Sunday, December 29, 2019

ভুটে আর ছোটকা

- ছোটকা
- হুঁ
- ও ছোটকা

- বলবি তো

- তুমি সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলে কেন?

- কে বলল?

- ওই তো মা আর বাবা সেদিন কথা বলছিলো...

- ও আজকাল অন্যদের আলোচনায় কান পাতার অভ্যেসও তৈরী হয়েছে!

- না না, ওরকম না। আমার সামনেই বলছিল, তাই ভাবলাম তেমন পার্সোনাল কথা নিশ্চয়ই না। বলো না ছোটকা সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলে কেন?

- হুম। তা ভুটেবাবু সন্ন্যাসী কাকে বলে জানা আছে?

-হ্যাঁ জানি তো। ছোট সংসারের মধ্যে আটকে না থেকে, পার্থিব জিনিসের মায়া ত্যাগ করে ভগবানের সন্ধানে যাওয়া।

- আরিব্বাস! ভুটেবাবু! পার্থিব, সংসারের মায়া, কী কেস রে? অংক ক্লাসের নতুন মেয়েটা পাত্তা দিচ্ছেনা?

- আহ ছোটকা! তোমার সবেতেই ঠাট্টা খালি। ঠিকাছে বাদ দাও, আমি যাই।

- আরে চটিস কেন! সত্যিই তো এ সব জিনিস নিয়ে ইয়ার্কি করা ভালোনা মোটেই। তা কী বলছে সে?

- কে আবার কী বলবে!

- ওহ। আচ্ছা ছাড় এসব, চল মন্টুর দোকানে নতুন একটা কারিগর এসেছে, মাছের ডিমের বড়া যা বানাচ্ছেনা রে। চল চারটে করে মেরে আসি।

- নাহ। তুমি যাও। আমার শরীরটা ভালো নেই!

- ওহ। হ্যাঁ শরীর ভালো না থাকলে এসব খাওয়া ঠিক না। তা যাবি নাকি কাল, পাঁচ নম্বর পুকুরে এপার ওপার এর রেস দিতে?

- নাহ ছোটকা, তুমিই যাও। আমার সামনে টেস্ট আছে, ঠান্ডা লেগে গেলে সমস্যা হবে।

- তাও বটে তাও বটে। তাহলে বুঝলি ভুটে এ কদিন তোর ডায়েটেরও বদল আনতে হবে, ঝোল ভাত, আর পেঁপে সেদ্ধ। আর সকালে এক গ্লাস লাউএর রস নাকি? মানে সামনে যখন টেস্ট আর শরীরটাও তোর ভালো নেই বলছিস। আরে আরে অত মুষড়ে পড়ছিস কেন, আচ্ছা আচ্ছা লাউ বাদ।
আচ্ছা আচ্ছা নে এবার বলতো কী হয়েছে। কে এমন পাপিষ্ঠ থোড় কিংবা লাউ মানুষ রূপে আমাদের ভুটেবাবুকে এত যন্ত্রণায় ফেলেছে! তোর ছোটকা আছে না, এত চিন্তা করছিস কেন?

- আমার না ভালো লাগছে না কিচ্ছু ছোটকা। আমি কেন তোমাদের মত হলাম না বলতে পারো? আমার মাথায় বুদ্ধি কম, আমি পড়াশোনায় তুখোড় না, সেরা জায়গা আমার জন্যে না, আমার হাইট দেখো, চেহারা দেখো, লোকজন খোরাক করে, অংক কোচিং এর মেয়ের কতগা বললে না? হুহ আমার দিকে তাকাবে এমন ভাবনাই অসম্ভব। তুমি বলবে আমি হীনমন্যতায় ভুগছি, এসব বাজে কথা, আমার থেকেও আরো কত কত লোকে খারাপ আছে তাই তো? আমি জানি ছোটকা এসব, কিন্তু আমার থেকে ভালোও তো কত লোকে আছে বলো। আমি কেন সেই সেরাদের দলে না? প্লিজ ছোটকা আমায় বোকোনা, হেসোনা। আমি কাউকে বলতে পারিনা এসব, আমার ভালো লাগেনা কিছু। মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই।

- বেশ। বুঝলাম। না আমি হাসবোও না, বোকবোও না। ভুটে তোর ছোটকা কিছু সেরাদের দলে পরে না। না, না, আগে আমায় বলে নিতে দে। তুই বলছিলিনা, আমি কেন সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলাম? আমি সন্ন্যাসী হইনি, স্রেফ বলতে পারিস ভবঘুরে হয়ে গেছিলাম। তুই জানিসই আমি নাস্তিক, ভগবানের খোঁজে আমায় যারা ভালোবাসে তাদের ফেলে বেরিয়ে যাওয়া আমার জন্যে না। আমি গেছিলাম কেন, সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক, আমি ফিরে এসেছিলাম কেন সেটাই বলি বরং।
ঘুরতে ঘুরতে আমি সেবার একটা শহরের গঙ্গার কাছে এক বস্তির কাছাকাছি একটা আস্তানায় থাকি। দাড়ি গোঁফে এমন চেহারা হয়েছিল, আর ইচ্ছে করেই একটা গেরুয়া পরেছিলাম বলে খাওয়ার অভাব হতনা। তো আমার মনের অস্থিরতা কমেনি কিছুই, বিরক্ত লাগে সব কিছুই, হতাশ লাগে তোর মতই। মনে হয় আমি অপদার্থ। আমার বন্ধু বান্ধবরা বিরাট চাকরি করে তখন, কেউ কেউ ভারী চমৎকার গান করে, কেউ ভালো খেলে...আমি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছি! সে সময়েই খেয়াল হল হঠাৎ, বস্তির লোকগুলোর আনন্দ ফূর্তির কম নেই। মানে খুবই আশ্চর্য ব্যপার, এই আজ অমুক পুজো, কাল ডান্স ধামাকা, পরশু তমুক। তবে লোকগুলো বেশীরভাগ পুজোয় আশপাশের সকলকে খাওয়াতো, ওদের সামর্থ্য মত। আমি খুব তাচ্ছিল্য ভরে ভাবতাম, অশিক্ষার কারনে এসব করে৷ দুঃখের এত কারন তাও দুঃখ নেই, নির্বোধ ভাবতাম ওদের এতই নির্বোধ ছিলাম।
তারপর জানিস একদিন খেয়াল হল, আরে আমার বিরাট চাকরি করা সফল বন্ধু গুলোও তো দিন রাত খেটে, অবসরে এই হুল্লোড়টাই করে পাবে গিয়ে বা পুজোয় বা বারে। তারপর বলে, এত স্ট্রেস আর ভাল্লাগেনা।

ভাবলাম খুব বুঝলি ভুটে, ভালো থাকা খারাপ থাকা আসলেই তো নিজের উপর। আমি দশটাকায় ভালো থাকতে পারি আবার একশো টাকাতেও পারি। হয়ত দশটাকায় ভালো থাকাটা একশো টাকায় ভালো থাকা লোকটা বুঝতে পারছেনা তাই ভাবছে আমি খারাপ আছি। আমি খারাপ আছি না ভালো সেটা অন্যের ইলিউশনে হয়ে যাচ্ছেনা তো? বুঝতে পারছিস ভুটে কী বলছি?

- হ্যাঁ ছোটকা, মানে এই যে বড়রা ভাবে এখনকার আমাদের ভিডিও গেমস জীবন কীই দুঃখের, এদিকে আমরা দিব্যি আছি সেরকম না?

- কারেক্ট। একদম তাই। যেই মাত্র এটা ভাবলাম, অমনি মনে হল, বেশ তো আমার জীবনটা অন্যের চোখে "সফল" কিনা দেখার বদলে, নিজের চোখেই দেখি একবার? ঝেড়ে ঝুড়ে দেখলাম, আমার ছেঁড়া জামার পকেটে বোঝাই করা মনি মানিক! দাদা, বৌদি,দিদি, মা বাবা, দু চার খানা বন্ধু বান্ধব, তুই তখন হোসনি তাই তোকে কাউন্ট করিনি, যাইহোক সব্বাই আমায় কত ভালোবাসে তা টের পেতে বেগ হলনা। জানিসই তো ভালোবাসা দিব্যি বোঝা যায়। তো যেনা টের পাওয়া, দেখলাম, আমার সকালের রোদ মাখা বিছানায় যে ওম লেগে থাকে রাতের চাঁদের আলোয় তা ঝকঝকে হয়ে যায় কেমন। বুঝলি ভুটে, তুই হয়ত সেরা না, তুই হ্যান্ডসাম না, হয়ত কেন তাইই, তুই যা বললি তা মেনেই নিলাম, সবাই দিব্যি সোজা সরল পথে তরতর করে এগিয়ে যায় তুই পাক খেয়ে খেয়ে লগি ঠেলিস, তাও ভুটে দেখবি হয়ত ওই পাক খেতে খেতেই একটা ডলফিন ঘাই মারলো, অনূকুলে পাওয়া হাওয়ার তরতর করে এগিয়ে যাওয়া নৌকাটা সেই ডলফিন মিস করে গেল।

এক জীবনে সব মেলে না রে ভুটে, তার জন্যে হা হুতাশ করার বদলে না পাওয়া গুলোকে সঙ্গে নিয়ে চলতে গিয়ে দেখলি আচানক সব রামধনু জুটে গেল।

- ঠিক। আমার কোনো বন্ধুর এমন ছোটকা নেই এ আমি হলফ করে বলতে পারি। ইয়ে, মন্টুর দোকানে যাবে নাকি? শরীরটা এখন দিব্যি চাঙ্গা লাগছে কিনা....

Wednesday, December 18, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা (শেষ)

বাঘ দেখে ফিরে ভয়ানক খিদে পেয়েছে দেখে গেটের বাইরেই এক হতভাগা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পরা গেল। সে এক আজব রেস্টুরেন্ট মাইরি! ধরো খাবার অর্ডার দিলে,  বলল দেরী হবে কিন্তু, তুমি অন্য একটা অর্ডার দিলে বলল আচ্ছা এটা হয়ে যাবে এক্ষুনি। তো স্বাভাবিকাবেই জলদি হবে এমন জিনিস, ডিম পাঁউরুটি অর্ডার দেবে তুমি। তাতেও দেখবে এক্ষুনি ব্যাপারটা কালের কাছে স্রেফ মায়া। তার এক্ষুনি আসলে আধঘন্টা, কিন্তু তাতে কি, পুরো মহাকালের তুলনায় সে তো নখের ডগাও না। তাই তুমি বসেই থাকবে বসেই থাকবে, ঘড়ির কাঁটা সরে যাক, খিদেয় তুমি নেতিয়ে যাও, যাই হয়ে যাক। আমায় এমন হাব্লা মত দেখতে কাউকে তাড়া দিলেও পাত্তা দেয়না। সমুটা বেশ লম্বা চওড়া আছে , সৌরভটাও কুস্তিগীর মত হয়েছে দেখতে, কিন্তু দুটোই ভারী মোলায়েম স্বভাবের। কাউকে গিয়ে ধমক দিয়ে বলবে সে ওদের ধাতে নেই, নিজের মনে বিড়বিড় করবে , তারপর হয়ত দুটো ঘাসের ডগাই চিবোবে। আর দলের মেয়েগুলোও ওরমই , তাদের আবার যত ধমক ধামক মার ধোর আমাদের উপর, কিচ্ছু না করলেও , বাইরে বলতে বলো ঝিম মেরে পড়ে থাকবে। শেষে আর্যদা গিয়ে দাঁড়াতে সামান্য মিলি সেকেন্ড তাড়াতাড়ি করল বটে।

তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। রিসর্টের চারদিকে যে উঁচু উঁচু ঘাসের বন দেখে মনে হয়েছিল কাল রাতে বাঘ লুকিয়ে বসে আছে, আজ কেমন রুক্ষ মত মায়া মায়া লাগছে। চারদিকটা বেশ ফাঁকা, রিসর্টে বেশী কাউকে দেখতেও পাচ্ছিনা। যদিও আরেকটা গাড়ি আছে এখানে। এমন পাখি ডাকা শান্ত পরিবেশ,  এমন ছুটি আমাদের খুব একটা মেলেনা কারোরই। এলোমেলো ছড়িয়ে বসে আড্ডা হচ্ছে,  তারই ফাঁকে একজন দুজন করে গিয়ে চান সেরে আসছে। সৌরভ এর ইচ্ছে ঘুম, এর মধ্যেই ঘুমিয়েও পড়েছে। কাল সারা রাত থেকে প্রায় জাগা, পেটে খাবার পড়তে আর এমন শান্ত পরিবেশে ইচ্ছে করছিল শুয়ে পড়তে। কিন্তু আমাদের ফের একটা সাফারি আছে। এবারের সাফারিটা ঘোষ দিয়েই বুক করা ছিল, তাই রিসর্টেই আনতে এসেছিল লোক। রাতের অন্ধকারে টের পাইনি, কিন্তু দুপুরের রোদে দেখতে পেলাম রিসর্ট আর মোহারলি গেটের মাঝে মস্ত একটা জলাশয়।  একটু দূর থেকে হুডখোলা জিপে বসে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।

দুপুরের জঙ্গল সকালের থেকে আলাদা। শীতের দুপুরে গাছগুলো সারসার দাঁড়িয়ে। সকালের হিহি ঠান্ডা এখন নেই। নিস্তব্ধ জঙ্গলে মাঝে মাঝে মাঝে দুটো চারটে পাখির ডাক,  হরিনের ডাক। শুরুতে একটা সম্বর দেখে এদিক ওদিক ঢুঁ মারছি, এখনো কিছু পাইনি তেমন। তারপর হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে বলল কল শোনা গেছে কল শোনা গেছে। হুড়মুড় করে জিপ নিয়ে গেলো।  বাঘ ওই জঙ্গলে দেখা গেছে অল্প, এবার তিনি যে কোনো দিকে যেতে পারেন। এমন কি আরো গভীর জঙ্গলেও যেতে পারেন। সবাই অপেক্ষা করছে।  অপেক্ষা করতে করতেই দেখি একটা ডালে এক ঝাঁক হরিয়াল বসেছে। ওইদিকের গাছে ছোট্ট একটা দোয়েল পাখি মনের আনন্দে দোল খাচ্ছে। ওই একটা কাঠঠোকরা উড়ে গেল। কোনো চাপ নেই জীবনে, বাঘ দেখতে পাওয়ার, দেখাতে পারার কিচ্ছু না। ঝলমলে কটা প্রজাপতি উড়ছে এদিক্সেদিক।দূরে একপাল হরিণ অব্দি ঘাস খেয়ে চলেছে একমনে। জাস্ট পাত্তা দিচ্ছে না বাঘ আসতে পারে কি পারেনা তার। আর মানুষগুলো, ছুটিতে এসেও বাঘ দেখতে পাবে কিনা, পেলেও ক্যাপচার করতে পারবে কিনা সেই নিয়ে উৎকন্ঠায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!  সুখ শান্তি আসলে মানুষ হারিয়েই ফেলেছে!









অনেক্ষন এদিকসেদিক করেও পাওয়া গেলনা বাঘের দেখা। খালি একদিনের বাসী বাঘের বর্জ্য দেখা গেল। এ জঙ্গলে একটা বেশ সুন্দর গাছ আছে। এরা বলে ঘোস্ট ট্রি। সাদা,  লাল আর বাদামী তিনটে কালার চেঞ্জ হয় সারা বছর ধরে।  ভারী সুন্দর গাছ। সাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ডালপালা মেলে ভূতের সিনেমা ভাব আসে বটে। এ জঙ্গলে শাল গাছ প্রচুর আছে। তাড়োবা লেকে নাকি কুমীর আছে বলছিল। মিথ্যে না সত্যি কে জানে! এইসব জায়গায় এলে আমার কেমন মনে হয়, আমরা কখন চলে যাব তার অপেক্ষা করে গাছগুলো। চলে গেলেই নিজেদের গল্পগুজব শুরু করে দেবে। গাছ টু গাছ টক, মানুষের সে কথা শোনার অধিকার নেই। নিজেদের বিরাট সভ্য ভেবে সে অধিকার তারা নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছে!


