Friday, December 30, 2022

ইয়ার এন্ড - ব্যলান্স শিট

বছর প্রায় শেষ হতেই চলল।মানে ক্যালেন্ডার ইয়ার। আমার জন্মদিনের বছর থেকে ধরলে সবে শুরু, ফিনাশিয়াল ইয়ার ধরলে ঢের দেরী,  আপিসের ইয়ার শেষ হওয়া ধরলেও সবে মাঝ বয়স। ক্যালেন্ডার ইয়ারের হিসবেই ভাবা যাক। মাঝে মাঝেই ভাবি জীবনের উদ্দেশ্য কী? ভেবে কূল পাইনা তেমন। ঋকানন্দ মহারাজের তো সাধনায় সিদ্ধি হয়নি এখনো, তাই বুঝেই পাইনা এই যে জীবন খানা পাওয়া গেছে এ নিয়ে ঠিক কী করার ছিল আমার?  সেদিন বন্ধুদের আড্ডায় সবাই আওয়াজ দিচ্ছিলো যখন,  আমার কথায় কথায় চল বেড়াতে যাই নিয়ে আমিও খুব বলছি তামাশা করে, "না না,  বেড়ানো আবার কেন! ওসব ভাল্লাগেনা, সারা সপ্তাহ কাজ করবো,  উইকেন্ডে শপিং মলে যাবো কিংবা কাছাকাছি সাজানো রিসর্টে, ফূর্তি করে মদ টদ খেয়ে ফিরে আসবো। বেড়ানো ওই বছরে একবার গেলাম কিংবা দু বছরে, অত বেড়ানো ভাল্লাগেনা"। লিখতে লিখতেই শিউরে উঠছিলাম! ওরে বাবারে,  এ কী লিখছি! এ জীবন বাঁচে  বহু লোকে, তাদের সেটা চয়েস  অবশ্যই কিন্তু এ জীবন আমি পেলে পাগল হয়ে যাবো। বেড়ানো মানে ঘর থেকে বেরিয়ে এলোমেলো রাস্তা ধরে হাঁটা কিংবা কাছাকাছি কোনো গাছেদের মাঝে কিংবা জলের কাছেতেও ধরি অবশ্য আমি। সুতরাং ব্যালেন্স শীটের খাতায় বেড়ানোটাই আগে ধরা যাক। তা হয়েছে, অনেকদিনের স্বপ্নের জায়গা দেখা হয়েছে এবারে।   উদয়পুর, চিতোর, মাউন্ট আবু, সামসিং, লাদাখ, রাঁচী, নেতারহাট আর অজন্তা ইলোরা, আওরাঙ্গাবাদ; ঐতিহাসিক জঙ্গল পাহাড় ।   এছাড়া খুচরো ঘোরাঘুরি গুলোকে ওড়ালে হবে না, ওরা আমার রোজের মাছভাজা, না পেলে প্রান আনচান করে। ওই যে আমাদের আশ্চর্য পিকনিকটা, কিংবা,  শীতের কোলকাতা ঘোরা, কিংবা রাত জেগে বন্ধুর পাড়ায় ঠাকুর দেখা, কিংবা ভ্যাপসা গরমে দু উজবুকের ড্যামের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা, বটগাছের তলায় বসে গরম কচুরিতে কামড়, বর্ষার জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় উঠতে গিয়ে ঝিঁঝির ডাক, বর্ষায় ভেজা আমলামেথি নামের গ্রামটা, অচেনা আশ্রমে হুট করে পেয়ে যাওয়া মধ্যাহ্ন ভোজন, গ্রামের রথের মেলায় বৃষ্টিতে ভেজা...  কম নয় কোনোটাই। 


আমার এক হাফ বন্ধু,  মানে পরিচিতের একটু বেশী কিন্তু বন্ধু মানে যদি বিপদের দিনে পাশে পাবে ভাবো তেমন না ,    তা সচারাচর বেশীরভাগ পরিচিতই তাইই হয় তবু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত এদের জন্যেও তো মেলে তাই এ নিয়ে অভিযোগ নেই। তা যা বলছিলাম, সে ভারী মনঃকষ্টে থাকে, তার জীবনই এতো জটিল কেন, এত সমস্যা তারই কেন হয়। যেমন অনেকেরই আমাদের মনে হয়, ইনফ্যাক্ট হয়ত আম্বানির ব্যাটারও হয়। আসলে চোখের সামনে হাতের পাতা ধরলেও তা পাহাড়প্রমান হয়ে দাঁড়ায় কিনা, অমন মনে হয়।  আমারই কত্ত সময় মনে হয়েছে যে জিনিসটা লোকে না ভাবতেই পায় তার জন্য এত দৌড় কেন করতে হয়, কেন আমার বেলাতেই টিকিট কাউন্টার বন্ধ হয়ে যায়, আমাকেই কেন একটা কাজে চারবার দৌড়তে হয়? রাগ হয়, মন খারাপ হয়, তারপর তর্ক যখন শান্ত হয়,  আঁচরদাগা বন্ধ হলে দেখি আরে খালি কোথায় হে, ঝোলা তো ভরেইছে দিব্যি। হ্যাঁ সবার ঝোলা কী আর এক জিনিসে ভরে, চেয়ে দেখ রে ব্যাটা তোর ঝোলায় যা ভরেছিস তা দাম দিলেও তো মেলে না সব সময়! তা ঝোলা বলতেই মনে হল,  মানুষের মন এক চায় করে এক এমন দলেই পড়ি আমি। ইচ্ছে আমার ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে যাই, দু চার দানা যা জোটে তাই নিয়েই চলুক দিন পাহাড়ে, নদীর ধারে, রাস্তায় কিন্তু  করার বেলায় দেখো! ঝোলা নিয়ে তাঁবু গেড়ে বসে গেলে।  আরে ও কী তোমার সয়! এক জায়গায় অনেকদিন রয়ে গেলে ঘাস,  জল সব যে পুরোনো হয়ে যাবে! চেনা জলে তেষ্টা মিটবে,প্রাণ জুড়োবে কি? সুতরাং এ বছর ঝোলা তুলে নেওয়া হল। নতুন চলা সব সময়েই অনিশ্চিত,  আকর্ষক একটু সন্দেহাকুল, তাও চলা তো বন্ধ করা যায় না।


সে অর্থে প্রতি বছরই কিন্তু কিছু কিছু পেয়ে থাকি বছরের থেকে। কোনো বিক্রিয়ার শেষ কী জানতে হলে হাবিজাবি কাজ করে যেতেই হয় যেতেই হয়, নয়ত অনন্ত অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকতে হয় কী রেজাল্ট আসবে? প্রসেস চলাকালীন মনে হয় ধুস শালা এ কী করে চলেছি,  তারপর এক সময় জিনিসটা শেষ হলে একবার ড্রোন ভিউতে দেখলে বোঝা যায় অতটা খারাপও ছিল না পুরো ব্যপারটা।  জীবন কখন থেমে যাবে কে জানতে পারে, কখন কী দেবে তাই বা কে বলতে পারে কিন্তু প্রতিটা গবেষক, প্রতিটা ঐতিহাসিক প্রতিটা পথিক জানে শুরুর আগের সেই অকূলপাথার ভাব, পথের শ্রম  কিন্তু  পার হয়ে গেলে ওই পথটাই ভরসা জোগায়, আনন্দ দেয়....নতুন বছর আসুক সব অনিশ্চয়তা সব ভরসা নিয়ে।এ বছরটার মুচকি হেসে বলছে একবার তাকাও হে শুরুটা খুব নিশ্চিন্তের ছিল না, কিন্তু তাও তোমার যাত্রাকেমন হল বলো? ধন্যবাদ জানাই হে, অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই।


Sunday, December 18, 2022

প্রি-ওয়েডিং

কাল চার বন্ধু শীতের রোদ মেখে ময়দানে আড্ডা মারছিলাম। এক বন্ধু মাফিন বানিয়ে এনেছিল, মাফিন আর কফি খাওয়া শেষ করে উঠবো ভাবছি, দেখি ফ্রি তে শো দেখা যাচ্ছে। প্রি ওয়েডিং করবে দুজন। বৈদিক অবৈদিক, নৈতিক,  বামাচারী,  দক্ষিণাচারী, ঐতিহাসিক, অনৈতিহাসিক কোনো বিয়ে দেখতেই আমার ভাল্লাগে না। যারা বিয়ে করে তাদেরকে অবশ্য খুব ভাল্লাগে কারন তারা বিয়ে করে বলে চাট্টি ভালো খাওয়া যায়। ভালো কাবাব কিংবা ফিশফ্রাই কিংবা পাতুরি কিংবা মাটন আর পছন্দসই মিষ্টি পেলেই হল আমার।  কিন্তু  এই প্রি ওয়েডিং দেখতে সেই লাগে!  আহাহা একজন লাল মশাল জ্বালাবে,  একজন বোঁ করে ঘুরবে আর এই থার্মোকলের থালা ভরা ময়দানে ব্লেজার আর গাউন পরে তারা হাসিমুখে পোজ দেবে বার কুড়ি একই ভাবে। 

ব্যাস প্রিওয়েডিং হচ্ছে দেখেই থেবড়ে বসে পড়েছি আবার। আমি আবার ব্যালকনি সীট পেয়েছি। মানে আমার সোজাসুজিইই হচ্ছে ঘটনাটা। একগোছা সূর্যমুখী ফুল নিয়ে হবু বর বউ হেঁটে যেতে যেতে ফস করে পিছনে ছুঁড়ে ফেলবে এই হল বিষয়। এবার কেন ফেলবে তা আমি জানিনা হয়ত দেখতে ভালো লাগে সিনেমা হয়ে আসবে যখন। কিন্তু মুশকিল হল ময়দানের হাওয়া তো তা জানে না, ফলে ফুল আর সোজাসুজি পরেইনা,  কোনাচে হয়ে যায়, তাতে ফটোগ্রাফার খুব উত্তেজিত এরকম করে করে সূর্যমুখী ফুল যখন ভাবছে," আমি কেন জন্ম নিয়েছিলাম ভাই! আর যদি নিয়েইছিলাম এদের বিয়ে হবারই কী দরকারছিল, কেনই বা আমাকেই চুজ করল! গোলাপ দিয়েই কাজ সারতো না হয়। শালার দল!" 
সে সময় আমরাও বোর হয়ে বিয়ের ভিডিওর গান নিয়ে আলোচনা করছিলুম। মানে সে কী সব ভয়াবহ ক্রিয়েটিভিটি ভাই! বন্ধুদের একজনের বিয়ে হবার সময় গান দিয়েছে, "যদি আরো কারে ভালোবাসো, যদি আরো ফিরে নাহি আসো, তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুঃখ পাই গো"!!! মানে সত্যি কী ভেবে এটা দিয়েছিল ফটোগ্রাফার টিম?! বিয়ে হচ্ছে না পরকীয়ার পারমিশন এগ্রিমেন্ট হচ্ছে হ্যাঁ??! তার বিয়েতেই,  মেয়ে বাড়ি থেকে যাবার সময় গান দিয়েছিল, " ভরা থাক স্মৃতি সুধায়...", মরে যাচ্ছে না রে ভাই,  বিয়ে করে ফূর্তিতে কাটাতে যাচ্ছে!! তবু ভালো সমুখে শান্তিরও পারাবার দেয়নি! তারপর শুনি, একজনের বিয়েতে নাকি একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি দিয়েছিল। "হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী" এর সাথে মালাবদলের এরকম মেলানো দেখলে, ক্ষুদিরাম শোকেই মারা যেতেন।
   আরো একটা শোনা গেল, লীলাবালি গান দিয়েছে এক বন্ধুর  বিয়েতে, তবে,  ছেলেটার যখন গায়ে গামছা জড়িয়ে গায়ে হলুদ হচ্ছে, সেময়, ছেলেকে ফোকাস করে,  গানবাজছে, "ভর যুবতী সই মোর..." আর তারই বিয়েতে, রিসেপশনে, তুমিই আমার সিরিজ প্রেমের শেষটা ছিল, তবে সেই লাইনে ক্যামেরার ফোকাস ছিল, ছেলেটার এক্সের উপর! ক্যামেরাম্যান বেঁচে ছিল এটাই যথেষ্ট!

যাইহোক এসব ফক্কিগিরি করতে করতে এতো জোরে হাসাহাসি করেছি, হবু বর বউ এর ফোকাস নষ্ট ক্যামেরাম্যান বিরক্ত, ফুল ফেলে তারা অন্যদিকে রওনা দিল।আর তাদের অভিশাপেই কিনা কে জানে, এ সিজনের আমার একমাত্র বিয়ের  নেমতন্ন আজ এদিকে ফাইনাল খেলা...
স্ট্রাগল করা কাকে বলে দেখে যাক প্লেয়াররা... হুহ

Wednesday, November 30, 2022

কোনো একদিন...

অক্টোবর ন তারিখে লাস্ট পোস্ট দিয়েছি এখানে। তারপর এক মাসেরও বেশী সময় কেটে গেছে,  আমার হাড়েও পঁয়ত্রিশ হেমন্তের পাতা পড়েছে। মাঝে কিছু খুচরো লিখেছি বটে কিন্তু তা এখানে দেওয়া হয়নি। অথচ এখানেই দেওয়া উচিত ছিল। ব্লগ শুরু করেছিলাম এরকমই এক পাতা ঝরা সময়ে। বিদেশে থাকতে হাতে লম্বা সময় থাকতো, সেটাই কথা না শুধু,  নতুন জিনিস দেখতে দেখতে লিখতে ভেবেছিলাম কোথাও আমারও বলার আছে। তারপর আর কি, লম্বা সময় পেরিয়ে গেল ফেসবুক এসে হানা দিলো, ব্লগে পোস্ট কম হল কিন্তু তারপর একদিন ফেসবুকটাও অত্যধিক নেশা বলে দুম করে ছাড়লুম। তাতে হল কি, ব্লগও বন্ধ, ফেসবুকও বন্ধ লেখাও বন্ধ। এমন না আমি না লিখলে সাহিত্য জগৎ থমকে যাচ্ছে,  চারদিকে হাহাকার পড়ে যাচ্ছে এসব কিচ্ছু না কিন্তু নিজেকে ভালো রাখতে গেলে মশাই নিজেকে দু চারটে মিথ্যে বলতে হয়, তারমধ্যে, এই ব্লগ চালিয়ে যাবার টোটকা হিসেবে দু চারটে নির্দোষ মিথ্যেও ঢুকে যায় আর কি। 

বাজে বকায় যদি নোবেল থাকতো অনেক বাঙালীই তার দাবীদার হতো (অন্য প্রদেশ বা দেশের লোকের সাথে মিশিনি তো তেমন জানিনা তাই),  তো সেই বাঙালীর মধ্যেও আমিই বেশী দাবীদার হতাম এ আমি জানি। এতক্ষন ধরে চাট্টি বাজেই বকেই চলেছি দেখছি। যাই হোক, আজকাল বেশীরভাগ সময় গাছপালায় ঘেরা মফস্বলে  , ঘর থেকে আপিস হয়ে এ সুবিধে হয়েছে। আমার কাজের টেবিলটা জানালার ঠিক পাশেই, চোখ মেললে একটা তরুণ শালগাছ, তার পাশেই একটা নিম, আর তার ওপারে একটা ঝামড়ি মতো গাছ, ভালো দেখা যায় না কিন্তু হনুমানের দল প্রায়ই ওই গাছটায় আসে,  ডাল পাতা ভাঙে, লাফালাফি করে ফের চলে যায়। শাল গাছের এ দিকটা ইলেক্ট্রিকের তার গেছে, মাঝে সাঝে দোয়েল,  বুলবুলি ফিঙে আসে। কাঠবিড়ালিও আসে তবে আজকাল কম দেখছি। আমি চিরকাল অমনোযোগী,  বয়স হওয়ায় তা কমেছে এমন না, আমার মন ওই জানলার বাইরেই সারাদিন ঘুরফির করতে থাকে। একটু বেলায়, যখন বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়, পায়রাগুলো বকম বকম করে সারাদিন ভরিয়ে রাখে। কীসের এত বক্তব্য কে জানে! ওদের জরুরী আলোচনার মাঝেই একটা দুটো শুকনো পাতা খসে পড়ে। শীত প্রায় সমাগত। হেমন্তের শেষের এই সময়টা বড় উচাটনের। আমার ভালো লাগেনা কাজে মন দিতে, নিশির ডাকের মতো পথ আমায় ডাকে। 

