Friday, December 6, 2019

তাড়াহুড়োয় তাড়োবা (২)

নেশা করলে যেমন মনে হয়, ভাই কাল সব সামলে দেব, আজ একটা বিছানা দে শোবার, ওইরকম ভাব নিয়ে আমাদের আর্লি চেকিন করা ঘরে ঢুকে পড়া গেল। রিসর্টের মালিক এর কিছু একটা ঘোষ, আমরা যখন বুক করছিলাম এর ঘরের ছবিতে খাটের যে ছবি ছিল তাতে আবার একটা আলো লাগানো টাইপ ছিল, আমাদের দলের একজন আবার তাই দেখে বলেছিল, মায়াবী আলো কেমন, চল এটাই বুক করি। তা চারটে দামড়া ছেলে দেখে মনে হয় মায়াবী আলোর তার কেটে দিয়েছিল। মেয়েদের ঘরে রেখেছিল কিনা জানিনা অবশ্য। যাইহোক আলো অন্ধকার কিচ্ছু না, শুতেই ঘুম। এমন ঘুম সৌরভের অ্যাসিংক্রোনাস নাক ডাকার আওয়াজ অব্দি কিচ্ছু করতে পারেনি।

জামা বদলাবার মত গাধামি আমাদের ঘরের কেউই করেনি, জিন্স জামা যা পরে ছিলাম সব পরেই শুয়েছি, খালি তার উপরে হুডি আর মাফলার। এই বুদ্ধিমানের মত ঘটনায় আমাদের ঘরটা মিনিট দশ পনেরো সময় বেশী ঘুনিয়ে বেশ বাঘের মতই হালুম হুলুম করে পার্কের গেটে পৌঁছে দেখি,   একটা মিটমিটে আলোয় কজন গাইড না ড্রাইভার খোদায় মালুম বসে আছে। তখনও কাউন্টার খোলেনি, ভোরবেলার অন্ধকারে বসে বসে খিদে পেয়ে গেল। এদিকে ঘাপচু (আসল নাম ভুলে গেছি)  আর নন্তে খালি বিস্কুট এনেছে তাও হাবার মত মেরি বিস্কুট!! কোনো মানে হয়! গজগজ করে তাই খান পাঁচেক খেতে খেতেই কাউন্টার খুলে দিল। ওবাবা এখানে ভারী অব্যবস্থা তো! আমরা সেই কখন এসেছি অথচ আমরা ফার্স্ট জিপ হব এমন উপায় নেই। ওদিকে কাউন্টারে আমাদের অনলাইন এর বুকিং দেখে বলল,  তোমরা এক গাড়িতে সব কটা ক্যামেরা রেখেছ, অন্য গাড়িটায় কিন্তু নিতে পারবেনা!! মাইরি বর্গি এলো দেশে বলে কেন ভয় দেখাতো বুঝছি! এই সাফারিটাতেই দুটো জিপ আর ক্যামেরা মিলে হাজার চব্বিশ দিয়েছিলাম( পরের গুলোতেও তাইই অবশ্য),  এরপরেও আবার অযথা ক্যামেরার চার্জ নিলে ভাল্লাগে? খুব গজগজ করে নিলাম অযথা, আর আসবোনা ইত্যাদি বলে, যদিও এমনিতেও আর আসা আমাদের হবেনা সেও জানি!