ফেরার পথে দুপুরের দেখা বাঁধটার জলে দারুণ একটা সূর্যাস্ত দেখলাম। হালকা থেকে গাঢ় হয়ে যাওয়া লালের নানান শেড দিগন্তব্যাপী বাঁধের জলের উপর।আহা এমন রঙ এর খেলা দেখতে পাওয়াও কম সৌভাগ্য না। না সে ছবি তুলিনি আমরা , ও ছবি স্রেফ মনে তুলে রাখতে হয়।রিসর্টে ফিরে খুব খানিক কাড়াকাড়ি করে খাওয়া,  আড্ডা হল জমাটি। আমরাবেই কজন সবসময় প্রাণের নেশায় বুঁদ থাকি, আলাদা করে মদ গাঁজা দিয়ে আমাদের বুঁদ হতে হয়না, হুল্লোড় করতে,  ফূর্তি করতে আলাদা করে উপকরণ দরকার পড়েনা। নেশা আমাদের কিসে হয় কে জানে, হয়ত একইরকম কটা একটু আধপাগল, তথাকথিত আনস্মার্ট,  হাবলা লোকেরা এক হলে তাদেরই আঁচে। নয়ত এরকম জঙ্গুলে সন্ধ্যেয়, মদ গাঁজা ছাড়া এত হাহা, এত প্রাণ লোকের কাছে অবিশ্বাস্য বটে।






রিসর্টে একটা ভারতীয় মেয়ের দল আর কটা বিদেশী এসেছে। বিদেশীগুলো রাতের একটা সাফারিতে যাচ্ছে। আমাদের অফার করেছিলো, দুটো সিট আছে, কেউ যদি যাই। সবাই আড্ডা দিতেই উৎসাহী বেশী, বন্ধুদের ছেড়ে অযাচিত সাফারি কেউই নিলনা। বাইরে আগুন জ্বেলে মেয়েদের দলটা নাচ গান করছে। আমাদের দলের ছেলেপুলেরা নেহাতই দুধভাত টাইপ। কেউই মাইরি গিয়ে আলাপ জমাবার চেষ্টাও করলাম না! বরং এক আকাশ তারা দেখে কোনটা কালপুরুষ,  কোনটা সপ্তর্ষিমণ্ডল, গুঁড়ো গুঁড়ো তারাগুলো কী হতে পারে সে সব আলোচনায় মেতে গেলাম সবাই মিলে। তবে মিথ্যে বলব না, আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে আড্ডা মারার ইচ্ছে আমাদের সকলেরই ছিল। রাতে খাওয়ার পর তাই নিভু নিভু আগুনের চারপাশে গুটিগুটি জড়ো হয়ে নরক গুলজার শুরু করা গেল ফের। হোটেলে লোকগুলো আমাদের দেখে ফের কাঠকুটো গুঁজে দিয়ে গেলো। আগুনে আঁচে মাথার উপর এক আকাশ তারা নিয়ে আমাদের আলাপ আরো একটু দমে বসানো গেলো, পাক হতে গেলে তা বড় জরুরী কিনা।

পরেরদিন আমাদের খুটওয়ান্ডা গেট থেকে সাফারি করার কথা। ওটা একটু দূরে, সকাল সকাল বেরোতে হবে কাল থেকে ভালো ঘুম নেই, তবুও শুয়ে পড়েও ফুক্কুড়ির শেষ হয়না। এ ওর ঠ্যাং টানাটানি করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। ভোরের আলো ফুটছে তখন, আমাদের গাড়িটা জঙ্গুলে রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে জঙ্গলের পাশেই একটা ছোট্ট গ্রাম পেরোচ্ছে। সার সার লোক, বউ সব রাস্তাতেই সুলভ শৌচাগার চালু করেছে! আমাদের দেশের লোকেদের বেসিক সেন্স এত কম কেন? নোংরা থাকবো নোংরা ভাববো এতে এত সুখ পায়! এত গুরু ঠাকুর, এত ধর্মীয় অনুশাসন এত ছুৎমার্গ কোথাও বলা নেই পরিচ্ছন্নতার মত প্রাথমিক বিষয় নিয়ে? দারিদ্রতা কোনো কারনই না, আমি মার্সিডিজ এর দরজা খুলে থক করে রাস্তায় থুতু ফেলা লোক দেখেছি প্রচুর। বোধটাই নেই। মন খারাপ হয়ে যায় এসব ভাবলে। একটা সময় পর হয় সব ধ্বংস হয়ে যাওয়াই ভালো। ভারতবর্ষের এত প্রাচীন ইতিহাস, আজ নোংরা, জনসংখ্যার ভারে ক্লান্ত, অশিক্ষিত, গাম্বাট লোকের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকগে,  ভাবব না এসব বেড়াতে এসে। মনটা সরাতে তাকালাম আকাশের দিকে একবার, সকাল হয়ে গেছে, আমরাও খুটওয়ান্ডা গেটে পৌঁছে গেছি।



খুটওয়ান্ডা গেট দিয়ে বেশী গাড়ি ঢোকে না, তাই সামনে আর কোনো গাড়ি ছিলো না। ঘুরে ফিরে সেই মোহারলির দিকেই যাবে যদিও তাও,  খানিক হলেও অন্য রাস্তা। জঙ্গলে হুড খোলা জিপসিতে ফাঁকা জঙ্গলে সকালবেলার বুনো গন্ধ নিতে নিতে যাচ্ছিলাম আমরা। ময়ূর, সম্বর, চিত্রল হরিণ, প্রজাপতি, পাখি দেখতে দেখতেই ফের উত্তেজনার খবর পাওয়া গেল। বাঘ দেখা গেছে!









বাঘের খবর শুনেই সারা পাড়া চুপ! দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই, মানে বসে আছি আর কি জিপে।বিস্কুট খাচ্ছি, শুকনো ডাল থেকে পাশের বন্ধু কারোর ছবি তুলতে ছাড়ছিনা, দু চারটে ফিসফিস করে কথাও বলছে লোকজন, এমন সময় ঘাড়ুম করে একবার বাঘ ডেকে উঠলো, ব্যাস, পুরো এলাকা বোমা ছাড়াই তটস্থ। ও বাবা! সেই যে ডাক শোনালো তারপর আর কিচ্ছু নেই। মহা অলস বাঘ তো! আমার থেকেও বেশী দেখছি! বসে বসে আলোচনা করছি, বিস্কুটের লোভ দেখি বাঘটাকে বাইরে বের করা যায় কিনা। আসলে সে খুবই কাছে আছে, শীতকালের শুরুতে ঘন জঙ্গল বলে একশো মিটারের তফাতেও ব্যাটা গা ঢেকে জিরোচ্ছে। অনেক অনেক্ষন বসে থাকার পর,  গাইড আমাদের কথাকেই সমর্থন করল,"শুয়ে পড়েছে মনে হয়"। বোঝো! এ কেমন ব্যাভার হল হ্যাঁ? লোকজন এসেছে বাড়িতে আর আপনি শুয়ে থাকবেন? অবশ্য ঠিকই আছে! আমিও বাড়িতে লোকজন এলে পালাতে ভালোবাসি। মহারাজদের ধরন একই রকম হবে স্বাভাবিক!

একটা ঘুরতে যাবার কত কথা হতে থাকে, কত আলোচনা, কত ঝগড়া, কত তর্ক...... বেড়ানো মনে হয় আমাদের সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে গেছিল,  সেই যখন থেকে স্বপ্ন দেখছিলাম। আমাদের বেড়ানোটা আসলে তো দেড়দি এর না, অনেক গুলো দিনের, মাসের। আবার কবে সবাই একসাথে হব কে জানে! ফেরার পথে  দুপুরবেলার হাইওয়েতে গাড়ির মধ্যে, পড়ন্ত বিকেলে ধাবায় খেতে গিয়ে, এয়ারপোর্টের সফিস্টিকেশনে আমরা দেড় দিনের মেয়াদটা আরো আরো লম্বা করছিলাম। না, বাঘ আমরা তিনটে সাফারিতে মোটে একটাতে দেখেছি, তবে তাতে আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি কিছু কম হয়নি।  শেষ হয়ে গেল তাই মন খারাপ তো হচ্ছিলোই, কিন্তু তাই বলেই আমরা মন খারাপ করে মুষড়ে পড়ে বাকি সময়টা নষ্ট করার জনতা না। যেটুকু মুঠোয় ধরে বুকপকেটে গুঁজে নিই....পরের জার্নি শুরু করার আগে অব্দি।



Friday, December 6, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা (২)

নেশা করলে যেমন মনে হয়, ভাই কাল সব সামলে দেব, আজ একটা বিছানা দে শোবার, ওইরকম ভাব নিয়ে আমাদের আর্লি চেকিন করা ঘরে ঢুকে পড়া গেল। রিসর্টের মালিক এর কিছু একটা ঘোষ, আমরা যখন বুক করছিলাম এর ঘরের ছবিতে খাটের যে ছবি ছিল তাতে আবার একটা আলো লাগানো টাইপ ছিল, আমাদের দলের একজন আবার তাই দেখে বলেছিল, মায়াবী আলো কেমন, চল এটাই বুক করি। তা চারটে দামড়া ছেলে দেখে মনে হয় মায়াবী আলোর তার কেটে দিয়েছিল। মেয়েদের ঘরে রেখেছিল কিনা জানিনা অবশ্য। যাইহোক আলো অন্ধকার কিচ্ছু না, শুতেই ঘুম। এমন ঘুম সৌরভের অ্যাসিংক্রোনাস নাক ডাকার আওয়াজ অব্দি কিচ্ছু করতে পারেনি।

জামা বদলাবার মত গাধামি আমাদের ঘরের কেউই করেনি, জিন্স জামা যা পরে ছিলাম সব পরেই শুয়েছি, খালি তার উপরে হুডি আর মাফলার। এই বুদ্ধিমানের মত ঘটনায় আমাদের ঘরটা মিনিট দশ পনেরো সময় বেশী ঘুনিয়ে বেশ বাঘের মতই হালুম হুলুম করে পার্কের গেটে পৌঁছে দেখি,   একটা মিটমিটে আলোয় কজন গাইড না ড্রাইভার খোদায় মালুম বসে আছে। তখনও কাউন্টার খোলেনি, ভোরবেলার অন্ধকারে বসে বসে খিদে পেয়ে গেল। এদিকে ঘাপচু (আসল নাম ভুলে গেছি)  আর নন্তে খালি বিস্কুট এনেছে তাও হাবার মত মেরি বিস্কুট!! কোনো মানে হয়! গজগজ করে তাই খান পাঁচেক খেতে খেতেই কাউন্টার খুলে দিল। ওবাবা এখানে ভারী অব্যবস্থা তো! আমরা সেই কখন এসেছি অথচ আমরা ফার্স্ট জিপ হব এমন উপায় নেই। ওদিকে কাউন্টারে আমাদের অনলাইন এর বুকিং দেখে বলল,  তোমরা এক গাড়িতে সব কটা ক্যামেরা রেখেছ, অন্য গাড়িটায় কিন্তু নিতে পারবেনা!! মাইরি বর্গি এলো দেশে বলে কেন ভয় দেখাতো বুঝছি! এই সাফারিটাতেই দুটো জিপ আর ক্যামেরা মিলে হাজার চব্বিশ দিয়েছিলাম( পরের গুলোতেও তাইই অবশ্য),  এরপরেও আবার অযথা ক্যামেরার চার্জ নিলে ভাল্লাগে? খুব গজগজ করে নিলাম অযথা, আর আসবোনা ইত্যাদি বলে, যদিও এমনিতেও আর আসা আমাদের হবেনা সেও জানি!

গাড়ি ছাড়ার আগে পাশে ঝুপড়ি থেকে চা খেতে গিয়ে দেখি এই সাতসকালে কয়েকজন স্থানীয় মানুষ  ভয়ানক তেল মশলা দেওয়া কি একটা তরকারি, খানিক পোহার উপর দিয়ে খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম,  বাফ্রে, যদি বলে চা এর সাথে এ জিনিসও খান! আমার এর আগে এমন হুড খোলা জিপে জঙ্গল সাফারির অভিজ্ঞতা বছর আষ্টেক আগে ডুয়ার্সে। গেট পার হয়ে খানিক যেতে যেতেই জঙ্গল তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে ধরা দিতে থাকে। লাল মাটির রাস্তায় ধূলো আর ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট নিয়ে জিপ এগোয়, তখনো ভালো করে রোদ ওঠেনি। তাই ভরসা আছে, জঙ্গল এর প্রাণীদের দেখা পাবার। জিপটা একটা গোঁত খেয়ে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে একটা জলাশয়ের ধারে পৌঁছলো। গাইড ব্যাটা খালি বলে চলেছে গরমে সব ঘাস ফাঁকা হয়ে যায় তো, তাই খুব ভালো সাইটিং হয়, এই সব জলে বাঘে জল খেতে আসে হ্যানা ত্যানা। শুনলেই রাগ আর দুঃখ হচ্ছিল। তাড়োবার জঙ্গলে বড় জানোয়ার বলতে মূলতঃ বাঘই। এছাড়া ব্ল্যাক লেপার্ড আছে, সে তো এমনিই ভয়ানক রেয়ার। আর বুনো কুকুর আছে।  বাঘ দেখতে না পেলে মুখে যাই বলি না কেন৷ ভয়ানক দুঃখ হবে  একথা সত্যি। তবে আমরা জঙ্গল ব্যপারটা এমনিতেও খুব ভালোবাসি, তাই সে শোক সামলেও নেব এ কথাও মিথ্যে না। তাই বলেই যদি সকাল থেকেই গাইড গান শোনায় যে কিছুই না মিলতে পারে বলে ভাল্লাগে নাকি!  জলের উপর গাছে কটা সারস বসে ছিল। সারসই তো বলে নাকি, ইংরাজিতে স্টর্ক বলে যাকে? খচাং খচাং করে ছবি তুলে নেওয়া গেল কুয়াশার সর পড়া জলের উপর দিয়ে।












দুধারে ঘন বাঁশবন এর ফাঁকে বাঘ থাকতেই পারে, এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে খোলা জিপে সকাল সকাল যেতে বেশ লাগছিল। মাঝে মাঝে এ ভারতভূমির আদিবাসী রাজাদের তৈরী নিশান দেখা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে। তাড়ু বলে একজন বাঘের দ্বারা মারা যায়, সেই থেকেই তাড়োবা। মন্দিরটাও আছে একখানে। নানান রকম পাখির ডাক, জিপের টায়ারের সাথে লাল মাটির ঘষার আওয়াজ আর গাইডের টুকটাক কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ একজায়গায় দেখি আরো কটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাইডে গাইডে কথা হয়ে গেল, উত্তেজনা দেখেই মনে হল কিছু নির্ঘাত আছে এখানে...বাঘই নাকি?

জানা গেল হ্যাঁ, কল শোনা গেছে। কল মানে বাঘের আসার খবর জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে বার্কিং ডিয়ার বা বাঁদর বা ময়ুরের মাধ্যমে। জঙ্গলের নিজস্ব সিকিউরিটি সিস্টেম। তাহলে বাঘ হরিণ পায় কি করে? বাঘ অনেক অনেক ক্ষন একই জায়গায় বসে থাকে,  তারপর হরিণে বা বাইসনের দল যখন একটু ঢিল দেয় ব্যাস। ঘাপ!

