Tuesday, October 31, 2017

নবাবখানায় নবাবি


মাথার পোকাটা ফের নড়ে উঠলো ট্রেক করে এসেছি মাস দুই তো হলো , আবার কোথাও পালাতে হবে। বেশী প্ল্যান ট্যান করে যাওয়া না , হুড়ুম দুড়ুম করে।দুই বন্ধুর কাছে প্রস্তাব রাখলাম , লখনৌ যাবি? শুক্রবার অফিস করে যাবো সোমবার ফিরে এসে অফিস। ব্যাস এক সপ্তাহ আগে কথা পাড়া হলো,  সেদিনই ফাইনাল ,টিকিট কাটা শেষ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে তাই আগের রাতে মাঝরাত অব্দি অফিস করে পরের দিন ভোরে ফের অফিস পৌঁছেছি , ব্যাগ নিয়েই সারাদিন ঘোরাঘুরি হবে , হোটেলে শুধু রাতটুকু কাটাবো তাই লাগেজ খুব কিছু নেওয়ার নেই তাও বৃষ্টির জন্য একসেট জামা প্যান্ট বেশী নিতেই হয়, ক্যামেরা চার্জার ব্রাশ এই তো...খাওয়া কোথায় হবে জানি,থাকা কোথায় জানিনা আমার অফিস হলো গিয়ে তেপান্তরে, ট্রেন হলো গিয়ে ভুশুন্ডির মাঠে, এবার দুটোকে মেলাতে গেলে কোন পথ টা সোজা হয় ভাবছিলাম। সেদিনই আবার দেখি একগাদা কাজ এসে হাজির


তেপান্তর থেকে ভুশুন্ডি যাবো তাই সময় নিয়ে বেরোতে হবে মহা যন্তন্না। সে যা হোক সব সামলে , সৌগতদার থেকে খান তিনেক বই নিয়ে ( অফিসেই দিয়ে গেল , বন্ধু ভাগ্য আমার বরাবরই ভালো আর কি), একটা খালি বাসে ওঠা গেলো। আহিরিটোলা থেকে লঞ্চ ধরবো।
দুপুরের লঞ্চে ভীড় নেই তেমন , বর্ষায় জল বেড়েছে গঙ্গায় এক জায়গায় দেখি নদীর জল বেড়ে পাড়ের গাছপালাকে হুটোপাটি খাওয়াচ্ছে, বুড়ো অশত্থের বাঁধানো বেদীতে একজন বসে বসে ভাঙা, গাছপালা গ্রাস করা বাড়িগুলোকে কি পাহারা দিচ্ছে কে জানে! একজন টকঝাল লজেন্স বিক্রি করছে লঞ্চে, আর আকাশে ঝকঝকে রোদ বেড়াতে যাবার মনের সাথে সঙ্গত দিচ্ছে।
হাওড়ায় পৌঁছে এক কাপ চা বিস্কুট খেয়ে নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম এর কাছে পৌঁছে সৌরভকে ফোন করা গেলো। আমরা কানপুর পৌঁছাবো কাল ভোরে, ওখান থেকে সমুকে নিয়ে লখনৌ এর বাস।
উচ্চশ্রেনীর প্রতীক্ষালয় তাই উচ্চ সোপান বেয়ে উঠতে হয়, আমরা সেই উচ্চমার্গে ঢুঁ মেরে, একটু কুল্ফি খেয়ে তারপর ট্রেনে ওঠার দম নিলা আসলে প্রভুজির জমানা কখন বেলাইন হয় কে জানে, মরতে হলে শখ সাধ মিটিয়ে মরাই ভালো কিনা।
