Sunday, September 30, 2018

হারিয়ে গিয়ে...

 সেদিন আনমনে হাঁটছিলাম। কলেজ স্ট্রীট যাবো বলে বেরিয়েছি, সীতারাম ঘোষ লেন থেকে ঢোকার পর  কোনদিকে যাচ্ছি খেয়াল না করেই হাঁটছিলাম। রাস্তাগুলো এখানে পরে সারানো হয়েছে, উঁচু হয়েছে আর বাড়িগুলো নীচু হয়ে গেছে। আচ্ছা এইরকম ঝুপসি জানলার একতলার ঘরগুলোয় কারা থাকে? আলো ঢোকে? আরিব্বাস কি চমৎকার একটা বারান্দা, এহে ভেঙে পড়বো পড়বো হয়ে গেছে তো। কেউ সারায় না মনে হয়। 

দুপুর খুব এখন। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ্দুর। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়, একটা দুটো ছোট ট্রাক যাচ্ছিলো জিনিসপত্র নিয়ে,  তাদেরও আর দেখা যাচ্ছে না কই। 
এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, এ গলিটা আমি চিনিনা। মানে চিনি হয়তো কিন্তু অচেনা লাগছে খুব। এই রাস্তার ধারে এতো ফাঁক ফাঁকা জায়গা ছিলো বুঝি? বাড়ি গুলোও অতটা পুরোনো না। একটা কাক ডাকছিলো কাছে কোথায়, জল তেষ্টা পেয়েছিল হয়তো, কই সেটাকেও তো আর দেখতে পাচ্ছিনা। একটা নেড়ি কুকুরও নেই কোত্থাও। কোথায় যেন কাঁসি ঘন্টার আওয়াজ। আমার ভারী জল তেষ্টা পেয়েছে। রাস্তায় এর ওর কাছে দরজা ধাক্কিয়ে জল আজ থেকে পনেরো বছর আগে খেতাম ঠিকই, তবে এরকম এখন আর করি না। হঠাৎ করে হোঁচট খেয়েছি জোর। হাঁটুর কাছটা গেলো মনে হয়।

"ওই তো,  ওই তো ছোটকত্তা ফিরেছে।" 

একটা বাড়িতে পুরোনো দিনের পোশাক পরা কিছু লোক। আমি কাউকে চিনতে পারছি না এদের, একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি, অবশ্য এরাও আমায় নিয়ে ব্যস্ত না তেমন, একটা ছোট ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। ওই লোকটা মনে হয় ওর বাবা, গম্ভীর মুখ খুব। আর ওই পিরান পরা বয়স্ক কিন্তু শক্ত চেহারার লোকটা মনে হয় ওর ঠাকুর্দা। ওই খেঁটো ধুতি পরা লোকটা... উমম চাকর মনে হয়। আরো সব লোকজন। আরে পুজোর মন্ডপ দেখছি। দুর্গা পুজো এসময়? এখন তো বৈশাখ মাস! এরা এতো পুরোনো দিনের জামা পরে, ওই দিকে কিছু মহিলা দাঁড়িয়ে, এক মাথা ঘোমটা টানা। কিরকম গোলমাল লাগছে। সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে নাকি? 

"যাও গিয়ে কাপড়চোপড় বদলে নাও। এক্ষুনি খ্যামের পুজো শুরু হলো বলে। মা এর জন্যেই আজ কোনো বিপদ আপদ ঘটেনি। যাও। " 

বাপরে কি দাপট। এরা কারা? এদের বাড়িতে এরকম ঢুকে  গেছি চোর টোর ভেবে না মারধর করে! কিন্তু পুজো কেন এসময়? শ্যুটিংই হবে, কিন্তু ক্যামেরা ট্যামেরা কিছু নেই কেন? কিছু বুঝতে পারছিনা। এহে হাঁটুটা কেটে গেছে অনেকখানি! একটু তুলো পেলে ভালো হতো। ভালো ব্যাথা করছে তো হাঁটতে গেলে। একটু বসে যাই এই সিঁড়ির কোনায় একটু। 

"তুমি কে?"

রিনরিনে গলায় কেউ জিজ্ঞেস করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা। আমি তড়িঘড়ি বলতে গেলাম,  'আমি চলে যাচ্ছি, তোমাদের শ্যুটিং এ ঢুকে পড়েছিলাম মনে হয়, আমি দুঃখিত, আসলে পা টা একটু কেটে গেছে কিনা।'

ছেলেটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো দেখি। এর পরনেও ধুতি। পুরোনোদিনের কোনো গল্পের শ্যুট হচ্ছে মনে হয়। 

"আমি তোমার কথা ভালো বুঝতে পারছিনা, তুমি বরং এসো আমার সাথে। এদিক দিয়ে এসো, নাহলে কেউ দেখে ফেললে মুশকিল হবে"। 

কী মুশকিল, কেন মুশকিল কিছু বুঝলাম না। কোনো বিপজ্জনক কিছু চলছে নাকি? কিন্তু এই ভরদুপুর বেলা,  কোলকাতা শহরে, কলেজ স্ট্রীট চত্বরে আমায় কেউ বিপদে ফেলবেই বা কেন! বাচ্ছাও না, বড়লোকও না। পুরোনো একটা টিশার্ট আর জিন্স,  ওয়ালেটে একশোটা টাকা কিডন্যাপ করতে চাইলেও করবে না কেউ কারন ঘেমে নেয়ে গা থেকে যা খুশবাই ছাড়ছে আমিই চমকে চমকে উঠছি। যাক এতো ভেবে কি করবো আর যাই বরং এর সাথে। 

ছেলেটার পিছন পিছন তিনতলায় এলাম। উত্তর কোলকাতার পুরোনো বাড়ির খড়খড়ি লাগানো জানলা দরজা। এরকম জানলা আমার ভারী ভাল্লাগে।

" তুমি কে? এটা কিরকম পোষাক? তোমার হাতে এইটা কি?"

কিরকম পোষাক মানে? ছেলেটা কি অপ্রকৃতিস্থ?  গোলমাল লাগছে। নিকুচি করেছে হাঁটুর ব্যাথার। বেরোই এখান থেকে। মোবাইলটা চেক করতে গিয়ে দেখলাম সুইচড অফ হয়ে আছে, অন হচ্ছে না।পড়ে গেছিলাম যখন তখনই গেছে মনে হয়।

"আরে তোমার পা অনেকটা কেটে গেছে দেখছি, দাঁড়াও আমি ছাদ থেকে গাঁদা পাতা নিয়ে আসছি। 

গাঁদা পাতা!! এ কে! মানে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?  ডেকে বললাম, 'এই শোনো, তোমার কাছে ডেটল জাতীয় কিছু নেই?'

" ডেটল কি?"

