Monday, September 4, 2017

ছোটবেলার পুজো ৪

আয়োজন বড় জরুরী। এই যে পুজোর আগের আয়োজন, মাঠে প্যান্ডেলের বাঁশ, রেডিওতে পুজোর অ্যাড, গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, নিউমার্কেট হয়ে পাড়ার দোকানগুলোয় মানুষের গুঁতোগুঁতি, ফাঁকা জংলা মাঠে কাশ ফুল, এসব আয়োজন করে দিয়েছে পুজোর। এখন বৃষ্টি আসুক না আসুক কিচ্ছু আসে যায়না, আনন্দ হবেই। আনন্দের জন্য আয়োজন তাই বড় দরকার, সে আয়োজন বুঝিয়ে দেয় কেউ কোথাও অপেক্ষা করছে, অনেকটা যত্ন ভালোবাসা যেন ওই আয়োজনেই লুকিয়ে থাকে, মা খেতে দেয় যেমন আয়োজন করে, পরিপাটি ভাত তরকারি গুছিয়ে, লেবুর ফালি দিয়ে, সেই আয়োজনের প্রয়োজন।
আজ যখন আসছি অফিসে, হঠাৎ করে টেম্পারেচার কমে গেলো, সব কিছু উন্মুখ, আকাশে ঘনশ্যামের ফাঁকে বিদ্যুৎ এর মুচকি হাসি....সে সময় রেডিওতে আশ্চর্যভাবে বাজছে 'তেরে হি তো পিছে পিছে বরসাত আয়ি...'
সে আয়োজন উপেক্ষা না করে এক ফোঁটা দু ফোঁটা....ঝমঝম।
লোকে বিরক্ত হয়ে গেছে বৃষ্টিতে জানি তবু প্রতিবার এই যে আকাশ কালো করে বিদ্যুৎ চমক, গাছপালা গুলোয় উন্মুখ প্রত্যাশা আর সে অমোঘ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৃষ্টির আগমন....প্রেমটা পুরোনো হয়েও হয়না যে এদের...

পুজো এসে গেছে সে আয়োজন করে গেলাম ...ছোটবেলার গল্প , একটু একঘেয়ে একটু গ্যাদ্গ্যাদে নস্টালজিক, তা নিত্যনতুন চমকে মন মাঝে মাঝে চেনা গলি ধরে সে ভরসসায় দিয়ে গেলাম, আগের বছরের লেখার শেষ কিস্তি।


