুন জিনিস দেখতে দেখতে লিখতে ভেবেছিলাম কোথাও আমারও বলার আছে। তারপর আর কি, লম্বা সময় পেরিয়ে গেল ফেসবুক এসে হানা দিলো, ব্লগে পোস্ট কম হল কিন্তু তারপর একদিন ফেসবুকটাও অত্যধিক নেশা বলে দুম করে ছাড়লুম। তাতে হল কি, ব্লগও বন্ধ, ফেসবুকও বন্ধ লেখাও বন্ধ। এমন না আমি না লিখলে সাহিত্য জগৎ থমকে যাচ্ছে,  চারদিকে হাহাকার পড়ে যাচ্ছে এসব কিচ্ছু না কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে গেলে মশাই নিজেকে দু চারটে মিথ্যে বলতে হয়, তারমধ্যে, এই ব্লগ চালিয়ে যাবার টোটকা হিসেবে দু চারটে নির্দোষ মিথ্যেও ঢুকে যায় আর কি। 

বাজে বকায় যদি নোবেল থাকতো অনেক বাঙালীই তার দাবীদার হতো (অন্য প্রদেশ বা দেশের লোকের সাথে মিশিনি তো তেমন জানিনা তাই),  তো সেই বাঙালীর মধ্যেও আমিই বেশী দাবীদার হতাম এ আমি জানি। এতক্ষন ধরে চাট্টি বাজেই বকেই চলেছি দেখছি। যাই হোক, আজকাল বেশীরভাগ সময় গাছপালায় ঘেরা মফস্বলে  , ঘর থেকে আপিস হয়ে এ সুবিধে হয়েছে। আমার কাজের টেবিলটা জানালার ঠিক পাশেই, চোখ মেললে একটা তরুণ শালগাছ, তার পাশেই একটা নিম, আর তার ওপারে একটা ঝামড়ি মতো গাছ, ভালো দেখা যায় না কিন্তু হনুমানের দল প্রায়ই ওই গাছটায় আসে,  ডাল পাতা ভাঙে, লাফালাফি করে ফের চলে যায়। শাল গাছের এ দিকটা ইলেক্ট্রিকের তার গেছে, মাঝে সাঝে দোয়েল,  বুলবুলি ফিঙে আসে। কাঠবিড়ালিও আসে তবে আজকাল কম দেখছি। আমি চিরকাল অমনোযোগী,  বয়স হওয়ায় তা কমেছে এমন না, আমার মন ওই জানলার বাইরেই সারাদিন ঘুরফির করতে থাকে। একটু বেলায়, যখন বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়, পায়রাগুলো বকম বকম করে সারাদিন ভরিয়ে রাখে। কীসের এত বক্তব্য কে জানে! ওদের জরুরী আলোচনার মাঝেই একটা দুটো শুকনো পাতা খসে পড়ে। শীত প্রায় সমাগত। হেমন্তের শেষের এই সময়টা বড় উচাটনের। আমার ভালো লাগেনা কাজে মন দিতে, নিশির ডাকের মতো পথ আমায় ডাকে। 

শনিবারের দুপুরে বেরিয়ে পড়া গেল। নদীর ধারে যেতেই ইচ্ছে করছে খুব, তা আমারও টেলিপ্যাথির যোগ কম নয়, কোথায় যাবো কোথায় যাবো করতে করতেই, দেউলের সন্ধার জানালো ময়ূরাক্ষী। অজয় নদীর পাশেই। তাহলে চল পিকনিক করি। পিকনিক? দুজনে?! 
হওয়ালেই হয়! ছোট বয়স থেকেই বন্ধু বান্ধব কম আমার, আসর জমানো লোক আমি নই কোনোকালেই। জীবন আমায় শিখিয়ে দিয়েছে আনন্দের উপকরণ এমনিই চারদিকে ছড়িয়ে আছে, দল বলো, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বলো, মিসফিট  ফিল করা, অপমানিত হওয়া,  উপেক্ষিত বোধ করা কিংবা একেবারে মধ্যমনি হওয়া এসবই পার্ট অফ লাইফ হয়ত, কিন্তু এরাই লাইফ এমন নয়। জীবন ঠিক কী তা বুঝিনি বটে কিন্তু কেমন যেন টের পাই এসবই আলগা পাথর, এসবের বাইরে একটা কিছু । তাই পিকনিক করতে ইচ্ছে করলে করো, একা একাই করতে পারো যদি চাও তো। শুধু ওই ইচ্ছেটুকুই সব নয় অবশ্য, খানিক উদ্যমও লাগে। তা বেড়াতে বেরোলে আমার উদ্যোম খানিক বাড়ে বটে। সৌভাগ্যক্রমে,  ময়ূরাক্ষীও আনন্দ কুড়োতে জানে। সুতরাং একটা ফ্লাস্কে গরম জল ভরা গেল, চা এর দোকান পেলেই ফেলে দিয়ে চা ভরা হবে। ফ্রিজ কুড়িয়ে দুটো কমলালেবু মিলল। তা পিকনিক করবো নদীর চরে একটা চেককাটা চাদর নেই? দেখা গেল নেই,  যেমন হয় আর কি অগোছালো মধ্যবিত্ত জীবনে। কিন্তু আমরা দমি নাকি! একটা পর্দা না তোষকের কাপড় ছিল রাখা, তাকেই নেওয়া হল। কেক তো মাস্ট, সেও ওই চায়ের দোকান থেকেই কেনা হবে খন। একটু স্যান্ডউইচ থাকতে হত বটে, কিন্তু আগের দিন আমরা ফ্রিজ ফাঁকা করে খেয়ে নিয়েছি,  তাছাড়া স্যান্ডউইচ বানাবার সময়েও পাওয়া যায়নি।আর গান শুনবো না আমরা? আমাদের দুজনের গানের গলা অসাধারণ সে কথা না, লোকসমক্ষে গাওয়া যায়না বলে আমরা আড়ালে গেয়েই থাকি কিন্তু পিকনিকে একটু অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া যাক নাকি? সুতরাং একটা ব্লুটুথ নেওয়া হল। 

