Wednesday, March 27, 2019

আলাপ

একটা ভূতের গল্প হয়ে যাক? আলাপ সিরিজই হয়ে যাচ্ছে দেখছি!
**********************************

-হ্যাল্লো ম্যাডাম?

-কে কে বলছেন!

- আমি ভূত।

-মানে! ইয়ার্কি মারছেন! অসভ্যতার একটা সীমা থাকে। রাত দুপুরে এসব অসভ্যতা করার জন্যই নেট নেন বুঝি!

- আস্তে ম্যাডাম আস্তে। অত মাথা গরম করলে খুলি ফেটে আমি হয়ে যাবেন তো!

-মানে ফের বাজে বকছেন! আপনাকে নলক করতে বাধ্য হচ্ছি।

-হাঃ হাঃ হাঃ (বেশ মহিষাসুর টাইপ করে পড়ুন,ইনফ্যাক্ট চাইলে আপনার কানের কাছে গিয়েও এরকম আওয়াজ দিতে পারি)। 

-হ্যাল্লো ম্যাডাম!

-একি! আপনাকে তো আমি ব্লক করলাম এক্ষুনি! আপনি এলেন কিভাবে!

-ব্লক হয়না তো! ভূত মানে অতীত ম্যাডাম, অতীত মানে যা ঘটে গেছেই, তাকে আপনি ব্লকাবেন কিভাবে!

-দেখুন এসব নোংরা অসভ্যতা আমার ভাল্লাগছেনা। কোনোভাবে হয়ত ব্লক হচ্ছেনা, এনিওয়ে আমি মেসেঞ্জার ওড়ালাম।

-হ্যাল্লো ম্যাডাম।

-একি!! হোয়াটসঅ্যাপে!  আপনি আমার নাম্বার জোগাড় করলেন কিভাবে!

- আহ শান্ত হয়ে শুনুননা একবার! ভালো করে দেখুন আমার নাম্বার আসছে? আসছেনা তো? কারন আমি সত্যিই ভূত।

-আপনি একজন হ্যাকার এবং কোনো ভাবে এটা হ্যাক করে করছেন। আমি টেকনোলজি বিশেষ বুঝিনা তাই ব্যপারটা ধরতে পারছিনা।

- শুনুন আপনিও আসলে ভূত থুড়ি পেত্নী,  তাহলে আমায় স্বীকার করতে এত অসুবিধে কি?

- মানে! বোকা কথা বলে পেঁয়াজি না মেরে ফুটুন তো।

- আচ্ছা দেখুন এতবার বলছি, আমি ভূত, আপনি সমানে হ্যাকিং,  খারাপ লোক ইত্যাদি নিয়ে পড়ে আছেন। আমি যদি ভূত নাওও হতাম খারাপ লোক তো নাও হতে পারতাম নাকি? একবার কথা অব্দি বললেননা ঠিক করে৷ এত অবিশ্বাস নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে নাকি, মরেই গেছেন তো ম্যাডাম আপনি!

- দেখুন ওসব ড্যাশের কথা বলে লাভ নেই, চিঁড়ে ভিজবে না। হ্যাঁ অবিশ্বাস করছি, কারন আপনাকে বিশ্বাস করার মত কিচ্ছু ঘটেনি।

-অবিশ্বাস করার মতই বা কি ঘটেছে?

-নাম হীন, ছবি হীন, বন্ধু হীন একটা অচেনা প্রোফাইল থেকে পিং করা, মেসেঞ্জার উড়িতে দেবার পর নিজের নাম্বার হাইড রেখে হোয়াতে ডিস্টার্ব করা সবটাই অবিশ্বাসের।

-আচ্ছা বেশ মেনে নিলাম। এবার ধরুন আমি পাঁচশো হাজার বন্ধু নিয়ে,  যে কোনো কারোর একটা ছবি, যে কোনো একটা নাম পদবী, বায়ো ইত্যাদি নিয়ে,  আপনার পরিচিত গ্রুপে চারটে কমেন্ট করে আপনার সাথে কথা বলতাম, তাতেই আপনি আমায় জেনে চিনে যেতেন?

-না তা হয়ত হতনা। আমি অচেনা লোকের সাথে এমনিও কথা বলিনা।

-ফেসবুকে সবাই আপনার চেনা?

-ফেসবুক আর ইনবক্স এক না। পার্সোনালি সবার সাথে কথা অবশ্যই বলিনা।

-বেশ, তাহলে আর কি! ফেসবুকে চাট্টি বাজে মিথ্যে বলে, কমেন্ট করেই আপনার সাথে আলাপ করব!

-মানে! কিরকম লোক আপনি! মিথ্যে বলে কথা বলবেন,  সেটাও গলা বাজিয়ে বলছেন!

-কী করব ম্যাডাম,  সত্যি বললাম আপনি তো বিশ্বাস করলেন না!

-কারন সেটা বিশ্বাসযোগ্য না!

- আচ্ছা বেশ শুনুন, আপনার বাড়ি শোভাবাজার, ভাড়া থাকেন, বাড়িতে মা বাবা আছেন। বাবা ব্যাংকে চাকরি করতেন এখন রিটায়ার করেছেন। আপনি চাটার্ড একাউন্ট্যান্ট। এসব গুলোই আপনি বলবেন হ্যাকার বলে আমি জেনেছি বা আপনার ফেসবুক থেকে জেনেছি, যদিও লাস্টের ইনফরমেশনটা ছাড়া কিছুই আপনার প্রোফাইলে নেই। আপনার একটা ছোট বোন ছিল, দু বছর বয়সে সে মারা যায়, আপনার কনুইএ একবার চিড় খেয়েছিল, আপনার জ্যেঠতুতো দাদা কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে ফেলে, এখনো আপনার বাঁ হাত পুরো টা টান করতে পারেননা। আর কিছু বলব?

- আপনি কে? কী চান?

- বিশ্বাস করবেন না জানি। তাও আবারও বলি আমি ভূত। বেঁচে থাকলে আমার বয়স আপনার বয়সের থেকে দশ বছর বেশী হত, মরে গিয়েও অবশ্য একই আছে।

-আপনি সত্যি বলছেন?

- হ্যাঁ রে বাওয়া হ্যাঁ। আমাদের সম্পর্কে যা সব শোনেন,  সবই ভুলভাল। আসলে ধরুন মানুষ মরে অন্য ডাইমেনশনে চলে যায়। আমরা আপনাদের সাথে কমিউনিকেট করতে পারিনা চট করে কারন টাইম ট্রাভেল করে ওয়ার্ম হোল দিয়ে এক্স্যাক্ট আমার জীবনেরই ফিউচারে যাওয়ার সোজা কোনো রুট পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়ত অন্য কোনো প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে চলে গেলাম আর সেখানে হয়ত আমার মা বাবার বিয়েই হয়নি, কিংবা আই হয়ত এখনো বেঁচে আছি। তবে রিসেন্টলি একজন এটা আবিষ্কার করেছে। ফলে আসা যাওয়া সোজা হয়ে গেছে।

-আমার খুব অবাক লাগছে। বিশ্বাস করার মত না। তাও আপনার কথার কারিকুরিতে বিশ্বাস করে ফেলছি যেন।

-ইটস ওকে। একটু শক্ত বটে বিশ্বাস করা।  তবে বিশ্বাস করলেও ক্ষতি নেই কিছু। এই যে আপনার আগের বয়ফ্রেন্ড যে আপনাকে ঠকালো, তাকে তো চিনতেন অনেকদিন, তাও চেনা হল কই। আরে আরে ওরকম মুখ করবেন না, আই অ্যাম সরি, আমার বলা উচিত হয়নি ও প্রসঙ্গ।

-আপনি আমার মুখ দেখতে পারছেন?

