Monday, June 29, 2020

বাজারে

আমি সাধারণত বারো-পনেরো দিনে একবার বেরোচ্ছি এখন, খুব দরকার কিছু না থাকলে। রবিবারে বেরিয়ে আজ বেরোনো তাই সিলেবাসের বাইরে, কিন্তু করোনাতঙ্কের আগে অব্দি যে কাজ গুলো বাবা করত তা আমায় করতে হলে সপ্তাহের মাঝের দিনেই বেরোতে হয়। নেট আসছে না, তাই অফিস বন্ধ। যদিও বলেই দিয়েছে পরে কাজ করে উসুল করতে হবে। সে যাকগে, পয়সা দেয় কাজ করার জন্যে, ক্যালামিটি হোক যা হোক ওদের কি! 

রাস্তায় বেশ ভালোই লোকজন কিন্তু। লকডাউন কি একেবারেই উঠে গেছে? একেকজন মাঝে মাঝে মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে গুটখার পিকও ফেলে আসছে, অবশ্য রাস্তার মাঝে ফেলেনি এই ভাগ্য! পোস্টাপিসে বিরাট লাইন। নেট নেই, তাই কান খাড়া রেখে নির্লিপ্ত মুখে লোকজনের কথা শুনছি (ভাবতে অয়ারো এ লেখা লিখছি কেমন করে, নেই মানে আসলে মোবাইল নেট যা খুবই অস্থায়ী। ও দিয়ে কানেকশন চালু রেখে কাজ করা যায় না)। এক বয়স্ক মহিলা আগের জন পরের জন হারিয়ে ফেলেছিলেন, এখন আর কেউ তাকে লাইনে ঢুকতে দিচ্ছেনা। কত মিটারের দূরত্ব যেন বজায় রাখা কথা? হাসি পায় মশাই৷ যাকগে পঙ্গপালও এসে পরেছে আর খাবার দাবারও পাবো না, এবার মারামারি শুরু হল বলে। লাইন আর এগোয়ইনা, আমার পিছনের দিক থেকে এক ভদ্রলোক এখন মোদীর কাজকর্মের নিন্দে করছে, লাইন দু পা এগোলো, এবার মমতার।  জানা গেল হিন্দু ঘরের বউদের নাকি রাস্তায় বেরোলে টেনে নিয়ে যাবার অবস্থা হয়ে যাচ্ছিল, বামুংাছির দিকে বিকেল মানেই এত আজান হবে বোঝাই যাবেনা ভারত না পাকিস্থান, বিজেপি ঝড়টা আসায় ভালোই হয়েছে।তর্ক করতে ক্লান্ত লাগে, লাইন আরো একধাপ এগোলো, ভদ্রলোক এখন মেয়েদের নিয়ে পড়েছে। "মেয়েছেলেরাই ঘরে বাইরে যত ঝামেলার কারন"  এই অব্দি পৌঁছে আমি কাজ মেটাতে পেলাম। 

বিস্তর বেলা হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট আবার শুনশান। দোকান হাট খোলা কিছু কিছু এখনো। একজন ভ্যানে করে অনেক তালশাঁস এনেছিল যাবার সময় দেখেছিলাম। ফেরার সময় দেখি কটা পড়ে আছে। আমার আগে একজন দেখি পাঁচ টাকায় পাঁচটা চাইলো! 
-কাটার দাম পোষাবেনা। 