জিপ গুলো সব টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সামনে একটু জল, তারপরে ওই পারে বাঁশের বন। বাঘ বাঁ দিক থেকে আসবে এমনটাই কল থেকে বোঝা গেছে। টানটান স্নায়ূ প্রায় শিথিল হয়ে আসবে এমন সমত কোঁয়াকো করে ময়ূরের তীক্ষ্ণ স্বর শোনা গেল,  তাতে যেন নিস্তব্ধতা না ভেঙে আরো ছমছমে হয়ে গেল চারিদিক। ওই যে ওই যে কোনায়, ওই গাছের ফাঁকে আসছেন তিনি। লম্বা লম্বা ঘাস এর ফাঁক দিয়ে অবয়বটা দেখা যেতে সবার ক্যামেরা সচকিত হয়ে গেল। ক্রমে ঝোপঝাড় পেরিয়ে রাজার মত মর্ণিং ওয়াকের ভঙ্গীতে এগিয়ে আসতে লাগলেন তিনি। দৃপ্ত ভঙ্গী, কোনো টেনশন নেই।থাকবেই না কেন! একটা থাবড়া মারলে সামনের জনের (বেশীভাগের) ভব্লীলা কাবার হয়ে যাবে! ক্রমে ক্রমে আমাদের দিকেই আসতে লাগলেন। চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘ না, নিজের এলাকায় ঘুরতে বেরোনো পূর্ণবয়স্ক একজন বাঘ যার থেকে আমাদের দূরত্ব হয়ত পঞ্চাশ -ষাট মিটার! অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। বাঘ চাইলে আমাদের দিকেও আসতেই পারে। গাইড ফিসফিস করে বলে দিচ্ছিল এলেও আমরা যেন কেউ উত্তেজিত হয়ে লাফালাফি না করি। চুপ করে বসে থাকলে,  বাঘকে বিরক্ত৷ না করলে সে নিজের মত চলে যাবে, মানুষ কিছু তার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়ার জিনিস না। বিরক্ত করলেই চিত্তির!

ব্যাটা জলের কাছে এগিয়ে এসেই জলশৌচের ভঙ্গীতে পেছন ডুবিয়ে দিয়ে বসে গেল! নির্ঘাত কোনো বাঙাল বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল আগের রাতে, একগাদা ঝাল খেয়ে ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম বলে সাত সকালেই ছুটে আসতে হয়েছে! অনেকক্ষন জলে পেছন ডুবিয়ে থেকে শান্তি পেয়ে ফের উঠে বাঁশবাগানের ধারে খেলতে খেলতে চলল, কখনো থাবা ছুঁড়ে বাঁশপাতা ধরছে লেজটা খাড়া করে। একবার মিষ্টি করে হাই তুলল একটা চমৎকার। তারপর হেলতে দুলতে চলে গেল আরো গভীর বনের দিকে।








বাঘ দেখে ফেলেই আমাদের এত্ত আনন্দ হয়েছিল  কী বলব! অথচ এমন কিন্তু হবার কথা ছিল না! বাঘ  এরকম কোনো ক্রমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এমন দিন হয়ত তিন পুরুষ আগেও কেউ ভাবেনি! আর ভাবেনি বলেই ওদের মেরে পিটে এমন সংখ্যালঘু করে দিয়েছে!  কেত আছে ভাই। কেমন আরামসে এলো, আশেপাশে লোকজনকে স্রেফ ইগ্নোর করে নিজের মত ঘুরলো, চলে গেল। এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গাইড এর ইশারায় গাড়ি দাঁড়িয়ে দেল। দেখি সামনে এক বিস্তীর্ন ঘাসভূমি, অনেক কটা চিত্রল হরিণ ঘুরছে(বেশী দেখা যায় বলে কদর নেই তেমন), সামনেই গাছে রাস্তায় অসংখ্য হনুমান মজাসে ডাল ধরে ঝুলছে, রাস্তাত বসে আছে। চমৎকার একটা সকাল!








হরিণ গুলো শিং তুলে একবার দেখে, তারপর নিজের মনে ঘাস খায়, হনুমান গুলোকে দেখলে আমার বরাবর হিংসে হয়। কিরকম লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকে ডালে। পরেরবার আমি হনুমান হব ঠিক। অমন একটা তাগড়া লেজ থাকবে, মগডালে বসে দোল খাব..মাঝে মাঝে ফল পাকুড়ে কামড় দেবো, ভালো না লাগলে ছুঁড়ে ফেলব। তবে বনের হনুমানই হব, লোকালয়ের গুলো কেমন উকুন বাছতেই ব্যস্ত থাকে মানুষের মত। দূষন বেশী বলেই হয়ত।



হনুমানদের কেরদানী আর হরিণদের শান্তিতে ঘাস খাওয়া দেখার পর ফের এগোনো গেলো।



(ক্রমশ)

Thursday, November 28, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা

দেড় দিনে?!!! কিই বলছিস!! পয়সা বেশী হয়েছে?! মাথা খারাপের দল সব!কিরকম বন্ধু, অ ফেসবুকে!এরকম করে ঘোরার কোনো মানেই হয়না যাই বলিস! 

উপরের সব কথাই শুনতে হয়েছে। তাদের পক্ষে অস্বাভাবিকও না। কেউ যদি শোনে স্রেফ দেড় দিনে কোলকাতা থেকে নাগপুরে গিয়ে ঘুরে আসছে তাহলে এসব বলবেই। খুলেই বলি তবে। আমরা সাতজন বন্ধু পাঁচটা আলাদা লোকেশনে থাকি দেশ আর রাজ্য মিলে। সবাইকে জড়ো করতে হবে, আবার ছুটিও নিতে পারবে না,  আবার একসাথেই বন্ধুরা মিলে বেড়াতে হবে এত ক্রাইটেরিয়া থাকলে যা হয় আর কি! সুতরাং উইকেন্ডে আমরা তাড়োবা যাবার তোড়জোড় করতে লাগলাম। ফেসবুক এক আজব জায়গা সবাই জানে কিন্তু আজব মানুষের গজব দুনিয়া কেমন হয় বলে নিই আগে বেড়াতে যাবার আগে। একটা কথা সত্যি যে তুমি যা খুঁজবে তাইই পাবে বা তার কাছাকাছি কিছুই পাবে, মানে তুমি ঝিনুক খুঁজলে পাখি পাবে না, তেমনই আমি নিজে আজব বলেই হয় আমার আজব কিছু লোকজন জুটে যায়। তার মধ্যে একজন মানুষ বাংলাদেশ থেকে দুদিনের জন্যে এলেও আমার সাথে দেখা করে যান, একগাদা বই আনেন, নিজের ছেলের আলমারী থেকে। আমেরিকায় থাকা এক দিদি জামাইবাবুকে আমার খুব দরকারি জিনিস বিনা দ্বিধায় আনার জন্যে বলতে পারি।  আর বন্ধু বান্ধবদের কথা? সে বলে শেষ করা যাবেনা!!  এইটুকু বলি আমার গল্প, আড্ডা, বেড়ানো, প্রয়োজন,  সবই এই ফেসবুক থেকে পাওয়া। তো এইরকমই কটা ছেলে মেয়ে মিলে আমরা সারাক্ষনই প্রায় বেড়াতে যাবার কথা ভাবি। কত জায়গা পৃথিবীতে আমরা কিছুই দেখিনি প্রায়। বেড়ানো জন্য সঙ্গী যদি প্রপার না হয় তবে একা বেড়ানোই বেটার এ আমি মনে করি। প্রত্যেকের বেড়ানোর ধরন আলাদা, কেউ ভালোবাসে কোনো জায়গায় গিয়ে স্রেফ ল্যাদ খেতে, কেউ ভালোবাসে খুব ঘুরে নিতে, কারোর খাওয়া, থাকা প্রায়োরিটি থাকে তো কারো আরেকটা জায়গা দেখা। কেউ ভালোবাসে শপিং বা পাবে যেতে কেউ ভালোবাসে ঝুম হয়ে বসে থেকে নিস্তব্ধতা শুনতে। তা আমাদের এই সাতজনের বেড়ানোর ধরন, বা জায়গা একই রকম পছন্দ তা কিন্তু না৷ আমাদের কারোর পাহাড় ভালোলাগে, কারোর সমুদ্র, কেউ ভালোবাসে সমুদ্রের ধারে হোটেলে সাতদিন ঝুম হয়ে কাটাতে কেউ ভালোবাসে পাহাড়ে হেঁটে বেড়াতে। তাও আমরা একসাথে যেতে চাই,  প্রাণপণ চেষ্টা করি একটা এমন জায়গা, সময় ঠিক করতে যাতে করে সবাই একোমোডেট করে যাই। আসলে বোধহয় যদি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, মায়া আর কম্ফোর্ট জোন ব্যাপারটা থাকে নিজের পছন্দ অপছন্দটা আপনা থেকেই নমনীয় হয় যায়।

অনেক ক্যালকুলেশন, অনেক দিন ক্ষন, অনেক জায়গা  মেক মাই ট্রিপে ঘুরে স্থির করা গেল এবার হবে জঙ্গল, আর  নাগপুরের ফ্লাইটটা খানিক সহজ হচ্ছে।  বেশ কথা, কিন্তু ছুটি? তা তো নাই আমাদের কারোরই! বাবুবাড়িতে ছুটি মেলা সোজা না। কিন্তু ওই যে,  আমরা যাবো ভেবেছি যখন, কে পারে রুখতে! সুতরাং প্ল্যান হল, শুক্রবারের ফ্লাইট ধরা হবে, আপিসের পর, রাতে পৌঁছে, শনিবার সকাল আর বিকেল দুটো সাফারি নেওয়া হবে,  আর রবিবার একটা সাফারি করে সেদিনই ফেরা।  কি আর এমন ব্যাপার তাই না?  


প্রথম ধাক্কা এলো শনিবার সকালের সাফারি বুক করতে গিয়ে। মারাঠা দস্যু আক্রমন ঘটে গেল আমার ব্যাংক একাউন্টে। আগে বুকিং করলে ডাবল চার্জ!! আমরা সাতজন মানে দুটো গাড়ি লাগবে। ফস করে ক্যামেরা আর দুটো জিপ মিলিয়ে হাজার পঁচিশেক নেই হয়ে যাবার পর আমার টনক নড়ল, আচ্ছা এত কেন? না ভুরু কুঁচকে তাকাবার কিছু নেই, আমি একটু ইয়ে মত আছি। বহুবার অমন ঘটেছে, ঘটনা ঘটানোর পর উপলব্ধি করেছি ছড়িয়েছি বলে৷ টিকিট কাটার আগে বাঘের মতই ক্ষিপ্র ভঙ্গীতে কাজ করেছি, স্রেফ একটা সাফারি আমার সোজা বাঘ থেকে ইঁদুর করে দিল, চিঁ চিঁ করে লিখলাম এই ঘটেছে।  এরা সবাইই ভীষণ ভদ্র ফলে কাঁচা খিস্তিটা আর করল না কেউ, বরং কেউ কেউ চেষ্টা করল ফোন করে কথা বলে ক্যানসেল করানো যায় কিনা, ইত্যাদি। অতীত বদলে বর্তমানের  আর ভবিষ্যতের ভিখারি দশা বদলাতে পারলে তো কথাই থাকত না। সুতরাং আমাদের কাছে দুটো অপশন রইল, হয় এই সাড়ে তিন হাজার এর মায়া ত্যাগ করা যাক না হয় লুঙ্গী ঝেড়ে মাঠে নেমেই পড়া যাক। কত দূর কপর্দকশূন্য হব আর,  এমনিতেও গরীবের হারানোর কিছু থাকেনা বিশেষ! 


পরের ধাক্কা এলো, ফ্লাইট বুক করতে গিয়ে, না দামে এবারে কুপোকাৎ করতে পারেনি, কারন এক অপরাধে দুবার সাজা যেমন হয়না, এক আঘাতে দুবার পেড়ে ফেলা যায়না। এবারের ধাক্কা সময়ে। বিভিন্ন রাজ্য থেকে সবাই জুটছিলাম বলেছি আগেই। তা দেখা গেল,  সবাই মিলে জড়ো হয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বাজবে। ওখান থেকে তিন ঘন্টা সাড়ে তিন ঘন্টা তাড়োবা। অর্থাৎ ভোর রাতে পৌঁছেই এক ঘন্টা পরেই হবে আমাদের প্রথম সাফারি। অবশ্য এটা যে আসলেই একটা চাপ এটা আমরা সকলে বুঝেছি অনেক পরে, যাবার  আগে আগে, কারন.... আচ্ছা সে কথায় পরে আসছি।


এরপর ধাপে ধাপে ধাক্কা খেয়েই গিয়েছি আমরা, নাগপুরে যে বন্ধুর ভরসায় ছিলাম, গাড়ি হোটেলের, সে দুম করে সবাইকে ব্লক করে পালিয়েছে। তারপর যে হোটেল বুক করেছি তার খরচা দেখে আমাদের হার্ট বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে, কেউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, কেউ কাজে ফেঁসে যাওয়াই ক্যান্সেল হয়ে যায় অবস্থা। তো ঘটনা হল আমরা এসবে আর পাত্তা দিইনা। আমাদের সাথে ভালো স্মুথ কিছু তো হবার কথাও না এ যেন আমরা জেনেই গেছি। যে ছেলেটা কোনোদিন মার খায়না সে মার খেলে কান্নাকাটি করে, আর যে মার খেয়ে খেয়ে পোক্ত সে মার খেলে হাসে। আমাদেরও তাই হাল আর কি। 

ক্রমে সেই দিন চলেই এলো। অফিস থেকে হাঁকপাঁক করে বেরিয়ে দেখি উবের কাস্তেতে শান দিয়েছে আমার গলাটা নামাবে বলে। একটা হলদে ট্যাক্সি ঝিমুচ্ছিল, ফিসফিস করে বললাম কাকা  তোমার ট্যাক্সিতে বসে উবের ডাকবো? ধড়মড় করে বলল, "তামাশা করনেকা ক্যা, যাব না বলেছি নাকি!"  

যাই বলো বাপু,  ট্রেনে যাওয়া অনেক আরামের, ফ্লাইটে বড় শীত করে,  তাছাড়া দশ টাকার চা একশো টাকায় বেচে বদ গুলো। শুধু নাক ঠেকিয়ে নীচের মিটমিটে আলো জ্বলা শহর দেখতে ভালো লাগে বেজায়। কোলকাতার থেকে সব এয়ারপোর্টই মনে হয় ভালো। মন খারাপ হয়ে যায় মাইরি। মন খারাপ অবশ্য বেশীক্ষন স্থায়ী হবার সুযোগ পায়না।  এয়ারপোর্টে সবাই মিলে জুটতেই ফের হাসাহাসি ,  গল্প আড্ডা। বন্ধুরা থাকলে অনেক কঠিন জিনিসই কেমন সহজ হয়ে যায় তাই না?


রাতের বেলা গাড়ি বা বাসে করে ট্রাভেলের একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে। হা ক্লান্ত হয়েও সমানে নিজেদের নিয়ে তামাশা করতে করতে কখন দেখি গাড়িটা হাইওয়ে ছেড়ে দিয়েছে। চারপাশ ঝোপঝাড় আর একটা অদ্ভুত আকাশ, গাড়ি কাচ দিয়েই একগাদা তারা দেখা যাচ্ছে, নিঝুম চারধার। একবার থামতে হল আমায়, খোলা বাতাস না হলে চলছিল না। ড্রাইভারজি পছন্দ করছিলেননা, কারন জঙ্গলের সীমান্তে আমরা ঢুকে গেছি তখন। চারপাশে বড় বড় মানুষ সমান ঘাস এর ফাঁকে কিছু থাকলেও টের পাবার উপায় নেই। এমন অদ্ভুত ছমছমে জায়গায় নামতে অস্বস্তি লাগে তো বটেই কিন্তু অদ্ভুতের আলাদা টানও থাকে। সেই টানেই মনে হয় শারিরীক অস্বস্তি ফেলে দিয়ে,  ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট সরিয়ে অন্ধকারে চোখ মেলে দেখতে ইচ্ছে করে, এক আকাশ ভর্তি ঝুরো ঝুরো জটলা করা, কিংবা আলাদা থাকা তারা দেখে থমকে যেতে হয়।

ড্রাইভারজি তাড়া দেয়,উঠে আসি। ফের চলা শুরু হয়। কতক্ষন পর, জঙ্গলের মধ্যে কাঁটা তার ঘেরা হোটেলে আমাদের গাড়ি ঢোকে। শুনশান সে হোটেল্র খোলা জায়গায় দাঁড়ালে শিরশির করে পাশের ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে।  খাবার জায়গায় আলো জ্বলছে, কেউ কোথাও নেই, আমাদের অবশ্য কিছু যায় আসেনা তাতে। কে যেন কেয়ারটেকারকে খুঁজতে গেল, বাকিরা ওইখানেই থাবা গেড়ে ঝোলাঝুলি খুঁজে কী আছে বের করতে লাগলো। বলছিলাম না,  মার খেয়ে খেয়ে বিগড়ে যাওয়া ছেলেপিলের দল সব! 