- সত্যি বলতে কি আমি তো যেখানে খুশিই যেতে পারি। আপনার ঘরেও। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না,  তাই এই চ্যাটেই এসেছি...না আপনার মুখ আমি দেখতে পারছিনা তবে, অনুভূতি বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি?

-😀

- হাসির কী হল! আগেকার মানুষের অনুভূতি বেশী ছিল, তাদের শিকড় ছিল...আপনাদের মত ভার্চুয়াল জগতের শিকড়হীন সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলনা।

-এমন বলছেন যেন কত বছর আগে জন্মেছিলেন। আপনি ইয়ে মানে কতদিন হল, মানে..

-আরে ভূত হয়েছি কিনা জানতে চান তো? এত আমতা আমতা করার কী আছে। পাঁচ বছর। না পাঁচ বছরের তফাতে এত কথা বলছি না, যদিও পাঁচ বছরে বদলেছে অনেক। আসলে ওই ওয়ার্ল্ডে সব কিছুই আলাদা ভাবে তৈরী হচ্ছে জানেন। ওখানে মায়া দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে মানুষের জীবন বইছে। আমার শুরুতে ভারী অসুবিধে হত, ছোট্ট একটা চাকরি করে আরো দশটা মানুষ তারা হয়ত সে অর্থে নিজের না, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, তাদের নিয়ে বাঁচা। বিলাসের জায়গা কমে গেছে, তবে আস্তে আস্তে সে স্বাদ পেলে আর অভাববোধ থাকেনা। বাড়িতে রঙচটা হাফ প্যান্ট পরে থাকার সুখের মত। বোঝাতে পারলাম না ঠিক মনে হয়।

-জানি। আমি বুঝি।

-জানি ম্যাডাম,  তাই জন্যেই তো আপনাকে পিং করছিলাম।

-আচ্ছা আপনি সামনে আস্তে পারেন না?

- হুঁ। পারি তো। কিন্তু এই যে একটু দূরে থাকা, দুম করে প্রথমেই সব দূরত্ব ঘুচিয়ে না দেওয়ার অসুবিধেটুকু থাক না?

- আর ফের কথা বলতে ইচ্ছে করলে?

- হবে। চিঠি লিখে রাখবেন। আমি পড়ে জবাব দেব।

-পুরোনো দিনের মত?

-আমি তো পুরোনো দিনেরই লোক।

- বেশ।  এমনিতেও আজকাল আর ভরসা বিশ্বাস করতে পায়ারিনা, এই চিঠি চিঠি খেলাটাই থাক।

-খেলা না ম্যাডাম,  আপনার বিশ্বাস ফিরিয়ে আনবো ফের, দেখবেন।

-আপনি চলে যাবেন আবার আপনার ওই দুনিয়ায়?

-যেতে তো হবেই ম্যাডাম। সব কিছুর জায়গা থাকে। চাইলেও তো এখানেই থেকে যাবার উপায় নেই। তবে একজন বন্ধু যাকে এখনো চিঠি লেখা যায় তাকে পাবেন।

-মন খারাপ করছে।

-সেকি! এক্ষুনি তো কথাই বলতে চাইছিলেন না।!
- 😑
- আহা রাগ করেনা ম্যাডাম।

-ধোর মশাই আপনার ম্যাডাম। আমার নাম আছে একটা।  আর আপনার নামটাই বা কি? স্যার বলে ডাকতে পারবো না!

- আচ্ছা আচ্ছা,  চিঠিতে জানাবো। কিংবা আপনি জানাবেন। দেখি কে আগে লেখে। আজ যেতে হবে। সময় শেষ,  ডাক পড়েছে। ভালো থাকবেন। চিঠি লিখবেন কিন্তু।

Tuesday, March 26, 2019

আবার পাহাড় (শেষ)

আলো ফুটতেও আকাশ পরিষ্কার হল না। তখনো সূর্য ওঠেনি, ওঠার আগের আকাশ। কিচিরমিচির পাখির ডাক নিয়ে রাস্তাটা ধরে হাঁটছি, ওদিকে খাদের উপর মেঘের সমুদ্র। সমুদ্রের মাথার উপর লাল সূর্য টা হেসে উঠতেই সকাল হয়ে গেল।



চা নুডলস খেতে ঝোলা গুটিয়ে জিসিংভাইকে থাকার কড়ি দিতে গেলাম। সে তো দেখি হিসেবে কেসিনাগের ভাই। যা হিসেব দিলো, তাতে করে আমার থাকা ফ্রি, খাবার খালি পয়সা ধরেছে! বললাম তাকে, হ্যাঁ হ্যাঁ ভারী ভুল হয়ে গেছে তো। এবার সে হিসেব করে চারজনের ভাড়া করে ফেললো। বললাম, কত্তা থামো, এরপর তো কেসিবাবু বাঁশে ছেড়ে দেবেন। যাই হোক হিসেব মিটিয়ে, ফিরতি রাস্তা ধরলাম। নামার রাস্তা এতোই প্রলোভনের হয়, ইচ্ছে করে ছুট লাগাই....গড়গড় করে নেমে যাব! কিন্তু লোভে পাপ পাপে গড়িয়ে পড়া। তাই ব্যালেন্স করে করে,নামতে হয়। মেঘমাতে আর্মির ক্যাম্প আর বৌদ্ধ মনস্ট্রি রাস্তার দুই পারে রয়েছে। বেশ চমৎকার সহাবস্থান বটে।ঘন্টার আওয়াজ পেলাম মনষ্ট্রি থেকে, শান্ত সকালে যেন ওটাও একটা অংশ, আলাদা না। আর্মির লোকেরা রাস্তা দেখিয়ে দিল আমায়, এখানে একটা রাস্তা নীচে বনে চলে যায়,পথ হারাবার চান্স থাকে।






মেঘমা থেকে চিত্রে অব্দি আবার খানিক গাছপালা আছে। লোকজনের সাথে দেখা হয় রাস্তায়, মানেভঞ্জন থেকে আসছে সব।নানানরকম দল, অল্পবয়সী, মাঝবয়সী...রাস্তায় একটা কুকুরের সাথে আলাপ হল। আলাপ সামান্যই অবশ্য, কারন তিনি আমায় রাস্তা দেখাতেই ব্যস্ত ছিলেন, কথাবার্তায় বিশেষ উৎসাহী না। ছবি তোলাতেওনা। একবার একবার দাঁড়িয়ে পথচলতি কারোর সাথে কথা হচ্ছে, কিংবা ছবি তোলার চেষ্টা করছি হয়ত, উনিও দাঁড়িয়ে পড়ছেন, একটা ফুল কি পোকা তাড়া করছেন। তারপর যেই না বলছি, "কিরে আর যাবি? অনেকটা রাস্তা এলি তো, যা এবার ফিরে যা। টাটা। "
অমনি বকে ধমকে একাকার। "আমি যাবনা বলেছি কি? তুমিইই তো দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তুলছ, বকবক করছ! কী যে স্বভাব মানুষের কে জানে বাবা! এসব বদভ্যাস আমাদের নেই। চলো চলো। " বলে পাঁইপাঁই দৌড়চ্ছে, ফের আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
- দাঁড়া রে ব্যাটা তোর একটা ছবি তুলি? 
-আহ কেন বাপু বেশ তো কান চুল্কাচ্ছি আরাম করে, ছবি দিয়ে কী হবে!এই করতে করতে আমার সাথে তিনি চিত্রে অব্দিই এলেন। তারপর কোনো রকম মন খারাপ, পিছুটান ছাড়া চলেও গেলেন। 
ধর্মরাজ কি ডাউনহিল এলেন?


