Wednesday, August 29, 2018

কপ্টুম্যাক

একটা কথা, কেউ বাই চান্স যদি পড়েন এ গল্প এ ব্লগে, খারাপ ভালো মন্তব্য করলে বাধিত হই। অন্তত বুঝতে পারা যায় ব্লগটা মৃত কিনা। 

************************************

মাঠাংবুরু ঘুরতে গেছে, লায়েক হয়েছে কিনা, পাত্তা দেয়না আজকাল। কি করে জানলাম? ওর বন্ধুদের কাছ থেকেই খবর পাই মশাই।

#কপ্টুম্যাক
********************************************

ভুটুটুটুটু...একটানা আওয়াজ হয়ে যায়, পাইলিং না কি করছে কে জানে! সিমেন্ট বালি সিমেন্ট বালি, বস্তা সাজিয়ে রেখেছে, ঠিক তারপাশেই পাইপে করে করে জল বেরিয়ে ছোট্ট একটা ডোবা হয়েছে। এখন ডোবা লাগছে তার আগের অংশটা খাল....ছোটবেলায় এটাই মস্ত পুকুর হতো। তার আগে খানিক নদী।
ভারী ইচ্ছে করছে ওই সিমেন্ট বালি দিয়ে তৈরী চৌকো সিংহাসনে উঠতে। ওঠা যায় না, বড় হয়ে গেছি কিনা! ট্রাক ড্রাইভারের পরেই আমার পছন্দ ছিলো রাজমিস্ত্রি হবার। সিমেন্টে বালি মিশিয়ে মিশিয়ে খপাৎ খপাৎ করে ওই চ্যাটালো মস্ত থালায় দিতাম, তার আগে গোল করে সিমেন্ট বালি দিয়ে ঘিরে জল দেওয়া হবে, তারপর চারদিক থেকে সিমেন্ট বালি জলে দিতে দিতে জল ফুরিয়ে যাবে, আমাদের খাল বিল গুলো যেমন বুজে যাচ্ছে। আচ্ছা বিল বলে কেন? বিল আমি দেখিনি কখনো, ডোবা মানে ছোট পুকুর, পুকুর তো পুকুর, তারপর দিঘী, তারপর হ্রদ তারপর সমুদ্দুর। 

তারপর তো সিমেন্ট তৈরী হয়ে গেলো, ইঁট বসিয়ে বসিয়ে সিমেন্ট দিয়ে জুড়ে দেবো। বাঁকা মিস্ত্রী ইঁট বসিয়ে কাজ করতো আর বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কথা বলত, "কিরে লোকে, এবার কি চাষ দিলি? "
লোকে মানে লোকু বা লখাই বলতো , "আর চাষ, বৃষ্টি নাই দেখেছ? এবার আশ্বিন মাসে ঢালবে, আর সে সময়েই  দেখবে জল ছাড়বে।"

বাঁকা মিস্ত্রীর নাম বাঁকা কেন কে জানে? বাঁকা বাড়ি বানালে সবাই ডাকে কেন? আর ও নিজেও তো বাঁকা না? তাহলে? আমি হাফপ্যান্ট আর চকচকে গেঞ্জি পরে বাঁকার নোংরা স্যান্ডো আর লুঙ্গির পাশ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখতাম যদি আমায় একটু দেয় সিমেন্ট মারতে দেওয়ালে,  থ্যাপাৎ থ্যাপাৎ করে। বলতে পারতাম না, লজ্জা লাগতো পাছে না বলে দেয়। 

আমার সেই থেকে বড় শখ, রাজমিস্ত্রী হবার। থ্যাপ থ্যাপ করে সিমেন্ট লেপবো ভাড়া বেঁধে। আমি লোভীর মতো বারান্দায় দাঁড়াই,  সামনে ঝিলের পাশে শোঁ শোঁ করে গাড়ি চলে যায়, ঝিলের উপর শরৎ এর নীল আকাশে মেঘ ওড়াওড়ি করে। কাজ আছে, কল আছে এক্ষুনি চলে যেতে হবে তবু আমি দেখি কেমন করে বিল্ডিং উঠছে। 

সেদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটা গম্ভীর ফড়িং এলো, ঠিক আমার পাশেই এসে বসেছে খানিক। মন টন খারাপ লাগছিলো, এমনিই, সেই কাজ আপিস,  বাড়ি ভাল্লাগেনা আমার পালাই পালাই মনে হয়। তেমন সময়েই ফড়িংটা এলো। ওই টুকুন ফড়িং তার আবার লম্বা একটা দাড়ি! আমি পাত্তাও দিইনি। কেনই বা দেবো! একটা ফড়িং বই তো না, ওব্বাবা দেখি ফড়িংটা ফস করে আমার সাথে কথা বলে উঠলো, "কিহে মন খারাপ নাকি? "
আমি তো হাঁ!!
ভাবলাম নির্ঘাত ভুল শুনছি! মোবাইলটা চেক করলাম একবার।
  - সারাদিন মোবাইলে কি দেখো বলতো? নট এট অল ইন্টারেস্টিং ম্যান, নট এট অল। তার চেয়ে আমি গান গাইছি কেমন শোনো,
  টিঁয়াও ছুউউ কিঁয়াও খুউউ আরে ঢিকচ্যাক চ্যাক ঢিকচ্যাক চ্যাক, 
ওওওও গুরুক করে তামাক খেয়ে উড়ছো বটে খুব,আর জলের নীচে পানকৌড়ি দিচ্ছে কেমন ডুব, ওওওওও।

আমি অবাক হওয়া সেই মাঠাংবুরুর পর থেকে ছেড়েই দিয়েছি, তাও খানিক অবাক হয়েছি তো বটেই। তবে তার চেয়েও বেশী রাগ ধরেছে, বলা নেই কওয়া নেই, সেদিন ফড়িং, সে অমন গান শোনাবে কেন? তাও মানে মাথা হীন গান, তাও আবার ঠ্যাং নাচিয়ে! ইয়ার্কি পায়া হ্যায়?

