ছায়াতাল বলতে বলতেই মনে পড়লো, এ লেখা লিখছি যখন, উত্তরাখন্ডের হিমবাহ গলে যাওয়া ঘটে গেছে।আমরা শুকনো নদী পেরিয়ে সিকিমের পথে চলার সময় দেখেছিলকম মরা নদীর কংকালে কেমন মানুষ পোকারা বাসা বেঁধেছে, নোংরা থিকথিকে। উত্তরাখন্ডের নদীগুলোর ওই দশা করতে গেছিলো, টানেল করে স্বাভাবিক নদীপথ বদলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ গড়ে ভূপ্রকৃতি বদলে উন্নয়ন আনতে চেয়েছি তার দাম দিয়েছে কাজ করতে আসা শ্রমিক, কতদিনের প্রাচীন গ্রাম। যারা ওই নদীর জলে পুষ্ট হয়েছে এতদিন, ক্ষীন স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো, তাদের নদী ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা উড়ে গেছে হঠাৎ করে গলে যাওয়া হিমবাহের জলে, নতুন তৈরী হওয়া তালে।
প্রকৃতি আমাদের কাছে আয়ের উৎস, তাকে দোহন করে আমাদের রবরবা তাকে আদর যত্নটুকুও করতে আমাদের কষ্ট। গাছ কেটে, নদী শুকিয়ে, আবর্জনায় ভরিয়ে দিয়ে আমাদের উন্নতি হতে পারেনা তা কি না বোঝার মতো বোকা আমরা? নাকি আমরা ওই ফ্রায়েড ফ্রগ সিনড্রোমে আছি সব্বাই। আরেকটু কম নিঃশ্বাস নিয়ে, আরেকটু কম সবুজে, কটা প্রাণ জলাঞ্জলি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিচ্ছি! সত্যি সত্যি সময় এসেছে চাকা ঘোরাবার, এত উন্নয়ন, এত সভ্যতার কোন প্রয়োজনটা আছে! বটলড ওয়াটার না খেয়ে নদীটাই যদি পরিষ্কার রাখতাম? একটু কম বিলাস যাপন করে, একটু কম আরামে থাকলে এত ক্ষতি হত কি? আর হলে হত, কিছু তো করার নেই। এতো পেয়ে, এত দৌড়েও লাভ ঠিক কী হচ্ছে? শান্তি নেমেছে কি? রোজ একটা স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে মনে হচ্ছে এটা ছেড়ে কিভাবে ছিলাম।অথচ দিব্যি ছিলাম!
বেড়ানোর গল্প করতে গিয়ে অনেক বেলাইনে কথা ছোটালাম। অবশ্য আমার ব্লগের পাঠক কেউইই নেই, নিজে নিজে কথা বলি নিজে নিজেই শুনি, আর বেড়ানোর গল্পে পরিবেশের সংকট এর কথাও থাকুক। না হলে আমাদের সাধের সোনার ডিম পাড়া ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিও আর ডিম পাড়বে না। ছায়াতাল এর কাছেই একটা গেট আছে ভার্সে স্যাংচুয়ারির। এমনি লোকে খুব একটা যায়না, তাই কেউই ভালো বলতে পারছে না, কোথায় সে জায়গা। অবশেষে একজন পথ বাতলালো সিকিমিজ ভাষায় নরেনকে। সে আমাদের একটা জায়গায় নামিয়ে বলল ওই তো উপরে উঠে যান, মিল যায়েগা। সে একটা সরু সুঁড়িপথ, পাহাড় বেয়ে উঠছে। এখানেই সত্যি? হাঁটিহাঁটি পা পা করে এগোনো গেলো,এক ঝাঁক রঙ বেরঙের চঞ্চল পাখির ওড়াউড়ি, তাদের কিচকিচ ছাড়া আর শব্দ নেই কিছু। বাঁশের গাছ, ঝরে পরা পাতায় মচমচ শব্দ করে যত উঠছি বন যেন তত অপরূপ হচ্ছে। রডোডেনড্রনের সময় না এখন, কিন্তু জঙ্গল রিক্ত না। পাতা লাল হয়ে যাওয়া গাছ, কতদিনকার প্রাচীন সব ফার্ণ জড়ানো গাছ দেখতে দেখতে দেখি একটা ভাঙাচোরা ঘরে, পাশে একটা পাকা পরিত্যক্ত ঘরের পাশে একটা গেট ভার্সের ভিতর ঢুকছে। কেউ কোথাও নেই। চুপচাপ একটা দুপুর জঙ্গলে শুয়ে আছে। আমরাও নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছিলাম না। হাঁ করে করে আদিম গাছ গুলো দেখতে দেখতে হাঁটছি, মাঝে মাঝে জলের আওয়াজ আসছে এদিক সেদিক থেকে, পাহাড়ি ঝোরা। কতক্ষন হেঁটেছিলাম জানিনা, তেরচা করে আসা রোদে পাখির ছবি তোলার চেষ্টার ফাঁকে খেয়াল হল, আমাদের নামতেও হবে। আমরা তো পুরোটা ট্রেক করবো বলে আসিনি। সেই কতদিন আগে এর আরেক পারে এসেছিলাম, সেই সব গাছ, ভার্সের ট্রেকার্স হাটের কাছে সেই চ্যাটালো পাহাড়টা,মিংমা, রাতের কুকুরগুলো সবার খবর নিলাম আলগোছে গাছেদের কাছে। চিৎকৃত শব্দের প্রয়োজন মানুষের। গাছেরা জ্ঞানী হয় তাদের এসব লাগে না। কিন্তু তাদের উত্তর বোঝার জন্য এমন অল্প সময় সংপৃক্ত থাকলে হয়না। আবার আসবো দেখো, প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলে আসি।
ফার্মিং এর শখ আমার বড়। কিন্তু আমার সব শখই কল্পনায় বেশী আসলে কম। এইখানে একজন পাহাড়ি মানুষ ফার্মিং করেছে একটা পাহাড়ের ঢালে। সে কত রকম গাছ, এলাচ,কফি,পীচ,কমলালেবু, পেয়ারা,আনারস। এলাচ গাছে টিপটিপ করে জল পড়ছে, ওইদিকে কমলালেবুতে বুলবুলি এসে বসছে, ওই লোকটার বউ আচারের শিশি সাজিয়ে রাখছে রোদে। আহা এমন একটা জীবন হলে মন্দ হয়না। এমন পাহাড়ে হবে না, তাহলেই পাহাড় কেজো হয়ে যাবে। প্রেমে খানিক অকাজ না থাকলে চলে না। কিংবা কে জানে হয়তো থাকতে থাকতে, কাজের মধ্যে পাহাড় আরো কাছের হয়ে যাবে। পাশাপাশি থাকলে মায়া তো কমেনা,বাড়েই বরং। লোকটা আবার অর্গানিক ওয়াইন বানায়। সব কটা চেখে টেখে পেয়ারারটাই সব চেয়ে ভালো লাগলো। ওয়াইন আমি অত বুঝিনা, স্বাদে ভালো লেগেছে মানে এটা হয়তো সব চেয়ে কমজোরি ওয়াইন! কে জানে। পীচ ফলের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে নীচের উপত্যকা দেখতে দেখতে সত্যি বলতে জীবনকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দিতে ইচ্ছে করে। সারাদিন কত না পাওয়া নিয়ে অস্থির করি, এই নেই সেই নেই,ওই হলো না, কত কি যে হয় তার হিসেব করিনা।
ফার্মে আসার আগে একটা মনস্ট্রি গিয়েছিলাম, পাহড়ি গাঁয়ের মন্সট্রি যেমন হয়, ছোটখাটো, ছায়া ছায়া অন্ধকার, বৌদ্ধ দেব দেবী, পিতলের প্রদীপ। তার একটু উপরেই কার যেন সমাধি, চুপ করে ঘুমিয়ে আছে পাহাড় জঙ্গলের মাঝে। রিনচেনপঙ গ্রাম হলেও খাবারের জায়গা আছে। গ্রাম না বলে হয়তো ছোট গঞ্জ বলা ভালো। নরেনই নিয়ে গিয়েছিলো, একটা খাবার দোকানে। দোতলায় উঠতে দেখি স্থানীয় লোকজন দিব্যি মোমো আর বিয়ার নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া পার করে জানলার ধারে একখান জায়গায় বসা গেলো। পাশের টেবিলে এক পুলিশ সাহেব তার অধস্তন লোকজন নিয়ে এলো দেখলাম। নাহ খাবার ভালোই হবে এখানে। আচ্ছা অধস্তন দেখলে কেমন বোঝা যায় না? আমাদের দেশে এই সামন্তপ্রথা বড়ই জোরালো, কর্পোরেট হোক কি গাঁয়ের পুলিশ প্রভুবাদ থেকেই যায়। যাকগে যাক, গরম গরম মোমো এসে গেছে, অত তত্ত্বকথায় মন দেবার থেকে তাতেই দেওয়া যাক। (ক্রমশ)