বারো তেরো বছরের ছেলে ডেটল জানে না! না আগে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার। ওদিকে সে গাঁদা পাতা আনতে গেছে।  তিনতলার একদিকটা ছাদ।  আমি ছাদে গিয়ে পুরো ঘেঁটে গেলাম। আশপাশটা যা দেখছি আর যাই হোক ২০১৮ সালের কোলকাতা শহর না। কিরকম একটা সন্দেহ হলো।

'এই এদিকে এসো জলদি, আজ কত তারিখ? '

কথাবার্তায় যা বুঝলাম আমার তো আক্কেল গুড়ুম!   বৈশাখের ঝাঁঝালো রোদ, পরিশ্রান্ত, হোঁচট ঠিক কিসে কী হয়েছে আমি জানিনা, কিন্তু আমি সম্ভবত কোনো ওয়ার্ম হোলে পড়ে গেছিলাম। আমি  ২০১৮ সালের বদলে ১৯৩৩ সালের শরৎকালে পৌঁছে গেছি! এদের কাউকে আমি চিনি না, এরা আমার কোনো রিলেটিভ না কিন্তু প্রকৃতির কোন রহস্যে আমি আর আমার চেনা জগতে নেই! ভয় পেলাম, ফিরবো কি করে? আমি যদি এক হাজার বার ওই কাজ গুলো ফের করিও আবার আমার জায়গায় ফিরতেও পারি নাও পারি। না ফেরার সম্ভাবনাই বেশী কারন ওয়ার্ম হোলের মুখটা বন্ধ হয়ে গেছে এতোক্ষনে।

দরদর করে ঘামছিলাম, আমার মুখ চোখ দেখে বুঝি ছেলেটা কিছু আন্দাজ করেছিলো। এর মধ্যে সে আমায় যত্ন করে গাঁদা পাতা এনে লাগিয়ে দিয়েছে। ছেলেটার মুখটা ভারী মায়াবী, চোখ দুটো কেমন যেন এইখানে নেই অন্য কোথাও। ক্রমে আলাপ জমে গেলো। ভালো নাম বলল,  দুলাল, এমনিতে খোকা, ছোটকত্তা এইসব বলেই ডাকে। একমাত্র ছেলে না হলেও, এ বাড়ির ছোট ছেলে বলে কথা।  তবে ওর নাকি এসব ভালো লাগেনা। এইটুকু বয়স কিন্তু বেশ ঝরঝরে পরিনত কথাবার্তা।  বন্ধু বান্ধব নেই বিশেষ। এক তো বড়লোক বাড়ির ছেলে, পড়ে গেলে কেউ তুলে ধরে অবস্থা,  তায় ও নিজেও একটু অন্তর্মুখী। পড়াশোনা করে নানান জিনিস নিয়ে, গাছেদের সাথে ভালো রকম আলাপ আছে। আর একটা জিনিস পারে বলল। খুব ফিসফিস করে, পাছে কেউ শুনে ফেলে এমন ভাবে। 

"আমি না বাঁশীতে সুর তুলতে পারি।" 

'আরে বাহ এতো দারুন ব্যাপার। কিন্তু কত্তা এ জিনিস লুকোনোর কি? এতো খুব ভালো ব্যাপার। ' 

আমার মনের আশংকা অস্থিরতা সরিয়ে রেখেই বললাম। চিন্তা করে তো কিছু করতে পারবো না।  বরং যে পরিস্থিতিতে এসে পড়েছি সেটাই জানা যাক! এক নিমেষে আমার জগত বদলে যাবার আগে অব্দি তো জানতাম না, কত কি প্ল্যান করে রেখেছিলাম, প্যারামাউন্টে সরবত খেয়ে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরবো আজ জলদি। মা কী যেন বানাচ্ছে বলছিলো....

"তুমি জানোনা,  আমাদের তো সবাই ব্যবসা করে। আমাদের তাই শিখতে হয়, আমি তো ব্যবসা করতে  চাইনা নতুনদাদা, আমি বাঁশী বাজাতে চাই। আমি অনেক দূরে একটা নদীর ধারে বাঁশী বাজিয়ে মেঘ নামাতে চাই, পাহাড়ে উঠে গান গেয়ে গাছেদের শোনাতে চাই, জাহাজে চড়ে নাম না জানা দেশে যেতে চাই। এরা আমায় খুব ভালোবাসে আমি জানি কিন্তু আমি যে এখানে থাকতে পারবোনা। আমাকে যেতেই হবে জানো, আমি স্বপ্ন দেখি নৌকায় শুয়ে শুয়ে আমি ভেসে চলেছি, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আমি চলে যাই তাই মাঝে মাঝেই। ধরা পড়ে যাই। আরেকটু বড় হলে আমি আর ধরা পড়বো না দেখো। " 

আমি আমার কথা বললাম। আমারও ভালো লাগত না বাড়িতে থাকতে। কিন্তু যেই টের পেয়েছি আর হয়তো কোনোদিন মাকে দেখতে পাবো না, নিজের বই গুলোয় হাত দিতে পারবোনা, বাবার বকুনি খাবো না...আমার মন কেমন করছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার লজ্জা লাগছিলোনা ওইটুকু ছেলের কাছে এরকম অকপট স্বীকারে। যেন আমি জানি, ও তামাশা করবে না। কিন্তু এখানে তো থাকা হবে না আমার। বললাম সে কথা। সে ছেলে তৎক্ষনাৎ বলল, আমিও যাবো তোমার সাথে চলো।  

আরে না, ধরা পড়লে কী হবে? তাছাড়া আমি কি করবো কোথায় যাবো কিছুই জানিনা। এ সময়টা আমি চিনিনা। এরকম ভাবে হয়নাকি? সেও শুনবে না, তার বক্তব্য আমি তো যেতামই যাবোই। তোমার সাথে নাও না। আমার তো বন্ধু নেই কেউ। পিছনের খিড়কি দরজা দিয়ে চলে যাবো, এখন অষ্টমীর আরতি হবে সবাই ব্যস্ত। কেউ টের পাবে না। চলো না।

তারপর? তারপর সত্যি সত্যি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শহরের কোলাহল ফেলে দুজন অসমবয়সী বন্ধু, অচেনা জগতে চলল। হাওড়া স্টেশন একেবারেই অন্যরকম। একটা ট্রেনে চড়ে বসেছি দুজন। ওদের বাড়ি থেকে আসার সময়েই আমার পোশাক বদলে নিয়েছি,  তাই কেউ তাকাচ্ছেনা তেমন। দু ভাই যেন বেরিয়েছে। সকালে তখন একটু একটু আলো ফুটছে, আমরা একটা স্টেশনে নেমে পড়েছি। লোকজন খুব কম বলে মনে হচ্ছে আমার। না বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম।  দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আমরা এমনি হাঁটা শুরু করেছি। খিদে পেয়েছে। কিন্তু আমি বা দুলাল কেউইই কিছু করতে পারিনা। বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর আর যখন পারছি না, একটা গ্রামে এক বাড়িতে একটু জল চাইলাম। বেলা প্রায় দশটা হবে, মুখ দেখে কিছু মনে হলো কিনা কে জানে! প্রশ্ন করল এক গাদা, আমরাও বানিয়ে বানিয়ে, আত্মীয়রা বাবা মা মারা যাবার পর তাড়িয়ে দিয়েছে ইত্যাদি গল্প বলে দিলাম। জল এর সাথে একটু মুড়ি আর বাতাসা পাওয়া গেলো। গপগপ করে খেয়ে ফের পা চালালাম।

অনেক অনেকটা হাঁটার পর একটা নদী দেখে তার পাশে পৌঁছে দুজনেই থেবড়ে বসে পড়েছি। খানিক জিরিয়ে নিচ্ছি চোখ বুজে। অনেক্ষন বিশ্রাম নেবার পর, দুলাল বাঁশী বের করে ফুঁ দিলো। আহা বড় ভালো বাজায় ছেলেটা এ বয়সেই। মন থেকে ক্লান্তি মুছে যায়, খিদে ভুলে যাওয়া যায়।

সত্যি তো ভোলা যায় না। খিদে পেয়েছে যখন বেশ খানিক, দেখি ক্যাপ্টেন চলো যাওয়া যাক,  কিছু খাবারের জোগাড় তো করতে হবে নাকি? পয়সা এখনো কিছু আছে, দুলালেরই টাকা, নিয়ে এসেছিল, টিকিট কেটেও ছিলো কিছু। কিন্তু এই জনহীন মাঠে দোকানই বা কোথায় খাবারই বা কোথায়! 