  - চোওঅঅপ।  এলেন!  বলি এরকম যখন তখন গান গাইলেই হলো হ্যাঁ? আর এটা গান? ছোঃ!  আমার গান শুনে দেখো বরং, তোমায় তালিম দিতে পারি বটে, যদিও এখন আপিসে গাইবো না।

  - তুমি? তুমি গান গাইবে? খ্যা খ্যা খ্যা। ওহে তোমার গান শুনলে মনে হয় গরু ডাকছে, সেকথা সকলেই জানে। তুমি আর হাসিও না।
  - ফড়িংরা গানের কি বোঝে হে। বকম বকম খালি। যাকগে আমি কাজ করতে গেলাম। দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে গেলে বাকি কথা হবে।
  - বেশ একটা পোকা কালেক্ট করে নিই এসময়ে।

লাঞ্চ করে আসার পর সে ফের এলো, তারও লাঞ্চ শেষ। আচ্ছা ওর কথা ওর মুখেই শোনো -

তোমরা আমায় পাগল বলতে পারো, খামোখা কাজ নেই কিছু নেই এমন চমৎকার দুপুরে,  মানুষদের আশেপাশে ঘোরার কোনো মানেই নেই। আসলে মাঠাংবুরু আমার বন্ধু কিনা, সে গেছে দুনিয়া দেখতে, যাবার সময় এই মহারাজের কথাও বলে গেছে। দেখলাম ছেলেটা একা একা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে, ভাবলাম যাই চারটে কথা বলে আসি। মানুষ আসলে ভালো না মোটেও, আমার গ্রামের কিনটো, তার বাবাকে তো কচুর রস খাইয়ে একটা মোটা মানুষেই মেরেছিলো। তাও মাঠাংবুরু বলল যখন, মনে হয় এ ছেলেটা অত বদ হবে না। মাঠাংবুরুর থেকেই তো আমি মানুষের ভাষা শিখলাম। ও আমার নাম বলিনি বুঝি? আমি  কপ্টুম্যাক। হেব্বি না নামটা? আসলে এ নাম খানা আমি নিজেই রেখেছি। বেশ একটা ট্যাঙ্গো ট্যাঙ্গো ভাব আসে না নামটা শুনলে? ট্যাঙ্গো কি জানো না? মহা বোকাটে তো তোমরা!! আরে ট্যাঙ্গো একটা ফূর্তির ব্যাপার। 

যাকগে,  যা বলছিলাম, আমি এখানে থাকিনা, শহরে তেমন পোকা টোকা মেলে না কিনা।  আমি এখান থেকে অনেএএক দূরে একটা নদীর ধারে থাকি। আমাদের গ্রামটা একটু দূরেই, আমি একাই থাকি, নদীর ধারে ঘাসের উপর শুয়ে দোল খাই, আর পোকা ধরি। মানে ইয়ে পুরোপুরি একা থাকি না,  আমার গিন্নীও থাকেন আর কি, সাথে। তবে রোজ রোজ না,  পাগল নাকি মশাই রোজ থাকলেই চিত্তির। এই যে একটু হালকা খুউব সামান্য একটা ভুঁড়ি হয়েছে, এ নিয়ে রোজ গঞ্জনা মশাই, কেন মর্ণিং ওয়াকে যাইনা, এতো বয়স হলো সঠিক পোকা কেন ধরে আনিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে বউটোম্যাক মানে আমার বউ, সে কিছুদিন মানুষের আশেপাশে থেকেছিলো কিনা, ওতেই গন্ডগোল হয়েছে। যাই হোক আজকাল তাই পোকা ধরার অছিলায়, এদিক সেদিক চলে যাই। আমি আসলে একটু আলসে ফূর্তিবাজ ফড়িং। মাঠাংবুরুর মতো দুনিয়া দেখার শখ আমার নেই বাবা। কিইই দরকার পাহাড়ে উঠে কষ্ট করে, ছবি দেখে নে না বাবা। আর সত্যি বলতে কি আমাদের তাল গাছের মাথায় উঠলেই বা কম কি পাহাড়?  তা যা বলছিলাম, এদিক সেদিক বেরোই, তারপর একটু ভালো পাতা দেখে ঘুমিয়ে পড়ি। পোকা টোকা কিছু না কিছু জুটেই যায়। পেট ভরা থাকলেই ট্যাঙ্গো নাচি, তারপর মন কেমন করলে বাড়ি ফিরে যাই। সোজা তো। বউটোম্যাকও কদিন না দেখে মন খারাপ করে, পোকা গুলোকে কষিয়ে রাঁধে,  তারপর হাল্কা মধু খেয়ে  কার্টুন দেখতে বসে যাই। আহা তোমাদের মতো নকল না,  সত্যিকারের সব। আচ্ছা এক দুটো বলি, সেদিন দেখি একটা হুলো মন দিয়ে মাটিতে কি যেন দেখছে। পিছন থেকে  বাদামী কুকুরটা,যেটা সব চেয়ে বিটলে, সারাক্ষন চোখ বুজে শুয়ে থাকে আর নিরীহ কেউ দেখলেই  ঘেউ ঘেউ করে তাড়া দেয় আর যে তারা ভয় খায় অমনি খ্যাক খ্যাক করে হাসে  সেইটে দেখি পা টিপে টিপে বিড়ালটার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিড়ালটা যেই চমকে উঠে দু পা পিছিয়েছে অমনি ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করেছে, তারপর তো হেব্বি রেস হয়ে গেলো।

তা এসব দেখে আরামেই দিন কাটাই। বেশী দৌড়ঝাঁপ ভাল্লাগেনা যাই বলো।  মহারাজের সাথে আলাপ হয়ে ভালোই হলো, আমায় বলেছে ওর একটা মস্ত পোকা আছে, যেটা কিনা দূর থেকে ও আকাশে ওঠাতে পারে আবার নামাতে পারে, অনেকটা আমার মতোই দেখতে। ওইটাতে একদিন বসিয়ে দেবে। একটু ভয় পাচ্ছি বটে, আমার আবার অত সাহস নেই, কিন্তু আমার মতো জিনিস যার আবার প্রাণ নেই,  কথা বলতে পারেনা, তেমন জিনিস এর  পিঠে চড়ার ইচ্ছেও হচ্ছে মন্দ না। সে দেখা যাবে, তেমন বুঝলে উড়ে যাবো।  

