Sunday, September 24, 2017

পুজো - তৃতীয়া

'যাদবপুর থানার সামনে, দশ মিনিটে পৌঁছে যাবো। একটু দাঁড়া, রাগ করিসনা প্লিজ'।
তৃতীয়ার সন্ধ্যে কে বলবে! গড়িহাটের মোড়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত ভীড়। আমিও সে ভীড়ের অংশীদার। নাহ দাঁড়িয়ে থাকতে খারাপ আমার লাগছে না সত্যি। পুজোর গন্ধ মাখা ভীড় দেখতে মন্দ লাগছে না। চা এর দোকানের খদ্দের আজ পুলিশ বেশী। ট্রাফিক সামলাবার ফাঁকে ফাঁকে গলা ভিজিয়ে যাচ্ছে। এক প্যাকেট মেরি বিস্কুট (মারি বিস্কিট শব্দবন্ধটা চা এর দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা ঋকানন্দ মহারাজের না)। লুঙ্গি, খালি গা, কাঁধে গামছা একজন চা খেয়ে মুখ টুখ কুঁচকে বল্লো কি রে পুজো কি তোরও শুরু নাকি, চিনি দে চিনি দে, শাল্লা মিষ্টি ছাড়া চা বানাচ্ছে!
ওদিকে চা এর দোকানের পাশে দোসার স্টল জমজমাট। একটা মহিলা খুব চেঁচাচ্ছে ফোনের ওপাড়ে থাকা কাউকে, বরই হবে, 'কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমার এখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি আমি, কখন আসবে.... '। বাবার কাঁধে চড়ে একটা ক্ষুদে বড় বড় চোখে সব দেখতে দেখতে একডালিয়ার দিকে এগোচ্ছে। কিছু জিনিস বদলায় না।
আমার পাশে এক মহিলাও অপেক্ষা করছে। আমার ফোনে কথা শুনেই হোক কি কটকটে হলুদ রঙের টিশার্ট দেখেই হোক আমার দিকে তাকিয়ে দেখলো দুবার, আমিও দেখলাম, দেখার জিনিস না দেখা অপরাধ। একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে হই হই করে এগোচ্ছে দেখি। কালো শাড়ি স্লিভ্লেস মেয়েকে তার বন্ধু বলছে, 'উফফ একডালিয়া তো হিলিয়ে দিলি রে'। মেয়েটা চটাস করে চাঁটা লাগালো সঙ্গে সঙ্গে, মেয়েটা ছেলেটা সহ পুরো দলটা হেসে উঠলো। পুজো এসে গেছে।
আমার কলেজ বেলার দিন গুলো মনে পড়ছিলো, একসাথে একদঙ্গল বেরিয়ে নিজেদের মধ্যে খিল্লি, লোকজনকে আওয়াজ, ঝাড়ি...বড় হয়ে গেছি, বা বুড়ো হয়ত। সেই পুরো কলেজের টিমটাই কোলকাতায় আছে এক দুজন বাদ দিলে তাও একসাথে বেরোনো হয়না আর হবেও না। শরতকালের মেঘের মতো সম্পর্ক বুনে বুনেই কেটে যায় দিন।
মনখারাপটা তাড়াতে জোর করে ফোনে খোঁজ নিলাম, বাকি মক্কেলরা কই। তারা আরেকপ্রান্তে তখন। বোঝো! যাক কদমকদম এগোনো যাক।
একডালিয়া আগের বছরের প্যান্ডেলটা কপি পেষ্ট করে দিয়েছে, একটা পিপিটি বানিয়ে প্রজেক্টরে ফেলেওও দিতে পারতো আরো কম এফোর্ট।
হিন্দুস্থান পার্কের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, বোর হচ্ছিনা, বন্ধুরা আড্ডা প্লাস সামনে বেশ মানে বেশ ইন্টারেস্টিং চালচিত্র আরকি। কাঁধখাবলা একটা জামা অনেক মামনিই পরে ঘোরাঘুরি করছে দেখছি, এক বন্ধু জানালো একে নাকি বলে কোল্ড শোল্ডার। হ্যাঁ রে ভাই এ যদি কোল্ড হয় হট শোল্ডারে তো প্যান্ডেল গলে যাবে রে। 
হিন্দুস্থান পার্কের মন্ডপটা ভালো বেশ ভালো, খালি একটা চর্মনগরীর পাশ দিয়ে গেলে যেমন ফিল আসে তেমন আসছিলো, আরএসএস কে খবর দিলে ব্যান করে দেবে। বালিগঞ্জ কালচারাল এর ঠাকুর গুলো বেশ মডেল সুলভ, মানে ইয়ে ব্যাপার আছে একটা বেশ। বিশদে বলা কাজের কথা হবেনা, দিনকাল ভালোনা। লেকের রাস্তার আল্পনাটা সত্যি বড় ভালো হয়েছে।