শনিবারের দুপুরে বেরিয়ে পড়া গেল। নদীর ধারে যেতেই ইচ্ছে করছে খুব, তা আমারও টেলিপ্যাথির যোগ কম নয়, কোথায় যাবো কোথায় যাবো করতে করতেই, দেউলের সন্ধার জানালো ময়ূরাক্ষী। অজয় নদীর পাশেই। তাহলে চল পিকনিক করি। পিকনিক? দুজনে?! 
হওয়ালেই হয়! ছোট বয়স থেকেই বন্ধু বান্ধব কম আমার, আসর জমানো লোক আমি নই কোনোকালেই। জীবন আমায় শিখিয়ে দিয়েছে আনন্দের উপকরণ এমনিই চারদিকে ছড়িয়ে আছে, দল বলো, কোনো বিশেষ ব্যক্তি বলো, মিসফিট  ফিল করা, অপমানিত হওয়া,  উপেক্ষিত বোধ করা কিংবা একেবারে মধ্যমনি হওয়া এসবই পার্ট অফ লাইফ হয়ত, কিন্তু এরাই লাইফ এমন নয়। জীবন ঠিক কী তা বুঝিনি বটে কিন্তু কেমন যেন টের পাই এসবই আলগা পাথর, এসবের বাইরে একটা কিছু । তাই পিকনিক করতে ইচ্ছে করলে করো, একা একাই করতে পারো যদি চাও তো। শুধু ওই ইচ্ছেটুকুই সব নয় অবশ্য, খানিক উদ্যমও লাগে। তা বেড়াতে বেরোলে আমার উদ্যোম খানিক বাড়ে বটে। সৌভাগ্যক্রমে,  ময়ূরাক্ষীও আনন্দ কুড়োতে জানে। সুতরাং একটা ফ্লাস্কে গরম জল ভরা গেল, চা এর দোকান পেলেই ফেলে দিয়ে চা ভরা হবে। ফ্রিজ কুড়িয়ে দুটো কমলালেবু মিলল। তা পিকনিক করবো নদীর চরে একটা চেককাটা চাদর নেই? দেখা গেল নেই,  যেমন হয় আর কি অগোছালো মধ্যবিত্ত জীবনে। কিন্তু আমরা দমি নাকি! একটা পর্দা না তোষকের কাপড় ছিল রাখা, তাকেই নেওয়া হল। কেক তো মাস্ট, সেও ওই চায়ের দোকান থেকেই কেনা হবে খন। একটু স্যান্ডউইচ থাকতে হত বটে, কিন্তু আগের দিন আমরা ফ্রিজ ফাঁকা করে খেয়ে নিয়েছি,  তাছাড়া স্যান্ডউইচ বানাবার সময়েও পাওয়া যায়নি।আর গান শুনবো না আমরা? আমাদের দুজনের গানের গলা অসাধারণ সে কথা না, লোকসমক্ষে গাওয়া যায়না বলে আমরা আড়ালে গেয়েই থাকি কিন্তু পিকনিকে একটু অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া যাক নাকি? সুতরাং একটা ব্লুটুথ নেওয়া হল। 

ব্যাস আর কি, দুপুরবেলায় দুজনে চল্লুম। গুগলম্যাপকে পুরো ভরসা না করলেও এটা মোটামুটি জানা যাচ্ছে ওই মোটামুটি পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন কিলোমিটার মোটে। পিকনিকের মূল নিয়ম কী জানা আছে তো? কিছু প্ল্যান অনুযায়ী হবে কিছু গোলমাল হবে। আধুনিক পিকনিকে অবশ্য টাইমে টাইমে লুচি তরকারি মিষ্টি,  চিকেন পকোড়া, এলাহি লাঞ্চ সব চলে আসে কিন্তু ওগুলো সব নকল পিকনিক। যাইহোক, আমরা অনেকদিন পর এরকম বেরোচ্ছি তাতেই আনন্দে দশ কিলোমিটার মতো যেতেই বেজায় খিদে পেয়ে গেল। সুতরাং হারাধনের দুটো কমলালেবুর একটা উধাও হয়ে গেল নিমেষে। আরো খানিক গিয়ে গুগল একটা মোড় ঘুরতে বলছে, কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গুগলকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা চলেনা। তাই একটা চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঠিক তাই, এ মোড় আমাদের জন্য না, আমাদের যাত্রার মোড় ঘুরবে আরেকটু পর। 

মুচিপাড়া ছাড়িয়ে খানিক এগোনোর পর আর পারা গেল না। এই দোকানেই চা খেয়ে নিই একটু নাকি? সুতরাং চা, খাস্তা কচুরি, বিস্কুট, কেক সহ আর্ধেক পিকনিকের খাওয়া ওখানেই হয়ে গেল। কটা কেক অবশ্য ব্যাগে পোরা হল, কিন্তু ফ্লাস্কে চা ভরতে গিয়ে বোঝা গেল, দুজনের দু ভাঁড় বা চার ভাঁড় চা ওই প্রমান সাইজের ফ্লাস্কে ভরলে সরবত হিসেবেই খাওয়া যাবে পৌঁছে!  নিজেদের আশ্বাস দিলাম খুব, বেশ তো পৌঁছে কিছু পেয়ে যাবো, ওখানে ভরে নেব খন। ভরদুপুর, নভেম্বরের শেষ, এখনো ধান কাটা চলছে কত জায়গায়। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। দোকানপাট বন্ধ করে খেতে গেছে হয়ত সব। একটা ইঁটভাটায় কটা লোক কাজ করছে। কয়েকজন রাজমিস্ত্রী প্লাস্টার করছে একটা ঘরে। বেলা গড়ানো রোদে, দেউল পৌঁছলাম। আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টের একটা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে, ইছাই ঘোষ নামে কেউ একজন এ মন্দির বানিয়েছিল, সপ্তদশ শতকের সময়কালে। পাতলা ইঁটের কাজ। পরে কারা যেন একটা শিবলিঙ্গ পুঁতে দিয়ে গেছে। কটা ছোট ছোট ছাগলছানা আরাম করে ঘাস খাচ্ছে চারপাশে।ইছাই ঘোষ কবেই ধূলো মাটি হাওয়া হয়ে গেছে,  ইঁট গুলোও মনে রেলহেছে কিনা কে জানে!  চল চল এখানেই পাটি পেতে বসা যাক নাকি? ফের ভাবি, তবু পরিষ্কার আছে, থাক, আমাদের দেখে আর কেউ যদি বসে আর নোংরা করে?  নাই বা আর বসলাম!

পাশেই একটা বটগাছের নীচে একটা ছোট্ট চালায় দোকানঘর। একটা ছোট মেয়ে সে দোকান চালাচ্ছে।  চা বিস্কুট কেক,  যেমন হয় আর কি! তার আবার  ক্ষুদে ক্ষুদে আত্মীয় ভাই বোন এসেছে তারাও দোকানদারি করতে এসেছে! অজয়ের জল একটু দূরে। পাড় ধরে হেঁটে যাবার আগে রাস্তা ধরে হাঁটি, একদিকে জঙ্গল একদিকে ক্ষেত। সূর্যের আলোয় পাতায় পড়ে ভারী সুন্দর একটা আলোছায়া মতো করেছে। হাঁ করে দেখি, কী দেখি বোঝাতে পারবোনা, কিন্তু এই রাস্তা, শালের পাতা, রোদ সব মিলিয়ে বড় ভালো লাগে। ধান কাটতে কাটতে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে একদল। থোকা থোকা কী যেন ফুল ফুটে আছে রাস্তার ধারে। কী ফুল জানিনা, নাম দিয়েই বা কী হবে! আরো খানিক এগোই। অজয়ের পাড়েই একটা রিসর্ট মতো করার চেষ্টা হয়েছিল, চলেনি মনে হয়।আপাতত আশেপাশে কেউ কোথাও নেই, সামনে রাশিরাশি কাশ ফুল ছাড়া। 

নদীর চর ধরে হাঁটি, বালিতে বসে থাকি।ভুলে যাই আমাদের পাটি পেতে বসার ছিল, গান শোনার সরঞ্জাম ছিল, চা ঢেলে খাবার ফ্লাস্ক ছিল। প্রকৃতির মধ্যে একবার ডুব দিলে সবই কেমন যেন এক্সট্রা হয়ে যায়। খিদে টের পেলে, পকেট থেকে চেপ্টে যাওয়া কেক বের করে খাই দুজনে। দূরে সূর্য আস্তে আস্তে কোন এক ইছাই ঘোষের বানিয়ে যাওয়া মন্দিরের পিছনের নামতে থাকে। একপাশে বর্ধমান একপাশে বীরভূম আমরা অজয়ের চরে বসে থাকি মাঝবরাবর। আমাদের বড় হওয়া হয়না, তৃণ হওয়াও না,মাঝ বরাবরই কেটে যায় জীবন। এক এক করে মেয়ে পুরুষের দল নদী পার হয়ে আসে, গরুকে হ্যাট হ্যাট করে তাড়িয়ে ঘরে নিয়ে চলে।  সূর্য ক্রমে রসালো লাল টমেটোর মতো হয়ে যায় আমরাও গরুগুলোর মতো বাড়ির পথ ধরি।

ফিরতি পথে বিনবিন করি, আমাদের তো পিকনিক হল না? হল না বুঝি? ওই বট গাছের নীচে,  চালায় বসে চা বিস্কুট খাওয়া, বালিতে বসে চ্যাপ্টা কেক, গাড়িতে বসে কমলালেবু,  কমটা কি? আচ্ছা বেশ তো বাকিটা এই শালের জঙ্গলের মাঝের ওই হোটেলটায় হবেনা? হোটেল মানে নামের ওজন আধহাত, আসলে সে সস্তায় খাবারের দোকান। ভাত চাও তো ভাত, মুড়ি চপ চাও তো তাই। দোকানি তখন পাঁউরুটির পেটের মধ্যে মশলামাখা পুর ভরে বেসনে দিয়ে ভাজবে বলে তৈয়ার হচ্ছে। কাঠের আগুন একটু উস্কে দিয়ে চপ ছেড়ে দিলো আমাদের জন্য। তারপর শালপাতায় মুড়ি চপ পিঁয়াজ দিয়ে মেখে,  আর আলুর পুরভরা পাঁউরুটির স্যান্ডউইচ (বেসনে না ভেজেই) কাঠের উনুনের পাশে প্লাস্টিকের টেবিলে বসে তোফা লাঞ্চ হয়ে গেল। পিকনিকের লাঞ্চ খানিক দেরী করেই হতে হয়।ওইই নিয়ম।


একটা পরিপূর্ণ হাতের  মুঠোয় ধরতে পারা নরম দিনের মতো আরামের দিনের শেষে উপহার অব্দি মিলেছিল। যে গাছের নীচে গাড়ি দাঁড় করিয়েছিলাম, সেটা শিউলি গাছ ছিল, কোত্থাও কিচ্ছু নেই, স্রেফ একটা শিউলি ফুল সাইড মিররে এসে পড়েছিল৷ পথের দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরার পথে মফস্বলি সার্কাসে ঢুঁ মারার ইচ্ছে ছিল। শুনেছিলাম, কুকুর ছাগল এসেছে নাকি! ছাগলে ট্রাপিজ দেখাচ্ছে এ বড় আশ্চর্য জিনিস বটে। কিন্ত শেষ অব্দি অন্যদিনের জন্য তা তোলা আছে। এক দিনে এর বেশী পেলে যদি লোভ হয়ে যায়, যদি মনে হয় এ আর এমন কী দিন গেল? তার চেয়ে বরং আজ দিনটা জঙ্গুলে বুনো গন্ধ, ধুলোর গন্ধ, জুতোয় ঢুকে যাওয়া নদীর বালি, বট গাছের নীচের চায়ের দোকানটা আর রাস্তাটার জন্য তোলা থাক, শিউলি ফুলটা সমেত।

Sunday, October 9, 2022

পুজোয়

হনহন করে হাঁটছিলাম, একটু আগে চড়কতলা পেরিয়ে এসেছি। একটা মুদির দোকানে সস্তার কিছু জিনিস, অল্প ভীড় পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকতেই বাগদি পাড়া। এখানে   বাগদি পাড়া, কুমোর পাড়া,  বাউন পাড়া,  মুসলমান পাড়া,এসব বিস্তর আছে। বাগদি পাড়াটা গরীব মানুষের বাস বোঝাই যায়। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা ওরকম কিছুতে তৈরী হওয়া সংকীর্ণ জায়গায় পলেস্তরা ছাড়া বাড়ি, দু বাড়ির মাঝের সরু রাস্তায় বেঁধে রাখা ছাগল।আজ নবমী। নবমী মানেই সবাই দল বেঁধে স্রেফ ঠাকুর মন্ডপে বসে থাকে বা আড্ডা দিয়ে কাটায় এই কল্পনাটাও শহুরে মধ্যবিত্তের। একটা লোক ঘর ছাইছে, গরুকে খেতে দিচ্ছে একজন। বাগদিপাড়ার পর আবার রাস্তা নেই, মাঠ আর মজা পুকুর৷ মালিক পাড়া মাঠ উন্নয়ন প্রকল্প বলে একটা বোর্ড টাঙানো। লোকজন তেমন নেই, মজা পুকুরেই একটা বউ বাসন মাজছিল, বাঁশবাগানের নীচ দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিল। বৃষ্টি হয়েছে কালকেও,রাস্তা ঘাট কাদা। কোথায় যাচ্ছি কে জানে!  অনেক দূর থেকে মাইকে মন্ত্রের আওয়াজ ভেসে আসছে,নবমীর হোমেরর মন্ত্র। মাঠে এখন ধানগাছের চারা, সবুজে সবুজ হয়ে আছে। একটা দুটো ক্ষেতে, পটল বেগুন হয়েছে। বেড়া আর জাল দিয়ে ঘেরা সেগুলো। খানিক বাদে আর যাবার রাস্তা নেই, মানে আছে হয়ত,মাঠ দিয়ে দিয়ে, সে আলপথ জলে কাদায় আমি চিনতেও পারবো না। 

আবার অন্য রাস্তা নিই একটু পিছিয়ে। চলতে গেলে এই যে নতুন রাস্তা দেখা হয় কিছু রাস্তা ভুল হয় কিছু রাস্তা ঠিক, এ বড় মজার। এর স্বাদ একবার পেলে না চলে থাকা যায়না। এবারে একটা ভালো রাস্তায় পরেছি, এ জায়গাটার নাম খ্যামপুর। আজব নামটা! শ্যামপুরের অপভ্রংশ কি? একজন আমায় দেখে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি, আমি নিজেও কি আর জানি কোথায় যাচ্ছি! সে আমায় বাড়ির দিক দেখালো, আমি তো বাড়ি যাবো না, কোথায় যাবো সেও বলতে পারছিনা, এই হেঁটে আসি একটু বলে কোনোরকমে এগিয়ে যাই। 

কালভার্ট পেরিয়ে বাঁয়ে খাল রেখে এগোচ্ছি। আচ্ছা আশ্বিন মাসে ধানের চারা আরেকটু বড় হবার কথা না? কার্তিকেই তো ধান পাকে নাকি? জীবনানন্দের কবিতায় কার্তিকে ধানের কথা ছিল না? কবিতা অবশ্য পড়িইনি কিছু তেমন। কিই বা করেছি, কবিতা বুঝতে পারি না, রাগ রাগিনী চিনিনা, গাছ, পাখি,  পোকা ফুল, শস্য কিচ্ছু চিনিনা। প্রকৃতিকে স্রেফ হিংস্রে থাবায় ধরেছি, তার কোন তারে কোন সুর কিছুই ধরতে পারিনি। জোর করে সম্ভোগে যে সুখ থাকেনা ছোটবেলা থেকে মানব জীবনের মূল পাঠ হওয়া বড় দরকার ছিল। ভালোবেসে জয় করতে শিখলে অনেক দুর্দশা ঘুচে যেত!

