Tuesday, March 26, 2019

আবার পাহাড় (শেষ)

আলো ফুটতেও আকাশ পরিষ্কার হল না। তখনো সূর্য ওঠেনি, ওঠার আগের আকাশ। কিচিরমিচির পাখির ডাক নিয়ে রাস্তাটা ধরে হাঁটছি, ওদিকে খাদের উপর মেঘের সমুদ্র। সমুদ্রের মাথার উপর লাল সূর্য টা হেসে উঠতেই সকাল হয়ে গেল।



চা নুডলস খেতে ঝোলা গুটিয়ে জিসিংভাইকে থাকার কড়ি দিতে গেলাম। সে তো দেখি হিসেবে কেসিনাগের ভাই। যা হিসেব দিলো, তাতে করে আমার থাকা ফ্রি, খাবার খালি পয়সা ধরেছে! বললাম তাকে, হ্যাঁ হ্যাঁ ভারী ভুল হয়ে গেছে তো। এবার সে হিসেব করে চারজনের ভাড়া করে ফেললো। বললাম, কত্তা থামো, এরপর তো কেসিবাবু বাঁশে ছেড়ে দেবেন। যাই হোক হিসেব মিটিয়ে, ফিরতি রাস্তা ধরলাম। নামার রাস্তা এতোই প্রলোভনের হয়, ইচ্ছে করে ছুট লাগাই....গড়গড় করে নেমে যাব! কিন্তু লোভে পাপ পাপে গড়িয়ে পড়া। তাই ব্যালেন্স করে করে,নামতে হয়। মেঘমাতে আর্মির ক্যাম্প আর বৌদ্ধ মনস্ট্রি রাস্তার দুই পারে রয়েছে। বেশ চমৎকার সহাবস্থান বটে।ঘন্টার আওয়াজ পেলাম মনষ্ট্রি থেকে, শান্ত সকালে যেন ওটাও একটা অংশ, আলাদা না। আর্মির লোকেরা রাস্তা দেখিয়ে দিল আমায়, এখানে একটা রাস্তা নীচে বনে চলে যায়,পথ হারাবার চান্স থাকে।






মেঘমা থেকে চিত্রে অব্দি আবার খানিক গাছপালা আছে। লোকজনের সাথে দেখা হয় রাস্তায়, মানেভঞ্জন থেকে আসছে সব।নানানরকম দল, অল্পবয়সী, মাঝবয়সী...রাস্তায় একটা কুকুরের সাথে আলাপ হল। আলাপ সামান্যই অবশ্য, কারন তিনি আমায় রাস্তা দেখাতেই ব্যস্ত ছিলেন, কথাবার্তায় বিশেষ উৎসাহী না। ছবি তোলাতেওনা। একবার একবার দাঁড়িয়ে পথচলতি কারোর সাথে কথা হচ্ছে, কিংবা ছবি তোলার চেষ্টা করছি হয়ত, উনিও দাঁড়িয়ে পড়ছেন, একটা ফুল কি পোকা তাড়া করছেন। তারপর যেই না বলছি, "কিরে আর যাবি? অনেকটা রাস্তা এলি তো, যা এবার ফিরে যা। টাটা। "
অমনি বকে ধমকে একাকার। "আমি যাবনা বলেছি কি? তুমিইই তো দাঁড়িয়ে পড়ে ছবি তুলছ, বকবক করছ! কী যে স্বভাব মানুষের কে জানে বাবা! এসব বদভ্যাস আমাদের নেই। চলো চলো। " বলে পাঁইপাঁই দৌড়চ্ছে, ফের আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
- দাঁড়া রে ব্যাটা তোর একটা ছবি তুলি? 
-আহ কেন বাপু বেশ তো কান চুল্কাচ্ছি আরাম করে, ছবি দিয়ে কী হবে!এই করতে করতে আমার সাথে তিনি চিত্রে অব্দিই এলেন। তারপর কোনো রকম মন খারাপ, পিছুটান ছাড়া চলেও গেলেন। 
ধর্মরাজ কি ডাউনহিল এলেন?


