Monday, June 29, 2020

বাজারে

আমি সাধারণত বারো-পনেরো দিনে একবার বেরোচ্ছি এখন, খুব দরকার কিছু না থাকলে। রবিবারে বেরিয়ে আজ বেরোনো তাই সিলেবাসের বাইরে, কিন্তু করোনাতঙ্কের আগে অব্দি যে কাজ গুলো বাবা করত তা আমায় করতে হলে সপ্তাহের মাঝের দিনেই বেরোতে হয়। নেট আসছে না, তাই অফিস বন্ধ। যদিও বলেই দিয়েছে পরে কাজ করে উসুল করতে হবে। সে যাকগে, পয়সা দেয় কাজ করার জন্যে, ক্যালামিটি হোক যা হোক ওদের কি! 

রাস্তায় বেশ ভালোই লোকজন কিন্তু। লকডাউন কি একেবারেই উঠে গেছে? একেকজন মাঝে মাঝে মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে গুটখার পিকও ফেলে আসছে, অবশ্য রাস্তার মাঝে ফেলেনি এই ভাগ্য! পোস্টাপিসে বিরাট লাইন। নেট নেই, তাই কান খাড়া রেখে নির্লিপ্ত মুখে লোকজনের কথা শুনছি (ভাবতে অয়ারো এ লেখা লিখছি কেমন করে, নেই মানে আসলে মোবাইল নেট যা খুবই অস্থায়ী। ও দিয়ে কানেকশন চালু রেখে কাজ করা যায় না)। এক বয়স্ক মহিলা আগের জন পরের জন হারিয়ে ফেলেছিলেন, এখন আর কেউ তাকে লাইনে ঢুকতে দিচ্ছেনা। কত মিটারের দূরত্ব যেন বজায় রাখা কথা? হাসি পায় মশাই৷ যাকগে পঙ্গপালও এসে পরেছে আর খাবার দাবারও পাবো না, এবার মারামারি শুরু হল বলে। লাইন আর এগোয়ইনা, আমার পিছনের দিক থেকে এক ভদ্রলোক এখন মোদীর কাজকর্মের নিন্দে করছে, লাইন দু পা এগোলো, এবার মমতার।  জানা গেল হিন্দু ঘরের বউদের নাকি রাস্তায় বেরোলে টেনে নিয়ে যাবার অবস্থা হয়ে যাচ্ছিল, বামুংাছির দিকে বিকেল মানেই এত আজান হবে বোঝাই যাবেনা ভারত না পাকিস্থান, বিজেপি ঝড়টা আসায় ভালোই হয়েছে।তর্ক করতে ক্লান্ত লাগে, লাইন আরো একধাপ এগোলো, ভদ্রলোক এখন মেয়েদের নিয়ে পড়েছে। "মেয়েছেলেরাই ঘরে বাইরে যত ঝামেলার কারন"  এই অব্দি পৌঁছে আমি কাজ মেটাতে পেলাম। 

বিস্তর বেলা হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট আবার শুনশান। দোকান হাট খোলা কিছু কিছু এখনো। একজন ভ্যানে করে অনেক তালশাঁস এনেছিল যাবার সময় দেখেছিলাম। ফেরার সময় দেখি কটা পড়ে আছে। আমার আগে একজন দেখি পাঁচ টাকায় পাঁচটা চাইলো! 
-কাটার দাম পোষাবেনা। 

আমি গিয়ে বললাম, আমায় দাও। দাম করার প্রশ্নই নেই, আমি চিনিইনা ভালো, দাম জানিও না।তারপরেই খেয়াল হল, আরে আমি তো খালি কার্ড এনেছি, আমার কাছে তো টাকা নেই কিছু। থমকে গিয়ে বলি, "দাঁড়াও কাকা দাঁড়াও।টাকা তুলে আনি,আমার কাছে টাকা নেই"। 
লোকটা অসন্তুষ্ট হয়না, হাসে আমার ভাব দেখে। বলে, "যাও,তাড়াতাড়ি আসবে, আমি ফিরবো। এটিমে টাকা বেরোয়না। মলিন মুখে এসে বলি, " নাহ কাকা, হল না, আমার কপালে নেই,টাকা বেরোলোনা।" লুঙ্গী আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোকটা হাসতে হাসতে বলে, "নিয়ে যাও নিয়ে যাও, কাল দেবে টাকা"।কিন্তু আমি যে এখন রোজ বেরোচ্ছিনা? 
-বেশ তো পরশু দেবে, যবে দেখা হবে তবে দেবে। 
-তুমি রোজ আসো? কই আমি তো তোমায় দেখিনি আগে। আচ্ছা তুমি তোমার মোবাইল নাম্বারা দাও।
হাসে আবার লোকটা। বলে, "মোবাইল আমি ব্যবহার করিনা তেমন। তুমি যাও তো,  ওকি সরাচ্ছো কেন, সবকটাই ব্যাগে ভরো, আমি সব কটাই তোমার জন্য রেখে দিয়েছি।
-আচ্ছা আমি বাড়ি এই সামনেই, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি। তুমি একটু দাঁড়াও?
- এখন আবার আসতে হবেনা। বলছি তো তুমি যাওনা। অত অবিশ্বাস করলে বাঁচা যায়? 

আহ তাই তো। বেসিক ভুলে যাই বলেই এত অশান্তি তাই না? এত অবিশ্বাস বলেই এত কষ্ট। তাই জন্যেই বুঝি এমন ভর দুপুরেও মুখে হাসিটি অমলিন। কিন্তু আমার যে ধার রয়ে যাবে। কত জনের কাছে এজন্মে ধার বাকি রয়ে গেছে, সেসব ধার তো মেটাবারও না এনার এই যে সাগর সমান বিশ্বাসের ধার এও তো মেটাতে পারবোনা। তাও কড়িকাঞ্চনের ধারটা অন্তত শোধ করে যাই...

-দাম কত?সেটা তো বলো? 
-দাও না যা হোক। 
-আমি যে জানিনা? কত দাম হয়? 
আবার হাসে লোকটা। আচ্ছা কুড়ি টাকা দাও।
-আচ্ছা দাঁড়াও তুমি। আমি এক্ষুনি আসছি হ্যাঁ? চলে যেওনা যেন। চেনা দোকান টোকান কিছু আছে কিনা দেখি। এক্ষুনি আসছি।

 রতনদার সেলুন থেকে কুড়িটাকা ধার করে দিয়ে আসি। মানুষটা তাকিয়েও দেখেনা,ঝোলায় পোরে৷ আটটাখানা তাল আর একবুক বিশ্বাসের আলো নিয়ে আমি পা চালাই....

4 comments:

  1. আমিও যেমন আছি, এঁরাও আছেন। এইটুকুই যা ভরসা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী যে বলো কুন্তলাদি , অবিশ্বাস করলে আমার লেখাটাও বিশ্বাস করতে নাকি ।

      Delete