আমি গিয়ে বললাম, আমায় দাও। দাম করার প্রশ্নই নেই, আমি চিনিইনা ভালো, দাম জানিও না।তারপরেই খেয়াল হল, আরে আমি তো খালি কার্ড এনেছি, আমার কাছে তো টাকা নেই কিছু। থমকে গিয়ে বলি, "দাঁড়াও কাকা দাঁড়াও।টাকা তুলে আনি,আমার কাছে টাকা নেই"। 
লোকটা অসন্তুষ্ট হয়না, হাসে আমার ভাব দেখে। বলে, "যাও,তাড়াতাড়ি আসবে, আমি ফিরবো। এটিমে টাকা বেরোয়না। মলিন মুখে এসে বলি, " নাহ কাকা, হল না, আমার কপালে নেই,টাকা বেরোলোনা।" লুঙ্গী আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোকটা হাসতে হাসতে বলে, "নিয়ে যাও নিয়ে যাও, কাল দেবে টাকা"।কিন্তু আমি যে এখন রোজ বেরোচ্ছিনা? 
-বেশ তো পরশু দেবে, যবে দেখা হবে তবে দেবে। 
-তুমি রোজ আসো? কই আমি তো তোমায় দেখিনি আগে। আচ্ছা তুমি তোমার মোবাইল নাম্বারা দাও।
হাসে আবার লোকটা। বলে, "মোবাইল আমি ব্যবহার করিনা তেমন। তুমি যাও তো,  ওকি সরাচ্ছো কেন, সবকটাই ব্যাগে ভরো, আমি সব কটাই তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।
-আচ্ছা আমি বাড়ি এই সামনেই, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। তুমি একটু দাঁড়াও?
- এখন আবার আসতে হবেনা। বলছি তো তুমি যাওনা। অত অবিশ্বাস করলে বাঁচা যায়? 

আহ তাই তো। বেসিক ভুলে যাই বলেই এত অশান্তি তাই না? এত অবিশ্বাস বলেই এত কষ্ট। তাই জন্যেই বুঝি এমন ভর দুপুরেও মুখে হাসিটি অমলিন। কিন্তু আমার যে ধার রয়ে যাবে। কত জনের কাছে এজন্মে ধার বাকি রয়ে গেছে, সেসব ধার তো মেটাবারও না এনার এই যে সাগর সমান বিশ্বাসের ধার এও তো মেটাতে পারবোনা। তাও কড়িকাঞ্চনের ধারটা অন্তত শোধ করে যাই...

-দাম কত?সেটা তো বলো? 
-দাও না যা হোক। 
-আমি যে জানিনা? কত দাম হয়? 
আবার হাসে লোকটা। আচ্ছা কুড়ি টাকা দাও।
-আচ্ছা দাঁড়াও তুমি। আমি এক্ষুনি আসছি হ্যাঁ? চলে যেওনা যেন। চেনা দোকান টোকান কিছু আছে কিনা দেখি। এক্ষুনি আসছি।

 রতনদার সেলুন থেকে কুড়িটাকা ধার করে দিয়ে আসি। মানুষটা তাকিয়েও দেখেনা,ঝোলায় পোরে৷ আটটাখানা তাল আর একবুক বিশ্বাসের আলো নিয়ে আমি পা চালাই....

Saturday, June 20, 2020

করোনা কড়চা(পাঁচ)

মে ১০, ২০২০

কদিন ধরে একটা টিকটিকি সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানে আপিসের কাজ করছি বসে, সড়াৎ করে পাশ দিয়ে খাটের তলা থেকে বুকশেলফের নীচে চলে গেল।দুপুরবেলা পাড়া বেড়াতে সাধ হয়েছে! দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার মাথা কাছ থেকে উঁকি মারছে, তাড়া দিলে ঢুকে যাচ্ছে। কোত্থেকে কী খাচ্ছে কে জানে,  সারা দেওয়াল হেগে ভরাচ্ছে! সন্ধ্যেবেলা প্রেমের তাড়নায় সিলিং বেয়ে প্রেয়সীর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছে টিউবলাইটের পেছনে। ধমক টমক পাত্তা দিচ্ছে৷ না বলে মাথা খাটিয়ে মনে হল, এরা ঠান্ডা রক্তের প্রাণী,  শীত তেমন ভালো লাগবেনা। সুতরাং অস্ত্র বানানো হল, গোলা, ইয়ে বরফের। দিয়ে ঠাঁই ঠাঁই করে ছুঁড়েছি। একটা পড়ল ওর থেকে দু ইঞ্চি দূরে,অল্পের জন্যে মিস। নতুন উদ্যমে ফের ওয়েপন সংগ্রহে গেছি, হাত টাত অবশ প্রায়, বরফ বের করে গোলা বানাতে, তাও যায় যদি যাক প্রান শত্রুর নাম... ইয়ে টিকটিকি৷ ব্যাটা তোর বদামি বের করছি। 

এ ঘরে এসে দেখি মালটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বরফটার দিকে। তারপর যা করলো, দেখে জীবনে ঘেন্না ধরে গেলো মাইরি....