(ক্রমশ)

Friday, November 15, 2019

বত্রিশ সিংহাসন

বত্রিশ কোটি বছর ধরে যার জীবন আবর্তিত হচ্ছে, তার আবির্ভাব আলাদা করে আবির্ভাব  দিবস উদযাপন এর প্রয়োজন নেই এ কথা তো আর আমার শিষ্য শিষ্যাদের বুঝিয়ে উঠতে পারা যায় না। তাই সকাল দুপুর নানান ভাবে নানান উপাচারে ভোগ গ্রহন করতেই হয়। 
অফিসে, বিকেলবেলা বাচ্ছা শিষ্য গুলো টেনে নিয়ে চলে,  আরে চলো না দাদা একদিনই তো। তাদের ইচ্ছে ছিল প্রিন্সেপঘাট। নৌকায় বসে নিজের হাতে সেজে  মহাপ্রভুকে নিবেদন করবে,  জল টল খাওয়া হবে। তা মহাপ্রভু নিজের বাহন নিজেই চালনা করেন বলে রাজী হলেননা কিছুতেই। 
শেষে কচি শিষ্যদের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,  চল তবে কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাট না,  ভেড়ি ঘাট! এক ওস্তাদ শিষ্য আছে, সে সব জানে কোন কোনে মহারাজের নিবেদনের জিনিস মিলবে। এদিকে মহারাজ তো এমনি একা একা ঘুরে এসব জায়গার সব জানে, কোথায় পার্থেনিয়ামের ঝাড় আছে, কোথায় কালীর মন্দির, কোনখানে বাড়ি, কোনখানে বসার জায়গা সব জানেন। মহারাজের লীলা আর এরা সব জানবে কী করে! বলছে দাদা তুমি এসব জায়গার খোঁজ পেলে কি করে! 

পাশেই কালীমন্দির। অন্ধকার  থেকে এক দুটো ইঁদুরের লাফানোর আওয়াজ ছাড়া আর তেমন আওয়াজ নেই। দুই শিষ্য হাবিজাবি বীজ ফেলে  মসৃন করছে একজন পাহারা দিচ্ছে আরেকজন মহারাজের মাথায় আরাম করে দিচ্ছে একটু। এমন সময়,  কে যেন এলো, সকলে সচকিত। ওস্তাদ শিষ্য আশ্বস্ত করলো, আরে কিচ্ছু হবেনা, আমি এসব ঢের দেখেছি।  প্রভু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন!  প্রভু অল্প হাসে,  যে আসে তার দিকে তাকিয়ে বলে কী ব্যপার। সে ওই মন্দিরের পুরোহিত, "প্রভু এক দুই টান...."। 

এইসব দ্রব্য লোকে শেয়ার করতেই ভালোবাসে। তাই কিছু সময় পর দেখা যায় সকলেই প্রসাদ পাচ্ছে। শিষ্যরা অবাক,  'প্রভু আপনার সত্যিই কিচ্ছু হল না!! " এসব সামান্য নেশায় মহারাজের সত্যিই কিচ্ছু হয়না। মহারাজের তো নেশা পার্থিব জিনিসে নেই! এসব কথা বোঝার সময় তাদের এখনো হয়নি। রাস পূর্ণিমার চাঁদ একটু ক্ষয়েছে কিন্তু তাতে তার রূপের খুব ক্ষতি হয়নি। ভেড়ির জলে চাঁদের সেই রূপ দেখে যে মাতাল হয় তার নেশার মাপকাঠি এরা বুঝবে কি করে। তারা বুঝতেই পারেনা, মহারাজ কেন ভেড়িতে আরো থাকতে চায়, তাদের প্রাণে ভয়, তারা শহরের আলোয় ফিরতে চায়। 

অরসিক থাকা মানেই এসব জায়গা ভীড়। তাই মহারাজ সদলবলে শহরের আসবাগারে যান। খাদ্য পানীয়তে মজে যায় শিষ্যরা,  মহারাজের এসবে আসক্তি নেই, তাঁর তফাতে বসে শিষ্যদের হুল্লোড় দেখতেই আনন্দ। ভালোবেসে বাচ্ছাগুলো কেক আনে, বত্রিশ লক্ষ কোটি বৎসর এর বৃদ্ধ কেক কাটেন হাসিমুখে। বাড়ি ফিরে দেখেন সংসারাশ্রমে তাঁর মা হাঁটুর ব্যথা উপেক্ষা করে,  চালের রুটি বানিয়েছে।পরের দিন তাঁর রান্নার দিদি রাগারাগি করে, কেন আগের দিন পাঁচ ভাজার কথা বলা হলনা, অন্যদিন হয় এত কিছু যেখানে স্রেফ মাংস কেন হবে, ভাইয়ের জন্মদিনে কি আর সে আপত্তি করতো বেশী রান্নায় ইত্যাদি...
মাতাশ্রী পরের দিন ডিউ কেকটা বানালেন। মহারাজ এত ভালোবাসাতেও টলেননা,  সামান্য ধোঁয়ায় তাঁর কী হবে!

Wednesday, November 6, 2019

আর ইউ হ্যাপি?

#হিজিবিজি 

হ্যাপি কথাটার মানে কি সুখী না খুশী? নাকি দুটোই? দুটো একসাথে না হবারও তো কিছু নেই।  আমাদের আপিসের এক ছেলে,  বিদেশে বিস্তর টাকা মাইনের চাকরি পেয়েছে। টাকার অংকটা এমনই বাড়িতে, পুরোনো আপিসে কোত্থাও আটকাতে পারেনি কেউ, সে নিজেও না। নিজেকেই যুক্তি দিচ্ছিলো, "বাইরে আমি বিএমডাব্লিউ X সিরিজ চালাবো এখানে হলে আইটেন,  কেন যাবনা বলতে পারো?" 

ঠিকই হয়ত। আবেগ দিয়ে বোকারা চলে, তাদের উন্নতিও কম হয়ত তাই। আচ্ছা তাহলে আড়াইহাজার বছর আগে যে রাজপুত্র রাজপ্রাসাদ,  রাজভোগ ফেলে রাস্তায় নেমেছিল সে কি বোকা? তবে সে বোকাকে দেখেই কেন মনে হত লোকের যে লোকটা জানে শান্তি কি, অবিচল থাকলেও রোবট হবার দরকার নেই! 

আমার এক বন্ধু আছে ডাক্তার মানুষ। ডাক্তার হয়েও মোটামুটি আমার মতই অবস্থা তার,  যদিও আমাদের দেশে অন্তত (বিদেশের কথা জানিনা), তার আরো অনেএএক গুন রোজগার হবার কথা। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,  তোর আপশোষ হয়না? হাসেনি, বলেছিল, "কি জানিস, বন্ধুদের সাথে বেরোলে একেবারে কি মনে হয়না কখনো? হয় তো। তবে কি জানিস, যখন নিজের জন্যে অনেকটা সময় বাঁচিয়ে,  নিজের মত কাটাতে পারি জীবনটা, আর আপশোষ হয়না।" 

আসলেই তাই মনে হয়, এত খারাপ লাগা,  অসুখে থাকা আসলেই অন্যের সাথে তুলনায়। ও এই করেছে আমি কী করলাম এই ধারণা কবে কেমন করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের অজান্তেই। তাই আমাদের যাই থাকনা, হ্যাপ্পিনেস নেই। 

আমাদের মনে হয় আরেকবার ভাবার সময় হয়ছে, আড়াইহাজার বছর আগেকার কথাগুলো, অন্তত এখনকার মত করেই। রোজ রোজ এত মানুষ এত দৌড়চ্ছে, এত মদ এত জুয়া এত রোজগার কিন্তু কিসের জন্যে করছি? কী পাচ্ছি ঠিক? দামী দোকানে খাওয়া, দামী জামা পরা, দামী জায়গা থাকা৷ দামী গাড়ি চড়া.... নিঃসন্দেহে এগুলো আকর্ষণীয়, কিন্তু ছায়া ঢাকা শান্ত জীবনের মত শান্তির কি? আমি ঠিক জানিনা। আমার সেই জীবনটায় গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, যেখানে এক সংসার ভরা লোকের মাঝে একদম কিচ্ছু না করা দু একটা লোক থাকে, যারা কিছু করেনা তবুও তাদের বাতিল বলে ত্যাগ করে না কেউ, বাড়িতে ভিখারী আসলে তার বরাদ্দ চাল, আলু থাকে। বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় থাকে, পাঁচ সাতদিন এমনিই কোনো জায়গায় যাওয়ার থাকে সব দেখবো ওই সময়ে এইরকম ভাব না নিয়ে।জানিনা, হয়ত আমার সে জীবন সইবেনা, সওয়ানোর মত মন আছে কিনা কে জানে! ডুব দেবার মত মন..... যখন  কেউ বলবে কোথাও থেকে,  তুমি সফল? সুখী? আমি হাসব খালি তাতেই সব জবাব হয়ে যাবে.....

Wednesday, October 9, 2019

পুজোর চালচিত্র

পুজো এলেই আমার বেজায় ভালো লাগে। হ্যাঁ হ্যাঁ ভীড় হ্যানাত্যানা কিচ্ছু আমায় কাত মাত করতে পারে না। সাধকদের সব রকম অভ্যেস আছে।ভৈরবের ভৈরবী থাকে, সাধকদের সাধিকা, অবধূতের মাতাজি....নইলে আবার সিদ্ধিলাভ মুশকিল কিনা। তাই ভীড়ে ভালো করে দৃষ্টিসঞ্চালন করে দেখছিলাম উপযুক্ত কাউকে কিনা। দূর দূর তক কুছু নাই মশাই, কোলকাতা যেন ভেজ থালির মতই খাঁ খাঁ করছে! 

অগত্যা মন দিয়ে ঠাকুর দেখাই স্থির করতে গিয়ে দেখি অসম্ভব। মোবাইলে তাগ করে সহস্র ফটোগ্রাফার! একজনকে বললাম,  "আরে দাদা আপনার হাতে তো ছবি কথা বলে!! হেব্বি তুলেছেন, একবার ওই এঙ্গেল থেকে দেখুন তো। আলোটা দারুণ ক্যাপচার করেছেন।" ব্যাস নিমেষে ঠাকুরের সামনেটা হালকা হয়ে গেল, ফটোগ্রাফারের দল "ওই" দিকটা চলে গেল। 


যাহঃ শালা! কাত্তিক গনেশ এরা এমন ট্যাবলেট সাইজ কেন? আর এবারে কি সিংহ পাতা ফেলেছে? সব কটা মন্ডপেই ঘোড়া দিয়ে কাজ চালাচ্ছে? ঘোড়া আবার হিংস্র ঘোড়া, ঘ্যাঁক করে দাঁত বের করে অসুরের হাত খাচ্ছে। ঘাসের বদলে মাস? ভেগানগুলোর চোখে এ দৃশ্য পড়লে মরেই যেত। 


সারা শহর টহল দিয়ে মহারাজের পা যখন বিদ্রোহ করছে,  ভীড় পেরিয়ে নদীর ঘাটে বসতে এসেছি। চার দিকটা তূলনামূলক ভাবে শান্ত এখানে। লোকজন তেমন নেই, একটা একা বোকা লোক নদীর ধারে চুপটি করে বসে ওইপাড়ের আলো দেখছে, এপাড়ের ভীড় হুল্লোড় পার হয়ে। আর ওই কোনায় একজোড়া ছেলে মেয়ে হাতে হাত দিয়ে আলো মেখে দাঁড়িয়ে। খানিক বসে থেকে ফিরতি পথে দেখি, একটা খুব খেঁচুটে মুখের গোঁফালো লোক আইস্ক্রীম কিনে দিচ্ছে একটা নাকে সর্দি মাথায় উকুনে ভরা বাচ্ছাকে। ট্রাফিক ছাড়তেই বাঁধ ভাঙা ভীড়ে বয়স্ক বাবার হাত ধরে তার মেয়ে নিয়ে যাচ্ছে।


আমার বন্ধুরা ভারী বিরক্ত হয় এই মেট্রোর সাড়ে ন লাখ মানুষের ভীড়ে, রাস্তায় জ্যামে, এত মানুষের ঠাকুর দেখবার জন্য রাস্তায় নামায়...কিন্তু এই যে এত ভালো ভালো দৃশ্য এগুলো পুজো না এলে কেইই বা দিত! 


ভালো হোক,  আনন্দে কাটুক সবার পুজো।



*******★**************★*****************



"কিরে এখনো কতদূরে?"


ফোনের ওপারে বাবার উত্তেজিত গলা। রওনা দিতে দেরী হয়েছে বিস্তর। ইচ্ছে করেই খানিকটা। যা হয়, বাবার উত্তেজনা বোঝার ক্ষমতা ছেলের থাকেনা। উলটে বিরক্ত হয়ে বলি, "আসছি তো অমন করছ কেন?" 


এবারে  আমাদের পুজো কোনোমতে হচ্ছে।মানে ঢাক, কাঁসর সবই আছে কিন্তু সে ঢাকে যতটুকু কাঠি না পড়লেই নয় ততটুকুই পড়ছে। হবার কথাই ছিল না, ধনাদার বউ মারা গেল পুজোর মুখেই,ভুল চিকিৎসায়। যে ডাক্তার অপারেশন করেছিল সে ডাক্তার মন দিয়ে ব্লাড রিপোর্ট দেখেনি, আরো অনেক অপারেশনের তাড়া, লোভ।পিজিতে শেষ কদিন যিনি দেখেছিলেন তিনি খুবই চেষ্টা করেছিলেন যদিও। বাড়ি অব্দি পৌঁছতে অনেকবার থামতে হয়। লোকুদার দোকান, কুমোরপাড়ায় কে একজন যেন, আমি চিনিনা, আমায় চেনে এমন কত জনের সাথে, কুশল মঙ্গল সেরে পৌঁছতে হয়। বাড়ি পৌঁছলে অসময়েও মা জ্যেঠিমা মিলে গরম লুচি ভেজে দেয়। 


সকালে ঘুম ভাঙে দূরে রথতলায় ক্লাবের পুজোর মাইকের আওয়াজে। চন্ডীপাঠ হচ্ছে। আচ্ছা ওরাও তো মাইকটুকু বন্ধই রাখতে পারতো। নাহ তা মনে হয় হবার না! ক্লাবের পুজোয় তো কাল নাকি "ডান্স নাইট" ও হয়েছে। লোকে মদ খেয়ে তাতে পয়সাও দিয়েছে। আমি হয়ত এ যুগের সাথে ফিট করিনা, আমার মনে হয় একটা সামগ্রিক অবক্ষয় আমাদের সবাইকে গ্রাস করছে। একটা ভিডিও দেখেছিলাম, বাচ্ছা ছেলে একটা দাঁড়িয়ে দেখছে এরকমই এক "ডান্স নাইট",  অশ্লীল ভঙ্গীতে নাচছে একটা মেয়ে। এইই একশো বছর টিকে গেলে সংস্কৃতি বলে গৃহীত হবে হয়ত! সকালে চন্ডীপাঠ রাতে সর্বসমক্ষে শরীরী আবেদন পূর্ণ নাচ।


এবারে মাছ ধরা নেই, চা খেয়ে ঘুম ভাঙা চোখে হাঁটা দিয়েছি। বড় সবুজ চারদিক। কিছুদিন আগে বন্যা হয়েছিল। রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে ভেঙে গেছে। কোনদিকে যাচ্ছি কে জানে! লক্ষ্মীর আঁচলের মত ধানের মাঠ, পটলের বরজ, অসময়ের শিম। পিতৃস্মৃতি, মাতৃস্মৃতি মন্দির বানানোর চল আছে খুব এখানে। মন্দির মানে সিমেন্টের চ্যাটালো উঁচু একটা বেদীর মত। তার একদিকে ভস্মাবশেষ রেখে উঁচু করা, মাথায় তুলসীগাছ পোঁতা থাকে। বৈশাখ মাসে জল দেবার রীতি আছে। ভালো নিয়মটা কিন্তু বেশ। একটা সিমেন্টে বাঁধানো বসার জায়গা রইল, বৈশাখ মাসে চারদিক যখন ফেটেফুটে যাবে, নিয়ম এর চক্করে হলেও তুলসী গাছ একটু জল পাবে। আসলে কিছু নিয়ম মন্দ থাকেনা, সময়ের সাথে সাথে শুধু রীতি গুলো মনে রেখে কজ টা ভুলেই চিত্তির হয়।  এই যে অশৌচ চলছে আমাদের,  নিরামিষ খেতে হয়, নতুন কিছু পরতে নেই ইত্যাদি এ তো স্রেফ শোকের আবহে  হুল্লোড় হয়না সেটাই বলা। কিন্তু যদি হুল্লোড় হয় আর এই নিয়মগুলো মানা হয় তাহলে আর মেনে কি লাভ! 



