Saturday, May 14, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা... (৩)

দুপুরে পিছনের অশ্বত্থ  গাছটা থেকে ঝিরিঝিরি হাওয়া ভেসে আসে। আমাদের গ্রামে অশ্বত্থকে বলে আশুথ গাছ । বট আশুথের হাওয়া বড় মিঠে হয়।  গরমে আগে এ অঞ্চলে আসিনি। মাসখানেক আগে যখন এসেছিলাম তখন লু বইত, বন্ধুরা এসেছিল। সপ্তাহান্তের দিন, দুপুরবেলা জানলা বন্ধ করে আড্ডায়,হুল্লোড়ে, তরমুজে মজে থাকতে মন্দ লাগেনি একটুও৷ বন্ধুরা না আসলেও আমি জানি ওই লু আমায় কাহিল করতে পারত না, গরম আমার শীতের চেয়ে ঢের বেশী ভালো লাগে। এবারে এসে এক দু পশলা বৃষ্টি পেয়েছি মাঝে মাঝে। গাছগুলো আবার সব সবুজ হয়ে গেছে। কাঠবিড়ালী, দোয়েল, হাঁড়িচাচা, ছাতারে, শালিখ সব্বাই ফিরে এসেছে। এমনকি পাগলা কোকিলেরাও। সকালে বেশীক্ষন ঘুমোলে ডেকে ডেকে তুলে দেয়, দুপুরে সব নিঝুম হয়ে যখন স্রেফ পিছনের বারান্দা দিয়ে অশ্বত্থের হাওয়া এসে ঘোরে তখনো কোকিলটা ডেকে যায়। মেয়ে কোকিলটাও আছে,  দেখেছি। বিশ্রী দেখতে। জীবজগতে মানুষ ছাড়া আর কোনো মহিলাই মনে হয় রূপসী না। তবে যার যাতে মজে মন, কালো কোকিলটা ওই বিশ্রী ছিটছিট মহিলা কোকিলের জন্যই ডেকে ডেকে হেদিয়ে গেল!


সকালে চা বিস্কুট খাচ্ছিলাম বারান্দায়, বিস্কুটের টুকরো পড়েছিল মনে হয় বারান্দায়। একটা কাঠবিড়ালী কুটকুট করে খেয়ে গেল। ওই সময়টা কাঠ হয়ে বসে থাকতে হয়। সামান্য বাড়াচাড়তেই ছোট্ট জীবটা ভয়ে চিড়িক চিড়িক আওয়াজ করে ছুটে পালায়। বাড়ির সামনের কামিনী গাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। অনেক রাতে বারান্দায় দাঁড়ালে ফুলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর সকালে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি। কামড়ায় না, নিজের মনে ফুলে ফুলে ঘোরে,  মধু খায়, চলে যায়। কাঁঠাল গাছটায় দোয়েল আর শাহ বুলবুলিটা এসে বক্তব্য রাখে, চারদিক সরেজমিনে দেখে। হাঁড়িচাচা লম্বা লেজ নিয়ে উড়ে এসে বকে দেয়বলে মনে হয়। ছাতারেও ছাড়ে না, কেন এত বেলা অব্দি ঘুমিয়ে আছি বলে ডেকে বকে একাকার করে। সকালে খানিক পরেই আসে সব্জিওয়ালা, তারপরেই মাআআছ মাছ বলে মাছওয়ালা। 


শান্ত দিন দুড়দুড়িয়ে টিম মিটিং, কাজের ফাঁকে গলে যখন বিকেলে যায় এক ঝাঁক টিয়াপাখি চক্কর কাটতে কাটতে ঘরে ফেরে ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজে। সারাদিনের গল্প গাছা করে হয়ত। কে কোথায় কী নতুন জিনিস দেখেছে, জেনেছে। চায়ের কাপে, টিয়ার ঘরে ফেরায়, মেঘের লালে সন্ধ্যে নামে। এই ঘরটাও ছেড়ে দেবো আমরা, সে কাজেই আসা। অন্য ঘরে যাবো, সে ঘর খানিক বড়, খানিক কম ভাঙাচোরা। কিন্তু এ পাড়ার কাঠবিড়ালী, প্রজাপতি, ছাতারে, দোয়েল কেউই যাবে না ওখানে। এদিকের আম,  কাঁঠাল,  নিম গাছেদেরও দেখা যাবে না। অশ্বত্থ গাছের হাওয়াও না। আমাদের জীবনে চাহিদা কিঞ্চিৎ কম। আমাদের ভাঙাচোরা বাড়িতে বাইরের লোক না এলে অভাববোধও কিছু হয়না। এলোমেলো করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকি। সেদিন বাজারে গেছি, রাস্তায় রাস্তায় কচুরি জিলিপির আহ্বান অগ্রাহ্য করা যায় না। হেঁটে হেঁটে এ গলি সে গলি করতে করতে একটা পুরোনো ভাঙা বাড়ির সামনে পড়েছি। এই মোটা থামগুলো ভেঙে পড়ছে, খড়খড়ি দেওয়া জানলায় ধুলোর আস্তরন। সামনের দেউড়িতে আবর্জনা। কোন প্রজন্মের শখ কোন প্রজন্মে ঘুচে গেছে কে জানে! পাশেই ইটালিয়ান সেলুনে দাড়ি কাটছে একজন, আর তারপাশেই মুরগি। মাছওয়ালা আমায় জোর করে দুটো পাবদা পুরে দেয়। আর লাগবে না বললে বলে,  নিয়ে যা নিয়ে যা, এমনিই দিচ্ছি, টাকা নেবো বলেছি কি? ও দুটো তোর জন্য ! 


পাগলা কোকিল বৈশাখের শেষে ডেকে যায়, পাগলা মাছওয়ালা এমনি এমনি মাছ দেয়..পাগল বিনে ভালো থাকার জো নেই কিনা।

No comments:

Post a Comment