Wednesday, April 21, 2021

নয় পাহাড়ের উপত্যকায়(দুই)

 কেইবুল লাম জাও ন্যাশনাল পার্ক লোকটাক লেকের এক অংশেই। পৃথিবীর একমাত্র ভাসমান ন্যাশনাল পার্ক যেখানে সাংহাই হরিণ থাকে। সাংগাইকে নাচুনে হরিণ বলে, আসলে ওই বায়োমাসগুলোর উপর দিয়ে ওরা যখন দৌড়ে যায়,  সেই তালে নীচের জলে ধাক্কা খায় বায়োমাসগুলো আর নাচের ছন্দ বলে ভ্রম হয়। এই হরিণগুলো একসাথে থাকে আর বাইচান্স মানুষে ছুঁয়ে দিলে (মানে মানুষের পাকামির তো শেষ থাকেনা, তাকে গুনে গেঁথে দেখতে হবে, জানতে হবে  বাকি সব প্রাণী কোথায় খাচ্ছে কী খাচ্ছে, কিভাবে মৈথুন করছে, তাই কলার লাগাতে যায়। এবার এটা লিখতে লিখতেই ভাবছিলাম, জানতে চাওয়া দোষের বলা যায় না, এদিকে জানতে গিয়ে প্রাইভেসিতে হাত দিচ্ছি তাও তো মিথ্যে না!), তাদের আর দলে ফিরিয়ে নেয় না। তখন তারা একা হয়ে যায়; একঘরে হয়ে যাওয়া সেই হরিণ মনের দুঃখে আত্মহত্যা করে। কোন জায়গার বায়োমাস এক মিটার অব্দি যায়নি,  সেটা তারা ভালোই জানে, সেইখানে গিয়ে ডুবে যায় ইচ্ছে করে। মানুষ নাকি সামাজিক প্রানী! একে মারছে, ওকে কাটছে, এই জাত ওকে ছুঁচ্ছে বলে পিটছে, ফুহ! 






বনের মধ্যে তখন রোদ এসে পড়ছে দূরের ঘাস জমির উপর, খালের জলে দুটো নৌকা বাঁধা নীচে, একটু আগে টেলিলেন্স দিয়ে সাংগাই হরিণ দেখা হয়েছে,প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে এখনাবার সব শান্ত। জঙ্গলের অদ্ভুত একটা রূপ হয়, তাকিয়ে থাকলে ঝিম ধরে, ইচ্ছে করে হেঁটে বনের মধ্যে দিয়ে গাছেদের সাথে আলাপ করে আসতে। নৌকায় চড়ে একটু চুপ করে ভাসমান মাটি, গাছেদের, পাখিদের আলাপ শোনার উপায় অবশ্য রইলো না। বনকর্মীটি কথা বলতে ভালোবাসেন। সাধারণতঃ দীর্ঘদিন প্রকৃতির কাছে সমর্পিত অবস্থায় থাকলে কথা বলা কমে যায়, কিন্তু এর অল্প বয়স, হয়তো এখনো অতদিন এই জঙ্গলে নেই। সে খুব উৎসাহে বলতে লাগলো,  মনিপুরে মেয়েদের ডানকানে ফুল থাকলে তাকে এনগেজড বলে বুঝে নিতে হিয় আর বাঁ কানে ফুল থাকলে ফাঁকা আছে বলে ভাবা যায় ইত্যাদি প্রভৃতি৷ একেকটা হরিণের ওজন ১২০ কেজি অব্দি হতে পারে,তারা লাফিয়েও ডোবে না যখন আমিও নামি একটু,  ডুবে যাবো না আশা করা যায়! দিব্যি খানিক তুড়ুক তুড়ুক করে লাফিয়ে নেওয়া গেলো। একটা তেত্রিশ বছরের দামড়া লোক লাফিয়ে এমন খুশী হতে পারে তা দেখে লোকগুলো অবাক হয়েছিলো হয়ত, হোকগে যাক। 

