Tuesday, February 25, 2020

বালিতে কদিন ( এক)

এটাও একটা বেড়ানোরই গল্প, তবে সব বেড়ানোর গল্পেরই একটা পূর্বকথন থাকে। তা আমার এবারের গল্পটার পূর্বকথন বেশ খানিকটা লম্বা। এ ব্লগের পাঠক কেউ আছে কিনা জানিনা। যদিও থাকে, সে এই বেড়ানোর গল্পের পূর্বকথন স্কিপ করে যেতে পারেন। ঘটনার ঘনঘটায়, বেড়ানো পর্বে আসতে সময় লাগবে খানিক।

সে ম্যালা দিন আগের কথা। আপিস করে, গরম কালে আম-টাম খেয়ে, শীতে কলাইশুঁটির কচুরি খেয়ে ফেসবুকের মন্ডপে রাজা উজির মারিনা, ফুক্কুড়ি করে আড্ডা মেরে  বেড়াই। সুযোগ পেলেই ধাঁ করে চলে যাই আজ ভেড়ির ধারে তো কাল পাহাড়ে। ফেসবুকে ছদ্মবেশে ফুক্কুড়ি করতাম বলেই সচরাচর দেখা সাক্ষাৎ করতে চাইতাম না কারোর সাথেই। ছদ্মবেশ শুরু করেছিলাম টংলিং এর গল্পের মতো পালাতে গিয়ে, কল্পানার বিশেকে নিয়ে , তারপর দেখলাম , ছদ্মবেশে থাকার সুবিধে হল , চেনা মানুষজনের কী কেন না ভেবেই নিজের মনে যা খুশী লেখা যায় । তো এই জন্যেই ওই আড়ালে থাকতে থাকতেই বন্ধু বানানো । ফেসবুক এর অন্ত্রাল আমায় প্রচুর কিছু দিয়েছে , আর সে সূত্রেই এ পোস্টের অবতারনা। এমনিতেও সামনাসামনি কথা বলার থেকে মেসেজে কথা বলতে আমি স্বস্তি বোধ করি অনেক বেশী, ফলে ফেসবুকে আড্ডায় আমি স্বস্তিও পাই বেশী। তো এরকমই কোনো এক বেয়াক্কেলে বারবেলায় একজনকে হঠাৎ প্রস্তাব দিই, "দেখা করবে?" আড্ডা তার আগে অনেকদিন ধরেই হয়, সে আমার বহু লোকের সাথেই হয়, কিন্তু আমার মতন এমন কন্দরবাসী লোকের মুখে এ হেন প্রস্তাব শুনে সে ঘাবড়েছিল বিস্তর (আমি সচরাচর দেখা করা এড়িয়ে যাই, সামনে আসতে ডরাই)। সেদিন প্রথম সাক্ষাতে মেলা আড্ডা হয়েছিল , যা আমার মত আন্সমার্ট লোকের জন্যে অবাক কান্ড বটে। আড্ডার মধ্যে এটুকু মনে আছ সেদিন একটা প্রপার বিয়ের কিরকম মেনু হতে পারে সে নিয়েই আলোচনা কফির কাপে,  আলো আঁধারি গলিতে, দমকা হাসির পাল্লায় পড়ে জমে গেছিল। প্রেম বিয়ে এসবের ইচ্ছে একেবারেই ছিল না।  তবু ওই আর কি, মোহন সিরিজের মতই কোথা হইতে কী হইয়া গেল, সেদিনের সেই মেনু নিজেদের কাজে লেগে গেল।

এবার অত খেলে ঘুরতে তো যেতেই হয়, হজম করার জন্যেই। সুতরাং আমরা একটা বেড়াবার জায়গা খোঁজার জন্যে দুনিয়া তোলপাড় করে ফেললাম প্রায়। আসলে পৃথিবীতে এত কিছু দেখার আছে আর আমরা এত কম দেখেছি তাই আমাদেএ হাল হল প্রায় কাঙালের শাকের ক্ষেত দেখার। দুজনেরই প্রথম পছন্দ পাহাড়, কিন্তু দেখা গেল কাশ্মীরে যাওয়া যাবে না," একরাশ বিপদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কানাকানি" করা যাবে না বসন্ত৷ এসে গেছে বলে। অরুনাচল যাওয়া যায় কিন্তু প্রচুর ধকলের রাস্তা। হিমাচল যাওয়াই হয়নি কখনো, কিন্তু ময়ূরাক্ষীর (ইয়ে মানে ওই নদীর ঘাটেই নৌকা বাঁধা হল আর কি) আবার দুবার ক্যানসেল করা হয়েছিল হিমাচলের টিকিট তাই ওর খুঁতখুঁত। ওদিকে আন্দামান, কেরালা ঘোরা আমার।দেশের বাইরে থাবা বাড়াতে গিয়ে আমাদের ঘোরা গ্রীস, ইওরোপ, কম্বোডিয়া সব ঘোরা হয়ে থিতু হওয়া গেলো বালিতে। সমুদ্র আছে, ছোট খাটো পাহাড় আছে,জঙ্গল আছে আর আছে সপ্তম অষ্টম থেকে পঞ্চদশ  শতক এর মন্দির। অনেকে বেড়ায় হোটেলের ঘরে, পুলে রিল্যাক্স করে, আমার বেড়ানোয় হোটেলে কম থাকার ভাগ থাকে। কেমন যেন মনে হয় দু চোখ ভরে যতটা পারি দেখে নিই, রঙ রূপ গন্ধ, আর আরামের জন্যে আমার কোলকাতার ঘরটাই আছে তো। তবে এ আমার ব্যক্তিগত ভাবনা, সবার ঘোরার ভঙ্গী এক হবে না স্বাভাবিক তাইজন্যেই ঘোরাঘুরি করার পার্টনার বা দল উমদা হওয়া খুবই দরকার। মানে হাতির পার্টনার পাখি হলেই চিত্তির। তো সৌভাগ্যক্রমে আমার ঘুরতে যাওয়ার পার্টনারটি আমার মতোই হয়েছে। তাই টিপিক্যাল বিবাহপরবর্তী ভ্রমন আমাদের ছিল না এটা। আট রাত নদিনের এই ট্রিপটায় আমরা বালি লম্বক ভালোই ছানবিন করেছি।