কপ্টুম্যাক এর সাথে আমার আবার দেখা হবে,  ওকে আমার রিমোট কন্ট্রোল্ড হেলিকপ্টার টাতে চড়াবো। দেখি ব্যাটার কেমন লাগে। পাশের লোকগুলোর কাজ শেষ আজকের মতো, আমিও যাই বাজে কাজ গুলো সেরে নিই। কপ্টুম্যাক যদি ভয় না পায় হেলিপ্টারে চড়ে, তাহলে ওকে দিয়ে ওই বড় বিল্ডিংটা আছে না? যাতে কেউ থাকেনা? ওখানে খোঁজ নিতে পাঠাবো। ওখানে নাকি একটা ভূত এসে থাকছে। আহারে বেচারা, একা একা আছে হয়তো, নিয়ে নেবো ওটাকেও আমাদের দলে। তারপর? কিই জানি তারপর কী হবে। গল্প শোনাবো খন।

Monday, August 27, 2018

ভুতুড়ে আলাপ


ভারী মুশকিলে পড়া গেছে। এক হাতে ইলিশ মাছ এক হাতে কফির কাপ, ওদিকে চশমাটা চুলকাচ্ছে। চশমাটা আসলে গত পঞ্চাশ বছর ধরে পরতে পরতে ওটাতেও চুলকায় আজকাল, সেই মানুষের চাকরি ছাড়া ইস্তক চলছে। না না ভূত না দিব্যি বর্তমানে আছি, কফি, কাবাব সব খাচ্ছি ভূত আবার কি? তাছাড়া ভূতেদের আমি ভয় পাই মশাই, ফস করে এই গা ছমছমে রাতে ভূত টুত বললে ভাল্লাগেনা বলে দিচ্ছি আগেই। 
উফফ, ভারী চুল্কুচ্ছে তো, "হেই ম্যাডাম একটু শুনবেন? আরে হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, আপনার চেহারার ফাঁক দিয়ে তো আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না যে আর কাউকে বলব"।
- কী বললেন? লজ্জা করে না আপনার? এরকমভাবে,  অপরিচিত মহিলাকে মোটা বলে ডাকেন? ছিঃ ছিঃ, এই কি আপনাদের কর্ম সংস্কৃতি,  থুড়ি ডাক সংস্কৃতি?
- ধোর বাবা। ডাক হাঁক ছাড়ুন দিকি, চশমাটা একটু চুলকে দিন আগে তারপর ডাকের মাংস খাইয়ে দেবো। তাছাড়া ইয়ে মোটা বলিনি, আর কেউ নেই সেটাই বলছিলাম।
- দুঃখিত মশাই।  পারলাম না। আমি, "মানুষ চাকরি" করার সময় অব্দি আমার কান চুলকানোর বাডস ছিল, মানুষের কাজ আজকাল করিনা। তাছাড়া আমার বয়স কম, সবে চল্লিশ বছর মানুষ হয়ে নেই, এখন আমার কাজ করা মানা। 
এহ কচি খুকি এলেন আমার রে। চল্লিশ বছরের বুড়ি নাবালিকা হয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। বিড়বিড় করলাম আমি। অস্বস্তিটা বেড়েই চলেছে আর ইনি এদিকে ইয়ে শুরু করেছেন। মহা যন্ত্রনা হলো। এই হতো আমার গিন্নী, বললেই,  " উফফ, বড় জ্বালাও জানো", বলে টলে ঠিক চুল্কে দিতো। কোথায়  আছে কে জানে, একা একা বেশ ভালোই আছি, যখন ইচ্ছে যা ইচ্ছে করছি, কোনো দায় দায়িত্ব নেই, একথা সত্যি যেমন এইসব দরকারে বেজায় মুশকিল হয় এও সত্যি, যাকে তাকে বলতে ভাল্লাগেনা মোটেও। তাছাড়া, এখন গিয়ে মাছ ভাজতে হবে,  গিন্নী থাকলে একটু ঘ্যানঘ্যান করলে ভেজেও দিতো। নাহ কাল দেখি খুঁজে দেখবো,  এদ্দিনে মানুষ হয়ে নেই আশা করি, বছর দশেকের  ছোটই তো ছিলো। 

-কি বিড়বিড় করছেন হ্যাঁ? গালাগালি করছেন নাকি? দেখুন আমি কিন্তু ভিডিও করে ভাইরাল করে দিতে পারি। বুড়ো বলে পার পাবেন না।
এহ যন্ত্রনা তো, হোঁৎকা বুড়িটা জ্বালালে তো। এই ভিডিও ভাইরালের মানুষটা এখনো খুলিতে ধরে রেখেছে দেখছি। এ বয়সে এতো উৎপাত সওয়া যায় না। দেখি মিষ্টি কথায় তুষ্ট করি।