কোথায় যেন এসেগেছি, এ জায়গাটা বেশ তো। কেমন ছায়া ছায়া মাখা। রোদ থেকে গাছের ছায়ায় গেলে একটা ঠান্ডা ভাব বুকে আসে।  তেমন আরাম পাখার হাওয়া বা এসিতে হয়না। মানসিক ব্যপার কিনা জানিনা, তবে আমি তো তফাৎ টের পাই দিব্যি! একটা কাঠঠোকরা ঠক ঠক করে কাঠে ঠোঁট ঠুকছে। একটা ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ তেঁতুল ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুর পাড়ে। এহে এটা তো কারোর বাড়ির পথ। এখান থেকে আর কোথাও পৌঁছনো যায়না।




"মা এসেছে?" রাস্তায় একজন জিজ্ঞেস করে আমায়। আমি জবাব দিই, সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করি, সে নাকি মায়ের খুব বন্ধু, গুছুতদিদি বললেই হবে। আবার হাঁটা দিই, অন্য রাস্তা, চিনিনা এ পাড়াটাও। কিছুই চিনিনা আমি, কেমন অন্ধ কালা ভাবে জীবন কাটিয়ে দিলাম সব থাকতেও! আলপথ ধরে হাঁটছি, দুটো চারটে ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, আশ্বিনের রোদের তাত খুব, এখন মোটে সাড়ে নটা তাতেই তেজ দেখো। মাঠের মাঝে একটা কাদের বাড়ি, একটা বউ পিছন ফিরে বসে কী যেন করছে আর বরটা খালি গায়ে প্যান্ট পরে বসে আছে পাশে। একতলা পাকা বাড়ি, উঁচু জানলা, রঙ করা হয়নি এখনো, হবেও না মনে হয়। আলটা একটু চওড়া মত রাস্তায় পরিনত হয়, দুধারে পার্থেনিয়ামের ঝাড়, আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পেরিয়ে যাই, এলার্জি আছে আমার। রাস্তাটা গোঁত খেয়ে একটা পুকুরের পাশ দিয়ে চলেছে, একটা মুদীর দোকানে আলগা ভীড়। তেমন কিছু বিরাট দোকান না, গ্রামের মধ্যে অল্প জিনিস নিয়ে বানানো দোকান, ধারেই চলে যা বেশীরভাগ সময়।  মাচা বেঁধে কতকগুলো জোয়ানলোক তাস খেলছে। খেলা খুব জমে উঠেছে মনে হয়, খুব উত্তেজিত সব, রঙের টেক্কা থাকতে বিবি দিল কেন বলে, রাস্তার ধারে পুকুরে দুজন বউ চান করছে আর দুটো ন্যাংটা ছেলে খেলছে। একটা লোক আর বউ মিলে জরির কাজ করছে, এখানে পুজো নেই। এ পাড়াটা গরীব না বড়লোক জানিনা, তবে সব কটাই পাকা বাড়ি কিন্তু সব কটাই খুব ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। আলো ঢোকে না, মাঝের রাস্তাটাও একটা সরু গলির মত, দুটো মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে। একদিকে কটা ছাগল বাঁধা পরপর। একটা আবার বোকাপাঁঠা, ওইপাশের দাওয়ায় একটা বাচ্ছা মেয়ে শিউলির মালা গাঁথছে, কিন্তু পাঁঠার গায়ের দুর্গন্ধই বেশী। টিউওয়েল থেকে জল পাম্প করছে একজন মাঝবয়সী বউ। সামনে আর যাওয়া যায় কিনা জিজ্ঞেস করতে, আমি কোথায় যাব খোঁজ নিয়ে বলল, 'এদিক দিয়ে তো বাবা যাওয়া যাবে না, কাদা আছে, ওই দিক দিয়েই যাও"। অ্যাই বলু একে রাস্তা দেখিয়ে দে না।

বলু নামের লোকটা একটা হাতজাল নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে কোথায়, আমায় আয় বলে ডেকে নিল। ওবাবা সামনে যে বিস্তর কাদা! বলুর ভ্রুক্ষেপ নেই, "জুতো হাতে চলে আয়"।  নাহ আমি উল্টোবাগেই যাই।



এদিকটায় কখনো আসিনি, কেমন ঝোপঝাড় ভর্তি। তুলসীমঞ্চ, ঠাকুর বেদী, বড় বড় মাছের হাঁড়ি, এটা জেলেপাড়া মনে হয়। চারটে ছাতারে পাখি ছ্যা ছ্যা করতে করতে উড়ে গেল, একটা লোক জমিতে সার দিচ্ছে। দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে, একটা এই মোটা জারুল গাছ দাঁড়িয়ে আছে হাত মেলে।কুকরু কুকরু করে একটা কি যেন পাখি ডাকছে। একটা গাছের নীচে অনেক্ষন বসে থেকে বুকের মধ্যে অনেকটা ঠান্ডা ছায়া ভরে নিলাম। গাছের সাথে কতদিন পর বসা হল! 





Sunday, October 6, 2019

পুজো শুরুর আগে

প্রত্যেকবার পুজো আসে আর আমার সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায়। ধুতি পরে হনহন করে চলেছে, একটু আগে ঝামেলা করে এসেছে ছেলের দলের সাথে, একটু পরে পদ্মদিদির কাছে ধরা পড়বে, পালিয়ে গিয়ে সারাদিন অভুক্ত থেকে হঠাৎ করে মিলবে পংক্তিভোজন কিংবা যাত্রাদেখা।

হুট করে কাকার হাতে ধরা পড়ে হতাশায় ডুবে গিয়ে সে যখন গরম কাঁচাগোল্লা চিবোয় মসমস শব্দে আমার মন খারাপ হতে থাকে। সেই ছেলেটার সাথেই আমার শিশির ধোয়া শরৎকালের ভোর দেখা হয় এই বৃষ্টিতে মাখামাখি একটাও গাছ, মাঠ,  ঘাস না থাকা শহরে।

সেদিন একটা কাজে ব্যারাকপুর যাচ্ছিলাম। ডানলপ পার হবার অনেক্ষন পর দুপাশের চেহারা  বদলে যায় অল্প অল্প করে। চোখ পড়ে যায় একটা ভাঙা বাড়ির বটগাছে। পাঁচিল ঘেরা অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল বাড়িটা। এখন আর কেউ থাকেনা,  আর কদিন পরেই তিনদিক খোলা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন উঠে যাবে। কারা থাকতো এ বাড়িতে? সেই সর্দার ছেলেটার মত পলানে ছেলে ছিল নাকি? বাড়িদের মন খারাপ হয়? এওরকম একটা বাড়ি দেখেছিলাম,  গড়িয়াহাটের কাছে। ঝকঝকে সব বাড়ির মাঝে,  বন্ধ হয়ে ছাদ ঝুলে যাওয়া একটা বাড়ি। এক পা এক পা করে ঢুকেছিলাম আমি, মাকড়সার জাল, পাতার স্তুপ পেরিয়ে। আবছা অন্ধকারে দেখা যায় দেওয়ালের একটা জায়গায় আলমারী জাতীয় কিছু ছিল বলে কেমিন ফ্যাকাসে, দু চারটে বাজে অদরকারী জিনিস....এ বাড়িতে দুর্গাঠাকুর আসবে না।

সেই সর্দারের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই ছেলেটা তো ঘরে ফিরতেই চায়নি, তবু পুজোর সময় সেই ভুল করে ফিরে যাওয়া ছেলেটার গল্পই মনে পড়ে। আর এই বাড়িটা দেখেও মন কেমন করে, ভুল করে বা ঠিক করে ছেড়ে গেছে সবাই। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে বেশ ভোম্বল সর্দার পুজোয় ধরা পড়ে যাবে না, আর এই ভাঙা বাড়ি গুলো ছেলে মেয়ে সব্বাই ফিরে আসবে, হই হই করে আড্ডা হবে, ছুটোছুটি করে খেলতে গিয়ে ছোটদের মধ্যে একজন ব্যথা পাবে,কান্নাকাটি হুলুস্থুল।
প্যারালাল ওয়ার্ল্ড পুজোয় অন্তত সবার পুজো ইচ্ছেপূরনে কাটুক।

Wednesday, September 18, 2019

বিশ্বকর্মা

বিশ্বকর্মা তো অত খাতির পাওয়া ঠাকুর না, নতুন জামা জুতো, সারারাত আলো কিচ্ছু না। রিকশাওয়ালাদের নতুন গেঞ্জি পরে তদারকি করা ঠাকুর, মেশিন আর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঠাকুর।  রাস্তায় বেরোতেই দেখি সব গাড়ি, রিকশা, অটো ঝকঝক তকতক করছে৷ কেউ কলাগাছ বেঁধে কেউবা ফুলমালা,  কেউ চকমকে কাগজ দিয়ে সাজিয়েছে নিজেদের গাড়ি৷ আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা চালকল আছে, মানে বড়সরো না, গ্রামের লোকজনই খোরাকির ধান ভাঙাতে আসে। সেখানেও আজ পুজো হয়, আর কদিন বাদেই পুজো এলো বলে। আকাশে একটাও ঘুড়ি নেই দেখলাম, হয়ত উড়বে পরে কখনো। কিংবা উড়বেই না, নিউ জেনারেশন মেঘেরা ঘুড়ি পছন্দ করেনা হয়ত।

আমার দুঃখিনী গাড়িটা ধুলো ময়লা পরাই আছে। আমি ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাসী না,  তাই আমার অবিশ্বাসের মূল্য চুকিয়ে আমার গাড়ি ম্লান মুখে চারদিক দেখতে দেখতে যায়। আচ্ছা আচ্ছা মন খারাপ করিসনি, এই সপ্তাহেই ঝাঁ চকচকে করে তুলবো খুব করে। অফিসে বেসমেন্টে মেশিন আছে যেখানে ওখানে বিশ্বকর্মা পুজো হয় প্রতিবছরেই। আলপনা আঁকা, সাজানো পুজো পুজো গন্ধওয়ালা বেসমেনড়ে খিচুড়ি আর আলুরদম খাওয়াচ্ছে। আমার এই সব জায়গায় আসলেই খুব ইচ্ছে করে কোর সেক্টরে চাকরি করতে। প্ল্যান্টে কাজ করতাম বেশ, ফ্যাক্টরির মধ্যে সাইকেল চালিয়ে দুপুরে খেতে আসতাম। রাতে ঝুপ করে রাত নামতো, সকাল হত তাড়াতাড়ি। 

বিশ্বকর্মা মনে হয় সেই ছেলেটার মত, আনস্মার্ট, ইংরাজিতে অদক্ষ, কিন্তু কাজটা জানে খুব। ঝলমলে শহরে তেমন পাত্তা পায়নি, কাউকে জানাতেই পারেনি সে কতটা পারে,তারপর নিজেও ভুলে গেছে সে কতটা পারতো....

Friday, September 13, 2019

ফিরতি পথে

কাল সকাল নটায় আপিস গেছি আর ফিরেছি ভোর চারটেয়। ভোর রাতের কোলকাতা যে কীইই মায়াবী কি আর বলব। রাস্তাঘাট কোনো সময়েই একদম ফাঁকা হয়না, কিছু গাড়ি কিছু বাইক থাকেই ঠিক, কিন্তু জেগে থাকা লোক প্রায় নেই হয়ে যায়, কুকুরগুলো অবদি মরার মত ঘুমোয়।

  আমার কাজ মিটে গেল পৌনে তিনটের দিকে, এমন রাতজাগা রাত তো খুব বেশী আসে না। তাই বাকিরা বেরিয়ে গেল, আমি হাঁটা লাগালাম খানিক, রাতে প্রজেক্টের পহায় ম্যালা খাওয়া হয়ে গেছে।খেতে গিয়ে দেখি কিই ভীড় কিই ভীড়। বুধবারের রাতে এত লোক সেক্টর ফাইভের রেস্তোরাঁয় ভাবা যায় না। হরেক কিসিমের লোক,  দল বাঁধা ছেলে, হুইস্কি আর তন্দুরি নিয়ে, বিয়ারের বোতল সামনে দুই কপোত কপোতি। তো সেই সব খাওয়া হজমও হবে।ওইদিকে এক একটা পাতলা অন্ধকার, মেঘ দেখা যায় আকাশে, কলসেন্টারের সামনে খালি এক মেয়ে সিগারেট ফুঁকছে। এ পাড়ায় নেড়ির প্রকোপ নেই, দু তিনটে যা আছে তারা রাতের বেলা বাঘ হয়ে যায় না। হাঁটতে হাঁটতে গোদরেজ বিল্ডিং এর পাশ দিয়ে ভেড়ির দিকে আগিয়েছি। 

এদিকে আলো কম, ঘুটঘুটে না হলেও বেশ ভালোই অন্ধকার। ইচ্ছে করছিল খুব, পাশের আলের রাস্তা ধরে যাই। সাধক মানুষ হলেও অঘোরী তো না,  মানুষের ইয়েতে অন্ধকারে পা পড়লে আনন্দ হবে না ভেবে এ যাত্রা ক্ষান্ত দেওয়া গেল। 

ঘুম চটকে গেছে, আচ্ছা এমনিই কোলকাতা পাক খেলে কেমন হয়? বাহন যখন আছেই? শুনশান রাস্তায় জলের পাইপ সারানোর কাজ হচ্ছে, কোথাও কোথাও রাস্তা সারাবার কাজও। সিগন্যাল গুলোও রাতের বেলা বেশ এক্টিভ হয়ে গেছে, সেই বিচ্ছু বাচ্ছা গুলো হয়না? দিনে ঘুমায় রাতে এনার্জেটিক হয়ে যায়? অমনি। সারাদিন তিন মিনিট লাগে যে কাজ করতে এখন দেখি দশ সেকেন্ডে হচ্ছে। 

কোলকাতায় বড় আলো মশাই। এত আলোয় খালি দেখা যায়,  মশারী টাঙিয়ে ফুটপাথে আরামে ঘুমোচ্ছে কেউ, এই তিনটেতেই রাস্তায় রিকশা বিয়ে বেরিয়েছে কেউ কেউ৷ ভিক্টোরিয়ার পরীটাকে দেখে আসলেও হয়, একা একা কেমন দাঁড়িয়ে আছে? নাকি ঘুরছে? নাকি সুযোগ পেয়ে মাঝরাত্তিরে  উড়ে গেছে, বন্ধুরা তো জ্যোৎস্না ছাড়া আসেওনা, গল্প করার খেলা করার লোক নেই। জ্যোৎস্না ছাড়া পরীদের পৃথিবীতে আসা বারন, কিন্তু কোলকাতার কালো পরী একদিন বেভুলে চলে এসেছিল। ঠিক বেভুলে না,  ভালোবেসেই, কাকে সেইই জানে,  কেন ভালোবেসেছিল সেটা অবশ্য সেও জানে না সবাইয়েএ মতই। না তাদের মেলেনি অবশ্য, কিন্তু তার আর ফেরার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছিল। নিজেরও খানিক অভিমান ছিল, আর ছিল অনেকটা গোপন ভালোবাসা,  নিজেও জানত না সে কথা। ভালোবাসা অভিমান হয়ে জমাট বেঁধে নিজেকে ভিক্টোরিয়ার পাথরে আটকে দিল। যাব নাকি তাকেই দেখতে এই অন্ধকারে? কালো পরীর চোখ দিয়ে জল পড়ে হয়ত এমন রাতে....থাকগে যে জল মোছাতে পারিনা সে জলের সাক্ষী না থাকাই ভালো।

কাঁকুরগাছি, ধর্মতলা হয়ে গিরীশপার্ক দিয়ে ফিরে ফের রাজারহাট নিউটাউন এসেছি। এলোমেলো পাক খাচ্ছি খালি, আমার তো কোথাও যাবার নেই....