চলতে চলতে আবার একটা কোন পাড়ায় ঢুকেছি। যদিও রাস্তা চওড়া এখান৷  আমাদের এক চাষীর সাথে দেখা, নারকেল গাছের পাতা কাটছিল ছেলের সাথে মিলে। পাশেই তার ঘরে তার বউটি রান্না করছে। দূরে শীতলাতলা থেকে খুব ঢাকের আওয়াজ আসছে। এর নাম কী যেন? কাশী না? আমি ভালো চিনিনা, ও  চেনে খুব। ' বাড়ি এসবেনে দাদা, বসে জল টুক খেয়ে যাও।' আমি কারো বাড়ি যেতে ভারী অস্বস্তি বোধ করি। গরীব বড়লোক, আত্মীয়, বন্ধু ব্যপার না, আমার ভারী সংকোচ হয়। তাই কোনো মতে সে ডাক সরিয়ে এগোই। আসার আগে, ' আসবেনে এখন তাহলে?  ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছ বুঝি, তাহলে সামনের শীতলাতলায় খুব বড় পুজো হয় দেখে এসোগে যাও", বলে আগিয়ে দিলো খানিক।

শীতলাতলার পুজোর ঢাকের আওয়াজ, থেমে থেমে পড়া মন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম খুব। খুব সেজে গুজে একটা ছোট্ট নেয়ে চলেছে আমার সামনে সামনে। একটা ছোট ছেলেও সাইকেল বাগিয়ে চলেছে ওইদিকেই। পিছন থেকে তার মায়ের ডাক ভেসে আসছে, "দেবুউউ কোথায় যাচ্ছিস খেয়ে যা আগে"। পথের ধারে টিউবওয়েলে ন্যাংটা খোকা চান করছে, দু চারজন বাঁশের মাচায় বসে তাস খেলছে। ঠাকুরপুজো ডাঁয়ে রেখে ফের এগোই। আবার ভুল করে মাঠের মধ্যে খানে এসে পড়েছি, আল পথে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি, গ্যাঙোর গ্যাঙোর করে ব্যাঙ ডাকছি ধান জমি থেকে, এখানে কোনো মন্ত্র আওয়াজ কিচ্ছু নেই, স্রেফ, ঝিঁঝিঁ্র আওয়াজ আর ব্যাঙের ডাক। দিনেরবেলা ঝিঁঝিঁ শুনলে ভারী অবাক মতো লাগে না? এইবার রাস্তাটা চেনা,  একটা পুকুরের পৈঠায় এক বুড়ো একা একা বসে, এর উৎসব নেই। ভীমতলায় কুমারী পুজোর পর তাকে নিয়ে বেরিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটা খুব সেজেগুজে অস্বস্তি আর অবাক ভাব নিয়ে বসে আছে ভ্যানে, পিছনে পিছনে একগাদা মেয়ে আর বাচ্ছা নেচে-কুঁদে চলেছে। পরিচিত পুরোনো হিন্দি গানের সুর বাজাচ্ছে একটা লোক আরেকটা ভ্যানে। 


নবমীর বিকেলে খবর পেলাম এক বৌদি মারা গেছে। লড়াই চলছিলই, কষ্ট লাঘব হল আর কি। ব্যাস অশৌচ শুরু হয়ে গেল আমাদের। সে অর্থে শোক তো আমায় বা আমাদের ছোঁয়নি। তাহলে এ অশৌচের মানেই বা কি! আমি মানিনা, মানছিও না আলাদা কথা কিন্তু লোকে যুক্তি দিয়ে ভাবে না কেন একবারও? অবশ্য ঢাক বাজিয়ে পুজো করা, উল্লাস করা দৃষ্টিকটু হত, কিন্তু প্রেতকে পিন্ড দেওয়া হয় বলে একদিন তিল কলা খাওয়া যাবে না এর মানে কি! আমি প্রেত হলে যে আমায় অমন পিন্ড দেবে তাকে ঠাস করে চড় মেরে বলব ইয়ার্কি মারা জায়গা পাস না হতভাগা! ডেকে এনে তিল, কলা দিচ্ছিস!! তাছাড়া প্রেত বলা মানেই মৃতকে অসম্মান করা হয় না?! প্রেত হয়ে তিল কলার লোভে ঘুরছে কেউ এ কেমন কথা! 


পাশের ক্লাবের  ছেলেদের ডেকে ভাসান দেওয়া হলেও, দুঃখটা একই রকম লাগে। প্রতিমার মুখটা আস্তে আস্তে ডুবে যায় জলে,  আর অকারণ মনখারাপ এসে থাবা মারে। ফাঁকা মন্ডপে একা একা আমষট্ বসে বসে পাহারা দেয়, অপেক্ষা করে কি?

বিজয়ার শুভেচ্ছা রইলো। ভালো হোক,শুভ হোক। মিষ্টি  খেয়ে জিভ এলিয়ে গেলে, জল খেয়ে ফের মিষ্টি খাওয়া হোক।



Thursday, September 1, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা (৫)

লাদাখের গল্পটা বলব কোনো এক সময়।ব্যপারটা হয়েছিল লাদাখ থেকে ফেরার পর৷ দুচোখে খালি ওই নীল আকাশ,বিস্তীর্ন মালভূমি পাহাড় আর ছোট ছোট গ্রাম, শান্ত জীবন থেকে ফেরার পর পটল বেগুন ক্রেডিট ডেবিটের জীবনে থিতু হওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই। নেমতন্ন খেতে যাচ্ছি, অফিস যাচ্ছি কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছিনা যেন। তারপর আমাদের মফস্বলের নিম, শিমূল গাছে ঘেরা ঘরে গিয়ে খানিক বসা গেল। এক জায়গার ফেলে আসা বন্ধুদের ভুলতে বালক যেমন ক্রমে নতুন জায়গায় আবিষ্কারের নেশায় মাতে তেমনই আমিও বর্ষার ছোটনাগপুর এর বর্ষায় সবুজ হওয়া প্রকৃতিতে ডুব দিচ্ছিলাম। মানে আলাদা করে কিছু করতে হয়নি, চারপাশে সবুজ প্রলেপ দিচ্ছিল নিজে থেকেই। সকালবেলা ঘুম ভেঙে গেলে বারান্দায় গিয়ে দেখি চারটে কাঠঠোকরা এসে মাটি থেকেই পোকা খুঁটে খাচ্ছে, কাঠবিড়ালির ছানা দুটো বড় হয়েছে খানিক, মুড়ির নেশাও হয়েছে। পাঁচিল পেরোতে গিয়ে ধুপ করে  একটা বিড়াল পড়ে গেল কাকের ডানার ঝাপটা খেয়ে! বিড়ালটা অমনি চারপাশ চট করে দেখে নিল, স্বাভাবিক! বিড়ালদের ঠেকে ওর আর মান ইজ্জত থাকবে কিছু! তারপর একদিন দুড়ুম করে বেরিয়ে পরা হল। সেদিন আবার ভ্যাপসা গুমোট গরম, বাড়িতে গোল হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করবে না কিন্তু ঘরে বসে থাকার মতো স্থিতিশীল হলাম আর কই। 

এখানে একটা সুবিধে আছে, ঘন্টা খানেক ঘন্টা দুয়েকের ড্রাইভে ছোট ছোট সুন্দর সব জায়গা মেলে। আশেপাশে সেসব বেশীরভাগ জায়গা আমাদের ঘোরা, খুঁজেপেতে একটা জায়গা বের করা গেল। স্টেশনের কাছে চার্চের গায়ে রোদ এসে পড়ছে তখন, আমরা পুরোনো ওভারব্রিজ পেরোচ্ছি যখন। এবারের ড্রাইভটায় আলাদা রোমাঞ্চ আছে, আমার গাড়ির স্টিয়ারিং জ্যাম হয়ে গেছে। এখানে আসার সময়েই দেখেছি, কিন্তু তখন সারাতে দেবার সময় ছিলনা, ফলে এখন আমায় একটা টার্ণ নিতে হলে, মাসল গজিয়ে যাচ্ছে আর কি। ইঁটের উপর কাচের বয়াম রাখা দোকানটায় খুব মিষ্টি দেওয়া চা আর সুজির বিস্কুট খেয়ে দেহে মনে বল ফিরিয়ে নিতে হল এক ঘন্টার রাস্তাতেও। দামোদর পেরিয়ে খানিক এগোনোর পর ফস করে গুগল ঠাকুমা বললে, ডাইনে মোর, হাঁচড়পাঁচড় করে গাড়ি ঘুরিয়ে এগোতেই দেখি বর্ষার জল পেয়ে সবুজ রঙে সেজে গুজে গাছ গুলো রাস্তার অপর পারের গাছেদের সাথে প্রেম করছে খুব। চারপাশের মাঠঘাট সবুজে সবুজ হয়ে আছে। গ্রামের মধ্যে খুব সরু একটা রাস্তা। একপাল গরু ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক বুড়ো। সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। মেশিনে ধান ঝাড়ছে মেয়ে পুরুষের দল। খানিক দূরে বিহারিনাথ পাহাড় দেখা গেল,  খেজুর গাছের পাশ দিয়ে।বিহারিনাথ মন্দির দেখার প্ল্যান ছিল না আমাদের, আমাদের ইচ্ছে ছিল পাহাড়ে চড়ার। বর্ষাকালে এ পাহাড়ে কেউ চড়ে না মনে হয়। ট্রেইলটাও জঙ্গল অধিকার করে নিয়েছে প্রায়। ঝোপ ঠেলে তাও খানিক দূর এগোলাম। অদ্ভুত চুপচাপ চারদিক। ঝিঁঝির ডাক আর পাখির ডাক ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। আর জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ। আরো খানিক গিয়ে মনে হল নাহ কাজটা হঠকারী হয়ে যাচ্ছে। সাপখোপ কতটা কি আছে এ জঙ্গলে জানিনা, আমাদের চোখও কংক্রীটে থেকে থেকে দেখতে ভুলে গেছে, সাপ দেখলেও চিনতে পারবোনা।  তার চেয়েও বড় কথা কোনো খারাপ মানুষ থাকলে তাকেও আটকানো যাবে না কারন আর কেউইই আশপাশে নেই। উচিত ছিল নীচের থেকে কাউকে সঙ্গে আনা। কাউকে চিনতে গেলে তার সাথে সময় কাটাতে হয়, এমন হাপবেলার ঘোরায় ছোঁয়া যায় স্পর্শ পাওয়া যায়না। যাকগে, উঠতেই হবে এমন পন করে বেরোইনি। ফের আসবো কখনো। নীচে নেমে অশ্বত্থের ছায়ায় খানিক বসা গেল৷ একটা ছোট্ট মিষ্টির দোকান সামনেই। বারকোশে স্তুপ করে রাখা জিলিপিতে মাছি ঘুরছে।ডেকচিতে রসগোল্লা, পান্তুয়া আর ল্যাংচা রাখা৷ আরেকটা বারকোশে বোঁদের লাড্ডু। দোকানি গরম গরম কচুরি ভেজে দিচ্ছে। মন্দিরটায় ভালোই লোক আসে দেখছি। 

দুটো উপায় হয়, এক যে পথে এসেছি সে পথেই ফেরা, অথবা সামনে এগিয়ে যাওয়া। ঘর থেকে বেরিয়েছে যে,  সহজে সে কি ফিরতে চায়! তাছাড়া সামনের দিকটার রাস্তাটাও তো জানা হবে না। সুতরাং খুব গায়ের জোরে স্টিয়ারিং ঘোরানো হল, আর সামনের সরু রাস্তাটায় এগোনো গেলো। দু পাশেই পাহাড়, লোক তেমন নেই। একটা মস্ত বোঝা চাপিয়ে একটা লড়ঝড়ে বাইকে একটা লোক গেল। আরো খানিক এগোলে, গঙ্গাজলঘাটির জঙ্গল, এই জঙ্গলে আগে এসেছি, ভারী ভালো লাগে। মেজিয়া পেরোলে একটা ধু ধু ফাঁকা মাঠের মাঝে কলেজ একখানা! সে কলেজের মজা ভারী! কলেজ কম্পাউন্ডের মধ্যে বয়েজ হস্টেল আর কম্পাউন্ড এর বাইরে মেয়েদের হস্টেল! আশ্চর্য জায়গা বটে।  কলেজ থেকে খানিক এগোলে ড্যামটা। শাল ইত্যাদি গাছের পাশেই। ছোট্ট একটা অতিথিনিবাসও আছে। এমন চমৎকার জায়গায় কলেজ হলে যা হয় আর কি, ছেলেএ মেয়ে গুলো চলে এসেছে বেশ কয়েকজন, জোড়ায় বা দলে। এর মধ্যেই একটা প্রি ওয়েডিং ভিডিও হচ্ছে। প্রি ওয়েডিং ভিডিও দেখতে আমাদের ভারী উৎসাহ। এই বিকট গরমে চকচকে জামা পরা ছেলে মেয়ে দুটো নানা ভঙ্গীতে হেঁটে বসে কসরত করে দেখাচ্ছে আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ফটোগ্রাফার বেঁকেচুরে খুব ভিডিও বানাচ্ছে। গাঁয়ের দিকে বলে নীল লাল ধোঁয়া নেই, কিন্তু মজা পেতে চাইলে কমতি নেই। এত গরমে লোকজন বলতে এই কটাই, মাথা খারাপ না হলে এমন গরমে ড্যামে আর কেইই বা আসবে! 
কাছেই একটা ছোট্ট পাহাড় আছে, টিলাও বলা চলে। টিলার থেকে ছোট পাহাড় শুনতে বেশী ভালো আর কি।  রাস্তায় একঝাঁক ছেলে মেয়ে দেখছিলাম, স্কুল ছুটি হয়েছে। বিহারিনাথ যাবার পথে বা এখানে আসার পথে যে কটা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম পেরোলাম, সে একেবারেই বইতে পড়া গ্রামের মতোই রিমোট বলা যায়। পশুপালন আর টুকটাক চাষ এইই করে সব। ভাগ্যিস এদেশে এখনো ফ্রিতে পড়ানো হয়, বই দেওয়া হয় সাইকেল দেওয়া হয়! পড়াশোনা করতেই হবে সব্বাইকে সত্যি বলতে আমি সে ধারনায় বিশ্বাসী না। কলেজের স্টুডেন্ট দের পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখে চমকে যেতে হয়, কেউ লেখে সশস্ত্র বিপ্লবীর নাম মহাত্মা গান্ধী কেউ লেখে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেছিলেন "master the sujjasen" (হল কালেকশনে যেমন শুনেছে আর কি)।  সামান্য চিন্তা ভাবনা বা জানার ইচ্ছে থাকলেও কেউ এসব লেখেনা। যে কোনো কাজ করতে গেলেই একটা গ্রাজুয়েট ডিগ্রি চাই এই চাহিদায় কিছু সময়,  অর্থ, এনার্জি আমরা নষ্ট করে চলেছি। আন এম্পলয়বেল রিসোর্স বানিয়ে তাদের জম্বি বানিয়ে ফায়দা তুলে চলেছে রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু সে তো কলেজে, স্কুলটা সবারই দরকার। শুধু পড়াশোনার জন্য তো না, একসাথে খেলা, ছুটে বেড়ানো, টিফিন ভাগ করে খাওয়া। আর কেউ যদি এর মধ্যে ভালোবেসে পড়াশোনাটা করে ফেলে, তবে তো কথাই নেই। কোন কথায় কোন কথা বকে ফেললাম। এ আসলে ঠিক ভ্রমন কাহিনী না, এখানে গেলে ওইটা দেখা যাবে,  বা ওই জিনিস গুলো অবশ্য দেখার এরকম কিছুই বলতে বসিনি। আমি রাস্তায় বেরোলেই খুশ। লাল বুনো ফুলে সাজা কিশোরী গাছ দেখলে, কিংবা শালপাতায় দেওয়া সস্তার কোনো খাবার, সবই আমায় আনন্দ দেয়, সেই আনন্দ পেতেই আমার চলা।
দুপুর হয়ে গেছে, আশ্রমের গেট বন্ধ হয়ে যায়। তাও এসেছি টুকটুক করে, টিলাটার মাথায় ওঠা যায় যদি। আশ্রমটা টিলার গোড়াতেই। কোন ঠাকুর, বা গুরুর আশ্রম জানিনা, জানতে চাইও না। উপরটা উঠতে পেলেই হল। উপর থেকে দূরের ড্যামটা দেখা যাচ্ছে। এই বিশ্রী ভ্যাপসা গরমে আর কোনো লোক জন নেই এই দুপুরে, খালি দুটো ঘুঘু পাখি বেলগাছটায় বসে ডেকে চলেছে। আশ্রমটা দেখতে ভারী চমৎকার, জাঁকজমক নেই, ফুলের গাছ আছে অনেক। ভিতরটা ঢুকে দেখার শখ হল, ইতস্তত করে ঢুকতে দেখি দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় কিছু বাচ্ছাদের। আর সম্ভবতঃ এদের দীক্ষা নেওয়া একটা পরিবারও বসেছে দেখছি এক পাশে। এইসব আশ্রমে কী নিয়ম হয় জানিনা, টাকা দিয়েই ভোগ খেতে হয় নির্ঘাত। স্বাভাবিকভাবেই উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছি, বেরিয়ে যাই নাকি? এমন সময় আশ্রমের এক কর্মী, "সেবা করবে তো,  বসে যাও বসে যাও" বলে আমাদের পাত পেতে দিলো। নির্ঘাত আমাদের ওই পরিবারটার কেউ ভেবেছে। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ। ভালোই হয়েছে, খিদেও পেয়েছে বটে। বিয়েবাড়িতে  ফাঁকি দিয়ে ঢুকে খেয়ে নেওয়ার মতোই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। শালপাতায়, ভাত শাকভাজা,শুক্তো পড়তে না পড়তেই আমিও হাত বাড়িয়েছি। একজন তাড়াতাড়ি বললেন, গীতাপাঠ না শেষ হওয়া অব্দি খাবেন না! শাকভাজাটা ততক্ষনে মুকে চলে গেছে। আরাম করে ভাত, শাকভাজা,  শুক্তো, ডাল, ছানার কোপ্তা, চাটনি পাঁপড়,  পায়েস মিষ্টি খেয়ে সুড়ুৎ করে কেটে পড়েছি। এ তল্লাটে আবার অনেকদিন আসা যাবে না! 
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়েই একটা ছোট্ট টিকটিকি উঠেছিল গাড়ির চালে, সে কিছুতেই নামবে না, নিয়ে চলো না, আমিও বেড়াতে যাবো বলে গাড়ির চাল আঁকড়ে শুয়েছিল। পাহাড়, ড্যাম সব ঘুরে টুরে,এই আশ্রমেই মনে হয় ওর ভালো লেগেছে। টুকটুক করে লেজ নেড়ে নেমে গেল। সন্ন্যাসী টিকটিকি!  অবশ্য এই আশ্রমিকদের আমার অবাক লাগে, নিজের সংসার ছেড়ে আরেক সংসারেই তো পড়ে আছে, সেই তো ভাঁড়ারের চাবি, রসগোল্লার হিসেব, পায়েস কেমন হয়েছের খোঁজ! কার কিসে আনন্দ কেই বা বলতে পারে!