গ্রামের দিকে শরৎকালের রাতে হিম পড়া শুরু হয়ে যায়। ছোট ছেলেটাকে হিমে ভিজতে দেওয়া যায়না। অন্ধকার নামার আগেই লোকালয়ে পৌঁছতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে একটা গ্রামে পৌঁছনো গেলো। একজনের মুখেই জানা গেলো, নবমীর রাতে যাত্রা বসেছে বারোয়ারি তলায়। সবাই সেখানেই চলেছে। একটু জল পাওয়া যাবে কোথাও? খাবার তো চাইতে পারিনা দুজনের কেউই। যে লোকটা যাত্রার খবর দিচ্ছিল,  সেইই বলল পুজোর মন্ডপে গেলেই জল মিলবে, তবে তার আগে যে কোনো বাড়িতে চাইলেই হবে, ওর বাড়ি এখানে নয়, গ্রামের অন্যদিকে। 

পা চালিয়ে পৌঁঁছনো গেলো। সন্ধ্যারতির প্রসাদ দিচ্ছিলো, মুড়কি, বাতাসা আর নাড়ু। পেটে খানিক শান্তি হতে দুজনে যাত্রার আসরের দিকে চললাম। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে, আমাদের দুজনের কারোরই এতো পরিশ্রম করার অভ্যেস নেই। যাত্রা শুরু হতে বিস্তর দেরী। ঘুম তাড়াতে দুলাল বাঁশীতে ফুঁ দিলো, টুকটাক সুর তুলছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে একজন আমাদের সামনে এলো।

  - এই ছোঁড়া তুই বাঁশী বাজাস?

দুলাল ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম কেন বলুন তো? 

  - আপনি কে? 
  - ওর দাদা। 
  - আপনাদের তো এ তল্লাটে দেখেছি বলে মনে হয়না। 
  - না আমরা এ গ্রামের না।
  - অ। শুনুন মশাই। আপনার ভাইটিকে দেখতে বেশ, বাঁশিও বাজাতে পারে টুকটাক দেখছি। যাত্রাদলে দিয়ে দিন। মাসে পাঁচটাকা করে পাবে, খাওয়া, বছরে একজোড়া ধুতি।
  - না না ও যাবেনা।  
  - ভেবে দেখুন। এ গ্রামের জমিদারের সাথে আমার চেনা আছে, ঝামেলার কিচ্ছু নেই।

ঝামেলার যে কিছু একটা আছে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে। আমি তাড়াতাড়ি,  আচ্ছা দাদা ভেবে জানাচ্ছি, বলে তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। দুলালও চটপট উঠে পড়েছে। আমরা যাত্রার আসর থেকে, স্টেশন কোন দিকে জেনে হাঁটা দিয়েছি। 


স্টেশন এ গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেকের দূরত্বে। কিছু করার নেই, লোকটার হাসি আমার ভালো লাগেনি। এখানে জোরজুলুম করলে কিছুই করতে পারবো না। দুলালও দেখলাম টের পেয়েছে, বলল, "আমি পারবো নতুন দাদা। চলো"।  অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে, রাস্তা ভুল করে,  হাঁটাহাঁটি খুবই বিপজ্জনক।  তাও আবার যে রাস্তা চিনিই না। তাই আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম যাত্রার আসর থেকে দূরের কোনো ঘরের রোয়াকে যদি আজ রাত টুকু কাটানো যায় চেষ্টা করা যাক। দু তিনটে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো, চার নম্বর বাড়িটা একটু সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি। সে বাড়িতে গিয়েই আগে সে বাড়ির কর্ত্রীকে দেখতে পেয়ে সাস্টাঙ্গে প্রনাম করে বললাম, 'মা আজ রাত টুকু দু ভাইকে থাকার অনুমতি দিন, আমরা কুটুম বাড়ি যেতে গিয়ে রাস্তা হারিয়েছি। স্টেশন যাবো, কিন্তু এ রাতে আর যাওয়া যায় না। তাছাড়া ভাইটা আমার আর হাঁটতেও পারছেনা'। 

সেকি কথা! বচ্ছরকার দিন! নিশ্চয়ই বাবারা। তোমার ভাই এর বয়সী আমার নাতি আছে, তাদের আসার কথা ছিলো, আসতে পারেনি। থাকো তোমরা। বছরকার দিনে দুটো মুখে দাও। কাল সকালে যেও।
গরম ভাত, ঘি, বেগুনভাজা, ডাল, তরকারি, মাংস,  এতো কিছু জুটবে আমরা নিজেরাও ভাবিনি। দুজন চোখাচোখি করে নিলাম,  খেয়ে হাত মুখ ধুয়েই  বাড়ির কর্তা প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসলেন। আসলে আগেই চেয়েছিলেন, বাড়ির গিন্নীর আপত্তিতে করতে পারেননি। কোথায় বাড়ি, কুটুমবাড়ি কোথায়, আসার পথে যে সব স্টেশন চোখে পড়েছিলো তাদের একটার নাম বলেও ওনার সন্দেহ খুব একটা গেলো না। কাদের বাড়ি, কি নাম। আমি দেখলাম বেশী প্রশ্ন মানেই বিপদ। তাছাড়া দুলাল অত ভালো বানিয়ে বলতেও পারেনা। কিছু গোলমাল বেঁফাস বললেই মুশকিল। তাড়াতাড়ি গিন্নিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, বড় ক্লান্ত লাগছে আসলে অনেকটা হাঁটা হয়েছে কিনা।

ব্যাস ও কথাতেই কাজ হলো। বউ এর কটমট চোখের সামনে কোন কালে কেইই বা টিকেছে। সকাল সকাল উঠেই বিদায় নিয়েছি। বেশীক্ষণ থাকা মানেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।  আমার কথা শুনলে তো পাগল বলবে। দুলালকে অল্প আধটু বলেছি। ওর কাঁচা মন,  তাই অত অবিশ্বাস করেনি। স্টেশনে গিয়ে জানলাম ট্রেন আসছেই। ট্রেনে ফাঁকা। দশমীর দিন এ সময় আর কে ট্রেনে থাকবে! দুলালকে বললাম,  'এবারে তোকে দিয়ে আসি বুঝলি, আরেকটু তৈরী হয়ে বেরোতে হবে, নিজের মতো থাকতে গেলে আগে নিজেকে তৈরী করতে হয়। তুই আমি কেউইই তেমন তৈরী না।তবে আমার তো থাকার উপায় নেই। তোকে পৌঁছে দিয়ে আমায় খুঁজতে বেরোতে হবে, যদি আমি বাড়ির পথ খুঁজে পাই।'

দুলালের চোখ ছলছল। তর্ক ও করতে পারে না। আমায় ওর বাঁশীটা দিয়ে বলল, "এটা রাখো তুমি নতুনদাদা। আবার আসবে তো?"
 ওর বাড়ির কাছে আসতেই, সোরগোল পড়ে গেলো। 
"ছোটকত্তা ফিরেছে "। 
" একটা লোক সাথে,  অ্যাই কে আছিস একে ধর,  এ তো মেজকত্তার কামড়জামা। চোর ব্যাটা, ছেলে ধরা, আমাদের ছোটকত্তাকে ভুলিয়ে নে গেছিলো, মার ব্যাটাকে"। 

কে যেন আমায় খুব জোর একটা মারলো মাথায়, চোখে অন্ধকার দেখছি, তেষ্টা পাচ্ছে খুব, মুখ থুবড়ে পড়ছি....পড়ছি...

