Saturday, March 14, 2020

বালীতে কদিন(তিন)

আগের পর্ব

বালীতে এ কদিন সমিদ্র সৈকত দেখলাম, বালিনিজ নাচ দেখলাম, কিন্তু মানুষজন এর সাথে কথা আর হল কই তেমন, রেভো আর সুর্য ছাড়া। এদিকে কোথাও গেলে সেই জায়গার রাস্তায় না হাঁটলে আমার স্বস্তি হয়না, ঘোরাঘুরি ঠিক হয়েছে বলে বোধ হয়না। এদের গান কেমন, সুর কেমন, বাড়ির ভিতরটা কেমন হয়? শান্ত শহরের বুকে ধানক্ষেত দেখেছি,  বিস্তীর্ণ ক্ষেত দেখা হয়নি , পরিষ্কার তকতকে রাস্তা, হর্ণ বাজিয়ে বিরক্ত না করার ভদ্রতা দেখেছি কিন্তু মন চাইছিল অন্য কিছু আরো। বলতেই পারো,  এ কেমন লোভী মন হে তোমার, এত সুন্দর সুন্দর পাহাড়ের ধার থেকে সমদ্র সৈকত, এত চমৎকার নীল জল, পাহাড় পাশে নিয়ে সমুদ্রের মধ্যে বোটে করে দ্বীপে যাওয়া তাতেও মন ভরছে না? আরো চাই? সত্যি বলতে এই তিনদিন চমৎকার কেটেছে, জায়গাটা নিয়ে অভাব অভিযোগ দূরে থাক মন ভরিয়ে দিয়েছে। নুসা দুয়াতে ডিপ সি ডাইভ করেছিলাম, সেইটে খালি তেমন জুতের লাগেনি। ইকুইপমেন্টটা ভালো ছিল না তেমন আর এর চেয়ে ঢের বেশী মাছ আর কোরাল আন্দামানে দেখেছিলাম। যাই হোক আসলে তো বালী মানে স্রেফ এই সমুদ্র না,  এদের সংস্কৃতিও বহু বহু দিনের। আমরা সেসবের স্বাদও নিতে চাইছিলাম। তাই আজ থেকে আমরা কুটা ছেড়ে উবুদেই থাকবো আর উবুদ থেকেই চারপাশ ঘুরবো। উবুদ হল এদের সাংস্কৃতিক রাজধানী। ছোট্ট শান্ত প্রাচীন একটা শহর।


সকাল বেলা আজ প্রথমে যে মন্দিরে গেলাম তার নাম তামান আয়্যুন।  এখানের সব মন্দিরের গেট দ্বিখণ্ডিত দুই খানা প্রতিসম পাথরের। দরজা থাকেনা কোনো। বলা হয়, এই গেট আসলে শুভ আর অশুভের গন্ডী। শিবের সাথে মাউন্ট মেরুর একটা যুদ্ধ হয়েছিল নাকি, আর তারপর তাকে ভাগ করে দেয়।ভাঙাচোরা ইংরিজিতে যতটুকু বোঝা যায় আর কি৷ তামান আয়্যুনে ঢোকার মুখে বিভীষণ বা যক্ষ জানিনা কে, দেখি জবা গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন বেড়াতে গেলে কেমন সুন্দর জামা জুতো পরে পোজ দেয়, আমরা দুজন এই জবা গোঁজা যক্ষ বা বিভীষণ কে ভেঙিয়ে ছবি তুলে বেড়ালাম। বালীর মন্দিরের আরেকটা বিশেষত্ব হল  প্যাগোডা স্টাইলের চূড়া। প্রথমে গেট তারপর পার হয়ে খানিক খোলা চত্বর আর গান বাজনা করার উঁচু জায়গা তারপর পেরিয়ে মূল পুজো করার জায়গা যেটা সেইটাই ওরকম চূড়া করা। বেশ লাগে দেখতে। বালীনিজরা এমনতে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন,  আর এরা দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে মূলতঃ বানিজ্য করেছে বলেই তাদের প্রভাবও বেশী পড়েছে। যেমন প্রতিটা মন্দির অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, দক্ষিণ ভারতীদের মতই নিম্নাঙ্গে সারং জড়িয়ে ঢুকতে হয় প্রতিটা মন্দিরে (তা যদি চালু থাকে)। প্রচুর গাছপালা দিয়ে ঢাকা এই তামান আয়্যুন এর চত্বর। এইটায় অত ট্যুরিষ্ট নেই।  বেশ শান্তি শান্তি লাগে ভীড়হীন জায়গাটা।
এই সে জবাপ্রেমী যক্ষ

