Friday, August 5, 2022

নুড়ি আর জল

অনেকদিন পর অফিস এসেছিলাম আজ। টিমটা ভেঙে গেছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে সবাই আগেই, বাড়িতে বসেই যে কাজ হয়ে যায় মর্গের ঠান্ডায় সে কাজ করতে যেতে ইচ্ছে করে না। তাও ডাক এলে যেতেই হয়। ল্যাপটপ স্ক্যান করানোর সময়, চুল পাতলা হতে শুরু করা পাতলা চেহারার সিকিউরিটি গার্ড হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল ভালো আছেন? সত্যি বলতে ওর মুখ সচেতনে কখনো মনে রাখিনি,এ আড়াই বছরে ও কেমন ছিল জানতে যাইনি। আমি জানিনা ওর বাড়ি কোথায়, কে আছে এর , কোন জায়গায় ঘুরতে যায়, কিংবা আরো সব প্রচন্ড সব দরকারি কথা, যা আমরা প্রতিদিন লেনদেন করি ভারচুয়াল দুনিয়ায় কিচ্ছু জানিনা।কিন্তু আমায় উনি মনে রেখেছেন, অনেকদিন পর দেখে অকৃত্রিম হাসি উপহারও দিলেন। আহারে মানুষ। 
জানলার পর্দা সরাতেই নারকেল গাছের মাথায় জলের মধ্যে মেঘের আনাগোনা দেখা গেল, চোখ টেনে দৈনন্দিন হিসেব নিকেশ, চিঠি চাপাটি শুরু করে দিতেই হল। দুপুরবেলা নিজে খেতে গিয়ে দেখি, বিশুর দোকান আজও বন্ধ। হল কি ছেলেটার? আগের বার অফিস এসেছিলাম যখন তখনো বন্ধ ছিল। সোমনাথেরও তাই। বিশু কিংবা সোমনাথ থাকলে মাসীর দোকানে যাইনা। মাসীর দোকান অপরিচ্ছন্ন এদের তুলনায়। তা উপায় নেই, বেচারি একা বসে ঢুলছে যাই চা খেয়ে আসি। মাসী আমায় দেখেই একগাল হেসে বলল, একইরকম আছিস দেখছি, কিচ্ছু বদলাসনি! বোঝো! বললাম তা তুমিও তো একই রকম আছো (আগেও বসে বসে ঢুলতে আর  প্রায় ঠান্ডা চা ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে দিতে। যদিও এটা বলিনি আর)।  তাতেও হাসি, তাই নাকি। প্রায় ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিয়ে বিশু আর  সোমনাথের খবর নিই।  সোমনাথ বাবার সাথে রাগারাগি করে দোকান দিচ্ছেনা।বিশুর মেয়েটার ক্যানসার হয়েছে,  বিশু ব্যঙ্গলোর গেছে।ওখানেই দোকানে কাজ করে আর মেয়েকে দেখে। সকালের নীল ঝকঝকে আকাশটা মলিন হয়ে গেল।  হাসিখুশী বিশুটার মুখটা নীল আকাশ আড়াল করে দিচ্ছিল। আহারে ছোট্ট মেয়েটা।  গোলুইদার কাছে নাম্বার আছে না বিশুর? যোগাযোগ করতে হবে। 