আমি বরারবর দেখেছি আমার কপালে সুন্দরী সহযাত্রিনী জোটেনা, সব সময় খেঁচুটে গোমড়া লোক/মহিলা, অসুস্থ বৃদ্ধ বৃদ্ধা যাদের জন্য কোনোরকমে রাতের খাওয়া সেরেই শুয়ে পড়তে হয় ইত্যাদি। তা এবারে উঠেই দেখি এক তরুনী বসে আমাদের সিটের খোপে, তা ভাবলাম সৌরভের কপালে আমারও কপাল বদলালো বুঝি। হরি তিনি ভুল করে বসেছিলেন, পাশের খোপে চলে গেলেন। যথারীতি এক বয়স্ক দম্পতি। ভদ্রলোক শোবেন এবং আমি যেহেতু সৌরভের তুলনায় অল্প রোগা,  ভদ্রমহিলা আমায় বললেন যাও তো বাবা তুমি ওদিকে, রোগাদের তো এই সুবিধে সব জায়গায় ফিট করে যায়। বিড় বিড় করে বললাম অসুবিধেও কম না। মহাভারতের অর্জুন হয়ে কৃষ্ণের পায়ের কাছে গুটি মেরে বসলাম। আগামিকাল কী কী দেখবো আর কী কী খাবো তার আরেকবার আলোচনা সেরে নিচ্ছি। 
এদিকে বুড়ো আইকার্ড দেখানোর জন্য হাঁচরপাঁচর করে ব্যাগ টানছেন, হাঁফিয়ে গেছেন, হাঁফাচ্ছেন।বুড়ি ডালমুট চিবোতে চিবোতে নির্বিকার গলায়, "হাঁফাচ্ছ দেখছি। হুঁ রিটায়ার করে গেছো কিনা আর কী হবে তোমায় দিয়ে..,দুটো মাত্র সুটকেস এবারে তাও এই...."
বুড়ো কম যায়না, একটু পরে বলে, দিল্লী পৌঁছেই কুলি খুঁজতে হবে তিনটে লাগেজ আছে, কুলির মাথায় বসিয়ে নিশ্চিন্ত। 
কানপুরে আধঘন্টা লেটে নামলাম যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা এখান থেকে ট্রেনেও যেতে পারতাম, কিন্তু ট্রেন নাকি যখন তখন মাঝরাস্তায় থেমে যায় ঘন্টাখানেকের জন্য। এখানে বাস স্ট্যান্ডের নামটা ভারী অদ্ভুত, ঝগরগটি। ঝগড়া করে গট গট করে হেঁটে চলে যায় হয়ত সবাই এখান থেকে! সমু এসে দাঁড়িয়েছিলো, তিন বাদশা লখনৌ এর সরকারী বাসে চড়ে বসলাম। 
কিছুক্ষন পর দেখি মাথায় এক ফোঁটা জল পড়লো! মনের ভুল নিশ্চয়ই? আবার এক ফোঁটা, সেকি আমরা কি মুক্তো আর বাসএর ছাতটা কি স্বাতী নক্ষত্র নাকি? ভালো করে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মেলে দেখি বাসটা সম্ভবত নবাবি আমলের, তাই ছাদ টাদ কিঞ্চিৎ প্রাচীন হয়ে ফুটো হয়ে গেছে আর কি। চারপাশে সব সিটই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে জানলা টানলা বন্ধ করে হালকা একটা ঘুম লাগাতে গেলাম হঠাৎ দেখি ফুরফুরে ভেজা হাওয়া আর বৃষ্টির ছাঁট, এবার কি তবে জানলার কাঁচটাও? তাকিয়ে দেখি সামনের সিটে এক বাচ্ছা নিয়ে বসে থাকা স্থানীয় মহিলার কীর্তি, তিনিই জানলা উন্মুক্ত করেছেন। ব্যাপার কি? এরকমভাবে বৃষ্টি বাতাস খাওয়ার সাধ হলো কেন এই সাত সক্কাল বেলা? জিজ্ঞেস করলাম, কি একটা বলল যেন বাচ্ছাটাকে দেখিয়ে উল্টি না কি ঘুমের চোখে ভালো শুনতে পাইনি। 'হ্যাঁ রে সৌরভ কি বলল রে? বমি করবে?' 