ব্যাস আর কি, দুপুরবেলায় দুজনে চল্লুম। গুগলম্যাপকে পুরো ভরসা না করলেও এটা মোটামুটি জানা যাচ্ছে ওই মোটামুটি পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন কিলোমিটার মোটে। পিকনিকের মূল নিয়ম কী জানা আছে তো? কিছু প্ল্যান অনুযায়ী হবে কিছু গোলমাল হবে। আধুনিক পিকনিকে অবশ্য টাইমে টাইমে লুচি তরকারি মিষ্টি,  চিকেন পকোড়া, এলাহি লাঞ্চ সব চলে আসে কিন্তু ওগুলো সব নকল পিকনিক। যাইহোক, আমরা অনেকদিন পর এরকম বেরোচ্ছি তাতেই আনন্দে দশ কিলোমিটার মতো যেতেই বেজায় খিদে পেয়ে গেল। সুতরাং হারাধনের দুটো কমলালেবুর একটা উধাও হয়ে গেল নিমেষে। আরো খানিক গিয়ে গুগল একটা মোড় ঘুরতে বলছে, কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গুগলকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা চলেনা। তাই একটা চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঠিক তাই, এ মোড় আমাদের জন্য না, আমাদের যাত্রার মোড় ঘুরবে আরেকটু পর। 

মুচিপাড়া ছাড়িয়ে খানিক এগোনোর পর আর পারা গেল না। এই দোকানেই চা খেয়ে নিই একটু নাকি? সুতরাং চা, খাস্তা কচুরি, বিস্কুট, কেক সহ আর্ধেক পিকনিকের খাওয়া ওখানেই হয়ে গেল। কটা কেক অবশ্য ব্যাগে পোরা হল, কিন্তু ফ্লাস্কে চা ভরতে গিয়ে বোঝা গেল, দুজনের দু ভাঁড় বা চার ভাঁড় চা ওই প্রমান সাইজের ফ্লাস্কে ভরলে সরবত হিসেবেই খাওয়া যাবে পৌঁছে!  নিজেদের আশ্বাস দিলাম খুব, বেশ তো পৌঁছে কিছু পেয়ে যাবো, ওখানে ভরে নেব খন। ভরদুপুর, নভেম্বরের শেষ, এখনো ধান কাটা চলছে কত জায়গায়। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। দোকানপাট বন্ধ করে খেতে গেছে হয়ত সব। একটা ইঁটভাটায় কটা লোক কাজ করছে। কয়েকজন রাজমিস্ত্রী প্লাস্টার করছে একটা ঘরে। বেলা গড়ানো রোদে, দেউল পৌঁছলাম। আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টের একটা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে, ইছাই ঘোষ নামে কেউ একজন এ মন্দির বানিয়েছিল, সপ্তদশ শতকের সময়কালে। পাতলা ইঁটের কাজ। পরে কারা যেন একটা শিবলিঙ্গ পুঁতে দিয়ে গেছে। কটা ছোট ছোট ছাগলছানা আরাম করে ঘাস খাচ্ছে চারপাশে।ইছাই ঘোষ কবেই ধূলো মাটি হাওয়া হয়ে গেছে,  ইঁট গুলোও মনে রেলহেছে কিনা কে জানে!  চল চল এখানেই পাটি পেতে বসা যাক নাকি? ফের ভাবি, তবু পরিষ্কার আছে, থাক, আমাদের দেখে আর কেউ যদি বসে আর নোংরা করে?  নাই বা আর বসলাম!