- আরে না না ম্যাডাম। আপনাকে গালাগালি করতে পারি। আপনার এতো মিষ্টি ব্যবহার, এতো মিষ্টি হাসি। জানি আপনার অল্প বয়স তাও,  মানে এই চশমাটা একটু চুলকে দেন যদি।
- আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। কই দেখি। এহেহে কিই ময়লা ম্যাগো! আপনি বুঝি চান করেন না? 
-না না,  ওটা আপনার চোখের ভুল, ওটা রঙটাই অমন, বয়স হয়েছে কিনা তাই ভুল দেখছেন হয়তো।
-বয়স হয়েছে মানে!!
-আহা না না মানে বলছি আমার চশমার বয়স হয়েছে কিনা।
-চশমারই বা কি এমন বয়স হয়েছে শুনি, মরে যাবার আগে আমার সাথেই তো গিয়ে বানালে, বউবাজার ঘুরে ঘুরে হয়রান করিয়ে দিয়েছিলে। একটা ফিশফ্রাই ঘুষ দিয়েছিলে খালি। 
-অ্যাঁ!! মানে ইয়ে তুতুমি, তুমি গিন্নী হ্যাঁ?
-তো কি ভেবেছিলে? সুন্দরী মেয়ে দেখে ছক করে বেড়াবে, একে ওকে দিয়ে চশমা চুলকিয়ে নেবে আমি টেরটি পাবো না? খুব ফূর্তি হয়েছে,এই রাত দুপুরে কফি খাচ্ছো যে? ভুঁড়িটার দিকে খেয়াল আছে? বাড়ি চলো পার্কে বসে ঝাড়ি মারা বের করছি।
-ইয়ে মানে এসব যন্ত্রণা তুমি ছাড়া আর কেইই বা করবে কিন্তু ইয়ে তোমায় এমন দেখতে হয়ে গেলো কি করে? মানে ওজনে একই আছো মনে হচ্ছে কিন্তু ইয়ে মুখ তো একই রয়ে যায় যারা এ মুলুকে আসে?তাছাড়া এদ্দিন ছিলে কোথায়? 
- রয়ে যায়, আমারও আছে। তোমায় ওয়াচ করবো বলে ফেসিয়ালের মুখোশটা পরেই চলে এসেছি। এই দেখো। আমিও একটু ঘুরে ফুরে এলাম, তোমার কাছে এলেই তো এইটা করে দাও ওইখানে চলো এই সেই করে জ্বালিয়ে মারবে। 
-ভালোই করেছো ইয়ে না মানে আমি তো খুবই মিস করছিলাম।  আহাহা, গিন্নী কিই আনন্দ যে হলো রে। ম্মুউউয়ায়াহ। ইলিশটা পোলাওই করো আজ তবে হ্যাঁ? আর তোমার সিগ্নেচার কাবাব? প্লিইজ?
-হুহ আদিখ্যেতা যত। এতোক্ষণ তো চিনতেও পারোনি, পরনারী দিয়ে চশমা চুলকাচ্ছো। তাছাড়া মোটা আরো কি কি সব বলছিলে।
- আহাহা, রেগে গেলেই তুমি লজিকে গোলমাল করে ফেলো। একই সাথে ছক আর মোটা বলা হয়? 
-তুমি যা হারামীর হাট হতেই পারে। হুহ।
-আচ্ছা আচ্ছা কদ্দিন পর দেখা বলোতো। অমন রাগ করলে চলে। চলো চলো আমি হেব্বি কফি বানানো শিখেছি,চলো এদ্দিন কি কি করলে তার  গল্প শুনি, তার আগে কই এদিকে এসো দেখি এদিকে।

Sunday, August 19, 2018

গোল্লাছুট


কিছু না কিছু সকলেই পারে৷ কেউ ভালো গান গায়, কেউ আঁকে,  কেউ বাজায়, আমি কিছুই পারিনা এসব তাই আমি খালি মানুষ বানাই। মানুষ বানানো বুঝলে না? আচ্ছা বলছি, আমরা হলাম গিয়ে এক রকম প্রাণী,  যাদের খেলনা বাটি হলো গিয়ে এই পৃথিবীর মতো নানান গোলক। আমাদের জোনটার জন্য পৃথিবী বরাদ্দ হয়েছে। মূল ডিজাইনটা অনেক আগেই ঠিক হয়ে গেছিলো, এখন যা চলছে ওই ডিজাইনের উপর বেস করেই এনহ্যান্সমেন্ট বলতে পারো। আসলে একেবারে বসে তো থাকা যায় না, এবার তুমি কি করছ না করছ তোমার রিসোর্স নিয়ে তা রিপোর্ট করতে হয়। এবার তোমায় দিয়ে যদি কোনো প্রফিটই না হয় মানে তোমার জোন থেকে তাহলে তোমাদের হটিয়ে দেওয়া হবে। প্রফিট বলতে তোমাদের টাকা পয়সা ভেবো না আবার। প্রফিট মানে ধরো পৃথিবীতে একটা সুর সৃষ্টি হলো, সেই সুর ঝরনার জলে মিশলে নীল সাদা পাথর তৈরী হয়, তারপর ধরো জঙ্গলের গন্ধের সাথে মায়ের আঁচলের গন্ধ মিক্স করে যে আরাম তৈরী হলো, কিংবা নীল ঝকঝকে আকাশের বুকে যদি একটা পদ্মপাতায় বসে পিঁপড়ে আর মাছে গল্প করে তাহলে সেই রঙ দিয়ে রামধনু মেরামত করা যায়, এইসব গুলোই প্রফিট। এরকম নানান জিনিস আছে, কিন্তু কিছুই না হলে তাহলে আর পৃথিবী পোষা কেন!

আমাদের জোনে সবাইই যে আমার মতো কিছু পারে না তা নয়, আমিই খালি এরকম হয়েছি। অনেকে মানুষ বানায় আবার সুন্দর করে আঁকে। কেউ কেউ গাছ বানায় আবার মানুষও বানায় এরকম।  যেহেতু আমি খালি মানুষ বানাই, আমার হাতে বেশ খানিক সময় থাকে। মানুষ বানাই মানেই যে সে যা কাজ কর্ম করবে তা বলে দিইনা, তাহলে ব্যাপারটা ভারী বোরিং হয়ে যাবে বলেই আমাদের তরফ থেকে এটা করতে অস্বীকার করা হয়েছিলো। সেও অনেক আগেকার গল্প, যাই হোক। আমি মানুষ বানাই আর দেখি। আসলে আমার তেমন বন্ধু বান্ধবও নেই,  সেই ছোটবেলা থেকেই। আমায় দেখতে একটু অন্যরকম কিনা। কিরকম? তোমাদের বললে ঠিক বুঝবে না, আসলে আমরা কেমন সেটাই তো তোমাদের বোঝানো যাবে না, তাহলে অন্যরকমটাই বা কেমন করে বোঝাই! 

আচ্ছা চেষ্টা করছি। এই যে আমাদের খেলনাটা, মানে পৃথিবীটা, আহাহা চটো কেন, তোমরা আমাদের দেখতে পাও না কিনা তাই ভাবো এ তোমাদের, আমরাও যেমন খেলতে খেলতে ভাবি এ আমাদের, আসলে কারোরই না। আসলে এই ধরো আমাদের প্রত্যেককে তো একরকম দেখতে না,  আমাদের সবার নানান রকম জিনিস তোমরা দেখতে পাও কিন্তু। লেজ, শিং,  ক্ষুর, দাঁত, হাত, পা, চোখ, জিভ, নাক, স্বর, ভাব সব সব কিছু আমাদের কারোর না কারোর আছে, এবার আমাদের মধ্যে যখন কেউ কিছু তৈরী করে করে সে তার একটা বৈশিষ্ট্য ঢুকিয়ে দেয়। ধরো না কেন এই লেজ, ব্যাপারটা খুবই কমন কিনা তাই দেখবে তোমাদের আশেপাশে যারা আছে তাদের লেজ আছে বেশীরভাগেরই।  এবার আমায় দেখতে একেবারেই আলাদা, মানে আমার লেজ শিং ক্ষুর ইত্যাদি কিছুই নেই। তাছাড়া আমি আগেই বলেছি, আমার বিপদ সেন্স করার ক্ষমতা থেকে গান বাজনা করার ক্ষমতা কিছুই নেই। তাই আমি দেখি বেশী, নিজের মনে।

