Wednesday, April 7, 2021

নয় পাহাড়ের উপত্যকায়(এক)

দার্জিলিং এর লেখায় পজ পড়েছে এতো আরো কিছুদিন পজ দেওয়া যাক। এর ফাঁকে দুড়ুম করে মনিপুর থেকে ঘুরে এলাম, সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের ভাষা, লোকজন, সেসব ভুলে যাবার আগে লিখে রাখি। আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে বেড়াতে যাবার কথা লেগেই থাকে, মিশর থেকে মিজোরাম আফ্রিকা থেকে আলাস্কা সব ঘোরার প্ল্যান হয়, তারপর পকেট, ছুটি সব আমাদের ফোঁস ফোঁস করে ভয় দেখায় আমরাও ল্যাজ গুটিয়ে কাজে বসি। তবু মাঝে মাঝেই ফোঁসফোঁস উপেক্ষা করেই কিছু জায়গা ফাইনাল হয়, টিকিট কেটে নেওয়া হয় ফস করে। অনেকে মিলে প্ল্যান করলে এইটা সব চেয়ে জরুরী।  ফস করে টিকিট কেটে নেওয়া। তাহলে সেটা আর কেউ ক্যানসেল করতে পারে না। না হলে কিছু না কিছু এসে দেখবে ভন্ডুল হবেই। এবারে শুরু হয়েছিলো আসাম দিয়ে। তারপর মেঘালয়, টিকিটের দাম দেখি আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেলো আমাদের গ্রুপ কলের মাঝেই। গুগল কিছু ডেটা চুরি করে বটে!! শেষে আমরা কোড নাম দিয়ে প্ল্যানিং শুরু করলাম। মানে যাবো মনিপুর কিন্তু বলছি মুম্বই। সত্যি বলতে এরকম করে কাজ আদৌ হয়নি হয়তো, তবু তাও তাতেই আমাদের মনে ভাব খুব কিছু করলাম! নর্থ ইস্ট এতোটাই আনএক্সপ্লোরড যে অন্য দেশ ভাবে লোকে!  ওরকম প্রায়  অচেনা একটা জায়গা দেখার উত্তেজনা আলাদাই হয়। প্রায় অচেনা বলতে আমি বলছি কমন ডেস্টিনেশন না আর কি। আহা ভাবলেই ভাল্লাগে।  "বাবু পন্ড দেখো", বলে হাঁক পারা থাকবে না।  "এই বয়সেই কেমন স্মার্ট হয়েছে দেখো এই টুকু ছেলে"  বলে বাঁদরামি করা বাচ্ছার গর্বিত মা বাবার হাঁকডাক থাকবেনা, জোরে গান চালিয়ে শান্তি নষ্ট করা থাকবে না। সুতরাং একদিন সকালে এয়ারপোর্টে সাত মক্কেল জুটে গেলো এই "রোজ একই দিন রিপিট হচ্ছে যেন " থেকে পালাতে। দেখা হতেই এমন বুঁদ হয়ে আড্ডা মারতে লেগেছিলাম, দু ঘন্টা আগে এয়ারপোর্ট এসেও আমাদের হাঁকডাক করে ডেকে পাঠিয়ে তবে প্লেনের পেটে তোলে! 







