Wednesday, October 9, 2019

পুজোর চালচিত্র

পুজো এলেই আমার বেজায় ভালো লাগে। হ্যাঁ হ্যাঁ ভীড় হ্যানাত্যানা কিচ্ছু আমায় কাত মাত করতে পারে না। সাধকদের সব রকম অভ্যেস আছে।ভৈরবের ভৈরবী থাকে, সাধকদের সাধিকা, অবধূতের মাতাজি....নইলে আবার সিদ্ধিলাভ মুশকিল কিনা। তাই ভীড়ে ভালো করে দৃষ্টিসঞ্চালন করে দেখছিলাম উপযুক্ত কাউকে কিনা। দূর দূর তক কুছু নাই মশাই, কোলকাতা যেন ভেজ থালির মতই খাঁ খাঁ করছে! 

অগত্যা মন দিয়ে ঠাকুর দেখাই স্থির করতে গিয়ে দেখি অসম্ভব। মোবাইলে তাগ করে সহস্র ফটোগ্রাফার! একজনকে বললাম,  "আরে দাদা আপনার হাতে তো ছবি কথা বলে!! হেব্বি তুলেছেন, একবার ওই এঙ্গেল থেকে দেখুন তো। আলোটা দারুণ ক্যাপচার করেছেন।" ব্যাস নিমেষে ঠাকুরের সামনেটা হালকা হয়ে গেল, ফটোগ্রাফারের দল "ওই" দিকটা চলে গেল। 


যাহঃ শালা! কাত্তিক গনেশ এরা এমন ট্যাবলেট সাইজ কেন? আর এবারে কি সিংহ পাতা ফেলেছে? সব কটা মন্ডপেই ঘোড়া দিয়ে কাজ চালাচ্ছে? ঘোড়া আবার হিংস্র ঘোড়া, ঘ্যাঁক করে দাঁত বের করে অসুরের হাত খাচ্ছে। ঘাসের বদলে মাস? ভেগানগুলোর চোখে এ দৃশ্য পড়লে মরেই যেত। 


সারা শহর টহল দিয়ে মহারাজের পা যখন বিদ্রোহ করছে,  ভীড় পেরিয়ে নদীর ঘাটে বসতে এসেছি। চার দিকটা তূলনামূলক ভাবে শান্ত এখানে। লোকজন তেমন নেই, একটা একা বোকা লোক নদীর ধারে চুপটি করে বসে ওইপাড়ের আলো দেখছে, এপাড়ের ভীড় হুল্লোড় পার হয়ে। আর ওই কোনায় একজোড়া ছেলে মেয়ে হাতে হাত দিয়ে আলো মেখে দাঁড়িয়ে। খানিক বসে থেকে ফিরতি পথে দেখি, একটা খুব খেঁচুটে মুখের গোঁফালো লোক আইস্ক্রীম কিনে দিচ্ছে একটা নাকে সর্দি মাথায় উকুনে ভরা বাচ্ছাকে। ট্রাফিক ছাড়তেই বাঁধ ভাঙা ভীড়ে বয়স্ক বাবার হাত ধরে তার মেয়ে নিয়ে যাচ্ছে।


আমার বন্ধুরা ভারী বিরক্ত হয় এই মেট্রোর সাড়ে ন লাখ মানুষের ভীড়ে, রাস্তায় জ্যামে, এত মানুষের ঠাকুর দেখবার জন্য রাস্তায় নামায়...কিন্তু এই যে এত ভালো ভালো দৃশ্য এগুলো পুজো না এলে কেইই বা দিত! 


ভালো হোক,  আনন্দে কাটুক সবার পুজো।



*******★**************★*****************



"কিরে এখনো কতদূরে?"


ফোনের ওপারে বাবার উত্তেজিত গলা। রওনা দিতে দেরী হয়েছে বিস্তর। ইচ্ছে করেই খানিকটা। যা হয়, বাবার উত্তেজনা বোঝার ক্ষমতা ছেলের থাকেনা। উলটে বিরক্ত হয়ে বলি, "আসছি তো অমন করছ কেন?" 


