Tuesday, March 19, 2019

আবার পাহাড়

প্রেম বোঝা যায় বিরহে বলেছিলাম না? তা যেমন সত্যি, তেমনি জড়িয়ে মড়িয়ে থাকলে ভালোবাসা জন্মায় এও সত্যি। দূরে আছি পাহাড়ের থেকে কতদিন? প্রায় এক বছর হতে চলল মনে হয়। তাও কয়েকদিনের কাছাকাছি থাকাই তো ছিল কেবল, কিন্তু সত্যিকারের দূরে তো নেই আসলে। ভালোবাসা শিকড় মেলে, সেই শিকড়টা তো পাহাড়ে গিয়েই বসিইয়ে , ছড়াতে দিয়েছিলাম। তাই পাহাড় না দেখলে কষ্ট হয় কিন্তু এটাও জানা থাকে আছে তো....

পাহাড়ে বারবার আমি অসময়ে যাই। ইচ্ছে করে যাই এমন না আসলে অত গুছিয়ে নিজের সাথে ঘুরতে যেতে ভালো লাগেনা। ফলে, যে সময়ে রডোডেনড্রনের আগুন জ্বলে আমি পাহাড়ে থাকিনা, যে সময় পরিবেশ উপযুক্ত থাকে সক্কলে টিকিট কেটে ফেলে আমি এদিক সেদিক ঘুরঘুর করে ভাবি, একবার ঠিক সময়ে যাব। টুকটাক ঘোরাঘুরি করার ফলে জানি, শহরে চাঁদ ঠিক প্রকাশ পায়না। তাই দোল পূর্নিমা না পেলেও একদশী দ্বাদশীর চাঁদও আলো ছড়াতে ভালোই পারে যদি তুমি দেখার সুযোগ পাও।

সান্দাকফু যেতে অন্তত গোটা পাঁচেক দিন লাগেই। আমার মধ্যবিত্ত জীবন প্রেমে অত দিন দেয় কই! ফলে পাহাড়ে হাঁটবো এই ইচ্ছে টুকু পূরন করতে টংলু টুকুই ঘুরে আসি। সেবার টংলু যেতে গিয়েই ভার্সে চলে গেছিলাম, পেন্ডিং আছে অনেকদিনকার। ফের সুমিতদাকে জ্বালাতন, কোন রুট দিয়ে যাব কোনটা দিয়ে ফিরবো, কতক্ষন লাগবে মোটামুটি। একটা দিনই ছুটি খালি, সোমবার, মানে সোমবারেই বিকেলের মধ্যে শিলিগুড়ি নামতে হবে। মোটামুটি যা বোঝা গেল, টংলু থেকে মানেভঞ্জন তিন সাড়ে তিন ঘন্টায় নেমে আসা যায়। কিন্তু এ তো এক্সপার্ট ট্রেকারের মত, আমি তো সে অর্থে ট্রেকার নই। ধুস যা হবে দেখা যাবে....

সুতরাং দুদিন আগে টিকিট দেখতে বসে দেখা গেল.... কী আবার অফকোর্স ওয়েটিং। জেনারেলে যাওয়া যায়....বাসের টিকিট আছে কি? আরিব্বাস আছে তো। চলো ফের। অফিস থেকে ফেরার পথে মনে পড়ে, একটা রুকস্যাক তো কিনতে হত। পাওয়ার ব্যাংকও তো নেই। যাকগে যাক। এই ব্যাকপ্যাকেই হয়ে যাবে।

শিলিগুড়িতে নেমে চা বিস্কুট খেয়ে গাড়ি খুঁজছি। শেয়ারে যাব অবশ্যই। সুখিয়াপোখরির গাড়ি মেলে, তবে এইখানে সব দার্জিলিং এর গাড়ি। দার্জিলিং মোড় অব্দি না গিয়ে আর, এখান থেকেই ঘুম অব্দি চলে যাই, ফের না হয় ওখান থেকে সুখিয়ার গাড়ি ধরে নেব। শেয়ার গাড়ির মজা বা সাজা যাই বলো না কেন, বেশ হরেক কিসিমের লোক মেলে। আমার পাশে যে তিনটে ছেলে তাদের দুজন হল গিয়ে স্টুডেন্ট। শৌখিন। হুঁ হুঁ বাবা ফেলুদা আম্মো তো পড়েছি খানিক নাকি? হাতে ওয়ান প্লাস, আঙুরের প্লাস্টিক, শেয়ার করার আধিক্য, পাহাড় দেখেই খচাৎ খচাৎ ছবি...দার্জিলিং প্রথমবার, কলেজ পড়ুয়া শিওর। আর এক জন গায়ে সস্তার চকচকে কোট, হাতে উল্কি, রোঁয়া ওঠা ফুটপাথের ব্যাগ, বিরক্ত মুখ চোখ, ঢুলতে ঢুলতে সারা রাস্তা.....দার্জিলিং এ কোনো হোটেলে কিংবা দোকানে কাজ করে। নাহ আমি জিজ্ঞেস করিনি কিছুই, ও আমার ভাল্লাগেনা,কাউকে দেখা মাত্রই কোথায় থাকো, কী করো নিয়ে প্রশ্ন করা। কিন্তু বসে বসে আন্দাজ করতে দোষ নাই। বলতে পারো স্টিরিওটাইপ আন্দাজ, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেলে বলেই না স্টিরিওটাইপ আন্দাজ করা হয়ে থাকে!