টুপটুপ করে ঝরে পরা জলটা একবার জিব বের করে চেটে দেখলো, দিব্যি ঠান্ডা জল,গরমের দিনে।  তারপর.... তারপর আরাম করে পুরো বরফজলটা চেটে চেটে খেলো মাইরি!!

মে ১৫, ২০২০

এখন মোটামুটি সবই খুলেছে অল্প আধটু করে৷ আজ দিন পনেরো পর বাজারে গেছিলাম। করোনায় আমাদের পরিবারে সব চেয়ে চাপ হয়েছে বাবাই এর। একটা লোক যার সারাদিনের রসদ বাজারে গিয়ে হতো তার দু মাসের উপর বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ হয়ে গেছে। সেদিন বারান্দা থেকে ব্যাগ ঝুলিয়ে আনাজপাতি কেনার সময় কাকে যেন বলছিলো, "ও চিনতে পারছো না যে"।  আমরা হাসাহাসি করি, যেন এ বাবাই এর গ্রামের মতো, দু মাস বাজারে না গেলেও কারোর মনে রাখার দায় থোড়াই আছে এই জনঅরণ্যে! সকাল থেকে বিকেল হাঁকাহাঁকি করে ঝিঙে পটল কেনে, আজ আমি দ্বিগুন দাম দিয়ে টমেটো কিনে এনেছিলাম সেটা দুপুরে আবিষ্কার করে উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসেছিল। আমরা হাসছিলাম কিন্তু বাবাই এর জন্যে খারাপ বাজার করা আর পরীক্ষায় ফেল করা একইরকম খারাপ। বাবাইএর সমস্যাটা আমি বুঝবই না আসলে, ওই হাসাহাসি করাটাই পারি খালি!

 দরকার ব্যপারটা খুবই গোলমেলে সত্যিই। এই যে সেলুন বন্ধ কতদিন, আগামী দিনেও যাবো কি যাবোনার দোলাচলে, সেলুনে সেলুনে যে অ্যাসিস্ট্যান্ট গুলো কাজ করত তাদের কিভাবে চলছে কে জানে! সেলুন আমার জন্যেও দরকারি ছিল সত্যিই, হাবিজাবি গল্প শুনতাম মাথা পেতে দিয়ে। অফিসের কাজ বাড়ি থেকে হয়ে যায় কিন্তু সোমনাথ বা বিশুর সাথে টুকরো টাকরা হাসি,কথা এসবও আমার জরুরী ছিল৷ একটা বুড়ো আমওয়ালা হিমসাগর বিক্রী করছিলো, লকডাউনে আম খাওয়া হয়ত জরুরী না কিন্তু ওর কাছে আম বিক্রী করাটা বেশ জরুরী। আনন্দ আজকেও জোর করছিলো একগাদা মাছ নেবার জন্যে, নিইনি, ব্যাটা আগের দিন পাঁচশো মৌরলা মাছ দিয়ে দিয়েছিল আমি ভালো বুঝিনা বলে। লাল্টুও দিয়ে দিয়েছে একগাদা মাছ, বাড়ি গেলে সবাই ফের বকাবকি করবে। কতদিন পর বেরিয়ে সবার সাথে কথা বলতেও খানিক আরাম লাগে। কবে এই করোনা যাবে কে জানে, হয়ত একে নিয়েই চলতে হবে, আর মানুষের যা স্মৃতি সব ভুলেও যাবে একদিন, তাই লিখে রাখছি,  একদিন ভীড় নিয়ে অতিষ্ঠ হওয়া আমি কেমন অপেক্ষা করেছিলাম ভয়হীন ভীড় ফিরে আসার।মে ১০, ২০২০

