Sunday, October 1, 2017

পুজো

পুজো মানে ঢাকের আওয়াজ। প্রচুর পুজো, থিম, হুল্লোড় খালি ঢাকের আওয়াজ কই শুনিনা কেন? দেশেরবাড়ি না পৌঁছলে বুঝি ঢ্যাংকুড়াকুড় বাদ্যি আর ঠাকুর পাবো না? হাঁটছিলাম, অফিস যেতে হবে। হঠাৎ সেই পরিচিত ষষ্ঠীর সকাল, ঢ্যাংকুড়াকুড় ঢ্যাঢ্যাং ঢ্যাং, ঢাকীরা একটা বাড়ির পুজোয় ঢাক বাজিয়ে ডাকছে দুগগা ঠাকুরকে। দুটো ছোট ছেলে মেয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে। আহা হোকগে অফিস, ষষ্ঠী, পুজো পুজো ফিল না হয়ে পারে!
বন্ধুদের সাথে বেরোনোর ছিলো, এক এক করে সবাই পাতলা হয়ে গেলো। বেশ যাকগে বাড়ি ফিরে ল্যাদ খায়েগা না হয়। মুখ গুঁজে কাজ করছি, এমন সময় এক ভাগ্না ফোন করলো, 'মামা কোথায়?....' । বাসে উঠে, কানে হেডফোন গুঁজতে যাবো হঠাৎ শুনি পাশ থেকে গজলের সুর ভেসে আসছে। পাশের সিটে একটা ছেলে গাইছে, পিছনের আরেকজন হলা মিলিয়েছে, অন্যপাশ থেকে এক ভদ্রলোক চোখ বুজে মাথা নাড়ছেন, ফাঁকা রাজারহাট সল্টলেক পেরিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাস। রাজারহাট, সল্টলেক অফিসদিনগুলোয় যত জমজমাট আজ ততটাই খাঁ খাঁ, কেমন বিষন্ন হয়ে প্রাণহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উল্টোডাঙ্গায় জ্যাম তবু বিরক্ত হচ্ছিনা বাসের কেউই, ড্রাইভার খিস্তি করলো, ওই ছেলেগুলোই বলে উঠলো, আরে দাদা পুজোর সময় রাগ করলে হয়।
রন্টি আটকে আছে শ্রীভূমির জ্যামে, আমি টুক করে তেলেঙ্গাবাগান চলে গেলাম। পুজোয় একা একা মন্ডপ ঘুরতে কেমন লাগে জানারও ছিলো। নট ব্যাড, অবশ্যই বন্ধুদের সাথে ঘোরার মতো না, তবে একবার বিগডেটা অ্যানালাইজার টাইপ হয়ে গেলেই, খালি লাগবে না আর কত।কি দেখার থাকে। ভীড়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত বিরক্ত খুকি বলছে বাড়ি যাবো, মা ধমকে ওঠে কেন না ফেস করো, দেখো কেন তোমায় আনিনা, জোর করে তো তুমিই আসতে চেয়েছ। ইচ্ছে করছে বলি, বুড়ো বয়সে আপনাকে বাড়িতে রেখে বা এরকম ভীড়ে দাঁড় করিয়ে ঠাকুর দেখাবে এইই, আর আপনার প্রশ্নের উত্তরে যদি আজকের দিনটা মনে করায়? বলা হয়না, বলা যায়না, এগিয়ে যাই।
বিষাদ বড় সর্বগ্রাসী, মনটা খারাপ হয়ে গেলো, ইতিউতি রোল চাউমিনের দোকান, মিঠা পান, অমলেট, আইস্ক্রীম কিছুই ভালো লাগছেনা। একা একা হাঁটতে ভারী বোকা বোকা লাগছে। করবাগান, পল্লীশ্রী আলো....পুরোনো দিন....ধ্যাত রন্টি কই রে বাবা। হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেলো, পুলিশ ভদ্রলোক একজন বুড়ো মানুষকে ধরে ধরে রাস্তা পার করে দিলো। একঝাঁক ছেলে মেয়ে বেরিয়েছে, ছেলেটার ফোন এসেছে, কে রে, আরে দাঁড়া হেডফিসের ফোন।হেডঅফিস তো পাশেই রে আবার কার ফোন, আরে সিনিয়র হেডঅফিস, মা ফোন করেছে। 