লোকটাক তো আর ছোটখাটো জায়গা হ্রদ না, তাই সামান্য উঁচু থেকে দেখলে ওই রিং রিং ব্যপারটা আরো ভালো বোঝা যায়। মাওপাকচুর বাড়ির কাছে ছোট্ট পাহাড়, বাপ্রে কী ফিটনেস ভদ্রলোকের এই বয়সেও! তরতর করে উঠে গেলেন। ওনার সাথে আমিও উঠলাম ঝোপঝাড় সরিয়ে,  পাথর ডিঙিয়ে। দলের বাকিরা আসেনি। পাহাড়ে উঠে নীচে তাকাতেই, "আরিব্বাস রে " বলে থমকে যেতে হয়। তখন সন্ধ্যে নামার আগে, সূর্য ঢলে গেছে খালি তার গোলাপী রঙটা সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে, সে রঙে হোলিখেলছে পাহাড়,  হ্রদ, বায়োমাসের রিং সব। ক্যামেরাটা বাগিয়ে কিছু ছবি তুললাম বটে তবে যা চোখে দেখলাম তার সিকিভাগও তুলতে পারলাম কই! চারিদিকে লোকটাকের রঙ্গোলী রিং, ঠিক মাঝখানে আমরা দাঁড়িয়ে, পাখির ডাক ভেসে আসছে ইতিউতি, দিন শেষের আলোয় ডুবে যাচ্ছে সবাই আস্তে আস্তে, অন্ধকার নেমে আসছে। সেই একদম নির্জন পাহাড়ে অন্ধকারে রাস্তা গোলমাল হয়ে যায়, নামার সময় সতর্কতা আরো বেশী রাখতে হয় কারন ঘাস শুকিয়ে হলুদ হয়ে থাকা রাস্তার পাশেই খাদ।পড়লে মরবো কিনা জানিনা, হাত,পা, কোমর না ভাঙার কারন নেই। সাপ খোপও থাকতে পারে হয়তো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে সেই মুহূর্তে আমার এসব কিচ্ছু মনে আসছিলো না, একটু আগের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়া আমার স্থিতি দিয়েছে, শান্ত করেছে। সেই হাওয়া বুকে নিয়ে অন্ধকার জঙ্গলে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবা যায় না।দুশ্চিন্তা তো ছেড়েই দিলাম।



















এদের ভারী সুন্দর নিয়ম,  সূর্যের সাথে কাজ শুরু, সূর্য ঢলতে কাজ শেষ। প্রাচীন মানুষের নিয়ম। পাওয়ার কনজাম্পশন কত কম।  আমরা কেন যে ভালো নিয়মগুলো সব জলাঞ্জলি দিলাম! সন্ধ্যে নামতে একগাদা ঝিঁঝি ডাক শুরু করলো। আশেপাশের থেকে পোকা মাকড় এসে আসর জমালো। এঁরা সাতটার মধ্যেই খেয়ে শুয়ে পড়ে, আমরা থাকায় আট্টার সময় টেবিল সাজালো, সেও এখানে মেলা রাত। লোকটাক হ্রদের আড় জাতীয় মাছ,সবজি রুটি ডাল আর কালো চালের পায়েস, তোফা খেয়ে শুতে গিয়ে দেখি,  তাপমাত্রা বেশ কমেছে। মশারীটা মাওপাকচুবাবুর আলাদাই কেতের। ঝালর দেওয়া,  এদিকে ফুটোফাটা। সে মশারি খাটেই লাগানো থাকে অষ্টপ্রহর তাই কিঞ্চিৎ ধূলো টুলোও আছে। সে থাক। আপাতত কম্বল গায়ে এলার্ম সেট করা যাক। কাল সাড়ে চারটেয় নৌকা করে হ্রদে ঘুরতে যাওয়ার কথা। সাড়ে চারটে শুনেই সবাই কাঁইমাই লাগিয়েছে। না না অত সকালে উঠবো কি করে। দলে গেলে মুশকিল এইটাই। পাঁচটায় রফা হল, যদিও সেই নৌকায় উঠতে সাড়ে পাঁচটাই বাজলো। এরা অবশ্য খুবই সময়জ্ঞানী, সাড়ে চারটেতেই এসেছিলো।


মাথায় টোকা দিয়ে, বসার মাদুর বগলে নিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরে (আমাদের মাঝির অবশ্য লাইফ জ্যাকেট ছিলো না),  ভোরের ঠান্ডা আলো আর হাওয়ায় একজনের বাড়ির উঠোন দিয়ে নৌকায় ওঠা গেলো। সালতির মতো নৌকা। বিদেশে কায়াকিং করে এরকম নৌকায়। দুটো সালতি জোড়া দিয়ে আমরা সাতজন বসেছি। বড় বড় ঘাসের মধ্যে দিয়ে, এগোচ্ছি। বাপরে কি ঠান্ডা রে বাবা। সূর্যের আলো এখনো নরম, পাশের পাহাড়ে ভরসা দেবার মতো করে এসে পড়ছে। লেকের মাঝে মাঝে বায়োমাস জমাট বেঁধে ফ্লোটিং চড়া বানিয়েছে, সেই চড়ায় একটা হোমস্টে আছে। আমরা দেখেছিলাম কিন্তু আপাতত সেটা চালু না। এদিক সেদিক পাক মেরে মেরে ঘুরতে ঘুরতে লোকটা নিয়ে গেলো আমাদের একটা ওরকম চড়ায়, গরমকালে এরা এখানে এসে থাকে। দেখতে তেমন উমদা হয়তো না, কোনোরকম বাঁশের ঠেকনা দেওয়া বাড়ি, ভিতরে একটা অস্থায়ী উনুন আর ঘাসের বিছানা। কি তু গরমের দিনে দুপুরে চারিদিকের ঠান্ডা বাতাসে আরাম যা হয়। ময়লা জামা, পরা উজ্জ্বল হাসি হেসে লোকটা তার সামার ক্যাম্প ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলো। তাতে এতটুকু মালিন্য নেই।