ছোট্ট পুচকে একখানা এয়ারপোর্ট, কোলকাতার মতো গরম নেই, তবে রোদ বেশ চড়া।  বাঙালী খালি আমরাই নামলাম মনে হয়,  ইনার লাইন পারমিট করাতে হল কেবল আমাদেরকেই কিনা। সেও ভারী অদ্ভুত নিয়ম, নতুন করালে ১০০ টাকা আর রিনিউ করালে ২০০! মগ দেশ পাশেই বোঝা যায়! গাড়ি চলা শুরু, নতুন জায়গার হাওয়ায় মন চনমনে।রাস্তার পাশেই ফাঁকা মাঠ আর তারপরেই নীল পাহাড়। রোদের তেজ যেমন আছে, হাওয়ায় ঠান্ডা ঠান্ডা ভাবও আছে।  ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেকার কোনো ছোট গ্রাম মতো যেন। টিনের চালের বাড়ি, অনেক বাড়ি দোকানের দেওয়ালও আবার টিনের। গায়ের উপর বাড়ি দেখে দেখে ক্লান্ত চোখে এতো খোলা জায়গা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।  ঝকঝকে নীল আকাশ, ছোট ছোট জন বসতি পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। মূল রাস্তা থেকে ডানদিক নিল গাড়িটা, একটা পুরোনো বিষ্ণুমন্দির আছে এখানে। একটা দড়ি ফেলা আড়াআড়ি রাস্তায়, কী ব্যপার? দোলের রেশ শেষ হয়নি এখনো, চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই চাঁদার ব্যপারটা তারপর ঘনঘন হতে থাকবে। এখানে ছেলের দল চাঁদা তোলে না, মেয়ে বউ এর দল তোলে, বাচ্ছা মেয়েরাও আছে কিন্তু বাচ্ছা ছেলেরা নেই। মেয়ের দল গাড়ি, বাইক সব থামায়, দশ টাকা বিশ টাকা বা খুচরো কিছু দিলে রাস্তা ছাড়ে তবে। চিত্রাঙ্গদা দড়ি ফেলে অর্জুনের পথ আটকেছিলো তবে!! বোঝো!এদ্দিন ভেবে এসেছি তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করেছে! ড্রাইভার ভালো জানেনা কোথায় যেতে বলছি, গুগলও ভালো বোঝে না, নেহাৎ সরকার বাহাদুর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছিলো তাই জানা গেলো এটাই সে প্রাচীন মন্দিরটা। ভেঙে চুরে গেছে, মন্দিরও বন্ধ। তবু, আমার অত খারাপ লাগছিলো না, ঝিরঝিরে হাওয়া আর কড়া রোদের এই কম্বোটাই আমার সেরা লাগে তার সাথে একগাদা পাখির ডাক, কিছু আমাদের রোজকার দেখা পাওয়া চড়াই আছে বটে, তবে আজকাল দেখতে পাওয়াই যায় না যাদের, সেই বুলবুলি, দোয়েল, ফিঙেও আছে। তুড়ুক তুড়ুক করে উড়ছে, দোল খাচ্ছে, মন্দিরের ছাদে বসে আড্ডা মারছে।দূরে পাহাড়ের কোল থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, চারপাশে ছোট জনবসতি, টিনের চালের ঘরের সব মিলিয়ে ভারী ঝিম ধরা শান্ত একটা পরিবেশ, টেনশন নেই, তাড়া নেই।