রন্টি কাঁকুড়গাছি ডাকছে, এগোচ্ছি, রঙের মেলায় ভীড়ে মেলায় মানুষের স্রোত, অটোভাড়া দড়াম করে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেঁপু বাশী, পেল্লায় গরমে ঘামে ভেজা শার্ট সব মিলিয়ে বেশ লাগছে। দেদার আড্ডা মারছি, ভাগ্নে প্রায় আমারই বয়সী, পুজোর পরেই অন্য শহরে যাবে তাই যতটা পারছে কোলকাতা বুকের মধ্যে তুলে নিচ্ছে। 
শ্রীভূমিতে বাহুবলী দেখার ভীড় দেখলে শ্রদ্ধায় নমো করতে ইচ্ছে করে, বাপরে বাপ, পাকা তালের মতো মাথার সারি সেই লেকটাউন অব্দি। লেকটাউনের ঠাকুর আবার একটা কিনলে দুটো ফ্রি কন্সপটে বানিয়েছে মনে হচ্ছে। দমদম পার্ক ঢোকার আগে জল কিনতে গেলুম, দেখি ব্যাটা মহিষাসুর মন্ডপ থেকে বেরিয়ে জলের দোকান দিয়েছে, কুড়ি টাকার জলের বোতল পঁচিশে!!
দমদম পার্কে ঠাকুর যতনা দেখা যায় চক্কর বেশী কাটা হয়, আর সারি সারি কত রকম খাবার রে ভাই, রোল চাউমিন ফুচকা ভেলপুরি মিষ্টি পিজ্জা মাছ ভাজা কি চাই নিয়ে বসে যাও। বেলুন ফাঠানো দেখে থামতেই হয়। আমার তাক বেশ খারাপ তাই ঝাঁকে তাক করি একটা না একটা ফাটবেই। 
আমরা যথারীতি রাস্তা হারিয়েছি, রিকশাওলা ভুল রাস্তা বলে দিলো, তারপর আড্ডা মারতে থাকা পাড়ার লোকে ঠিক রাস্তা, পা প্রায় হাতে চলে আসার উপক্রম হাঁটতে পারছিনা করে করে বাড়ি।
চান টান করে এসিটা অন করে পুজোবার্ষিকি আহা কাল আবার সপ্তমী, বন্ধুদের সাথে আড্ডা। 

কটা দিন চেটেপুটে নিই....

***************************************************************************************************************
বদল ইজ, যে পুকুরে থুড়ি লাফ খেয়ে শিং গজায় সে পুকুরের জল দেখে 'চুল্কাবে গা, পাগল নাকি নামবো'!
আনন্দ ইজ, বিকেলে হাঁড়ি হাতড়ে দুপুরের অষ্টমীর লুচি ছোলার ডাল বোঁদে বিকেলে চুপিচুপি।
ছায়া ইজ, গাড়িতে চোট লাগলে মায়ের কাছে দাঁড়ানো, আর 'যা আমি দিয়ে দেবোখন, অষ্টমীর দিন অত মন খারাপ করতে হবে না'।
অষ্টমী ইজ, উপরের সবকটার কোলাজে, 'ওরে বেলপাতাগুলো নিয়ে আয় রে', 'ঢাকি কই, এই এদিকে এসো', 'সময় শুরু হয়ে গেছে সন্ধিপুজো শুরু করো শুরু করো', আরতির তাপ বুকে মাথায় লাগানো, বন্ধুদের সাথে হুল্লোড়, , 'কেমন আছিস, কবে এলি', ধোঁয়ার মোড়া ঠাকুর, ধুনোর গন্ধের ঠাকুরতলার চেয়ার, ক্যাপ বন্দুকে চোর পুলিশ, লাল জামা পরা সেম সাইজের দুটো ক্ষুদে দাদুর কোলে বসে আরতি।

********************************************************************************************************************




মাইকে 'তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে' শুনে ঘুম ভেঙে গেলো সক্কাল বেলা। তবু ভালো গতকালকের মতো, এপাড়ে থাকবো আমি তুমি রইবে ওপাড়ে জাতীয় কিছু চালিয়ে দেয়নি। নবমীর সকাল।অন্যবার ভোরে ঘুম ভাঙে,  মাছ ধরতে আসে এবারে বন্যা হয়েছিলো, পুকুর ভেসে গেছে সাথে মাছও, তাছাড়া পাড়ে দাঁড়াবার জায়গা নেই মাছ ধরা হবে না। বাবাই আর মেজদাদা বাজার গেলো, আমিও চা খেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। 