আজ কলকাকলি কাটিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যে নামার মুখে ভেড়ির ধার ধরে এলোমেলো হাঁটছিলাম। কলেজের ছেলে মেয়েদের আড্ডা, প্রেম, গান বেশ খানিকদূর অব্দি আসে।তারপর জায়গাটা আশ্চর্য নির্জন হয়ে যায়। কে বলবে, কয়েকশো মিটার দূরেই ব্যস্ত শহর দৌড়চ্ছে। একটা পানকৌড়ি ডুব মারলো, রূপোলী একটা মাছ ঠোঁটে ছটফট করছে, নিস্তেজ হবার আগেই পেটে চলে গেল, একটা ফড়িং উড়ছে, নিমগাছের ডালে কাক ডাকছে। একটা বাজ পড়া তালগাছের মাথায়  পাখি বসেছে একটা, তার ঠিক পিছন দিয়ে একটা ইন্ডিগোর উড়োজাহাজ উড়ে গেলো। কটা সাহেব মেম অফিস পরিদর্শনে এসেছে, এদেশীয় দুটি লোক তাদের ভেড়ির চারপাশ ঘোরাচ্ছে। মন্দিরের পাশের সিমেন্টের চাতালে একটা হাফপেন্টুল পরা ছেলে বসে আছে, দুজনেই চুপ করে কতক্ষন বসে রইলাম। সে কী ভাবছিল জানিনা, ভদ্রলোক নয় ভাগ্যিস,  তাই আমি কী কেন ইত্যাদি কিচ্ছু জানতে চায়নি। তারপর অনেক্ষন পর বটের ঝুরির পাশ দিয়ে আলো কমে এলো যখন, ফিক করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ফরেনারগুলোকে  তুলসীপাতাও বাদ রাখেনি খাওয়াতে!

ফিরতি পথে দেখি একজন পুলিশ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে দেখছে। টহল দিতে এসেছিল এদিকে। আমিও খানিক ইচ্ছে করে এলোমেলো পা ফেলে বারবার পুলিশের দিকে তাকিয়ে নিজের পকেটে হাত দিয়ে দিয়ে দেখছি। ব্যাস আমার ফাঁদে পড়েছে। দেখি চোখে মুখে আনন্দের আলো খেলে গেলো তার, পাকড়েছি ভাব।
গম্ভীর গলায় বলল, "কী আছে পকেটে"?
- অ্যাঁ?  
- বলি পকেটে কী আছে?
- এই যে মোবাইল। (পকেটে আরো কিছু আছে,  সেগুলোকে আড়াল করার ভঙ্গী করে)
- আর কি আছে? উঁচু মতো? গাঁজা নাকি?
বুদ্ধি মাইরি! গাঁজা থাকলে পকেটে রাখবো! ফস করে আইকার্ডটা বের করে হ্যা হ্যা করে হেসেছি খুব। রাগে মসমস করতে করতে চলে গেল। 
ভেড়ির জলে লম্বা ছায়া ততক্ষনে আরো লম্বা হয়েছে।

আসার সময় বছর কতক আগে যে গানগুকো খুব শুনতাম ফের শুনছিলাম, নিজের মনেই হাসছিলাম, হাসির গান একটাও না অবশ্য। ভাবছিলাম কেমন করে সম্ভাবনা জন্মায়, মরে যায়, ফের জন্মায়। সমান্তরাল বিশ্ব আছে কিনা জানিনা, কিন্তু থাকলে কিরকম হবে সেই সব সম্ভাবনা গুলো যেগুলো ভাগ্যিস হয়নি! যার জন্য অপরিসীম আকুতি থাকে সময়এর তফাতে দেখলে সেগুলোই কেমন অবাক লাগে...ভাগ্যিস হয়নি,কিংবা ভাগ্যিস হয়েছে বলে। অনেকদিন পর বুড়ো হয়ে এরকম কোনো অখ্যাত সরু পায়ে চলা রাস্তা দেখলে হাঁটবো কিনা জানিনা, কে জানে তখন কী ভাববো, ভাগ্যিস সেই শেষ সূর্যের আলোয় বটের ছায়ায় বসা দিনটা পেয়েছিলাম নাকি ভাববো ওই সময়ে আরো অর্থনৈতিক  উন্নতির কোনো কাজ করতে পারতাম! 
ভাগ্যিস জানিনা, কারন বুড়ো আমি দ্বিতীয়টা ভাবলে ভেড়িতেই পুঁতে দিতাম হতভাগাকে....