"কী হয়েছে ভাই? মৃগী না গাঁজা? 

চারদিকে ছোটখাটো জটলা, বিকেলের রোদ পড়েছে ভাঙা বাড়িটার গায়ে।
চারদিকের নোংরায়, কোলাহলে বুঝলাম আমি ফিরে এসেছি আবার আমার চেনা শহরে। তবে কি সব স্বপ্ন ছিলো? 

তাকিয়ে দেখি আমার পরনে, ধাক্কাপাড় ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর একটা আড়বাঁশী।

Thursday, September 27, 2018

বাদলা দিনে মনে পড়ে ...

"বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান, বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান"।
বৃষ্টি বাদলার দিন হলেই আমার তিন চারটে র‍্যান্ডম কবিতা গল্প মনে পড়ে যায়। একই বয়সের না, আলাদা সময়কার। কালো করে আকাশ, সিঁড়ির বন্ধ জানলা বেয়ে জল এসে দালান থৈ থৈ। আমার কাগজের নৌকা ডুবে গেছে সেইই কখন, লেবু গাছের গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে৷ আমি নীচের ঘরে আবছা অন্ধকারে, 'কবে বিষ্টি পড়েছিলো, বান সে এলো কোথা', ভাবতাম, কল্পনায় যেন দেখতাম অন্ধকার আলো নিভু নিভু ঘরের দৃশ্য।

আরেকটা গল্প মনে পড়ে যায়, ক্ষীরের পুতুলে, সেই দুয়োরাণী বাঁদর ছেলেকে ঘুম পাড়ায়, বাইরে তখন খুব ঝড় জল।

আরেকটা গল্প ছিল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় এর মনে হয়। কয়েকজন বন্ধু বিকেলে জড়ো হতো ক্লাবে, চা মুড়ি চপ খেতো, এরকম একদিন বৃষ্টি বাদলার দিনে যারা জড়ো হয় তারা সব মানুষ না!

তিনটে বিসদৃশ জিনিস মনে পড়ে কেন কে জানে! সাথে এলোমেলো করে বৃষ্টির দিনের ছবি, সে ছবিতে কেন্নোর দালানে উঠে আসা আছে, অফিস যাবার নাম করে বেরিয়ে ইচ্ছে করে ভিজে বাড়ি চলে আসা আছে, তুমুল বৃষ্টিতে ঝাপসা কাচে বাইক চালানো আছে, একটা বাচ্ছা ছেলের ভিজে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে আসা আর তার মা এর গামছা দিয়ে মুছিয়ে দেবার পর প্রথমবার আদা দিয়ে সত্যিকারের চা খাওয়া আছে।

বৃষ্টি মানে ভূতের গল্প এই জন্যই কি? ভূত মানেই তো অতীত, ছেঁড়া খোঁড়া ঝলমলে হিংস্র নরম অতীত।

*******************************************************************************

একা একা সময় কাটাতে স্টুলিশ খেলছিলাম। হঠাৎ আলো কমে এলো, হুড়োহুড়ি করে একরাশ মেঘ ছুটে এলো কোথা থেকে। দিনদুপুরে রাতদুপুর হয়ে গেলো। জানলা খুলে হাঁ করে দেখছিলাম চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেলো, ফলওয়ালা তার ঠ্যালাগাড়ি ফেলে পালিয়েছে, রাস্তায় একটাও লোক নেই আর। সাদা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে আর একটাও লোক নেই....এমন অপচয় বড় কষ্ট দেয়।

আমার নীচে নামা বারন, অবশ্য বারন না হলে আমি এতোক্ষন একটা কাচের ঘেরার মধ্যে বসে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। জানলা দিয়ে ঝাপ্টা আসছে, আমার চুল, বিছানা বালিশ ভিজে যাচ্ছে, বাবাই বকবে এক্ষুনি। 
হঠাৎ করেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় গোলমাল হয়ে যায়, একটা একানে ছেলে টিউশন শেষে হাঁটা লাগিয়েছে, এখানে তার বন্ধু বান্ধব নেই তেমন। অবশ্য কোথায়ই বা ছিলো। বাসের ভাড়া বাঁচিয়ে সিগারেট কিনবে, নতুন শখ, খালের ধারে ভাঙা পাঁচিলে তার দেশলাই লুকোনো আছে, ব্যাগে রাখলে ধরা পড়ে যাবে।

হঠাৎ বৃষ্টি নেমে আসে। একা একা হাঁটা দেখেই সঙ্গী হয় বোধহয়। ছেলেটার ছাতা নেই, ব্যাগে পরীক্ষার খাতা, সে পরীক্ষায় সে সব চেয়ে কম পেয়েছে। মন খারাপে, একলায় মাখামাখি ব্যাগে বৃষ্টি ঢুকে দেখে। মেঘ নেমে এসে উড়িয়ে দেয় সব। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে ভীতু হাতে সিগারেট ধরায়, ভয়ের চোখে দেখে আশেপাশে কেউ আছে কিনা!

রাতের বেলায়, সব থেমে যাবার পর টেবিল ল্যাম্পের আলোয় নদী আঁকে সে খাতায়। আঁকতে সে পারে না মোটেও একটাই আঁকা জানে, একটা নদী, নদীর ধারে ঝাঁকড়া গাছ, দূরে একটা বাড়ি, কয়েকটা পাখি আর সূর্য। আঁকতে আঁকতে কখন যেন নদী, গাছ সব তার মধ্যে ঢুকে যায়। পরীক্ষার কম নাম্বার, একলা কোচিং কিচ্ছু যেন আর ছুঁতে পারে না তাকে।

".....জানলাটা খোলা, দরজা হাট করা, সব ভিজে গেলো, আবার শরীর খারাপ না বাধালেই না?"

যাই।

Tuesday, September 25, 2018

শরত তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

চেকাপের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে কি আহ্লাদ যে হলো কী আর বলি। শরতের রোদে ধোয়া আকাশ, প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধা চলছে। রাস্তায় হরেক কিসিমের লোক। জুতো জামা পরে আপিস যাচ্ছে কেউ তো কেউ সাইকেল নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে।  এসিটা অফ করে জানলার কাচ নামিয়ে দিতে বলব? বাইরের হাওয়া খেতে ইচ্ছে করছে বেজায়। আচ্ছা থাকগে বললে যদি না করে দেয় দুঃখ হবে, আজ বেশ ঝলমলে দিন আজ দুঃখ পাওয়া যাবে না। 

ভিয়াইপির ধারে বড় বড় গাছ গুলোয় কি করেছে কে জানে পাতা টাতা ঝরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেমন মনমরা হয়ে। এমন পুজো পুজো দিনে কারো মন খারাপ হলে ভাল্লাগেনা, ওর পাতা গজিয়ে যাক প্লিজ। আরে এই গাছটায় কচি কচি সবুজ দেখা যাচ্ছে না? হ্যাঁ হ্যাঁ। আরে আরে এই গাছটায় তো অনেক সবুজ পাতা জন্মেছে, "প্রাণ আছে এখনো প্রাণ আছে"।  মন ভালো দিন। 