পিছনের মহিলা পুজো দিতে চায়, একটা নারকেল তার দরকার। পাহাড়ের শেয়ারের গাড়ি বড়ই এডজাস্টেবল হয়। সামনে ড্রাইভার সহ চারজন বসে যায় দরকার পড়লে, যে কোনো গাড়িতে। সে অভিজ্ঞতা পড়ে বলছিখন। যার যেমন দরকার সেখানে দাঁড়াতে পারে। ফলে এনার নারকেলের জন্য বার চারেক হল্ট হল, বিভিন্ন দোকানে। কার্শিয়াং, সোনাদা আর দু জায়গায়। সামনে দুজন বুড়ো মানুষ। বুড়ো মানুষ বলাটা মনে হয় পলিটিক্যালি কারেক্ট হল না। যাকগে এ আমার হাবিজাবি, আমি তো সত্যিই গেঁয়ো আনপড়....। 
হ্যাঁ কি বলছিলাম যেন, সামনের দুই বুড়ো মানুষ, বকম বকম করছিল নেপালি ভাষায় ড্রাইভারের সাথে, বুঝছিলাম না কিছুই। হঠাৎ করে, আমায় বলে সুখিয়া যাবে? ট্রেক করতে বুঝি? ওই যে ওই পাহাড়টা সুখিয়া। বোঝো! আঙুলের তাক বরারবর পাঁচ ছয়খানা পাহাড়, কোনটা সুখিয়া?

ঘুমে নেমে জ্যাকেট গলাচ্ছি, দেখি একা দেখেই তাক করেছে, সুখিয়া? একশো দেবে? না দেবো না বলে, একটা প্রায় চলন্ত গাড়িতে ঝপ করে উঠে পড়েছি। এ রুটের গাড়ি, সুখিয়া নামিয়ে দেবে। আচ্ছা আমার কি খিদে পাচ্ছে একটু? একটা পকেটে খচমচ করছিল চকলেট, চেপ্টে গেছে, ঠান্ডা কিনা তাই গলে গিয়েও ফের র‍্যাপারের গায়ে জমে গেছে। এখানে আমায় কেউ চেনে না, আমিও কাউকে চিনিনা, আর এই গাড়িতে কালচার এর ধ্বজাধারী কেউ নেই, সব আমার মতোই অশিক্ষিত, আনকালচার্ড, লোকজন সুতরাং বেশ আরাম করে জিভ দিয়ে চেটে চেটে চকলেটের র‍্যাপার খানা খাওয়া গেল। খেতে খেতেই সুখিয়ার চেকপোস্ট এ দেখি সিট তুলে তুলে কী যেন সব দেখলো।

সুখিয়া থেকে ধোত্রের ডিরেক্ট যেতে গেলে রিম্বিকের গাড়িতে উঠতে হবে, দার্জিলিং থেকে আসে। খুবই কম কম আসে। অনেক্ষন দাঁড়িয়ে চা কেক টেক খেয়েও গাড়ি আসছেই না যখন ভাবছি একবার আলতো করে মানেভঞ্জন এর গাড়ি গুলোকে জিজ্ঞেস করবো ধোত্রে অব্দি কত নেবে বুক করলে, সেই সময়েই একজন বলল (তার আগে মেলা মাথা খেয়েছি লোকজনের গাড়ি কই গাড়ি কই বলে), ওই তো তোমার গাড়ি।

ও বাবা যেই না গাড়ি এসে থেমেছে দেখি পিল পিল করে চারজন লোক ছুটে এলো। দুজন স্থানীয়, দুজন ট্যুরিস্ট। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম তারা সকলেই ফিট করে গেল আমি হাবার মত বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ড্রাইভারদাদাকেই বললাম গোঁয়ারের মত, আমাকেও নিতেই হবে, ইয়ার্কি নাকি, আমি সেই কক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে আছি! 
-তুমিও যাবে? আচ্ছা বসো সামনে। দেখছি, খেয়ে আসি কেমন?