Friday, August 5, 2022

নুড়ি আর জল

অনেকদিন পর অফিস এসেছিলাম আজ। টিমটা ভেঙে গেছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সবাই আগেই, বাড়িতে বসেই যে কাজ হয়ে যায় মর্গের ঠান্ডায় সে কাজ করতে যেতে ইচ্ছে করে না। তাও ডাক এলে যেতেই হয়। ল্যাপটপ স্ক্যান করানোর সময়, চুল পাতলা হতে শুরু করা পাতলা চেহারার সিকিউরিটি গার্ড হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল ভালো আছেন? সত্যি বলতে ওর মুখ সচেতনে কখনো মনে রাখিনি,এ আড়াই বছরে ও কেমন ছিল জানতে যাইনি। আমি জানিনা ওর বাড়ি কোথায়, কে আছে এর , কোন জায়গায় ঘুরতে যায়, কিংবা আরো সব প্রচন্ড সব দরকারি কথা, যা আমরা প্রতিদিন লেনদেন করি ভারচুয়াল দুনিয়ায় কিচ্ছু জানিনা।কিন্তু আমায় উনি মনে রেখেছেন, অনেকদিন পর দেখে অকৃত্রিম হাসি উপহারও দিলেন। আহারে মানুষ। 
জানলার পর্দা সরাতেই নারকেল গাছের মাথায় জলের মধ্যে মেঘের আনাগোনা দেখা গেল, চোখ টেনে দৈনন্দিন হিসেব নিকেশ, চিঠি চাপাটি শুরু করে দিতেই হল। দুপুরবেলা নিজে খেতে গিয়ে দেখি, বিশুর দোকান আজও বন্ধ। হল কি ছেলেটার? আগের বার অফিস এসেছিলাম যখন তখনো বন্ধ ছিল। সোমনাথেরও তাই। বিশু কিংবা সোমনাথ থাকলে মাসীর দোকানে যাইনা। মাসীর দোকান অপরিচ্ছন্ন এদের তুলনায়। তা উপায় নেই, বেচারি একা বসে ঢুলছে যাই চা খেয়ে আসি। মাসী আমায় দেখেই একগাল হেসে বলল, একইরকম আছিস দেখছি, কিচ্ছু বদলাসনি! বোঝো! বললাম তা তুমিও তো একই রকম আছো (আগেও বসে বসে ঢুলতে আর  প্রায় ঠান্ডা চা ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে দিতে। যদিও এটা বলিনি আর)।  তাতেও হাসি, তাই নাকি। প্রায় ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে বিশু আর  সোমনাথের খবর নিই।  সোমনাথ বাবার সাথে রাগারাগি করে দোকান দিচ্ছেনা।বিশুর মেয়েটার ক্যানসার হয়েছে,  বিশু ব্যঙ্গলোর গেছে।ওখানেই দোকানে কাজ করে আর মেয়েকে দেখে। সকালের নীল ঝকঝকে আকাশটা মলিন হয়ে গেল।  হাসিখুশী বিশুটার মুখটা নীল আকাশ আড়াল করে দিচ্ছিল। আহারে ছোট্ট মেয়েটা।  গোলুইদার কাছে নাম্বার আছে না বিশুর? যোগাযোগ করতে হবে। 

আজ কলকাকলি কাটিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যে নামার মুখে ভেড়ির ধার ধরে এলোমেলো হাঁটছিলাম। কলেজের ছেলে মেয়েদের আড্ডা, প্রেম, গান বেশ খানিকদূর অব্দি আসে।তারপর জায়গাটা আশ্চর্য নির্জন হয়ে যায়। কে বলবে, কয়েকশো মিটার দূরেই ব্যস্ত শহর দৌড়চ্ছে। একটা পানকৌড়ি ডুব মারলো, রূপোলী একটা মাছ ঠোঁটে ছটফট করছে, নিস্তেজ হবার আগেই পেটে চলে গেল, একটা ফড়িং উড়ছে, নিমগাছের ডালে কাক ডাকছে। একটা বাজ পড়া তালগাছের মাথায়  পাখি বসেছে একটা, তার ঠিক পিছন দিয়ে একটা ইন্ডিগোর উড়োজাহাজ উড়ে গেলো। কটা সাহেব মেম অফিস পরিদর্শনে এসেছে, এদেশীয় দুটি লোক তাদের ভেড়ির চারপাশ ঘোরাচ্ছে। মন্দিরের পাশের সিমেন্টের চাতালে একটা হাফপেন্টুল পরা ছেলে বসে আছে, দুজনেই চুপ করে কতক্ষন বসে রইলাম। সে কী ভাবছিল জানিনা, ভদ্রলোক নয় ভাগ্যিস,  তাই আমি কী কেন ইত্যাদি কিচ্ছু জানতে চায়নি। তারপর অনেক্ষন পর বটের ঝুরির পাশ দিয়ে আলো কমে এলো যখন, ফিক করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফরেনারগুলোকে  তুলসীপাতাও বাদ রাখেনি খাওয়াতে!

ফিরতি পথে দেখি একজন পুলিশ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে দেখছে। টহল দিতে এসেছিল এদিকে। আমিও খানিক ইচ্ছে করে এলোমেলো পা ফেলে বারবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে নিজের পকেটে হাত দিয়ে দিয়ে দেখছি। ব্যাস আমার ফাঁদে পড়েছে। দেখি চোখে মুখে আনন্দের আলো খেলে গেলো তার, পাকড়েছি ভাব।
গম্ভীর গলায় বলল, "কী আছে পকেটে"?
- অ্যাঁ?  
- বলি পকেটে কী আছে?
- এই যে মোবাইল। (পকেটে আরো কিছু আছে,  সেগুলোকে আড়াল করার ভঙ্গী করে)
- আর কি আছে? উঁচু মতো? গাঁজা নাকি?
বুদ্ধি মাইরি! গাঁজা থাকলে পকেটে রাখবো! ফস করে আইকার্ডটা বের করে হ্যা হ্যা করে হেসেছি খুব। রাগে মসমস করতে করতে চলে গেল। 
ভেড়ির জলে লম্বা ছায়া ততক্ষনে আরো লম্বা হয়েছে।

আসার সময় বছর কতক আগে যে গানগুকো খুব শুনতাম ফের শুনছিলাম, নিজের মনেই হাসছিলাম, হাসির গান একটাও না অবশ্য। ভাবছিলাম কেমন করে সম্ভাবনা জন্মায়, মরে যায়, ফের জন্মায়। সমান্তরাল বিশ্ব আছে কিনা জানিনা, কিন্তু থাকলে কিরকম হবে সেই সব সম্ভাবনা গুলো যেগুলো ভাগ্যিস হয়নি! যার জন্য অপরিসীম আকুতি থাকে সময়এর তফাতে দেখলে সেগুলোই কেমন অবাক লাগে...ভাগ্যিস হয়নি,কিংবা ভাগ্যিস হয়েছে বলে। অনেকদিন পর বুড়ো হয়ে এরকম কোনো অখ্যাত সরু পায়ে চলা রাস্তা দেখলে হাঁটবো কিনা জানিনা, কে জানে তখন কী ভাববো, ভাগ্যিস সেই শেষ সূর্যের আলোয় বটের ছায়ায় বসা দিনটা পেয়েছিলাম নাকি ভাববো ওই সময়ে আরো অর্থনৈতিক  উন্নতির কোনো কাজ করতে পারতাম! 
ভাগ্যিস জানিনা, কারন বুড়ো আমি দ্বিতীয়টা ভাবলে ভেড়িতেই পুঁতে দিতাম হতভাগাকে....

Tuesday, July 19, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা(৪)

গরম কমার মুখে ঠিক হল এদিককার ছোট আর ভাঙাচোরা বাড়ি ছেড়ে ওইদিকের বড় ভালো বাড়িতে যাবো। যাবো যাবো করছিলাম অনেকদিন ধরেই,  নানান টালবাহানায় আটকে ছিল। যাবো ঠিক হতেই যেন আরো মায়া পড়ে যায় এই ঘর খানাতেই৷ বিকেলের পড়ন্ত সূর্য,  নিস্তব্ধ দুপুরে আসা কাঠবিড়ালি সবাই এসে জমা হয় পকেটে।সেদিন হল কি, যে কুকুরটা মাছের  কাঁটাকুটি,মাংসের হাড়গোড় খায় সে যথারীতি এসেছে।এদিকে আমাদের সেদিন তরমুজ দিয়ে লাঞ্চ হয়েছে। সে অবশিষ্টাংটা ওকে ছুঁড়ে দিয়ে দেখছিলাম খায় কিনা। ও বাবা তাকালো,  "এ তুমি কী দিলে!" বললাম আজ নেই যা পালা, তাতেও তাকিয়ে, "কিছুই কি নেই" ভাব।
শেষে দুটো বিস্কুট দেওয়া হল। একটা খেয়ে তাকাচ্ছে, "এটাই দিলে হত আগে, তা আর একটু হবে নাকি?"
হেংলু কাঠবিড়ালিটার নাম দেওয়া হয়েছে টংলু। তিনি সকালে এসেছিলেন দেখে চাট্টি মুড়ি দিয়েছি, ও বাবা সে কী ভয়! তুড়তুড় করে পালালো। মুড়ি এলোমেলো হয়ে গেল তাও এলো না। যেই ময়ূরাক্ষী কলেজে বেরিয়েছে, অমনি আবার এসেছে।কুড়কুড় করে খাচ্ছে। ঘরেতেও চলে আসছে দিব্যি।  
এখানে দিন শুরু হয় খুব সকালে। আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য যে লোক ঠিক করেছি তারা সাতসকালেই হাজির! সমস্ত মোটামুটি গুছিয়ে নেবার পর চারপাশ তাকিয়ে আনন্দই হল।এদিকটাও বেশ গাছপালায় ঘেরা।নিম, শিমূল, বট। কিন্তু টংলু? তার তো বেশ মুড়ির নেশা হয়েছিল, সে এখনো ঘুরে ঘুরে খুঁজে চলেছে নাকি? 

কোকিল, বুলবুলি, কাঠঠোকরা, দোয়েল, পায়রা ওদিকেও ছিল, এদিকে এর সাথে কাক, ছাতারেদের ভীড় আছে দেখছি। সকালবেলা থেকে হরেক পাখির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। কোকিল গুলোর বর্ষা যেন শুরুই হয়না। একেকদিন হনুমানের দল আসে৷ ছানা কোলে মা হনুমান লাফাতে না পারলে গোদাটা এসে সাহায্য করবে কিনা জানতে চেয়ে পাশে বসে। তার ভারে গাছের ডাল ভেঙে যায়, মা হনুমান ছানাটাকে নিয়ে লাফ মেরে অন্য গাছে যায়। ও বাড়িতে থাকতে একটা বুলবুলি সকাল বেলা আমাদের চা খাবার সময় বারান্দার তারে এসে বসতো, সেদিন দেখি এ বাড়ির বারান্দাতেও এসে বসে ডেকে চলে গেল। কি জানি খোঁজ নিতেই এসেছিল কিনা৷ আমার কাজের টেবিলের ওপাশে জানলা দিয়ে দেখা যায়, নিম গাছের ডালের দাঁড়কাক,কিংবা কার্নিশে বসা ছাতারের ঝগড়াঝাটি৷ কাঠবিড়ালি গুলোও খুব খেলে তুড়তুড় করে৷ তাদের ভয় একটু কমেছে, আমাদের কার্নিশে এসে মুড়ি খেয়ে যায়। 



লেখালেখি আজকাল আর করা হয়না তেমন,কাজ,পড়াশোনা আর গল্পে সময় কেটে যায়। একেকদিন সকাল সকাল বাজারে যাই। স্টেশনের মাছওয়ালাকে বললেই দিয়ে যায়, তাও যাই কখনো। পথ ভুলে এলোমেলো হয়, কেমন সব পুরোনো পুরোনো বাড়ি।সকাল সকাল কচুরির দোকানে ভীড়। রোয়াকে বসে সকাল সকাল খেয়ে কাজ বেরোনো লোকজনের সাথে আমিও বসে জিলিপি খাই৷ ড্রামের জল আলগোছে গলায় ঢালে তারা আমার শৌখিন মজদুরি ওখানেই থেমে যায়। দেখতে দেখতে রথ চলে এলো। গ্রামের দিকের মেলার আলাদা একটা ধরন থাকে, আমাদের গ্রামের বাড়ির ওখানে শীতে ভীমমেলা হত। এক সপ্তাহ ধরে, সে কি আনন্দ আমাদের তখন। সে সময়, আনন্দের উপকরন বাক্সবন্দী এত থাকতো না তাই এই সব মেলার অপেক্ষা আলাদাই ছিল।  সারারাত ধরে যাত্রা হত, আর এমনি মেলার হরেক মজা, নাগরদোলা, বন্দুক, আদ হাত লম্বা রঙীন জিভেগজা।  এ জায়গাটা গ্রাম না হলেও ছোট গঞ্জ বটে। এখানেও সপ্তাহব্যাপী রথের মেলা হয়৷ একদিন গেছিলাম, রথের মেলায় যা যা থাকে,  ফুলের গাছ, জিলিপি, পাশকুঁড়ার চপ, হরেক রোল চাউমিনের দোকান। গৃহস্থালির জিনিসের  দোকানে ভীড়, মাইকে সতর্কবার্তা,  সব পেরিয়ে একটা কম আলো পৌঁছনো জায়গায় এখানকার ভূমীজ এক বুড়ি বসে আছে তার পসরা নিয়ে। ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাসন, কী হয় ওগুলো দিয়ে কে জানে!
মথুরা কেক, রথের মেলায় 

একদিন পূর্নিমায় ছাদে গিয়ে দেখি চাঁদ উঠলো এই বড় একটা। শ্রাবন মাসের চাঁদ, নিম গাছের মাথায় উঠে চারদিন সাদা করে আলো দিচ্ছিলো। সে আলো গায়ে মেখে গাছগুলো খুব রসস্থ হয়েছে। আরো রাতে পরীরা নেমে আসবে আমি জানি, সে সময় গাছেদের সাথে পরীদের কথা হয়, মানুষদের করা সব বোকামো, সব বজ্জাতি, সব ভালো সপাটে উড়িয়ে দেয়,,পাত্তাও পায়না মানুষে সেখানে। সেই আলো সেই হাওয়া গায়ে লেগে গেলে মানুষ হালকা হয়ে যায়। তার শিকড় ছড়িয়ে যায় অনেএএক দূর। ছোট খাটো না পাওয়া কিংবা পাওয়ার বাইরে দুহাত বাড়িয়ে চাঁদ ছুঁয়ে দেয়।

Saturday, May 14, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা...(২)

লম্বা একটা লোহার বিম আর আড়াআড়ি অনেক গুলো কড়িবরগা মাথা তুললে দেখা যায়। ছোট্ট একফালি দোকানটার গায়ে বয়সের ছাপ পড়েছে। দেওয়ালে পলেস্তারা খসেছে অনেক জায়গায়, কাঠের ছোট চেয়ার টেবিল, কালো হয়ে গেছে দেওয়ালের রঙ।  উপরে নাচা করে রাখা কত সব জিনিস, এক কোনে উঁচুতে কেন কে জানে একটা ধূলোয় ঢাকা মিক্সি৷ বয়সের ছাপ পড়েছে বটে কিন্তু তার এখনো দাঁত পড়েনি, চুল পাকেনি,সুগার প্রেশার কোলেস্টেরল পাকড়ায়নি। কোলকাতা শহরের বুকে নিজের মতো সময় কিনতে পাওয়া যায়। এসির আরামে, কেতাদুরস্ত গদিতে বসে, কেতাদুরস্ত মোহিতো নামের সরবতে চুমুক দেবে? তার দাম আলাদা। আলাদা করে রিসর্ট, ওয়ো ইত্যাদির কথা বলছিইনা। আমার মতো মানুষ যাদের রাস্তায় হাঁটা নেশা, তাদের কাছে এই রকম দোকানের মূল্য বেজায়। চায়ের দাম ফুটপাথের চায়ের দোকানের থেকেও কম। আমার চাহিদাও বেশী না ফলে  এ দোকানে যা যা মেলে, পোচ, ডিম টোস্ট, অমলেট, গোলমরিচ আর মাখন দেওয়া টোস্ট ইত্যাদি আমার জন্য ঢের। কায়দার কাপের কফির চেয়ে বরং বেশী লোভনীয়। তা আমারও যেমন চকচকে উন্নতি নেই, এ দোকানটারও নেই। শ্যামবাজারের মোড়ের মাথায় সারাদিন অগনিত "কাস্টমার" আসলেও নেই। দু ঘন্টা বসে থেকে পঞ্চাশ টাকা বিল হলে হবেওনা। তাতে তো কই এদের মুখে ছায়া পড়তে দেখছিনা?