এইরে গাড়িটা বেমক্কা ঘোরাচ্ছে কেন? যাকগে আমার কি, আমার বরং ভালো। বেশী বেশী ঘোরা যাবে। হাঁ করে করে বাইরের দিকে চেয়ে চেয়ে গাছ দেখছি,  ফ্লাইওভার থেকে একটা বাড়ির মাথায় লেখা উচ্চ বিদ্যালয় লেখা দেখছি, আরিব্বাস ওই বাড়িটার ছাদে কত্ত গাছ লাগিয়েছে। একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ লাগাবো বাড়িতে। 

ডাক্তার আসেনি, মাকে বললাম এই পাশের দোকানে চা খেয়ে আসছি একটু। একটা চা দেবেন দাদা? বলে, যেই গোল নোনতা বিস্কুট নিতে গেছি, 'আমায় বলো কি চাই, হাত দিচ্ছো কেন'!  আমি কি চোর নাকি! খাবোই না শালা তোর দোকানে। বললাম, ও তাই, আচ্ছা থ্যাংক ইউ আমার লাগবে না চা। 

রেগে গিয়ে গটমট করে হেঁটে এগিয়েছি। নাহ, রাগ করে মেজাজ খারাও করা যাবে না। আরে এই মিষ্টির দোকানটায় ঢুঁ মারি তো। আরিব্বাস রে পোস্তকদম্ব মানে বহরমপুরের রসকদম্ব।  
আমদই দেখছি,  বাহ বাহ। মা দইবড়া ভালোবাসে, কালাকাঁদটা ভালো মনে হচ্ছে। বাহ বেশ উজ্জ্বল আবিষ্কার হলো তো আজ। 

মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখি আকাশে একটা লাল ঘুড়ি উড়ছে, বেশী উঁচুতে ওড়েনি তখনো৷ এখনো ল্যাতপ্যাত করছে কিন্তু ওড়াচ্ছে যে ছানাটা তার মুখের ভাব বলেই দিচ্ছে আজ আকাশে নীল লাল সব রঙের ছবিই আঁকা হবে। 

আজ রঙের মেলার দিন। আজ তো হবেই। 😊😊

Friday, September 21, 2018

মানভৌতিক

সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। সারদিন শুয়ে বসে কাটাই বলেই হয়তো রাত নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয় না।  মশারির জট থেকে বেরিয়ে টয়লেট ঘুরে এসে জল খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। মন টন ভয়ানক খারাপ,  কাল বাড়িতে এক গাদা লোক আসবে কিন্তু আমার কি তাতে আমার তো সে সব্বার আগে পেঁপে ভাতে কুমড়ো ভাতে,  চিকেন স্টু। অবশ্য একটা সুবিধে আছে, শরীর খারাপ বলে ইচ্ছে না হলেই বকবক করতে হবে না। 

একা একা সাতপাঁচ ভাবছি,  দেখি এসির জলে একটা কাগজের নৌকায় বসে একটা এক আঙুলে ভূত আমায় ডাকছে, "কী হলো হে? মাঝ রাত্তিরে এমন ছলছল নয়নে ব্যাগড়া দিচ্ছো কেন হে?" 

ভারী রাগ ধরে গেলো। ও আবার কি আমার ঘর আমার বারান্দা,  চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছি ফস করে আমারই এসির জলে নৌকা বাওয়া ভূতে আমায় চোখ রাঙাবে! কলিকাল কি শেষের পথে নাকি? 

বললুম, 'তোমার তাতে কি হে? আর ব্যাগরা দিচ্ছি মানে? আমি কি গান গাইছি নাকি?'
  - মন খারাপ তো করছ। আমাদের ভূতেদের এসব নেগেটিভ চিন্তা ভারী ক্ষতিকর। আর ও আবার কি একজন ভদ্রমহিলাকে এরকম ভাবে বলতে লজ্জা করে না হ্যাঁ? ভূত বলে কি মহিলা নই!
  - 
 মহিলা! এ মহিলা? এ কুচো একটা ভূত তার আবার মহিলা না পুরুষ কে বুঝবে বাওয়া! সে কথাই বললাম। ওব্বাবা এক আঙুলে হলে কি তেজ কম না। অবশ্য স্বাভাবিক মহিলা ভূত আমার বোঝা উচিতই ছিলো। 

"কুচো ভূত আবার কি? লজ্জা করে না?  শোনো আমি তোমারই বয়সী বুঝেছ? আমি আসলে আসলে, বামন বলতে পারো। আমাদের ভূত সমাজে যেমন হওয়া উচিত মেয়েদের, কুচকুচে কালো, বা ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা, ভয় পাওয়ানো মুখ, এই আলিশান চেহারা কিছুই আমার না। বয়স বেড়েছে এদিকে চেহারা ঠিক ছোটই রয়ে গেছে। তাই আমি একা একাই থাকি। অবশ্য আমার তাতে অসুবিধে হয়না, মানুষদের ঘরবাড়িতে এই আলোর শহরেও অনেক ছায়া ছায়া জায়গা খুঁজে নিয়েছি ,  ফলে রোজ রোজ নতুন জায়গা থাকার জন্যে আমার। তাছাড়া কুকুর বেড়ালে আর ভয় খায়না আমায় বেশ রাতের বেলা আড্ডা মেরে কাটে। "

শুনে মনটা খারাপ হলো একটু। আমিও তেমন লম্বা চওড়া সা-জোয়ান চেহারার না, খেলতে পারিনা, গাইতে পারিনা, পড়াশোনায় দড় না, আমারও তেমন বন্ধু নাই।  আমিও নিজের মতোই ঘুরে ঘুরে বেরাই। বাপী, লাল্টু, চাঁদুরা খেলেতে গেলে দুধ ভাত করে দেয়। আমার মন খারাপ করে। 

  - আহা মন খারাপ কোরোনা, ভূতেদের গল্প বলো বরং। আমারও তেমন বন্ধু নেই, তুমি বন্ধু হয়ে যাও। 
  - ভূতেদের গল্প আর কি। তোমাদের মতোই সব,  একটু আলো একটু কালো এইসব দিয়ে তৈরী। এই তো আজ রাতেই জলসা বসবে বটতলায়।  যাবে নাকি? 
  - আমি? আমি কী করে যাবো? আমার বাড়ি থেকে বেরোনো মানা তো।  তাছাড়া এই রাতে বাড়ি থেকে বেরোনো যায় নাকি!
  - ওহ তুমি বুঝি খুব ভালো ছেলে? মানে দুধুভাতু ছেলে?
  - দুধুভাতু আবার কি! মেরে তোমার পেত্নীগিরি ঘুচিয়ে দেবো। একটা কথা বলতে জানে না এসেছে আবার। শোনো তোমায় না পাত্তা দেয়না কেউ তোমার স্বভাবে বুঝেছ? 
  -  নখ দাঁত বেরিয়ে গেলো তো অমনি? অবশ্য আমারও ভুল তোমার দুর্বল জায়গায় আমিই আগে খোঁচা মেরেছি। সরি হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ হয়তো, আমার দোষেই কেউ বন্ধু নেই আমার। আচ্ছা আমি যাই এখন। ভালো থেকো। 
  - আরে সরি সরি।  দুঃখ পেওনা। আমারও এই স্বভাব জানো ফস করে রেগে যাই। ওরম চলে যাওয়া কি হে। তুমি  শাঁকচুন্নি ফ্রেন্ড বলে কথা, বন্ধুদের উপর রাগ করলে চলে!
  - আচ্ছা রাগ করলাম না যাও। ভুল আমারও ছিল। তোমার সাথে কথা বলে ভারী ভাল্লেগছে। যা বলছিলাম, যাবে ভূতেদের জলসায়? না না বাড়ির গেট খুলতে হবেনা। তুমি খালি আমার হাতটা ধরো আমি নিয়ে যাবো। ভয় পাবে না কিন্তু।
  - ইয়ে ভূতেদের গা নাকি ভারী ঠান্ডা হয় শুনেছি। আমার আবার শীতে ভারী সমস্যা হয়। 
  - আরে এইটা একটা কথা নাকি! তুমিও যেমন। ওরা তো সব মরা ভূত। আমি তো জ্যান্তো শাঁকচুন্নি। আমার হাত ধরে দেখো, অমন ভুতুড়ে না। 
  - আরে তাই তো! 