লগবগ করতে করতে এগোচ্ছি, সাইকেল চালাইনা অনেকদিন, কাল রাতে হালকা বৃষ্টি হয়ে কাদা কাদা হয়ে আছে। ইচ্ছে করেই অন্য রাস্তা ধরলাম, ওদিকটা যাইনি আগে। প্রাইমারী স্কুলের পাশ দিয়ে এগোচ্ছি রাস্তাটা গিয়ে ফের পিচরাস্তায় উঠেছে। কোন জায়গা এটা? ও ওই তো আল আমীন মিশন তারমানে খলতপুর। পিচরাস্তা দিয়ে এগোচ্ছি, একটা দুটো বাস পেরিয়ে যাচ্ছে, ডানহাতে মিশনের ছেলেরা খোলা জায়গায় সবাই মিলে চান করছে, একটা পাগলী সন্দেহজনক চোখে আমার দিকে দেখে এগিয়ে আসছে। সোজা ডিহিভূরশুট যাবো? নাহ এদিককার গ্রামগুলো ঢুঁ মারিনি এদিকেই যাই। বাঁদিক ধরে এগোচ্ছি, একটু পরেই কংক্রিটের রাস্তা শেষ হয়ে কাঁচা আলপথ। মুসলমান পাড়া এদিকটা, তার মানেই যে বিরাট তফাৎ চোখে পড়ার মতো আলাদা তা নয়, দুর্গাপুজো হচ্ছে না বটে কিন্তু মাইকে দিব্যি নবমীর পুজোর মন্ত্র ভেসে আসছে। এদিককার সব গ্রামই আবাস যোজনা পেয়ে বাড়ি বানিয়েছে কিন্তু অদ্ভুত এরা এক ফোঁটা জায়গা ছাড়ে না, ফল হয় গ্রামগুলো, পাড়া গুলো ঘিঞ্জি একটা জায়গা হয়ে যায়। সরু সরু রাস্তা গায়ে লাগা লাগা বাড়ি।
এক বুড়ি হাঁটু জলে নুয়ে নুয়ে কলমী শাক তুলছে, অচেনা আমায় দেখে জিজ্ঞেস করে উঠলো, কে রে তুই, কোথায় যাবি? গ্রামে এটা স্বাভাবিক, মানে এমন ডাক দেওয়াই, আমি বললাম অমুক পাড়া ঠাকমা, এই সোজা রাস্তা যাবে? এখানে পাড়া হয় সারনেম দিয়ে, বলল ও সোজা না এই তো বাঁদিকে বেঁকে যা,  ওই দুটো পুকুরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা, মসজিদ এর গোড়ায় উঠবে ওর পাশ দিয়ে চলে যাবি। দেশী মুরগি ঘুরছে,  মুরগীদের চলার মধ্যে বেশ গর্বিত রাণী রাণী ভাব আছে। এখন আর মাইক এর আওয়াজ আসছেনা। ছিপ নিয়ে কতকগুলো ছেলে পুঁটি খলসে ধরছে। একটা ছোট মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে কোমরে হাত দিয়ে।  বেল দিলাম যথারীতি সে পাত্তাও দিলো না। আমিই ঝপাং করে নামলুম। এদিককার পাড়া আমার চেনা না একেবারেই, একঝাঁক হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করছে, সাদা লুঙ্গি পরা তিনটে অল্পবয়সী ছেলে মোবাইল ঘাঁটছে গাছের গোড়ায় বসে।
একজন লোক ঝুড়িতে করে কিসব বিক্রী করতে এসেছে, ছেলের দল ঘিরে দাঁড়িয়ে। 'এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় কোথাও?' 'তুমি কোথায় যাবে? হ্যাঁ হ্যাঁ যাবে চলে যাও'। চারিদিকে ধানক্ষেত, সবুজ হয়ে ছেয়ে আছে। আচ্ছা বানে এইসব তো জলে ডুবে ছিলো, ধান নষ্ট হয়নি? বাড়ি ফিরে জিজ্ঞেস করতে হবে। রাস্তা বলতে চওড়া আল, ট্রাক্টর চলে চলে অদ্ভুত ভাবে গর্ত।