আমাদের এ দেখার গোলমাল আছে। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম না, মূল্য স্থির ব্যপারটা আমার আয়ত্ত্বের বাইরে। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের এত অপশন এত স্বাচ্ছন্দ্যেও সুখ নেই কেন? বলতেই পারো নেই কে বলেছে! ও তোনার দেখার ভুল। বেশ তো,  তবে মানুষে মানুষে এত কোন্দল কেন ফেসবুক টুইটারেও। এখানে তো দেশ, বর্ণ, জাতি, টাকার সে অর্থে প্রভাব থাকা উচিত ছিল না। তবে তা হল না কেন? সামান্য একটা জিনিস ভালো বা লাগলেও পাঁচজনে ঝাঁপায় কেন ট্রোল করবে বলে? স্রেফ যশ খ্যাতির ছবি ছাপাবে বলে পাখির বাসা ভেঙে পাখির ছানার ক্ষতি করতে বাধে না।মানুষ তো সুখে আছে, হাতে টাকা আছে তার। রেস্তোরাঁ যাত্রা তার কাছে পারিবারিক ক্যালেন্ডারের তারিখ হিসেবে না, নতুন জামা কিনতে তিথি লাগে না। এত চাই, এত পাচ্ছো তবু অস্থিরতা কমে না কেন?   

এসব কিছুই ভাবছিলাম না ওই দোকানে বসে। কাঠে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসে আরাম করে গল্প করছিলাম মোবাইল সরিয়ে রেখে। তার আগে সেই কলেজ স্ট্রীট থেকে হাঁটতে শুরু করেছি। বেশী দূর নয় অবশ্য, অনভ্যাসে তাইই অনেক মনে হচ্ছিল।রাস্তায়  কপিলা আশ্রমের দোকান ভেঙে জায়গা না পাওয়া যুবক ভারী অনুনয়ের সঙ্গে বলছিল সেইই আসলে আসল। ঠনঠনিয়া পার হতেই  উদয়পুরের হাভেলীগুলোর মতো দেখতে নাম না জানা রাণীর প্রাসাদ কত গল্প শোনাতে চাইছিল, সেসব পার হয়ে যেতে হয়। অমৃতর লাল দইটা দোকানের নামকরণের মর্যাদা রেখেছে। তারপর নিয়মিত ক্রেতারাও উঠতে লাগলো, পাশের টেবিলের নতুন আসা খদ্দেরের টোস্ট ফুরিয়ে গেল। চা নেবে কিনা আর কেউ জিজ্ঞেস করে আর কেউ হ্যাঁ বলল না, শাটার আর্ধেক নেমে গেল। 

আর সেই মুহূর্তে আর একবার উপলব্ধি করলাম , সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে নেহাতই  লরিবাক্য, ভালো থাকতে জানলে দুইই দিব্যি ধরা যায়। এই তো কালিঝুলো দোকানে,  চায়ের কাপে, হাতের ফাঁকে তারা হাজির.....কুড়িয়ে নিলেই হল।

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা.. (১)

একদম শীতের শেষে তিনটে গাছ এনেছিলাম। আমি গাছ ভালোবাসি কিন্তু যত্ন জানিনা। টবের গাছের যত্ন অনেক। বেচারাটা অল্প মাটি পায়, তাতেই মাস থুড়ি দিন চালানো কষ্টকর, তাই একটু বেশী যত্ন লাগেই। বাড় কমিয়ে কিংবা ডাল ছেঁটে। আমার এসব ভালো লাগেনা, একটা নিমের বীজ কোথা থেকে এসে পড়েছিল, তা থেকে গাছ হয়েছে, অমন একটা সজীব গাছকে মেরে ফেলার কথা আমরা ভাবতেও পারিনা, তাই নিজের মত বেড়ে উঠেছে। আশ্চর্য রকম রোগা হয়ে, বেঁটে হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেকে। নিজে নিজেই, বাবা হয়ত মাঝে সাঝে ডাল ছেঁটেছে কিন্তু মূলতঃ তারই উদ্যোগ ছিল বাঁচার। হাঁ করে দেখার এত কিছু থাকে আমার, আমি হাঁ করে দেখি, কেমন বিন্দাস বাঁচে গাছটা,ওর মাটি পাওয়া বন্ধুরা এই মোটা এই লম্বা এই বড়। গাছেদের আলাদা নেটওয়ার্ক,  তাই ওও জানে নির্ঘাত, কিন্তু তাতে ওর দুঃখ দেখিনা, বসন্তে কচি পাতা, ফুল, প্রজাপতি অভাব নেইই৷ 

আমার আনা তিনটে গাছই শীতের গাছ। ডালিয়া, ক্যালেন্ডুলা, আর গোলাপ। আশ্চর্যজনকভাবে তিনটে গাছই বেঁচে আছে দিব্যি। ডালিয়া ফুল ফোটায়না, একদিকের পাতা,ডাল সব মরে শুকিয়ে গেছে, অন্যদিকে দিব্যি কচি কচি পাতা! ফুল দিক বা না দিক একে উপড়ে ফেলব কেন! ফুল দিলে ভালো না দিলেও ভালো। ক্যালেন্ডুলা কুঁড়ি ধরায়, তারপর কুঁড়িতেই মরে যায়, অপুষ্টিতে হয়ত। সার দিলে হয়, কিন্তু আমার দৌড় খালি মাটি আলগা করে দেওয়া আর রোজ জলটুকু দেওয়া। আজ দেখি একটা কুঁড়ি মাথা তুলেছে গায়ের জোরে কিংবা মনের জোরে। হলুদ রঙের ছোট্ট ফুল ফুটেছে।
 গোলাপটার সব পাতা ঝরে গেল যখন কী দুঃখ কী মন খারাপ। তারপর এক সকালে দেখলাম কচি কচি পাতা হয়েছে।বেঁচে থাকা দেখতেও এত আনন্দ!  তারপর থেকে সে রোজই নতুন নতুন পাতার জন্ম দেয়। আমি মাটি আলগা করতে গেলে কাঁটায় হাত ছড়ে যায়, বকুনি দিই মাঝে, তারপর আবার সকালে জল।

আশা করে আছি একদিন গাছ বড় করতে পারা শিখবো গাছেদেরই কাছ থেকে। যেমন করে আমার বুকের মধ্যে অকারণ না পাওয়া কিংবা আরো পাওয়ার চাহিদা মাথা চাড়া দিলে শান্ত করে দেয়,সে ভাষা আমি টের পাই তেমন করেই ঠিক কী কী করলে ওদের সাথে আরো ভালো করে কথা বলতে শিখবো সেটাও বলে দেবে নির্ঘাত।আপাতত স্রেফ জল দিতে দিতে বলি, মরে যাস না...আমার ইচ্ছের জোরে চুনিপান্না হোক বা না হোক, হলুদ ফুল আর সবুজ পাতা হয়েছে,চুনিপান্নার থেকে কম কি?

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা... (৩)

দুপুরে পিছনের অশ্বত্থ  গাছটা থেকে ঝিরিঝিরি হাওয়া ভেসে আসে। আমাদের গ্রামে অশ্বত্থকে বলে আশুথ গাছ । বট আশুথের হাওয়া বড় মিঠে হয়।  গরমে আগে এ অঞ্চলে আসিনি। মাসখানেক আগে যখন এসেছিলাম তখন লু বইত, বন্ধুরা এসেছিল। সপ্তাহান্তের দিন, দুপুরবেলা জানলা বন্ধ করে আড্ডায়,হুল্লোড়ে, তরমুজে মজে থাকতে মন্দ লাগেনি একটুও৷ বন্ধুরা না আসলেও আমি জানি ওই লু আমায় কাহিল করতে পারত না, গরম আমার শীতের চেয়ে ঢের বেশী ভালো লাগে। এবারে এসে এক দু পশলা বৃষ্টি পেয়েছি মাঝে মাঝে। গাছগুলো আবার সব সবুজ হয়ে গেছে। কাঠবিড়ালী, দোয়েল, হাঁড়িচাচা, ছাতারে, শালিখ সব্বাই ফিরে এসেছে। এমনকি পাগলা কোকিলেরাও। সকালে বেশীক্ষন ঘুমোলে ডেকে ডেকে তুলে দেয়, দুপুরে সব নিঝুম হয়ে যখন স্রেফ পিছনের বারান্দা দিয়ে অশ্বত্থের হাওয়া এসে ঘোরে তখনো কোকিলটা ডেকে যায়। মেয়ে কোকিলটাও আছে,  দেখেছি। বিশ্রী দেখতে। জীবজগতে মানুষ ছাড়া আর কোনো মহিলাই মনে হয় রূপসী না। তবে যার যাতে মজে মন, কালো কোকিলটা ওই বিশ্রী ছিটছিট মহিলা কোকিলের জন্যই ডেকে ডেকে হেদিয়ে গেল!


সকালে চা বিস্কুট খাচ্ছিলাম বারান্দায়, বিস্কুটের টুকরো পড়েছিল মনে হয় বারান্দায়। একটা কাঠবিড়ালী কুটকুট করে খেয়ে গেল। ওই সময়টা কাঠ হয়ে বসে থাকতে হয়। সামান্য বাড়াচাড়তেই ছোট্ট জীবটা ভয়ে চিড়িক চিড়িক আওয়াজ করে ছুটে পালায়। বাড়ির সামনের কামিনী গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। অনেক রাতে বারান্দায় দাঁড়ালে ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর সকালে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। কামড়ায় না, নিজের মনে ফুলে ফুলে ঘোরে,  মধু খায়, চলে যায়। কাঁঠাল গাছটায় দোয়েল আর শাহ বুলবুলিটা এসে বক্তব্য রাখে, চারদিক সরেজমিনে দেখে। হাঁড়িচাচা লম্বা লেজ নিয়ে উড়ে এসে বকে দেয়বলে মনে হয়। ছাতারেও ছাড়ে না, কেন এত বেলা অব্দি ঘুমিয়ে আছি বলে ডেকে বকে একাকার করে। সকালে খানিক পরেই আসে সব্জিওয়ালা, তারপরেই মাআআছ মাছ বলে মাছওয়ালা। 


শান্ত দিন দুড়দুড়িয়ে টিম মিটিং, কাজের ফাঁকে গলে যখন বিকেলে যায় এক ঝাঁক টিয়াপাখি চক্কর কাটতে কাটতে ঘরে ফেরে ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজে। সারাদিনের গল্প গাছা করে হয়ত। কে কোথায় কী নতুন জিনিস দেখেছে, জেনেছে। চায়ের কাপে, টিয়ার ঘরে ফেরায়, মেঘের লালে সন্ধ্যে নামে। এই ঘরটাও ছেড়ে দেবো আমরা, সে কাজেই আসা। অন্য ঘরে যাবো, সে ঘর খানিক বড়, খানিক কম ভাঙাচোরা। কিন্তু এ পাড়ার কাঠবিড়ালী, প্রজাপতি, ছাতারে, দোয়েল কেউই যাবে না ওখানে। এদিকের আম,  কাঁঠাল,  নিম গাছেদেরও দেখা যাবে না। অশ্বত্থ গাছের হাওয়াও না। আমাদের জীবনে চাহিদা কিঞ্চিৎ কম। আমাদের ভাঙাচোরা বাড়িতে বাইরের লোক না এলে অভাববোধও কিছু হয়না। এলোমেলো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। সেদিন বাজারে গেছি, রাস্তায় রাস্তায় কচুরি জিলিপির আহ্বান অগ্রাহ্য করা যায় না। হেঁটে হেঁটে এ গলি সে গলি করতে করতে একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ির সামনে পড়েছি। এই মোটা থামগুলো ভেঙে পড়ছে, খড়খড়ি দেওয়া জানলায় ধুলোর আস্তরন। সামনের দেউড়িতে আবর্জনা। কোন প্রজন্মের শখ কোন প্রজন্মে ঘুচে গেছে কে জানে! পাশেই ইটালিয়ান সেলুনে দাড়ি কাটছে একজন, আর তারপাশেই মুরগি। মাছওয়ালা আমায় জোর করে দুটো পাবদা পুরে দেয়। আর লাগবে না বললে বলে,  নিয়ে যা নিয়ে যা, এমনিই দিচ্ছি, টাকা নেবো বলেছি কি? ও দুটো তোর জন্য ! 


পাগলা কোকিল বৈশাখের শেষে ডেকে যায়, পাগলা মাছওয়ালা এমনি এমনি মাছ দেয়..পাগল বিনে ভালো থাকার জো নেই কিনা।

Saturday, March 5, 2022

চাঁদ দেখতে চন্দ্রাহতরা

কোথাও বেড়াতে গেলে আমার এনার্জি যাতা লেভেলের হয়ে যায়। কাল অনেক রাত অব্দি বাইরে বসে থাকার পরেও আজ দিব্যি সাত সকালে উঠে তৈরী। সাত সকাল মানে অবশ্য তেমন কিছুও না, জেলেরা মাছ আনছে এমন সকাল। মেঘলা হয়ে আছে চারদিকটা, মাঝে মাঝেই টুপটাপ বৃষ্টি। একটু পরেই রম্ভা বেরিয়ে যাবো। যাওয়ার আগে ছোট্ট শান্ত সমুদ্রপাড়ের জনপদটা ঘুরে ঘুরে দেখে নিচ্ছি যতটা পারি। একটা ছোট্ট দোকানে খুব করে সকালের জলখাবার খেয়েছি কলাপাতায়।  ধোসা আর ঘুগনি, অদ্ভুত কম্বো! কতরকম খাওয়া যে আছে দুনিয়ায়। যা জানিনা তাইই অদ্ভুত লাগে। আমি যেমন, মুড়ি যে কোনো তরকারি দিয়ে তরিবৎ করে খাই, মাছের ঝোল দিয়েও, ডাল দিয়েও, যে খায়না সে ভাববে আজব কম্বো! 
অটোতে করে চলেছি, গাড়িতে ভাড়া বেশী হত, আমাদের এবারে বাজেট কাটছাঁটের ব্যপার আছে। অটোতে লম্বা ফাঁকা রাস্তা পাড়ি দিতেও মন্দ লাগেনা কিন্তু। খালি আওয়াজ খানা দিচ্ছে হানা এই যা। গোপালপুর থেকে রম্ভার রাস্তাট ভারী মনোরম। একটু দূরে ছোট ছোট নীল পাহাড়, রাস্তার পাশেই চাষের ক্ষেত, সবুজ হয়ে আছে। হাঁ করা ছেলে আমি, হাঁ করে এত রঙ, এত তরতাজা চারদিক দেখতে দেখতেই রাস্তা ফুরোয় আমার। তারাতারিনী মন্দির হয়ে তারপর রম্ভা যাবো৷ ভক্তি আমার নেই, কিন্তু মন্দির, মসজিদ, চার্চ এসব ভারী ইন্টারেস্টিং জায়গা। মানুষ দেখা তো আছেই, পুরোনো মন্দির গুলোয় যা অপূর্ব কারুকাজ থাকে আমাদের এখনকার লোকেদের দিলে ছড়িয়ে লাট করবে। এইতো সেদিন রাজস্থানের দিলোয়ারা মন্দিরে দেখি মন্দির পুনরুদ্ধারের অংশে পুরোনোর পাশে নতুনটা খুবই নিম্নমানের কাজ! যাকগে সে কথা থাক। তারাতারিনী মন্দির চড়তে গেলে হাজারটা সিঁড়ি ভাঙতে হয় অথবা রোপওয়ে চড়তে হয়। তা কোভিডের কারনে রোপওয়ে বন্ধ। 