বালি জায়গাটা চুজ করার আরেকটা মারাত্মক কারন বলাই হয়নি, এর থেকে বেশী রেস্তোঁ ছিল না, মানে ক্রাঞ্চ না করে ঘোরার আর কি। আর দেশে ঘুরলে ওই লেভেলের স্বাধীনতা মিলত না। মানে যে স্বাধীনতায় প্রত্যেকে বয়স্ক মানুষের মতই আচরন করবে অবোধ শিশুর মতো অযথা কৌতূহল বা রাস্তায় নোংরা ফেলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ভাবার মত পাগলামো করবেনা আর কি। তো যাই হোক, বালি যাবার একখানা দামী অর্থাৎ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস আর একখানা কমদামী অর্থাৎ এয়ার এশিয়া উপায় আছে। এয়ার এশিয়া খুবই ইয়ে, ফ্লাইটে জল অব্দি দেয়না ফ্রিতে কিন্তু তাও এয়ার এশিয়াতেই যেতে হয়, কারন দুটো এয়ারলাইনসের দামের তফাৎ বিস্তর৷ সমস্যা আমাদের জলে তত হয়নি যতটা হয়েছিল মার্কেটে করোনা ভাইরাস নিয়ে একটা ভয় চালিত হওয়ায়। বিয়ের ঝামেলা মিটিয়ে মাস্ক কেনা আমাদের হয়ে ওঠেনি, এদিকে হোটেল ফ্লাইট সমস্ত বুক সেই কবে থেকে, করোনা ভাইরাসের কারনে ক্যান্সেল তো করা সম্ভবই না তাহলে শোকেই মরে যাব। যা হবে দেখা যাবে ভঙ্গীতে বসা গেলো ফ্লাইটে, কুয়ালালামপুর এর হল্টে নাক চোখ চ্যাপ্টা দেখলেই সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে খেয়াল করলাম, ঠক বাছতে গাঁ উজার হয়ে যাবে,  সুতরাং 'সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কী ভয়!' ভঙ্গীতে চোখ বোজানো গেল যতক্ষন না বালিতে নামার ঘোষনা করলেন পাইলটবাবু। ঘুম ভেঙে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি ঘন নীল জল বেষ্টন করে একটা ছোট্ট সবুজ ভুখন্ড উঁকি মারছে।