বালিনিজ গেট , প্রতিটা মন্দির বাড়িতে ঢোকার মুখে এরকম থাকবেই, আর দূরে সাহেবগুলো সারং পরে চলেছে

মন্দিরে ঢোকার মুখে


ঢোকার পরেই যেসব জায়গায় থাকে অনুষ্ঠানের জন্যে

প্যাগোডা আকৃতির মন্দির।।বালির মন্দিরে বৈশিষ্ট্য

তামান আয়্যুন মন্দির



বালীদ্বীপের আরেকটা দারুন জিনিস হল রাইস টেরেস। মানে পাহাড়ে ধাপ কেটে ধান চাষ। এবং সেটা একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। বালিতে দুটো বিখ্যাত রাইস টেরেস আছে, জাটিলুই আর টেগালালং। এরমধ্যে জাটিলুই উবুদ থেকে একটু দূরে,পাহাড়ের উপর যেতে হবে গাড়ি করে, দূরে বাটিকারু আগ্নেয়গিরি দেখা যায় এখান থেকে। জাটিলুই আবার ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানে যেতে গেলে টিকিট লাগে, প্লাস একটু দূরে তাই এখানে লোকজন কম আসে খানিক। এলেও ভারতীয় লোকজন কম কারন উবুদের একদম কাছেই টেগালালং,  তাছাড়া বেশীরভাগ ভারতীয়দের প্ল্যানে  টেগালালং, কফি প্লান্টেশন, ওয়ানাগিরিতে দোলনায় ছবি তোলা একটা প্যাকেজে থাকে। খারাপ কিচ্ছু না,  কিন্তু আমরা সেটা চাইনি, একটু কম ভীড় তুলনামূলক ভাবে  কম এক্সপ্লোরড জায়গায় ঢুঁ মারতে চেয়েছি, তাছাড়া কফি প্ল্যান্টেশন দেখার চেয়ে আমরা হাইকিং করতে বেশী উৎসাহী ছিলাম। কম এক্সপ্লোরড মানে এমন না একেবারেই লোক নেই, আছে, তবে বেশ খানিক কম। যাই হোক, তামান আয়্যুন থেকে ছায়া ছায়া গাছ ঢাকা রাস্তা দিয়ে চললাম। সরু রাস্তা,  পাশেই জমি,  গ্রামই একটা, কিন্তু বড় সুন্দর বড়ই মনোরম। হর্ণ দেওয়ার প্রশ্নই নেই, ওভারটেকও করেনা কেউ চট করে, রাস্তার দুপাশে জঞ্জাল বা বাইক,ঠেলা রেখেও দেয়নি কেউ। আচ্ছা আমরা এমন হতে পারিনা কেন? স্রেফ পপুলেশন দায়ী না, আমরা আসলে স্বভাবে ইন্ডিসিপ্লিন্ড, নিয়ম ভাঙাতে আমাদের বীরত্ব! তাতে আর পাঁচটা লোকের অসুবিধে হলেও। মাঝ রাতে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বাইক যায় পাড়া কাঁপিয়ে, হর্ণ বাজিয়ে...কোনো দরকার নেই কিন্তু ওই, নিজেকে প্রদর্শন করা হবে কুৎসিত ভাবে হলেও!  

চলতে চলতে মাথায় মেঘ নিয়ে বাটুকারু পাহাড় দেখা দিল, একটা ছোট বসতি অঞ্চল পেরোচ্ছি সে সময়। এখানে প্রতিটা বাড়ি বা দোকানই সকালবেলায় ভগবানের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করে ছোট্ট কলা পাতার তৈরী পাত্রে। নির্দিষ্ট কিছু জিনিস নেই,  আমি সেই উৎসর্গে পয়সা কেবলমাত্র একটি ক্ষেত্রে দেখেছি আর একটাও না। কেউ বিস্কুট দিয়েছে দেখেছি, কেউ দিয়েছে বাতাসা, এমনকি ডিম দিতেও দেখেছি। আমি যা খাই ভগবানকে তা থেকে বঞ্চিত করার কী আছে এমনই ভঙ্গী। ছোট্ট জনবসতিটা পার হচ্ছি যখন সার সার বালীনিজ বাড়ি, আর তাদের সামনে বেদী মত করা সেখানে পুজো নিবেদন করা, সোজা রাস্তার মিট করছে মেঘ মাথায় করা বাটুকারুকে। আহা ভগবান থাকলে এমন ভাবেই থাকা উচিত, রাজার মত, মন্দির এর ঘুপচিতে না ।
এই যে বেদী করে ছোট্ট ছোট্ট হাতে তৈরী ডালা দিয়েছে