গাড়ি ছাড়ার আগে পাশে ঝুপড়ি থেকে চা খেতে গিয়ে দেখি এই সাতসকালে কয়েকজন স্থানীয় মানুষ  ভয়ানক তেল মশলা দেওয়া কি একটা তরকারি, খানিক পোহার উপর দিয়ে খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম,  বাফ্রে, যদি বলে চা এর সাথে এ জিনিসও খান! আমার এর আগে এমন হুড খোলা জিপে জঙ্গল সাফারির অভিজ্ঞতা বছর আষ্টেক আগে ডুয়ার্সে। গেট পার হয়ে খানিক যেতে যেতেই জঙ্গল তার পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে ধরা দিতে থাকে। লাল মাটির রাস্তায় ধূলো আর ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপট নিয়ে জিপ এগোয়, তখনো ভালো করে রোদ ওঠেনি। তাই ভরসা আছে, জঙ্গল এর প্রাণীদের দেখা পাবার। জিপটা একটা গোঁত খেয়ে একটা সরু রাস্তায় ঢুকে একটা জলাশয়ের ধারে পৌঁছলো। গাইড ব্যাটা খালি বলে চলেছে গরমে সব ঘাস ফাঁকা হয়ে যায় তো, তাই খুব ভালো সাইটিং হয়, এই সব জলে বাঘে জল খেতে আসে হ্যানা ত্যানা। শুনলেই রাগ আর দুঃখ হচ্ছিল। তাড়োবার জঙ্গলে বড় জানোয়ার বলতে মূলতঃ বাঘই। এছাড়া ব্ল্যাক লেপার্ড আছে, সে তো এমনিই ভয়ানক রেয়ার। আর বুনো কুকুর আছে।  বাঘ দেখতে না পেলে মুখে যাই বলি না কেন৷ ভয়ানক দুঃখ হবে  একথা সত্যি। তবে আমরা জঙ্গল ব্যপারটা এমনিতেও খুব ভালোবাসি, তাই সে শোক সামলেও নেব এ কথাও মিথ্যে না। তাই বলেই যদি সকাল থেকেই গাইড গান শোনায় যে কিছুই না মিলতে পারে বলে ভাল্লাগে নাকি!  জলের উপর গাছে কটা সারস বসে ছিল। সারসই তো বলে নাকি, ইংরাজিতে স্টর্ক বলে যাকে? খচাং খচাং করে ছবি তুলে নেওয়া গেল কুয়াশার সর পড়া জলের উপর দিয়ে।












দুধারে ঘন বাঁশবন এর ফাঁকে বাঘ থাকতেই পারে, এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে খোলা জিপে সকাল সকাল যেতে বেশ লাগছিল। মাঝে মাঝে এ ভারতভূমির আদিবাসী রাজাদের তৈরী নিশান দেখা যাচ্ছিল মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে। তাড়ু বলে একজন বাঘের দ্বারা মারা যায়, সেই থেকেই তাড়োবা। মন্দিরটাও আছে একখানে। নানান রকম পাখির ডাক, জিপের টায়ারের সাথে লাল মাটির ঘষার আওয়াজ আর গাইডের টুকটাক কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ একজায়গায় দেখি আরো কটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাইডে গাইডে কথা হয়ে গেল, উত্তেজনা দেখেই মনে হল কিছু নির্ঘাত আছে এখানে...বাঘই নাকি?

জানা গেল হ্যাঁ, কল শোনা গেছে। কল মানে বাঘের আসার খবর জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ে বার্কিং ডিয়ার বা বাঁদর বা ময়ুরের মাধ্যমে। জঙ্গলের নিজস্ব সিকিউরিটি সিস্টেম। তাহলে বাঘ হরিণ পায় কি করে? বাঘ অনেক অনেক ক্ষন একই জায়গায় বসে থাকে,  তারপর হরিণে বা বাইসনের দল যখন একটু ঢিল দেয় ব্যাস। ঘাপ!

জিপ গুলো সব টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সামনে একটু জল, তারপরে ওই পারে বাঁশের বন। বাঘ বাঁ দিক থেকে আসবে এমনটাই কল থেকে বোঝা গেছে। টানটান স্নায়ূ প্রায় শিথিল হয়ে আসবে এমন সমত কোঁয়াকো করে ময়ূরের তীক্ষ্ণ স্বর শোনা গেল,  তাতে যেন নিস্তব্ধতা না ভেঙে আরো ছমছমে হয়ে গেল চারিদিক। ওই যে ওই যে কোনায়, ওই গাছের ফাঁকে আসছেন তিনি। লম্বা লম্বা ঘাস এর ফাঁক দিয়ে অবয়বটা দেখা যেতে সবার ক্যামেরা সচকিত হয়ে গেল। ক্রমে ঝোপঝাড় পেরিয়ে রাজার মত মর্ণিং ওয়াকের ভঙ্গীতে এগিয়ে আসতে লাগলেন তিনি। দৃপ্ত ভঙ্গী, কোনো টেনশন নেই।থাকবেই না কেন! একটা থাবড়া মারলে সামনের জনের (বেশীভাগের) ভব্লীলা কাবার হয়ে যাবে! ক্রমে ক্রমে আমাদের দিকেই আসতে লাগলেন। চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘ না, নিজের এলাকায় ঘুরতে বেরোনো পূর্ণবয়স্ক একজন বাঘ যার থেকে আমাদের দূরত্ব হয়ত পঞ্চাশ -ষাট মিটার! অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। বাঘ চাইলে আমাদের দিকেও আসতেই পারে। গাইড ফিসফিস করে বলে দিচ্ছিল এলেও আমরা যেন কেউ উত্তেজিত হয়ে লাফালাফি না করি। চুপ করে বসে থাকলে,  বাঘকে বিরক্ত৷ না করলে সে নিজের মত চলে যাবে, মানুষ কিছু তার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়ার জিনিস না। বিরক্ত করলেই চিত্তির!

