Friday, February 19, 2021

অনেকদিন পরে পাহাড়ে(দুই)

 ছায়াতাল বলতে বলতেই মনে পড়লো, এ লেখা লিখছি যখন, উত্তরাখন্ডের হিমবাহ গলে যাওয়া ঘটে গেছে।আমরা শুকনো নদী পেরিয়ে সিকিমের পথে চলার সময় দেখেছিলকম মরা নদীর কংকালে কেমন মানুষ পোকারা বাসা বেঁধেছে, নোংরা থিকথিকে। উত্তরাখন্ডের নদীগুলোর ওই দশা করতে গেছিলো,  টানেল করে স্বাভাবিক নদীপথ বদলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁধ গড়ে ভূপ্রকৃতি বদলে উন্নয়ন আনতে চেয়েছি তার দাম দিয়েছে কাজ করতে আসা শ্রমিক, কতদিনের প্রাচীন গ্রাম। যারা ওই নদীর জলে পুষ্ট হয়েছে এতদিন, ক্ষীন স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো, তাদের নদী ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা উড়ে গেছে হঠাৎ করে গলে যাওয়া হিমবাহের জলে, নতুন তৈরী হওয়া তালে।  


প্রকৃতি আমাদের কাছে আয়ের উৎস, তাকে দোহন করে আমাদের রবরবা তাকে আদর যত্নটুকুও করতে আমাদের কষ্ট। গাছ কেটে, নদী শুকিয়ে, আবর্জনায় ভরিয়ে দিয়ে আমাদের উন্নতি হতে পারেনা তা কি না বোঝার মতো বোকা আমরা?  নাকি আমরা ওই ফ্রায়েড ফ্রগ সিনড্রোমে আছি সব্বাই। আরেকটু কম নিঃশ্বাস নিয়ে, আরেকটু কম সবুজে,  কটা প্রাণ জলাঞ্জলি দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে নিচ্ছি! সত্যি সত্যি সময় এসেছে চাকা ঘোরাবার, এত উন্নয়ন,  এত সভ্যতার কোন প্রয়োজনটা আছে! বটলড ওয়াটার না খেয়ে নদীটাই যদি পরিষ্কার রাখতাম? একটু কম বিলাস যাপন করে, একটু কম আরামে থাকলে এত ক্ষতি হত কি? আর হলে হত, কিছু তো করার নেই। এতো পেয়ে, এত দৌড়েও লাভ ঠিক কী হচ্ছে? শান্তি নেমেছে কি? রোজ একটা স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে মনে হচ্ছে এটা ছেড়ে কিভাবে ছিলাম।অথচ দিব্যি ছিলাম! 


বেড়ানোর গল্প করতে গিয়ে অনেক বেলাইনে কথা ছোটালাম। অবশ্য আমার ব্লগের পাঠক কেউইই নেই, নিজে নিজে কথা বলি নিজে নিজেই শুনি,  আর বেড়ানোর গল্পে পরিবেশের সংকট এর কথাও থাকুক। না হলে আমাদের সাধের সোনার ডিম পাড়া ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রিও আর ডিম পাড়বে না। ছায়াতাল এর কাছেই একটা গেট আছে ভার্সে স্যাংচুয়ারির। এমনি লোকে খুব একটা যায়না, তাই কেউই ভালো বলতে পারছে না, কোথায় সে জায়গা। অবশেষে একজন পথ বাতলালো সিকিমিজ ভাষায় নরেনকে। সে আমাদের একটা জায়গায় নামিয়ে বলল ওই তো উপরে উঠে যান, মিল যায়েগা। সে একটা সরু সুঁড়িপথ, পাহাড় বেয়ে উঠছে। এখানেই সত্যি? হাঁটিহাঁটি পা পা করে এগোনো গেলো,এক ঝাঁক রঙ বেরঙের চঞ্চল পাখির ওড়াউড়ি, তাদের কিচকিচ ছাড়া আর শব্দ নেই কিছু। বাঁশের গাছ, ঝরে পরা পাতায় মচমচ শব্দ করে যত উঠছি বন যেন তত অপরূপ হচ্ছে। রডোডেনড্রনের সময় না এখন,  কিন্তু জঙ্গল রিক্ত না। পাতা লাল হয়ে যাওয়া গাছ, কতদিনকার প্রাচীন সব ফার্ণ জড়ানো গাছ দেখতে দেখতে দেখি একটা ভাঙাচোরা ঘরে, পাশে একটা পাকা পরিত্যক্ত ঘরের পাশে একটা গেট  ভার্সের ভিতর ঢুকছে। কেউ কোথাও নেই। চুপচাপ একটা দুপুর জঙ্গলে শুয়ে আছে। আমরাও নিজেদের মধ্যে কোনো কথা বলছিলাম না। হাঁ করে করে আদিম গাছ গুলো দেখতে দেখতে হাঁটছি, মাঝে মাঝে জলের আওয়াজ আসছে এদিক সেদিক থেকে, পাহাড়ি ঝোরা। কতক্ষন হেঁটেছিলাম জানিনা, তেরচা করে আসা রোদে পাখির ছবি তোলার চেষ্টার ফাঁকে খেয়াল হল,  আমাদের নামতেও হবে। আমরা তো পুরোটা ট্রেক করবো বলে আসিনি। সেই কতদিন আগে এর আরেক পারে এসেছিলাম, সেই সব গাছ, ভার্সের ট্রেকার্স হাটের কাছে সেই চ্যাটালো পাহাড়টা,মিংমা, রাতের কুকুরগুলো সবার খবর নিলাম আলগোছে গাছেদের কাছে। চিৎকৃত শব্দের প্রয়োজন মানুষের। গাছেরা জ্ঞানী হয় তাদের এসব লাগে না। কিন্তু তাদের উত্তর বোঝার জন্য এমন অল্প সময় সংপৃক্ত থাকলে হয়না। আবার আসবো দেখো,  প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলে আসি।