সামনে আরো দুজন ছিল। আমি গিয়ারের একদিকে এক ঠ্যাঙ আরেকদিকে আরেক ঠ্যাং রেখে বসেছি। একটু ভয়েই, গীয়ার ফস করে ইয়েতে মেরে দেবে না তো? সুখিয়া হল বাজার এলাকা। মাঝের চারজন লোক গেছে বাজার করতে, ড্রাইভার গেছে খেতে। গাড়িতে বাকিরা ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে, শুধু বাঙালী ট্যুরিস্ট বাদে। খানিকবাদে ড্রাইভার এলো, বাজারুরা তখনো আসেনি। আরো খানিক বাদে, গাড়ি ম ম করা কেক বিস্কুটের গন্ধ নিয়ে বাকিরাও এল।

মানেভঞ্জন এর কাছে এসে আমায় নামিয়ে দিল। আমি অবাক! অ্যাঁ! যাব কী করে? কাঁউমাউ করে বললাম, এখান থেকে তো কিছুই পাবো না! সে হেসে হেসে বলল, "আরে বাবা এখানে এরা তিনজন সামনে এলাউ করে না, এগিয়ে এসো আছি আমি"। টুকটুক করে হেঁটে, গাড়ি, পারমিট চত্বর পার হওয়া গেল। এখান থেকেই সান্দাকফু ট্রেক শুরু করে বেশীরভাগ লোকে। গাড়ি, পারমিট, গাইড সব এখান থেকেই। মানেভঞ্জন নামটা কেমন অদ্ভুত না? কার মান এখানে ভঞ্জন করেছিল কে, কে জানে!

ধোত্রে আরো সতেরো কিলোমিটার। এ রাস্তায় গাড়ি বেশী চলে না। নিস্তব্ধ রাস্তায়, নেপালী গান আর বুড়ো বোলেরো চলতে লাগল। খানিক বাদে ফের থেমে গেল।
-উতরিয়ে।

আরে ফের কী হল? এবার গেছে গাড়ির ক্লাচের তার কেটে। গদি পেতে শুয়ে পড়ে সারানো হল। এখোনো দশ কিলোমিটার বাকি৷ ধোত্রে হল একটা পাহাড়ি গ্রাম। ছোট্ট, শান্ত। ইচ্ছেগাঁও বা সিলারির মত হাইপড না তাই এখনো ফাঁকাই। বেশীরভাগ ট্রেকাররাই এসে থাকে। খুব কম এমনি ট্যুরিস্ট। এখন বাজে দুটো। সুমিতদাই একজনের নাম্বার দিয়েছিল, তার বাড়িতেই আগে গেলাম, সে নেই, তার ছেলে বলল বাবা না এলে কিছু বলা যাবে না। সে তার বন্ধুকে দিয়ে পাঠালো শেরপা নিবাসে। মন্দ না কিন্তু কিরম কিরম যেন। আচ্ছা আজ সোজা টংলু চলে যাব? ওই ছেলেটা তো বলছিল ঘন্টা দেড়েক লাগবে। ওর ঘন্টা দেড়েক মানে আমার যদি আড়াইও লাগে...দুটো বাজে...সন্ধ্যে হয়ে যাবে....থাকগে। আমি তো কোথাও পৌঁছতে আসিনি। শেষ তক পদ্ম দিদির বাড়িতেই থানা গাড়লাম। একা বলে আর স্টুডেন্ট বলে (ওই আর কি, ঝাড়ি মারলে কিসে পড়ো শুনি যখন হোটেলে স্টুডেন্ট নয় কেন), খানিক ছাড় টার দিয়ে থাকতে খেতে দিল।