এবারে  আমাদের পুজো কোনোমতে হচ্ছে।মানে ঢাক, কাঁসর সবই আছে কিন্তু সে ঢাকে যতটুকু কাঠি না পড়লেই নয় ততটুকুই পড়ছে। হবার কথাই ছিল না, ধনাদার বউ মারা গেল পুজোর মুখেই,ভুল চিকিৎসায়। যে ডাক্তার অপারেশন করেছিল সে ডাক্তার মন দিয়ে ব্লাড রিপোর্ট দেখেনি, আরো অনেক অপারেশনের তাড়া, লোভ।পিজিতে শেষ কদিন যিনি দেখেছিলেন তিনি খুবই চেষ্টা করেছিলেন যদিও। বাড়ি অব্দি পৌঁছতে অনেকবার থামতে হয়। লোকুদার দোকান, কুমোরপাড়ায় কে একজন যেন, আমি চিনিনা, আমায় চেনে এমন কত জনের সাথে, কুশল মঙ্গল সেরে পৌঁছতে হয়। বাড়ি পৌঁছলে অসময়েও মা জ্যেঠিমা মিলে গরম লুচি ভেজে দেয়। 


সকালে ঘুম ভাঙে দূরে রথতলায় ক্লাবের পুজোর মাইকের আওয়াজে। চন্ডীপাঠ হচ্ছে। আচ্ছা ওরাও তো মাইকটুকু বন্ধই রাখতে পারতো। নাহ তা মনে হয় হবার না! ক্লাবের পুজোয় তো কাল নাকি "ডান্স নাইট" ও হয়েছে। লোকে মদ খেয়ে তাতে পয়সাও দিয়েছে। আমি হয়ত এ যুগের সাথে ফিট করিনা, আমার মনে হয় একটা সামগ্রিক অবক্ষয় আমাদের সবাইকে গ্রাস করছে। একটা ভিডিও দেখেছিলাম, বাচ্ছা ছেলে একটা দাঁড়িয়ে দেখছে এরকমই এক "ডান্স নাইট",  অশ্লীল ভঙ্গীতে নাচছে একটা মেয়ে। এইই একশো বছর টিকে গেলে সংস্কৃতি বলে গৃহীত হবে হয়ত! সকালে চন্ডীপাঠ রাতে সর্বসমক্ষে শরীরী আবেদন পূর্ণ নাচ।


এবারে মাছ ধরা নেই, চা খেয়ে ঘুম ভাঙা চোখে হাঁটা দিয়েছি। বড় সবুজ চারদিক। কিছুদিন আগে বন্যা হয়েছিল। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ভেঙে গেছে। কোনদিকে যাচ্ছি কে জানে! লক্ষ্মীর আঁচলের মত ধানের মাঠ, পটলের বরজ, অসময়ের শিম। পিতৃস্মৃতি, মাতৃস্মৃতি মন্দির বানানোর চল আছে খুব এখানে। মন্দির মানে সিমেন্টের চ্যাটালো উঁচু একটা বেদীর মত। তার একদিকে ভস্মাবশেষ রেখে উঁচু করা, মাথায় তুলসীগাছ পোঁতা থাকে। বৈশাখ মাসে জল দেবার রীতি আছে। ভালো নিয়মটা কিন্তু বেশ। একটা সিমেন্টে বাঁধানো বসার জায়গা রইল, বৈশাখ মাসে চারদিক যখন ফেটেফুটে যাবে, নিয়ম এর চক্করে হলেও তুলসী গাছ একটু জল পাবে। আসলে কিছু নিয়ম মন্দ থাকেনা, সময়ের সাথে সাথে শুধু রীতি গুলো মনে রেখে কজ টা ভুলেই চিত্তির হয়।  এই যে অশৌচ চলছে আমাদের,  নিরামিষ খেতে হয়, নতুন কিছু পরতে নেই ইত্যাদি এ তো স্রেফ শোকের আবহে  হুল্লোড় হয়না সেটাই বলা। কিন্তু যদি হুল্লোড় হয় আর এই নিয়মগুলো মানা হয় তাহলে আর মেনে কি লাভ! 