দেবতার জন্যে নিবেদিত...রাস্তা

জাটিলুই পৌঁছেই মনটা ভরে গেল। আজ রোদ ওঠেনি, মেঘলা আবহাওয়ায় পাহাড় ঘেরা এই রাইস টেরেস যেন শান্ত করে দেয় বুকের কাছটা৷ সেই নবম শতক থেকে সমবায় পদ্ধতিতে জল বাঁটোয়ারা করে, পার্সিয়ান হুইল ইরিগেশন ব্যবহার  করে। একই পদ্ধতি এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে পাহাড়ের মাথার মেঘগুলো ছুটোছুটি লাগিয়েছে,আমরা টুকটুক করে হাঁটা শুরু করলাম  পাহাড়ি ধান জমির মধ্যে দিয়ে। ছশো একর জমির পুরোটা হাঁটবে অর্থাৎ লং ট্রেক রুট নেবে না শর্ট তা ঠিক করে  তীর চিহ্ন দিয়ে আঁকা পথ ধরে গেলেই হবে। পাথুরে রাস্তা ধরে আমরা শর্ট ট্রেকটাই নিলাম। তাতেও মিনিট চল্লিশের হাঁটা হবে টুকটুক করে। জমিতে মাঝে মাঝে হাওয়া মোরগের মত কি একটা লাগানো আছে, হাওয়া দিলেই ভারী মিষ্টি ঝিরঝিরে একটা শব্দ বয়ে যাচ্ছে।


মাঠে আলো দেবার ব্যবস্থা







মিষ্টি ভাসী হাওয়া ঘন্টি

যেতে যেতে একজন স্কুটার আরোহী চাষীর সাথে মোলাকাত হল। টোকাই, সারং আর মালপত্র নিয়ে সে ফিরছে এখন জমি থেকে।  দূরে একজন লোক সার ছড়াচ্ছে জমিতে। পেঁপে গাছ ছিল একটা রাস্তার পাশে, সেটা দেখে ভারী একটা আপনজন আপনজন ফিলিং হল।  কী অদ্ভুত না! জানিনা সবার হয় কিনা কিন্তু নিজের দেশে গাছ, ফুল দেখলে ভারী একটা আহ্লাদ হয় বিদেশে। আরো কয়েকধাপ নামতে পাহাড়ের কোলে একটা লোক ছাউনি বেঁধে বাজনা বাজাচ্ছে। জলতরঙ্গের মত,ঝিরঝিরে বাতাসের মত এদের বাজনার আওয়াজ। সে আওয়াজে মন্ব বেশ একটা প্রসন্ন,  হালকা স্ফূর্তির ভাব আসে। একথা শুনে মনে হতে পারে হুড়ুমদুড়ুম পাঞ্জাবী পার্টি সং বলছি হয়ত, তা না কিন্তু একেবারেই,ভারী মোলায়েম একটা ভাব। আমি বাজনা বাজাতে পারিনা, রাগ সঙ্গীত বুঝিনা বলে বোঝাতে পারলাম না সঠিক করে। সে যাই হোক, আরো খানিক এগোলে, খুঁটি বাঁধা ছোট্ট দু চারট্র দোকানে হরেক রকম চাল,  ডাব, চালের পাঁপড় এসব বিক্রী হচ্ছে। আমরা কিসের একটা পাঁপড় মত কী একটা কিনলাম যেন, মন্দ না, খুব আহামরি কিছুও না।
পাথুরে পথ এবার চড়াই, নালা দিয়ে জল আসছে বাঁ হাতে ডান হাতে জঙ্গল থেকে পাখির কিচমিচ ভেসে আসছে রাস্তায় আর কেউ নেই স্রেফ আমরা দুজন। দূর থেকে জাটিলুই এর হাওয়া ঘন্টির আওয়াজ আসছে টিংটিংটুংটাং করে, সব মিলিয়ে মনে একটা শান্ত দুপুর বুকের মধ্যে স্থায়ী আস্তানা গেড়ে নেয়।




বাজনদার





চাষীর সাথে আলাপ করছিলাম ফসল নিয়ে🤴 





ছাতা উঁকি মারছে...আমাদের আর রোমান্টিক ছবি হবে কী করে!