মানুষ হয়েও গেছে অনেক। আর মানুষ না ছাড়লেও হবে, কিন্তু সব মানুষ তো আমরা তৈরী করি না, কিছু কিছু মানুষ আবার মানুষ নিজেরাও তৈরী করে। ফলে ব্যাপারটা ক্রমেই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এ গোল্লাটার প্রজেক্ট হয়তো আমরা আর কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট করে দেবো। খুব কিছু পাওয়া যাচ্ছে না এখান থেকে, খালি মানুষ গুলো দিনরাত কাটাকাটি মারামারি করছে, তেমন ভালো কিছু তৈরী হচ্ছে না, মানুষ বাদে বাকি প্রাণীগুলোও ঠিক নিজেদের গ্রুম করতে পারলো না, মেলে ধরতে পারলো না। এইযে পিঁপড়ে এদের এতো বুদ্ধি দেওয়া হলো,  বৃষ্টি ঝড় সেন্স করতে পারার ব্যাটারা চিনির দানা খুঁজেই গেলো। 

এসব নিয়ে আমরা খুব বেশী ভাবি তা না, করুক যা ইচ্ছে, ইচ্ছে থাকলে পৃথিবীটা বাঁচিয়ে নেবে সবাই মিলে না হলে মরে যাবে এই তো কথা! আমাদের অনেক অন্য জায়গা আছে, সেখানে ফের নতুন করে সব শুরু হবে। হ্যাঁ কোনো প্রজেক্ট এর সাপোর্ট বন্ধ হয়ে গেলে খানিক কর্মশূন্যতা তৈরী হয় বটে, উপরের কর্তাদের কিছু চাপও হয় কিন্তু আমাদের রিসোর্স অনেক, আমরা জানি কিভাবে ফের রিইনভেন্সটমেন্ট করে নিতে হয়। তাই আমরা কেউ চাপ নিই না। খালি আমি,  আমি তো ওদের মতো হইনি, ফলে এই হেরো লোকগুলোর উপর আমার আলতো একটা মায়াও আছে, বোকাগুলোর উপর রাগ যেমন আছে তার সাথেই। 

তোমরা যখন একটা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাও অন্য শহরে, কেমন মায়া মায়া চোখে দেখো না সব? এটাও আসলে ইনহেরিটেন্স,অল্প করে মায়া ব্যাপারটাও দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তোমাদের এ গল্প শোনাচ্ছি কেন? আমার মনে হয় তোমরা যারা এ গল্প পড়ছ তারা হয়তো একটু আলাদা, পড়াশোনা বা খেলাধূলো বা গান বাজনা এসব কোনো কিছুতে সেভাবে দাগ কাটোনি কখনোই, খারাপ কাজও খুব বেশী করতে পারোনি যেমন ভালো কাজও করোনি। তোমরা আসলে আমার তৈরী মানুষ, সবাই না, যারা এসব কিছুর মানে খুঁজে পাওনা, কোনো জায়গাতেই থাকো না যেন তারা।  বাকিরাতো এ গল্প শুনতে পাবে না। তোমাদের মন খারাপ হয় না? এমনি এমনি মন খারাপ? জানি তো আমারও হয়। কী করবে তখন? আমি জানিনা। বরং তোমাদের বলি আমি সারাদিন কেমন সব লোক দেখি। 

ওই দেখো বাইকে করে দুটো লোক যাচ্ছে। একটা গুঁফো লোক যে চালাচ্ছে বাইক আর একটা দেড়ো লোক যে বাইকের পিছনে। কেমন নিস্পন্দ মুখ দেখো, এ নির্ঘাত নিজের কাজের জায়গায় খুব ভালো, আপিসের পর আড্ডা মারে, বাড়ি এসে বারমুডা কিংবা পাজামা পরে খালি গায়ে টিভি দেখতে বসে, মাঝে মাঝে বগল চুলকে নেয়, তারপর রাত বাড়লে এক থালা ভাত খেয়ে সিগারেট খেয়ে ঘুম যায়।
আচ্ছা ওই লোকটা দেখো, ফর্সা, ট্রিম করা দাড়ি, ব্রান্ডেড চশমা, গেঞ্জি, ফোন। এরও কেমন নিস্পন্দ মুখ। এও ওই রকমই করে, গান শুনতে শুনতে আপিস যায়, আপিসে কাজ করে তামাশা করে, শুক্রবারে বাইরে রেস্তোরাঁয় যায়, রাতে ল্যাপটপ কিংবা ফোনে থাকে খানিক তারপর ঘুম যায়।

বোরিং মনে হচ্ছে? তা তো হবেই এরা সব কটাই বোরিং, আচ্ছা চলো তোমায় একটু দূরে নিয়ে যাই। কোথায় যাবে? পাহাড় না সমুদ্র? সমুদ্র? তা বেশ, ওখানে লোক বেশী পাবে  বটে। ওই দেখো,  দুজন লোক তাদের বউ মেয়ে নিয়ে এসেছে। দুটো পাপড়িচাট কিনে শেয়ার করছে, লোকটার আরেকটু খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু বউটা খাবে বলে কম কম করে খাচ্ছে দেখছি। আবার বউটা কম কম খেয়ে মেয়েটাকে আর অন্য বউটাকে একটু দিচ্ছে, সে আবার একটু খেয়ে পাশের জনকে.......বড় মায়া হে বড় মায়া। 

আচ্ছা শামুক দেখবে? ওই দেখো, একটা শামুকের পিঠে একটা পিঁপড়ে চড়ে কেমন গল্প করছে। আমি ওদের নাম জানি, ওদের গল্প ওরা নিজেরাই এসে বলে যাবে খন। এদিকটা বড় ভীড়,  চলো একটা গান ভেসে আসছে ওই দিকে বালিয়াড়ির ওদিকটা থেকে। আমি গাইতে পারিনা বটে কিন্তু শুনতে ভালোবাসি বেজায়। তোমরা শুনতে পাচ্ছোনা না? স্বাভাবিক, জোরে জোরে তো গাইছে না কেউ। হাওয়ার সুর, ঝাউগাছের বাজনা সমুদ্রে ভোকাল...লিরিক্স? ওই যে মাছ গুলো ঘাইমারছে, আর লাল কাঁকড়া গুলো হুটোপুটি করতে করতে কি সব বলছে শোনো.... 
ওই দেখো একটা মেয়ে একটা পাখির ছানাকে কোলে করে তুলে নিয়ে গেল, ওইই দেখো বুড়ো মাঝি ভালোবেসে ছেলেটাকে কাঁকড়া দিচ্ছে একটা বেশী.....