কদিন ধরে একটা টিকটিকি সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মানে আপিসের কাজ করছি বসে, সড়াৎ করে পাশ দিয়ে খাটের তলা থেকে বুকশেলফের নীচে চলে গেল।দুপুরবেলা পাড়া বেড়াতে সাধ হয়েছে! দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার মাথা কাছ থেকে উঁকি মারছে, তাড়া দিলে ঢুকে যাচ্ছে। কোত্থেকে কী খাচ্ছে কে জানে,  সারা দেওয়াল হেগে ভরাচ্ছে! সন্ধ্যেবেলা প্রেমের তাড়নায় সিলিং বেয়ে প্রেয়সীর সাথে মিলিত হতে যাচ্ছে টিউবলাইটের পেছনে। ধমক টমক পাত্তা দিচ্ছে৷ না বলে মাথা খাটিয়ে মনে হল, এরা ঠান্ডা রক্তের প্রাণী,  শীত তেমন ভালো লাগবেনা। সুতরাং অস্ত্র বানানো হল, গোলা, ইয়ে বরফের। দিয়ে ঠাঁই ঠাঁই করে ছুঁড়েছি। একটা পড়ল ওর থেকে দু ইঞ্চি দূরে,অল্পের জন্যে মিস। নতুন উদ্যমে ফের ওয়েপন সংগ্রহে গেছি, হাত টাত অবশ প্রায়, বরফ বের করে গোলা বানাতে, তাও যায় যদি যাক প্রান শত্রুর নাম... ইয়ে টিকটিকি৷ ব্যাটা তোর বদামি বের করছি। 

এ ঘরে এসে দেখি মালটা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বরফটার দিকে। তারপর যা করলো, দেখে জীবনে ঘেন্না ধরে গেলো মাইরি....

টুপটুপ করে ঝরে পরা জলটা একবার জিব বের করে চেটে দেখলো, দিব্যি ঠান্ডা জল,গরমের দিনে।  তারপর.... তারপর আরাম করে পুরো বরফজলটা চেটে চেটে খেলো মাইরি!!

মে ১৫, ২০২০

এখন মোটামুটি সবই খুলেছে অল্প আধটু করে৷ আজ দিন পনেরো পর বাজারে গেছিলাম। করোনায় আমাদের পরিবারে সব চেয়ে চাপ হয়েছে বাবাই এর। একটা লোক যার সারাদিনের রসদ বাজারে গিয়ে হতো তার দু মাসের উপর বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ হয়ে গেছে। সেদিন বারান্দা থেকে ব্যাগ ঝুলিয়ে আনাজপাতি কেনার সময় কাকে যেন বলছিলো, "ও চিনতে পারছো না যে"।  আমরা হাসাহাসি করি, যেন এ বাবাই এর গ্রামের মতো, দু মাস বাজারে না গেলেও কারোর মনে রাখার দায় থোড়াই আছে এই জনঅরণ্যে! সকাল থেকে বিকেল হাঁকাহাঁকি করে ঝিঙে পটল কেনে, আজ আমি দ্বিগুন দাম দিয়ে টমেটো কিনে এনেছিলাম সেটা দুপুরে আবিষ্কার করে উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসেছিল। আমরা হাসছিলাম কিন্তু বাবাই এর জন্যে খারাপ বাজার করা আর পরীক্ষায় ফেল করা একইরকম খারাপ। বাবাইএর সমস্যাটা আমি বুঝবই না আসলে, ওই হাসাহাসি করাটাই পারি খালি!

 দরকার ব্যপারটা খুবই গোলমেলে সত্যিই। এই যে সেলুন বন্ধ কতদিন, আগামী দিনেও যাবো কি যাবোনার দোলাচলে, সেলুনে সেলুনে যে অ্যাসিস্ট্যান্ট গুলো কাজ করত তাদের কিভাবে চলছে কে জানে! সেলুন আমার জন্যেও দরকারি ছিল সত্যিই, হাবিজাবি গল্প শুনতাম মাথা পেতে দিয়ে। অফিসের কাজ বাড়ি থেকে হয়ে যায় কিন্তু সোমনাথ বা বিশুর সাথে টুকরো টাকরা হাসি,কথা এসবও আমার জরুরী ছিল৷ একটা বুড়ো আমওয়ালা হিমসাগর বিক্রী করছিলো, লকডাউনে আম খাওয়া হয়ত জরুরী না কিন্তু ওর কাছে আম বিক্রী করাটা বেশ জরুরী। আনন্দ আজকেও জোর করছিলো একগাদা মাছ নেবার জন্যে, নিইনি, ব্যাটা আগের দিন পাঁচশো মৌরলা মাছ দিয়ে দিয়েছিল আমি ভালো বুঝিনা বলে। লাল্টুও দিয়ে দিয়েছে একগাদা মাছ, বাড়ি গেলে সবাই ফের বকাবকি করবে। কতদিন পর বেরিয়ে সবার সাথে কথা বলতেও খানিক আরাম লাগে। কবে এই করোনা যাবে কে জানে, হয়ত একে নিয়েই চলতে হবে, আর মানুষের যা স্মৃতি সব ভুলেও যাবে একদিন, তাই লিখে রাখছি,  একদিন ভীড় নিয়ে অতিষ্ঠ হওয়া আমি কেমন অপেক্ষা করেছিলাম ভয়হীন ভীড় ফিরে আসার।

