Sunday, December 29, 2019

ভুটে আর ছোটকা

- ছোটকা
- হুঁ
- ও ছোটকা

- বলবি তো

- তুমি সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলে কেন?

- কে বলল?

- ওই তো মা আর বাবা সেদিন কথা বলছিলো...

- ও আজকাল অন্যদের আলোচনায় কান পাতার অভ্যেসও তৈরী হয়েছে!

- না না, ওরকম না। আমার সামনেই বলছিল, তাই ভাবলাম তেমন পার্সোনাল কথা নিশ্চয়ই না। বলো না ছোটকা সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলে কেন?

- হুম। তা ভুটেবাবু সন্ন্যাসী কাকে বলে জানা আছে?

-হ্যাঁ জানি তো। ছোট সংসারের মধ্যে আটকে না থেকে, পার্থিব জিনিসের মায়া ত্যাগ করে ভগবানের সন্ধানে যাওয়া।

- আরিব্বাস! ভুটেবাবু! পার্থিব, সংসারের মায়া, কী কেস রে? অংক ক্লাসের নতুন মেয়েটা পাত্তা দিচ্ছেনা?

- আহ ছোটকা! তোমার সবেতেই ঠাট্টা খালি। ঠিকাছে বাদ দাও, আমি যাই।

- আরে চটিস কেন! সত্যিই তো এ সব জিনিস নিয়ে ইয়ার্কি করা ভালোনা মোটেই। তা কী বলছে সে?

- কে আবার কী বলবে!

- ওহ। আচ্ছা ছাড় এসব, চল মন্টুর দোকানে নতুন একটা কারিগর এসেছে, মাছের ডিমের বড়া যা বানাচ্ছেনা রে। চল চারটে করে মেরে আসি।

- নাহ। তুমি যাও। আমার শরীরটা ভালো নেই!

- ওহ। হ্যাঁ শরীর ভালো না থাকলে এসব খাওয়া ঠিক না। তা যাবি নাকি কাল, পাঁচ নম্বর পুকুরে এপার ওপার এর রেস দিতে?

- নাহ ছোটকা, তুমিই যাও। আমার সামনে টেস্ট আছে, ঠান্ডা লেগে গেলে সমস্যা হবে।

- তাও বটে তাও বটে। তাহলে বুঝলি ভুটে এ কদিন তোর ডায়েটেরও বদল আনতে হবে, ঝোল ভাত, আর পেঁপে সেদ্ধ। আর সকালে এক গ্লাস লাউএর রস নাকি? মানে সামনে যখন টেস্ট আর শরীরটাও তোর ভালো নেই বলছিস। আরে আরে অত মুষড়ে পড়ছিস কেন, আচ্ছা আচ্ছা লাউ বাদ।
আচ্ছা আচ্ছা নে এবার বলতো কী হয়েছে। কে এমন পাপিষ্ঠ থোড় কিংবা লাউ মানুষ রূপে আমাদের ভুটেবাবুকে এত যন্ত্রণায় ফেলেছে! তোর ছোটকা আছে না, এত চিন্তা করছিস কেন?

- আমার না ভালো লাগছে না কিচ্ছু ছোটকা। আমি কেন তোমাদের মত হলাম না বলতে পারো? আমার মাথায় বুদ্ধি কম, আমি পড়াশোনায় তুখোড় না, সেরা জায়গা আমার জন্যে না, আমার হাইট দেখো, চেহারা দেখো, লোকজন খোরাক করে, অংক কোচিং এর মেয়ের কতগা বললে না? হুহ আমার দিকে তাকাবে এমন ভাবনাই অসম্ভব। তুমি বলবে আমি হীনমন্যতায় ভুগছি, এসব বাজে কথা, আমার থেকেও আরো কত কত লোকে খারাপ আছে তাই তো? আমি জানি ছোটকা এসব, কিন্তু আমার থেকে ভালোও তো কত লোকে আছে বলো। আমি কেন সেই সেরাদের দলে না? প্লিজ ছোটকা আমায় বোকোনা, হেসোনা। আমি কাউকে বলতে পারিনা এসব, আমার ভালো লাগেনা কিছু। মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই।