সৌরভ নির্বিকার মুখে বলল, হ্যাঁ।
আমি তড়াক করে সোজা হয়ে বসেছি, হ্যাঁ মানে কি, বমি করা মানে সে বমি ব্যাকফায়ার করে আমার মুখেই তো আসবে হ্যাঁ! নবাবি স্মৃতি দেখতে হাল আমলের টাটকা ইয়ে স্মৃতি আমি নিয়ে যেতে চাইনা কখনোই। তৎক্ষণাৎ উঠে অন্য সিটে,  কিন্তু সেগুলোর ছাদ প্রায় জবাব দিয়ে দিয়েছে, কেউ কেউ বাসে রেনকোট পরেই বসে। আমরা কেউ ছাতা মাথায় ঘুমাতে পারিনা বলে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে উঠে দেখলাম, সমু জামা খুলে নিংড়াচ্ছে! শেষটুকু ছাতা মাথায় বসেই যাওয়া গেলো!
লখনৌ শহরে যেখানেই যাও ভাড়া পার সওয়ারি দশ, কিন্তু সেদিন সকালে চারবাগে নেমে আমাদের অত জানার কথা না তায় বৃষ্টি সুতরাং আমরা একটা বেশী ভাড়ার অটোতেই চললাম। 
লখনৌ শহরে দ্রষ্টব্য যা কিছু সব বেশ কাছাকাছি রেডিয়াসে, আর আমাদের যেহেতু উইকেন্ড ট্রিপ তাই আগে থেকেই ঠিক করা যে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে খেয়ে একেবারে হোটেলে ফিরবো। তাই হোটেল ঠিক করার ব্যাপার নেই।
বড়া ইমামবাড়ায় পৌঁছলাম যখন তখনো বৃষ্টি পড়ছে। তবে সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়, আমরা অলরেডি নবাবি আমলের বাসের কল্যানে চান করেই আছি। 
বড়া ইমামবাড়া বানায় নবাব আসাফউদদৌল্লা, সতেরশো চুরাশি খ্রীষ্টাব্দে। নবাবি ব্যাপার, খালি মহরমের জমায়েত হবে দূর চলো একটু লুকোচুরি খেলার ব্যবস্থাও হোক। অর্থাৎ ভুলভুলাইয়া।






বড়া ইমামবাড়ার উপরের অংশই সেই বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া।  ভুলভুলাইয়া মানেই ফেলুদা,  ভুলভুলাইয়া মানেই রহস্য, সেই গোরা সৈন্য যে বিকেলে ঢোকে আর পরের দিন যার মৃতদেহ পাওয়া যায়। এখানে ঢোকার সময়েই গাইড আমাদের বলে দিলো গাইড ছাড়া ঘুরলে আমরা কত বোকামো করব। এক একটা দরজার এক একটা ইঁটের ইতিহাস গাইডের কাছে আছে যা আমরা কোথা পাবো আর। আমরা আগে থেকেই ঠিক করে এসেছিলাম ভুলভুলাইয়া আমরা একারাই ঘুরবো, ফেলুদার মতো আমরাও পারবো  ভুলভুলাইয়ার গোলোকধাঁধা থেকে বেরোতে। গাইডকে কাটিয়ে উপরে উঠলাম। মানে বড়া ইমামবাড়ার ভিতরে আছে নবাবের সমাধি,  তার উপরে চারধার রেলিং ঘেরা ফাঁকা সেই জায়গাটা যেখানে একদিক থেকে দেশলাইকাঠি জ্বালালে অন্যদিক থেকে শোনা যায় যায়। আর তাকে ঘিরেই আছে সে বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া। একটা সিড়ি আছে নীচ থেকে সোজা উঠে যাচ্ছে, মাঝে ভুলভুলাইয়াতে ঢুকে পড়ো, ওই সিঁড়িই সোজা ছাতেও যায়। এবার ভুলভুলাইয়ার টার্গেট হলো নীচের এই বালান্দায় পৌঁছতে হবে আর তারপর ফের ভুলভুলাইয়া হয়ে ছাদে। 