Thursday, June 18, 2020

করোনা কড়চা (চার)

এপ্রিল ১৬,  ২০২০

 আমাদের টিমটা চমৎকার ছিল।অফিসের লাস্ট প্রজেক্টের। আড্ডা, তামাশা, দল বেঁধে খেতে যাওয়া,এ ওর ঘাড় ভাঙা, রাত জেগে কাজ দারুন ছন্দ। দুম করে করোনা এলো, লকডাউন শুরু হল।আমরা কম্পিউটার নিয়ে এসে বাড়ি থেকে কাজ শুরু করলাম,  করোনার কাউন্ট করলাম, ভয় পাওয়া শুরু করলাম, গৃহবন্দী জীবনের সুবিধে অসুবিধে ভাবলাম সব করলাম খালি রোজের জীবনের অংশ টীমটা ভেঙে গেলো। কাল এক জুনিয়র ফোন করেছিল, "দাদা তোমাদেরো কি রিলিজ করছে? তোমাদের টিমেই থাকার কোনো উপায় নেই? যদি কিছুদিন লিভ উইদাউট পে করেও থাকা যায়"।  সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছে এরা, পাসিং ক্লাউড শব্দবন্ধ বোঝেনা ওরা, তাই এরকম আবেগের কথা বলে। আমার দশ বছর আগের প্রথম টিমটা মনে পড়ে যাচ্ছিলো, ওদের আর কারোর সাথে এই দশ বছরে আর একটাও প্রজেক্ট করা হয়নি, আমরা এক বয়সী পাঁচ ছ যারা শুরু করেছিলাম,তাদের একজন খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে, বাকিরা কেউ অফিস বদলেছে কেউ শহর কেউ বা বিল্ডিং৷ মন খারাপ করা একেবারেই উচিত না, কিন্তু আমার মন খারাপ হয়, আমি ওই ছানা গুলোর কষ্টটা টের পাই, যদিও জানি আমাদের নিজেদেরই কারোর কোনো ঠিক নেই....

সেদিন দেবাশিষদা বলছিলেন একদিন দেখা করব কিনা করোনা মিটলে, নাকি করোনার পর কাটিয়ে দেবো, সব্যর সাথে জঙ্গলের মধ্যে সেই হোটেলটায় যেখানে মাঝ রাতে জন্তু জানোয়ার এসে গাছে আওয়াজ করে যায়....কতজনের সাথে দেখা হবে বলে দেখা হয়নি, আমারই দোষে, আমিই করিনি,  এবার ভাবছি পেন্ডিং কিছু আর রাখবো না, অন্তত না রাখারই চেষ্টা করব, লাস্ট টিমটার একসাথে একটা না হওয়া পিকনিকের মতো যদি আর না হয় কখনো। জানি সব কিছু হয়ও না, যা ভাবি, তাও কিছু তো হাতে থাকেই....

এপ্রিল ১৮, ২০২০

বাংলা সিঅাইডি হিন্দিটার মতই অসাধারণ। 

অভিজিৎ- এই যে গলাকাটা লাশ এ যে দীপকের এটা বোঝা যাবে কি করে?