 


ফেরার সময়,  মনিপুরি ভাষা শেখাবার চেষ্টা করলো সে খুব, কিন্তু নেহাতই নিরেট মাথা আমাদের,  তেমন কিছুই মনে রাখতে পারিনি, তবে গানের গলাটা খাসা। ভারী সুন্দর গান শোনালো। যাদের বাড়ির উঠোন দিয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার সময় ভালো করে দেখতে দেখতে আসছিলাম, মাওপাকচুর বাড়ির মতোই এই বাড়িটাও নিকোনো উঠোন, তারপর লাল মেঝের দাওয়া, চিনের চালের ঘর৷ লাল মেঝের দাওয়ায় ছেলে কাঁখে বসে একজন। বাড়িটার চারধারে ফুলের গাছ, একটা হাঁস বা মুরগী পোষার জায়গা ওদিকে। ভারী শান্তি লাগে দেখলে। ইচ্ছে হয় এখানেই থেকে যাই, লেকের জলে মাছ ধরবো, অবসরে বই পড়বো, আর মাঝে মাঝে পাহাড়ে উঠে বসে থাকবো। কিন্তু সেই শান্তির জীবন বাপার মতো মানসিক স্থৈর্য,  নির্লোভী ভাব, শান্তি খিয়ে বসেছি কবেই হয়ত।

নৌকা ভ্রমন করে ফেরার পর, মিসেস মাওপাকচু, দলের মেয়েদের মনিপুরী পোশাক দিয়ে সাজিয়ে দিলো,তারপর কালো চালের মিষ্টি লুচি, কলা, আর দেশী ডিম খেয়ে মাওপাকচুর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। আজ আমরা যাবো অন্য দিকে, উখরুল। লম্বা জার্নি আছে সামনে, উখ্রুল নিয়ে আমাদের পড়াশোনায় বিস্তর খামতি ছিলো। বলছি। 

মিস্টার এন্ড মিসেস মাওপাকচু

(ক্রমশঃ)


Wednesday, April 7, 2021

নয় পাহাড়ের উপত্যকায়(এক)

দার্জিলিং এর লেখায় পজ পড়েছে এতো আরো কিছুদিন পজ দেওয়া যাক। এর ফাঁকে দুড়ুম করে মনিপুর থেকে ঘুরে এলাম, সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ভাষা, লোকজন, সেসব ভুলে যাবার আগে লিখে রাখি। আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে বেড়াতে যাবার কথা লেগেই থাকে, মিশর থেকে মিজোরাম আফ্রিকা থেকে আলাস্কা সব ঘোরার প্ল্যান হয়, তারপর পকেট, ছুটি সব আমাদের ফোঁস ফোঁস করে ভয় দেখায় আমরাও ল্যাজ গুটিয়ে কাজে বসি। তবু মাঝে মাঝেই ফোঁসফোঁস উপেক্ষা করেই কিছু জায়গা ফাইনাল হয়, টিকিট কেটে নেওয়া হয় ফস করে। অনেকে মিলে প্ল্যান করলে এইটা সব চেয়ে জরুরী।  ফস করে টিকিট কেটে নেওয়া। তাহলে সেটা আর কেউ ক্যানসেল করতে পারে না। না হলে কিছু না কিছু এসে দেখবে ভন্ডুল হবেই। এবারে শুরু হয়েছিলো আসাম দিয়ে। তারপর মেঘালয়, টিকিটের দাম দেখি আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেলো আমাদের গ্রুপ কলের মাঝেই। গুগল কিছু ডেটা চুরি করে বটে!! শেষে আমরা কোড নাম দিয়ে প্ল্যানিং শুরু করলাম। মানে যাবো মনিপুর কিন্তু বলছি মুম্বই। সত্যি বলতে এরকম করে কাজ আদৌ হয়নি হয়তো, তবু তাও তাতেই আমাদের মনে ভাব খুব কিছু করলাম! নর্থ ইস্ট এতোটাই আনএক্সপ্লোরড যে অন্য দেশ ভাবে লোকে!  ওরকম প্রায়  অচেনা একটা জায়গা দেখার উত্তেজনা আলাদাই হয়। প্রায় অচেনা বলতে আমি বলছি কমন ডেস্টিনেশন না আর কি। আহা ভাবলেই ভাল্লাগে।  "বাবু পন্ড দেখো", বলে হাঁক পারা থাকবে না।  "এই বয়সেই কেমন স্মার্ট হয়েছে দেখো এই টুকু ছেলে"  বলে বাঁদরামি করা বাচ্ছার গর্বিত মা বাবার হাঁকডাক থাকবেনা, জোরে গান চালিয়ে শান্তি নষ্ট করা থাকবে না। সুতরাং একদিন সকালে এয়ারপোর্টে সাত মক্কেল জুটে গেলো এই "রোজ একই দিন রিপিট হচ্ছে যেন " থেকে পালাতে। দেখা হতেই এমন বুঁদ হয়ে আড্ডা মারতে লেগেছিলাম, দু ঘন্টা আগে এয়ারপোর্ট এসেও আমাদের হাঁকডাক করে ডেকে পাঠিয়ে তবে প্লেনের পেটে তোলে! 