অনেকক্ষন চলার পরেও বোঝা গেলো না কোথায় যাচ্ছি। অবশ্য এরকমভাবে এলোমেলো ঘুরবো বলেই তো বেরিয়েছিলাম্বাএ ।
দুটো বাঁকানো শিংওলা গরু নিয়ে হ্যাট হ্যাট করতে করতে একটা লোক যাচ্ছে, ও কাকা এ রাস্তা কোথায় যাচ্ছে? কোথায় যাবি তুই? বড় জ্যেঠার নাম করে বলল,  ওদের বাড়ির ছেলে তুই? তা এদিকে চলে এলি কি করে। আমি ভাবছিলাম,  আমার বড় জ্যাঠা মারা গেছেন আজ চোদ্দ বছর হয়ে গেলো, এখনো আমাদের পাড়ার নামে বড় জ্যাঠার নাম দিয়ে লোক চেনে। গরুটার শিংটা বেশ সম্মানজনক, মনোযোগ টাল খেয়ে গেলো, টলমল করতে করতে পপাত চ সোজা ধান ক্ষেতে। পড়লাম না ঠিক, বলা ভালো কাদায় গেঁথে গেলাম, হাতে পায়ে কাদা মেখে উঠে সাইকেলে ওঠার আর চান্স না নিয়ে সাইকেল ঠেলে এগোচ্ছি। কয়েকটা বুলবুলি সামনে নবমীর রোদ মেখে আড্ডাচ্ছে, ওদিকে ইলেক্ট্রিকের তারে একটা ফিঙে ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে আরাম করছে। দূর থেকে মন্ত্রপাঠ ভেসে আসছে। আরে দূরে ওই মাঠে ওটা কি? নেউল এতো বড়? এহ ক্যামেরা নেই,  একটাও কিছুর ছবি উঠবেনা। যাকগে নাই বা উঠলো ওই ভালোলাগাটা এই মায়া মায়া রোদ ঝলমলে সকালটা কি ক্যামেরায় তোলা যেত, বুকের মধ্যে পুরে নিই যতটা পারি।
এহে সামনে আবার জল যে রে, আলটা এখানে নেইই একেবারে, স্রেফ মাঠ এর মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া! হেঁটে গেলেও চাপ, জল কতটা বুঝছিনা, যা হবে হোক, সাইকেল চালিয়ে দেখি। এবং যা দেখা স্বাভাবিক তাই হলো, কাদায় চাকা স্লিপ করলো আর আমি জলে। মানে ওই কাদায় গেঁথে যাওয়া ফের। হাত ডুবিয়ে ডুবিয়ে চটি উদ্ধার হলো, কাদাটা জলে ধুতে ধুতেই নিজের বদমায়েশিটা বুঝলাম, আমি আসলেই এই কাদা মাখতে চাইছিলাম, নিজেকে শুধু এইভাবে বোঝানো।
আবার একটা গ্রাম, এখানে বাড়ির সামনেই গরু বেঁধে রাখে, গোবরে মাছিতে কিছুই যায় আসে না, অদ্ভুত! গোবরের গন্ধে জায়গাটা ভরে আছে, আরেকটু এগোতে মন্দিরে বসে বাঘবন্দী খেলছে দুজন লোক। মন্দির মানে ওই সৌধ গুলো, মারা যাওয়ার পর গ্রামের দিকে বানায়। একটা বুড়ি উবু হয়ে বসে রান্না করছে একটা চালাঘরে। ডিমের ঝোলের গন্ধ ছাড়ছে কোথায়। একটা বউ চেঁচিয়ে চেঁচয়ে ঝগড়া করছে, 'আমি না থাকলে তো চোখে ঘুঘুচরা দেখবে'।  এ খানে পুজো হচ্ছে না।
বাবাই ফোন করছে,  ওহ এতো দেরী হয়ে গেছে বুঝি। সূর্য মাথার উপর উঠে গেছে কখন।একটা ঝোপে কতকগুলো নীল ফুল ফুটেছে, সুপারি গাছের নীচে কয়েকটা ছেলে খেলছে, পুকুড়পাড়ে বসে একটা বউ বাসন মাজছে। ঘামে আমার গেঞ্জি ভিজে গেছে। বাড়ি ফিরতেই সব্বাই  কোথায় ছিলি কোথায় ছিলি করে বলে ধেয়ে এলো। 'নাওয়া নেই খাওয়া নেই এই এক পাগলা ছেলে হয়েছে, রোদে পুড়ে গেছে যা গিয়ে দুটো মুখে দে'। এসব সময় সুড়ুত করে হাতপা ধুয়ে খেতে দাও খিদে পেয়েছে বলাটা সবচেয়ে নিরাপদ।