যেখানে ভুলভুলাইয়ার এন্ট্রান্স বলা যায় সেখানে ছাদ থেকে রুমি দরোয়াজা সহ গোটা চত্বর বেশ চমৎকার দেখা যায়। তারপর আমরা ভুলভুলাইয়ার সুরঙ্গে হারিয়ে গেলাম।







আহা হারিয়ে ফিরেছি আবার, গোরা সৈনিকের মতো মরে ভূত হলে তো লেখা আপনার কানে ফিসফিস করে বইতো নাকি? হারিয়ে গেলাম মানে কয়েক ধাপ নেমে,  আগ্রা অব্দি যাওয়ার টানেল বন্ধ দেখে উপরে উঠে গলি গলি ঘুরে দেখি বাইরের বারান্দার দিকে চলে এসেছি। প্রতি দেওয়ালে ছাদে, লক্ষ কোটি নাম লেখা,  প্রতিটা মানুষ তাদের নিজেদের নাম অমর রাখতে মরীয়া তা সে যেভাবেই হোক। আর আমাদের দেশে ইতিহাস এতো বেশী বলেই বোধ তাকে আর আলাদা করে কেউ গুরুত্ব দেয়না। রাজারাজড়াদের ইতিহাসের সাথে এভাবেই হয়ত সাধারণ মানুষের ইতিহাস ঢুকে পড়ে। কোনো এক আগামীর পুরাতত্ত্ববিদ খুঁজে দেখে জানবে,  কোনো মাহমুদ কোনো ফতিমাকে ভালোবেসেছিলো। হয়ত ভালোবাসার চিহ্নটাই সেসময় বদলে যাবে কিংবা, কিংবা প্রেম শব্দটাই বাড়তি হয়ে যাবে! কে জানে!
আবার কেঁচে গন্ডুষ করে ঢুকলাম ভিতরে,  আবার পাক খাচ্ছি গলি সে গলি,  এখনো খুঁজে পাইনি সেই রেলিং ঘেরা বারান্দা, দেশলাইকাঠি ধরানোর শব্দ কেমন দৌড়ে যায় দেখা হয়নি এখনো। হঠাৎ সেই গাইডের সাথে দেখা। দুলে দুলে ব্যাঙ্গ করে বলে, 'কেয়া জনাব বহুত সামাজদার বন লিয়া না, আফসোস হোতা হ্যায় পাতা হ্যায়? আপ লোগ ইতনা দূরসে আকে কুছ নেহি দেখ পায়েঙ্গে' আমাদের মধ্যে সমুই মোটামুটি ট্যুরের গাইড, আগে বার দুই আসার কল্যানে, ওই জবাব দিলো আমাদের হয়ে 'আপ ফিকর মাত কিজিয়ে' 
মানে লেগেছে আমাদের সবারই খুব। ইয়ার্কি হচ্ছে তিনটে দামড়া ছেলে একটা তিনশো বছরের পুরোনো ধাঁধার উত্তর জানবেনা? ফের নতুন উদ্যমে শুরু করলাম। সিঁড়ির ধাপে চটা উঠে গেছে, জল পড়ছে ইঁটের কোন বেয়ে, কোনো গলিতে চামসা গন্ধ,  মানেই এখানে যাতায়াত কম মানেই এটা ভুল রাস্তা। একটা গলি দিয়ে নামতেই দেখি বারান্দা না একটা খোলা ফোকর, ঠিক নীচেই নবাবের সমাধি। গোরা সৈনিকটা নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে এরকমই কোনো ফোকর এর কাছে এসে পড়ে গেছিলো। ভুল করে, কানাগলি ঘুরে, তিনশো বছরের প্রাচীন ইঁট, অন্ধকারকে হাসি তামাশায় উড়িয়ে দিয়ে আমরা পৌঁছলাম সেইখানে অবশেষে
যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে তিন নবাব ঝুল বারান্দায় ঘুরে আওয়াজের কেরামতি শুনে বেরিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি খুজতে লাগলাম। মানে ভুলভুলাইয়ার ভিতর দিয়ে ছাদে উঠবো, এমনি সিঁড়ি তো আছেই। আবার ভুল করা আবার পাক খাওয়া।  এটাই বুঝতে পারিনা যে ভুল রাস্তাটাই কেন চোখের সামনে ধরা পড়ে? ঠিক রাস্তাটা কিন্তু পাশেই, তবুও ভুলটাতেই ঢুকে হোঁচট খাওয়া বারংবার।  অবশেষে হিসেব কষে ছাদে। বৃষ্টির মধ্যেও আমরা ছাড়া কতকগুলো ট্যুরিস্ট আছে অবশ্য। সে দলে এক দুটো মেয়েও আছে। আমরা প্রকৃতির সব কিছুই মনোহর দৃষ্টিতে দেখি,  ছাদ থেকে বৃষ্টি ভেজা লখনৌ শহর, ইমামবাড়ার গেট, ক্লক টাওয়ার হয়ে মানবী সবই









দেখা টেখা শেষ করে এবার নামার পালা। নামবো মানে ভুলভুলাইয়ার ভিতর দিয়েই। আবারো পথ ভুল, এবারে আবার সোজা সেই ফিসফিস বারান্দায়। আরে মহা যন্তন্না, যখন যেটা চাইবো তার বিপরীত টাই পাওয়া ভুলভুলাইয়ার ধর্ম বুঝি? বেশ তাই সই। এবারে আবার একটা কানাগলিতে ঢুকলাম যার মধ্যে কিছুই দেখা যায় না! একেবারে সরু এক ফালি সুরঙ্গ দিয়ে এক এক করে পার হয়ে হুট করে একটা উঁচু সিঁড়ি, আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলাম। ব্যাটা নবাবরা নিশ্চয়ই সেইসব বেগমদের নিয়ে এখানে আসতো যাদের পছন্দ হচ্ছেনা। তারপর অন্ধকারে এক ধাক্কা মেরে দিতো। ওহ বলাই হয়নি এখানে কাপলরা ঢুকতে গেলে কিন্তু গাইড মাস্ট। অর্থাৎ এখনকার বাদশা বেগমদের সে সুবিধে আর নেই। 
নীচে নেমে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি। বর্ষায় জায়গাটা পিচ্ছিল না খুব একটা কারন পাথরের মেঝে, কিন্তু কার্পেট পাতা আছে একটা সেটা আবার জলে ভিজে শ্যাওলাদের ঘরবাড়ি হয়ে গেছে। জুতো জোড়া নিয়ে শাহি বাউলি দেখতে চললাম। জায়গাটার আর্কিটেকচার দেখার মতো মশাই, মানে পুরো ইমামবাড়াটাই বলছি, ভুলভুলাইয়া সমেত। এই ধরাযাক শাহি বাউলি, গেট দিয়ে ঢুকে কয়েকধাপ উঠে সিঁড়ি ফের নেমে  গেছে। বিল্ডিংটার কিছু তল আছে মাটির লেভেলের নীচে উপরে কিছু। এবার ওই সিঁড়ি দিয়ে নামলেই সেই জল যার মধ্যে পড়বে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো লোকের ছায়া। ফলে উল্টোদিকে অন্ধকারে থাকা লোকে এই ছায়া দেখে তীর চালাতে পারবে। যদিও লাভ কিছুই হয়নি সে তা আমরা জানি, মারের সাবধান কি আর দুর্গে হয়। এখানে আমাদের এক গাইড জুটলো, ত্রিশ টাকা মাত্র ত্রিশ টাকা মাত্র বলে এমন হাঁকডাক করলো আমরা আর ফেরাতে পারলাম না, যদিও আমাদের পার্মানেন্ট গাইডের এতে সখৎ আপত্তি ছিলো। তা গাইডসাহেব ভারী আয়েসী।  