চিত্রে থেকে পাইন বনের রাস্তায় নামছি টুকটুক করে। ইচ্ছে করেই আস্তে আস্তে নামছি। আর তো একটু পরেই তো আর এই পাহাড়, গাছ, নির্জনতা সব ফুরিয়ে যাবে। একটা রাস্তায়, গাছের ছায়ায় আধশোয়া হয়ে ভাবছি না এত পাখি দেখলাম, তুলতে আর পারলাম না। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ....ঝিরঝিরে পাইন বনের হাওয়ায় ঘুম এসে যায়। এমন সময় একটা পাখি পোজ দিয়ে বলল, ছবি তুলবে? আচ্ছা এই নাও তোলো। তারপর সে কতক্ষন ধরে আমার মডেল হল, তার ঠিক নেই। খচাৎ খচাৎ তুলে তাকে থ্যাংকইউ বলতেই সে আমায় ভালো থেকো হে বলে পালালো। 


শেষ বাঁকটা নামছি যখন পাইন গাছেদের উদ্দেশ্য করে বললাম, "এবার সেভাবে কথা হয়নি তেমন, নিজের মনে বকেছি, এখন বলি?যদিও জানো তোমরা,ইয়ে মানে শ্রদ্ধা টদ্ধা ওজনদার কথা, তা বাদ দাও, আমি তোমাদের ভালোবাসি। সত্যিইই। ভালো থেকো কেমন? আর ইয়ে থ্যাংকু। " 
বাকি আরো কথা হল বটে, তবে সে সব পার্সোনাল। আমি জানি ওরা বুঝেছে, হাওয়াটা বদলে গেল দেখলে না? আর থ্যাংকুটাও নিয়েছে, ওটা যে আমি ফর্মালিটি করিনি সে বেশ বুঝেছে। গাছেদের এই ব্যাপারটা অবাক লাগে না আর, আমি জানি ওদের টেলিপ্যাথি তীব্র, সব জায়গার গাছেদের কানেকশন ওদের আছে। মানে ধরো আমি কোলকাতায় একটা গাছের গায়ে পানের পিক ফেললাম পাহাড়ের গাছ জানবে, ওরা তোমায় উপেক্ষা করবে। আর যদি ওদের কাছে একবার পৌঁছে যেতে পারো, জীবনটা বদলে যাবে। না না গাড়ি বাড়ি যশ কিছুই হবে না, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। গাঁজা ভাঙ না খেয়েই ফুরফুরে মন হয়ে যাবে।





ফেরার সময় ট্রেনে ওয়েটিং লিস্ট দুই...অগত্যা বাসেই। শিলিগুড়ির বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়ালে হরেক মানুষ দেখা যায়। চানা মটর কচুরি ভাত ডাল খাওয়া প্যাসেঞ্জার, দালাল, মজুর, গোমড়া টিকিট কাউন্টারের লোক, টাকা হারিয়ে গেছে বলে সাহায্য চাওয়া মিথ্যুক ...অপেক্ষা কোলাজ হয়ে যায়।আজ ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখছি, দুধারের মাঠ, গাছ, বাড়ি ঘর সব চাঁদের আলোয় অন্য ডাইমেনশনের হয়ে গেছে যেন....চাঁদের আলোই ওই জগতে যাবার রাস্তা....প্যারালাল ওয়ার্ল্ড।সেই চাঁদের আলো, একবুক তেষ্টা নিয়ে খাল, মাঠ, ঘরবাড়ি বুকে পুরে নিচ্ছে,আগামী এক পক্ষকালের অন্ধকার সইবার জন্যে....যেমন করে এই মহারাজও রোজকার দৈন্য সইবার জন্য শক্তিটা বুকের মধ্যে পুরে নিয়ে এসেছে....





2 comments:

  1. কী ভালো ছবি, আর তেমনি ভালো লেখা। তোমার ছবির চেহারা এখন রক্তমাংসের চেহারাটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছি বলে ভালো লাগছে বেশি, প্রদীপ্ত। আর তোমার চারপেয়ে গাইডের দারুণ একখানা মুহূর্ত ক্যাপচার করেছ কিন্তু, জিভ বার করে ঠ্যাং তুলে একেবারে আরামের হদ্দমুদ্দ। আমার, আমাদের খুউউউউউব যাওয়ার ইচ্ছে ওই দিকটায়। যাওয়ার আগে তোমার থেকে টিপস নেব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংকু থ্যাংকু কুন্তলাদি। হ্যাঁ আরামের একশেষ একেবারে, জীবন হো তো অ্যাইসা!
      আমারও তোমার সাথে আলাপ করে ভারী আনন্দ হয়েছে।
      অবশ্যই জানিও ওদিকে গেলে, আমি বলে দেবো যা জানি, যদি কিছু সুবিধে হয় তাতে ^_^

      Delete