রেভোর সাথে ফের চলা শুরু। উলুন দানু বেরাতন লেক মন্দির যাব। এইটা একটা হেব্বি  লোকেশনে। পিছনে পাহাড়, সেই পাহাড়ে মেঘের দল হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। পাহাড়টার পা ধুইয়ে দিচ্ছে লেকের জল আর  লেকের পাড়েই এই মন্দির। বেরাতন লেক খুবই গুরুত্বপূর্ণ  এদের, সেচ আর জল সাপ্লাইতে। তাই জন্যেই মনে হয় এই মন্দিরটায় ভীড় বেশী। প্রচুর লোক সাদা সারং আর কুর্তা পরে পুজো দিতে এসেছে ডালি নিয়ে। বুদ্ধ স্তুপের মতও আছে এক জায়গায়। মেইনলি এটা শিবের মন্দির।তবে এখানের কোনো মন্দিরেই মূল গৃহে প্রবেশে অনুমতি নেই পর্যটকদের জন্যে। সেটা স্রেফ "অফারিং টু গড" এর জন্যে।







ওয়ানাগিরি জায়গাটাও বড় সুন্দর, ওটা পার করেই যেতে হয় বন্যুমালা ওয়াটার ফলস। ফেরার সময় দাঁড়াবো একবার ওয়ানাগিরিতে আপাতত বন্যুমালাই হোক। বন্যুমালাতেও লোকজন বেশী যায় না। ওয়াটার ফলস মানে ভেবেছি, পাহাড়ের গোড়ায় গাড়ি নিয়ে গিয়ে থামাবে। তারপর দু কদম গেলেই পাবো, ওবাবা তা নয় মোটেও! যেখানে থামলো গাড়ি, তার থেকে বেশ খানিক উৎরাই ভেঙে পৌঁছনো গেল এক জায়গায় যেখানে লেখা "ওয়েলকাম টু বন্যুমালা",  পাশেই কাঠের ছোট্ট ঘরে টিকিট কাটছে দু চারজন। ঐ খান থেকে এইসান উঁচু উঁচু সিঁড়ি ( প্রায় কোমরসমান একেকটার সাইজ) ভেঙে নামতে লাগলাম। খানিক পর সিঁড়ি একেবারে খাড় নেমে গেছে, কিন্তু নেমে নেমে যাচ্ছে কোথায় রে বাবা। এই পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে আবার ওরে বাবা! সেও না হয় হল কিন্তু আর তো পথ নেই সামনে মনে হচ্ছে! দূরে কোথায় একটা জলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে বিটে কিন্তু সামনের রাস্তাটা তো জলে ভেজা,  ফার্নে ঢাকা মনে হচ্ছে। এখানের পর রাস্তা কই?! থমকে দাঁড়াই এদিক ওদিক দেখি, আর তো কোনো রাস্তা দেখাও যাচ্ছে না! তাহলে? দোনোমনা করে এগিয়ে গেলাম। ময়ূরাক্ষীরই হঠাৎ চোখে পড়ল, 'আরে ওই দেখো,  ওইতো কোন থেকে ফের নেমে গেছে রাস্তা।' দূর থেকে আসা জলের আওয়াজ এর সাথে মিশে যাচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়া টুপটুপ জলের শব্দ।ফার্ন, মস ঢেকে দিয়েছে পাথুরে দেওয়াল, রাস্তা ক্রমে আরোই পিচ্ছিল আর খাড়াই নামা। সমস্ত এলাকাটা সবুজে ঢাকা, জঙ্গল এর মধ্যে আসলে এই প্রপাতটা। বনের মধ্যে থেকে তীব্র শব্দ আয়াছে একটা পোকার ডাকের। এছাড়া আর কোনো শব্দ নেই সমস্ত চরাচরে। কিরম আচ্ছন্ন লাগছিল। অবশেষে পৌঁছনো গেল। এটাকে জলপ্রপাত বলাটা বাড়াবাড়ি, বড় ঝর্ণা বলা যেতে পারে। অনেকগুলো ধারা আছে অবশ্য। জলটা এসে একটা গোল মতো জায়গায় জমা হয়ে তারপর পাহাড়ি নালা হয়ে নেমে আছে। পুরো জায়গাটায় সেই পোকার আওয়াজটা ছাড়া আর কেউ নেই। ওই জলে অবগাহন করতে হয়। ডুব দিতে হয় এই পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে। কতক্ষন পরে কে জানে আরো দুজন এলো। এর মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হক টুপটুপ করে। ফেরার পথে আরো পিচ্ছিল হয়ে গেছে সব জায়গাটা। আরো নিস্তব্ধ যেন। আদিমকালের কোনো দুপুর যেন, জঙ্গল আর আকাশ ছাড়া যেখানে আর কোনো উপাচার নেই, প্রকৃতি নিজেই যেন ডুব দিয়েছে নিজেতে।