বিকেলবেলা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। কড়কড়াৎ করে বাজ পড়ছে লোডশেডিং।  জেনারেটর চলে আসার আগে ফট করে চারদিকটা অদ্ভুত শান্ত, ঝিরঝির করে হাওয়া দিচ্ছে, নারকেল গাছের ফাঁকে নবমীর চাঁদ উঠেছে। আরতি শুরু হলো। ঢাকি, পুরোহিত, ঝাঁজ কাঁসর সবাই মিলে চাইছে নবমীর নিশি যেন না পোহায়। অষ্টমীর পুজোটায় ভক্তিভাব বেশী থাকে আর নবমীর পুজোয় মনখারাপি আকুলতা বেশী। যেওনা, আবার তো সেই কতদিন পর আসা। আরতির শেষে বাড়ির বাচ্ছাদের খেলা নাচ গান সবের ফাঁক দিয়ে দিয়ে উদাস হয়ে যাচ্ছে মনটা, চাঁদ আরো সরে গেছে, মন্ডপের আলোর শেষেই অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে, যতদূর আলো দেওয়া আছে তার পরেই ঝিঁঝিঁর ডাক। আড্ডা মারছি ভাই ভাগ্নাদের সাথে, ইয়ার্কি মারছি বৌদিদের সাথে, ছোট ভাইপো ভাইঝিদের পিছনে লাগছি তবু যেন আমি এখানে নেই। আচ্ছা সেই আম গাছটার সাথে তো দেখা করা হলো ন। এবার, লোভী মানুষ ভাবছে নির্ঘাত, ছায়ার খোঁজে আমের খোঁজে যারা যায়।  ক্রমে আরো রাত বাড়ে, মা খেতে ডাকে, শব্দ কমে আসে,  মাইক বন্ধ হয়, দুগগা ঠাকুরের মুখটাও কি মলিন হয়? নিজের মনেই হেসে উঠি এ ভাবনায়, জ্যান্ত পুতুল নাকি যে মলিন হবে, কালকেই রাস্তার ধারে একটা শিবঠাকুরের থান থেকে খুচরো পয়সা তুলে আইস্ক্রীম খেয়েছি, এসব ভগবান এসে বসা কেস আমি মানিনা কিন্তু কল্পনার ডানা ছোটাতে বেশ লাগে। রাতের বেলা কে জাগরি করে লক্ষ্মী তার প্যাঁচা নিয়ে উড়ে যাবে কদিন পর ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়, ফিসফিস করে পরীরা নেমে এসে মাঠে খেলে বেড়াবে, গাছের ডালে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী সব দেখে শুনে রাখবে। রূপকথা না থাকলে জীবন বড় এক মাত্রিক, যান্ত্রিক হয়ে যাবে যে।
সক্কাল থেকে অঝোর বৃষ্টি। আকাশ কালো করে রয়েছে, টেঁপিদিদির মা গল্প জুড়েছে,  'হ্যাঁ বাপ তুমি তাহলে নিজে নিজে অত বড় গাড়িটা চাল্লে যাও?' আরে দূর আমি চালাই নাকি ইঞ্জিন চালায় তো, আমি এমনি বসে থাকি। তোমার নাতিরা কই। 'আর বলুনি বাপি, দুটোই মানুষ হলুনি' (মুখে আঁচল গুঁজে খুঁকখুঁক কান্না)।  আহা কাঁদছ কেন, কী হলো, বম্বেতে কাজ করত শুনেছিলাম তো। 'হ্যাঁ বাপ,  বেশ কাজ করছেলো, তারপর কি মতি হলো কিই বলবো, একটা মেয়ে বয়সে বড় তার সঙ্গে লাভ কল্লে'।
বড় জানলে কি করে, তোমার নাতির বয়স জিজ্ঞেস করতে বললে জানোনা।
'ওই বোঝা যায়,  ডাগর হয়ে গেচে, তারপর থে ঘরে মোটে আসেওনে,  ট্যাকাও পাটায়নে'।
'তা বয়স হয়েছে এবার তো সে বে শাদী করতেই পারে নাকি?'