অনেকগুলো সিঁড়ি পেরিয়ে একটা চাতালে পৌঁছে দেখি অনেকদূর অব্দি নীচটা দেখা যাচ্ছে, মেঘের জন্য ঈষৎ ঘোলাটে হলেও গাছপালা, পাহাড় থেকে দূরের নদী আর সমতলভূমি দেখতে চমৎকার লাগে।কতরকম লোক উঠছে, ছোট ছেলে থেকে হাঁফ ধরা বুড়ো বুড়ি সবাই৷ পুন্যের লোভ না ভক্তি জানিনা, এই মনের জোর বাড়ানো ওষুধটা মন্দ কি যাদের কাজ হয়। আমার যেমন হয় না, কিন্তু আমার আবার অন্য জিনিসে কাজ হয়, ওই মন্দিরের কাজ দেখবো, পুরোনো দেওয়ালের গায়ে দিলে কেমন রোমাঞ্চ হয়। মাঝে মাঝে টাটকা দই আর কারি পাতা দেওয়া জল নিয়ে মেয়েরা বসে আছে।  দশ টাকা বিশটাকা গ্লাস, বললেই ঘোল বানিয়ে দেবে। লোভ হচ্ছিল খুব, কিন্তু বাতিকও তো কম না, মানে জল নিয়ে। আসলে সেই একবার ধর্মতলায় লেবুর জল খেয়ে প্রান যায় যায় অবস্থা হয়েছিল  সেই থেকেই আমার অচেনা জল টপ করে খেতে ভয় লাগে। মন্দিরের গায়ের কাজ চমৎকার। কত দেবি দেভী, যক্ষিনীদের মূর্তি, কিছু চিনি কিছু চিনিনা। বাঁদরের উৎপাত ভয়ানক। পান্ডাদের চেহারা বেশ পালোয়ান সুলভ। মন্দিরে গিয়ে পুজো না দিয়ে  স্রেফ কাজ দেখলে কেমন অপছন্দের চোখে তাকায়। ঘুরে ঘুরে এক একটা প্যানেলের কাজ দেখছিলাম, তখনকার দিনের পুরুষমূর্তিদের স্ট্রাকচার কিঞ্চিৎ মেয়েদের মত, নারী পুরুষ বিভাজন চিহ্ন দেখে করতে হয়। এদিকে কালের নিয়মে নাক ইত্যাদি অংশ খসে গেছে, আর আমার মূর্তি সম্পর্কে পড়াশোনাও কম, ফলে আরোই চিনতে অসুবিধে হচ্ছে পূর্ব পরিচিত কাঠামো না হলে। কিন্তু খুঁজে খুঁজে মিলিয়ে এটা চন্ডী ওটা বিষ্ণু এরকম বের করতে পারলে বেশ আনন্দ পাওয়া যায়। 
মন্দিরের পিছন দিকটায় স্বাভাবিকভাবেই লোক কম, পাহাড় কেটে চওড়া রাস্তা হচ্ছে ও দিকটায়, দূরে ঋষিকুল্যা নদী দেখা যাচ্ছে। পাহাড় কাটলে আমার বেজায় দুঃখ হয়। পাহাড় নিজেই একটা জ্যান্ত জিনিস তায় কত প্রাণী, কত গাছ, কত ইতিহাসের আবাস। এত উন্নতি মানুষ রাখবে কোথায় কে জানে! মন্দিরের বাইরে খোদাই করাএকটা মূর্তির উপর একটা গোদা হনুমান বসে বসে আধখানা নারকেলের মালা কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে, আর তার পাশে একটা হেংলু মত ছানা হনুমান প্রানপন তাকিয়ে আছে, যদি ওকে একটু দেওয়া হয়। গোদাটা পাত্তা না দিয়ে খেয়েই চলেছে, শেষে ছোটটা গোদাটার গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো পড়া নারকেল গুলো তুলেই খাচ্ছে আবার তাকাচ্ছে এতে যদি মায়া হয়। অতই সোজা হে, গুঁড়ো খেয়েই আমাদের যাপন চলে মায়া আর লাগে কই কারো! আরেকপাশে আরেকটা ছোট বাঁদর মন খারাপ করে বসে, যেন সাতসকালে ওকে ইস্কুলে যেতে বলা হয়েছে আর ও যেতে চায়ইই না। 
নামার সময় একটা মোটাসোটা প্রৌঢ়কে দেখি ঘেমে নেয়ে অস্থির, হাত ধরে দুটো স্টেপ তুললাম। স্ট্রোক হয়ে গেছে কিনা কে জানে! তবু উঠতেই হবে! নামার পথে লোভ ভয়ের থেকে বেশী হল, টকটক পান্তা স্বাদের ওই দই এর ঘোল খেলুম এক চুমুক। রম্ভায় পৌঁছে ঘরে ঢুকে  দেখি নারকেল গাছের পর্দা চিল্কাকে দেখতে দিচ্ছে না।  ম্যানেজারকে বিস্তর অনুরোধ করে ঘর বদল হল, চান করে কাঁকড়াও খাওয়া হল। যদিও আহামরি কিছু না। পূর্ব ভারতের আতিথেয়তা শিল্পের উন্নতি সাধন খুব দরকারি। হিমাচলের প্রতিটা সরকারি হোটেলের স্টাফদের ব্যবহার খুব ভালো ছিল এখানে যেন দায়সারা ভাব সবার মধ্যে। আজ নৌকা চড়ব না আমরা, কাল যাবো আজ এমনিই বসে থাকবো জলের ধারে, রাতে জ্যোৎস্নায় ধোওয়া পাহাড় হ্রদ দেখবো এই আশায় এসেছি, যদিও আজও আকাশের মুখ ভার। জেটিতে হরেক লোকের আনাগোনা তখন, একটা অল্পবয়সী পরিবার এসেছে, ছেলে মেয়ে দুটো অল্প বয়সেই বাপ মা হয়েছে, ছানাটাও ক্ষুদে। লোকটা, ছেলেই বলা যায়, ছেলেকে সামলাবে না বউকে না শালীর আবদারে পোজ দিয়ে ছবি তুলবে সে নিয়ে নাজেহাল হচ্ছে। খানিক বাদে একটা বড় দল এলো, ক্যাচোরম্যাচোর করে একাকার। কতগুলো নৌকা এলো গেলো, কত গুলো পরিযায়ী পাখি একমনে খাবার খুঁজে গেল। ক্রমে সন্ধ্যে হয়ে এলো, পাহাড় গুলো জমাট ছায়ার মতো হল, জলে সেই ছায়া ঘনিয়ে এলো।  
সন্ধ্যে থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে ফের টুপটাপ করে। ঢাকা বারান্দায় বসে চায়ের কাপ হাতে ঝুপ্সি অন্ধকারে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কখন ব্যাটা থামবে আর জ্যোৎস্না দেখতে পাবো। একটা বড় পরিসরে, চাঁদের আলোয় কখনো কেউ ডুব দিলে তার হয়ে গেল, সারাজীবন বুকের মধ্যে খানিকটা জায়গা বালি বালি জ্যোৎস্না হয়ে যাবে। ভিতর থেকে তাড়া খাবে সবসময়ে, কিন্তু কিসের তা সে জানবে না, টের পাবে না কেন এই অস্থিরতা। তারপর আবার কোনো নিস্তব্ধ চাঁদের আলোয় স্নান করে টের পাবে তার আসল পাওয়ার জায়গা কোনটা, কিসে তার শান্তি। তারপর? তারপর আবার ভুলে গিয়ে খোঁজ লাগাবে।
চাঁদ বেরোলো,  মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে। দূরে চিল্কা আর সংলগ্ন বেঁটেখাটো পাহাড়, গাছপালায় চাঁদের আলোয় অপার্থিব রূপ নিয়েছে। ভালো বোঝা যায় না কেন, কিন্তু এসব সময়টা মনে হয় আমি যেন এখানে অনাহুত, এরা সবাই কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে আমায় দেখেই চুপ, কিংবা এখনো বলছে আমার কানে যাচ্ছে না। আমি পাহাড়, জল, গাছ, বাতাস সবেতেই প্রাণ খুঁজে পাই, আমার কাছে এরা কেউই প্রাণহীন না।মনে হয় এদের ভাষা শিখে উঠতে পারিনি এখনো তাই বুঝতে পারছিনা। মেঘের কারনে চাঁদের আলো ব্যহত হচ্ছে ঠিকই, তাছাড়া বৃষ্টিতে ছাদটা খুবই ভয়ানক কাদাকাদা হয়ে আছে। পূর্ব ভারতের সরকারী প্রপার্টি, তাই এদের ছাদ তকতকে রাখার দায় নেই আর কি! রাতে খেতে গিয়ে সে এক চিত্তির, উড়িষ্যায় এসেছি ডালমা খাবো মেনুতে থাকলে সেটাই স্বাভাবিক। তা বাবুরা ডালমা বানাতে যা সময় নিলেন, ফ্রায়েড রাইস চিলিচিকেন নেমে যেত। সময়টা বৃথা যায়নি অবশ্য। এক ভদ্রলোক বাইক চালিয়ে ব্যঙ্গালোর থেকে আসছেন, কত অনামা গ্রামে ঢুঁ মেরেছেন,কত ডিট্যুর করেছেন সেসব শুনছিলাম। আর্লি রিটায়ারনেন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুনলেই ভাল্লাগে এসব। সকালে চিল্কাতে বোটিং করা হিবে ইনি আমাদের অনুরোধ করলেন ওনাকেও সাথে নিতে, একার জন্য খরচটা বেশী হয়ে যেত। বেশ তো আপত্তির কিছু নেই আমাদেরও। 
বোটিং এর সঙ্গী আরো একটি কাপল জুটে গেল। ভালোই তো ভাগাভাগি হবে খরচ। হালকা ভয় ছিল, এরা কিরকম লোক হবেন, "অ্যাই বাবু লেজ খাবি", কিংবা " হ্যাঁ বাবলাদা, দারুণ, বিউটিফুল  জায়গা বুঝলে, কাল হেব্বি মাছ খেয়েছি, রাতে একটু চলেছে বুঝলে তো...." এরকম লোক হলেই চিত্তির। খুব উচ্চকিত উচ্ছ্বাস বরদাস্ত হয় না। যাক সৌভাগ্যক্রমে এঁরা সেরকম নন। অবশ্য রম্ভা তো তেমন পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয়, ফলে ওই ভীড়টা কমই। মাঝির পেট্রল বাঁধা, যতটা ঘোরানোর কথা ততটাই ঘোরাবে। তবে কাঞ্চনমূল্য ধরে দিলে তেমন পূজার ত্রুটি মাফ হয়ে যায়, জল থেকেও পেট্রল উৎপাদিত হয়। সেই কোনকালে কোন সাহেব এসে হ্রদের মাঝে ঘর তুলেছিল, স্রেফ সকালে ব্রেকফাস্ট খাবে বলে ভাবলে ভারী অবাক লাগে। অবশ্য শখ শৌখিনতার সাথে  প্রাচুর্য্যর যোগ আছে তো বটেই। সাহেব শৌখিন ছিলেন বটে। হ্রদের ধার ঘেঁষে থাকা বেঁটে খাটো পাহাড়ে হরেক পাখির আনাগোনা, ময়ূর, মাছরাঙা, পানকৌড়ি আরো অনেক মাইগ্রেটরি বার্ড। বাঁদরও আছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছেনা, নিজের মত মাছ, কিংবা পোকা কিংবা ফল খুঁজছে খাচ্ছে। মাইগ্রেটরি বার্ডদের ভয়ানক আশ্চর্য লাগে। বছর বছর একই রাস্তা ধরে কেমন আসে। সাংঘাতিক স্মৃতিশক্তি বটে। আচ্ছা এই যে চলার পথে আমাদের দেখে, গাছেদের ডালে বসে, কত নতুন পাখিদের সাথে আলাপ হয় এসবও মনে রাখে? পরের বছর এসে খুঁজবে আমায়? 
আজ দুপুরেই ট্রেন ফেরার। কিন্তু ট্রেনটার আপডেট পাচ্ছিনা অনেক্ষন থেকে। বিজয়ওয়ারা ঢকেনি এখনো সেটাই দেখিয়ে চলেছে। স্টেশনে গেলে বোঝা যাবে। আপাতত টামপারা লেক যাই। আজ ভারী রোদ ঝলমলে দিন। এতোই বেশী টাম্পারায় বোটিং করার কথা ভাবা যাচ্ছে না। কিন্তু হ্রদটা ভারী সুন্দর। নীল আকাশ, গাছাপালা ঘেরা হ্রদ, দূরে একটা ঘাটে স্নান করছে কিছু যুবক লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে। আমারও স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এমন টলটলে জলে কিন্তু ট্রেনটার কী হল খোঁজ নেওয়া দরকার।
স্টেশনে এসে মাথায় হাত পরে গেল। চেন্নাইতে বন্যা হয়েছে,  অনেক কটা ট্রেনের ট্র‍্যাক জলের তলায়, আমাদের ট্রেন কোথায় কেউ জানে না। হ্যাঁ বেরিয়েছে যখন হাওড়া যাবে তবে সেটা কাল না পরশু কেউ জানে না! কাল ভোরের মধ্যে না পৌঁছলে আমাদের চলবে না। একজনকে উজিয়ে যেতে হবে আরো দুশ কিলোমিটার সেখান থেকেই। আর একান্তই না হলে সকালের মধ্যে, তাতে যদি একজন অন্তত অফিস করতে পারে। উপায় কি? এখন আর কোনো ট্রেন নেই। কাছাকাছি বড় স্টেশন ভুবনেশ্বর। খোঁজ লাগানো শুরু হল গাড়ির,যদি ভুবনেশ্বর অব্দি চলে যাই তাহলে কত টাকা লাগবে, কতক্ষন লাগবে? সেখান থেকে ট্রেন পেয়ে যাবো অনেক বা বাস। পরের একটি ঘন্টা চলল আত্মীয়দের থেকে (ময়ূরাক্ষীর এক মাম থাকেন এদিকেই),  ইন্টারনেট থেকে পাওয়া নাম্বারে, আমাদের ড্রপ করে গেল যে গাড়ি তাকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া। আজ বিয়ের দিন বলে সমস্ত গাড়ি বুকড,কিছুই পাওয়া গেল না। একজন বলল যদিও পাঠাচ্ছে, খানিক বাদে সেও বলল হবে না! আমি ওলা,  এমএমটি এসবও দেখেছি কিচ্ছু নেই এখানে। ব্রহ্মপুরে সার্ভিস নেই!  শেষে স্থির হল, চলো বাস স্ট্যান্ডে যাই। কোনো বাস ধরে ভুবনেশ্বর যাই। এ জায়গা একটেরে ছোট্ট স্টেশন হলেও ভুনবনেশ্বর না, অন্তত সেখান থেকে কিছু না কিছু মিলবেই৷ যে অটো ধরে ফের স্টেশন থেকে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছি সে কথা শুনে কিছু বুঝেছে মনে হয়। বলল, কেন এখান থেকেই সোজা কোলকাতার বাস যায় তো, ওতেই চলে যান, আবার ভুবনেশ্বর ইত্যাদি করার দরকার কি?