চিত্রে থেকে পাইন বনের রাস্তায় নামছি টুকটুক করে। ইচ্ছে করেই আস্তে আস্তে নামছি। আর তো একটু পরেই তো আর এই পাহাড়, গাছ, নির্জনতা সব ফুরিয়ে যাবে। একটা রাস্তায়, গাছের ছায়ায় আধশোয়া হয়ে ভাবছি না এত পাখি দেখলাম, তুলতে আর পারলাম না। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ....ঝিরঝিরে পাইন বনের হাওয়ায় ঘুম এসে যায়। এমন সময় একটা পাখি পোজ দিয়ে বলল, ছবি তুলবে? আচ্ছা এই নাও তোলো। তারপর সে কতক্ষন ধরে আমার মডেল হল, তার ঠিক নেই। খচাৎ খচাৎ তুলে তাকে থ্যাংকইউ বলতেই সে আমায় ভালো থেকো হে বলে পালালো। 


শেষ বাঁকটা নামছি যখন পাইন গাছেদের উদ্দেশ্য করে বললাম, "এবার সেভাবে কথা হয়নি তেমন, নিজের মনে বকেছি, এখন বলি?যদিও জানো তোমরা,ইয়ে মানে শ্রদ্ধা টদ্ধা ওজনদার কথা, তা বাদ দাও, আমি তোমাদের ভালোবাসি। সত্যিইই। ভালো থেকো কেমন? আর ইয়ে থ্যাংকু। " 
বাকি আরো কথা হল বটে, তবে সে সব পার্সোনাল। আমি জানি ওরা বুঝেছে, হাওয়াটা বদলে গেল দেখলে না? আর থ্যাংকুটাও নিয়েছে, ওটা যে আমি ফর্মালিটি করিনি সে বেশ বুঝেছে। গাছেদের এই ব্যাপারটা অবাক লাগে না আর, আমি জানি ওদের টেলিপ্যাথি তীব্র, সব জায়গার গাছেদের কানেকশন ওদের আছে। মানে ধরো আমি কোলকাতায় একটা গাছের গায়ে পানের পিক ফেললাম পাহাড়ের গাছ জানবে, ওরা তোমায় উপেক্ষা করবে। আর যদি ওদের কাছে একবার পৌঁছে যেতে পারো, জীবনটা বদলে যাবে। না না গাড়ি বাড়ি যশ কিছুই হবে না, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। গাঁজা ভাঙ না খেয়েই ফুরফুরে মন হয়ে যাবে।





ফেরার সময় ট্রেনে ওয়েটিং লিস্ট দুই...অগত্যা বাসেই। শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়ালে হরেক মানুষ দেখা যায়। চানা মটর কচুরি ভাত ডাল খাওয়া প্যাসেঞ্জার, দালাল, মজুর, গোমড়া টিকিট কাউন্টারের লোক, টাকা হারিয়ে গেছে বলে সাহায্য চাওয়া মিথ্যুক ...অপেক্ষা কোলাজ হয়ে যায়।আজ ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখছি, দুধারের মাঠ, গাছ, বাড়ি ঘর সব চাঁদের আলোয় অন্য ডাইমেনশনের হয়ে গেছে যেন....চাঁদের আলোই ওই জগতে যাবার রাস্তা....প্যারালাল ওয়ার্ল্ড।সেই চাঁদের আলো, একবুক তেষ্টা নিয়ে খাল, মাঠ, ঘরবাড়ি বুকে পুরে নিচ্ছে,আগামী এক পক্ষকালের অন্ধকার সইবার জন্যে....যেমন করে এই মহারাজও রোজকার দৈন্য সইবার জন্য শক্তিটা বুকের মধ্যে পুরে নিয়ে এসেছে....





Saturday, March 23, 2019

আবার পাহাড় (২)

ঠান্ডার জায়গায় ঠান্ডাকালে যাবার অসুবিধে সুবিধে সবাইই জানে। আরেকটা অ্যাড করে দিই, জামাকাপড় মোজা সব পরেই শুয়ে পড়ো, সেই পরেই ফের সকালে বেরিয়ে পড়ো। তাই সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙলো, আমার জানলার কাচের বাইরের অন্ধকার কেটে গেছে দেখে, তুড়ুক করে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়তে সময় লাগে না বিশেষ। 
ছাদে গিয়ে দেখি ওইই তো স্নো পিক দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা না কুম্ভকর্ণ কোন পিক জানিনা, কিন্তু গরম চা এর কাপ হাতে, পাইন বনে ঘেরা গ্রামে চাদে বসে স্নো ক্যাপ মাউন্টেন দেখতে গেলে নামের অত মহিমা লাগে না। অন্তত আমার কাছে। সুন্দর রোদ মাখা সকাল। কিচিরমিচির করে পাখি ডাকছে। একটু পরেই বেরিয়ে পড়ব। তার আগে হেঁটে হেঁটে ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখে আসা গেল একবার। মন্দির থেকে ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে।





এক পেট নুডলস খেয়ে, পদ্মদিদির ভরে দেওয়া চা ফ্লাস্কে আর জল বোতলে নিয়ে শেরপা নিবাসের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু হল। আলোয় ছায়ায় মোড়া রাস্তা। পদ্মদিদির বর বলে দিয়েছে ফুটবল গ্রাউন্ড অব্দি চওড়া রাস্তা তারপরেই ফুট ট্রেল শুরু, কোনো ভাবেই যেন ওই ফুট ট্রেল না ছাড়ি৷ আর পদ্মদিদি বলে দিয়েছে সাবধানে যেত। শেরপা নিবাসের পাশে একটা ঘোড়া একমনে পাতা চিবোচ্ছে। খান কতক ছেলে ট্রেক শুরু করবে বলে প্রস্তুত, গাইড এলেই শুরু করে দেবে। অল্পবয়সীইই সব, কলেজ পড়ুয়া বা আরেকটু বেশী। ফুটবল গ্রাউন্ড এর পাশেই প্রাইমারি স্কুল। ট্রেইল ধরে একটু এগোলেই জঙ্গলের রাস্তা শুরু। সাদা একটা ফুলের গাছ আছে সবুজ জঙ্গলটায় মাঝে মাঝে আলো জ্বালিয়ে ফুলে ভরে আছে।




সামনে গুরাস পিছনে ম্যাগনেলিয়া

 নীল ঝকঝকে আকাশ, ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ পাখি উড়ছে। আমি তাক করলেই তারা উড়ে পালাচ্ছে। বদামির সীমা থাকে মশাই। এই পাখিগুলো এত জ্বালিয়েছে, মানে ফচকেমি করে খালি উড়ে উড়ে পালিয়েছে ফোকাস করতে গেলেই যে আমি ঠিক করেছি পরের জন্মে এইরকম ফুদকুরি পাখি হয়েই জন্মাবো আর মানুষ গুলোকে উত্যক্ত করবো মনের সুখে। লাল লাল ফুলের গাছও ঢের আছে আর আছে ঘাসফুল। অদ্ভুত আরাম আর আনন্দ হচ্ছে এই পুরো জঙ্গলটার রাস্তায়, যতক্ষন না টংলু পৌঁছচ্ছি একা আমি। উঠতে উঠতে হাঁফিয়ে পড়লে পাখির ছবি তোলার নামে জিরিয়ে নিচ্ছি একটু। খানিক ওঠার পর দেখি শুকনো সাদা পাতা ছড়িয়ে গাছের তলাটা কেমন যেন বরফের রঙ নিয়েছে। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভালো পারিনা, তাই যা চোখে দেখলাম তা লেন্সে ধরা গেল না।