পাশেই একটা বটগাছের নীচে একটা ছোট্ট চালায় দোকানঘর। একটা ছোট মেয়ে সে দোকান চালাচ্ছে।  চা বিস্কুট কেক,  যেমন হয় আর কি! তার আবার  ক্ষুদে ক্ষুদে আত্মীয় ভাই বোন এসেছে তারাও দোকানদারি করতে এসেছে! অজয়ের জল একটু দূরে। পাড় ধরে হেঁটে যাবার আগে রাস্তা ধরে হাঁটি, একদিকে জঙ্গল একদিকে ক্ষেত। সূর্যের আলোয় পাতায় পড়ে ভারী সুন্দর একটা আলোছায়া মতো করেছে। হাঁ করে দেখি, কী দেখি বোঝাতে পারবোনা, কিন্তু এই রাস্তা, শালের পাতা, রোদ সব মিলিয়ে বড় ভালো লাগে। ধান কাটতে কাটতে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল। থোকা থোকা কী যেন ফুল ফুটে আছে রাস্তার ধারে। কী ফুল জানিনা, নাম দিয়েই বা কী হবে! আরো খানিক এগোই। অজয়ের পাড়েই একটা রিসর্ট মতো করার চেষ্টা হয়েছিল, চলেনি মনে হয়।আপাতত আশেপাশে কেউ কোথাও নেই, সামনে রাশিরাশি কাশ ফুল ছাড়া। 

নদীর চর ধরে হাঁটি, বালিতে বসে থাকি।ভুলে যাই আমাদের পাটি পেতে বসার ছিল, গান শোনার সরঞ্জাম ছিল, চা ঢেলে খাবার ফ্লাস্ক ছিল। প্রকৃতির মধ্যে একবার ডুব দিলে সবই কেমন যেন এক্সট্রা হয়ে যায়। খিদে টের পেলে, পকেট থেকে চেপ্টে যাওয়া কেক বের করে খাই দুজনে। দূরে সূর্য আস্তে আস্তে কোন এক ইছাই ঘোষের বানিয়ে যাওয়া মন্দিরের পিছনের নামতে থাকে। একপাশে বর্ধমান একপাশে বীরভূম আমরা অজয়ের চরে বসে থাকি মাঝবরাবর। আমাদের বড় হওয়া হয়না, তৃণ হওয়াও না,মাঝ বরাবরই কেটে যায় জীবন। এক এক করে মেয়ে পুরুষের দল নদী পার হয়ে আসে, গরুকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে ঘরে নিয়ে চলে।  সূর্য ক্রমে রসালো লাল টমেটোর মতো হয়ে যায় আমরাও গরুগুলোর মতো বাড়ির পথ ধরি।

ফিরতি পথে বিনবিন করি, আমাদের তো পিকনিক হল না? হল না বুঝি? ওই বট গাছের নীচে,  চালায় বসে চা বিস্কুট খাওয়া, বালিতে বসে চ্যাপ্টা কেক, গাড়িতে বসে কমলালেবু,  কমটা কি? আচ্ছা বেশ তো বাকিটা এই শালের জঙ্গলের মাঝের ওই হোটেলটায় হবেনা? হোটেল মানে নামের ওজন আধহাত, আসলে সে সস্তায় খাবারের দোকান। ভাত চাও তো ভাত, মুড়ি চপ চাও তো তাই। দোকানি তখন পাঁউরুটির পেটের মধ্যে মশলামাখা পুর ভরে বেসনে দিয়ে ভাজবে বলে তৈয়ার হচ্ছে। কাঠের আগুন একটু উস্কে দিয়ে চপ ছেড়ে দিলো আমাদের জন্য। তারপর শালপাতায় মুড়ি চপ পিঁয়াজ দিয়ে মেখে,  আর আলুর পুরভরা পাঁউরুটির স্যান্ডউইচ (বেসনে না ভেজেই) কাঠের উনুনের পাশে প্লাস্টিকের টেবিলে বসে তোফা লাঞ্চ হয়ে গেল। পিকনিকের লাঞ্চ খানিক দেরী করেই হতে হয়।ওইই নিয়ম।


একটা পরিপূর্ণ হাতের  মুঠোয় ধরতে পারা নরম দিনের মতো আরামের দিনের শেষে উপহার অব্দি মিলেছিল। যে গাছের নীচে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলাম, সেটা শিউলি গাছ ছিল, কোত্থাও কিচ্ছু নেই, স্রেফ একটা শিউলি ফুল সাইড মিররে এসে পড়েছিল৷ পথের দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরার পথে মফস্বলি সার্কাসে ঢুঁ মারার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম, কুকুর ছাগল এসেছে নাকি! ছাগলে ট্রাপিজ দেখাচ্ছে এ বড় আশ্চর্য জিনিস বটে। কিন্ত শেষ অব্দি অন্যদিনের জন্য তা তোলা আছে। এক দিনে এর বেশী পেলে যদি লোভ হয়ে যায়, যদি মনে হয় এ আর এমন কী দিন গেল? তার চেয়ে বরং আজ দিনটা জঙ্গুলে বুনো গন্ধ, ধুলোর গন্ধ, জুতোয় ঢুকে যাওয়া নদীর বালি, বট গাছের নীচের চায়ের দোকানটা আর রাস্তাটার জন্য তোলা থাক, শিউলি ফুলটা সমেত।