এসিপি প্রদ্যুমন - এটা দীপকের লাশ তা এখনো বোঝা যায়নি। ❤

এপ্রিল ২, ২০২০

কাল খানিক বেরোতে হয়েছিল। এক মাস স্টার্ট দিইনি গাড়িতে, বেচারি বিরহে শুকিয়ে যায় পাছে অদর্শনে, লং ডিস্ট্যান্সের ভরসা আমি করিনা, তাই খানিকক্ষন তাকে চার্জ আপ করা গেলো।  আহ সে  প্রেমিক প্রেমিকার গোপন কথা, ও কথা থাক,  বেরিয়েছিলাম দুপুরে,  যাতে বাজারের ভীড়টা তা সে যতটুকুই হোক, এড়ানো যায়। আমাদের বাড়ি থেকে গ্যারাজটা একটু দূরে, রাস্তায় আধভাঙা বাড়ি, একটাও জনপ্রানী নেই। সেই ছোটবেলায় রূপকথার গল্পে পড়ার মতো, দুম করে যে যেখানে যেভাবে ছিল পাথর হয়ে গেল,  সেইরকম। কতদিন পর দোকানে যাওয়া বাদে চেনা কোনো গলিতে ঢুকে ভারী আরাম লাগছিল, বুড়ির বাড়ির আমগাছটায় খুব আম এসেছে, হলুদ বাড়িটার বারান্দা থেকে গোলাপী ফুলের থোকা ঝুলছে। কবে সব ঠিক হবে আবার বেড়াতে যাব কে জানে! 

সন্ধ্যেবেলা ঝড় এলো আগে লম্বা লম্বা পায়ে, দুটো প্ল্যাকার্ড ওড়ালো, ডাস্টবিনটা ফেললো, জানলা দরজা ধাক্কা দিলো অস্থির বালকের মতো, ধমকে চমকে দিলো বিদ্যুৎ এএ ঝলক। তারপর  ফোঁটা ফোঁটায় এলো বৃষ্টি, সাড়া পাড়া অন্ধকার, একটা দুটো এমার্জেন্সি গাড়ির সামনে দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো তুরতুর করে নেচে নিচ্ছে, ওই ঘর থেকে মা হাঁক দিচ্ছে যাতে না ভিজি....

এরকম কোনো বৈশাখী ঝড়জলের রাতে কোলকাতার রাস্তায় চুপচুপে ভিজেছি, কিংবা তুমুল গাড়ি চালিয়েছি কালকে রাতেরটা বেশ অন্যরকম বুঝলে,কেমন অন্ধকার পাড়া, যেন বেশ কিছু বছরের পুরোনো সময়।আচ্ছা বৃষ্টি ঝড়ের  অতি বৃদ্ধ দাদু ঠাকুর্দার কোনো লিখিত ইতিহাস আছে কি? ওদের ভাষায়, যে ভাষা আমরা বুঝি না। মানুষের মত বোকা না নিশ্চয়ই ওরা, খালি রাজা বাদশাহ দের কথাই লিখবে। কেমন করে প্রথম ভাতের গন্ধের সাথে ঘি এর গন্ধ মিশেছিল, কেমন করে  গরু ছাগলের সাথে মানুষের ভাব হয়েছিল, আকাশে সাথে ভালোবাসার কথা, নদীর জলের সাথে নুড়ির বিরহের কথা... এদের ইতিহাসে ঠিক থাকবেই।  খালি হিটলার, চেঙ্গিজ খাঁ, লড়াই বিদ্রোহর কথা না খুঁজে কিছু এমনি ফুল ফোটার গল্প শোনা যাবে বেশ সেই ভাষা বুঝতে পারলেই....ব্যাস তখনই সৃষ্টি রহস্যও জেনে যাব গাছেদের থেকে।

কবে যে হবে এসব....

এপ্রিল ২৬,  ২০২০

ধরুন একটা পুচকে দ্বীপ, হাতে গোনা কটা থাকার জায়গা। উত্তর দিক থেকে পশ্চিমে হেঁটে যাচ্ছেন, যেতে যেতে একটা গাছ দেখে তার ছায়ায় বসলেন। একটু দূরে একটা নৌকা বাঁধা আছে, আর কেউ কোথাও নেই, একটাও ময়লা পড়ে নেই, ধপধপে বালিতে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েও পড়লেন। তারপর ঘুম ভাঙলো, স্থানীয় ফলওয়ালির ডাকে। সে মাথার ঝাঁকা থেকে নাম না জানা অচেনা ফল এগিয়ে দেয়, ইশারায় ভেঙে খেতে বলে। হাসি বিনিময়ে ভালোমন্দ বোঝা হয়ে যায়। বাকি ভাষা বাহুল্য বোধ হয়। তারপর ফের খানিক এগিয়ে যান, যেতে যেতে সমুদ্রের তীরে ছোট্ট একটা দোকানের পেতে রাখা আসনে, জমিয়ে বসে পানীয় নেন কোনো পছন্দের, সামনে তখন সেদিনকার মতো শাট ডাউন করে সমুদ্রের সাথে ডেটে চলেছে সূর্য।

এসবই যেন একশো বছর আগে হয়েছিল....কবে যে আবার এরকম একটা সুর্যাস্তের ছবি ধরে হেঁটে যাব কে জানে! ততদিন পুরোনো ছবিই সঙ্গী হোক....