দোলের ছুটি এদের এখনো চলছে, আইএনএ মিউজিয়াম বন্ধ। খানিক আপশোষ তো হোলোই। সেই কবে একটা মেরুদন্ড সোজা লোক বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছিলো, সকলে একবাক্যে তাকে নেতাজি বলতে দ্বিধা করেনি। দ্বিতীয় জায়গা যেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উঠেছিল সে জায়গা দেখতে না পেলে আপশোষ হবেই।লোকটাক হ্রদে আমরা মাওপাকচুর ঘর বুক করে রেখেছিলাম।সে কেমন ঘর জানিনা, তবে ভদ্রলোক ভারী অমায়িক এটা জানতাম। আমাদের ড্রাইভারবাবু তো কিছুই চেনেন না, মাওপাকচুর সাথে কথা বলে, গুগল ম্যাপের নির্দেশ শুনেও ভারী নাকানিচোবানি খেয়ে তিনি পৌঁছলেন। লোকটাক লেকের ঠিক পাড়েই পাহাড়ের কোলে ওনার বাড়ি। লোকটাক লেকের বৈশিষ্ট্য হল, বায়োমাস গুলো জমে জমে ভারী সুন্দর একটা রিং রিং আকৃতি করেছে সারা লেক জুড়েই। যেন কাদের রঙ্গোলী দেবার শখ হয়েছিলো। আলপনা বললাম না,  কারন সাদা রঙের না, সবুজ রঙের সে রিং। গাড়ি থেকে নেমে একটা উৎরাইতে নেমেই দেখি তকতকে লাল মেঝের মস্ত দাওয়া একটা বাঁধানো উঠোনের চারপাশে। উঠোনের মাঝে তুলসীমঞ্চ।  দাওয়ার এক পাশে মস্ত টেবিল চেয়ার পাতা কাঠের কাজ করা আর দাওয়ার ওইদিকে জাল বোনার সরঞ্জাম, চরকা এইসব। ছোট্ট একটা সুইফট বাসা বেধেছে দেওয়ালের গায়ে। দেখেই মনে এতো শান্তির একটা ভাব হয় সব অবসাদ কেটে যায়। তাই ঘরের বাথরুমে স্নানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কি নেই তা নিয়ে কোনো অভিযোগই যেন আকার নেয় না। দোতলায় ছোট্ট একটা লাইব্রেরি আর ক্লান্ত হলে লেকের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য জানলা। জানলা দিয়ে দেখা যায় ডিঙি ভাসছে একটা।  দুপুরে ঝকঝকে স্টিলের থালায়, স্টিলের ডেকচিতে সে আমাদের খেতে দিল। মনিপুরি স্টিকি রাইস, নিজের ক্ষেতের বাঁধাকপি, ডাল, দেশী মুরগি, আর জলপাই এর চাটনি। অন্যরকম স্বাদ, কিন্তু মিসেস মাওপাকচু রেঁধেছেন নিজেই, আর এত যত্ন করে খেতে দিয়েছেন মিস্টার মাওপাকচু,  সব মিলিয়ে ভারী আনন্দ হল খেয়ে। 

কি ভাগ্যিস এঁর ঘর বাথরুম আমাদের দলের মেয়েদের চূড়ান্ত অপছন্দ হয়েছিলো। মানে পুরো পরিবেশ নিঃসন্দেহে ভালো কিন্তু ঘরে ধূলো, কিংবা চানের জায়গা না থাকা বাথরুম তাদের স্বস্তি দেয়নি তেমন, ফলে আমার খানিক সুবিধেই হল। মানে খেয়ে উঠেই কেউ গড়াতে চাইলো না, ফলে আমাকেও তাড়া দিয়ে বের করতে হল না। আসলে আমি কোথাও বেড়াতে গেলে যতটা পারি বাইরে বাইরে কাটাতে ভালোবাসি, হোটেলে বসে থাকবো, কিংবা ঘুমোতে যাবো বলে পাহাড়ে উঠবোনা এ আমি ভাবতেই পারিনা তাই কিঞ্চিৎ লড়তে হয় সদলবলে কোথাও গেলে। সুবিধে হল, এই দলের সবার ধরন আলাদা হলেও সবারই মোটামুটি এমপ্যাথি কোশেন্ট বেশী। আমার তো মনে হয় আর কিছু না,  মায়া ব্যপারটা বড় জরুরী,  ওটা থাকলেই হয়তো আর্ধেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। (ক্রমশঃ)

5 comments:

  1. আমাদের হালকা করে কুঁড়ে বলেচিস বটে তবে বায়োবাসের রংগোলী আর দড়ি ফেলে অর্জুন কে আটকানোর চিত্রকল্প টা ভারী মনে ধরায় কিচু বল্লেম না 😌❤️

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইয়ে বায়োমাস

      Delete
    2. বায়োমাস দিয়ে তোদের বেঁধে নিয়ে গেলে হত। 😌

      Delete
  2. গপ্পো টা খাসা কিন্তু মাস্ক টা ঠিকঠাক নয়। কাপড়ের এই মাস্কগুলো কোন কম্মের নয়। either 3ply surgical or N95.Plane এ,দুটোর combination বা কাপড়ের মাস্কের সাথে 3ply

    ReplyDelete