তারপর আমি টুংলুর মানে ওর নতুন বন্ধু হওয়া শাঁকচুন্নির হাত ধরে আকাশে সাঁই করে উড়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত অবশ্য তারপর একটা প্রকান্ড আর্ধেক তৈরী হয়ে পড়ে থাকা বাড়ি যাকে অট্টালিকাই বলা যায় তার কাছে এনে ফেললো। এ জায়গাটা চিনি মনে হচ্ছে না? বলতে গেলাম টুংলুকে, বলল হুঁ সবই এদিক সেদিক করেই নেওয়া তো৷ অত চেনা খুঁজতে যেওনা, তা দেখছো তাইই দেখো। 

আসর তখন জমে উঠেছে। গীটার হাতে খুলি নাচিয়ে গান গাইছে এক ছোকরা ভূত।ওই দেখো ওইযে হ্যান্ডু ছেলেটা গান গাইছে খুলি নাচিয়ে, খুব ঝাড়ি মারি বুঝলে।
আহাহা কি তার রূপ! চোখটা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে একবার, খুলিটা খুলে নিয়ে পাক খেয়ে নিলো! একেই নাকি পছন্দ! ভুতুড়ে পছন্দ কি আর এমনি বলে! 
-তা একে এতো পছন্দ যখন সাহস করে প্রোপোজ করলেই পারতে। 
  - পাগল নাকি! ঝাড়ি মারতে পছন্দ মানেই প্রপোজ করার মতো নাকি। ভারী ক্যাবলা হে তুমি যাই বলো।
  আমি কথা বাড়ালুম না। এখানে ঝগড়া করে তারপর এখানেই ফেলে পালালেই চিত্তির। ভুতুড়ে আসর মন্দ না কিন্তু। বেশ অনেক ক্ষন গান বাজনা শুনে, টংলু বলল চলো কিছু খাওয়া যাক। প্রথমবার আমাদের পাড়ায় এলে। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম, কি না কি খেতে দেবে। ভূতেদের ডেলকেশি হয়তো থাবা থাবা শুঁটকি, সে জিনিস দিলেই কেস।  বললাম, না না,  চলো বরং এবার ফেরা যাক নাকি?
টংলু বলল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? 
আমি তাড়াতাড়ি জানালাম,  যে সেরকম কোনো ব্যাপারই না।
  - তাহলে আর কি চল। খেয়ে একটু ভেড়ির ধারে ঘুরে ফেরা যবে খন। 

ভয়ে ভয়ে একটা আর্ধেক শেষ হওয়া বাড়ির ন্যাড়া ছাতে বসলাম। চারিদিকটা জ্যোৎস্নায় অদ্ভুত মায়াময় লাগছে। এতো উঁচু থেকে সবটা দেখা যাচ্ছে আবছায়ায়,  একটা প্রায় অপরিচিত শাঁকচুন্নির পাশে ন্যাড়া ছাতে বসে আছি খেয়াল থাকে না। মন কেমন করে। যেন কোন আদিন কাল  থেকে সবাই এরকম রাত জাগে, ওই যে রাতচরা পাখিটা কি বলে গেলো তা যেন গাছটা শুনতে পেলো বুঝতে পেল। চমক ভাঙলো টংলুর ডাকে। "এই যে মহারাজ, এই নাও।" আরে! এ যে তন্দুরি। ভাগাড়ের নাকি? টংলু যেন আমার মনের কথা শুনতে পেয়েই বলল," আরে ঘাবড়িওনা, তোমাদের মতো ভাগাড়ের সন্ধানে ঘুরিনা। তোমরা যখন বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ ভাবো বর্তমানটা তো মরে যায় তখন আমরা সেইখান থেকে যা মন চায় তুলে নিই। সে যাক তুমি এতো ভেবোনা, খাও। "

আরাম করে তন্দুরি খাওয়া গেলো দুজনে। শুঁটকি ওদের ডেলিকেশিই বটে তবে আমি থাকায় আর ওটা বের করেনি। ভাগ্যিস! তন্দুরি খেয়ে একটা দুই  বেখাপ্পা মানুষ আর ভূত মিলে ভেড়ির হাওয়া খেয়ে ,  চাঁদের আলো মেখে ফের আস্তানায় ফিরে গেলো।

তারপর? তারপর আবার কি হে! দুজন বেঠিক মানুষ-ভূতের দারুন বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তারা আড্ডা মারে, বই গান এক্সচেঞ্জ করে, ঘুরে বেড়ায়। ওহো তোমরা বুঝি সেই প্রেম আর বিয়েতে আটকে গেছো? তারা পেল্লায় বন্ধু হয়েছে এটুকু জেনেই আমি খুশ, মানুষ ছেলে আর শাঁকচুন্নি ভূতে বাকি গল্পটা কেমন করে এগোবে তা আমি জানিনা বাপু, ছেলে মেয়ে মিলে বন্ধুত্ব তো হেব্বি হয় দেখলুম। বাকি অত রংমিলান্তি খুঁজোনা বাপু।

Sunday, September 16, 2018

অলীক চিঠি



লীলা মজুমদার ক্ষমা করে দেবেন আশা করি।

*************************************
প্রিয় পানু,

এ চিঠিটা পড়েই গিলে নিস। চারিদিকে গুপ্তচর গিজগিজ করছে। এক্ষুনি জেনে যাবে সব। শোন আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি, কাউকে বলিনি এখনো। কাউকে মানে আবার ভাবিস না গরুর কথা বলছি। হ্যা হ্যা হ্যা। সেদিন এর কথা মনে আছে তোর? বোঁচা কেমন বোকা বনেছিলো কাউ নিয়ে। যাকগে সেসব। 

বুঝলি সেদিন মাঝ্রাতে চারদিক সব চুপচাপ, ভোঁওওও আওয়াজ করা মোটরবাইক, বিটলে কুকুর গুলো ভৌ ভৌ কিচ্ছু নেই। চৌকিদারের লাঠির আওয়াজটাও না। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এই শরীর খারাপের জন্য জানিসই তো বাড়িতে স্বাধীনতা বলে কিচ্ছু নেই, মশারীর মতোন খারাপ জিনিস টাঙিয়ে দিয়ে যায় রোজ। শুধু কি তাই, বিকেলে ছানা দুপুরে পেঁপে আর কুমড়ো রাতে চিকেন স্টু....দিন খুব খারাপ যাচ্ছে ভাই। একটু সেরে উঠলেই একটা কাবাবের দোকান দেখে রেখেছি। খেতে যাবো হ্যাঁ? আর আর অ্যামাজনে একটা রিমোট কন্ট্রোল কার দেখেছি, একদম ফেরারি, ওটা কিনবো ভেবেছি, জন্মদিনে আরো কিছু পয়সা জমিয়ে একটা রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টারও কিনবো। তারপর এরকম মাঝরাতে বারান্দা থেকে হেলিকপ্টার নামাবো কেমন? 