তোমাদের উচ্ছন্নে যেতে আরো কিছু বাকি আছে মনে হয়। তোমাদের গোলকের এখনো কিছুদিন আয়ু আছে দেখছি।

Tuesday, August 14, 2018

সেই গল্পটা.….

এই ছবিটার গল্প আছে একটা।  
সে অনেকদিন আগের কথা। গাছ গুলো বলেছিলো তারা হবে প্রহরী। সমুদ্র যেন তাদের টপকে এগোতে না পারে। তারা হবে সীমানা। 

শুকনো ডাঙা আর ভেজা মাটির মাঝে মধ্যস্থতা করতো তারা, সার দিয়ে দিয়ে। কিন্তু ওই যা হয়, দীর্ঘদিন পাশে থাকতে থাকতে সব কঠিনও ক্রমে নরম হয়ে যায়। সমুদ্রের সাথে রোজ ছোঁয়াছুঁয়ি হতে হতে গাছটা যেন বুঝতে শুরু করে দিলো সমুদ্রকে। আর সমুদ্রও সারা দুনিয়ার ঢেউ এর গল্প এনে দিতো গাছটাকে। গাছটা বলতো ওপারের শুকনো ডাঙার গল্প, আকাশের পাখিদের গল্প, মেঘেদের গল্প অবশ্য দুজনেই জানত। 

গাছটা আরো বলত শিকড়ের গল্প। সমুদ্র এই একটা জিনিস একেবারেই বুঝতনা। সে অতল বোঝে, সে ভাঙচুর বোঝে, সে ডুব বোঝে কিন্তু আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকা? কেন? সমুদ্র বলত তুমি চলো আমার সাথে,  দেখবে কত অজানা দেশ, দেখবে কেমন গভীর জলের স্তব্ধতা, ঝড়ের হাওয়া উন্মাদ নাচ, উথালপাথাল আনন্দ, এখানে এই শুনশান জায়গায় কেন পড়ে আছো? কিই বা আছে এখানে? গরু, মানুষের আবর্জনা আর কখন আমি গল্প শোনাবো সেই অপেক্ষা!

গাছটা হাসতো। তা যে হবার নয়, সমুদ্রের ছটফটানিতে, অস্থির ঢেউ ছোঁড়ায়, আর তারপরেও ফিরে ফিরে আসা দেখে মিটমিটিয়ে হাসতো সে। তারপর একদিন সমুদ্র হলো বড় অবুঝ, সে উপড়ে নিয়ে যাবে গাছকে, দেখাবে সারা দুনিয়া, এতো কিছু দেখে, জয় করে গাছ নির্ঘাত বুঝবে কিই বোকামিই না করেছে এতোদিন। গাছ সমুদ্রের কথা শুনে ফের হাসে,  বলে বেশতো, কাল এসো সকালে।

সকালে আলো ফোটে, কিচিরমিচির করে পাখিদের কাজকর্ম শুরু হয়, হন্তদন্ত হয়ে সমুদ্র আসে, আজ সে গাছকে রাজী করিয়েছে, নিয়ে যাবে। এসে দেখে সোজা সটান গাছটা,  সোজা হয়েই অপেক্ষা করছে কিন্তু চুপ করে শুয়ে। মুখে তার হাসিটা তখনও লেগে। সমুদ্র ডাকে খুব ওঠো,  কথা বলো, এভাবে নিয়ে যেতে তো আসিনি আমি। সমুদ্রের কান্নায় বাতাসে নোনা হাওয়ার ঝড় বয়, তবুও গাছ আর ওঠে না।

সেই থেকে সমুদ্র এসে রোজ দেখে যায় তার প্রিয় গাছকে, ফিসফিসিয়ে বলে রোজ,  তোমায় নিয়ে যাবো একদিন, এভাবেই নিয়ে যাবো দেখো, তারপর দেখবো কেমন করে আমার সাথে কথা না বলে থাকো। তোমার আমি দুনিয়া দেখাবো, দেখবে   নীল মাছেরা যখন তোমার পিঠে চড়ে লাফাবে, তুমি আবার জেগে উঠবে। তোমার শিকড় তো আমি বুঝেছি গাছ,  সেই শিকড়েতো ভালোবাসাই আসল,  তবে আমার ভালোবাসায় নতুন শিকড় গজাবে না কেন? নতুন করে,  নতুন ভাবে?  

গাছ চুপ করে শুয়েই থাকে, সোজা সটান।  আর সমুদ্রটা রোজ বলেই যায়।


Wednesday, August 8, 2018

হিজিবিজি আঁকিবুঁকি


তো যা বলছিলাম, আমার আবার একটু নদী, জল এসব প্রীতি একটু বেশীই। বহুদিন আগে গাল্ফেরেনের সাথে টাকি গেছিলাম, সে নিয়ে বিস্তর ফ্যাচফ্যাচও করেছিলাম, ইয়ে মানে লিখেছিলাম। এক জ্ঞানী লোক বলেছেন, গাল্ফেনের সাথে ঘোরা জায়গা গুলো বউ এর সাথে ঘুরে দেখলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। গত সপ্তায় গাদিয়ারা আর তার আগের সপ্তাহে কোলাঘাট, বোম্বে রোড ধরে খুবই স্মুদ যাওয়া হয়েছিলো কিন্তু আবার বম্বে রোড না ধরে অন্য কোনো রাস্তায় যেতে মন করছিলো। তাই সে জ্ঞানী মানুষের পরামর্শ মনে রেখে, ফের টাকি।