গাছতলায় আরাম করে বসে একটু জল খেয়ে চা এ চুমুক দিচ্ছি। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো জ্যাকেট, গেঞ্জি খুলে ফেলেছিলাম ক্রমে, এখন আবার মনে হচ্ছে পরে নিলেই ভালো। এই জ্যাকেট খোলা পরার ক্যাপ্টেন গিরি টংলু অব্দি চলেছিল। বেশ খানিক ওঠার পর একটা খোলা জায়গা এল আর সেখান থেকেই দূর পাহাড়ের উপর টংলু দেখতে পেলাম। দেখে সত্যি বলব আমার শুকিয়ে গেছিল। হ্যাঁ! ওই পাহাড় চড়তে হবে এখনো! ইরিবাপ্রে। কী আর করা দূরে না তাকিয়ে ফের ফুল পাখি গাছ পালা দেখতে দেখতেই হাঁটা দিলাম। খানিক ওঠার পর দেখি, অ্যাঁ! আমি এই এতোটা উঠে পড়লাম! মানে রাস্তা যতটা কঠিন লাগে দেখলে অতটাও না। চলা শুরু করলেই সোজা হয়ে যায়। 







আর দু পাক ঘুরে একটা ঝাঁকড়া গাছের পাশ দিয়ে উঠলেই ওই তো টংলু। একটা মারুতি ওমনি দাঁড়িয়ে আছে। তার ভিতরে দুজন কি সব করছে। একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটায় গিয়ে খোঁজ নিতে গেছি, ওটাই ট্রেকার্স হাট কিনা ওব্বাবা একটা বিটলে বদ কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এলো। পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে গলে আমায় সে কি চমকানি। জ্বালাতন তো! কই কে আছেন? এটা ট্রেকার্স হাট? উঁহু এটা না এটা না, ওই বাঁকটা এগিয়ে যাও ওইখানে৷
বাঁকটা ঘুরতে দেখি এক দল ঘোড়া একটা ফাঁকা জায়গায় লুটোপুটি খাচ্ছে খুব গড়াগড়ি দিয়ে। আজব তো! ঘোড়ারা তো নাকি খালি মরে গেলে শুয়ে পড়ে শুনেছিলাম! ওইদিকে দুটো কুকুর চেঁচাচ্ছে হিংস্র ভাবে; বাঁধা আছে দেখছি! যাক!





ট্রেকার্স হাটে ঢুকে দেখি দুজন লোক, স্থানীয় না অবশ্যই, হিন্দিতে আমায় বলল, ওই দিকে কেউ আছে কিনা খোঁজ নিতে, বাঙালীই হবে বোধ হচ্ছে। "কোই হ্যায়" বলে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখলাম একটা খাবার জায়গা, কেউ নেই, আমার আওয়াজেই মনে হয় এক অল্পবয়সী মেয়ে বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। 
"বুকিং নেই, ঘর চাই।"
-ভাইয়া বল সকতে হ্যায়।
চেয়ারে ব্যাগ রেখে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। মেঘে স্লিপিং বুদ্ধ তো দূর বুদ্ধের নাকটুকুও দেখা যাচ্ছেনা! অবশ্য নতুন করে হতাশ হবার কিছু নেই, আমার সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার সম্পর্ক পদ্মাবতী আর আলাউদ্দীন এর মতোই। রানী দেখা দেবেননা আমিও নাছোরবান্দা, দেখি কতদিন অপেক্ষা করায়। 
বাঙালী ভদ্রলোক দুজন তখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। আমায় একা দেখে অফার করলেন ওনাদের সাথে সান্দাকফু অব্দি যেতে, গাড়িতে জায়গাও আছে, আর সান্দাকফুতে বুকিংও। কাল ওনারা নেমেও যাবেন। কিন্তু আমার তো তাহলে হাঁটা হবে না। আমি তো হাঁটতেই এসেছি...নিজের মতোন, গাছেদের সাথে বকবক করবো, পাথরে শুরে পড়বো, ইচ্ছে মতো জায়গায় বসে গান গাইবো হেঁড়ে বেসুরো গলায়....কিংবা একদম চুপ করে পাহাড়ি নিস্তব্ধতা বুকে পুরে নেব।
সবিনয়ে জানালাম এ যাত্রায় হবে না, তবে পথে এই যে কত লোক পাওয়া হয়ে যায় তবু বলি কেন একা ঘুরি?








খানিকবাদে জিসিং ভাই এলো। গাল দুটো টমেটোর মত লাল। খুব নাকি বুকিং চলছে তাই ঠিক সামনের ভালো ঘর গুলো দিতে পারবেনা। পিছনের ঘর এ থাকতে পারি। তাই সই। ব্যাগ বস্তা রেখে বেরোলাম। ট্রেকার্স হাটে জিসিং ভাই বিরানব্বই সাল থেকে আছে। নিজের ফার্ম মত বানিয়ে ফেলেছে এতোদিনে। গরু, মুরগী, কুকুর, ঘোড়া, ছাগল নিজের ক্ষেতিবাড়ি। তবে শুনে যেমন মনে হচ্ছে ওরকম না। এই ধরো একটা পাথরের উপর মুরগির ঘর, উঁচু নিচু চড়াই ভেঙে খানিক গিয়ে গরুর থাকার জায়গা। ওইই দূরে পাহাড়ের ঢালে অল্প করে চাষের জায়গা। আরো খানিক নীচে নেমে গেলে জল ধরে রাখার জায়গা...ওইইই টুমলিং থেকে আসে। জলের বড় অভাব এখানে। এই ধরে রাখা জলই বয়ে নিয়ে যেতে হয় ট্রেকার্স হাটে। ওইই যে নীচে টুমলিং দেখা যাচ্ছে। 


সোজা রাস্তায় গেলে ঘুরপথ হবে, পিছনের এই পাহাড়ি পায়ে চলা রাস্তা ধরে গেলে কম হবে খানিক। নীল আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, সুন্দর হাওয়া, আমি তরতর করে হেঁটে নেমে গেলাম ঘোড়াগুলো যে রাস্তায় গেছে সেই পথে। এ পাহাড়টা পুরো ন্যাড়া। গাছ নেই একদম। হয়ত মরে গেছে বা শীতের পর পর বলে এত ন্যাড়া বোঁচা লাগছে। চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়েছি একটা চ্যাটালো জায়গা দেখে। মেঘ গুলোর হাবভাব দেখছি। পুরোই কেতাদুরস্ত মানুষ এর মতো ব্যবহার! এই দিক থেকে মেঘবাবু এক যাচ্ছেন, ওদিক থেকে মেঘবাবু দুই আসছেন, দুজনে মুখোমুখি, "হাই, সব ভালো তো?"? " হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যাভ এ নাইস ডে"। ব্যাস কথা শেষ, দুজনে নিজের মত চলতে লাগলো। শেষে রোদ যখন নাকটা ভালো রকম খামচাতে শুরু করলো ফের ওঠা গেল। রাস্তার ধারে একটা বৌদ্ধ মন্দির মত আছে, সেখানে ঢোকার আগে একটা ছোট গেট, কেউ কোথাও নেই, ঝরা পাতার রাশি, ফুল ফুটেছে লাল গাছটায়, এমনকি পাখির আওয়াজও শোনা যায়না।



টুমলিং এ ঘরবাড়ি কিঞ্চিৎ বেশী। সান্দাকফু যাবার গাড়িগুলো সারাই ঝাড়াই হচ্ছে এখানে। এখানেও একটা বৌদ্ধ স্তুপ টাইপ আছে। আমি ঘুরে দেখলাম, ফল আর জল দিয়েছে খেতে, নো পয়সা। আমি আবার মন্দির টন্দিরের খুচরো টাকা নিয়ে আরেক মন্দিরের কাজ সেরে থাকি....যদিও এখানে প্রয়োজন নেই। টুমলিং থেকেও কিচ্ছু দেখা গেল না। মেঘ বরং আরো বেরেছে। ফেরার রাস্তাই ধরলাম আবার। এদিকে মেঘগুলো নেমে এসেছে উপত্যকায়। মেঘ দিয়ে পুরোই ঢেকে গেছি। এইরে, রাস্তাটা কোথায়?