আরে আসল কথাটাই বলিনি দেখছি। একটা ছোট ভূতের ছানা ধরার প্ল্যানে আছি, একবার ধরতে পারলেই হেলিকপ্টার টায় ঢুকিয়ে দেবো। সেদিন রাতে ঘুম ভাঙলো তো তারপর বারানাদায় গিয়ে ওই ভূতের ছানাটাকে দেখলুম। এক আঙুলের মতো সাইজ,  দেখি ব্যাটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে আমার বারান্দা থেকে। তার আগে অব্দি আমার মন খুব খারাপ ছিল, এবারে আমার জামা কিনতে যাওয়া হবে না, পুজোয় চিকেন রোল খাওয়া হবে কিনা কে জানে, ঘুরতেও যেতে পারবো না কতদিন কিন্তু ভূতের ছানাটার কসরত দেখেই প্ল্যান করে ফেলেছি বুঝলি। একে রোজ ছায়ার লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে বশ করে ফেলবো। তারপর পুষতে পারলেই, তোর কাছে পাঠাবো বুঝলি।  সেই সবুজ পাথরটা পরিষ্কার করে রাখিস, ওইখানে বসে বাকি প্ল্যান করবো। 

ভূতের ছানাটা ছায়া ছাড়া আর কি খেলে তাড়াতাড়ি বশ হবে বলিস তো৷ পুরোনো ক্যাপ বন্দুকের ধোঁয়া দেবো? আর একটু খানি ডাল্ডার  টিনে রাখলে কি ভালো থাকবে? বিশদে আলোচনা সামনাসামনি হবে।  কাউকে বিশ্বাস নেই, ভূতের ছানাটা খুব বেশী কথা বলছে না  তাই বুঝতে পারছিনা বাঙালী না বিলেতি। বিলেতি হলে আবার মুশকিল।

বিঃদ্রঃ -  চিঠি লেখার পর একটা আপডেট আছে,  ভূতের ছানাটা লায়ন ক্যাপ শুনে চকচকে চোখে দেখছিলো।

ভালো থাকিস, আর এ চিঠি পরেই গিলে নিস কিন্তু। শিগগিরই দেখা হবে। 

- গুপী

Saturday, September 15, 2018

হাসপাতালের পর

"হেলদি" লাইফ ফলো করায় আজকাল আমার শরীরের ভিতরকার যন্ত্র গুলো চমকে চমকে যাচ্ছে, মানে এটা কিই হচ্ছে!! সাড়ে দশটার মধ্যে ঘুম! সকাল ছটায় ওঠা! এইরকম থাবা থাবা পেঁপে কুমড়োর ইনপুট! চোখ তো কাল মুচ্ছো যাচ্ছিলো, রাবড়ির ভাঁড়ে হাত না দিয়ে সন্দেশের প্যাকেটে হাত!! হাত রীতিমতো বিদ্রোহ করছিলো, বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিলো যা হোক তাকে ম্যানেজ করা যায় শেষ তক। এরকম নানান বিস্ময় দেখে দেখে তারা নানান ভাভে জানাচ্ছে সে যাক, ঘটনা হলো এই সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যাওয়ায় সকালটা দেখা হচ্ছে বেশ। মন্দ না কেমন যেন নতুন নতুন ব্যাপার।

জানলার পর্দা গুলো সরালেই সকালের নরম রোদ লুটোপুটি খেয়ে যায়। আমি আবার মোবাইলে সেই রোদ ধরে এদিক সেদিক ছুঁড়ে দিই। কাগজওলাদাদা হাঁক দিয়ে যায়, জয়দেবের সব্জীর  ট্রাক এসে নামিয়ে নামিয়ে যায়, বেগুন, কুমড়ো, পটল, শাকের আঁটি। কুমড়োর খানিক কাটা, দেখে নিয়েছে ভিতরটা, ট্রাকের ছেলেটা একটা দুটো বেগুন পটল নিজের জন্য রেখে রেখে দিচ্ছে। আরিব্বাস পটলের বস্তাটা কিই ভারী, ছেলেটা হেঁইয়ো করে নামালো। 

বিহারী জুতো সারাই লোকটা ফুটপাথে যেখানে বসে, তার সামনেটা ঝাঁটপাট দিয়ে নিলো। দুধের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, রাস্তা ফাঁকা এখনো।  স্কুলের বাস, একটা শাড়ি পরা টিফিন এর ব্যাগ নেওয়া মহিলা, বেকারির গাড়িটা...

মাছওয়ালা বটির ফালিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লাগিয়ে দেবে। আকাশটা এখনো নীল হয়নি, সকালের ঘোলাটে ভাবই রয়েছে কিন্তু চারদিকটা বেশ জেগে জেগে উঠছে বোঝা যায়। 

সকাল সকাল মনটা একটা চমৎকার গল্প পড়ে বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে কিনা তাই এতো আজেবাজে বকলাম। বইটা আমার এক ফেসবুকের বন্ধুই দিয়েছে। আমার শরীর খারাপ শুনে, মহম্মদ জাফর ইকবাল এর ব্ল্যাকহোলের বাচ্ছা। কোনো সোশ্যাল এক্টিভিস্ট না, বদমায়েশী করে সাধু বলা নিজেকে যা কিছু নিয়ে বকবক করা একটা না দেখা লোককে এই যে এতো লোক ভালোবাসে এর তো কোনো কারন নেই না? আসলে কি জানো, লোকে ভালোবাসতেই চায়, ভালোটাই চারদিকে আমরা মাঝে মাঝে ওই খারাপটুকুর ধোঁয়া এলেই সব ঝুট হ্যায় বলে দিই বটে, তা মোটেও সত্যি না। 

ধোঁয়াটা কেটে গেলে দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে গেলেই দেখো "আলোয় আলো আকাশ, আকাশ আলোয় ভরা..."

Wednesday, September 12, 2018

হাসপাতালে হরেকরকম (পার্ট টু)

হাসপাতাল থেকে জানালো যেন আমি চলে যাই, ওদের অদ্ভুত ব্যাপার, আগে থেকে কেবিন বুক করা যায় না, বলে রেখেছিলাম তাও যে না হলে যাবোই না,  তাতে নেহাত দয়া পরবশ হয়ে বলেছিল যে আচ্ছা আচ্ছা আপনাকে সকালে জানাবো খন, আপনি চলে আসবেন।
ব্যাগে চার্জার, হেডফোন, সাদাকাক(আহ বই, সত্যিকারের কাক নিয়ে ঘুরবো?) , তারাপদ রায় এইসব নিয়ে বেশ একটা ভ্রমন মুডে বেরিয়েছি। বাইরে বলছিনা কাউকে, বেশ ক্যাজ ভাই ক্যাজ ভাব নিচ্ছি কিন্তু মনের মধ্যে বেশ একটা খারাপ খারাপ খালি খালি ভাব কি আর হচ্ছে না? ডাক্তারও তো মানুষ, অপারেশন করতে গিয়ে গন্ডগোল হয়ে গেলো, আমাদেরই কি হয়না? uat তে হুল্লাট চলছে কোড প্রোডাকশনে ঝুলে গেলো, কিংবা তার জুনিয়র কে যদি কাজ শেখাতে গিয়ে বলল কই কর দেখি ব্যাটা এটা, আমি একটু বিড়ি খেয়ে আসছি, ইন দ্য মিন টাইম সে ছড়িয়ে ছত্রাকার!  এহে মুন্নার কচুরি, জিলিপিটা আর খাওয়া হবে না, তালের বড়াও খাওয়া হবেনা, বড় ভালোবেসে সেজ জেঠিমা পাঠায় আমার জন্য। আচ্ছা আমি মনে হয় খুবই পেটুক, মরে যাবার সম্ভাবনায় জাগতিক সব কিছুর বদলে খালি খাবারের কথাই বা মনে পড়ছে কেন?  