Sunday, June 7, 2020

করনা কড়চা (তিন)

এপ্রিল ৭,  ২০২০

 আসলে মানুষ যা তা হল আশ্বাস। তা হয়ত বেসলেস তাও কেউ একজন আছে এই বোধটাই ভয়ানক সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশে বুড়োদের বানপ্রস্থে এবং তারপর সন্ন্যাস নেবার কথা চালু ছিল, আজকাল মনে হয় সে প্রথা ফের ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে। ফস করে  পোস্টঅফিসের সব সঞ্চয়ের সুদের হার কমে গেল, মাস গেলে আরো  হাজার টাকা কম পাবে হাতে। দেশের উন্নতির সময় তাদের বলেছিল, এটা দরকার, সংকটের সময়েও বলছে এটা দরকার।বাংলা কথা হল বুড়ো হয়েছ অতয়েব ফোটো, তুমি যা দিয়েছ তোমার যৌবনে  তার জন্য আমার অত কৃতজ্ঞতা নেই যে বাকি জীবন তোমার কথা আমি ভাববো। যদিও অবাক ব্যপার দেশের নেতারা সবাই বুড়ো। আমি অর্থনীতির ছাত্র না, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম, তাই আমি ভালো বুঝিনা এ দরকার। তবে ওই যে বলছিলাম না, খুব দরকার মানুষের একটা আশ্বাস,  কেউ না কেউ আছে, মসীহা হয়ে বা ভগবান হয়ে বা ভরসা হয়ে? ওই জন্যেই মনে হয় আমাদের দেশের গরীব বুড়ো গুলো বেঁচে যায় কোনোমতে, ভাবে দেশের সরকার হয়ত দেখবে বা তার ছেলে মেয়ে আত্মীয় পরিজন হয়ত দেখবে।  এই দেখো না, বাড়ির নীচে একটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে এক গাদা মাস্ক ঝুলিয়ে বিক্রী করতে এসেছে, করোনা নিবারক মাস্ক। লোকে সে মাস্ক হাত দিয়ে দেখছে, রঙ পছন্দ করছে, নাকে বেঁধে দেখে নিচ্ছে ঠিক মতো না লাগলে রেখে দিয়ে আরেকটা তুলছে। 
 ৬.৬% ইন্টারেস্ট রেট কিংবা অদেখা ভাইরাস এদের এই ভরসার দেখে অবাক হয় কিনা জানিনা।

এপ্রিল ১১,  ২০২০

 দুপুরবেলাটা নিঝুম হয়ে যায় একদম। একদম মানে একদমই, একটাও কাক অব্দি নেই চৈত্রের দুপুরে। বিকেল বেলা হলেই মোড়ের মাথায় সিমেন্টের স্ল্যাবে দুজন লোক এসে বসবে, রাত নটা সাড়ে নটা অব্দি থাকে৷ আমি বারান্দা থেকে দেখি,  বিকেল হলেই কিছু লোক এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে দুধের দোকানের সামনে, গলির মুখে, চুপিচুপি একটা পুচকে চায়ের দোকান খোলে....প্রথম প্রথম রাগ হত ভারী, এত করে সবাই বলছে শুনতে পারে না একটু, বেরোনোর কি দরকার টা কি৷ তারপর দেখলাম, আমার না হয় চিলতে বারান্দা আছে, সেখানে দাঁড়াতে পারি হাঁফ ধরে গেলে, আমি না হয় ভার্চুয়াল জগতে আড্ডা মেরে বেড়াতে পারি ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফাঁকে কিন্তু যে লোকটা একটা ঘরে চার পাঁচজনে থাকে তাকে সারাদিন অদৃশ্য কিছুর ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা সোজা না। 
কাল অনেক রাতে "পঞ্চায়েত" দেখে বারান্দায় গেছিলাম। পঞ্চায়েতটা দেখলে বেশ তৃপ্তি হয়,  লড়াই টড়াই নেই,শহুরে স্মার্টনেস নেই হয়ত ডিকোড করে শত্রু মারা নেই হয়ত কিন্তু বেশ একটা মাটির গন্ধ আছে। রাতেও পাড়াটা একদম নিঝুম হয়ে যায়। কাল অবাক ব্যপার দেখছিলাম। আমাদের পাড়ায় দশটা পনেরোটা তাগড়া তাগড়া কুকুর আছে। মাংসওলা ওদের ছাঁট দেয় রোজ, সাড়ে এগারোটা বারোটার সময় তারস্বরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। ঝাঁট ফাট জ্বলে যাবার মতো, ইচ্ছে করে মাংসওয়ালার বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসতে। কাল তারা ফর আ চেঞ্জ ঘুমোচ্ছিলো, একটাও ভোঁ গ্রুম গ্রুম করে চলে যাওয়া বাইকও নেই, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে চাঁদের আলো পড়েছে, সমস্ত পাড়ায় একটা বা দুটো বাড়িতে আলো জ্বলছে তখন। হুট করে দেখি একটা ফিঙে দোল খাচ্ছে তারেতে। এই মাঝরাতে কি করিস রে ব্যাটা! এটা তো তোর সময় না। নাকি তুইও ওয়েব সিরিজ দেখে ফুরফুরে হাওয়ায় দোল খেতে বেরিয়েছিস? 