আমরা

ছবিতে আসলে বোঝাই যাচ্ছেনা কত সুন্দর ছিল জায়গাটা


রাস্তা

গাড়ির কাছে অব্দি আসার পথে দেখা হল এক চাষীর সাথে। সে একবিন্দুও ইংরেজি বোঝে না, তার জমিতে কী চাষ হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম সে কী যেন বলল, দুজনেই হেসে চলে গেলাম যে যার রাস্তায়। এ মন্দ না তাই না? কেউই কিছু বুঝলাম না, অযথা কথাও হল না। ফেরার পথে ওয়ানাগিরিতে একবার থামা গেল। পাহাড় আর লেক মিলে এখান থেকে ভিউটা চমৎকার।  দোলনা, ইত্যাদি আছে ছবি তোলার জন্যে, কিন্তু হাইকিং করে জলে ভিজে আমাদের চেহারা বেশ খোলতাই হয়েছে তখন। খামোখা পয়সা দিয়ে অমন কাকতাড়ুয়া ছবি তোলানোর দরকার নেই।  বরং শান্ত হয়ে দু চোখ ভরে পুরো প্রেক্ষাপটটা দেখতে বেশী আনন্দ।  কানের মধ্যে বুকের মধ্যে তখনো আসলে বন্যুমালার শান্তিটা রয়ে গেছে বলেই হয়ত....
(ক্রমশ)

Monday, March 9, 2020

বালিতে কদিন (দুই)

আগের পর্ব

সীবীচ গুলোর নামগুলো সব অদ্ভুত -গুনুং পায়ুং, পাদাং পাদাং! নাম যাই হোক বীচগুলো খুবই সুন্দর। সুন্দর তকতকে,  নীল জল। আমরা খান চারেক বিচ দেখলাম তারমধ্যে মেলাস্টি আর ড্রিমল্যান্ড বিচ দুটো বেশী চমৎকার, বাকি দুটোও দিব্যি।  মেলাস্টি যাওয়ার মুখে একটা ক্লিফ আছে, দুই খানা পাহাড় যেন প্রতিবেশী। এই যে হরেক কিসিমের লোক যায়, ছবি তোলে দেখে মজা নেয় রাত ঘনিয়ে আসলে পরে  তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে নিজেদের মধ্যে"মানুষ গুলোর এই লঘুচিত্ততা কবে যাবে বলতো! একটা মুহূর্ত আটকে রেখে দেবে একটা  ছবির মধ্যে তাও কী হয়!" আমরা অবশ্য লঘুচালের লোক, তাই বিস্তর ছবি তুলে নিলাম। আজ আমাদের ড্রাইভার ছিল রেভো, সে নিজে থেকেই পোজ দাও পোজ দাও বলে ছবি তুলে দিলো অনেক কটাই।


এখানে আসার আগে একটু পড়াশোনা করেছিলাম। তাই কেচক ডান্স এর কথাটা মাথায় ছিল। এটা হয় উলুয়াটু (uluwatu) মন্দিরের ওপেন এয়ার অডিটোরিয়ামে,বিকেলে শুরু হবে ওটা। মন্দিরটা এগারোশ শতকে বানানো, একটা পাহাড়ের উপর। পাহাড়ের ঠিক নীচেই সমুদ্র এসে আছড়ে পড়ছে। ভয়ানক রোদ উপেক্ষা করেই পাহাড়ের গা ধরে পাথর দিয়ে তৈরী উঁচু নিচু রাস্তা ধরে চলছিলাম ও বাব্বা পাঁচ ছটা কচি আর গোদা হনুমান পাঁচিলে বসে খুব আড্ডা দিচ্ছে দেখি! আমাদের দেখে মুখ ভ্যাংচায়নি, কিন্তু গোদাটা কেমন সন্দজনক ভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল দেখে আমরা আবার রিরুট করে নিলাম। চড়া রোদ্দুর, ভেবেছিলাম গাছাপালার মধ্যে দিয়ে যাব,  নাহ বাবা থাক!