টুমলিং টংলুর থেকে নীচে। ফলে নামার সময় রাস্তা ঠাওর করে করে না নামলেও চলে কারন পুরো জায়গাটাই ফাঁকা, গাছপালা নেই, রাস্তা হারাবার প্রশ্নই আসেনা। কিন্তু ওঠার সময় তো লাগে। এমন মেঘে ঢাকা তারা হয়ে আছি, গরুর পাল, ঘোড়া গুলো,কিচ্ছুই দেখতে পাচ্ছি না। শেষমেষ জলের লাইন যেটা কিনা জিসিং ভাই দেখিয়েছিল, টুমলিং থেকে যে লাইন দিয়ে জল এসে টংলুতে আমাদের খাওয়া ধোয়ার ব্যবস্থা করে সেই জলের লাইন ধরে ধরে এবড়োখেবড়ো বেপথে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে একটা নীচু জায়গায় দিল্লি একটা ঘোড়ার কংকাল পড়ে আছে। মরে কংকাল হয়ে শুয়ে আছে....বড় অসহায় দেখতে লাগে। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই, ট্রেকার্স হাটের কাছাকাছি এসে দেখি, একটা দল খচ্চরের পিঠে জিনিস মালপত্র চাপিয়ে হেঁটে আসছে, কথা ভাসছে তাদের 
"টংলুতে কিছুই নেই"
"সেবার অমরনাথের রাস্তায় গেছিলাম, ওটা আরো খাড়াই...."
এসব দলকে সযত্নে পাশ কাটিয়ে যেতে হয়। বেলা হয়েছে বেশ, খেয়ে নিলেও হয়। মেঘ এখোনো কাটেনি। তবে দু হাত দূরের জিনিস দেখা যায়নার থেকে বেটার হয়েছে।





খেয়ে উঠে আশপাশটা চড়তে বেরিয়েছি ফের। খাদের দিকে মেঘ হলে কি হয়, গাছের উপর রোদ পড়েছে বেশ, কিচিরমিচির করে সেই ফচকে পাখিগুলো খুব আমায় প্রভোক করছে আর যেই না ফোকাস করার চেষ্টা করছি অমনি ফুড়ুৎ। যা যা, তুলবো না ছবি হুহ, এলেন আমার ক্যাটরিনা রে। পস্ট শুনলাম কিচিরমিচির করে আমায় আওয়াজ দিয়ে পালালো ফচকে গুলো। 




সকালে মারুতি ওমনিতে যাদের দেখেছিলাম, তারা ক্যাম্প করতে এসেছে। গাড়িতেই থাকা খাওয়া শোওয়া সব। তবে কতদূর যেতে পারবে ওরা জানেনা, কারন, গিসিবাসের পর তো ওমনি আর যাবে না। যাকগে ওরা তা নিয়ে অত ভাবছেই না। কম্বলের উপর জায়গা করে দিয়েছে, আঙুর খাও, লাঞ্চ করে যাও আমাদের সাথে, গাঁজা খৈনী চলবে কিছু? বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে উঠে পড়লাম। এই যে আমি কোনো স্নো পিক, কোনো স্লিপিং বুদ্ধ দেখতে পাচ্ছিনা তাতেও আমার কোনো দুঃখ হচ্ছেনা। আমি উঁকি মেরে মেরে দেখছি লাল গরুটা হাম্বা হাম্বা করে জিসিং ভাইকে ডাকছে, "এবার আমায় ঢুকিয়ে দাও না ঘরে", বলে বলে। ছাগল গুলো তো বোকার হদ্দ মেঘে মেঘে কোথায় ঘুরছে কে জানে! মুরগীটা কোঁক্করকোঁ করে করে চিক্কুর ছাড়ছে, মুরগী না মোরগ এটা? কে যেন ডাকে? ভারী সুন্দর দেখতে কিন্তু। তবে আমি আবার সাধক মানুষ কিনা, এমন সুস্বাস্থ্যের মুরগী দেখলে মনে হয় খেতেও হেব্বি হবে।



বেলা পড়ো পড়ো যখন, একটা পরিবার এলো, বাবা মা ছেলে, প্রপার ট্রেকিং ব্যাগ, জামা জুতো লাঠি নিয়ে। আমার মতো যা আছে নিয়ে বেরিয়ে পড়া পাব্লিক না। আর কেউ না আসলে জিসিং ভাই আমায় সামনের ঘরটা দেবে, আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে ওই ঘর থেকেই স্নো ক্যাপ মাউন্টেইন দেখতে পাওয়া যায়। আর কেউ এলো না, ঠান্ডা আরো বাড়লো....ক্রমে অন্ধকার হয়ে এলো আর একটা ফ্যাকাশে চাঁদ উঠলো। ওই অন্ধকারে ওই চাঁদেরই জোর বেজায়। সে যে কী অদ্ভুত, কী মায়াবী লাগছিল বোঝাতে পারবোনা। চাঁদের আলোয় মেঘে ঢাকা টংলু আমার কাছে ভারী অচেনা লাগছে। যেন এই পাহাড়, গাছ, ঘরবাড়ি, রাস্তা সব অন্য জগতের। আমি ওই রাস্তা ধরে কুয়াশায় মেঘে মিলিয়ে গেলে অন্য কোথাও পৌঁছে যাব। আমি বোঝাতে পারবোনা সে অনুভূতি। বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটছি, কেউ কোত্থাও নেই, নিজের পা এর শব্দ ছাড়া.....চুপ করে বসে রইলাম একটা জায়গায়। তারপর গেলাম ফের সেই ছেলে দুটোর গাড়ির কাছে। ওরা তখন কাল ওদের সঙ্গে আনা কাঠ জ্বেলে আগুন পোহাচ্ছে।বসে কফি খেলাম, আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে ফিরেও এসেছি আবার। ঠান্ডায় হাত পা জমে যায় মশাই। জিসিং ভাই এর ছেলে পেম্বা ক্রুজে শেফ, ছুটিতে এসেছে। কিচেনে কাঠের আগুনে রান্না হচ্ছে, আমি আর পেম্বা খানিক গল্প করছি, ওদিকে জিসিংভাই, ওর বৌ,শালী আর দুজন লোক মিলে গল্প গুজব করছে। একটা দল এলো এগারোজনের। রাতের রান্না শেষ প্রায়। এমন সময় দেখলাম সেই সুন্দরী কমলা থুড়ি মুরগী কাঠের থালায় শুয়ে এলেন। পেম্বা, যার নামের মানে শনিবার, সে দামী ঘড়ি হাতে, একটা চপার হাতে লেগে পড়লো কাজে। ঢিমে আঁচে কাঠের উনুনে হওয়া দেশী মুরগীর মাংস আর ভাত.....খেয়ে হাত ধুতে ইচ্ছে করে না এত ঠান্ডা। কুয়াশা কিংবা মেঘ আরো নেমে এসেছে, ওদিকের মাঠে দুটো দল ক্যাম্প করেছে, কুকুর দুটো ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। আস্তে আস্তে সব চুপ করে গেল। আমি ছাড়া এদিকের ঘর গুলোয় আর কেউ নেই। জানলার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলে ফ্যাকাশে চাঁদ, কুয়াশা কিংবা মেঘ, কয়েকটা তারা....আর অনন্ত নিস্তব্ধতা। যতবার ঘুম ভাঙলো রাতে ততবার এ দৃশ্যের বদল হয়নি, আলো ফোটা অব্দি।










(ক্রমশ)

Tuesday, March 19, 2019

আবার পাহাড়

প্রেম বোঝা যায় বিরহে বলেছিলাম না? তা যেমন সত্যি, তেমনি জড়িয়ে মড়িয়ে থাকলে ভালোবাসা জন্মায় এও সত্যি। দূরে আছি পাহাড়ের থেকে কতদিন? প্রায় এক বছর হতে চলল মনে হয়। তাও কয়েকদিনের কাছাকাছি থাকাই তো ছিল কেবল, কিন্তু সত্যিকারের দূরে তো নেই আসলে। ভালোবাসা শিকড় মেলে, সেই শিকড়টা তো পাহাড়ে গিয়েই বসিইয়ে , ছড়াতে দিয়েছিলাম। তাই পাহাড় না দেখলে কষ্ট হয় কিন্তু এটাও জানা থাকে আছে তো....