- বেশ। বুঝলাম। না আমি হাসবোও না, বোকবোও না। ভুটে তোর ছোটকা কিছু সেরাদের দলে পরে না। না, না, আগে আমায় বলে নিতে দে। তুই বলছিলিনা, আমি কেন সন্ন্যাসী হয়ে গেছিলাম? আমি সন্ন্যাসী হইনি, স্রেফ বলতে পারিস ভবঘুরে হয়ে গেছিলাম। তুই জানিসই আমি নাস্তিক, ভগবানের খোঁজে আমায় যারা ভালোবাসে তাদের ফেলে বেরিয়ে যাওয়া আমার জন্যে না। আমি গেছিলাম কেন, সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক, আমি ফিরে এসেছিলাম কেন সেটাই বলি বরং।
ঘুরতে ঘুরতে আমি সেবার একটা শহরের গঙ্গার কাছে এক বস্তির কাছাকাছি একটা আস্তানায় থাকি। দাড়ি গোঁফে এমন চেহারা হয়েছিল, আর ইচ্ছে করেই একটা গেরুয়া পরেছিলাম বলে খাওয়ার অভাব হতনা। তো আমার মনের অস্থিরতা কমেনি কিছুই, বিরক্ত লাগে সব কিছুই, হতাশ লাগে তোর মতই। মনে হয় আমি অপদার্থ। আমার বন্ধু বান্ধবরা বিরাট চাকরি করে তখন, কেউ কেউ ভারী চমৎকার গান করে, কেউ ভালো খেলে...আমি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছি! সে সময়েই খেয়াল হল হঠাৎ, বস্তির লোকগুলোর আনন্দ ফূর্তির কম নেই। মানে খুবই আশ্চর্য ব্যপার, এই আজ অমুক পুজো, কাল ডান্স ধামাকা, পরশু তমুক। তবে লোকগুলো বেশীরভাগ পুজোয় আশপাশের সকলকে খাওয়াতো, ওদের সামর্থ্য মত। আমি খুব তাচ্ছিল্য ভরে ভাবতাম, অশিক্ষার কারনে এসব করে৷ দুঃখের এত কারন তাও দুঃখ নেই, নির্বোধ ভাবতাম ওদের এতই নির্বোধ ছিলাম।
তারপর জানিস একদিন খেয়াল হল, আরে আমার বিরাট চাকরি করা সফল বন্ধু গুলোও তো দিন রাত খেটে, অবসরে এই হুল্লোড়টাই করে পাবে গিয়ে বা পুজোয় বা বারে। তারপর বলে, এত স্ট্রেস আর ভাল্লাগেনা।

ভাবলাম খুব বুঝলি ভুটে, ভালো থাকা খারাপ থাকা আসলেই তো নিজের উপর। আমি দশটাকায় ভালো থাকতে পারি আবার একশো টাকাতেও পারি। হয়ত দশটাকায় ভালো থাকাটা একশো টাকায় ভালো থাকা লোকটা বুঝতে পারছেনা তাই ভাবছে আমি খারাপ আছি। আমি খারাপ আছি না ভালো সেটা অন্যের ইলিউশনে হয়ে যাচ্ছেনা তো? বুঝতে পারছিস ভুটে কী বলছি?

- হ্যাঁ ছোটকা, মানে এই যে বড়রা ভাবে এখনকার আমাদের ভিডিও গেমস জীবন কীই দুঃখের, এদিকে আমরা দিব্যি আছি সেরকম না?

- কারেক্ট। একদম তাই। যেই মাত্র এটা ভাবলাম, অমনি মনে হল, বেশ তো আমার জীবনটা অন্যের চোখে "সফল" কিনা দেখার বদলে, নিজের চোখেই দেখি একবার? ঝেড়ে ঝুড়ে দেখলাম, আমার ছেঁড়া জামার পকেটে বোঝাই করা মনি মানিক! দাদা, বৌদি,দিদি, মা বাবা, দু চার খানা বন্ধু বান্ধব, তুই তখন হোসনি তাই তোকে কাউন্ট করিনি, যাইহোক সব্বাই আমায় কত ভালোবাসে তা টের পেতে বেগ হলনা। জানিসই তো ভালোবাসা দিব্যি বোঝা যায়। তো যেনা টের পাওয়া, দেখলাম, আমার সকালের রোদ মাখা বিছানায় যে ওম লেগে থাকে রাতের চাঁদের আলোয় তা ঝকঝকে হয়ে যায় কেমন। বুঝলি ভুটে, তুই হয়ত সেরা না, তুই হ্যান্ডসাম না, হয়ত কেন তাইই, তুই যা বললি তা মেনেই নিলাম, সবাই দিব্যি সোজা সরল পথে তরতর করে এগিয়ে যায় তুই পাক খেয়ে খেয়ে লগি ঠেলিস, তাও ভুটে দেখবি হয়ত ওই পাক খেতে খেতেই একটা ডলফিন ঘাই মারলো, অনূকুলে পাওয়া হাওয়ার তরতর করে এগিয়ে যাওয়া নৌকাটা সেই ডলফিন মিস করে গেল।

এক জীবনে সব মেলে না রে ভুটে, তার জন্যে হা হুতাশ করার বদলে না পাওয়া গুলোকে সঙ্গে নিয়ে চলতে গিয়ে দেখলি আচানক সব রামধনু জুটে গেল।

- ঠিক। আমার কোনো বন্ধুর এমন ছোটকা নেই এ আমি হলফ করে বলতে পারি। ইয়ে, মন্টুর দোকানে যাবে নাকি? শরীরটা এখন দিব্যি চাঙ্গা লাগছে কিনা....

No comments:

Post a Comment