গুটিগুটি পায়ে ওপেন এয়ার অডিটোরিয়াম এর দিকে এগোতে দেখি এর মধ্যেই বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। রেভো আমাদের টিকিট কেটে রেখেছিল, পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উঁচু দেখে একটা জায়গায় বসে গেলাম। ব্যাকগ্রাউন্ডটা ঘ্যামা মাইরি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সমুদ্রের বুকে, এগারোশ শতকের একটা পাথুরে মন্দিরে বসে, প্রায় একশো বছর আগের একটা নাচ দেখতে বসেছি! কেচক ডান্স কেন বলে তার কারনটা নাচ শুরু হতে বোঝা গেল, এখানে কোনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয়না। একদল লোক এক নাগাড়ে গান,  তাল, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে গেল খালি গলায় আর সেজে গুজে রামায়নের তিনটে অংশ অভিনয় করে গেলেন আর কিছু কুশীলবরা। চ্ক্চ্ক্চ্ক্চ্ক্...এরম করে একটানা মন্ত্রের মতো বলেই যাচ্ছিল লোকগুলো , কেচক শুনতে লাগে একটানা শুনলে। সব মিলিয়ে ভারী অন্যরকম একটা দৃশ্যকল্প যেন।মারীচ ছদ্মবেশে রামকে বোকা বানালো, নকল আর্তনাদে সীতা চঞ্চল হয়ে লক্ষনকে বকে ধমকে পাঠালো, রাবন বুড়োর ছদ্মবেশে সীতাকে চুরী করলো, জটায়ু বাধা দিলো, তারপর রামের অনুনয়ে হনুমান লাফ দিয়ে সীতার কাছে অঙ্গুরীয় পৌঁছে লংকা কান্ড ঘটালো এসবই হলো ঐ লোকগুলোর চকচকচকচকচচক্াচক্া এরকম অদ্ভুত ধ্বনি আর মাঝে মাঝে কিছু অন্যরকম সুর গলায় তুলে। এদের দেশেও রাম দেখি বাঙালীর রামের মতোই পত্নীপ্রেমে কেঁদে ফেলা নরম সরম রাম। হনুমান এদের লেঙ্গুর এর মতো দেখতে। সীতাকে পাহারা দেওয়া রাক্ষসীরা নাচানাচি করে থাকে। সীতা হয়েছিল যে মেয়েটি তাকে ভারী চমৎকার দেখতে। সব শেষে হনুমান যখন নেচেকুঁদে মঞ্চ মাতাচ্ছে আগুন জ্বালিয়ে, সূর্য তখন লাল হয়ে ডুব দিচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ডে।




ফিরতি পথেও কানের মধ্যে যেন ওই চক্চক্চক্চক্চক্চক্ ধ্বনি হয়েই যেতে লাগল....






আমাদের হোটেলের রেস্তোরাঁটাও বেশ চমৎকার,  রাতের খানা ওই গোরেং চাম্পুরই নেওয়া গেল। কাল সকালে আবার সকাল সকাল ওঠা আছে। হানিমুনে এসে সকাল ছটায় বেরোয়! আমরা মনে হয় খুবই হাবা টাইপ, পইপই করে রেভোকে বললাম,  একটু পরে গেলেও তো হয়, নাহয় নটার বোট নেবো, আটটার না, আর যদি আটটার বোটও নিই তাহলেও সাতটায় বেরোলেই হবে তো! কিছুতেই মানলো না,  অনেক দরাদরাইর পর সাড়ে ছটায় রফা হল। 