ছোট্ট পুচকে একখানা এয়ারপোর্ট, কোলকাতার মতো গরম নেই, তবে রোদ বেশ চড়া।  বাঙালী খালি আমরাই নামলাম মনে হয়,  ইনার লাইন পারমিট করাতে হল কেবল আমাদেরকেই কিনা। সেও ভারী অদ্ভুত নিয়ম, নতুন করালে ১০০ টাকা আর রিনিউ করালে ২০০! মগ দেশ পাশেই বোঝা যায়! গাড়ি চলা শুরু, নতুন জায়গার হাওয়ায় মন চনমনে।রাস্তার পাশেই ফাঁকা মাঠ আর তারপরেই নীল পাহাড়। রোদের তেজ যেমন আছে, হাওয়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবও আছে।  ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেকার কোনো ছোট গ্রাম মতো যেন। টিনের চালের বাড়ি, অনেক বাড়ি দোকানের দেওয়ালও আবার টিনের। গায়ের উপর বাড়ি দেখে দেখে ক্লান্ত চোখে এতো খোলা জায়গা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।  ঝকঝকে নীল আকাশ, ছোট ছোট জন বসতি পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। মূল রাস্তা থেকে ডানদিক নিল গাড়িটা, একটা পুরোনো বিষ্ণুমন্দির আছে এখানে। একটা দড়ি ফেলা আড়াআড়ি রাস্তায়, কী ব্যপার? দোলের রেশ শেষ হয়নি এখনো, চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই চাঁদার ব্যপারটা তারপর ঘনঘন হতে থাকবে। এখানে ছেলের দল চাঁদা তোলে না, মেয়ে বউ এর দল তোলে, বাচ্ছা মেয়েরাও আছে কিন্তু বাচ্ছা ছেলেরা নেই। মেয়ের দল গাড়ি, বাইক সব থামায়, দশ টাকা বিশ টাকা বা খুচরো কিছু দিলে রাস্তা ছাড়ে তবে। চিত্রাঙ্গদা দড়ি ফেলে অর্জুনের পথ আটকেছিলো তবে!! বোঝো!এদ্দিন ভেবে এসেছি তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করেছে! ড্রাইভার ভালো জানেনা কোথায় যেতে বলছি, গুগলও ভালো বোঝে না, নেহাৎ সরকার বাহাদুর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছিলো তাই জানা গেলো এটাই সে প্রাচীন মন্দিরটা। ভেঙে চুরে গেছে, মন্দিরও বন্ধ। তবু, আমার অত খারাপ লাগছিলো না, ঝিরঝিরে হাওয়া আর কড়া রোদের এই কম্বোটাই আমার সেরা লাগে তার সাথে একগাদা পাখির ডাক, কিছু আমাদের রোজকার দেখা পাওয়া চড়াই আছে বটে, তবে আজকাল দেখতে পাওয়াই যায় না যাদের, সেই বুলবুলি, দোয়েল, ফিঙেও আছে। তুড়ুক তুড়ুক করে উড়ছে, দোল খাচ্ছে, মন্দিরের ছাদে বসে আড্ডা মারছে।দূরে পাহাড়ের কোল থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, চারপাশে ছোট জনবসতি, টিনের চালের ঘরের সব মিলিয়ে ভারী ঝিম ধরা শান্ত একটা পরিবেশ, টেনশন নেই, তাড়া নেই।