খেয়ে উঠে ফের বেরিয়ে পড়েছি। জঙ্গলের দিকটায় যেতে গিয়ে দেখি একটা ছোট পুকুর মত, পাশে একটা লোমওয়ালা গরু জাবর কাটছে। আজ বেশী হাঁটবোনা। কাল টংলু ছয়, ওখান থেকে টুম্লিং দুই ব্যাক করে টংলু ফের দুই, মানে দশ এগারো কিলোমিটার হাঁটা আছে। একটু উঁচুতে ভিউ পয়েন্ট। যদিও এখন কিছুই দেখা যায় না, কিন্তু সকালে নাকি চমৎকার কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ স্নোক্যাপ মাউন্টেইন দেখা যায়। ভিউ পয়েন্টের কাছে আরো চারটে ছেলে ছিল। চারজনেই ফোনে ট্রাই করছে, একটু নেটওয়ার্ক পেয়েছে কিনা। গলা নিচু, একটু সাইড হয়ে কিংবা সামনে দাঁড়িয়েই, জোরে জোরে কথা বলা দেখেই ওপারের লোক কারা আছে বোঝা যায়। ফরেস্টের রশিদদা ছিল ওখানে। শিলিগুড়ির ছেলে। টংলুর রাস্তাটা জিজ্ঞেস করে নেমে এসেছি ওখান থেকে ফের। এত লোক ভাল্লাগেনা। এদিক সেদিক চলতে চলতে গ্রামটার মধ্যে ঢুকে গেছি। এক মহিলা রোদে উল বুনছে এক মনে, বাঁহাতে গরু, ছাগল, মুরগির ঘর। চাল বাছছে একজন। রোদ কমে আসছে ক্রমে। রাজন বলে একজনের সাথে আলাপ হল, রান্না করছিল, বীফ কারি। তার গোল্লা মত ছেলেটাকে নিয়ে তার বউ দাঁড়িয়েছিল। গোল্লাটা একবার আমার কোলে এসি এক হাতে আমার দাড়ি আরেক হাতে চশমা খামচেছে। রাজনের ক্ষেতিবাড়ি আছে, টুকটাক মূলো, আলু, বিট, গাজর ফলায়, আর গাইডের কাজ করে৷ 
-চায়ে পিলো ভাই থোড়া, কুছ নেহি তকলিফ হোগা।

সহজ জীবনে সহজ সুর থাকে। বেশী কিছু চাহিদা নেই, তাই সহজে পথের আলাপে বাড়ি ডেকে বসতে দেওয়া যায়। সত্যি বলতে আমাদের গ্রামেও আমি দেখেছি ছোটবেলায় বাড়িতে কেউ এলে আগে বসানো হত। জল মিষ্টি দেওয়া হত। ভিখারী এলেও দুপুরে খালি পেটে যেত না। অনাহুত কেউ ছিল না কোনোদিন। কবে থেকে সন্দেহের বিষ ছড়িয়ে গেল, কবে থেকে আমাদের দৃষ্টিসীমা ছোট হয়ে গেল, আমরা দরজাটুকু একটু ফাঁক করে জিনিস নিই খালি...দেওয়ার পালা ঘুচেছে কবেই। তাই মনে হয় পাবার জিনিস কিনেই মেলে। দাম হীন জিনিসের অধিকার আমরা হারিয়ে ফেলেছি কোন ফাঁকে।

ক্রমে অন্ধকার নেমে আসে। এক দুটো হোমস্টের আলো ক্রমে নিভে যায়। বাকি গ্রাম আগেই অন্ধকার। পদ্মদিদি আমাদের খাইয়ে নিজে খেতে যায়।এই ছাদটা বড় ভালো, পিছনেই স্নোক্যাপ মাউন্টেইন দেখতে পাবো কাল ভিউ ক্লিয়ার থাকলে। রাত বাড়তে হাওয়াও বেড়েছে বেশ। ঠান্ডা টাও। বেশী রাত অব্দি ছাদে থাকা যাবেনা। কিন্তু কী অপরূপ লাগছে। বিকেলে মেঘলা গ্রামটাকে যেমন বিষন্ন লাগছিল, এখন তেমনই মায়াবী লাগছে। আকাশে তারা ফুটেছে অনেক, হাওয়াটা থেমে গেছে। চাঁদের আলোয় জঙ্গল, গ্রাম সব যেন অবাক এক জনপদ হয়ে গেছে। এখানে যেন আর থাকা মানুষের সীমার বাইরে। এক্ষুনি জঙ্গল পাহাড় জেগে উঠবে। যারে মানুষ না থাকে তাই জন্যেই কী এত হাই উঠছে? জানি জানি এতটা জার্নি, রাতে ভালো না ঘুম হওয়ার কথাই বলবে....কিন্তু সত্যিটা কী তা কে জানে.....









(ক্রমশ..)

4 comments:

  1. মন ভালো করে দেওয়া লেখা,দারুন.

    ReplyDelete
  2. বাঃ, জায়গাগুলোর নামের মতোই সুন্দর লেখা। তোমার পর্বগুলো গাইড করে ঘুরে আসার ইচ্ছে রইল, প্রদীপ্ত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ ^_^ কুন্তলাদি । চলে যেও একবার, বড় ভালো জায়গা।

      Delete