আরিব্বাস এই সাত সকালেও ম্যালা লোক উঠে পড়েছে দেখছি! পরে বুঝেছি যদিও, আসলে রোদ চড়া হয়ে যায় কিনা, তাই সকাল সকাল বেরোলেই সুবিধে। আজ নুসা পেনিডা যাব।ওটা আরেকটা আইল্যান্ড, বোটে করে যেতে হবে। বোটের টিকিট কেটে রেভো আমাদের টাটা পরে আক্ষরিক অর্থেই জলে নামিয়ে দিল! জেটি নেই, জল ঠেলেই বোটে চড়তে হবে।  বাঁ পাশে মাউন্ট আগুং কে রেখে একটা ছিমছাম দ্বীপে আমাদের বোট ঠেকলো। এখানে অন্য এক ড্রাইভার আমাদের ঘোরাবে। সে ছেলেটি ইংরেজি প্রায় বোঝেই না। এদিকে আমার তো হাঁ করা স্বভাব। চারদিকে গাছপালা বাড়ি  মন্দির পাহাড় যাইই দেখি হাবলার মতো জিজ্ঞেস করতে থাকি এটা কি সেটা কি, সে তো কিছুই বোঝে না সম্পূর্ণ উল্টো কোনো জবাব দেয়!  খানিক বাদে রনে ভঙ্গ দিয়ে পৌঁছলাম  যে জায়গাটায় তার নাম এঞ্জেল বিলাবং। তার ঠিক পাশেই আছে ব্রোকেন বিচ। চড়চড়ে রোদ উপেক্ষা করেও হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়েছিল অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য পটের জন্যে। 


ঘন নীল জল আর ঝকঝকে নীল আকাশ তার সাথে একটাও নোংরা পড়ে না থাকা পাহাড়ের ধার। এসব জায়গায় হেব্বি হেব্বি হবি ওঠে, ক্যামেরার হাত বিশেষ ভালো না হলেও প্রকৃতিই পোজ দিয়ে ভালো ছবি আদায় করে নেয়। মানুষদের ছবিও ভালো ওঠে, তবে আমরা দুজনেই  খানিক হাবলা মত, আর আমরা অমন পিকচার পারফেক্টও না। তাই আমরা নিজেরা হেব্বি কেত মেরে যে সব ছবি তুললাম তা ওইসব জায়গায় লোকজন যা ছবি তোলে তার তুলনায় নেহাতই পরোটা কাবাব পাশে চারাপোনার ঝোল। তবে আমরা অত দুঃখ পাইনা, আমাদের ভোমলা ছবিতে দিব্যি আনন্দ হয়।  আর অমন চমৎকার জায়গায় গেলে অত পোজ দেবার থেকে হাঁ করে দেখতেই বেশী ভালো লাগে। ব্রোকেন বিচটা আরো ভালো, পাহাড়ের শিলা ক্ষয়ে ক্ষয়ে ন্যাচারাল ব্রিজ তৈরী করেছে আর জলটা নীচ দিয়ে এসে যে পাহাড়ের উপর আমরা দাঁড়িয়ে তারই গোড়ায় এসে আটকে গেছে। 





বোকার মত হাওয়াই চটি পরে বেরিয়েছিলাম আজ। জানা ছিলো না এখানে পাহাড়ি রাস্তা বাইতে হবে। ঘামে ভিজে হাওয়াই চটি  ফস ফস করে বেরিয়ে যাচ্ছে, ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে গেঞ্জি তাতেও উৎসাহ কম নেই আমাদের,paluang cliff থেকে একটা পাহাড় নামলেই  kelingking beach। ওই হড়কানো পা নিয়ে নীচে আর নআ সম্ভব হল না। আমরা উপর থেকেই উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিলাম। উঁকিঝুকি না মেরেও উপায় নেই, এখানে প্রচুর লোক এসেছে, মূলতঃ চীন বা কোরিয়া (আমি ঠিক বুঝিনি),  তারা আবার বেশীরভাগ ইনস্টাগ্রামার। ফলে,  সে নানানরকম ভাবে পোজ দিয়ে, বেঁকেচুরে ছবি তুলিয়েই যাচ্ছে,  এমনকি একজন দেখি গাছের উপর উঠে ছবি তুলে দিচ্ছে!! এদের নমো করে ফেরার পথ ধরলাম। 


লাঞ্চে একটা লোকাল রেঁস্তোরায় গিয়ে ফের নাসি চাম্পুর আর মি গোরেং এর একটা অন্য ভার্শন খাওয়া গেল। মানে নামটা আলাদা ছিল, আমি ভুলে গেছি সে নাম।


