Friday, September 21, 2018

মানভৌতিক

সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছে। সারদিন শুয়ে বসে কাটাই বলেই হয়তো রাত নিরবচ্ছিন্ন ঘুম হয় না।  মশারির জট থেকে বেরিয়ে টয়লেট ঘুরে এসে জল খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। মন টন ভয়ানক খারাপ,  কাল বাড়িতে এক গাদা লোক আসবে কিন্তু আমার কি তাতে আমার তো সে সব্বার আগে পেঁপে ভাতে কুমড়ো ভাতে,  চিকেন স্টু। অবশ্য একটা সুবিধে আছে, শরীর খারাপ বলে ইচ্ছে না হলেই বকবক করতে হবে না। 

একা একা সাতপাঁচ ভাবছি,  দেখি এসির জলে একটা কাগজের নৌকায় বসে একটা এক আঙুলে ভূত আমায় ডাকছে, "কী হলো হে? মাঝ রাত্তিরে এমন ছলছল নয়নে ব্যাগড়া দিচ্ছো কেন হে?" 

ভারী রাগ ধরে গেলো। ও আবার কি আমার ঘর আমার বারান্দা,  চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছি ফস করে আমারই এসির জলে নৌকা বাওয়া ভূতে আমায় চোখ রাঙাবে! কলিকাল কি শেষের পথে নাকি? 

বললুম, 'তোমার তাতে কি হে? আর ব্যাগরা দিচ্ছি মানে? আমি কি গান গাইছি নাকি?'
  - মন খারাপ তো করছ। আমাদের ভূতেদের এসব নেগেটিভ চিন্তা ভারী ক্ষতিকর। আর ও আবার কি একজন ভদ্রমহিলাকে এরকম ভাবে বলতে লজ্জা করে না হ্যাঁ? ভূত বলে কি মহিলা নই!
  - 
 মহিলা! এ মহিলা? এ কুচো একটা ভূত তার আবার মহিলা না পুরুষ কে বুঝবে বাওয়া! সে কথাই বললাম। ওব্বাবা এক আঙুলে হলে কি তেজ কম না। অবশ্য স্বাভাবিক মহিলা ভূত আমার বোঝা উচিতই ছিলো। 

"কুচো ভূত আবার কি? লজ্জা করে না?  শোনো আমি তোমারই বয়সী বুঝেছ? আমি আসলে আসলে, বামন বলতে পারো। আমাদের ভূত সমাজে যেমন হওয়া উচিত মেয়েদের, কুচকুচে কালো, বা ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা, ভয় পাওয়ানো মুখ, এই আলিশান চেহারা কিছুই আমার না। বয়স বেড়েছে এদিকে চেহারা ঠিক ছোটই রয়ে গেছে। তাই আমি একা একাই থাকি। অবশ্য আমার তাতে অসুবিধে হয়না, মানুষদের ঘরবাড়িতে এই আলোর শহরেও অনেক ছায়া ছায়া জায়গা খুঁজে নিয়েছি ,  ফলে রোজ রোজ নতুন জায়গা থাকার জন্যে আমার। তাছাড়া কুকুর বেড়ালে আর ভয় খায়না আমায় বেশ রাতের বেলা আড্ডা মেরে কাটে। "

শুনে মনটা খারাপ হলো একটু। আমিও তেমন লম্বা চওড়া সা-জোয়ান চেহারার না, খেলতে পারিনা, গাইতে পারিনা, পড়াশোনায় দড় না, আমারও তেমন বন্ধু নাই।  আমিও নিজের মতোই ঘুরে ঘুরে বেরাই। বাপী, লাল্টু, চাঁদুরা খেলেতে গেলে দুধ ভাত করে দেয়। আমার মন খারাপ করে। 