নিজে আর সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন না, আমাদের আঙুল দিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিলে উধার যাইয়ে জনাব, ডাঁয়ে সে যাইয়ে, বাঁয়ে ঘুমিয়ে, থোড়া নীচে দেখিয়ে এইসব করে। 






বাউলি থেকে বেরিয়ে আমাদের খিদেয় অস্থির অবস্থা। সৌরভের ব্যাগে গুপ্তধন ছিলো,  এক প্যাকেট বিস্কুট তা দিয়ে প্রাণ রক্ষা করে শুনি টাঙ্গাওলারা খুব চেঁচাচ্ছে, ছোটা ইমামবাড়া যাবেন চলুন, পঁচাশ পঁচাশ। কিন্তু ছোটা ইমামবাড়া খুবই কাছে, আমরা হেঁটেই যাবো জানি। তাই তাদের কাটিয়ে এগিয়েছি একটু দেখি এক টাঙাওলা বলে,  আসুন আসুন দশ টাকা তিন আদমি কে লিয়ে!! বলে কি রে! তিনজনের দশ টাকা? আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে টপ করে উঠে পড়লাম। কিছু পরে দেখি তার ঘোড়াও হেসে উঠেছে, সেই দেখে বিব্রত টাঙাওলা বলল, 'আপ লোগ উতর যাইয়ে জনাব, হাম নেহি যায়েঙ্গে' 
ক্লক টাওয়ার রাস্তা থেকেই দেখা যায়,  পাশেই একটা নোংরা জল কম অথচ গ্যালারী করে সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর। এর আশেপাশেই কোথাও পিকচার গ্যালারি আছে। পিছনের সরকারি অফিসের মতোন ওই বাড়িটাই নাকি? কাছে গিয়ে দেখি তাইই। পৌঁছতেই সাগ্রহে যেভাবে একজন আইয়ে জনাব বলে ছুটে এলো নিঃসন্দেহ হওয়া যায় গাইড। 
বিভিন্ন রাজা রাজড়াদের ছবি টাঙানো সব,  বেশীরভাগ থ্রিডি ছবি, মানে আমি বাঁ দিক থেকে ডানদিকে গেলে ছবিও ঘুরবে। সেই গাইড জনাব রসিক আছেন। এক নবাবের (নাম ভুলে গেছি) ,  শুধু নাগরাই জুতো ঘুরছে এমন না সাথে চোখও ঘুরছে, বলে 'দেখিয়ে দোনো তরফ আওরাত দেখনে কা নতিজা, ইনকো জেহের দিয়া গ্যায়া ঔর মর গিয়া কম উমর মে হি।'
আমার মুখে একটা মোটোর মেকানিক ছাপ আছে জেনেছিলাম আগেই, এবার জানলাম আমার মুখে একটা চা দোকানের বয় ছাপও আছে। সমুকে তো গাইড বলেই দিলো, আপকো নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কি তরাহ দেখনে মে হ্যায়। অবশ্য সে নিয়ে সমুর বিড়ম্বনাই বেশি হয়েছে আমাদের কাছে। একটা ছবি দেখানোর সময় সৌরভকে বলল, শেহজাদে, আপ মেরে বাঁ তরফ আইয়ে জারা, আর আমায় বলল, ছোটু তুম মেরে ডাঁয়ে তরফ আও জারা!! এরপরে আর কিই বা করার থাকে কমন্ডুলু নিয়ে হিমালয়ের পথে যাওয়া ছাড়া! 