ভরপেট খেয়ে কেউ সমুদ্রে নামে? নামে না তো? কিন্তু আমরা দুই হাবল, আমরা অত্যন্ত সুন্দর সি বিচ দেখেই ক্ষান্ত দিতে রাজি না, এমন চমৎকার জলে নাইবো না মনোভাব! আজ সুইমিং কস্টুম আনেনি ময়ূরাক্ষী, তাতেও আমরা দমিনি, বিচে পোশাক বিক্রী করছিল একজন, তার থেকেই কিনে চেঞ্জিং রুম ভাড়া করে, ক্যামেরা টাকার ব্যাগ, পাসপোর্ট সব ড্রাইভারের হাতে তুলে   জলে নেমেই....ঘপাৎ। মানে আর কিছুই না ঢেউ এর জোর খুবই, আর তলাতেও বালি না, মরা কোরাল। কী জানি কেমন করে সাহেবগুলো এমন আরাম করে ঢেউ এর তালে স্নান করতে পারছিল! আমরা মনের দুঃখে থেবড়ে বিচের গোড়ায় বসে বসে সে কথাই বলছি অমনি ফের একটা বদমাশ ঢেউ এসে বসা অবস্থাতেও ফেলে দিলো মাইরি!! ক্ষোভে দুঃখে হতাশায় আমরা তুরতুর করে ফের চানের ঘর ভাড়া করতে ছুট। তবে এখানে এ জিনিসটা ভালো, সীবিচ সংলগ্ন জায়গায় চেঞ্জিং রুম আর শাওয়ার রুম ভাড়া পাওয়া যায়। 

ফেরার পথে হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি! বেশ তীব্র,  সরু পাহাড় ঘেরা রাস্তায় সে বৃষ্টি অদ্ভুত লাগছিল। ড্রাইভারের হাত বেশ ভালো হতে হবে এখানে গাড়ি চালাতে।একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। দু পাশে আমাদের দেশেরই গাছপালা বেশীরভাগ, কিন্তু বাড়ি গুলো সংলগ্ন মন্দির দেখলেই টের পাওয়া যায় দেশে নেই। এমন  মন্দিরের টেক্সচার আমাদের দেশে হয়না। 


আবার সমুদ্রের ধার আবার জল পেরিয়ে পাড়ে ওঠা। রেভো দাঁড়িয়ে ছিল, হাসিখুশি দিব্যি এই ছেলেটা। গাড়ি চালাতে চালাতে  মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়ে।  জিম্বারনে সি বিচে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে সু ফুড খাওয়া নাকি হেব্বি ব্যাপার না করলে চরম মিস! আমাদের ঘোরাটা আমরা ওই চরম মিস ব্যপারগুলো রাখতেই হবে এমন করে বানাইনি। তাই আমরা এমন সব জায়গায় গেছি যা ওই টিক মার্ক মার্কা গুলোর সব হয়তো নেই। জিম্বারনও ছিলো না, কিন্তু সূর্যাস্তের খানিক দেরী ছিল, হোটেলে ঢোকার থেকে সি বিচে যাওয়া বেশী ভালো,  রেভোও বলল চলো ভালো লাগবে তোমাদের। সুতরাং গেলাম সেখানে। এখানে পুরো বিচটাই কোনো না কোনো রেস্তোরাঁ নিয়ে রেখেছে, ফলে খাবার খেতে খেতে সূর্যাস্তটা অপশনাল না ম্যান্ডেটরি। জ্যান্ত কাঁকড়া,  বা বরফে শোওয়ানো মাছ যা খুশী চুজ করা যায় ওজন হিসেবে অথবা প্ল্যাটার নেওয়া যায়। আমরা দুজন মিলে অত খেতে পারব না ভেবে,  ওজন হিসেবে কিং প্রন, কাঁকড়া আর কিং ফিশ বেক করতে দিলাম। আস্তে আস্তে সমুদ্রের রঙ বদলাতে লাগলো, আকাশে মেঘ আছে তাও তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে হরেকরকম রঙ চুবিয়ে দিতে লাগলো। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, ওরা মোম জ্বালিয়ে গেল টেবিলে টেবিলে। একদল লোক এসে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাতে লাগলো...খারাপ লাগছিলনা কিন্তু তাও আমরা এক পা দু পা এগিয়ে আলো,  গান থেকে খানিক সরে ঢেউএর কাছে গেলাম। ঢেউএর গর্জনে অন্ধকারে বালির আরেকটা দিন মিশে গেল।(ক্রমশ)