Sunday, September 8, 2019

ভুটের বন্ধু

একটা কেন্নো গুটিগুটি এগোচ্ছে, বারান্দা পেরিয়ে মেঝেতে ঢুকে পড়ল। আমি দেখছি আর একটু পরেই এটা ঘরে ঢুকে পড়বে, আর আমি মাকে বলব। তার আগে না, বললেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। বৃষ্টির জন্যে ঘরের মধ্যে মেলে রাখা কাপড় জামা, সবাই হাঁকপাঁক করবে,  আমি সেই ফাঁকে ঝাঁটার কাঠি দিয়ে কেন্নোটার গায়ে ধরব,গোল্লা পাকিয়ে যাবে, আমি ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাব। সেই সুযোগে, নৌকাটাও ভাসিয়ে দিয়ে আসবো। এরা খালি পড়া পড়া করে। আমার পড়তে ভালো লাগে না। আমি কিছু বুঝতে পারিনা ফিজিক্স এর অংক, আমি গ্রামার এ ঠেক খাই। আমি পড়াশোনায় খারাপ, তাই সারাদিন বকুনি খাই। নৌকাটা ভাসাতে পারলেই হবে, ওই নৌকা ঠেক খাবে এদিক সেদিক, তারপর ভাসতে ভাসতে ঠিক পৌঁছে যাবে কোনো এক অজানা দেশে। আমি জানি এসব হয়না কিছু, আমি তো আর ছোট নেই যে জানব না এসব! কিন্তু আমার তাও ভাবতে ভালো লাগে,  একটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ড কি আর নেই, যেখানে ফিজিক্স নেই, আইয়াইটি নেই, বাবার কলিগের ছেলের ভালো মার্কস নেই।

যা ভেবেছিলাম,  ধুন্ধুমার লেগেছে। আমি এক পা দু পা করে বাইরে। আমাদের আবাসনটায় আমাদের বাড়িটা সবার শেষে, আমাদের বাড়ির পাশেই ভ্যাট, তারপর কুকুর গুলো থাকে, গেট পেরোলে ফুটপাথের লোকগুলো। আজ বৃষ্টিতে আর বেরোয়নি কুকুরগুলো, কেয়ারটেকারের ঘরের পাসে গুটিয়ে শুয়ে আছে, আমি পেরিয়ে যাই। এখানে কোথাও পুকুর নেই, আমার মামারবাড়ির ওখানে আছে। কত পুকুর, এরকম বৃষ্টির দিনে মামার বাড়ির ছাদ থেকে জল সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে লাল রোয়াকে এসে নকশা করে যায়।বৃষ্টি সমানে হয়েই চলেছে, ভিজে যাচ্ছি আমি, জানি বাড়ি ফিরলেই বকুনি খাব, আমার জন্যে কত কষ্ট করে সব তারপরেও আমার মন নেই পড়ায় এসব বলে। বড় হলে আমি ঠিক করেছি এদের থেকে পালিয়ে চলে যাব, আমি ও পাড়ার তাপস,গুড্ডু ওদের মত সোনা রূপোর দোকানে কাজ করব। বড়লোক হওয়া যাবে না  হয়ত কিন্তু বড়লোক হলেই বা কি এমন চতুর্বর্গ হবে! ওই তো বাবার বন্ধুরা, সব খালি বলে সুগার কোলেস্টেরল এই খাব না সে খাব না। ফুহঃ।  সেদিন বিয়েবাড়িতে আমি দশটা মিষ্টি খাচ্ছি দেখে বিশুকাকুর ন্যাকা মেয়েটা তো প্রায় মুচ্ছোই যায় আর কি! তারচেয়ে পয়সা জমিয়ে আমি নতুন নতুন দেশে যাব, সেখানে কিছু মিছু করে পয়সা জমিয়ে আবার নতুন দেশে। খালি বড় হওয়ার যা অপেক্ষা৷ 

সেদিন কি মারটাই না মারলো,  কী না পড়ার বই এর বদলে মোবাইলে গোপাল ভাঁড় দেখছিলাম। কী এমন ক্ষতি হয় তাতে? বাড়ি থেকে পালাবো ভেবেছি, বইবের ব্যাগে একটা জামা,  পাঁচশো টাকা আর দুটো বিস্কুটের প্যাকেট। ব্যাস আর কি চাই! আজ সারাদিন ধরে মায়ের সব কাজ করে দিয়েছি, অনলাইনে মাসকাবারি অর্ডার দেওয়া, বাবার মোবাইলটা সারিয়ে দেওয়া, সব। চুপচাপ পড়তেও বসেছি।বিকেলেই বেরিয়ে যাব কিনা তাই ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। ফিরব যখন সবার জন্যে এত এত গিফট নিয়ে আসব। নতুন নতুন দেশ দেখতে হলে এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত। 

সুতরাং, ভুটে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।কোলকাতার রাস্তায় বৃষ্টিতে মজার থেকে সাজাই বেশী, তবে তাও ভুটের বৃষ্টিতে ভিজতে দিব্যি লাগে। নোংরা জল ছিটিয়ে ছপছপ করতে করতে সে চলল। আরে এদিকের রাস্তাটা তো আমি অর্থাৎ শ্রীল শ্রীযুক্ত ভুটের আসাই হয়নি। অবশ্য স্কুল টিউশন আর বাড়ি ছাড়া কোথাইই বা যাই। না এখানে সত্যি কথাই লিখি, মাঝে মাঝে ইস্কুলের ক্লাস পালিয়ে সুইমিংপুলের পাড়ে গিয়েও বসি।  সুইমিংপুলের নামটা আর বললাম না, বাড়ি ফেরার পর আর যাওয়া যাবে না শেষে! 

নোংরা জল গায়ে লাগলে বাবা মা খুব চেঁচায়, এখন যা লাগছে দেখলে অজ্ঞানই হয়ে যেত হয়ত। আমি শুনেছি, বাবা অনেক বড় চাকরি করে, যদিও কক্ষনো বলেনা, কিন্তু আমি তো আর গাধা না রে বাবা, আমার জামা, জুতো, আমাদের ফ্ল্যাট দেখলেই আমি বুঝি। পড়াশোনা করলে আমিও নাকি এমন হতে পারব, কিন্তু বাবা তো আরামে থাকে না। রোজ রাতে অফিসের কল থাকে, ট্যুরে যায়,  সেখানে নাকি ঘুরতেও অয়ায়না,  খালি মিটিং করে। তাই জন্যেই তো আমি ঠিক করেছি, আমি গ্লোব ট্রটার হব। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো। এমনিতেও পড়াশোনা আমার মাথায় ঢোকেনা, এইই ভালো।

"কেবল পেটে বড় ভুখ না খেলে নাই কোনো সুখ...",  খিদে পেয়েছে।  তা সত্যি বলতে খিদে আমার বেশ ভালই পায়, যখন তখন পায়। একটা বিস্কুটের প্যাকেট তো কখন উড়ে গেছে। কিছু মিছু কাজ দেবে না কেউ? চলতে চলতে কত কিই না দেখা যায়। খিদে না পেলে আরো মন দিয়ে দেখতাম অবশ্য। দেশ ছাড়ার উপায়টা কঠিন। আমার ভূগোল বই খুবই খারাপ লাগে কিন্তু গুগল ম্যাপ বেশ লাগে। তাতে এটা ওটা সার্চ করে যা দেখলাম, ভুটান বা নেপাল যাওয়া যেতে পারে সহজে। ট্রেনে জেনারেলে উঠে পড়লেই হল। বাকিটা তো অ্যাডভেঞ্চারে।
খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। হাঁটতে হাঁটতে কোথায় এসেগেছি বুঝতে পারছিনা। মোবাইল থাকলে লোকেশন ট্র‍্যাক করা যেত। অবশ্য লোকেশন ট্র‍্যাক করেই বা কি হবে।  আমি যে হাওড়া বা শিয়ালদার কোনো ট্রেনে চেপে বসিনি, আমি তো এমনিই ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি এদিকে। বাবা আসলে ঠিকই বলে, আমার কোনো ফোকাস নেই। 

" অ্যাই ওঠো, এখানে ঘুমোচ্ছ কে তুমি?"
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কার যেন ডাকে ঘুম ভাঙলো! অ্যাঁ আশেপাশে তো কই কিছু নেই! এ জায়গাটাও একটু অন্যরকম লাগছে কেন? 
"কে তুমি? তোমার নাম কি? "
ভূত নাকি রে বাবা? চঙমঙ করে চারদিক চেয়ে দেখি একটা নেংটি ইঁদুর খালি দুপায়ে ভর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে।  এইই কথা বলছে নাকি? 
আমি ভারী অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি মানুষের মত কথা বলতে পারো?" 
ইঁদুরটা ভারী অবাক হয়ে বলল, " সে আবার কি! মানুষের মত হবে কেন! আমি আমার মতই কথা বলছি তো!" 
অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখি, সত্যিই তাই! আমি ইঁদুরের কিচমিচ বুঝতে পারছি!! ধুস এরকম হয় নাকি! আমি নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছি, এক্ষুনি বাবা কান ধরে পড়তে বসিয়ে দেবে। আবার পড়াশোনার কথা মনে পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল। এবার নাইন হয়ে গেল, এরপরেই নাকি ঠিক হয়ে যায় আমি বড় হয়ে বিদেশে এইইই বড় চাকরি করব না এখানে চা এর দোকান দেব! 
ওদিকে ইঁদুরটা দেখি কি সব কিচমিচ করছে, কান পাততে দেখি বলছে, "তোমার বুঝি খিদে পেয়েছে? মুখটা এমন শুকনো কেন?"

যেই না বলা খিদের কথা, অমনি পেটটা খিদেদে গুড়গুড় করে উঠলো।  আমি তাও খুব গম্ভীর মুখেই বললাম, "না খিদে পায়নি আমার। কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছিই বা কি করে?"
সত্যি বলতে আমার ভয় করছে, কিন্তু নাইনে পড়া ছেলের ভয় পাওয়াটা দেখানো যায়না। ইঁদুরটা মনে হয় বুঝে ফেলেছে আমার ভয় পাওয়াটা, এক্ষুনি খিল্লি করবে ঠিক। আশ্চর্যের ব্যপার ইঁদুরটা খিল্লি করলো না, খুব নরম গলায় বলল, "দেখো তুমি আশ্চর্য হয়েছ খুব আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কেন হয়েছ আশ্চর্য আমি জানিনা, আমরা তো সবাই সবার কথা বুঝতে পারি, এটাই তো স্বাভাবিক ব্যপার। আর তোমার খিদে পেয়েছে এও আমি টের পাচ্ছি তো, কেমন ম্লান হয়ে গেছে তোমার মুখটা, সুখ দুঃখ সবই টের পাওয়া যায় তো।  তোমার বাড়ি কোথায়? চলো আগে কিছু খাওয়া যাক। "
আমি অবাক হয়েছি এতই,  আমার আর ভয় করছে না। আমি নিজেও বুঝতে পারছি কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। যদি এটা স্বপ্নও হয়,  এটা ভয়ের স্বপ্ন না, তবে চলুক যেমন চলছে।

সুতরাং ইঁদুরের সাথে চলা শুরু হল আমার। গল্প করতে করতে বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ওর নাম লটপট। লটপট নামটা এমন মজার নাম ভারী ভালো লেগে গেল। একটা সিং থাকলেই এর সাথে কেমন,  হাতে লাঠি,  লাঠির আগায় পুঁটলি নিয়ে চলা ইঁদুরের ছবি মনে আসে। ওকে বলতে ওও হেসে ফেলল। কথায় কথায় যা বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে যা বোঝা যাচ্ছে না, তবে সম্ভবত এ জায়গাটা আমার চেনা পৃথিবী না। প্যারালাল ওয়ার্ল্ড মনে হয়। এখানে সবাই সবার কথা শোনে বুঝতে পারে। 

-হ্যাঁরে লটপট, খেতে কোথায় নিয়ে চলেছিস? আমার কাছে মোটে পাঁচশো টাকা আছে।

- অ্যাঁ টাকা? টাকা কি? ও  দিয়ে কী হবে?

- বলিস কি!  টাকা জানিস না? ওরে মানুষদের তো টাকা দিয়েই সব রে। টাকা না থাকলে কিচ্ছু হবে না। খাওয়া, পরা, থাকা, বেড়ানো কিচ্ছু না।

- সে কিরে! এরকম কখনো শুনিনি তো! আমাদের এখানেও তো মানুষ আছে। টাকা হয়না তো তাদের! আমাদের এখানে ভালো কাজ গোনা হয়। ধর,  তোর খিদে পেয়েছে, খাবার নেই।  এবার তোকে কেউ খাওয়ালো। সেটার পয়েন্ট হল, সেই পয়েন্ট দিয়ে তুই তোর পছন্দের কিছু করতে পারবি। আবার তোকে তো রোজ রোজ এমনি খাওয়ালে তোর লাভ হবে না কারন তোর আত্মিক উন্নতি হচ্ছেনা। হ্যাঁ তুই যদি বিজ্ঞানী,  বা শিল্পী হতিস যা গাছ লাগানো লোক তাহলে তোকে তোর খাবার চিন্তা করার দরকার হত না। গাছেরাই তোকে খাওয়াতো। তাহলে,  তোকে রোজ খাওয়ালে কিন্তু পয়েন্ট বাড়বে না, বরং তোকে যদি এমন কিছু কাজে নেওয়া গেল যাতে তোর নিজের  আত্মিক উন্নতি হবে বা বাকিদের তাহলে পয়েন্ট অনেক বেশী। তাছাড়াও আরো জটিল ব্যাপার আছে। 

- পয়েন্ট ট্র‍্যাক করে কে? নাহলে তো যে কেউ মিথ্যে বলতে পারে?