পিকচার গ্যালারির বাইরেই দেখলাম, তারপর আরো বহু জায়গায় দেখলাম, তখনকার লোকে খিলেন বানাতো পাতলা ইঁট যা দিয়েই পুরো বাড়িটা বানাচ্ছে সেই ইঁট কাত করে করে খিলেন এর আকার দিতো। 
পিকচার গ্যালারি থেকে ছোটাইমাবাড়া হাঁটা পথ, বৃষ্টি থেমে গেছে। লখনৌ শহরটা একে এতো পুরোনো তায় যত্রতত্র অবাধে গরু ঘোড়া ঘুরে বেড়ায়। পান গুটখার পিক আর গোবরে রাস্তাঘাট ভরে আছে। কাদা, গোবর বাঁচিয়ে চলতে গেলে বিক্রম মানে সিএনজি বা বড় অটো, বিক্রমের সাথে এসে ঢুঁসো মারতে চায়। এখানে ট্র্যাফিক সত্যি বড় অদ্ভুত, যার মন চাইছে যেমন খুশিতে যেভাবে সেভাবেই যাচ্ছে। যদি আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তা পেরোবেন বলে তাহলে সারাদিন দাঁড়িয়েই থাকতে হবে, বুক ফুলিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে হবে,  পথেই এবার নামো সাথী গাইতে গাইতে, অটো বা টোটো বা বাইক স্পীড না কমিয়ে আপনাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। আপনি ইষ্টনাম জপতে জপতে বৈতরনী মানে রাস্তা পার হবে।
ছোটা ইমামবাড়া আসলে মসজিদ। রিনোভেশনের নাম করে বেশ খানিকটা নষ্ট করেছে আমাদের দেশের কোনো উচ্চবুদ্ধির লোক। যাই হোক যা আছে তাও দারুণ লাগে দেখতে। ঢোকার দরজার মাথায় উড়ুক্কু মাছ বসানো।  তখন জানতে গেলে গাইড নিতে হয়,  তাই আমরা গুগল গাইড থেকে জেনে নেওয়াই উচিত বোধ করেছি। 




বর্তমানকে উপেক্ষা করে ইতিহাসে মুখ গোঁজার মন আমাদের নয় তাই পেট ত্রাহিমাম ত্রাহিমাম করে উঠছে বুঝেই আমরা আর সোজা টোটো ধরে, টুন্ডে কাবাব খেতে চললাম। চৌকের টুন্ডে অনলি বিফ আগেই শুনেছিলাম কুন্তলাদির ব্লগ থেকে তাই আমাদের গন্তব্য আমিনাবাদ।
টোটো ধরা মহা ভুল হয়েছিলো দেখা যাচ্ছে, খিদের গতি ঘন্টায় পাঁচশো মাইল আর টোটোর গতি ঘন্টায় পাঁচ মাইল! এদিকে সে আবার চিকন ফ্যাক্টরি নিয়ে যাবেই। প্রথমে তো শুনছিলাম চিকেন ফ্যাক্টরি, চিকেন খেতে ভালোবাসি কিন্তু পোল্ট্রি দেখতে যাবার মতোও ভালোবাসিনা তাই বিস্মিত হয়েছিলাম খুবই।।মুখ দেখেই বোঝা যায় মাংসভুক? ধরে ধরে পোল্ট্রি নিয়ে যায়? পরে বুঝলাম চিকন ফ্যাক্টরি। তারপর টোটোওলা এক ওয়ান ওয়েতে ঢুকে পড়েছে। পুলিশ এসে বাতচিত করছে, সময় এগোচ্ছে আমাদের খিদে এবার চেঙ্গিস খাঁ হয়ে যাচ্ছে। শেষে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সে পুলিশ চেঙ্গিস খাঁ এর হাত থেকে রেহাই পেলো। 
আগের গলিতে আমাদের নামিয়ে দিলো। হেঁটে হেঁটে লখনৌ এর পুরোনো গলি দিয়ে এগোচ্ছি, বাতাসে জর্দার গন্ধ, রাস্তার পাশে পুরোনো ভাঙাচোরা হাভেলী টাইপ বাড়ি, সে বাড়ির সামনে গনেশপুজো হচ্ছে। পাশেই দাড়িওলা ফেজ টুপি ঠুক ঠুক করে কি যেন ঠুকছে ছোট্ট দোকান ঘরে। ডানদিকে দিব্যি জামা কাপড়ের দোকান। সব মিলিয়ে ইতিহাস বর্তমান একাকাকার হয়ে চলতে থাকে। হঠাৎ নাকে এলো সুবাস আর আমরা বুঝে গেলাম এসে গেছি আমাদের মোক্ষস্থলে। 




(ক্রমশ)