  - আহা মন খারাপ কোরোনা, ভূতেদের গল্প বলো বরং। আমারও তেমন বন্ধু নেই, তুমি বন্ধু হয়ে যাও। 
  - ভূতেদের গল্প আর কি। তোমাদের মতোই সব,  একটু আলো একটু কালো এইসব দিয়ে তৈরী। এই তো আজ রাতেই জলসা বসবে বটতলায়।  যাবে নাকি? 
  - আমি? আমি কী করে যাবো? আমার বাড়ি থেকে বেরোনো মানা তো।  তাছাড়া এই রাতে বাড়ি থেকে বেরোনো যায় নাকি!
  - ওহ তুমি বুঝি খুব ভালো ছেলে? মানে দুধুভাতু ছেলে?
  - দুধুভাতু আবার কি! মেরে তোমার পেত্নীগিরি ঘুচিয়ে দেবো। একটা কথা বলতে জানে না এসেছে আবার। শোনো তোমায় না পাত্তা দেয়না কেউ তোমার স্বভাবে বুঝেছ? 
  -  নখ দাঁত বেরিয়ে গেলো তো অমনি? অবশ্য আমারও ভুল তোমার দুর্বল জায়গায় আমিই আগে খোঁচা মেরেছি। সরি হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ হয়তো, আমার দোষেই কেউ বন্ধু নেই আমার। আচ্ছা আমি যাই এখন। ভালো থেকো। 
  - আরে সরি সরি।  দুঃখ পেওনা। আমারও এই স্বভাব জানো ফস করে রেগে যাই। ওরম চলে যাওয়া কি হে। তুমি  শাঁকচুন্নি ফ্রেন্ড বলে কথা, বন্ধুদের উপর রাগ করলে চলে!
  - আচ্ছা রাগ করলাম না যাও। ভুল আমারও ছিল। তোমার সাথে কথা বলে ভারী ভাল্লেগছে। যা বলছিলাম, যাবে ভূতেদের জলসায়? না না বাড়ির গেট খুলতে হবেনা। তুমি খালি আমার হাতটা ধরো আমি নিয়ে যাবো। ভয় পাবে না কিন্তু।
  - ইয়ে ভূতেদের গা নাকি ভারী ঠান্ডা হয় শুনেছি। আমার আবার শীতে ভারী সমস্যা হয়। 
  - আরে এইটা একটা কথা নাকি! তুমিও যেমন। ওরা তো সব মরা ভূত। আমি তো জ্যান্তো শাঁকচুন্নি। আমার হাত ধরে দেখো, অমন ভুতুড়ে না। 
  - আরে তাই তো! 

তারপর আমি টুংলুর মানে ওর নতুন বন্ধু হওয়া শাঁকচুন্নির হাত ধরে আকাশে সাঁই করে উড়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত অবশ্য তারপর একটা প্রকান্ড আর্ধেক তৈরী হয়ে পড়ে থাকা বাড়ি যাকে অট্টালিকাই বলা যায় তার কাছে এনে ফেললো। এ জায়গাটা চিনি মনে হচ্ছে না? বলতে গেলাম টুংলুকে, বলল হুঁ সবই এদিক সেদিক করেই নেওয়া তো৷ অত চেনা খুঁজতে যেওনা, তা দেখছো তাইই দেখো। 