অষ্টমীর সকাল মানে উপোস,  অঞ্জলি, বাবাই এর দেওয়া জামা প্যান্ট পরে বেলপাতা ছুঁড়ে ঠাকুরের পায়ে দেওয়া এই ছিলো ছোটবেলায়। সন্ধিপুজো যদি অঞ্জলির আগে পড়ে তাহলে আলাদা ব্যাপার। সক্কাল সক্কাল কাকচান বকচান করে দৌড়ে ঠাকুরদালানে। মা, জ্যেঠিমা, কাকিমা, দিদিরা (আমার কিছু দিদি আছে যারা মা এর বয়সী),  সবাই গিয়ে বসে গেছে, কচি কাঁচারা পরের ব্যাচ। অঞ্জলী দিয়েই ফের খেলা। এদিকে বাড়িতে বাড়িতে লুচি ভাজার গন্ধ। হ্যাঁ সপ্তমী অষ্টমীর দিন আমাদের নিরামিষ হয়। গাড়িদাদাকে আসতে বলা হয়েছে দুদিনই। দুপুরে মা থালায় করে লুচি  নিয়ে আসছে, পিছনে টেঁপিদিদির মা বিভিন্ন সব তরকারির বাটি থালায় করে। জল আসন আগেই পাতা, গাড়িদাদা বসেছে, আমি খাটের উপর থেকে হেঁটমুন্ডু হয়ে দেখছি। মাকে বড্ড ভালো লাগে এইসময়টা, কেমন কপালে ঘাম লেগে সিঁদুর আর পুজোর টিপটা মিলেমিশে গেছে, গলার হারটা দুলছে নীচু হয়ে খাবার দেবার সময়। ছোটবেলায় মা এর আঁচলের চাবির আওয়াজ, চুড়ির আওয়াজ সব মিলিয়ে মা আসলেই বুঝতে পারতাম, আর পড়া ফেলে গল্পের বই পড়াটা লুকিয়ে ফেলতাম। বাইরে থেকে অরিত ডাকছে খেলতে যাবার জন্য, এদিকে গাড়িদাদাকে ফেলে চলে যাওয়াও যাবে না, মা আরো কাকে কাকে সব খেতে। আমি টিউবওয়েল থেকে জল এনে এনে দিচ্ছি। ফাঁক পেয়েই দে দৌড়। দুপুরবেলায় ঠাকুরচত্বরটা ফাঁকা ফাঁকা, আমরা চটাং চটাং করে ঢাক পেটাচ্ছি আনাড়ি হাতে। এম্নিতে দেয়না কিন্তু নেহাত বাবুদের ছেলেদের না করা যায়না। সন্ধ্যেবেলা সন্ধিপুজো হবে। ১০৮ পদ্মফুল চাই। ১০৮ টা বেলপাতা দিয়ে মালা হবে। ১০৮ খানা প্রদীপ জ্বালাতে হবে। সব কিছুর প্রস্তুতি অনেক কিন্তু পুজোর সময় খুব কম। অষ্টমী আর নবমীর সন্ধিক্ষনে সব অর্ঘ্য নিবেদন করতে হবে, না হলেই সব বৃথা। মাধঅবো আর আরেকজন পুরোহিত ওই সময়টা পরীক্ষা দেবার মতো করে মন্ত্র বলে যায় একমনে কোনোদিকে মন না দিয়ে, ঢাকিদের ঢাক বাজানো বন্ধ ও সময়, স্রেফ মন্ত্রোচ্চারণ আর ঘন্টা নাড়ার আওয়াজ। ধুনোর ধোঁয়ায় মন্ত্রের আওয়াজে সবার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ঘোর এনে দিতো। ওঁং হ্রিং সিং কালিকায় নমঃ  না কি যেন বলত, আসলে তো কালীমূর্তি এনে পুজো হতো তার। ক্ষ্যামের পুজো না কি যেন বলত চলতি কথায়। চণ্ডিকা পুজো। তারপর মাধঅবো ইশারা করলেই একসাথে ঢাক ঢোল বেজে উঠতো আর ওদিকে বোম গাছে আগুন ধরানো হতো, সন্ধিপুজোর আরতি শুরু হতো। 
অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলার আরতিটা হয় প্রায় ঘন্টাঘানেক ধরে কি তারো বেশী। খেয়াল থাকেনা ঘড়ির। ঢাকি পুরোহিত সবাই তালে তালে মজে গেছে, দুর্গার মুখের গর্জন তেল চিকচিক করছে, ওই বুঝি পলক ফেলে।  আমরা খেলছি তারপরের বড় হতে আড্ডা। অষ্টমীর রাতেই বোধহয় পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান হতো, ভালো মনে নেই। গান আবৃত্তি নাচ এইসব আর কি।
নবমীতে  সকাল বেলা মাছ ধরতে আসতো , সে কথা আগেই লিখেছি। নবমীতেই তো যজ্ঞ হয় । নবমীর সন্ধ্যে থেকেই বিষাদ। দশমীর প্রনাম একটা বিরাট ব্যাপার । আমরা চার জন বেরোতাম প্রনাম করতে , সব্বাই বড় আমাদের থেকে , মিষ্টি  খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম । দু একটা জালি মিষ্টিও মুখে পড়তো , মানে তেল তেল গন্ধ হয়ে যাওয়া নাড়ু বা নিমকি । মুখে পুরে পাইপাই দৌড় ফেলার জন্য । যারা ঠাকুর ভাসান দেবে সেই সব বড় দাদারা , বড় মানে অনেক বড় আমাদের থেকে তারা নেশাগ্রস্ত।অত বুঝতাম না , খালি দেখতাম তাদের কথাবার্তায় তারা বাদে সবাই হাসছে । আচ্ছা নেশাড়ু আর পাগলে খুব তফাৎ নেই না? সিঁদুর খেলা হয় বরন কনকাঞ্জলির (চলতি নামে বলত কোনাকাঁচুলি) পর । বাবুজি দুর্গার কানে কানে বলে দিতো পরের বছর আবার আসে যেন শিবঠাকুরকে লুকিয়ে। বরন করে মা আঁচলে ভাপ  এনে আমাদের মাথায় বুকে ছুঁইয়ে যাচ্ছে , ওদিকে নাচানাচি হচ্ছে । আমার মন খারাপ করছে একটু, ঘুমও পাচ্ছে ।তারপর তো এক, দুগগা মাইকি জয় আর আসছে বছর আবার হবে আর গাছবমার আওয়াজে পরের বছরের অপেক্ষা শুরু।

ছোটবেলার পুজো নিয়ে লিখতে লিখতে কখন ওই সময়টায় ফিরে গেছিলাম, বাড়ি ভরা আত্মীয়, খেলাধুলো হইহুল্লোড়....আনন্দ অকারণ,  দুঃখ গুলো সে সময়ের মাপে খুব বেশী, কিন্তু স্থায়িত্ব কম ছিলো, চড়চাপড় খেয়ে, কিংবা আছাড় খেয়ে কষ্ট হতো বটে বইতে হতো না। পুজোর পর অরিত রন্টিরা ফিরে গেলে কষ্ট হতো খুব, একাদশীর দিন ফাঁকা মন্ডপটা তাকানো যেতোনা স্রেফ কিন্তু তারপর আবার কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যেত। হেমন্তের হাল্কা শীতে মা এর আঁচল এর নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে, উমার( বড় জ্যাঠাইমা) সাথে লুডো অষ্টাকুট (একখান খেলা প্যাঁকাটি দিয়ে) খেলে, শীতকালে মাঠে সর্ষেফুল, শিশির মেখে, কচি অপুষ্ট  মটরশুঁটি চিবিয়ে, সন্ধ্যেবেলা পুরোনো বাড়ির লোডশেডিং এ উমার কাছে গল্প শুনে বা বাবুজির স্টেথেস্কোপ মিছিমিছি কানে গুঁজে। বড় হওয়ায় আক্ষেপ আমার নেই, এমন ছোটবেলা ছিলো বলেই হয়ত, বুড়ো কখনই হবো না বলে হয়ত।

2 comments:

  1. পরের সং্খ্যার অপেক্ষায় রইলাম, আশা করি পরের পুজোর আগে পাব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এহে শেষ করেদিলাম তো আবার পরের সংখ্যা কই আর :D

      Delete