ভেবেছিলাম, আজকাল রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে চুরুট খান যখন, নিশ্চিত ভাবে রাস্তা গুলো বেশ মাখন এর মতোই হবে। তবে আমার ভাবাটাই ভুল ছিলো, মাখনে কি ভালো করে দাঁড়ানো যায়? অমসৃন তলা না হলে হবে? পিছলে যাবে না চাকা? তাই বারাসাত পেরোতে না পেরোতেই দেখি গাড়িটা বেশ দুলকি চালে চলছে। আহা একই সাথে গাড়িও চড়ছি নৌকাতেও যাচ্ছি এ কি কম নাকি! গান চালালাম তাড়াতাড়ি, এ মুহূর্ত টার মানাসই, 'সাগরে উথালপাথাল বুকেও এই নৌকা চলে'।

সেই বাণে বাণে অন্ধকার দেখতো কুরুক্ষেত্রে সবাই, মনে আছে? খানিকপর আমিও দেখলাম, ইয়ে বাণে বাণে না, ধুলোয় ধুলোয়। তোমার ওই ধূলায় আমি ছিলেম, না কি যেন গান আছে না? কাচ তোলা বলে আমি ধুলো খাচ্ছিনা, কিন্তু উইন্ডস্ক্রীনটা বেশ রঙ বদলে গেছে।এরপর হলো বৃষ্টি শুরু, তেড়েই হলো। আমিও আর গর্ত গুলো একেবারেই বুঝতে অপারগ হয়ে নেচে নেচে চললাম। এরপর একবার থেমে দেখি বাহ বাহ, তেনার চ্যায়্রা ছবি বেশ খোলতাই হয়েছে। কাদার আঁচল দিয়ে গা মাথা ঢেকে চলেছেন।

তবে রাস্তায় চলার মজা হলো, খানিক জীবনের মতো, যখন একেবারেই হাল ছেড়ে দেওয়া গেলো, আর কিছুই পাবার নেই, আশা করার নেই তখন বেশ চমক মেলে। এই যেমন দেখছি রাস্তাটা বদলে আস্ত পিচের রাস্তা হয়ে গেলো, ওই দেখ না দেখ কেমন দুধারে মস্ত মস্ত গাছের ছায়া দিয়ে দিয়ে জুড়ে রেখেছে। জুড়ে থাকাই দরকার বড়, চোখ তুলে তাকাও একবার। ছায়া ছায়া রাস্তা শেষ কিন্তু রাস্তা এখনো গোটাই, ওই দেখো কেমন মাঠ পুকুর এক হয়ে গেছে সব, সারি সারি পাট শুকুচ্ছে রাস্তার দুপাশে, প্যাঁকাটি শুকোতে দিয়েছে।

রাস্তার দুধারে কত নতুন নতুন বাজার, জমকালো সব নামের জায়গা। মিষ্টির দোকান গুলো এসব গাঁ গঞ্জ জায়গায় যেমন হয় তেমনই, সার সার রসগোল্লা আর পান্তুয়া আর দানাদার। ভোঁ ভোঁ মৌমাছি। মিষ্টি গুলোর চেহারা এক্কেবারে আশপাশের সাথে মানানসই, তেমন ভালো দেখতে হয়তো না, খেতেও গরীব মতোই । ইছামতীর কাছে পৌঁছতে চাই এবার। বেলা আড়াইটা বাজে, সেই কখন বেরিয়েছি!

আগেরবারের মতোই এবারেও দেখি সেই একগাদা লোক, বলে মিনি সুন্দরবন গোলপাতা জঙ্গল, ভূমিকন্যার শ্যুটিং, হ্যানাত্যানা যেতে। দুশো আড়াইশো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কোত্থাও যাবো না। কিংবা যেতেও পারি, এতো ঠিক করে তো আসিনি। আপাতত একটু চরে বেড়াই নিজের মতো। নদীর ধার দিয়ে খাবার জায়গা, ফেরিঘাট পার হবার পর খানিক হাঁটলে একটা মাচা বাঁধা দেখলাম। নিকুচি করেছে কোথাও যাওয়া, মাচায় লম্বা হয়ে নদীর হাওয়া খাওয়ার থেকে আর কিছু আমি চাইনা মোটেও। ওই দূরে ওপারের গাছগুলো বাংলাদেশের। আচ্ছা বাংলাদেশের গাছেদের সাথে ভারতের গাছেদের কথা হয়? ওদের তো টেলিপ্যাথিতে কথা, শিকড় দিয়ে দিয়ে, পাখি দিয়ে দিয়ে, কি বলে? "কিরে ব্যাটা আজ পাসপোর্ট ছাড়া কথা বলিস? হাহাহা, মানুষ গুলো পারেও বল? হ্যাঁ, এদ্দিন ধরে আমাদের দেখে তাও কিছু শেখে না রে উজবুক গুলো? এতো এতো ছানা পোনা তো মাছেদেরও হয়না, সে বুদ্ধি নেই, তারা কাঁটাতার দিয়ে সমাধান খুঁজবেনা তো কি?"

নদীর ধারে মানুষ আসে বোঝাই যায়, একগাদা নোংরা প্লাস্টিক, থার্মোকল ফেলা! সাড়ে চারটে বাজে, দেখি কিছু খাওয়া যাক, নাকি? নদীর ধারে একটা হোটেলে দেখি লেখা, ছাদে বসে খাবারের সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু তাদের আবার খাবার নেই। বলল আচ্ছা ওই পাশের দোকান থেকে কিনে উপরে গিয়ে খাও না হয়। বেশ বেশ। আমার তো শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ডিম পাঁউরুটি ভরসা। ডিম পাঁউরুটি নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখি মোটাসোটা এক হুলো মনে আনন্দে মাছের কাঁটাকুটো খাচ্ছে। ওদিকে নদীর বুকে মেঘ করেছে কালো হয়ে, ওইই দূরে বাংলাদেশে ভেড়ী দেখা যাচ্ছে। নদীতে ইতস্ততঃ মাছ ধরার নৌকা। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে। সমস্তটা যেন একটা হাতে আঁকা ছবি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় কাঁপতে থাকা জলে ভাসা নৌকা, কালো মেঘ, হাওয়ার টানে ভেসে আসা কোনো চিৎকার সবটা যেন এই পুরোটা কমপ্লিট করছে, একটুও বেচাল নেই, আবার কোনো একটা না থাকলেও কিচ্ছু অসম্পূর্ণ হবে না! এই আমি আছি এখানে রেলিঙে হেলান দিয়ে, এটাও যেন এই ছবিটার অংশ আবার না থাকলেও ক্ষতি নেই। বোঝাতে পারলাম মনে হয়। এ আমার হিজিবিজি ভাবনা।