কোথায় যেন এসেগেছি, এ জায়গাটা বেশ তো। কেমন ছায়া ছায়া মাখা। রোদ থেকে গাছের ছায়ায় গেলে একটা ঠান্ডা ভাব বুকে আসে।  তেমন আরাম পাখার হাওয়া বা এসিতে হয়না। মানসিক ব্যপার কিনা জানিনা, তবে আমি তো তফাৎ টের পাই দিব্যি! একটা কাঠঠোকরা ঠক ঠক করে কাঠে ঠোঁট ঠুকছে। একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ তেঁতুল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পাড়ে। এহে এটা তো কারোর বাড়ির পথ। এখান থেকে আর কোথাও পৌঁছনো যায়না।




"মা এসেছে?" রাস্তায় একজন জিজ্ঞেস করে আমায়। আমি জবাব দিই, সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করি, সে নাকি মায়ের খুব বন্ধু, গুছুতদিদি বললেই হবে। আবার হাঁটা দিই, অন্য রাস্তা, চিনিনা এ পাড়াটাও। কিছুই চিনিনা আমি, কেমন অন্ধ কালা ভাবে জীবন কাটিয়ে দিলাম সব থাকতেও! আলপথ ধরে হাঁটছি, দুটো চারটে ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, আশ্বিনের রোদের তাত খুব, এখন মোটে সাড়ে নটা তাতেই তেজ দেখো। মাঠের মাঝে একটা কাদের বাড়ি, একটা বউ পিছন ফিরে বসে কী যেন করছে আর বরটা খালি গায়ে প্যান্ট পরে বসে আছে পাশে। একতলা পাকা বাড়ি, উঁচু জানলা, রঙ করা হয়নি এখনো, হবেও না মনে হয়। আলটা একটু চওড়া মত রাস্তায় পরিনত হয়, দুধারে পার্থেনিয়ামের ঝাড়, আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পেরিয়ে যাই, এলার্জি আছে আমার। রাস্তাটা গোঁত খেয়ে একটা পুকুরের পাশ দিয়ে চলেছে, একটা মুদীর দোকানে আলগা ভীড়। তেমন কিছু বিরাট দোকান না, গ্রামের মধ্যে অল্প জিনিস নিয়ে বানানো দোকান, ধারেই চলে যা বেশীরভাগ সময়।  মাচা বেঁধে কতকগুলো জোয়ানলোক তাস খেলছে। খেলা খুব জমে উঠেছে মনে হয়, খুব উত্তেজিত সব, রঙের টেক্কা থাকতে বিবি দিল কেন বলে, রাস্তার ধারে পুকুরে দুজন বউ চান করছে আর দুটো ন্যাংটা ছেলে খেলছে। একটা লোক আর বউ মিলে জরির কাজ করছে, এখানে পুজো নেই। এ পাড়াটা গরীব না বড়লোক জানিনা, তবে সব কটাই পাকা বাড়ি কিন্তু সব কটাই খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। আলো ঢোকে না, মাঝের রাস্তাটাও একটা সরু গলির মত, দুটো মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে। একদিকে কটা ছাগল বাঁধা পরপর। একটা আবার বোকাপাঁঠা, ওইপাশের দাওয়ায় একটা বাচ্ছা মেয়ে শিউলির মালা গাঁথছে, কিন্তু পাঁঠার গায়ের দুর্গন্ধই বেশী। টিউওয়েল থেকে জল পাম্প করছে একজন মাঝবয়সী বউ। সামনে আর যাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করতে, আমি কোথায় যাব খোঁজ নিয়ে বলল, 'এদিক দিয়ে তো বাবা যাওয়া যাবে না, কাদা আছে, ওই দিক দিয়েই যাও"। অ্যাই বলু একে রাস্তা দেখিয়ে দে না।

বলু নামের লোকটা একটা হাতজাল নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে কোথায়, আমায় আয় বলে ডেকে নিল। ওবাবা সামনে যে বিস্তর কাদা! বলুর ভ্রুক্ষেপ নেই, "জুতো হাতে চলে আয়"।  নাহ আমি উল্টোবাগেই যাই।