এ বড় সাংঘাতিক দোলাচল,  বেশীদিন এই অবস্থা চললে রিসেশনের কবলে মরে যাব যদি বা করোনায় বাঁচি। অথচ এটাও তো ঠিক আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব চেয়েছি বলেই এই অবস্থা, প্রকৃতি এখন ভালো আছে অনেক, আর । এই দিনকাল তো আমাদের দেখতেই হতনা যদি প্রথম থেকেই কেউ রোগ না লুকিয়ে ঘুরতো, নামাজে না গিয়ে ঘরে, মলে বা পার্টিতে না গিয়ে বাড়িতে কিংবা শুরুতেই এয়ারপোর্ট বা বন্দরে ফোর্স কোয়ারেন্টাইন করত যদি....যদি আমরা আরেকটু সহমর্মিতা দেখাতাম...

তপতীদি,  ভারতীতিদি প্রায়ই ফোন করে, ওদের উৎকন্ঠাটা বুঝি, যতই অভয় দিই, বসে বসে মাইনে পাবে এটা বুঝি ওদের হজম করতে ভরসা হয়না, ওদিকে ফিঙেটা রোজ রাত হলেই আরাম করে দোল খেতে আসছে। ল্যাম্বরগিনি, যুদ্ধবিমান আর লোডশেডিং এ ভাত রান্নার মাঝে কোনো একটা মঝঝিম পন্থা থাকার দরকার ছিলো খুব.....

এপ্রিল ১৪,  ২০২০

আমার পয়লা বৈশাখ মানে মিষ্টির বাক্স,বন্ধুদের সাথে আড্ডা, প্যারামাউন্টে সরবত খেয়ে বই বাজারে ঢুঁ.....। কোনোবার নেহাতই অফিস যেতে হলেও উৎসবের সুরটা থাকেই। এবারে এই মহামারী  আমাদের নতুন বছরের শুরুর রুটিন্টা ঘেঁটে দিয়েছে। এমনিতেই বেচারি পয়লা বৈশাখ ছাড়া বাকি দিনগুলো ন্যালাক্ষেপার মতো পড়ে থাকে তাতে এটাও গেল। কাল এক বন্ধুকে বলছিলাম কাক গুলো কমে গেছে কেমন দেখেছিস। সে জীবনানন্দ পড়তে দিচ্ছিলো, কবিতা আমি খুবই ভয় পাইবতায় সিলেবাসে থাকা, তাই আঁতকে উঠে বললাম, ক এ ক এ মিল আছে বলে কবিদের কাক বলতে চাস? সে আবার বিদুষী রমনী, কবিদের নিয়ে এসব বাজে কথা বলার পরেও বেঁচে আছি নেহাত লকডাউন চলছে বলেই। যাই হোক সে বলল, মহামারীতে কাকেরা মানুষদের ছেড়ে যায়। 

নতুন বছরে কাকেরা ফিরে আসুক, বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারে না সামনে বসে আড্ডা হোক, সবার জীবন থেকে এই আতঙ্ক মুছুক, ভালো হোক সবার।