Wednesday, August 29, 2018

কপ্টুম্যাক

একটা কথা, কেউ বাই চান্স যদি পড়েন এ গল্প এ ব্লগে, খারাপ ভালো মন্তব্য করলে বাধিত হই। অন্তত বুঝতে পারা যায় ব্লগটা মৃত কিনা। 

************************************

মাঠাংবুরু ঘুরতে গেছে, লায়েক হয়েছে কিনা, পাত্তা দেয়না আজকাল। কি করে জানলাম? ওর বন্ধুদের কাছ থেকেই খবর পাই মশাই।

#কপ্টুম্যাক
********************************************

ভুটুটুটুটু...একটানা আওয়াজ হয়ে যায়, পাইলিং না কি করছে কে জানে! সিমেন্ট বালি সিমেন্ট বালি, বস্তা সাজিয়ে রেখেছে, ঠিক তারপাশেই পাইপে করে করে জল বেরিয়ে ছোট্ট একটা ডোবা হয়েছে। এখন ডোবা লাগছে তার আগের অংশটা খাল....ছোটবেলায় এটাই মস্ত পুকুর হতো। তার আগে খানিক নদী।
ভারী ইচ্ছে করছে ওই সিমেন্ট বালি দিয়ে তৈরী চৌকো সিংহাসনে উঠতে। ওঠা যায় না, বড় হয়ে গেছি কিনা! ট্রাক ড্রাইভারের পরেই আমার পছন্দ ছিলো রাজমিস্ত্রি হবার। সিমেন্টে বালি মিশিয়ে মিশিয়ে খপাৎ খপাৎ করে ওই চ্যাটালো মস্ত থালায় দিতাম, তার আগে গোল করে সিমেন্ট বালি দিয়ে ঘিরে জল দেওয়া হবে, তারপর চারদিক থেকে সিমেন্ট বালি জলে দিতে দিতে জল ফুরিয়ে যাবে, আমাদের খাল বিল গুলো যেমন বুজে যাচ্ছে। আচ্ছা বিল বলে কেন? বিল আমি দেখিনি কখনো, ডোবা মানে ছোট পুকুর, পুকুর তো পুকুর, তারপর দিঘী, তারপর হ্রদ তারপর সমুদ্দুর। 

তারপর তো সিমেন্ট তৈরী হয়ে গেলো, ইঁট বসিয়ে বসিয়ে সিমেন্ট দিয়ে জুড়ে দেবো। বাঁকা মিস্ত্রী ইঁট বসিয়ে কাজ করতো আর বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কথা বলত, "কিরে লোকে, এবার কি চাষ দিলি? "
লোকে মানে লোকু বা লখাই বলতো , "আর চাষ, বৃষ্টি নাই দেখেছ? এবার আশ্বিন মাসে ঢালবে, আর সে সময়েই  দেখবে জল ছাড়বে।"

বাঁকা মিস্ত্রীর নাম বাঁকা কেন কে জানে? বাঁকা বাড়ি বানালে সবাই ডাকে কেন? আর ও নিজেও তো বাঁকা না? তাহলে? আমি হাফপ্যান্ট আর চকচকে গেঞ্জি পরে বাঁকার নোংরা স্যান্ডো আর লুঙ্গির পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখতাম যদি আমায় একটু দেয় সিমেন্ট মারতে দেওয়ালে,  থ্যাপাৎ থ্যাপাৎ করে। বলতে পারতাম না, লজ্জা লাগতো পাছে না বলে দেয়। 

আমার সেই থেকে বড় শখ, রাজমিস্ত্রী হবার। থ্যাপ থ্যাপ করে সিমেন্ট লেপবো ভাড়া বেঁধে। আমি লোভীর মতো বারান্দায় দাঁড়াই,  সামনে ঝিলের পাশে শোঁ শোঁ করে গাড়ি চলে যায়, ঝিলের উপর শরৎ এর নীল আকাশে মেঘ ওড়াওড়ি করে। কাজ আছে, কল আছে এক্ষুনি চলে যেতে হবে তবু আমি দেখি কেমন করে বিল্ডিং উঠছে। 

সেদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা গম্ভীর ফড়িং এলো, ঠিক আমার পাশেই এসে বসেছে খানিক। মন টন খারাপ লাগছিলো, এমনিই, সেই কাজ আপিস,  বাড়ি ভাল্লাগেনা আমার পালাই পালাই মনে হয়। তেমন সময়েই ফড়িংটা এলো। ওই টুকুন ফড়িং তার আবার লম্বা একটা দাড়ি! আমি পাত্তাও দিইনি। কেনই বা দেবো! একটা ফড়িং বই তো না, ওব্বাবা দেখি ফড়িংটা ফস করে আমার সাথে কথা বলে উঠলো, "কিহে মন খারাপ নাকি? "
আমি তো হাঁ!!
ভাবলাম নির্ঘাত ভুল শুনছি! মোবাইলটা চেক করলাম একবার।
  - সারাদিন মোবাইলে কি দেখো বলতো? নট এট অল ইন্টারেস্টিং ম্যান, নট এট অল। তার চেয়ে আমি গান গাইছি কেমন শোনো,
  টিঁয়াও ছুউউ কিঁয়াও খুউউ আরে ঢিকচ্যাক চ্যাক ঢিকচ্যাক চ্যাক, 
ওওওও গুরুক করে তামাক খেয়ে উড়ছো বটে খুব,আর জলের নীচে পানকৌড়ি দিচ্ছে কেমন ডুব, ওওওওও।

আমি অবাক হওয়া সেই মাঠাংবুরুর পর থেকে ছেড়েই দিয়েছি, তাও খানিক অবাক হয়েছি তো বটেই। তবে তার চেয়েও বেশী রাগ ধরেছে, বলা নেই কওয়া নেই, সেদিন ফড়িং, সে অমন গান শোনাবে কেন? তাও মানে মাথা হীন গান, তাও আবার ঠ্যাং নাচিয়ে! ইয়ার্কি পায়া হ্যায়?

  - চোওঅঅপ।  এলেন!  বলি এরকম যখন তখন গান গাইলেই হলো হ্যাঁ? আর এটা গান? ছোঃ!  আমার গান শুনে দেখো বরং, তোমায় তালিম দিতে পারি বটে, যদিও এখন আপিসে গাইবো না।

  - তুমি? তুমি গান গাইবে? খ্যা খ্যা খ্যা। ওহে তোমার গান শুনলে মনে হয় গরু ডাকছে, সেকথা সকলেই জানে। তুমি আর হাসিও না।
  - ফড়িংরা গানের কি বোঝে হে। বকম বকম খালি। যাকগে আমি কাজ করতে গেলাম। দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে গেলে বাকি কথা হবে।
  - বেশ একটা পোকা কালেক্ট করে নিই এসময়ে।

লাঞ্চ করে আসার পর সে ফের এলো, তারও লাঞ্চ শেষ। আচ্ছা ওর কথা ওর মুখেই শোনো -

তোমরা আমায় পাগল বলতে পারো, খামোখা কাজ নেই কিছু নেই এমন চমৎকার দুপুরে,  মানুষদের আশেপাশে ঘোরার কোনো মানেই নেই। আসলে মাঠাংবুরু আমার বন্ধু কিনা, সে গেছে দুনিয়া দেখতে, যাবার সময় এই মহারাজের কথাও বলে গেছে। দেখলাম ছেলেটা একা একা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে, ভাবলাম যাই চারটে কথা বলে আসি। মানুষ আসলে ভালো না মোটেও, আমার গ্রামের কিনটো, তার বাবাকে তো কচুর রস খাইয়ে একটা মোটা মানুষেই মেরেছিলো। তাও মাঠাংবুরু বলল যখন, মনে হয় এ ছেলেটা অত বদ হবে না। মাঠাংবুরুর থেকেই তো আমি মানুষের ভাষা শিখলাম। ও আমার নাম বলিনি বুঝি? আমি  কপ্টুম্যাক। হেব্বি না নামটা? আসলে এ নাম খানা আমি নিজেই রেখেছি। বেশ একটা ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো ভাব আসে না নামটা শুনলে? ট্যাঙ্গো কি জানো না? মহা বোকাটে তো তোমরা!! আরে ট্যাঙ্গো একটা ফূর্তির ব্যাপার। 