- তা পারে না। এখানে ট্র‍্যাক হয় অটোমেটিক্যালি। মানে তুই জন্মালি যখন, কোনো গাছের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। গাছেরা তো খুব প্রাচীন বিচক্ষণ,  তাদের একটা পদ্ধতি আছে তারা ওই ছোট বয়সেই সবার মধ্যে ভালোবাসা, আর মায়া তৈরী করে দেয় শিকড় দিয়ে। ব্যাস ও হলেই হল, বাকিটা এমনিই হয়ে যায়।

- মানে এই যে আমি কিচ্ছু পারিনা, ফিজিক্স, কেমিষ্ট্রি, ইতিহাস, ভূগোল আমাকেও এখানে কেউ দুচ্ছাই করবে না? আমি যদি গাছ লাগাই, গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করি, হাওয়ায় গান ভাসাই আমার পয়েন্ট হবে, আমায় সবাই ভালোবাসবে আর ভালো বলবে? 

- আরি বাপ্রে গাছেদের স্থান সবার উপরে এখানে।  আর হাওয়ায় গান ভাসালে  তো হয়েই গেল। তুই তাহলে সবার ভালোবাসা পাবি। 

- আর যে এসব কিচ্ছু করেনা, অন্যের জিনিস কেড়ে নেয়,জুলুম করে সে? তাকে কি মেরে ফেলা হয়?

- এখানে অমন সহসা কেউ করে না বুঝলি। তাও কারোর যদি ভালোবাসার তার কেটে যায়,  অমন হয়ে যায়, তাকে আমরা জঙ্গলে একা একা ছেড়ে দিই।

- বাঘে খেয়ে নেয় বুঝি তাকে?

- না না, সে আবার কি!  বাঘ অমন মানুষ খায়না। বাঘেদের তো আলাদা খাবার আছে। জঙ্গলে থেকে থেকে ওর মধ্যে আবার ভালোবাসা ফিরে আসে। শিকড় লেগে যায় মনে।

অবাক হচ্ছিলাম, তাও বড় ভালো লাগছিল সব।  আহা কিই ভালো কিই ভালো। এখানেই থেকে গেলে হয়। লটপট আর ভুটে মিলে পৌঁছলাম এক জায়গায়। মিষ্টি এখানেও সব একইরকম পাওয়া যায়। আসলেই তো একই জায়গা খালি অন্য ডাইমেনশনে। দুজনে মিলে খুব খানিক কালাকাঁদ, সরপুরিয়া,  সরভাজা, কেশর রসমালাই,  রাবড়ি খেয়ে চললাম আবার। মনে ফূর্তি থাকলে আমি গান গাই মন্দ না, একটা নদীর ধারে, সবুজ মাঠের উপর আধশোয়া হয়ে গান গাইছি, লটপট বাজনা বাজাচ্ছে, ওই দেখো একটা হনুমান, ল্যাজ ঝুলিয়ে আরাম করে বসে শুনছে। আরো চারটে ছেলে মেয়েও জুটেছে দেখছি। গান টান গেয়ে শেষ হতে না হতেই এক পশলা বৃষ্টি এসে গেল। কাদায় মাটিতে মাখামাখি হয়ে খুব খেলাও হল। কাদা মাটি মেখে হুড়োহুড়ি করতে এত ভালো লাগে? জানাই ছিল না তো! 

দিন কেটে যায়  খেলে,হুল্লোড়ে, আনন্দে। আমি চমৎকার রাঁধতে শিখেছি। বন্ধুদের খাওয়াই, গল্প করি। গান গাই। আমি নাকি খুব ভালো।  এমন করে কেউ কখনো বলেনি আগে। আহা আমাদের পৃথিবীটাও এমন হত যদি। পৃথিবী বলতেই মনে পড়ে গেল, মা এর কথা। অমনি আমার মন খারাপ করতে লাগলো খুব। বৃষ্টি ভালো লাগে না, গান ভালো লাগে না, নদীতে ঝাঁপাই জুড়তে ভালো লাগেনা। খালি কান্না পায়। 
আমার বন্ধুরা ডেকে ডেকে সাড়া পায়না। শেষে একদিন লটপট টেনে নিয়ে গেল বুড়ো বটের কাছে। বটদাদা আমায় আদর করে ডেকে নিল ঝুরির মাঝে।

- মাকে মনে পড়ছে? 

- হুঁ।

- এখানে আত আলো,  এত গান তাও ভালো লাগছে না?

- না আমি বাড়ি যাব।

- আচ্ছা বেশ। তুই এত ভালো তোর মন খারাপ হলে আমাদের সবার কষ্ট হয় তো। তোকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। কখনো যদি খুব কষ্ট হয় অস্থির লাগে আমায় বলিস নিয়ে আসবো। 

- তোমায় বলব কি করে? ওখানে তো তোমাদের দেখাই যায়না! 

- দেখার দরকার নেই তো। আয়, তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি। 

বটদাদা শিখিয়ে দিয়েছে আমায়। আসার আগে বন্ধুদের জন্যে কষ্ট হচ্ছিল খুবই, তবে আনন্দও হচ্ছিল, মাকে দেখবো বলে। বটদাদাই আমায় পৌঁছে দিল কেমন করে যেন।  যেইখানে বসেছিলাম সেই খানে।  কতদিন কেটে গেছে এর মাঝে কে জানে। আমি এ কদিনেই অনেক বড় হয়ে গেছি। আমি জানি আমি কী পারি। আমি আনন্দে থাকতে জানি এখন থেকে। গাছেদের সাথে কথা বলা শিখে গেছি,  দুঃখ হলেই বলে দিতে পারি তাদের। পালাবোনা আর। এরাই আসলে বাঁচতে জানেনা। আমি জানি, আমি বড় হলে নদীর পাড়ে একটা ঘর বানাবো, গাছে ঘেরা। আমার মত আরো অনেক হেরে যাওয়া দুঃখী অপদার্থ ভুটেকে শিখিয়ে দেব। ওই দুনিয়া থেকে লটপট বেড়াতে আসলে তাকে দেখাবো তার বন্ধু তাকে ভোলেনি, তার জন্যে জায়গা বানিয়ে দিয়েছে এখানে।

Sunday, August 4, 2019

লালচাঁদের বন্ধু

ফ্রেন্ডশিপ ডে তে একটা গল্প রইল বন্ধুদের জন্যে

********************


সে অনেকদিন আগের কথা না। এখনকারই কথা।  একটা বাতিল হওয়া মোবাইলের গল্প। বাতিল তো হয়ে গেছিল, কারন সে তেমন নতুন মডেলের না।  সে টুজি মোবাইল, নেটের স্পীড কম স্বাভাবিক তাকে দিয়ে আর হবে না। আমরা ভাবি বটে মোবাইলের আবার আলাদা করে প্রাণ কি। জড় পদার্থের প্রাণ নেই এতো ছোটবেলার স্কুল বইতেই থাকে! কিন্তু সে সবের বাইরে বেরোলেই দেখা যায় এই যে আমাদের চারপাশে বই, জিনস, গেঞ্জি, কফিমগ, মোবাইল এ সব কিছুর প্রাণ আছে। আমাদের র‍্যাডারে ধরা পড়ে না। সে এক অন্য দুনিয়া। আমি জানলাম কেমন করে? র‍্যাডারের কিছু গন্ডগোল হয়ে থাকবে, অন্য ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে ফেলেছিল।

তো সেবার সেই বাতিল মোবাইল,  ধরা যাক তার নাম লালচাঁদ। লালচাঁদ  তো মনের দুঃখে ধূলো মেখে শুয়েছিল পুরোনো বাতিল জিনিস রাখার তাকে। সে আর কি করে,  সুস্থ সবল মোবাইল স্রেফ নতুন জিনিস পারেনা বলে তাকে কেউ আর পাত্তা দিচ্ছে না, নতুন মোবাইলদের থেকে শুনতে পারে সে কত কিছু। কত রকম খবর, কত আশ্চর্য দৃশ্য সবই দেখে, নিজেদের মধ্যে গোপনে আদান প্রদানও হয় নানান রকম জিনিসের। লালচাঁদ শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হয়ে গেল। এরকম ভাবে হয়না। সে যখন কাজে যেত, সে দেখেছিল পূর্নিমার চাঁদে হিমালয়ের চূড়ো, সে দেখেছিল বর্ষায় উথালপাথাল  নদী, ঝরনা, জোয়ারের উচ্ছ্বাসে থাকা সমুদ্র, সে ভেবেছিল একদিন সামনাসামনি দেখবে এসব কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল দেখো!  এত সব শখ অপূর্ণ রেখেই মরে যাবে নাকি একদিন ওই সাদা মোবাইল ক্যানুর মত? 

সুতরাং লালচাঁদ একদিন রাতে গুটগুট করে বারান্দায় এলো।  নিঝুম রাত। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে খানিক আগেই। রাস্তায় আলো গুলো গম্ভীর মুখে পাহারা দিচ্ছে। ওরা খুব একটা আলাপী না, কথাও বলেনা নিজেদের মধ্যে। দু চারটে গাছ মাথা ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে মাঝে মাঝে,  জল ঝাড়াও হচ্ছে গানের তালও হচ্ছে। গাছেরা দিব্যি আছে বাপু, ভাবে লালচাঁদ, মারো কাটো পাত্তাও দেবেনা। নিজেদের মত করে বাঁচবে, জ্ঞান নেবে কিন্তু অযথা দিতে যাবেনা, আশ্রয় দেবে, আর বর্ষার রাতে সবাই ঘুমোলে জলসা বসিয়ে দেবে গানের, আড্ডার। লালচাঁদ ভাবে, সে একটা চেষ্টা করবেই করবে। হয়ত মরে যাবে, সে এখনও তো মরেই আছে প্রায়। 

"আরে আরে করো কি, ঝাঁপ দেবে নাকি!"

চমকে তাকায় লালচাঁদ, এত রাতে কে! ঝিম ধরা রাস্তা শুয়ে আছে খালি। ঘরের ভিতর মানুষগুলো ঘুমোচ্ছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ইলেকট্রিক তারে বসে ঝিমোনো একটা কাক।  ডানা ঝাপটে তাকেই বলছে। লালচাঁদ গম্ভীর মুখে বলে,  'দেখি কি করি। তুমি এসময় জেগে?' 

-আর বাপু বোলোনা। মানুষগুলোর জ্বালায় নিশ্চিন্দি ঘুম কি আর আছে হে। সারা রাত গাড়ি চলে, আর কুকুরগুলোর কাজ তো জানোই হাউমাউ করে চেঁচানো আর সারা পাড়া মাত করা। ঘুমের আর থাকে কি! 

- হুঁ সে সত্যি বটে। আমি যখন কাজ করতাম, মানুষগুলোর হয়ে, তখন তো নেটের এত বেশী রমরমা ছিল না, তাতেই মাঝে মাঝে রাতে কাজ করতে হত আমায়। আর এখন তো দেখি, যারা কাজ করে তাদের রাত দিন বলে কিছু নেই। চব্বিশঘন্টায় দশ এগারো ঘন্টা খালি বিশ্রাম। তা তারা সব ইয়ং জেনারেশন মোবাইল, স্মার্ট, ক্যারিয়ারিস্টিক, তারা ভাবছে তাদের ছাড়া মানুষ বুঝি অচল। তারা গেলে অন্য কিছু আসতে একদিন লাগবে মানুষের আর এই এক্সট্রা খেটে আসলে তাদেরই শক্তিক্ষয়, জীবনক্ষয় হচ্ছে সে আর বোঝে না। যাক,  বেশী বলব না এ নিয়ে ভাববে হিংসে করে বলছি। হাজার হোক আমি তো বেকার অচল। 

- আরে তুমি দেখি বেজায় মুষড়ে পড়েছ। একথা ঠিক তোমার কথাগুলো অসফলের অজুহাত ভাববে সবাই, তাই না বলে ভালো করেছ কিন্তু তাই বলেই তুমি বেকার অচল হবে কেন? দেখো দেখি কেমন চমৎকার গান ধরেছে ওই কোনার নিমগাছ, কেমন ঝিম ধরা রাত দেখো এসব মনের মধ্যে অনুভব করতে পারছ যখন অচল হবে কেন তুমি?

- আরে ভায়া ওইটেই তো কথা। আমি দুনিয়া দেখতে চাই। কাজের সময় কত দেখেছি ছবি, এবার নিজের চোখে সামনে থেকে দেখতে চাই। আমি আকাশের নীল ঘুড়ির সাথে উড়তে তো পারব না কিন্তু খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সেই ঘুড়ির লড়াই দেখতে চাই, ঝরণার জলে চান করতে পারব না কিন্তু বর্ষায় কেমন ঝপাং করে পড়ে একরাশ জল, নদীতে তাই দেখতে চাই। সেটাই ভাবছিলাম তো এখানে দাঁড়িয়ে, যে যাব কিভাবে।

- ওহ এই কথা! শোনো ভায়া আমার নিজেরও আর ভালো লাগে না এখানে। এত নোংরা খুঁজে খাবার জোগাড় করতে করতে কেমন যেন ওইটাই আমার পরিচয় হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তো পাখি বলো। আমি উড়াল দিতে চাই, ঘাসের ফাঁকে পোকা ধরতে চাই, গরুর পিঠে বসে খুনসুটি করতে চাই। আমিও ভাবছিলাম পালাবো বুঝলে।

- তোমার তো সুবিধে,  তুমি উড়ে চলে যেতে পারবে যেখান খুশি। আমার তো তেমন সুবিধে নেই, তাই ভাবছিলাম কেমন করে যাই।

- না বাপু অত সোজাও না যত ভাবছ। আমাদের সমাজ আছে না, তারা অন্যরকম হওয়া পছন্দ করে না। আমায় পকলাতে হবে। জানি পালাবার পর ছিছিক্কার পড়ে যাবে। তাছাড়া টান অনেক কিছুর হে, কাটানো মুশকিল হয়।

-তা মিথ্যে বলব না আমারও কি মনে হচ্ছে না কাজ কাম না করে বেশ আছি তো। শুধু শুধু চাপ নিয়ে আর লাভ কি! তবে ওই আর কদিন বাঁচবোকে জানে, যদ্দিন পারি ঘুরেই নিই।  যা হবে দেখা যাবে।

- তবে চলো।

-  অ্যাঁ তুমিও যাবে বুঝি?  কিন্তু তুমি তো উড়েই চলে যাবে।  আমি যাব কেমন করে? 

- শোনো এক কাজ করি, সেদিন একটা মালা মত জোগাড় করেছিলাম। ওটা তোমার জামায় আটকে দিই, তারপর গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ব।

- সে তো খুবই ভালো প্রস্তাব আমার জন্যে,  কিন্তু তোমার বড় কষ্ট হবে।  তুমি এতটা পথ বইবে আমায়.....

- আরে এত ভাবলে চলে? থামবো না হয় একবারের জায়গায় দুবার। আমাদের তাড়া কি? আর শোনো বন্ধুদের জন্যে এটুকু তো করাই যায় নাকি? তুমি আমায় গান শুনিয়ো, গল্প বোলো ওড়ার কষ্ট দূর হয়ে যাবে।

- আহা বড় আনন্দ পেলাম রে ভাই। তোমার নাম কি? আমি লালচাঁদ।

- আমি?  সে একটা কিছু ছিল ছোটবেলায়, এখন আমি খালি এপম্লয়ি নাম্বার ৩৫৭১৮৬৩।

- অ্যাঁ সে আবার কি?

- সে আছে,  পরে বলব খন। ওসব বাদ দাও।  ধরে নাও আমার নাম লালচাঁদের বন্ধু।

- সে তো বটেই।  তবে আমি কি নিজেকে বলব লালচাঁদের বন্ধুর বন্ধু?  