পাহাড়ে বারবার আমি অসময়ে যাই। ইচ্ছে করে যাই এমন না আসলে অত গুছিয়ে নিজের সাথে ঘুরতে যেতে ভালো লাগেনা। ফলে, যে সময়ে রডোডেনড্রনের আগুন জ্বলে আমি পাহাড়ে থাকিনা, যে সময় পরিবেশ উপযুক্ত থাকে সক্কলে টিকিট কেটে ফেলে আমি এদিক সেদিক ঘুরঘুর করে ভাবি, একবার ঠিক সময়ে যাব। টুকটাক ঘোরাঘুরি করার ফলে জানি, শহরে চাঁদ ঠিক প্রকাশ পায়না। তাই দোল পূর্নিমা না পেলেও একদশী দ্বাদশীর চাঁদও আলো ছড়াতে ভালোই পারে যদি তুমি দেখার সুযোগ পাও।

সান্দাকফু যেতে অন্তত গোটা পাঁচেক দিন লাগেই। আমার মধ্যবিত্ত জীবন প্রেমে অত দিন দেয় কই! ফলে পাহাড়ে হাঁটবো এই ইচ্ছে টুকু পূরন করতে টংলু টুকুই ঘুরে আসি। সেবার টংলু যেতে গিয়েই ভার্সে চলে গেছিলাম, পেন্ডিং আছে অনেকদিনকার। ফের সুমিতদাকে জ্বালাতন, কোন রুট দিয়ে যাব কোনটা দিয়ে ফিরবো, কতক্ষন লাগবে মোটামুটি। একটা দিনই ছুটি খালি, সোমবার, মানে সোমবারেই বিকেলের মধ্যে শিলিগুড়ি নামতে হবে। মোটামুটি যা বোঝা গেল, টংলু থেকে মানেভঞ্জন তিন সাড়ে তিন ঘন্টায় নেমে আসা যায়। কিন্তু এ তো এক্সপার্ট ট্রেকারের মত, আমি তো সে অর্থে ট্রেকার নই। ধুস যা হবে দেখা যাবে....

সুতরাং দুদিন আগে টিকিট দেখতে বসে দেখা গেল.... কী আবার অফকোর্স ওয়েটিং। জেনারেলে যাওয়া যায়....বাসের টিকিট আছে কি? আরিব্বাস আছে তো। চলো ফের। অফিস থেকে ফেরার পথে মনে পড়ে, একটা রুকস্যাক তো কিনতে হত। পাওয়ার ব্যাংকও তো নেই। যাকগে যাক। এই ব্যাকপ্যাকেই হয়ে যাবে।

শিলিগুড়িতে নেমে চা বিস্কুট খেয়ে গাড়ি খুঁজছি। শেয়ারে যাব অবশ্যই। সুখিয়াপোখরির গাড়ি মেলে, তবে এইখানে সব দার্জিলিং এর গাড়ি। দার্জিলিং মোড় অব্দি না গিয়ে আর, এখান থেকেই ঘুম অব্দি চলে যাই, ফের না হয় ওখান থেকে সুখিয়ার গাড়ি ধরে নেব। শেয়ার গাড়ির মজা বা সাজা যাই বলো না কেন, বেশ হরেক কিসিমের লোক মেলে। আমার পাশে যে তিনটে ছেলে তাদের দুজন হল গিয়ে স্টুডেন্ট। শৌখিন। হুঁ হুঁ বাবা ফেলুদা আম্মো তো পড়েছি খানিক নাকি? হাতে ওয়ান প্লাস, আঙুরের প্লাস্টিক, শেয়ার করার আধিক্য, পাহাড় দেখেই খচাৎ খচাৎ ছবি...দার্জিলিং প্রথমবার, কলেজ পড়ুয়া শিওর। আর এক জন গায়ে সস্তার চকচকে কোট, হাতে উল্কি, রোঁয়া ওঠা ফুটপাথের ব্যাগ, বিরক্ত মুখ চোখ, ঢুলতে ঢুলতে সারা রাস্তা.....দার্জিলিং এ কোনো হোটেলে কিংবা দোকানে কাজ করে। নাহ আমি জিজ্ঞেস করিনি কিছুই, ও আমার ভাল্লাগেনা,কাউকে দেখা মাত্রই কোথায় থাকো, কী করো নিয়ে প্রশ্ন করা। কিন্তু বসে বসে আন্দাজ করতে দোষ নাই। বলতে পারো স্টিরিওটাইপ আন্দাজ, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেলে বলেই না স্টিরিওটাইপ আন্দাজ করা হয়ে থাকে!

পিছনের মহিলা পুজো দিতে চায়, একটা নারকেল তার দরকার। পাহাড়ের শেয়ারের গাড়ি বড়ই এডজাস্টেবল হয়। সামনে ড্রাইভার সহ চারজন বসে যায় দরকার পড়লে, যে কোনো গাড়িতে। সে অভিজ্ঞতা পড়ে বলছিখন। যার যেমন দরকার সেখানে দাঁড়াতে পারে। ফলে এনার নারকেলের জন্য বার চারেক হল্ট হল, বিভিন্ন দোকানে। কার্শিয়াং, সোনাদা আর দু জায়গায়। সামনে দুজন বুড়ো মানুষ। বুড়ো মানুষ বলাটা মনে হয় পলিটিক্যালি কারেক্ট হল না। যাকগে এ আমার হাবিজাবি, আমি তো সত্যিই গেঁয়ো আনপড়....। 
হ্যাঁ কি বলছিলাম যেন, সামনের দুই বুড়ো মানুষ, বকম বকম করছিল নেপালি ভাষায় ড্রাইভারের সাথে, বুঝছিলাম না কিছুই। হঠাৎ করে, আমায় বলে সুখিয়া যাবে? ট্রেক করতে বুঝি? ওই যে ওই পাহাড়টা সুখিয়া। বোঝো! আঙুলের তাক বরারবর পাঁচ ছয়খানা পাহাড়, কোনটা সুখিয়া?

