Sunday, September 17, 2017

ঠিকানাহীন চিঠি

একজন এর চিঠির খাতা আমার হাতে এসে পড়েছিলো , চিঠির প্রাপক  প্রেরক আমি না তার খাতা থেকে টুকে দিলাম
*********************************************************************************************************************
চিঠি - এক

নেই সম্পর্কের চিঠির আবার সম্মোধন কি। তাই সোজাসুজি শুরু করলাম কেমন? জানি প্রথম লাইনটা পড়েই ভাববে আহ এতো ঘ্যাম নিয়ে কেউ চিঠি লেখে ইত্যাদি। বুঝলে সমস্যাটা সেখানেই। এই যে না বুঝতে পারার সমস্যা। আচ্ছা উদাহরণ দিই? পেটুক মানুষ খাবারের উদাহরণ টাই হোক নাকি? গুড় আর নারকেলের কম্বিনেশন যে অমন একটা অমৃত টাইপ ব্যাপার হয় সে কি করে বের করা গেছিলো কে জানে কিন্তু ওই পাক দেওয়াটাই আসল বুঝলে। তোমার জগৎ আর আমার জগৎ ভয়ানক ভয়ানক আলাদা। আমার মধ্যবিত্ত বারান্দায় কুমড়োর দানা শুকোতে থাকে, আমার স্টিলের থালায় ভাত, আমার মুড়ির কাঁসি এসব নিয়ে আমি কুঁকড়ে থাকিনা সত্যিই কিন্তু প্রেম যেই বাস্তবে আসে এরা যেন বলে ওঠে আলাদা, ভয়ানক আলাদা, মিলবে না। তুমি সেদিন প্রেম আর ভালোবাসার তফাৎ নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলে। অত আমি বুঝি না বুঝলে, আমার মা আর বাবা রোজ রোজ ঝগড়া করে করে বয়সে এসে এক সাথে বিকেলের চা খাওয়াটা প্রেম না ভালোবাসা আমি জানিনা। এই ধরো গাছের জগৎ আর মাটির জগৎ আলাদা কি করে ওদের প্রথম সংকোচ কাটে কে জানে, আবার মরুভূমির ক্যাকটাসের সাথে কি সুন্দরবনের মাটির মিলবে। তার চেয়ে বরং এই দূরটাই ভালো। গল্প শোনাবো তোমায় মনে মনে রোজ, যে গল্পগুলো সামনে বসে শোনালে নির্ঘাত হাই তুলবে। এই যে ভীড় জ্যামে দাঁড়িয়ে সুমন গাইছে, 'যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা' আর আমি জানলার কাচ টাচ তুলে তোমার সঙ্গে শুনছি এইই ভালো না? না না ভীড় বাসে কোনোরকমে এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়েও 'তবু আজো আমি রাজি, চাপা ঠোঁটে কথা ফোটে' শুনতে শুনতে আমি একা হয়ে যাই। তোমায় বোঝাতে পারবোনা, হেসে উঠবে কিংবা বিরক্ত হবে সব কিছুর অবয়ব না থাকাই ভালো।
বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দেখি মেঘ করে এসেছে, রাস্তা গাছ পালা সব্বাই অপেক্ষা করছে কখন বৃষ্টি নামবে, তারপর সেই হাওয়াটা দিলো জানো। তুমি জানোনা বোধহয় ওই হাওয়াটা, বৃষ্টি আসার আগেই আসবে, বেশী জোরে আসলে আর বৃষ্টি হয়না আবার একদম না এলেও হয়না, ওই প্রেমের আবেগটার মতো। একটু চাল ওচাল হলেই ডুব দেওয়া প্রেম, নইলে নির্ভর বন্ধু।
আর আর... আরো কিছু গোলমাল হলে? পুরো লছমনঝোলা কেস।
কোলকাতা শহরে রাত দেখেছ? উৎসবের রাত না এমনি রাত। বোধহয় দেখোনি, আসলে কোলকাতার রাত গুলো মেল শভিনিস্ট তোমার ভাষায়। ওই সময় রাস্তায় লুঙ্গি বা হাফপ্যান্ট পরে খালি গায় রেডিও শোনে পান বিড়ির দোকানের লোকটা। ফাঁকা রাস্তায় ফোন কানে কোনো সদ্য প্রেমে পড়া ছেলে, আমার মতো ফেক প্রেমিক না, বেশ চোখ মুখ উজ্জ্বল হওয়া কথা বলতে বলতে স্বপ্ন মাখা প্রেমিক। তোমার ভাষায় তো আমি নিজেকে ছাড়া কাউকে কিছুকেই ভালোবাসিনা। না না কথা শোনাচ্ছিনা অ্যাক্সেপ্ট করছি কেবল। বেশী বেশী ইংরাজি শব্দ ঢুকে যাচ্ছে না? আচ্ছা পরের বার খেয়াল রাখবোখন, এবার শোনো যা বলছিলাম। সেই রাতের রাস্তায় দুর্দান্ত ভাবে ছুটে চলা বাইককে খুব ভয়ানক খিস্তি মারে ড্রাইভার সে এমন টাইপ তোমার সামনে সে কথা ভেবে লিখলেও লজ্জা লাগবে। রিক্সাওলা গান চালাতে চালাতে যাবে, হেঁকে হেঁকে আদিরসাত্মক চুটকি বলবে চা ওলা তার বন্ধু কোনো সব্জিওলাকে। হ্যাঁ মাঝ্রাতেও সবজি বিক্রি হয় জানো, কাদের জন্য আমার দেখা হয়নি কখনো। একটাও মেয়ে দেখিনা আমি রাস্তায় সময়, এমনকি বাইকের পিছনেও না। শুধু মেয়েরা দখল করে নেয় এরকম কোনো সময় চব্বিশ ঘন্টার কখনো?
বেশী লম্বা হয়ে গেলো না? ধ্যুত এর চেয়েও বেশী বকবক করি আমি তোমার সাথে।
ভালো থেকো বোলেগা নেহি ন্যাকামো বলবে, ইয়ে একখান উত্তর দেবে নাকি? নীল খাম টাম চাইনা এমনি রুল্টানা খাতার পাতায় লিখলেও পড়ে নেবো।