- হাহাহা আচ্ছা বেশ  আমার নাম দিলাম পলানে। পালাচ্ছি কিনা? কি বলো অ্যাঁ? এবার চলো নইলে ভোর হয়ে যাবে সব চৌপাট হবে।

- হ্যাঁ হ্যাঁ আর শোনো না আমার জন্যে মালাটালা নিতে হবে না। আমার চার্জারটা আছে না ওটার দুমুখ আমার জামায় কায়দা করে আটকে দাও তো। মাঝে মাঝে খাবার দরকার হবে, খুব কম কিন্তু হবে।

- সে আর বেশী কথা কি। এসব আমি পারি ভালো। 

তারপর তারা দুজন পালালো। অদ্ভুত অসম দুই বন্ধু, একটা কাক, তেমন দক্ষ না কাজে, আর একটা মোবাইল যে আজকের দিনে প্রায় অচল, এবং অপদার্থ।  তারা একটু যায় অনেক বিশ্রাম নেই। চলতে চলতে কত লোকের বারান্দা, ঘর, কত পাহাড়, নদী ঝরনা দেখলো। কত লড়াই দেখে মুচকি হাসলো। কতবার রাগারাগি হল নিজেদের মধ্যে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ হল না। কারন ওরা জানতো বন্ধু ছাড়া এমন দুনিয়া দেখা তাদের হত না,  কিংবা আনন্দও হত না হয় একা একা দেখে। 

মাঝে মাঝে হুট করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পেতেও পারো একটা কাক আর তার গলায় একটা মোবাইল  ঝুলিয়ে চলেছে।

Friday, July 19, 2019

নদীর পাড়ে

শান্ত আশ্রমের মত বাড়িটা পেরিয়েই নদী দেখা যায়। নদীর এখন ভাটার সময়, মস্ত চড়া।  দেখে ভাববে বুঝি এ আবার কি নদী, খালি কাদাই সার। ওহ এ তো আবার নদী না, নদ। নদী নামটা কেমন ভালো নদ কথাটা কেমন যেন। আবার নদ-নদী বললে খারাপ লাগেনা।  সে যাই হোক, এখন নাম ধাম ভুলে তাকাও, নদীই মনে হবে যেন। অনেক পথ পাড়ি দেওয়া,  সংসারের তাপে ক্লান্ত হলে কি হবে, চওড়া পাড় দেখেই বুঝবে এ বয়েছে অনেক, যৌবনে অনেক নতুন পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছেছে। তারপর নদীর পাশে বসলেই ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে তোমার মন শান্ত হলে দেখবে পলিমাটি জলেই গামছা পরে ছেলের দল কেমন লুটোপুটি করছে। তুমি কাদা ভুলে নেমে যাবে জলে, কাদায় পা গেঁথে যাবে তারপর,  স্রোতের মুখে সে কাদা সাফও হয়ে যাবে। ফের উঠে আসবে  যখন গোড়ালি অব্দি পলিমাটি মাখা হয়ে বড় আরাম হবে। কতদিন পর তুমি মাটি ছুঁলে বলোতো? পলিমাটি আর এমনি কাদার স্পর্শে যে তফাৎ তাতো ভুলেই গেছিলে। কাদা পরিষ্কার করার ছলে হাতে মাখবে সেই কাদা। বসে থাকবে থুম হয়ে যতক্ষন না তোমার চোখের সামনে হুড়মুড় করে জল বাড়া শুরু হবে। যেন এক ঝাঁক ছোট ছেলে, ইস্কুলের ছুটি পড়তেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসেছে। তোমার পা ছুঁয়ে যাবে জল। তুমি তাকিয়ে দেখবে জোয়ারের জলের সাথে সাথে সারি বেঁধে নৌকা ভেসে যাচ্ছে কোথায়। ছোটবেলার মত করে গুনতে গিয়ে খেয়াল করবে তোমার প্যান্ট ভিজে গেছে, তুমি নিজেই নিজেকে বাহানা দেবে, ইচ্ছে করে তো আর না।

তারপর... তারপর আবার কি? একটা নদী বুকের মধ্যে নিয়ে ফিরবে....


Thursday, July 11, 2019

বুড়ো শহরটায়

বাড়িটার নাম ছিল ড্রিমল্যান্ড। দোতলা,  বারান্দাওয়ালা বাড়ি। যেমন হত আগেকার দিনে, বারান্দাটা টালির ছাওয়া। যখনকার বাড়ি এখানে তেমন লোক ছিল না মনে হয়, বাড়ির গায়েই হয়ত সব্জিওয়ালারা বসে যায়নি, কিংবা মুরগির ঝুড়িটা লাগানো থাকতোনা। এখন অবস্থা বদলেছে, ড্রিম আর নেই, ডিম হয়ে গেছে। ডিমল্যান্ড। পথচলতি কেউ তাকিয়ে দেখেও না হয়ত। কারা থাকে ওখানে এখন কে জানে! 

কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে সারাদিনে। ধর্মতলা থেকে ময়দানের পাশ দিয়ে ইডেন গার্ডেন হয়ে বাবুঘাটের রাস্তাটা বড় প্রিয় আমার। মনুষ্য-বর্জ্যের  গন্ধ ছাপিয়েও এক এক জায়গায় বৃষ্টি ভেজা বুনো গন্ধ নাকে ঝাপ্টা মারে। কোলকাতা শহরে এ বড় কম। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দেখি বাবুঘাটের গোল্লাটায় আটকে গেছে, দু পা এগোয়, একটা বাস আসে ফের দু পা পিছোয় আর তাতে তাদের হাসাহাসি বাড়ে। প্রেমে থাকলে ছোটখাটো অসুবিধে মনে হয় ইগ্নোর মোডে চলে যায়। ওই যে,  বেঞ্চের সামনে গোড়ালি ডোবা জলকে কাটিয়ে দুজন জমিয়ে প্রেম করছে। বাফ্রে ডেডিকেশনের হদ্দমুদ্দ যাকে বলে। একটা লোক ডানহাতে গোলাপি লেডিস ব্যাগ বাঁ হাতে ছেলের হাত ধর হেঁটে যাচ্ছে, একদল ছেলে মেয়ে সেলফি তুলছে লঞ্চ আর মেঘলা আকাশ নিয়ে। আরে আরে ওইখানে কি হচ্ছে! একজন ন্যাড়া সাহেবকে পাকড়ে কজন মিলে সেল্ফি তুলছে!! বড় লজ্জা লাগে, কেন এমন করে দেশের মাথা নিচু করে দেয়? একটু পরে দেখি সাহেব তড়িঘড়ি করে চলে যাচ্ছে,  পাছে ফের কেউ পাকড়ে ধরে। 

তবে যাই বলো, বর্ষার এই মেঘ ধোয়া বিকেলগুলো বড় সুন্দর হয়। গঙ্গার ধারটা সুন্দর করে দিয়ে বড় ভালো হয়েছে। দূরে দূরে ভেসে থালা হাত নৌকা গুলো ডাক দেয়। সন্ধ্যে নেমে আসা কোলকাতায় একটা তেরপলের নীচে কাঠের উনুনে ভাত বসিয়েছে একজন মাঝি। কাছেই জোয়ার আসা গঙ্গায় তার হ্যারিকেন ঝোলা নৌকা দুলছে। মাঝি এখন রাঁধুনিও বটে। বড় খুঁতখুঁতে রাঁধুনি দেখি, শিলনোড়ায় রসুন থেঁতো করে ঢাকনা খুলে কেটে রাখা পেঁয়াজের পাশে যত্ন করে তুলে রাখে, ফের চাপা দেয়। জানান দিল, মাছ ধরা হয়েছে আজ। কোনদিন মাঝির অতিথি হয়ে যাব ঠিক। জোর করেই। এসব বলছি কিন্তু জানি হবে না, আমি কোনোদিনই অমন মুখ ফুটে চাইতে পারবো না, কোনোদিন পারিনি বলে কত পাওনা জোটেনি আগে,  পরেও জুটবেনা সেও জানি। 

অন্ধকার ছায়া ছায়া রাস্তাটা পার হলেই ব্যস্ত এসপ্ল্যানেড, দুম করে প্রেক্ষাপট বদলে গেলে কেমন ঘুম ভেঙে যাওয়া অনুভূতি হয়। দেখি এক বয়স্ক দম্পতি ফুচকাওয়ালার সামনে। ফুচকার জল বুড়ির গায়ে পড়ে, বুড়ো যত্ন করে রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দেয়। এ শহরের খারাপ টুকু তো সবাই জানে, বড় শিল্প নেই, কাজের মন নেই, আলসে, অভদ্র, কিন্তু তাও এইযে ভালোবাসার গল্প গুলো বাঁচিয়ে রেখেছে সে খবর জানে কজনা। অবশ্য প্রেম ভালোবাসা এ গতিময় যুগে বাহুল্য বটে। কিন্তু আমি তো ওই ভালোবাসার ভরসাতেই বেঁচে থাকি, বুড়োটে ক্ষয়াটে শহরটার মতই......

Wednesday, July 10, 2019

একদিন হাসপাতালে

সার সার বেড পাতা। সার সার জানলা। তবুও হাওয়া আসছেনা মোটেও। প্রায় সবারই পরণে লুঙ্গি। বুকের খাঁচা ছোট হয়ে যাওয়া বুড়ো কোনো বেডে, কোনো বেডে পেট প্রায় মিশে যাওয়া জোয়ান ছেলে, কোনো বেডে এই গরমে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়ে থাকা লোক। শহরের হাসপাতাল নয় কিনা, তাই ভীড় লাগামহীন না।

সকাল বেলা থেকে দুপুর অব্দি ডাক্তার, নার্স, বাড়ির লোক, নতুন টেস্ট, নতুন রুগীর ভীড় বেশী। দুপুরে নীচ থেকে খাবার আনে যে যার থালায়। খাবার পর শুনশান হয় খানিক। একটা অল্পবয়সী ছেলের বাড়ির অনেক লোক এসেছে, মা,  মাসী, আরো কারা যেন, একজন হাতপাখার বাতাস দিচ্ছে, একজন পেটে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জানলার পাশ থেকে দুটো বেড পর একটা লোকের মাথায় শিরা ওঠা শাঁখা পরা একটা হাত পরম মমতায় বুলিয়ে দিচ্ছে।

পাশের ঘরটা ফাঁকা।  সারি সারি বেড পাতা কিন্তু রুগী থাকার সিস্টেম নেই। আসলে হাসপাতালটায় কাজ হচ্ছে। মাথায় গামছা বেঁধে, যে রোদে হাসপাতালের গেট পার হয়ে জলের জায়গা অব্দি  যাওয়া যায় না সেই রোদের মধ্যেই, দেওয়ালে  রঙের তুলি বোলাচ্ছে কার্ণিশে দাঁড়িয়ে একজন আর বাঁশে দাঁড়িয়ে একজন। গেটে ঢোকার মুখে মালাই বরফ  বিক্রী করছিল, বারোটার রোদে মাথায় গামছা আর সাইকেলের ক্যারিয়ারে টিনের বরফের বাক্সে লেবু নুন দেওয়া বরফ। পাঁচ টাকায় একটা পিতলের হাতা দিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে তুলে দেওয়া বরফ।
ফাঁকা ঘরটায় অনেকে শুয়ে আছে। রুগীর বাড়ির রাত জাগা লোক। ছেলেই বেশী। যে বউ গুলো বরের সাথে রয়েছে তারা তো রুগীর খাটেই একটু জায়গা করে শুয়ে পড়েছে। আর যে মায়েরা এসেছে বড় ছেলের সাথে তারা মাটিতে বেড পেতে শুয়েছে। ক্রমে দু চারটে পাখির ডাক ছাড়া বাইরের মিস্ত্রীরা ছাড়া সবাই চুপ করে যায়, ঝিম ধরা দুপুর নামে। একটা বিড়াল এসে উঁকি মেরে দেখে যায় ডাস্টবিনে কিছু আছে নাকি। এক পা দুই পা পুরো মাথা নেমে যায় ভাতের খোঁজে.....

ফাঁকা ঘরটায় দুটো ছেলে, একজন গল্প শোনায়, বিদেশে কেমন সেক্স ফ্রি তার। সে দেখেছে এক্সভিডিওতে এরকমই হাসপাতালে গেলেই রুগীর বাড়ির লোককে, "ম্যাসেজ" করে দেয়, তারপর সুযোগ পেলে....ইঙ্গিত করে হাতের মুদ্রায়। সে দেশে নাকি বর বউ বলে কিছু না, একটা ঘরে চোখ বেঁধে সবাই ল্যাংটা হয়ে যায়, "তারপর তোর বউ আমার...."..... শুনে যাই হুঁ হাঁ করে, এক্সভিডিও সত্যি, ইউটিউব সত্যি, হোয়াটসঅ্যাপে গুজব বন্ধ করবেন? সত্যি বলতে ছেলেগুলো নিজের বিশ্বাসে অদ্ভুত সরলতায় বলে যায় এসব।জানি জানি আপনি কি বলবেন,  হাসপাতালে এসব কথা বলে এরা কারা, কিংবা এরা প্রত্যেকে পোটেনশিয়াল রেপিস্ট এই তো? অত সাদা কালো মানুষ হয় না কত্তা। বন্ধুর বাবার জন্যে রাত জাগা যায়,  দুপুর রোদে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটোছুটি করা যায়, কিন্তু সে কারনে মন খারাপ করা যৌবনের ধর্ম না যে! আর রেপিস্ট? মানুষ দেখেননি আপনি তবে। আরেকটু দেখেই নিন না কত্তা, অত সহজে নাই বা দাগালেন৷

হঠাৎ  করে একটা শোরগোল ওঠে। একটা লোক,বেশ শক্ত পোক্ত সা-জোয়ান চেহারা, মাথায় কিছু গোলমাল হয়ে গিয়েছে। বাইরের বারান্দাতেই পেচ্ছাপ করতে চায়। প্যান্টের চেন খুলে, বের করে দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার বউটা তাকে অনুনয় করছে,  চলো না গো চলোও না গো বলে সে " ধোর বাঁড়া সর তুই বলে" ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। বউটা অসহায় ভঙ্গীতে কেঁদে ফেলেছে।এ ঘর থেকে ওই ছেলেটা ছুটে গিয়ে লোকটাকে, "কাকা এস এসো" বলে টেনে নিয়ে এগোচ্ছে, আমরা বাকিরাও হাত লাগাচ্ছি....বাথরুম অব্দি পৌঁছে দিয়ে দেখি লোকটার ছেলে এসে পৌঁছেছ্ব, হয়ত নীচে ওষুধ আনতে গেছিল সে ফাঁকে এই অবস্থা।

ক্রমে বিকেলের রাউন্ডের সময় হয়ে আসে।
নার্স হাঁক পাড়ে, অনুপ মাজি, অনুপ মাজির বাড়ির লোক কে আছে? য
এ পাশ থেকে ফর্সা রোগা বউটা ছুটে যায়....
"শেখ সাহাবুদ্দিন..."
নাম ধরে ধরে ওষুধ দেয় নার্স, কারোর স্যালাইন বদলে দেয়, কাউকে ইঞ্জেকশন। ডাক্তার আসে। অল্পবয়সী ছেলে।  কাল থেকে একে দেখছি, শান্ত মুখে সবার ওষুধ লিখছে, টেস্টের রিপোর্ট দেখছে। রেফার করার হলে রেফার করছে। একটা মাথা ফাটিয়ে গুন্ডার দল এসেছিল, তাদেরও ওষুধ দিল চুপচাপ। ক্যাপ্টেন কুল।

বিকেল গড়ায়....বড় কম্পাউন্ডটায় শিরীষ,  কদম, শিমূল গাছের ছায়া পড়ে। ভিজিটিং আওয়ার শেষের ঘন্টা পড়ে। যদিও এরকম গ্রাম গঞ্জে অত সময় মানে না কেউইই। মাঠের কাজ শেষ করে যে আসবে তার কি সময় মেপে আসা যায়! সেই মাথা খারাপ রুগীটাকে রেফার করেছে, বউটা শক্ত করে লোকটার হাত ধরে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে এগোয়। লোকটা শিশুর মত টলমল করে,  বিস্ময় মাখা চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগোয়, তার কিছুতেই কিছু এসে যায় না, ওই দূরে রাস্তাটার দিকে নজর তার, ছাড়া পেলেই চলে যাবে যেন। বউ, ছেলে, সব গোলমাল হয়ে যাবার পর কীসের দর্শন পেয়েছে সে কে জানে!