Wednesday, September 12, 2018

হাসপাতালে হরেকরকম (পার্ট টু)

হাসপাতাল থেকে জানালো যেন আমি চলে যাই, ওদের অদ্ভুত ব্যাপার, আগে থেকে কেবিন বুক করা যায় না, বলে রেখেছিলাম তাও যে না হলে যাবোই না,  তাতে নেহাত দয়া পরবশ হয়ে বলেছিল যে আচ্ছা আচ্ছা আপনাকে সকালে জানাবো খন, আপনি চলে আসবেন।
ব্যাগে চার্জার, হেডফোন, সাদাকাক(আহ বই, সত্যিকারের কাক নিয়ে ঘুরবো?) , তারাপদ রায় এইসব নিয়ে বেশ একটা ভ্রমন মুডে বেরিয়েছি। বাইরে বলছিনা কাউকে, বেশ ক্যাজ ভাই ক্যাজ ভাব নিচ্ছি কিন্তু মনের মধ্যে বেশ একটা খারাপ খারাপ খালি খালি ভাব কি আর হচ্ছে না? ডাক্তারও তো মানুষ, অপারেশন করতে গিয়ে গন্ডগোল হয়ে গেলো, আমাদেরই কি হয়না? uat তে হুল্লাট চলছে কোড প্রোডাকশনে ঝুলে গেলো, কিংবা তার জুনিয়র কে যদি কাজ শেখাতে গিয়ে বলল কই কর দেখি ব্যাটা এটা, আমি একটু বিড়ি খেয়ে আসছি, ইন দ্য মিন টাইম সে ছড়িয়ে ছত্রাকার!  এহে মুন্নার কচুরি, জিলিপিটা আর খাওয়া হবে না, তালের বড়াও খাওয়া হবেনা, বড় ভালোবেসে সেজ জেঠিমা পাঠায় আমার জন্য। আচ্ছা আমি মনে হয় খুবই পেটুক, মরে যাবার সম্ভাবনায় জাগতিক সব কিছুর বদলে খালি খাবারের কথাই বা মনে পড়ছে কেন?  

শরতের আকাশ, ফুরফুরে মেঘ নীল আকাশ এনাস্থেসিয়ার ডোজের কম বেশী নিয়ে বাসে বসে আছি। সুস্থ মানুষ হেঁটে হেঁটে বাসে করে নার্সিংহোম গিয়ে ভর্তি হবে, এতে আমার তেমন অবাক লাগছেনা কিন্তু নার্সিংহোম এর লোকেদের বেশ অবাক লেগেছে দেখছি। জলের বোতল, সাবান শ্যাম্পু, চিরুনী ইত্যাদির খাম দিয়ে হোটেলে ভর্তি হওয়া গেলো। হোটেলের মতোই সিস্টেম, নটা টু নটা। আমার কেবিনটার পাশেই ঘর বাড়ি, মাথার দিক থেকে আকাশ কম দেখা যায়। গাধা আছে তো,  ওদিকটা মাথা করলে পারতো, চ্যানেলটাও তাহলে বাঁহাতে করা যেত অনায়াসে।  যাকগে, আজ তো কিছুই নাই, একটা অল্পবয়সী মহিলা ডাক্তার কেস হিস্ট্রি নিতে এলো। ঝাড়ি মারার মতো ভালো বেশ। আমার ডাক্তার আরো খানিক বাদে আসবে। মা বাবাই বন্ধু বান্ধব মিলে আড্ডা মেরে কাটলো তো ভালোই সন্ধ্যে তক। 

দুজন অল্প বয়সী নার্স আছে একজন দেখতে ভালো বেশী ফলত গম্ভীর আর একজন তেমন ভালো না কিন্তু বেশ হাসীখুশী। এছাড়া জেলারের মতো দেখতে একজন নার্সদিদি আছেন, বুড়ি মাসী গোটা তিন, দিন পাঁচেকের পরিচিতি হয়ে যায়। সকালে চ্যানেল করতে হাসিখুশি নার্স যার নাম মমতা( আমার কুনো দোষ নাই) এলো, নরম মাটি পেয়ে দাবী জানালাম বাঁ হাতে করে দাও চ্যানেল, ডান হাতটা নাড়াতে না পারলে ভারী অসুবিধে কিন্তু। সেই ঠান্ডা ঠান্ডা ঘর,  ডাক্তার এসে দেখে গেছে, এই ডাক্তারকে আমার পছন্দ হয়েছিল। ইয়ে আমি আবার ডাক্তার চুজ করি বন্ধু বান্ধবদের থেকে খবর নিয়ে, মানে ওই রেটিং বলতে পারেন, তা সে তো সব পেশাতেই রেটিং আছে না হলে উপায় কি জানার। আর একটা ব্যাপার সেটা রেটিং যদি একটু কমও হয় আমার ওই পছন্দ হওয়ার ব্যপারটা ম্যাটার করে। হাসিখুশি হবে, আমি দু চারটে বোকা প্রশ্ন করলে সময় শেষ আসুন ভঙ্গী করবে না, দরকারে ফোন করলে অন্তত এখন ব্যস্ত আছি রে অমুক সময়ে ফোন করিস বলার সময়টুকু থাকবে এ না হলে আমি ভারী অস্বস্তি বোধ করি। 