এদিকটায় কখনো আসিনি, কেমন ঝোপঝাড় ভর্তি। তুলসীমঞ্চ, ঠাকুর বেদী, বড় বড় মাছের হাঁড়ি, এটা জেলেপাড়া মনে হয়। চারটে ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করতে করতে উড়ে গেল, একটা লোক জমিতে সার দিচ্ছে। দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে, একটা এই মোটা জারুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে হাত মেলে।কুকরু কুকরু করে একটা কি যেন পাখি ডাকছে। একটা গাছের নীচে অনেক্ষন বসে থেকে বুকের মধ্যে অনেকটা ঠান্ডা ছায়া ভরে নিলাম। গাছের সাথে কতদিন পর বসা হল! 





Sunday, October 6, 2019

পুজো শুরুর আগে

প্রত্যেকবার পুজো আসে আর আমার সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। ধুতি পরে হনহন করে চলেছে, একটু আগে ঝামেলা করে এসেছে ছেলের দলের সাথে, একটু পরে পদ্মদিদির কাছে ধরা পড়বে, পালিয়ে গিয়ে সারাদিন অভুক্ত থেকে হঠাৎ করে মিলবে পংক্তিভোজন কিংবা যাত্রাদেখা।

হুট করে কাকার হাতে ধরা পড়ে হতাশায় ডুবে গিয়ে সে যখন গরম কাঁচাগোল্লা চিবোয় মসমস শব্দে আমার মন খারাপ হতে থাকে। সেই ছেলেটার সাথেই আমার শিশির ধোয়া শরৎকালের ভোর দেখা হয় এই বৃষ্টিতে মাখামাখি একটাও গাছ, মাঠ,  ঘাস না থাকা শহরে।

সেদিন একটা কাজে ব্যারাকপুর যাচ্ছিলাম। ডানলপ পার হবার অনেক্ষন পর দুপাশের চেহারা  বদলে যায় অল্প অল্প করে। চোখ পড়ে যায় একটা ভাঙা বাড়ির বটগাছে। পাঁচিল ঘেরা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল বাড়িটা। এখন আর কেউ থাকেনা,  আর কদিন পরেই তিনদিক খোলা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন উঠে যাবে। কারা থাকতো এ বাড়িতে? সেই সর্দার ছেলেটার মত পলানে ছেলে ছিল নাকি? বাড়িদের মন খারাপ হয়? এওরকম একটা বাড়ি দেখেছিলাম,  গড়িয়াহাটের কাছে। ঝকঝকে সব বাড়ির মাঝে,  বন্ধ হয়ে ছাদ ঝুলে যাওয়া একটা বাড়ি। এক পা এক পা করে ঢুকেছিলাম আমি, মাকড়সার জাল, পাতার স্তুপ পেরিয়ে। আবছা অন্ধকারে দেখা যায় দেওয়ালের একটা জায়গায় আলমারী জাতীয় কিছু ছিল বলে কেমিন ফ্যাকাসে, দু চারটে বাজে অদরকারী জিনিস....এ বাড়িতে দুর্গাঠাকুর আসবে না।

সেই সর্দারের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই ছেলেটা তো ঘরে ফিরতেই চায়নি, তবু পুজোর সময় সেই ভুল করে ফিরে যাওয়া ছেলেটার গল্পই মনে পড়ে। আর এই বাড়িটা দেখেও মন কেমন করে, ভুল করে বা ঠিক করে ছেড়ে গেছে সবাই। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে বেশ ভোম্বল সর্দার পুজোয় ধরা পড়ে যাবে না, আর এই ভাঙা বাড়ি গুলো ছেলে মেয়ে সব্বাই ফিরে আসবে, হই হই করে আড্ডা হবে, ছুটোছুটি করে খেলতে গিয়ে ছোটদের মধ্যে একজন ব্যথা পাবে,কান্নাকাটি হুলুস্থুল।
প্যারালাল ওয়ার্ল্ড পুজোয় অন্তত সবার পুজো ইচ্ছেপূরনে কাটুক।