ফার্মিং এর শখ আমার বড়। কিন্তু আমার সব শখই কল্পনায় বেশী আসলে কম। এইখানে একজন পাহাড়ি মানুষ ফার্মিং করেছে একটা পাহাড়ের ঢালে। সে কত রকম গাছ, এলাচ,কফি,পীচ,কমলালেবু, পেয়ারা,আনারস। এলাচ গাছে টিপটিপ করে জল পড়ছে, ওইদিকে কমলালেবুতে বুলবুলি এসে বসছে, ওই লোকটার বউ আচারের শিশি সাজিয়ে রাখছে রোদে। আহা এমন একটা জীবন হলে মন্দ হয়না। এমন পাহাড়ে হবে না, তাহলেই পাহাড় কেজো হয়ে যাবে। প্রেমে খানিক অকাজ না থাকলে চলে না। কিংবা কে জানে হয়তো থাকতে থাকতে, কাজের মধ্যে পাহাড় আরো কাছের হয়ে যাবে। পাশাপাশি থাকলে মায়া তো কমেনা,বাড়েই বরং। লোকটা আবার অর্গানিক ওয়াইন বানায়। সব কটা চেখে টেখে পেয়ারারটাই সব চেয়ে ভালো লাগলো। ওয়াইন আমি অত বুঝিনা, স্বাদে ভালো লেগেছে মানে এটা হয়তো সব চেয়ে কমজোরি ওয়াইন! কে জানে। পীচ ফলের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে নীচের উপত্যকা দেখতে দেখতে সত্যি বলতে জীবনকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া দিতে ইচ্ছে করে। সারাদিন কত না পাওয়া নিয়ে অস্থির করি, এই নেই সেই নেই,ওই হলো না, কত কি যে হয় তার হিসেব করিনা। 


ফার্মে আসার আগে একটা মনস্ট্রি গিয়েছিলাম, পাহড়ি গাঁয়ের মন্সট্রি যেমন হয়, ছোটখাটো, ছায়া ছায়া অন্ধকার, বৌদ্ধ দেব দেবী,  পিতলের প্রদীপ। তার একটু উপরেই কার যেন সমাধি, চুপ করে ঘুমিয়ে আছে পাহাড় জঙ্গলের মাঝে। রিনচেনপঙ গ্রাম হলেও খাবারের জায়গা আছে। গ্রাম না বলে হয়তো ছোট গঞ্জ বলা ভালো। নরেনই নিয়ে গিয়েছিলো, একটা খাবার দোকানে। দোতলায় উঠতে দেখি স্থানীয় লোকজন দিব্যি মোমো আর বিয়ার নিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়া পার করে জানলার ধারে একখান জায়গায় বসা গেলো। পাশের টেবিলে এক পুলিশ সাহেব তার অধস্তন লোকজন নিয়ে এলো দেখলাম। নাহ খাবার ভালোই হবে এখানে। আচ্ছা অধস্তন দেখলে কেমন বোঝা যায় না? আমাদের দেশে এই সামন্তপ্রথা বড়ই জোরালো, কর্পোরেট হোক কি গাঁয়ের পুলিশ প্রভুবাদ থেকেই যায়। যাকগে যাক,  গরম গরম মোমো এসে গেছে, অত তত্ত্বকথায় মন দেবার থেকে তাতেই দেওয়া যাক। (ক্রমশ)