দুটো ডানা গোঁজা হয়ে গেলো, ইসিজি মিটার চালু হলো মনে হয়, এইবার দেবে প্যাঁক.....উঠুন উঠুন প্রভু.....জলের নীচে বন্ধ দরজায় ডাকাডাকি শুনে ঘুম ভাঙে, সেই গুপি বাঘা ফিরে এলোতে যেমন হিপনোটাইজ এর (নকল) পর ওরা গান গাইছিলো, 'আ আ আজ আজ আজ থেকে, আজ থেকে.......' ওভাবে ম্যা ম্যা করতে করতে জ্ঞান ফেরা, কেঁপে কেঁপে ওঠা আগেরবারের মতোই সব....বড় ব্যথা।


তারপর দিন রাত আধা ঘুমে আধা জাগরনে কাটে, জ্বর কমে না বাড়ে জানা যায়না, মাথার মধ্যে দপদপ করে ঘুম হয়, হয়না। ঘুমের মধ্যে দেখি আমি এক উপকূলে, একজন লোকআগেকার দিনের পোশাক পরা, তার সমুদ্রের ধারের বাসভূমিতে,  আমার কি যেন জিনিস আছে তার কাছে আনতে গেছিলাম দিতে যাবার আগের মুহূর্তে কী যেন হলো বাজ পরার মতো সব সাদা কালো হয়ে গেলো। কারা যেন বসে বসে বড় পিপে ঘুরিয়ে কি পানীয় কাচ্ছে তারাই বলল বসে থাকো হয়তো আবার সব জাগবে। 

বসে থাকার সময় মাথার ব্যাথা বেড়ে যায়, আমি স্বপ্নের মধ্যেই টের পাই আমার বসে থাকলে চলবে না। কি হয় আমি জানিনা একটা ওয়ার্ম হোলে না কাদার গর্তে পড়ে যাই.....হাঁচোরপাঁচোর করে উঠতে দেখি এ এক নতুন দেশ। কারা যেন ন্যাড়া মাথায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে....আমি যাবার আগেই মাথার যন্ত্রনা তীব্র হয় আমি উঠে পড়ি।

আরেকদিন, জানলার পর্দা ফাঁক করে দেখি ফুরফুরে রোদ বেরিয়েছে।  একটা কাক ঠোঁটে করে গ্লাস নিয়ে চলেছে। কাকেরা বুঝি গ্লাসে করে জল খায়? নাকি হুইস্কি?  একটা পায়রা তারে বসে অস্থির ভাবে ইতিউতি চাইছে,  যেন ওয়াইফাই এর সমস্যা দেখা গেছে খুব চিন্তিত। একটা বুড়ি সকালবেলায় ছাদে এসে কল খুলে কি যেন করে....বেশী কিছু দেখাই যায়না, আমার ঘুমও পায়না, মাথা ব্যাথাও কমেনা। 

এ কদিন নীলুমাসীকে জ্বালানো হয়েছে খুব, একদিন আমার বন্ধু বলেছে মাসী তোমার হাতে ভালো চ্যানেল করা যাবে, হেব্বি খচে গেছে। রোজ জ্বর আসে, না হয় কিছু না কিছু হয় সারবোই না নাকি আর? হ্যাঁ ইয়ার্কি হোতা হ্যায়? তারপর একদিন সকালে ডাক্তার এসে বলল কেমন আছিস বলতো? ব্যাথার কথা আর বলে লাভ নেই, বললাম ভালো আছি। সে মশাই এমন ভাবে হাঁফ ছাড়লো কী বলি! ভাবলো বোধহয় এ মক্কেল আমার হাতে ভবনদীর কূল পার হলে কপালে বিস্তর দুঃখ ছিল। হয়তো রাতে এসে বলবে, "নক নক, আচ্ছা পেটকামড়ানোটা কি স্কেলিটনে হওয়ার কথা?" "আমার খুলিটা খুব যন্ত্রণা করছে "। কিংবা ভূতেদের জ্বর হওয়া নিয়ে দেড় পাতা বকে গেলো! 


তাই.....ফিরেই এলাম আর কি।

No comments:

Post a Comment