ঘুমে নেমে জ্যাকেট গলাচ্ছি, দেখি একা দেখেই তাক করেছে, সুখিয়া? একশো দেবে? না দেবো না বলে, একটা প্রায় চলন্ত গাড়িতে ঝপ করে উঠে পড়েছি। এ রুটের গাড়ি, সুখিয়া নামিয়ে দেবে। আচ্ছা আমার কি খিদে পাচ্ছে একটু? একটা পকেটে খচমচ করছিল চকলেট, চেপ্টে গেছে, ঠান্ডা কিনা তাই গলে গিয়েও ফের র‍্যাপারের গায়ে জমে গেছে। এখানে আমায় কেউ চেনে না, আমিও কাউকে চিনিনা, আর এই গাড়িতে কালচার এর ধ্বজাধারী কেউ নেই, সব আমার মতোই অশিক্ষিত, আনকালচার্ড, লোকজন সুতরাং বেশ আরাম করে জিভ দিয়ে চেটে চেটে চকলেটের র‍্যাপার খানা খাওয়া গেল। খেতে খেতেই সুখিয়ার চেকপোস্ট এ দেখি সিট তুলে তুলে কী যেন সব দেখলো।

সুখিয়া থেকে ধোত্রের ডিরেক্ট যেতে গেলে রিম্বিকের গাড়িতে উঠতে হবে, দার্জিলিং থেকে আসে। খুবই কম কম আসে। অনেক্ষন দাঁড়িয়ে চা কেক টেক খেয়েও গাড়ি আসছেই না যখন ভাবছি একবার আলতো করে মানেভঞ্জন এর গাড়ি গুলোকে জিজ্ঞেস করবো ধোত্রে অব্দি কত নেবে বুক করলে, সেই সময়েই একজন বলল (তার আগে মেলা মাথা খেয়েছি লোকজনের গাড়ি কই গাড়ি কই বলে), ওই তো তোমার গাড়ি।

ও বাবা যেই না গাড়ি এসে থেমেছে দেখি পিল পিল করে চারজন লোক ছুটে এলো। দুজন স্থানীয়, দুজন ট্যুরিস্ট। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তারা সকলেই ফিট করে গেল আমি হাবার মত বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ড্রাইভারদাদাকেই বললাম গোঁয়ারের মত, আমাকেও নিতেই হবে, ইয়ার্কি নাকি, আমি সেই কক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে আছি! 
-তুমিও যাবে? আচ্ছা বসো সামনে। দেখছি, খেয়ে আসি কেমন?

সামনে আরো দুজন ছিল। আমি গিয়ারের একদিকে এক ঠ্যাঙ আরেকদিকে আরেক ঠ্যাং রেখে বসেছি। একটু ভয়েই, গীয়ার ফস করে ইয়েতে মেরে দেবে না তো? সুখিয়া হল বাজার এলাকা। মাঝের চারজন লোক গেছে বাজার করতে, ড্রাইভার গেছে খেতে। গাড়িতে বাকিরা ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে, শুধু বাঙালী ট্যুরিস্ট বাদে। খানিকবাদে ড্রাইভার এলো, বাজারুরা তখনো আসেনি। আরো খানিক বাদে, গাড়ি ম ম করা কেক বিস্কুটের গন্ধ নিয়ে বাকিরাও এল।

মানেভঞ্জন এর কাছে এসে আমায় নামিয়ে দিল। আমি অবাক! অ্যাঁ! যাব কী করে? কাঁউমাউ করে বললাম, এখান থেকে তো কিছুই পাবো না! সে হেসে হেসে বলল, "আরে বাবা এখানে এরা তিনজন সামনে এলাউ করে না, এগিয়ে এসো আছি আমি"। টুকটুক করে হেঁটে, গাড়ি, পারমিট চত্বর পার হওয়া গেল। এখান থেকেই সান্দাকফু ট্রেক শুরু করে বেশীরভাগ লোকে। গাড়ি, পারমিট, গাইড সব এখান থেকেই। মানেভঞ্জন নামটা কেমন অদ্ভুত না? কার মান এখানে ভঞ্জন করেছিল কে, কে জানে!

ধোত্রে আরো সতেরো কিলোমিটার। এ রাস্তায় গাড়ি বেশী চলে না। নিস্তব্ধ রাস্তায়, নেপালী গান আর বুড়ো বোলেরো চলতে লাগল। খানিক বাদে ফের থেমে গেল।
-উতরিয়ে।

আরে ফের কী হল? এবার গেছে গাড়ির ক্লাচের তার কেটে। গদি পেতে শুয়ে পড়ে সারানো হল। এখোনো দশ কিলোমিটার বাকি৷ ধোত্রে হল একটা পাহাড়ি গ্রাম। ছোট্ট, শান্ত। ইচ্ছেগাঁও বা সিলারির মত হাইপড না তাই এখনো ফাঁকাই। বেশীরভাগ ট্রেকাররাই এসে থাকে। খুব কম এমনি ট্যুরিস্ট। এখন বাজে দুটো। সুমিতদাই একজনের নাম্বার দিয়েছিল, তার বাড়িতেই আগে গেলাম, সে নেই, তার ছেলে বলল বাবা না এলে কিছু বলা যাবে না। সে তার বন্ধুকে দিয়ে পাঠালো শেরপা নিবাসে। মন্দ না কিন্তু কিরম কিরম যেন। আচ্ছা আজ সোজা টংলু চলে যাব? ওই ছেলেটা তো বলছিল ঘন্টা দেড়েক লাগবে। ওর ঘন্টা দেড়েক মানে আমার যদি আড়াইও লাগে...দুটো বাজে...সন্ধ্যে হয়ে যাবে....থাকগে। আমি তো কোথাও পৌঁছতে আসিনি। শেষ তক পদ্ম দিদির বাড়িতেই থানা গাড়লাম। একা বলে আর স্টুডেন্ট বলে (ওই আর কি, ঝাড়ি মারলে কিসে পড়ো শুনি যখন হোটেলে স্টুডেন্ট নয় কেন), খানিক ছাড় টার দিয়ে থাকতে খেতে দিল।

খেয়ে উঠে ফের বেরিয়ে পড়েছি। জঙ্গলের দিকটায় যেতে গিয়ে দেখি একটা ছোট পুকুর মত, পাশে একটা লোমওয়ালা গরু জাবর কাটছে। আজ বেশী হাঁটবোনা। কাল টংলু ছয়, ওখান থেকে টুম্লিং দুই ব্যাক করে টংলু ফের দুই, মানে দশ এগারো কিলোমিটার হাঁটা আছে। একটু উঁচুতে ভিউ পয়েন্ট। যদিও এখন কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু সকালে নাকি চমৎকার কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ স্নোক্যাপ মাউন্টেইন দেখা যায়। ভিউ পয়েন্টের কাছে আরো চারটে ছেলে ছিল। চারজনেই ফোনে ট্রাই করছে, একটু নেটওয়ার্ক পেয়েছে কিনা। গলা নিচু, একটু সাইড হয়ে কিংবা সামনে দাঁড়িয়েই, জোরে জোরে কথা বলা দেখেই ওপারের লোক কারা আছে বোঝা যায়। ফরেস্টের রশিদদা ছিল ওখানে। শিলিগুড়ির ছেলে। টংলুর রাস্তাটা জিজ্ঞেস করে নেমে এসেছি ওখান থেকে ফের। এত লোক ভাল্লাগেনা। এদিক সেদিক চলতে চলতে গ্রামটার মধ্যে ঢুকে গেছি। এক মহিলা রোদে উল বুনছে এক মনে, বাঁহাতে গরু, ছাগল, মুরগির ঘর। চাল বাছছে একজন। রোদ কমে আসছে ক্রমে। রাজন বলে একজনের সাথে আলাপ হল, রান্না করছিল, বীফ কারি। তার গোল্লা মত ছেলেটাকে নিয়ে তার বউ দাঁড়িয়েছিল। গোল্লাটা একবার আমার কোলে এসি এক হাতে আমার দাড়ি আরেক হাতে চশমা খামচেছে। রাজনের ক্ষেতিবাড়ি আছে, টুকটাক মূলো, আলু, বিট, গাজর ফলায়, আর গাইডের কাজ করে৷ 
-চায়ে পিলো ভাই থোড়া, কুছ নেহি তকলিফ হোগা।