Saturday, February 13, 2021

অনেকদিন পরে ...পাহাড়ে(এক)

 এক বছর আগে কোভিড নিয়ে কথাই হয়নি প্রায় আর এই এক বছরে কোভিড ছাড়া কথাই হয়নি প্রায়।  এত আনপ্রেডিক্টেবল জীবনে হাঁটুর জোর, ধকল নেবার ক্ষমতা মাত্র কিছু বছর অব্দি, তার মধ্যে যদি এক বছর নষ্ট হয়ে যায়,  পাহাড়ে না হেঁটে কেটে যায় তাহলে বেজায় দুঃখের মশাই।


এক বছরটাকে আর বাড়তে দেওয়া যায়না।  থাকি একখানা ছোট ফ্ল্যাটে বয়স্ক বাপ মা এর সাথে সুতরাং চাইলেই যা ইচ্ছে হোক বলে বেড়ানো যায়না। কিন্তু চিনিপ্রেমীদের  কথা চিন্তামনি ভেবে না রাখলে তার ব্যবসাও লাটে ওঠে। রানীগঞ্জের  আস্তানাটাই কাজে লাগানো যাবে ফেরার পর, কটা দিন কাটিয়ে আসলেই হল। মোহরের জন্মদিন আর আমাদের অ্যানিভার্সারি মিলিয়ে একটা পাহাড় সফর করে ফেলাই যায়৷ জানি জানি আপনারা হাসছেন খুব, ভাবছেন প্রথমবার বলেই এতো ফুত্তি প্রাণে, তা প্রথম বছর তো সত্যিই আশ্চর্যজনক একটা ব্যপার। একজন মানুষ জন্ম আলাপের কারনে বা কাজের সূত্রে বেঁধে থাকার কারনে পাশাপাশি থাকা না , এসবের বাইরে একজনের  সাথে সারাক্ষন থাকার  , রাগ, অপমান, আনন্দ দুঃখ সব ভাগ করে নেবার  এই অবাক ব্যপারটা সেলিব্রেট করতেই হয়। তবে আমার মতে সব কটা বছরই এমন আশ্চর্যজনক হয়, হওয়া উচিত। নিজের নিজের মতো করেই উদযাপন হলে তাতে হাসির কিছু দেখিনা। 


 কোভিড এর কারনে কিছু এক্সট্রা ব্যপার , মানে হাতের কাছের পাহাড়ে ট্রেনের বদলে ফ্লাইট আর নিজেদের চাদর ইত্যাদি বওয়া! ও এই ফাঁকে একটু বলে নেওয়া ভালো, ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের কথা আমাদের মাথাতেই আসেনি, তাতে খরচ খানিক কম আর আরাম একটু বেশীই হত। সকাল সাড়ে ছটার ফ্লাইট ছ ঘন্টা দেরীতে দৌড়নোয় মাথায় এসেছিলো সেসব। বেড়াতে বেরোনোর আগের রাতটা ছোটবেলার মতোই উত্তেজনার হয় কিন্তু। বোর্ডিং পাস এলো কিনা, ব্যাগেজ ট্যাগ নাকি আজকাল দিচ্ছেনা? সাদা কাগজে চিপকে নে রে, স্যান্ডেল জোড়া কাল সকালে মনে করে ভরতে হবে। ভোর বেলার এলার্ম, অন্ধকার মাখা রাস্তা পেরিয়ে অনন্ত অপেক্ষা। শেষমেশ সত্তিকারের বাগডোগরা থেকে বেরোনোর সময়েই নেতিয়ে পড়েছি প্রায়। আজকের প্ল্যান চৌপাট অলরেডি। দিন পাঁচেকের সফর আমাদের এবারে,  প্রথম দেড় দিনের জন্য রাখা ছিলো কালুক। পশ্চিম সিকিমের ছোট্ট একটা গ্রাম। পেলিং এর কাছে কিন্তু "সেরকম কিছু দেখার নেই" বলেই হয়তো তেমন ভীড় হয়না। ভাগ্যিস! তা আজ তো পৌঁছতেই সন্ধ্যে নেমে যাবে। যাকগে ভেবে লাভ নেই। এয়ারপোর্টের বাইরেই বীরেনের গাড়ি অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য। বেচারি সেই কোন সকালে এসেছে আমাদের নিতে তারপর এতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলো অথচ এতটুকু বিরক্ত না, এমন ধৈর্য্য, ভদ্রতাবোধ সকলের মধ্যেই থাকলে জীবন বোধহয় আরেকটু সহজ হতো! কিংবা কি জানি পাহাড়ের কাছে খোলা প্রকৃতির কাছে থাকে বলেই হয়তো এদের উদারতা বেশী হয়, গিজগিজে ভীড়ের মধ্যে ছোট্ট চৌখুপীতে থাকতে থাকতে আমাদের মধ্যে সংকীর্ণতা বেশী। মেল্লি পৌঁছে থামা গেলো খানিক। এখান থেকে সোজা গ্যাংটক চলে যায়। একটু আগে কালিম্পং এর দিকে রাস্তা চলে গেছে, আর এখান থেকেই জোড়থাং হয়ে সিকিমের বিভিন্ন দিকে যাওয়া যায়। এর আগে ওখরে যাবার সময় এই রাস্তা ধরে এসেছি। নীচে তিস্তা। চারপাশের চেহারা বদলে গেছে অনেক আগেই, সবুজে মোড়া পাহাড়,  পাহাড়ি মানুষ,  ঠান্ডা কনকনে জল, গরম ধোঁয়া ওঠা নুডলস আর চা মন চনমনে হবার আর কি চাই?