শরতের আকাশ, ফুরফুরে মেঘ নীল আকাশ এনাস্থেসিয়ার ডোজের কম বেশী নিয়ে বাসে বসে আছি। সুস্থ মানুষ হেঁটে হেঁটে বাসে করে নার্সিংহোম গিয়ে ভর্তি হবে, এতে আমার তেমন অবাক লাগছেনা কিন্তু নার্সিংহোম এর লোকেদের বেশ অবাক লেগেছে দেখছি। জলের বোতল, সাবান শ্যাম্পু, চিরুনী ইত্যাদির খাম দিয়ে হোটেলে ভর্তি হওয়া গেলো। হোটেলের মতোই সিস্টেম, নটা টু নটা। আমার কেবিনটার পাশেই ঘর বাড়ি, মাথার দিক থেকে আকাশ কম দেখা যায়। গাধা আছে তো,  ওদিকটা মাথা করলে পারতো, চ্যানেলটাও তাহলে বাঁহাতে করা যেত অনায়াসে।  যাকগে, আজ তো কিছুই নাই, একটা অল্পবয়সী মহিলা ডাক্তার কেস হিস্ট্রি নিতে এলো। ঝাড়ি মারার মতো ভালো বেশ। আমার ডাক্তার আরো খানিক বাদে আসবে। মা বাবাই বন্ধু বান্ধব মিলে আড্ডা মেরে কাটলো তো ভালোই সন্ধ্যে তক। 

দুজন অল্প বয়সী নার্স আছে একজন দেখতে ভালো বেশী ফলত গম্ভীর আর একজন তেমন ভালো না কিন্তু বেশ হাসীখুশী। এছাড়া জেলারের মতো দেখতে একজন নার্সদিদি আছেন, বুড়ি মাসী গোটা তিন, দিন পাঁচেকের পরিচিতি হয়ে যায়। সকালে চ্যানেল করতে হাসিখুশি নার্স যার নাম মমতা( আমার কুনো দোষ নাই) এলো, নরম মাটি পেয়ে দাবী জানালাম বাঁ হাতে করে দাও চ্যানেল, ডান হাতটা নাড়াতে না পারলে ভারী অসুবিধে কিন্তু। সেই ঠান্ডা ঠান্ডা ঘর,  ডাক্তার এসে দেখে গেছে, এই ডাক্তারকে আমার পছন্দ হয়েছিল। ইয়ে আমি আবার ডাক্তার চুজ করি বন্ধু বান্ধবদের থেকে খবর নিয়ে, মানে ওই রেটিং বলতে পারেন, তা সে তো সব পেশাতেই রেটিং আছে না হলে উপায় কি জানার। আর একটা ব্যাপার সেটা রেটিং যদি একটু কমও হয় আমার ওই পছন্দ হওয়ার ব্যপারটা ম্যাটার করে। হাসিখুশি হবে, আমি দু চারটে বোকা প্রশ্ন করলে সময় শেষ আসুন ভঙ্গী করবে না, দরকারে ফোন করলে অন্তত এখন ব্যস্ত আছি রে অমুক সময়ে ফোন করিস বলার সময়টুকু থাকবে এ না হলে আমি ভারী অস্বস্তি বোধ করি। 

দুটো ডানা গোঁজা হয়ে গেলো, ইসিজি মিটার চালু হলো মনে হয়, এইবার দেবে প্যাঁক.....উঠুন উঠুন প্রভু.....জলের নীচে বন্ধ দরজায় ডাকাডাকি শুনে ঘুম ভাঙে, সেই গুপি বাঘা ফিরে এলোতে যেমন হিপনোটাইজ এর (নকল) পর ওরা গান গাইছিলো, 'আ আ আজ আজ আজ থেকে, আজ থেকে.......' ওভাবে ম্যা ম্যা করতে করতে জ্ঞান ফেরা, কেঁপে কেঁপে ওঠা আগেরবারের মতোই সব....বড় ব্যথা।


তারপর দিন রাত আধা ঘুমে আধা জাগরনে কাটে, জ্বর কমে না বাড়ে জানা যায়না, মাথার মধ্যে দপদপ করে ঘুম হয়, হয়না। ঘুমের মধ্যে দেখি আমি এক উপকূলে, একজন লোকআগেকার দিনের পোশাক পরা, তার সমুদ্রের ধারের বাসভূমিতে,  আমার কি যেন জিনিস আছে তার কাছে আনতে গেছিলাম দিতে যাবার আগের মুহূর্তে কী যেন হলো বাজ পরার মতো সব সাদা কালো হয়ে গেলো। কারা যেন বসে বসে বড় পিপে ঘুরিয়ে কি পানীয় কাচ্ছে তারাই বলল বসে থাকো হয়তো আবার সব জাগবে। 

বসে থাকার সময় মাথার ব্যাথা বেড়ে যায়, আমি স্বপ্নের মধ্যেই টের পাই আমার বসে থাকলে চলবে না। কি হয় আমি জানিনা একটা ওয়ার্ম হোলে না কাদার গর্তে পড়ে যাই.....হাঁচোরপাঁচোর করে উঠতে দেখি এ এক নতুন দেশ। কারা যেন ন্যাড়া মাথায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে....আমি যাবার আগেই মাথার যন্ত্রনা তীব্র হয় আমি উঠে পড়ি।

আরেকদিন, জানলার পর্দা ফাঁক করে দেখি ফুরফুরে রোদ বেরিয়েছে।  একটা কাক ঠোঁটে করে গ্লাস নিয়ে চলেছে। কাকেরা বুঝি গ্লাসে করে জল খায়? নাকি হুইস্কি?  একটা পায়রা তারে বসে অস্থির ভাবে ইতিউতি চাইছে,  যেন ওয়াইফাই এর সমস্যা দেখা গেছে খুব চিন্তিত। একটা বুড়ি সকালবেলায় ছাদে এসে কল খুলে কি যেন করে....বেশী কিছু দেখাই যায়না, আমার ঘুমও পায়না, মাথা ব্যাথাও কমেনা। 

এ কদিন নীলুমাসীকে জ্বালানো হয়েছে খুব, একদিন আমার বন্ধু বলেছে মাসী তোমার হাতে ভালো চ্যানেল করা যাবে, হেব্বি খচে গেছে। রোজ জ্বর আসে, না হয় কিছু না কিছু হয় সারবোই না নাকি আর? হ্যাঁ ইয়ার্কি হোতা হ্যায়? তারপর একদিন সকালে ডাক্তার এসে বলল কেমন আছিস বলতো? ব্যাথার কথা আর বলে লাভ নেই, বললাম ভালো আছি। সে মশাই এমন ভাবে হাঁফ ছাড়লো কী বলি! ভাবলো বোধহয় এ মক্কেল আমার হাতে ভবনদীর কূল পার হলে কপালে বিস্তর দুঃখ ছিল। হয়তো রাতে এসে বলবে, "নক নক, আচ্ছা পেটকামড়ানোটা কি স্কেলিটনে হওয়ার কথা?" "আমার খুলিটা খুব যন্ত্রণা করছে "। কিংবা ভূতেদের জ্বর হওয়া নিয়ে দেড় পাতা বকে গেলো! 


তাই.....ফিরেই এলাম আর কি।