এরপর হল সংগ্রামের ইতিহাস। বাপরে বাপ, সে কি মারাত্মক জায়গা ব্রহ্মপুর বাস স্ট্যান্ড। বিশ বাইশ  বছর আগের হাওড়া বা ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড মনে আছে কারো? সেরকম ভয়ানক জায়গা, অজস্র দালাল, কোন বাস কখন ছাড়বে কোনো প্রপার কাউন্টার নেই। সরকারি কাউন্টার মাছি ওড়ানোর ভঙ্গীতে আমাদের তাড়িয়ে বলল আজ আর কোনো বাস নেই। আর কোনো সাহায্য মিলবে না মুখ করেই বলল। ফের গেলাম বেসরকারি বাস ছাড়ছে যেখান থেকে সেখানে। একটা লোক যার সর্বাঙ্গ থেকে দেশী মদের গন্ধ ভেসে আসছে এই বিকেলবেলাতেই, সে আমাদের খুব অ্যাসিওর করছে যে এই বাস ভুবনেশ্বর অব্দি যাবে ঠিকই, কিন্তু সে দায়িত্ব নিয়ে আরেকটা বাসেতুলে দেবে। মানে তুলে দেবেনা, ফোন নাম্বার দেবে। তাকে কাটানো কি সোজা, না মশাই যাবো না বলে হেঁকে ডেকে খোঁজ নিতে গেলাম ডিরেক্ট বাস আছে কিনা, আছে একটি কিন্তু সাড়ে পাঁচটায় ছাড়বে আর কিছু নেই। ব্রহ্মপুরের সার্ভিসের ওপর অতটাও ভরসা আর নেই ওই একটি বাসের ভরসায় থাকবো, এদিকে রেডবাসে দেখছি ভুবনেশ্বর থেকে ভলভোর আর দুটি টিকিটই আছে। ভুবনেশ্বর কতক্ষনে পৌঁছবে তাও বুঝছিনা, টিকিট কেটে পৌঁছতে না পারলে? শেষমেশ যা হবে হোক,একটা ভুবনেশ্বরগামী বাসেই উঠলাম, ততক্ষনে আরো অনেকটা সময় চলে গেছে এক এজেন্ট থেকে অন্য এজেন্ট ছোটাছুটি করতে। তারা আমাদের একটা প্রায় ছেড়ে যাওয়া বাসে বসিয়ে দিল। স্লিপার কোচ, কিন্তু আমরা বসে যাওয়ার সিট পেয়েছি। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, অল্প আলো ছায়ায় দেখছি কেউ নিজের জুতো মাথার পাশে রেখে আরামে ঘুম দিতে যাচ্ছে স্লিপার সিটে, কেউ বা জুতো রাখছে জলের বোতলের খোপে। আমাদের দেশে সাধারন পরিচ্ছন্নতা বোধের একটু অভাব আছে। খানিক এমপ্যাথির অভাবও, ওইখানে কেউ জলের বোতল রাখতে পারে ভাবার দরকার কি! আমার হলেই হল। বাস ঘন্টা দুই চলার পর টয়লেট যাওয়ার একান্তই দরকার পরল, বারংবার কন্ডাকটরকে বলে যা বুঝলাম, ওদের ইচ্ছে যেখানে হবে সেখানেই থামাবে। মুখের উপর হ্যাঁ হ্যাঁ থামাচ্ছি বলাটা ওদের এক মিথ্যে বুলি। আরো জ্ঞন্টাখানেক পর যেখানে থামালো, সেটা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। এর আগে বড় বড় কিছু ধাবা পেরিয়ে এসেছি। মেয়েরা কোথায় যাবে ভাবার দরকার নেই! বাকি যাদের সে সুবিধে আছে তাদের ওই সামান্য রাস্তার ধারেই কাজ সারতে হল।  সাড়ে চার ঘন্টা না পৌঁনে পাঁচ ঘন্টা নাগাদ যখন পৌঁছলাম ভুবনেশ্বর একটাই চিন্তা, ট্রেন তো সব ভরা দেখাচ্ছে, বাসেও কি জায়গা পাবো না?

বাস স্ট্যান্ডের প্রায় প্রতিটা কোলকাতা গামী বাসে খোঁজ করে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল যে নাহ, জায়গা নেই। কেউ কেউ অফার করল  মেঝেতে বসে যাবার জন্য৷ একটা বাস পেলাম যার কেবিনে দুটো জায়গা হতে পারে। কেবিনে বসে সারারাত যাওয়া? একা হলে হয়ত ভাবতাম না, কিন্তু ময়ূরাক্ষীর পক্ষে একটু বেশীই চাপের হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান ময়ূরাক্ষী আমার আজীবনের  ট্রাভেল পার্টনার বলে। আমাদের কাছে উপায় তখন ভুবনেশ্বর হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে বাস বা কিছু ধরে যাওয়া অথবা এই বাসে কেবিনের সিটে বসে যাওয়া। ভাবার উপায় বেশী ছিল না সিট ভর্তি হয়ে যাচ্ছে, হ্যাঁ কেবিনের সিটের জন্যেও ময়ূরাক্ষী সম্মতি জানাতেই টিকিট নিয়ে নেওয়া হল। পুরো দামই পড়েছিল। লাস্ট খেয়েছি ব্রহ্মপুর স্টেশনে, ট্রেনে খাবো বলে আনা আলুর পরোটা, মাঝের সময়টা বাস ধরতে পারার তাড়নায় খিদের কথা ভাবার ফুরসত হয়নি।আর এ বাস কোথাও খাবার জন্য থামবেও না। তড়িঘড়ি কিছু শুকনো খাবার আনাগেল। তারপর শুরু হল বিচিত্র ভ্রমন। আরো তিনটি ছেলেও উঠেছিল কেবিনে, অল্পবয়সী খেটে খাওয়া ছেলে বোঝা যায়৷ তাছাড়া কেবিনে ড্রাইভার, খালাসী আর কন্ডাকটর।  বাস খানিক এগোতেই, মহানন্দা ব্রিজ। যে চাঁদ দেখার জন্য এতো ছুটোছুটি,  সেই চাঁদে ভেসে যাচ্ছে মহানন্দা নদী। আধঘন্টা চলা যায় এমন সিটে সারারাত পারি জমানো আমরা সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ক্রমে শহর ছেড়ে হাইওয়ে ধরে এগোতে লাগলো বাস। রাত বাড়লো, মাঝখানে পেরিয়ে যাওয়া জনপদ, শহর ক্রমে ঘুমন্ত হল। মূল বাসের মধ্যে এসির আরামে বাকিরাও ঘুমোচ্ছে। খানিকবাদে কন্ডাকটর চলে গেল, তারও একখানা শোওয়ার জায়গা আছে। কেমন আমাদের দিল না দেখলি বলে আমরা খুব লোভী চোখে দেখলাম। খালাসী চাপড় মেরে মেরে সাউন্ড বক্স চালালো। নব্বই এর যে গান একদম চলেনি, সে গানগুলোই এদের এত পছন্দ কেন কে জানে! 

ডিট্যুর করে ড্রাইভার খাবার তুলে নিল এক ফাঁকে, রুটি,  পনিরের তরকারি। খালাসী রোল করে করে খাইয়ে দিল ড্রাইভারকে। ময়ূরাক্ষীকে বললাম দেখে নে রে, খিদে পেলে একটা চিপ্স দিলে হবে না লম্বা সফরে বেরোবো যখন। এর আগে টোলে কিচ্ছু দেয়নি এরা, আমরা ডেলি বাস ইত্যাদি বলে এখন দেখলাম বাংলায় ঢোকার  আগে ড্রাইভার বদলে গেল,  মানে একজন মাঝরাস্তায় উঠে এলো আর একজন নেমে গেল। এমনকি ফাস্ট্যাগ অব্দি বেরিয়ে এলো, আর বাসের বোর্ড,  যাতে লেখা থাকে কোথায় যাচ্ছে সেটাও বদলে গেল। এত কিছু জানাই যেত না কখনো বাসে ঘুমিয়ে থাকলে! এও একবার হল্ট দিয়েছিল, কিন্তু কোনো দোকানে না, স্রেফ রাস্তার উপর। আবার সেই একই অবস্থা মেয়েরা কোনো রকমে বাসের পিছনে আড়াল খুঁজতে গেল, ছেলেদের লজ্জা পাওয়ার অধিকারও নেই, গাছের এক ধারে দাঁড়লে অন্য ধারে আরেকজন দাঁড়িয়ে যায়। আমি পশ্চিমবঙ্গে,  হিমাচলে বাসে ট্রাভেল করেছি লম্বা লম্বা, এরকম অসভ্যতা উড়িষ্যাতেই দেখলাম। ধাবাতে দাঁড়াতে কী হয়? নাকি রাস্তা আমাদের জন্মগত ডাস্টবিন, শৌচাগার সব এ ধারনা এ রাজ্যে বেশীই? হাইওয়ে ঘুমোয়না। ড্রাইভারের ঠিক পিছন থেকে রাস্তা দেখতে দেখতে আর নিজেদের মধ্যে তামাশা করতে করতে দেখলাম অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে গেছি কখন। আসলেই কঠিন সময়গুলোয় অসুবিধের দিকে ফোকাস রাখলে জার্নি আরো আনকম্ফোর্টেবল হয়ে যায়। 

ভোরবেলা বাবুঘাটে এসে ভাঁড়ে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে যে আরামটা পেয়েছিলাম বলার না। সত্যি বলতে কাল রাতেও ভাবিনি এরিকম ভাবে সত্যিই পৌঁছে যাবো, কিন্তু দিব্যি গেলাম যখন দেখলাম সারারাত ঠায় বসে থেকে এসে আবার অফিস করতে করতে মেসেজ করছি, পরের বার পাহাড় যাবো বুঝলি? 

Monday, February 14, 2022

চাঁদ দেখতে.. গোপালপুর রম্ভা

আমাদের উঠলো বাই তো ঘুরতে যাই এমন না, আমাদের হল ওহ আগের উইকেন্ড বাড়িতে ছিলাম এবারেরটায় না বেরোলে কেমন করে হবে! পড়াশোনা, কাজ, সব গোল্লায় পাঠিয়ে আমরা ঘুরতে চলে যাই। আমাদের "উন্নতি" হয়না, আনন্দ হয়। এবার কোনটা ভালো কোনটা খারাপ এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু সে সময়টাও আমরা আনন্দ করে কাটিয়ে দিই।  এমন না আমরা খুব "অফবিট" জায়গা খুঁজে ঘুরতে যাই। আজকাল অফবিটে যা ভীড় অর্থে পপুলার ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ত ভীড় কম! কদিন আগেই হিমাচল ঘুরে এসেছি, পকেটে টান পরে কিনা বলতে পারবো না, আমার ঝোলায় ক মুঠো চাল আছে সে দেখে আমি বেড়াতে বেরোইনা, ঝোলার খবর নিতে যাওয়ার সময়টা বরং পথের খবর নেওয়া জরুরি বোধ করি। পরে সে যা হবে দেখা যাবে কিন্তু দিন ফুরোলে জিরোনো ছাড়া গতি থাকবে না। মুশকিল অন্য জায়গায়, ছুটি মেলে না সহজে। শহরে জ্যোৎস্না দেখে দেখে বা বলা ভালো না দেখে দেখে আমরা ক্লান্ত। তাই ঝুপ ঝুপ করে পূর্ণিমা দেখে টিকিট কাটা। একটু নিরিবিলি, বিশেষ কিছু "করার" নেই তাই তাই গোপালপুর আর রম্ভা। গুরু নানকের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা দিন ছুটি পাওয়া যেতে পারে, সুতরাং, ঘরে কে থাকে আর। 

হাওড়া স্টেশনে সাউথের ট্রেন ধরার জন্য দাঁড়ালে বেশ অদ্ভুত একটা ফিলিং হয়। এই যে দাঁড়িয়ে আছি সামনেই ছোট ছোট প্লাস্টিকের চাদর পেতে আলাদা আলাদা পরিবার বসে। রাতের খাওয়া চলছে দিব্যি স্টেশনের মেঝেতে বসেই। আমি কি একটু উন্নাসিক হয়ে গেছি? আমি কিছুতেই পারবো না। অবশ্য আমার বাতিক একটু আছে বরাবরই অস্বীকার করে লাভ নেই। কিংবা সেরকম দায়ে পড়ে গেলে খেয়েও নেব কে জানে। খাওয়া দাওয়ার পর বাসন মাজাও হচ্ছে কাছে কল থেকে। এরই মাঝে কেউ ঘুমোচ্ছে প্রেমসে, ব্যাগ পোঁটলা কিচ্ছুর চিন্তা না করেই। ট্রেনের সময় সমাগত, এঞ্জিনের পরে পরেই জেনারেল সম্ভবতঃ,  ভীড়ে থিকথিক করছে সেখানটা। কোভিড এর ভয় মিডিয়ার বাইরে বরাবরই কম, এসব জায়গায় আরো কম স্বাভাবিক ভাবেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেকেন্ড ওয়েভ খানিক মাথা নামিয়েছে। আমাদের আলাদা আলাদা জায়গা পড়েছে এবারে। আমার সাইড লোয়ারের সাথে কেউ সিঙ্গল সাইড আপার থাকলে বদলে নেবো এই আশায় ছিলাম। তা আমার পাশে সাইড আপারে যিনি এলেনে তিনি তো এন্ট্রি নিলেন একেবারে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির খুব খারাপ নকল ভার্শনের মতো। রাত  এগারোটায় সানগ্লাস পকেটে পুরে ধীরে সুস্থে জানালেন,  না তার পক্ষে সম্ভব না কোথাও যাওয়া। বেশ বেশ। এবারে ট্রেনে আবার সবাচ্ছা পরিবারের ভীড় বেশী। আমার ট্রেনে বাচ্ছা থাকলে একটু আতংকই লাগে। অধিকাংশ বাবা মা মুগ্ধ কাজল পরে থাকে। ময়ূরাক্ষীর সিটটাও লোয়ার ছিল, ফলে একজনকে আমার সাইড লোয়ার দিয়ে তার মিডল বার্থটা নেওয়া গেল, কিন্তু কপালগুনে উলটো দিকে একটি বছর চার পাঁচেকের বাচ্ছা সহ পরিবার।  রাত এগারোটায় ট্রেন ছাড়লো, তার মিনিট দশ পনেরো পর ধীরে সুস্থে তারা বাচ্ছাকে খাওয়াতে বসল, বাচ্ছা খাবে মোবাইল দেখতে দেখতে, অবশ্যই লাউডস্পিকার অন থাকবে ফোনের। তারপর ঘন্টাখানেক পর বাচ্ছার বাবা মা খাবে, তারও খানিক পর বাচ্ছার বিছানা করে ঘুম পারানো অব্দি সেই মোবাইল তারস্বরে বাজবে। মোটামুটি একটা দেড়টা অব্দি এসব চলল। ওবাবা সাত সকালে সেই ছানা নাগাড়ে চেঁচিয়ে সবাইকে তুলে দিলেন। তারপর ঘন্টাখানেক মোবাইলে ভিডিও চালিয়ে,  সবাইকে বিরক্ত করে তিনি নিদ্রা গেলেন! 