' তা করুক না বাপি, তাই বলে ঘরকে এসতেও নেই,  দুটো পয়সা বাপের হাতে দিতে নেই?'
হাবিজাবি কথাবার্তা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না বাইরে যাওয়া যাচ্ছে।
সুতো কাটার ঢাক বাজছে, 'ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ ঠাকুর যাবি বিসর্জন, ঠাকুর থাকবি কতক্ষণ ঠাকুর যাবি বিসর্জন'।  অপারাজিতা পুজো হয়ে গেলো, সবাই হলুদ জলে দুর্গার মুখ দেখছে। কেন দেখে কে জানে, জিজ্ঞেস করা হয়নি, ভুলে যাই। দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে। বৌদিরা গোল হয়ে বসে আনাজ ছাড়াচ্ছে,  পিঁয়াজ কাটছে, মাঝে মাঝে রহস্যজনক ভাবে হেসে উঠছে নিজেদের মধ্যে। বৃষ্টি কমেছে,দুধচিঁড়ে ভোগ হাতে আমি পুকুরপাড়ে গিয়ে গাছে হেলান দিয়ে বসে খাচ্ছি, একটা ডেঁয়োপিঁপড়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমার কাছে এসে নাক মানে শুএ তুলে বুঝে নিলো খাবার আছে অম্নি ব্যাটা গুড়গুড় করে এগিয়ে এলো, আমিও সেটাকে গোটাকতক ঘুরপাক দিয়ে ছেড়ে দিলাম।
দুপুরে পরিবেশনের মজাটাই আসল, 'ছ্যাঁচড়াটা দিয়ে যা রে এদিকে একটু', 'ডাল দিয়ে যা না রে',  'ও ঠাকমা দুটো ভাত নাও', 'অরুণ মাংসের বালতিটা নিয়ে আয় তো, ছোজ্যাঠ্যাইকে মাংস দে',  'তুই দে না কাকার পাতে আরো চারটে রসগোল্লা, হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা খাবে'।  এইসব কথাবার্তায় সরগরম হয়ে উঠলো পাড়া। কুকুরগুলো এঁটো শালপাতার কাছে জমা হচ্ছে, মিত্তুনদার নাতি একহাতে রসগোল্লা আরেক হাতে দাদুর হাত ধরে চলেছে।
তারপর ক্রমে সব শেষ হয়, শান্ত হয়ে আসে চারিদিক, একটা চোখগেলো পাখি কাঁহা কাঁহা তার সঙ্গিনীকে খুঁজে ফেরে অলস দুপুরে, একমনে জাবর কাটে গরুগুলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল,  সন্ধ্যে হয়ে যায়, আলো জ্বলে ওঠে। মাইক বেজে ওঠে, ঢাক। দশমীর চাঁদ উঠেছে।, মেঘ কেটে গেছে। প্রনাম, মিষ্টি, সিঁদুরখেলা, নাচ দিয়ে বিষণ্ণতা দূরে রাখা। মা বরন করছে, যত্ন করে মিষ্টি, দুধ, পান খাইয়ে মুখ মুছিয়ে কানে কানে বলছে আবার আসতে। সবাই মিলে হাত লাগিয়েছি, আসছে বছর আবার হবের জোরে ভারী কাঠামোটা তুলে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া যায়....কি খারাপ লাগে এই সময়টা, ভাসতে ভাসতে টুপ করে দুর্গার মুখটা জলের নীচে, ফাঁকা মন্ডপে শান্তিজল।
চাঁদ আরো সরে গেছে, অন্ধকারে সরে গেলাম, পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে, ঝিরঝিরে হাওয়ায়, ঝিঁঝির ডাকে সেই আম গাছটাকে বলছি, যাওয়া হয়নি মানেই মনে করিনি তা না কিন্তু, গাছেরা তো সব টের পায় এই নারকেল গাছটা নিশ্চয়ই পৌঁছে দেবে আমার কথাটা। দেখা হবে নিশ্চয়ই আবার, আসছে বছর বা তার আগে।

No comments:

Post a Comment