আসর তখন জমে উঠেছে। গীটার হাতে খুলি নাচিয়ে গান গাইছে এক ছোকরা ভূত।ওই দেখো ওইযে হ্যান্ডু ছেলেটা গান গাইছে খুলি নাচিয়ে, খুব ঝাড়ি মারি বুঝলে।
আহাহা কি তার রূপ! চোখটা হাতে নিয়ে লাফাচ্ছে একবার, খুলিটা খুলে নিয়ে পাক খেয়ে নিলো! একেই নাকি পছন্দ! ভুতুড়ে পছন্দ কি আর এমনি বলে! 
-তা একে এতো পছন্দ যখন সাহস করে প্রোপোজ করলেই পারতে। 
  - পাগল নাকি! ঝাড়ি মারতে পছন্দ মানেই প্রপোজ করার মতো নাকি। ভারী ক্যাবলা হে তুমি যাই বলো।
  আমি কথা বাড়ালুম না। এখানে ঝগড়া করে তারপর এখানেই ফেলে পালালেই চিত্তির। ভুতুড়ে আসর মন্দ না কিন্তু। বেশ অনেক ক্ষন গান বাজনা শুনে, টংলু বলল চলো কিছু খাওয়া যাক। প্রথমবার আমাদের পাড়ায় এলে। আমি একটু ভয় পাচ্ছিলাম, কি না কি খেতে দেবে। ভূতেদের ডেলকেশি হয়তো থাবা থাবা শুঁটকি, সে জিনিস দিলেই কেস।  বললাম, না না,  চলো বরং এবার ফেরা যাক নাকি?
টংলু বলল, তোমার শরীর খারাপ লাগছে নাকি? 
আমি তাড়াতাড়ি জানালাম,  যে সেরকম কোনো ব্যাপারই না।
  - তাহলে আর কি চল। খেয়ে একটু ভেড়ির ধারে ঘুরে ফেরা যবে খন। 

ভয়ে ভয়ে একটা আর্ধেক শেষ হওয়া বাড়ির ন্যাড়া ছাতে বসলাম। চারিদিকটা জ্যোৎস্নায় অদ্ভুত মায়াময় লাগছে। এতো উঁচু থেকে সবটা দেখা যাচ্ছে আবছায়ায়,  একটা প্রায় অপরিচিত শাঁকচুন্নির পাশে ন্যাড়া ছাতে বসে আছি খেয়াল থাকে না। মন কেমন করে। যেন কোন আদিন কাল  থেকে সবাই এরকম রাত জাগে, ওই যে রাতচরা পাখিটা কি বলে গেলো তা যেন গাছটা শুনতে পেলো বুঝতে পেল। চমক ভাঙলো টংলুর ডাকে। "এই যে মহারাজ, এই নাও।" আরে! এ যে তন্দুরি। ভাগাড়ের নাকি? টংলু যেন আমার মনের কথা শুনতে পেয়েই বলল," আরে ঘাবড়িওনা, তোমাদের মতো ভাগাড়ের সন্ধানে ঘুরিনা। তোমরা যখন বর্তমানে বসে ভবিষ্যৎ ভাবো বর্তমানটা তো মরে যায় তখন আমরা সেইখান থেকে যা মন চায় তুলে নিই। সে যাক তুমি এতো ভেবোনা, খাও। "

আরাম করে তন্দুরি খাওয়া গেলো দুজনে। শুঁটকি ওদের ডেলিকেশিই বটে তবে আমি থাকায় আর ওটা বের করেনি। ভাগ্যিস! তন্দুরি খেয়ে একটা দুই  বেখাপ্পা মানুষ আর ভূত মিলে ভেড়ির হাওয়া খেয়ে ,  চাঁদের আলো মেখে ফের আস্তানায় ফিরে গেলো।

তারপর? তারপর আবার কি হে! দুজন বেঠিক মানুষ-ভূতের দারুন বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তারা আড্ডা মারে, বই গান এক্সচেঞ্জ করে, ঘুরে বেড়ায়। ওহো তোমরা বুঝি সেই প্রেম আর বিয়েতে আটকে গেছো? তারা পেল্লায় বন্ধু হয়েছে এটুকু জেনেই আমি খুশ, মানুষ ছেলে আর শাঁকচুন্নি ভূতে বাকি গল্পটা কেমন করে এগোবে তা আমি জানিনা বাপু, ছেলে মেয়ে মিলে বন্ধুত্ব তো হেব্বি হয় দেখলুম। বাকি অত রংমিলান্তি খুঁজোনা বাপু।

No comments:

Post a Comment