**********************************************************************************************************************
চিঠি - দুই

**************************
কি করছো বলো দেখি? ব্যস্ত ব্যস্ত? সারাদিন কী এতো ব্যস্ত থাকো বলোতো, খালি নিজেকে ভোলাতে তা জানো? তোমার রান্না করার ছল, নিত্যনতুন সিনেমা সব আমার ভারী চেনা, আমিও ভুলিয়ে রাখি কিনা নিজেকে। হরেকমাল পাঁচটাকায়। মাঝে মাঝে ভয়ানক ডিপ্রেসিভ চিন্তা আসে জানো, এই যে নিজেকে নিত্য নতুন জিনিস দিয়ে ভুলিয়ে রাখি কেন? মানে এই নাম যশ আহার মৈথুন এর কি মানে আছে? কেন করছি এসব দিনগত পাপক্ষয়? আসলে ইমেজের ভয় বোধহয়, লোকে কি বলবে? চাকরিটা দুম করে ছেড়ে দিলে। বাউণ্ডুলে হবার সাহস তো সবার হয়না। ভয় পেওনা, আমি সে ভোঁতা মনখারাপের গর্তে ফের পড়বো না। তোমায় বলা হয়নি না? আমার সব মন খারাপ আমি পাহাড়ের কুয়াশায় গাছের ফাঁকে মিলিয়ে দিয়েছি। আমায় টের পেতে দেয়নি কি করে তারা নিয়ে নিয়েছে কিন্তু নিয়ে নিয়েছে তাই সেই অকারণ বিষাদ আমায় ছুঁতে পারেনা আর জানো?
চিঠি লেখাটাও একটা নেশা বুঝলে, আমার হাজারটা খেলার, নেশার একটা অংশ আর কি। তোমায় লিখি, তুমি পড়ে মুচকি হাসো, ভ্রু কোঁচকাও বা ঘাবড়ে যাও তিনটেই আমি দেখতে পাই। কিন্তু অত চাপ নিও না, আমায় তো চেনো তুমি, দাবী নিয়ে সামনে দাঁড়ানোর মতো চওড়া বুক যে আমার নেই।
ঢাক বাজছে, নীল আকাশে মেঘ গুলো নানান আকার নিচ্ছে, ভগবান মানিনা কিন্তু উৎসব মানি, উৎসব আসছে। অনেক রাত্তিরে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়েছ কখনো? দ্বাদশীর চাঁদে অল্প অল্প করে বইতে থাকা হাওয়া, চাঁদের ছায়া জলে পড়ে, তিরতির করে কাঁপতে থাকে সমুদ্রের জল, বাতাস না ওই চাঁদের আলো কার জন্য কাঁপছে কে বলতে পারে কিন্তু সবটুকু মিলিয়ে বড় ভালো লাগে। তেমনই ঠিক কি জন্য ভালো লাগে জানিনা কিন্তু মাঝে মাঝে সব কিছু বড় ভালো লাগে জানো, ওই যে এক গলা সস্তার মদ খেয়ে নাচতে নাচতে বিশ্বকর্মা পুজো উদযাপন করা লোক গুলো আর চড়া দামে ডান্স ফ্লোর কিনে সেখানে উদ্দাম নাচা তরুণ তরুণী, ভীড় রাস্তায় বিরক্তি নিয়ে বসে থাকা ছেলেটার কাঁধে মেয়েটা মাথা রাখার পর হাসি ফুটে ওঠা ছেলেটা, ফোকলা হাসি নিয়ে ওই বুড়িটা, শোক জরা সব কিছুকে হারিয়ে জীবনকে আলিঙ্গন করা, সব কিছুই বড় ভালো লাগে।
জানো তোমাদের বাড়ির পাশের যে গাছটা আছে, যেখানে সেই পাখিটা এসে বসে মাঝে মাঝে আমার তার সাথেও কথা হয়, গাছেরা অনেক জানে কিন্তু বলে না সে তোমায় বলেছি আগেই ঘ্যানঘেনে প্রেমিক টাইপ চিঠি মনে হচ্ছে নাকি? আসলে এই উৎসবের মরশুমে প্রতিদিনের নতুন করে বেঁচে থাকায় তোমায় খুঁজি জানো, হাত ধরতে চাইনা হাত ছেড়ে দিলে কানা গলিতে ঘুরপাক, বরফ পড়া তীব্র শীতের রাত বড় বেশি তাড়া করবে। আর আমি তো আমায় চিনি, বড় পিচ্ছিল হাত, তুমি পারবে না ধরে রাখতে, বরং ধরার ফলেই হুমড়ি খাবে আরো বেশী। মানুষ তো হাত ধরে ভরসা পেতে যে হাত খালি অনিশ্চয়তা দেবে সে হাত বাড়ানোও তো ঠিক না। তাই ঘাবড়ে যেও না।
যা বলছিলাম, এই যে চারিদিকে এতো জীবন সবই বড় ভালো লাগে মাঝে মাঝে কিন্তু মাঝে মাঝে সব কিছু থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, মাইকের ওই 'ম্যায় তো তন্দুরি মুরগি হুঁ ইয়ার, কাটকালে মুঝে অ্যালকোহোল সে' যেন বড় বেশী সবখানে, এতো কিছু কেন চাইছে লোকে, আমার দমবন্ধ লাগে। পালাতে না পেরে তোমার কাছে যাই, তোমার কাছ থেকে পালাতে পারলে একদিন সব ছেড়েও পালাতে পারবো জানি।
কিন্তু পালাতেই কি চাই, জন যে ঘরে বসত করে কে জানে! এভাবেই পৌঁছে যাবো একদিন হয়তো কোথাও বা একটা নদীর ধারে কিংবা পাহাড়ে পাইন গাছের গোড়ায় সাড়ে তিনহাত জায়গা পেয়ে যাবো।
ভালো থাকো, চিঠিটা শীতকালের ভোরে লেপ ছেড়ে যাওয়ার মতো খারাপ হলো, পরের বার একটা গরমের বিকেলের হাওয়ায় ভরা চিঠি দেবো ঠিক


No comments:

Post a Comment