ব্যাটা জলের কাছে এগিয়ে এসেই জলশৌচের ভঙ্গীতে পেছন ডুবিয়ে দিয়ে বসে গেল! নির্ঘাত কোনো বাঙাল বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ ছিল আগের রাতে, একগাদা ঝাল খেয়ে ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম বলে সাত সকালেই ছুটে আসতে হয়েছে! অনেকক্ষন জলে পেছন ডুবিয়ে থেকে শান্তি পেয়ে ফের উঠে বাঁশবাগানের ধারে খেলতে খেলতে চলল, কখনো থাবা ছুঁড়ে বাঁশপাতা ধরছে লেজটা খাড়া করে। একবার মিষ্টি করে হাই তুলল একটা চমৎকার। তারপর হেলতে দুলতে চলে গেল আরো গভীর বনের দিকে।








বাঘ দেখে ফেলেই আমাদের এত্ত আনন্দ হয়েছিল  কী বলব! অথচ এমন কিন্তু হবার কথা ছিল না! বাঘ  এরকম কোনো ক্রমে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এমন দিন হয়ত তিন পুরুষ আগেও কেউ ভাবেনি! আর ভাবেনি বলেই ওদের মেরে পিটে এমন সংখ্যালঘু করে দিয়েছে!  কেত আছে ভাই। কেমন আরামসে এলো, আশেপাশে লোকজনকে স্রেফ ইগ্নোর করে নিজের মত ঘুরলো, চলে গেল। এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গাইড এর ইশারায় গাড়ি দাঁড়িয়ে দেল। দেখি সামনে এক বিস্তীর্ন ঘাসভূমি, অনেক কটা চিত্রল হরিণ ঘুরছে(বেশী দেখা যায় বলে কদর নেই তেমন), সামনেই গাছে রাস্তায় অসংখ্য হনুমান মজাসে ডাল ধরে ঝুলছে, রাস্তাত বসে আছে। চমৎকার একটা সকাল!








হরিণ গুলো শিং তুলে একবার দেখে, তারপর নিজের মনে ঘাস খায়, হনুমান গুলোকে দেখলে আমার বরাবর হিংসে হয়। কিরকম লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকে ডালে। পরেরবার আমি হনুমান হব ঠিক। অমন একটা তাগড়া লেজ থাকবে, মগডালে বসে দোল খাব..মাঝে মাঝে ফল পাকুড়ে কামড় দেবো, ভালো না লাগলে ছুঁড়ে ফেলব। তবে বনের হনুমানই হব, লোকালয়ের গুলো কেমন উকুন বাছতেই ব্যস্ত থাকে মানুষের মত। দূষন বেশী বলেই হয়ত।



হনুমানদের কেরদানী আর হরিণদের শান্তিতে ঘাস খাওয়া দেখার পর ফের এগোনো গেলো।



(ক্রমশ)

2 comments:

  1. 🙄 গাগুলোনোর কথাটা বেমালুম চেপে গেছিস দেখছি!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই নিয়ম হে। বেদব্যাস কি কখনো লিখেছিল লিখতে লিখতে কতবার নাক খুঁটেছে আনমনে?

      Delete