সহজ জীবনে সহজ সুর থাকে। বেশী কিছু চাহিদা নেই, তাই সহজে পথের আলাপে বাড়ি ডেকে বসতে দেওয়া যায়। সত্যি বলতে আমাদের গ্রামেও আমি দেখেছি ছোটবেলায় বাড়িতে কেউ এলে আগে বসানো হত। জল মিষ্টি দেওয়া হত। ভিখারী এলেও দুপুরে খালি পেটে যেত না। অনাহুত কেউ ছিল না কোনোদিন। কবে থেকে সন্দেহের বিষ ছড়িয়ে গেল, কবে থেকে আমাদের দৃষ্টিসীমা ছোট হয়ে গেল, আমরা দরজাটুকু একটু ফাঁক করে জিনিস নিই খালি...দেওয়ার পালা ঘুচেছে কবেই। তাই মনে হয় পাবার জিনিস কিনেই মেলে। দাম হীন জিনিসের অধিকার আমরা হারিয়ে ফেলেছি কোন ফাঁকে।

ক্রমে অন্ধকার নেমে আসে। এক দুটো হোমস্টের আলো ক্রমে নিভে যায়। বাকি গ্রাম আগেই অন্ধকার। পদ্মদিদি আমাদের খাইয়ে নিজে খেতে যায়।এই ছাদটা বড় ভালো, পিছনেই স্নোক্যাপ মাউন্টেইন দেখতে পাবো কাল ভিউ ক্লিয়ার থাকলে। রাত বাড়তে হাওয়াও বেড়েছে বেশ। ঠান্ডা টাও। বেশী রাত অব্দি ছাদে থাকা যাবেনা। কিন্তু কী অপরূপ লাগছে। বিকেলে মেঘলা গ্রামটাকে যেমন বিষন্ন লাগছিল, এখন তেমনই মায়াবী লাগছে। আকাশে তারা ফুটেছে অনেক, হাওয়াটা থেমে গেছে। চাঁদের আলোয় জঙ্গল, গ্রাম সব যেন অবাক এক জনপদ হয়ে গেছে। এখানে যেন আর থাকা মানুষের সীমার বাইরে। এক্ষুনি জঙ্গল পাহাড় জেগে উঠবে। যারে মানুষ না থাকে তাই জন্যেই কী এত হাই উঠছে? জানি জানি এতটা জার্নি, রাতে ভালো না ঘুম হওয়ার কথাই বলবে....কিন্তু সত্যিটা কী তা কে জানে.....









(ক্রমশ..)

Monday, March 11, 2019

আলাপ

- আচ্ছা শুনুন। আপনিই আসবেন বলেছিলেন তো?

- আমায় কি মিথ্যেবাদী মনে হয়!

- উহ লংকার চপ মনে হয়।এত ঝাল কেন! 

- কি!??

- না না আপনাকে না।  এই যে নরেনের দোকান থেকে দুটাকার মুড়ি আর চপ কিনেছিলাম কিনা।

- ও আপনিই চপশিল্পের ব্র‍্যান্ড এম্বাসাডর!  ওই জন্যেই এরকম ড্রামের মত চেহারা! 

- দেখুন প্রথম দিনেই এরকম ড্রাম টাম বলে অপমান করাটা কি ভালো হচ্ছে?

- ও আচ্ছা পরের দিন অপমান করব বলছেন?

- আহ কি মুশকিল ভুঁড়ির কথা আসছেই বা কেন। প্রথম দিন ডেট এ গিয়ে এসব কথা বলা ঠিক না! 

- ডেট? দেখা করা মানেই কিছু ডেট না। তাছাড়া হামহাম করে এক ঠোঙা মুড়ি চপ খেতে খেতে হাজির হওয়া লোকের সাথে ডেটিং করতে চাইও না।

- আচ্ছা আচ্ছা আপনাকে কি আর অফার করতাম না। এই তো নিন না।

- আপনি কি পাগল! ফার্স্ট ডেটে এসে লংকার চপ মুড়ি অফার করছেন! নবান্নে তো আপনাকেই দরকার, বাইরে কেন?

- যাক আপনি স্বীকার করছেন এটা ডেটই?

- আপনি খুবই পাজি লোক মশাই। 

- সে অবশ্য অস্বীকার করা যায় না। আচ্ছা দুধ চা না লিকার? 

- মানে? এত কিপ্টে নাকি আপনি যে একটা কফিশপেও যাবেন না!!

- তা না তবে ইয়ে মনের ভুলে ঝগড়া করতে করতে আপনি দেখুন লংকার চপ আএ মুড়ি খাচ্ছেন আমার থেকে, এর সাথে কফি ভাল্লাগবে?

- অ্যাঁ! ও হ্যাঁ তাই তো! কিন্তু আপনি আমায় ঝগ্রুটে বললেন নাকি? 

- না না তাই কি বলি! আচ্ছা শুনুন আপনার মা লুচি বানাতে পারে তো?

- কেন!!

- না মানে,  যেদিন আপনার বাবাকে বিয়ের কথা বলতে যাব....

- কি!! আপনি আমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন!! আমার বাবাকে! আমার বাবা প্রথমত, আপনার মত চরিত্রহীন না,  আমার মা ছাড়া অন্য কারোর দিকে নজর নেই। দ্বিতীয়ত,  আমার বাবা স্ট্রেট, তৃতীয়ত  আপনি গে যদি আমার সাথে ডেটে এলেন কেন?

- ওরেবাবা। আরে না না,  বিয়ের কথা মানে আপনাকে বিয়ে করার কথাই বলতে যাব আপনার বাবাকে।

- মানে!! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! চপ মুড়ি খেয়েছি আর ভাঁড়ে চা খেয়েছি আপনার সাথে বলেই কী ভাবছেন আপনার প্রেমে পড়ে গেছি!

- আহা রাগ করো কেন। আজকেই তো বলতে যাবনা। কদিন আরেকটু ঘোরাঘুরি করে নিই।

- আরে তুমি আমায় তুমি বলছ কেন! অদ্ভুত তো।

- ইয়ে তুমিও তো তাই বললে। 

- ও হ্যাঁ।  উহ খুবই জ্বালাও হে তুমি! 

- আচ্ছা ওই জন্যেই আগে থেকে বলে দিচ্ছিলাম,  বলছি লুচি আমি সাদা ধপধপে ফুলকো খাই হ্যাঁ? 

- ওহ এলেন লাটসাহেব রে।

- না না লাটসাহেবরা এসব সুখাদ্য খায়না।  যাক যা বলছিলাম। সাথে বেগুন ভাজার ঝামেলায় যেও না বুঝলে, কারন আমি আবার বেগুনের বোঁটার দিকটা খাই খালি। 

-তুমি মেফিস্টোফিলিস! উরুক্কু বাঘ। গন্ডার। তুমি ভেবেই নিয়েছ আমার সাথে বিয়েটা ঠিক আর সমানে খাওয়ার কথা বলে চলেছ।

- আচ্ছা আচ্ছা ক্যাপ্টেগিরি পরে হবে। দেখো, বিয়ে কেন করে লোকে খাওয়ার জন্যেই কিনা? এই তোমার বাড়ি যাব কথা বলতে, তারপর আবার মা বাবার সাথে যাব, তোমার বাড়ি থেকে আসবে, আইবুড়ো ভাত,বিয়ে বৌভাত....উফফ

- পেটুক কোথাকার। ইয়ে শোনো তোমার মেনু ঠিক করা আছে?

- না না চলো  চলো ফিশফ্রাই খেতে খেতে ঠিক করি। আর বলছি শোনোনা, লুচি আমি একটু ভালো খাই হ্যাঁ, মানে স্রেফ চারটে লুচি ধরানো বাড়িতে আমি ভাইফোঁটা নিতেও যাইনা....মানে...

-উফফ...রাক্ষস কোথাকার, বলে দেবো এক ধামা লুচি করতে সেদিন। 

-ইয়ে তারমানে ফাইনাল? 

-- হ্যাঁ আমার যেমন কপাল...চলো এবার মেনুটা করেই ফেলি।