    

 মন চনমনে হলেও পৌঁছতে পৌঁছতে নেতিয়ে গেছিলাম। সেই কোন সকালে উঠেছি, রাতেও উত্তেজনায় ঘুম হয়নি ভালো, পাক খাওয়ানো এই রাস্তা সব মিলিয়ে ভারী হা দশা হয়েছিলো। সন্ধ্যের অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চড়িনি আগে তেমন স্মরনকালে, এক একটা বাঁক পেরোচ্ছি আর আলো কমছে একটু একটু করে তারপরই ঝুপ করে সন্ধ্যের অন্ধকার। সে বদলটা চোখে না দেখলে আমার মতো কারোর পক্ষে বোঝানো মুশকিল। আঁকতে জানলে, রঙ তুলির জ্ঞান থাকলে তাও খানিক বোঝানো যেত। গাড়িতে অতটা বোঝা যায়নি, হোটেলে নেমে টের পাওয়া গেল ঠান্ডাটা কেমন।  বাপ্রে বাপ। আমার একটা কোট আছে, বেজায় গরম আর আরাম হয় ঠান্ডায়, তেমনই কদাকার দেখতে। তা আমার বাপু কদাকারই ভালো, নিজের চেহারাই বা এমন কি যে জ্যাকেটের চেহারা নিয়ে মাথা ঘামাবো! সে জ্যাকেট আর এদের একখানা উমদা ওয়েলকাম ড্রিংক শীত রোধ করায় বেরোনো গেলো বারান্দায়। সামনে পেলিং, গেজিং এইসব শহরের ঝিকিমিকি আলো, ঝুপসি হয়ে থাকা গাছেদের অবয়ব কনকনে ঠান্ডাকে উপেক্ষা করিয়ে দেয় একটু হলেও।  খানিকক্ষণ ঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হোটেলের সামনের দিকে এসে দেখি একখানা চাঁদ উঠেছে চমৎকার।  আহাহা আরো কিই বা চাওয়ার থাকে। কালুক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা চমৎকার দেখা যায় তবে আমার কাছে পাহাড় মানে পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেলে তো তো কথাই নেই, না পেলেও দুঃখী হয়ে থাকার ব্যপার নেই। পাহাড়ের গা দিয়ে হাঁটবো,  পাহাড় মাখবো এইই তো অনেক। আর আমার সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার আলাদাই সম্পর্ক!  সেও দেখা দেবে না আমিও ফিরে ফিরে আসবো। কিন্তু এবারে পাহাড় দেখেছে আমি আর একা একা তার কাছে আসিনি, তাই আমার সাথে লুকোচুরি খেলার দুষ্টুমিও করেনি। বরং যুগলকে প্রথমবার দেখার জন্য, উপহারই দিয়েছে। 