আমরা খুব হাঁটতে পারি, আড্ডা দিতে দিতে হাঁটতে আমাদের আলাবেজার নাই। টিউবওয়েল এ জল, দেশপ্রিয় থেকে হেঁটে ঢাকুরিয়া যাবো ভিতরটা দিয়ে, এই রাস্তায় ভীড় নেই, ফুলের গন্ধ, গাছের গন্ধ রাতের গন্ধ মেখে পড়ে থাকা রাস্তা। একা একা জানলার ধারে বসে আছেন একজন বয়স্ক লোক। তাঁর পুজো নেই। চোখে মুখে অদ্ভুত বিষাদ, নির্লিপ্তি মেখে চেয়ে, সে চোখের দিকে তাকাতে ভয় করে, যৌবনের শেষ দেখতে পেয়ে বুকের ভিতর শিরশির করে, দ্রুত পা চালাই।
ক্রমে রাত বাড়ে, ট্যাক্সিওয়ালা ডিকির উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তৃতীয়ার রাত চতুর্থীর দিকে এগোয়। মানুষের ভীড় খুব কিছু কমে না, পঁচানব্বই এর পল্লীর সামনে এক বাবা এক হাতে তার মেয়েকে ধরে গল্প শোনাতে শোনাতে এগোচ্ছে, দৌড়ে রাস্তা পার হবার সময় একটু আগে ঝগড়া করে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটা একবার পিছিয়ে এসে ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে দৌড় দেয়, দুটো যুবক কোনোদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের হাত দুটো শক্ত করে ধরে এগোচ্ছে আইস্ক্রীম এর গাড়িটার দিকে।
একটা ফাঁকা গাড়ি ফিরছে, 'কোথায় যাবে ভাই?' দরাদরি করে উঠে বসলাম। একটু বেশীই নিলো কি করা যাবে, পুজোর বাজার বলে কথা, নিকগে। বকরবকর করতে করতে এগোচ্ছি, পুজোয় একদিনও ছুটি নেই, মালিকের সাথে ঝগড়া করে ছেড়েই দেবে কাজ বলছে। বললাম দুম করে ছেড়ো না হে, তিনটে বাচ্ছা, মা বাবা পুজোর সময় কেস খাবে। বলল আরে না ভাই কথা বলে রেখেছি এক জায়গায়। ভাল্লাগে বলো? মেয়েটা রোজ জিজ্ঞেস করে বাবা কবে ছুটি তোমার, ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যবেনা? আমি হাসলাম, আমি জানি এ যাতনা, তৃতীয়ার দিন ঠাকুর দেখতে তো আর সাধে বেরোইনি, আইটি খাদানে কাজ করা শ্রমিকদেরও একই হাল কিনা। কাঁধ চাপড়ে বললাম ঠিক আছে ভাই হয়ে যাবে, মাথা গরম করে লাভ আছে। পুজো আয় পুজো যায়, লাল জামা নীল জামা গায়।
মোড় থেকে হাঁটছি, রাস্তায় আলো, কুকুর এক দুটো ওলা আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। আজ কেন কে জানে কুকুরেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আমায় খুব একটা ধমকাচ্ছেনা। একা একা দুটোর সময় ফাঁকা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে ভারী অদ্ভুত লাগে, ফাঁকি দেওয়ার নেশার মতো তীব্র আকর্ষনের। আকাশের দিকে তাকালাম একবার, হাল্কা একটা আলো ছড়িয়ে আছে....এই পথ চলাতেই তো আনন্দ, পুজোর আনন্দ বাঁচার আনন্দ। উৎসব।

6 comments:

  1. খুব ভালো লাগল, প্রদীপ্ত। যৌবনের শেষের মুখোমুখি হওয়া সত্যি বড় বেশি সাহসের কাজ, আমারও নেই অত সাহস। তোমার লেখা ইদানীং খুব ভালো হচ্ছে, আগেও হত, এখন বেশি ভালো হচ্ছে। থ্যাংক ইউ।

    ReplyDelete
  2. থ্যাংকইউ কুন্তলাদি 😊😊।

    ReplyDelete
  3. Replies
    1. -_- ফের ঠ্যাং টানা শুরু হলো ।

      Delete