এদিকে ট্রেন চলতে চলতে দেখি পাহাড় আর হ্রদের মাঝখানের একরাস্তায় এনে ফেলেছে। বাঁ পাশের জানলা দিয়ে তাকালে দেখি ছোট ছোট পাহাড়, আর ডানদিকে তাকালে চিল্কা। ভারী সুন্দর ওই রাস্তাটা। খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে, জানলার কাচ দিয়ে টুপটাপ চল পড়ছে, বৃষ্টি ধোয়া কাচ দিয়ে নীল চিল্কা দেখা যাচ্ছে। এসেই পড়লাম প্রায় আর একটু পরেই নামবো। ট্রেনের  জায়গাও অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে, ভুবনেশ্বরেই যা নামার নেমে গেছে, বাকিরা সেই দক্ষিন ভারতেই চলেছে। চিকিৎসার কারনেই যায় মূলতঃ,  বাক্স প্যাঁটরা বেশী থাকে, তাদের চোখে মুখে হালকা একটা উদ্বেগ। ব্যবসা বা চাকরির জন্য যাচ্ছে যারা তারা অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক।  আমার মানুষ দেখতে বেশ লাগে। আজকাল মাস্কের কারনে মুখ ঢাকা থাকে ফ্লাইটে, কিন্তু ট্রেনে এত কেউ মানে না। দিব্যি মাস্ককে চোখের ফেট্টি করে যেতেও দেখি, কোভিডে ভয় প্রথম দফায় পেয়েছে লোকে কিন্তু এখন আর সাধারণ মানুষের ক্ষমতা নেই ভয় পাওয়ার। 

ব্রহ্মপুরে নামার লোক বেশী নেই। ট্যুরিস্ট তো কেউ নামলো না, স্থানীয় মানুষ নামলো কয়েকজন। স্টেশনটা বেশ ঝকঝকে তকতকে, ছোট্ট স্টেশন হলে একটা লিফট আছে। বুড়ো কিংবা পায়ের সমস্যায় থাকা মানুষগুলোর কথা ভেবেছে সেটাই ভালো ব্যপার। আমাদের সাথে লাগেজ খুব বেশী না, তবে গোপালপুরে আমরা ঘুরতে এসেছি পুরোনো দিনের মতো হোটেল বুক না করে, আর এখানে হোটেল তেমন কেতের কিছুতে থাকবো এমন প্ল্যানও নেই, তাছাড়া এই কোভিডের চক্করে ট্রেনে লাগেজ দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে এক্সট্রা চাদর বইতে হয়। তাও দরাদরি করে অটোয় না ওঠার মত লাগেজ না। গোপালপুরে যেখানে নামাবে সেখানেই বিচ শুরু, আর হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল। দিব্যি ছিমছাম জায়গা। তবে যে হোটেলে শুরুতে ঢুঁ মারতে গেছি সেখানে একটা ১৭ সিটার গাড়ি এসে থেমেছে, আর যেখানেই থাকি বাপু এখানে না এই বলে  এদিক সেদিক করে একটা হোটেলে আস্তানা গাড়া গেল। সমুদ্রের ধারের হোটেল, এসি আছে যদিও আমাদের লাগবে না, বাথরুমও পরিষ্কার,ঘর দোরও একটু আগে মুছে গেছে কড়া ফিনাইলের গন্ধই বলে দিচ্ছে। সস্তায় ঘুরবো বলে এসেছি এর চেয়ে বেশী আর কিই বা চাই। 

জায়গাটা খুবই ছোট্ট আর শান্ত। ভাতের হোটেল আছে,  যেখানে সস্তায় ভাত ডাল তরকারি মাছ মেলে, ছোটখাটো চাউমিন ইত্যাদির দোকান। সব মিলিয়ে একদম নিরালা একটা সমুদ্রতীরস্থ গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে পান্থনিবাসের দিকে এগোচ্ছিলাম। রাস্তায় লোক নেই বিশেষ, পান্থনিবাস মনে হয় বালিয়াড়ি বাঁচাতেই একটু ভিতরের দিকে বানিয়েছিল। মুশকিল রাতের বেলা ঝাউবন পেরিয়ে সমুদ্রে যেতে দেয় না। তাই এটাকে আমরা থাকার জন্য ভাবিনি। কিন্তু জায়গাটা এমনিতে ভারীসুন্দর। লোকজন নেই, ঝাউবন পেরিয়ে বালিয়াড়ি টপকে সমুদ্রের ধারে উল্টোনো নৌকার পাশে গিয়ে বসা গেল।  সমুদ্রের সাথে প্লেটোনিক প্রেমে আমার চলে না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্র বুকের মধ্যে ভরে নেওয়ার স্থৈর্য আসেনি এখনো, তাই জল দেখলেই নামতে ইচ্ছে করে, পায়ের তলার বালিগুলো তিরতির করে বয়ে যায় আঁকড়ে ধরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাতে এই বয়সেও আনন্দ পাই। একটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে একা একা, দূরে এই অবেলাতেও কটা ছেলে জলে নেমেছে।সমস্ত জায়গাটা শান্ত নিঝুম মতো। ওই দূরে দুটো মাঝি ছায়ায়  জিরুচ্ছে। জলে নামাই যাক নাকি? বিকেল হয়ে এসেছে তাতে কি? 
এদের আজ কী যেন উৎসব আছে। এই কার্তিকের পূর্ণিমা উপলক্ষ্যেই। অমন ফাঁকা সমুদ্র সৈকত খানিক বাদেই লোকে লোকে ভরে গেল। তবে এখানকার ভীড়ের চরিত্র কিঞ্চিৎ আলাদা মনে হল। নিজেদের মধ্যে গল্প, আনন্দ করছে বটে, কিন্তু উচ্চকিত কোলাহল যা বিরক্ত করে অন্যকে তা বিশেষ টের পেলাম না। মেলায় মূলতঃ ঝালমুড়ির স্টল, আর না হলে প্লাস্টিকের খেলনা। ভীড়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকলে চোখে পড়বে, ভাঙা এক পরিত্যক্ত  বাড়ি চারিদিকের সাজানো  হোটেলের পাশে দিব্যি দাঁড়িয়ে। এখানে আকাশ এত নীল, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের আওয়াজ এতোই জোরালো তার মালিন্য চোখে পড়েনা, বরং মনে হয় যেন ইতিহাস কী বলতে চায়, কান পাতলেই শোনা যাবে কিংবা হয়ত যাবে না। সেসব পেরোলে আরো নানাব রকম পসরা সাজিয়ে লোক বসেছে। ভারী চমৎকার একটা স্থানীয় খাবার খেলাম। অনেকটা ভাপা দই এর মত। শালপাতায় দেয়, দিব্য খেতে। রাস্তাতেও মেলার রেশ। দুপুরে যে ফাঁকা শুনশান রাস্তা দেখেছিলাম বিকেলে তাই ভরন্ত গাছের মতো হয়ে গেছে। খাওয়ার দোকান, মানুষ, আনন্দ। আচ্ছা একটু তফাৎ থেকে দেখে, মানে আমরা যেমন কোনো উই এর ঢিপি,বা মাছের ঝাঁক, কিংবা পিঁপড়ের সারি দেখি, আমাদের যদি কেউ এরকম ভাবে দেখে কিরকম লাগে তার? ঘিনঘিনে? মজার? ভয়ের? 
পূর্নিমা দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু চাঁদ আমাদের ভাসাতে রাজী না এবারে।থেকে থেকেই বৃষ্টি আসছে টিপটিপ করে, মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ। একটু রাতে মেঘ কাটতে শীতের কামড় উপেক্ষা করে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেক্ষন। সীবিচ ফাঁকা হয়ে গেছে ততক্ষনে। জোরালো আলো লাগানো আছে বটে, কিন্তু সমুদ্রে চাঁদের আলো বোঝা যায় বেশ। কেউ কোথাও নেই তেমন। অনেক অনেক পরে পায়ে ব্যথা হয়ে নীচে এসে দুখানা চেয়ার পেতে বসা গেল, একটা শুনশান সমুদ্রের হাওয়া, চাঁদ আর সমস্ত ক্লান্তি উড়িয়ে পাশাপাশি চুপ করে বসে থাকার আরাম নিয়ে। 
(ক্রমশঃ)

Sunday, January 23, 2022

আমলামেথি আর বিদ্যেধরী

সড়াৎ করে টার্ণটা নেওয়ার পর থেকেই রাস্তাটা খারাপ হতে শুরু করেছিল। তাও গুগল ম্যাপকে ভরসা করেই বেঁকেছিলাম। এখন তো একেবারে ফাটা বাঁশে আটকে যাওয়া কেস রে ভাই।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বিশ্রী আবহাওয়া। লেপমুড়ি দিয়ে ভূতের গল্প পড়ো, মাঝে মধ্যে একটু কফি খেলে। দুপুরে কচ্ছপের মতো অতি কষ্টে বেরিয়ে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি খেলে ব্যস। আর কিচ্ছু করা শাস্ত্রে মানা। কিন্তু মাঝে মাঝে শাস্ত্রের নিয়ম অগ্রাহ্য করাও মহারাজ ঋকানন্দের নিয়ম৷ লম্বা পাড়ি দেওয়া হয়নি অনেকদিন, জলের শব্দ শোনাও হয়নি কত্তদিন। এই বছরের একুশটা দিন কেটে গেছে আমি আপিস করেছি, খেয়েছি, আড্ডা মেরেছি, ঘুমিয়েছি, পড়েছি, উদ্ভট ভিডিও দেখেছি কিন্তু নিঝুম দুপুরে নদীর ছলাৎ ছলাৎ শুনিনি, নতুন মানুষ দেখিনি, পথের ধারে হঠাৎ থেমে চায়ের দোকানের সস্তার কেকে আমেজ করে কামড় দিইনি, হুট করে আসা বৃষ্টিতে কিংবা শেষ বিকেলের সূর্য মাখিনি। পথ আমার সব শক্তির আধার, আমার ভালো থাকার ওষুধ। তাই আমার উপায় ছিল না  আজ লেপমুড়ি দিয়ে জিরোবার।

যাওয়ার জায়গার অভাব নেই। কিন্তু ট্যুরিস্ট প্লেসে ঠিক যেতে চাইছিলাম না। একটু হলেও নাগরিক উল্লাস তফাৎ থাক। আবার নদীও চাই,  সমুদ্র বা পাহাড় তো বললেই পাওয়া যায় না। সুতরাং গুগলবাবুকে একটা গাঁ এর ঠিকানা দেওয়া হল। আমলামেথি। কেমন সুন্দর নাম না? নাম শুনেই প্রেমে পড়ে গেছিলাম আসলে। তা গুগলের মনে হয় অত ভালোলাগেনি। ওই যে ওর কথা না শুনে শুরুটা অন্য রাস্তা নিয়েছিলাম তাতেই তার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে মনে হয়। শুরুতে বলছিলাম না, ওই চুড়িবাজার থেকে টার্ণ নিয়ে খানিকদূর ভারী সরুরাস্তা দিয়ে এগোনোর পর দেখি একটা দরগার পাশে মেলা মতো বসেছে, আর সেই দু পাসের পসরার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে জায়গা আছে তাকে যদি রাস্তা বলা যায় তবে সে রাস্তায় ওইদিক থেকে একটা টেম্পো আর বড় লরি ঢুকে এসেছে। এদিকে আমার বাঁ দিকে গরম জিলিপির কড়াই, ডানদিকে এক বাইকওয়ালা আরাম করে চিনেবাদাম সওদা করছে। সবাই অপেক্ষা করছে কখন তার কেনা শেষ হবে সে গেল, এরপরেই সাঁত করে কটা ভ্যান ঢুকে ব্যাপারটা বেশ খোলতাই করে দিল। একদিকে খাদ আর উটের দ হয়ত নেই কিন্তু গরম জিলিপির কড়াই, লরি,আর কাঁচা রাস্তার কম্বোটাও কম না। কী করে যে পার হলাম সে দ তা আমারও মনে নেই। আমার হাতেই স্টিয়ারিং ছিল কিন্তু ও পথ দিয়ে আমি মানে এই আমিই পেরিয়েছি!!

এই বীর ভাব কিন্তু বেশীক্ষন রইলনা। গুগল ম্যাপ আজ আমাদের বেশ অ্যাডভেঞ্চারে নামাবেন স্থির করেছেন। দু কদম যেতে না যেতে তিনি আরেকটি বাজারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে। শুক্রবার না হলেও শনিবারের হাটও বেশ রমরমাই৷ মাছ,সবজি, গামছা, দাদের মলম আর তার সাথে রাস্তা সবার মানে আমারও মান্র আমার সাইকেলের এই ভাবনায় কিছু মানুষ সাইকেল রেখে দিয়েছে। সেসব সদিয়ে যাও বা পেরোলাম,  একটা সরু এমন রাস্তায় ঢোকালো, যার একদিকে পুকুর,একদিকে খাটাল বা বাড়ির দেওয়াল! আর ভরসা করা গেল না। আমার সনাতনধর্ম বেঁচে থাক, মানুষ ডেকে জানা গেল আর কিলোমিটার দুই এই রাস্তা সইলে মেন রাস্তায় ওঠা যাবে। দাঁতে দাঁত চেপে এসব খারাপ সময়গুলো পার হলে কিন্তু ম্যাজিক মেলে, আর খারাপ রাস্তাতেই  মেলে। এই যেমন দেখোনা, ভেড়ির ধারে গাড়ি থামিয়ে, হাঁটতে মন্দ লাগছে নাকি? রোদ বেরোয়নি ঠিক কথা কিন্তু এই যে পানকৌড়ি কাদাখোঁচা আরো কত চেনা অচেনা পাখি উড়ছে। আরো কতক্ষন পরে ফের রওনা দিলাম। কত লোকে পথ চিনিয়ে দিল এদিক না ওদিক, রাস্তায় নামলে রাস্তা চিনতে আর কঠিন কি। ।

আবারও একটা সরু রাস্তায় ঢুকে পড়েছি। এবারে আবার একদিকে খাল একদিকে খেতিজমি।বৃষ্টি এলো ঝমঝম করে এর মধ্যেই।একটা ন্যাংটো খোকা ছাতা মাথায় দৌড়ে গেল, দুটো ছোট মেয়ে  ছুটতে ছুটতে বৃষ্টি মাখছে, একটা ছোট ছেলে তার ছোট ছাগল ছানা বুকে জাপটে নিয়ে মাথা বাঁচাতে যাচ্ছে। পথের ধারে কত অজস্র দৃশ্য তৈরী হয় সেসম দু চোখে নিয়ে এই বিপজ্জনক রাস্তায় চলতেও অসুবিধে হয়না। বৃষ্টি থেমে যায় আচমকাই, দূরে দবুজমাঠ আরো তকতকে হয়ে করে দিয়ে৷ একজনকে জিজ্ঞেস করি রাধারাণীপুর জায়গাটা কোথায়?  কেউ চেনে কেউ চেনে না, তবে আছে ঠিক। আসলে চলার নেশাতেই চলছি, পৌঁছতেই হবে এমনও কিছু নেই। তবুও পথচলতি লোক উপযাচক হয়েই বলে দেয়,  কেউ বলে আগিয়ে দেবো চলো। পথের ধারে এর কুড়িয়ে পাওয়া ধন থাকে আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছেই করে না তাই।


আমলামেথি নামের মতোই জায়গাটা। মস্ত গাছের নীচে ছোট্ট দোকান, দুপুরের খাওয়া চলছে তখন। রাস্তায় থেমে চা বিস্কুট খেয়েছিলাম এক জায়গায়। বাপ গিয়েছিল খেতে, সদ্য গোঁফের রেখা গজানো ছেলে সামলাচ্ছিল দোকান।ভাত খাওয়া থামাতে ভাল্লাগেনা কারো, তার চেয়ে চলো নদীর কাছেই বরং। বিদ্যেধরী নদীর কাছে কতবার এলাম এই নিয়ে? কী জানি! এক নদীতে তো একের বেশীবার আসাও যায় না। দুপুরের খেয়ায় ছাগল, বাইক, সাইকেল, ডাব সবই চলেছে ওইপারে। অত বাছবিছার চলে না এদিকে। ছাগলও বাধ্য ভারী, চারটি কাঁঠালপাতা দেওয়া আছে, চিবিয়ে চলেছে আপন মনে। ওইপারে পৌঁছে বাঁধ ধরে হাঁটা শুরু  করেছি।  বাঁধের ধারের গাঁ টা শীতের দুপুরে ঝিমোচ্ছে। মাঝে মাঝে মোরগের কোঁকরকোঁ, গরুর হাম্বা,  কিংবা ছাগলের ম্যা ম্যা ভেসে আসে। বাঁ হাতে বিদ্যেধরী ছলাৎ ছলাৎ করে সঙ্গ দিচ্ছে। একটা মোহনচূড়া পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে পোকা না কি যেন ধরছে। মোটকা একটা শালিখ তার সাথে ভাব জমাতে যাচ্ছে। মোহনচূড়ার মত সুন্দর পাখি পাত্তা দেবে কেন,  উড়ে উড়ে পালাচ্ছে। মাছরাঙা আর একটা ঘুঘু বসে আছে চুপটি করে ইলেকট্রিক তারে। একটা মৌটুসী আকন্দ গাছে দোল খেয়ে নিল। একটা বাঁশপাতি উড়ে গেল। ক্যামেরাটা আনিনি, আসলে খুব প্ল্যান করে বেরোইনি তো। বেরোতে হবে, এই তাড়না থেকেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। খুব অসুবিধেও বোধ করছিনা। দিব্যি ভারমুক্ত হেঁটে যাওয়া। একটা বৌ কোলের ছেলে নিয়ে নতুন বাছুরএর  তদারকি করতে গেল। ঝপঝপ করে জল ঢালছে মাথায় একটা ছেলে। ক্যাঁচক্যাঁচ করে টিউবয়েলের আওয়াজ আসছে। পাশের পুকুরের একঝাঁক হাঁস আরাম করে সাঁতার দিচ্ছে। ফিরতে ইচ্ছেই করছে না। হেঁটে চলেছি কতক্ষন দেখিনি, কতদূর এলাম কে জানে। "কাদের বাড়ি এসেছ? কোথায় যাবে?" জাল সারাতে সারাতে হাঁক দেয় কেউ। গ্রামের পথে এভাবে খোঁজ নেওয়া স্বাভাবিক। উত্তর দিয়ে এগোই। রোদ পরে আসছে ক্রমেই। ফিরতে হবেই। একবার ঠিক আসবো, পিছুটান না রেখে। যেখানে অন্ধকার নামবে সেখানেই মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে নিয়ে কিংবা না জুটিয়ে নিয়ে। পথের দেবতা কবে আমায় তেমন ভাবে নিয়ে বেরোবে কে জানে....