অনেক্ষণ পর নীচে নেমে গাড়িতে উঠেছি, তিনি এলেন, টপটপ করে করে বড় বড় ফোঁটায়। একটু পরেই অঝোরে। ফেরার রাস্তায় দেখি মালঞ্চ হয়ে কোলকাতা যাবার দিক নির্দেশ। বেশ তো যাওয়া যাক না। নতুন রাস্তা দেখতেই তো বেরোনো। এই রাস্তাটা সত্যিই ভালো, খুব বৃষ্টি তাই কাচ নামানো যাচ্ছেনা, কিন্তু ঝাপ্সা কাচে দিব্যি দেখাশোনা যায়। ওই যে দুধারে আদিগন্ত ভেড়ী। আরে একটা ভেড়ীর মাঝখানে একটা একলা গাছ কেমন দাঁড়িয়ে দেখ, আরেকটু এগোতে দেখি একটা আধভাঙা নৌকা শুয়ে। এই রাস্তাটাও বেশ ভালো, গাছগাছালিও বিস্তর। একটা মোড়ে দেখি খুব করে চপ, বেগুনি ফুলুরি, পিঁয়াজি ভাজছে। ঝমঝম করে বৃষ্টিতে চারধার শুনশান প্রায়। মাথায় ছিট থাকলে যা হয়। গাড়িটা সাইড করে, ওই ঝমঝমে বৃষ্টিতে হেঁটে হেঁটে চুপ্পুস ভিজে মুড়ি কিনতে গেছি। চুল বেয়ে জল নামছে, এহেহে চশমাটা গাড়িতে রেখে আসা উচিত ছিলো। 
- কাকা দু টাকার মুড়ি দুটো পিঁয়াজি, দুটো আলুরচপ দাও দেখি, আর দুটাকার ছোলা সেদ্ধ হ্যাঁ? 
কাকা গজগজ করে, 'কি সব ছেলেপুলে আজকালকার, এরকম ভিজে কেউ আসে, তাও খাওয়া দেখো! আমাদের ছেলেরা এর তিনগুন খাবে বুঝলি, সব খালি কল্লামি করা, বৃষ্টিতে ভেজার নকশা খালি।'

কিই বা বলি সত্যিই তো এ আমাদের শখের খাওয়া, আমাদের গ্রামের বাড়িতে জমি চাষ করতে আসতো যারা তারা মুড়ি খেতো এক একজন একটা ইয়াব্বড় গামলা ভর্তি করে, থাবা দিয়ে দিয়ে খেতো। চা এর দোকানে কত সময় দেখেছি, এক কাঁসি মুড়ি নিয়ে এক হাতা ঘুগ্নি আর জল দিয়ে মেখে খেতে। যাকগে শখ আহ্লাদও থাকার দরকার বটে, না হলে জীবন বড় গোদা হয়ে যায়।সে কারোর জমিতে চাষ করেও হতে পারে কারোর শেয়ার মার্কেট কিংবা প্রমোশনের গোলোকধাঁধাতেও হতে পারে। শখ জরুরি হ্যায়।

ভেজা গেঞ্জি পরে এসিতে বসলে বাড়ি পৌঁছবার আগেই মরে যাবো, তাই খালি গায়ে বসে স্টিয়ারিং ধরেছি, ব্যাস আমি এখন আমার সেই স্বপ্নের ট্রাক ড্রাইভার। সুতরাং সমস্ত জল জমার উপর দিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করে অ্যাক্সিলারেট করে ঝরনা বানাচ্ছি, দুধারের বাইক, গাড়ি সব ভিজিয়ে ভিজিয়ে। হ্যাঁ এবার বলতেই পারো, 'ও আবার কি! এ তো অসভ্যতা। অমন কেউ করে! তোমায় করলে কেমন লাগতো?' ইয়ে খুবই খারাপ লাগতো বটে। খিস্তিও করতাম, কিন্তু ইয়ে আশেপাশে লোককে ভেজাইনি সত্যি বলছি। মাক্কালি। আহ অত কূটতর্ক করার কি নাস্তিক তো কি? তুমি তো মানো তবে?

মালঞ্চ বলে জায়গাটার নাম যেমন সুন্দর তেমন ওর একটা নদী আছে। কি নাম নদীর কে জানে! বাসন্তী হাইওয়েতে উঠেছি যখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি থেমে গেছে। কোলাব্যাঙের কটরকটর, ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত লাগছে। আজ রবিবার বলেই না বৃষ্টির দিন বলেই কে জানে গাড়িও খুব কম। এক জায়গায় পাশের দিকে খানিক জায়গা আছে দেখে দাঁড় করিয়ে আলো টালো সব নিভিয়ে দিয়েছি। বিপজ্জনক কাজ অবশ্যই। কিন্তু ওই পোকা নড়া কেস!

এমন অন্ধকার বহুদিন ফিল করিনি, সে অন্ধকার যেন ধাক্কা মারা যায় এমন জমাট। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর আওয়াজ যেন আরো তীব্র। সে অন্ধকার যেন কথা বলে উঠবে এক্ষুনি। আমি শুনতে পাচ্ছিনা খালি, শুনতে আমি কিছুই পাইনা, গাছ, ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁ, নদী, ভেড়ি আকাশ, এই অন্ধকার, এই আলো, এমনকি আমার গাড়িটাও কত কি বলে নিজেদের মধ্যে। আমি কিচ্ছু শুনতে পাইনা, বুঝতে পাইনা, খালি দেখে যাই, ছুঁতে চেষ্টা করি নিজের মতো করে.....

যদ্দিন না এ ভাষা বুঝি আমার নিস্তার নাই...বারবার বেরোতে হবে।