পরের দিন সকাল বেলাতেই সেই উপহার জানলার পর্দা সরাতেই! কাচঢাকার জানলার ওপারে সবুজ গাছপালার উপর আর নীল আকাশের নীচে সাদা ঝকঝকে পুরো হিমালয়ান রেঞ্জ!!! এটা অবশ্য আমার গিফট না আজ মোহরের জন্মদিন উপলক্ষেই গিফট নিশ্চয়ই।

 

 তবে পাহাড় অত কৃপন না,  একে দিলে ও নিতে পারবে না এমন ছ্যাঁচড়ামি করা পাহাড়ের স্বভাবে নেই। এই হোটেলটা দিব্যি,  আলাদা আলাদা কটেজ আছে ফলে খাবার জায়গা  ছাড়া অন্য জায়গায় লোকজনের মুখ না দেখলেও চলে। নিজেদের কমলালেবু, কিউই, বাতাবীলেবু এসবের গাছ টাছ আছে।  সবমিলিয়ে চমৎকার একটা সকাল। আহা এখানেই বেশ থেকে যাওয়া যেত। যাবে না জানি, অত পরিশ্রম করা সইবে না আমাদের, সুখী সুখী "যদি থেকে যাওয়া তে" টাইপ ভাবনাতেই আনন্দ আর কি।



 বীরেনের ভাই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিলো। নাইন পয়েন্টস সেভেন পয়েন্টস দেখবার তাড়া আমাদের ছিলো না, সে ইচ্ছে নিয়ে আসিওনি। এসেছি স্রেফ ফাঁকা একটা জায়গায়, পাহাড়ি রাস্তায়, রোদ ছায়ার সাথে,  পাখির ডাক শুনতে শুনতে, হাঁটতে।  কালুক জায়গাটায় বাজার মতো খানিক থাকলেও, আমাদের হোটেলটা তফাতে খানিক, সেখানে বাজারের কোনো কোলাহলই কানে আসার চান্স নেই। কালুকের পাশেই রিনচেনপঙ নামেই আরেকটা ছোট্ট গ্রাম আছে, আর এদিকে ছায়াতাল বলে আরেকটা সুন্দর ছোট গ্রাম। খানিক দূর গেলে পেলিং পড়বে, তবে আমরা পেলিং যেতে চাইনা, সিংসোর ব্রিজ না, কিচ্ছু না। এই রিনচেনপঙ, তার ছোট্ট মনস্ট্রী, ছায়াতাল আর সেখানে ভার্সে স্যাংচুয়ারির একটা গেট আছে, সেই গেট থেকেই ভার্সের দিকে খানিক যাবো। বীরেনের ভাই নরেন প্রথমে বুঝতে পারেনি ভালো কোথায় যেতে হবে, সে নিয়ে গেছে একটা পার্ক মতো জায়গায়। সেটা আসলে একটা পাহাড়ের মাথায় ওদের এক রাজার স্ট্যাচু বানানো, মানুশশের তৈরী ওই স্ট্যাচু দেখেই মুখ কুঁচকে না করেছি। তারপর কি মনে হল, চলো যাওয়াই যাক। পাহাড়ের মাথায় স্ট্যাচু, পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে ওঠার রাস্তা। দূরে গাছপালার মধ্যে একটা গ্রামে জল তোলার আওয়াজ আসছে খালি আর কোত্থাও কোনো আওয়াজ নেই। ওহ না ভুল বললাম,  দু চারটে ভারী চঞ্চলমতি পাখি এদিক সেদিক উড়ছে আর টুই টুই করে ডাকছে। ভাগ্যিস পার্ক ভেবে এড়িয়ে যাইনি। ভারী চমৎকার জায়গাটা, আমরা দুজন ছাড়া আর লোক নেই, ফলে,  "এই বাবুনদা এদিকে আয়, ছবি তুলবো" কিংবা "একটা সিগারেট হবে নাকি ঘোষদা" এইসব অত্যাচারে শান্তিভঙ্গ বা রসভঙ্গ হবার চান্স নেই। হ্যাঁ মানছি আমরাও ট্যুরিস্ট কিন্তু পাহাড়ে গিয়ে একটু পাহাড় বুকের মধ্যে না নিয়ে ওইরকম কলতান যারা করে তাদের আমি নমো করি দূর থেকে।  দূর থেকে ছায়াতাল লেক, পাহাড়ি ঘর বাড়ি খেলনার মতো একটু খানি হয়ে দেখা যাচ্ছিলো। আহ এই রাজাটা বেজায় ভালো জায়গায় দাঁড়ারে পেয়েছে তো। (ক্রমশ)