যাকগে,  যা বলছিলাম, আমি এখানে থাকিনা, শহরে তেমন পোকা টোকা মেলে না কিনা।  আমি এখান থেকে অনেএএক দূরে একটা নদীর ধারে থাকি। আমাদের গ্রামটা একটু দূরেই, আমি একাই থাকি, নদীর ধারে ঘাসের উপর শুয়ে দোল খাই, আর পোকা ধরি। মানে ইয়ে পুরোপুরি একা থাকি না,  আমার গিন্নীও থাকেন আর কি, সাথে। তবে রোজ রোজ না,  পাগল নাকি মশাই রোজ থাকলেই চিত্তির। এই যে একটু হালকা খুউব সামান্য একটা ভুঁড়ি হয়েছে, এ নিয়ে রোজ গঞ্জনা মশাই, কেন মর্ণিং ওয়াকে যাইনা, এতো বয়স হলো সঠিক পোকা কেন ধরে আনিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে বউটোম্যাক মানে আমার বউ, সে কিছুদিন মানুষের আশেপাশে থেকেছিলো কিনা, ওতেই গন্ডগোল হয়েছে। যাই হোক আজকাল তাই পোকা ধরার অছিলায়, এদিক সেদিক চলে যাই। আমি আসলে একটু আলসে ফূর্তিবাজ ফড়িং। মাঠাংবুরুর মতো দুনিয়া দেখার শখ আমার নেই বাবা। কিইই দরকার পাহাড়ে উঠে কষ্ট করে, ছবি দেখে নে না বাবা। আর সত্যি বলতে কি আমাদের তাল গাছের মাথায় উঠলেই বা কম কি পাহাড়?  তা যা বলছিলাম, এদিক সেদিক বেরোই, তারপর একটু ভালো পাতা দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। পোকা টোকা কিছু না কিছু জুটেই যায়। পেট ভরা থাকলেই ট্যাঙ্গো নাচি, তারপর মন কেমন করলে বাড়ি ফিরে যাই। সোজা তো। বউটোম্যাকও কদিন না দেখে মন খারাপ করে, পোকা গুলোকে কষিয়ে রাঁধে,  তারপর হাল্কা মধু খেয়ে  কার্টুন দেখতে বসে যাই। আহা তোমাদের মতো নকল না,  সত্যিকারের সব। আচ্ছা এক দুটো বলি, সেদিন দেখি একটা হুলো মন দিয়ে মাটিতে কি যেন দেখছে। পিছন থেকে  বাদামী কুকুরটা,যেটা সব চেয়ে বিটলে, সারাক্ষন চোখ বুজে শুয়ে থাকে আর নিরীহ কেউ দেখলেই  ঘেউ ঘেউ করে তাড়া দেয় আর যে তারা ভয় খায় অমনি খ্যাক খ্যাক করে হাসে  সেইটে দেখি পা টিপে টিপে বিড়ালটার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিড়ালটা যেই চমকে উঠে দু পা পিছিয়েছে অমনি ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করেছে, তারপর তো হেব্বি রেস হয়ে গেলো।

তা এসব দেখে আরামেই দিন কাটাই। বেশী দৌড়ঝাঁপ ভাল্লাগেনা যাই বলো।  মহারাজের সাথে আলাপ হয়ে ভালোই হলো, আমায় বলেছে ওর একটা মস্ত পোকা আছে, যেটা কিনা দূর থেকে ও আকাশে ওঠাতে পারে আবার নামাতে পারে, অনেকটা আমার মতোই দেখতে। ওইটাতে একদিন বসিয়ে দেবে। একটু ভয় পাচ্ছি বটে, আমার আবার অত সাহস নেই, কিন্তু আমার মতো জিনিস যার আবার প্রাণ নেই,  কথা বলতে পারেনা, তেমন জিনিস এর  পিঠে চড়ার ইচ্ছেও হচ্ছে মন্দ না। সে দেখা যাবে, তেমন বুঝলে উড়ে যাবো।  

কপ্টুম্যাক এর সাথে আমার আবার দেখা হবে,  ওকে আমার রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টার টাতে চড়াবো। দেখি ব্যাটার কেমন লাগে। পাশের লোকগুলোর কাজ শেষ আজকের মতো, আমিও যাই বাজে কাজ গুলো সেরে নিই। কপ্টুম্যাক যদি ভয় না পায় হেলিপ্টারে চড়ে, তাহলে ওকে দিয়ে ওই বড় বিল্ডিংটা আছে না? যাতে কেউ থাকেনা? ওখানে খোঁজ নিতে পাঠাবো। ওখানে নাকি একটা ভূত এসে থাকছে। আহারে বেচারা, একা একা আছে হয়তো, নিয়ে নেবো ওটাকেও আমাদের দলে। তারপর? কিই জানি তারপর কী হবে। গল্প শোনাবো খন।

4 comments:

  1. আমি আছি তোমার ব্লগের নিয়মিত পাঠক, প্রদীপ্ত। গল্প তো ভালো হয়েইছে, তোমার লেখার একটা স্ট্রং ভয়েস তৈরি হয়েছে সেটা আরও ভালো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ কুন্তলাদি। বড় ভালো লাগলো তোমার কমেন্ট পেয়ে।

      Delete