বালি এই সময় বৃষ্টি বাদলার জায়গা। মানে আমাদের ভাদ্র মাসের মতো, খানিক বৃষ্টি বা মেঘ বা চড়া রোদ্দুর সাথে দরদরে ঘাম। সারা রাতের প্রায় নির্ঘুম যাত্রার পর হোটেলে গেলে আর বেরোতে ইচ্ছে করবেনা তাছাড়া গাড়িতে উঠে খানিক পকেট ঝেড়ে ঝুড়ে পাওয়া কেক খেয়ে আর নতুন দেশ দেখতে দেখতে অত টায়ার্ডও লাগছিল না। আমাদের ড্রাইভার সূর্য ভারী হাসিখুশী মানুষ , আমাদের জন্যে প্রচুর সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে এয়ারপোর্টে তাও বিরক্তি দেখলাম না। এটা অবশ্য পরে আরোই দেখেছি , এখানের অধিবাসীরা মূলতঃ সোজা সরল আর হাসিখুশী , ঠক জোচ্চোর কি নেই, তাও আছে সে পাল্লায়তেও পড়েছি তাও বল্ব মূল সুরটা এখানে সহজ। এই যেমন ডেনপাশর , কুটা , সেমিনিয়াক এসবই শহর অঞ্চল , কিন্তু সরু রাস্তাতেও কেউ হর্ণ দিচ্ছে না , কেউ বাইক রেখে রাস্তা ব্লক করেনি , দুটো বাড়ির মাঝে ফাঁকা জায়গা হলে সেখানে ধান রুইয়েছে, উন্নয়নের জন্যে গাছ কেটে দেয়নি। লম্বা ইমিগ্রেশন আমাদের যা কাহিল করেছিল, মেঘলা আকাশ,এক পশলা বৃষ্টি আর সবুজ ঝকঝকে পরিষ্কার বালি আমাদের ফের চাঙ্গা করে নিয়ে গেল পাহাড় ঘেরা সমুদ্রের মাঝের মন্দির তানহা লটে। এই মন্দিরটা আসলে বরুনদেবের মন্দির,পঞ্চদশ শতকে শেষ হয়েছিল এ মন্দিরের কাজ। একটা ন্যাচারাল আর্চ এর উপর একটা মন্দির আর একটা মন্দির সমুদ্রের মধ্যে একটা শিলাখন্ডের উপর। বালিনিজদের কাছে ভারী পবিত্র এই মন্দির তাই পুজো-আচ্চা চলে এখনো। রাস্তায় আসতে আসতেই শুনেছি, আমাদের ড্রাইভার সুর্যর থেকে, বালিতে আশী ভাগ হিন্দু যদিও ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমান সংখ্যাগুরু। জানি এসব তথ্য গুগল ঘাঁটলেই মেলে তাও আমি সব জিনিস গুগল থেকে জানার থেকে এখনো মানুষের মুখ থেকে কিছু জিনিস জানতে ভালোবাসি।  একটা গুহামত জায়গায় কিছু পুরোহিত গোছের লোক নির্দেশ দিচ্ছে দেখি কী সব। কাছে গিয়ে উঁকি মারতেই একটা ছোট্ট গুহাগাত্রের ঝোরা থেকে মুখ ধুতে ইশারা করল দেখি, একিরে বাবা, আমাদের দেশের মন্দিরের মত নাকি? পয়সা নেবার বাহানা জোর করে? তা আমাদের কানে চাঁপাফুল আর ভেজা চাল দিয়ে কপালে টিপ পরুয়ে দেওয়ার পর দেখি ডোনেশন বক্স, জোর জুলুম নাই।












আস্তে আস্তে সমুদ্রের জল বাড়তে লাগলো মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় জলের অংশ বাড়তে লাগলো সাথে সাথে। ঢেউ এর ঝাপ্টা উপেক্ষা করে লোকজন দিব্যি ছবি তুলে বেড়াচ্ছে, কটা বাচ্ছা দেখি জলের মধ্যে দিব্যি হুড়ুমদুড়ুম করছে।  মন্দিরের পাশের ক্লিফটায় কিছু দোকানপাট, মাথা খোলা রেস্তোরাঁ।  এক কাপ কফি বা চা এর জন্যে মনটা বেশ আনচান করছিল, এখান থেকে সুর্যাস্তটা বেশ চমৎকার দেখাবে। ও বাবা কি জায়গা রে বাবা! দাম দস্তুর হচ্ছে রেস্তোরাঁয়!  যেই নিজেদের মধ্যে বলেছি," এই ওই দোকানটায় তো পনেরো হাজার ডাবের দাম বলছিল" অমনি দোকানদার তরুণী হেসে বলে আমিও তাইতেই দেব।  ও ভালো কথা,  ওখানে টাকা বদলে রাশী রাশী টাকা পাওয়া যায়, যদিও তার মানেই সব খুব সস্তা তা না, একটা ডাব পঁচানব্বই থেকে একশো ষাট টাকা অব্দি হতে পারে আমাদের হিসেবে। যাকগে হিসেব থাক এখন, যতই হোক এমন সুন্দরী দয়ালু মহিলা উপেক্ষা করা যায়, তাই ওইখানেই বসা গেল। মস্ত বড় ডাব,  আর কফি অর্ডার করে দেখি মেঘের ফাঁকে সুর্য কেমন ডুব দেবার তাল করেছে আজকের মত আপিস থেকে। ট্রপিকাল দেশ বলেই হয়ত বা সমুদ্রের ধারে বলে, জানিনা, ভাত এদের প্রধান খাবার। ভাত বা নুডলস, নাসি গোরেং হল মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর মি গোরেং হল মিক্সড নুডলস,  সাথে থাকবে দুটো ছোট্ট কাঠিতে গোঁজা মিষ্টি সস মাখানো চিকেন, একটা পোচ, কিছু পাঁপড় আর শশা, টমেটো। এবার অঞ্চল বা দোকান ভেদে একটু তফাৎ হয়, মানে মি গোরেং এ  বেশীরভাগ জায়গায় পোচের বদলে ডিমটা ভেজে ভেজে উপরে দেবে ছড়িয়ে, এইসব আর কি। শেষ বিকেলের আলো মেখে সমুদ্রে ধারে পাহাড়ের উপর বসে আরাম করে খাওয়ার এই মুহূর্তটা বহুদিন মনের মধ্যে থাকবে , সূর্য ওঠা আর ডুবে যাওয়া কতবার দেখলাম তবু প্রতিবারেই এমন ভালো লাগে বলেই বোধহয় জীবন এত সুন্দর। (ক্রমশ)