দোলের ছুটি এদের এখনো চলছে, আইএনএ মিউজিয়াম বন্ধ। খানিক আপশোষ তো হোলোই। সেই কবে একটা মেরুদন্ড সোজা লোক বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছিলো, সকলে একবাক্যে তাকে নেতাজি বলতে দ্বিধা করেনি। দ্বিতীয় জায়গা যেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উঠেছিল সে জায়গা দেখতে না পেলে আপশোষ হবেই।লোকটাক হ্রদে আমরা মাওপাকচুর ঘর বুক করে রেখেছিলাম।সে কেমন ঘর জানিনা, তবে ভদ্রলোক ভারী অমায়িক এটা জানতাম। আমাদের ড্রাইভারবাবু তো কিছুই চেনেন না, মাওপাকচুর সাথে কথা বলে, গুগল ম্যাপের নির্দেশ শুনেও ভারী নাকানিচোবানি খেয়ে তিনি পৌঁছলেন। লোকটাক লেকের ঠিক পাড়েই পাহাড়ের কোলে ওনার বাড়ি। লোকটাক লেকের বৈশিষ্ট্য হল, বায়োমাস গুলো জমে জমে ভারী সুন্দর একটা রিং রিং আকৃতি করেছে সারা লেক জুড়েই। যেন কাদের রঙ্গোলী দেবার শখ হয়েছিলো। আলপনা বললাম না,  কারন সাদা রঙের না, সবুজ রঙের সে রিং। গাড়ি থেকে নেমে একটা উৎরাইতে নেমেই দেখি তকতকে লাল মেঝের মস্ত দাওয়া একটা বাঁধানো উঠোনের চারপাশে। উঠোনের মাঝে তুলসীমঞ্চ।  দাওয়ার এক পাশে মস্ত টেবিল চেয়ার পাতা কাঠের কাজ করা আর দাওয়ার ওইদিকে জাল বোনার সরঞ্জাম, চরকা এইসব। ছোট্ট একটা সুইফট বাসা বেধেছে দেওয়ালের গায়ে। দেখেই মনে এতো শান্তির একটা ভাব হয় সব অবসাদ কেটে যায়। তাই ঘরের বাথরুমে স্নানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কি নেই তা নিয়ে কোনো অভিযোগই যেন আকার নেয় না। দোতলায় ছোট্ট একটা লাইব্রেরি আর ক্লান্ত হলে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য জানলা। জানলা দিয়ে দেখা যায় ডিঙি ভাসছে একটা।  দুপুরে ঝকঝকে স্টিলের থালায়, স্টিলের ডেকচিতে সে আমাদের খেতে দিল। মনিপুরি স্টিকি রাইস, নিজের ক্ষেতের বাঁধাকপি, ডাল, দেশী মুরগি, আর জলপাই এর চাটনি। অন্যরকম স্বাদ, কিন্তু মিসেস মাওপাকচু রেঁধেছেন নিজেই, আর এত যত্ন করে খেতে দিয়েছেন মিস্টার মাওপাকচু,  সব মিলিয়ে ভারী আনন্দ হল খেয়ে। 

কি ভাগ্যিস এঁর ঘর বাথরুম আমাদের দলের মেয়েদের চূড়ান্ত অপছন্দ হয়েছিলো। মানে পুরো পরিবেশ নিঃসন্দেহে ভালো কিন্তু ঘরে ধূলো, কিংবা চানের জায়গা না থাকা বাথরুম তাদের স্বস্তি দেয়নি তেমন, ফলে আমার খানিক সুবিধেই হল। মানে খেয়ে উঠেই কেউ গড়াতে চাইলো না, ফলে আমাকেও তাড়া দিয়ে বের করতে হল না। আসলে আমি কোথাও বেড়াতে গেলে যতটা পারি বাইরে বাইরে কাটাতে ভালোবাসি, হোটেলে বসে থাকবো, কিংবা ঘুমোতে যাবো বলে পাহাড়ে উঠবোনা এ আমি ভাবতেই পারিনা তাই কিঞ্চিৎ লড়তে হয় সদলবলে কোথাও গেলে। সুবিধে হল, এই দলের সবার ধরন আলাদা হলেও সবারই মোটামুটি এমপ্যাথি কোশেন্ট বেশী। আমার তো মনে হয় আর কিছু না,  মায়া ব্যপারটা বড় জরুরী,  ওটা থাকলেই হয়তো আর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। (ক্রমশঃ)