Sunday, June 7, 2020

করনা কড়চা (তিন)

এপ্রিল ৭,  ২০২০

 আসলে মানুষ যা তা হল আশ্বাস। তা হয়ত বেসলেস তাও কেউ একজন আছে এই বোধটাই ভয়ানক সাপোর্ট হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশে বুড়োদের বানপ্রস্থে এবং তারপর সন্ন্যাস নেবার কথা চালু ছিল, আজকাল মনে হয় সে প্রথা ফের ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে। ফস করে  পোস্টঅফিসের সব সঞ্চয়ের সুদের হার কমে গেল, মাস গেলে আরো  হাজার টাকা কম পাবে হাতে। দেশের উন্নতির সময় তাদের বলেছিল, এটা দরকার, সংকটের সময়েও বলছে এটা দরকার।বাংলা কথা হল বুড়ো হয়েছ অতয়েব ফোটো, তুমি যা দিয়েছ তোমার যৌবনে  তার জন্য আমার অত কৃতজ্ঞতা নেই যে বাকি জীবন তোমার কথা আমি ভাববো। যদিও অবাক ব্যপার দেশের নেতারা সবাই বুড়ো। আমি অর্থনীতির ছাত্র না, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম, তাই আমি ভালো বুঝিনা এ দরকার। তবে ওই যে বলছিলাম না, খুব দরকার মানুষের একটা আশ্বাস,  কেউ না কেউ আছে, মসীহা হয়ে বা ভগবান হয়ে বা ভরসা হয়ে? ওই জন্যেই মনে হয় আমাদের দেশের গরীব বুড়ো গুলো বেঁচে যায় কোনোমতে, ভাবে দেশের সরকার হয়ত দেখবে বা তার ছেলে মেয়ে আত্মীয় পরিজন হয়ত দেখবে।  এই দেখো না, বাড়ির নীচে একটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে এক গাদা মাস্ক ঝুলিয়ে বিক্রী করতে এসেছে, করোনা নিবারক মাস্ক। লোকে সে মাস্ক হাত দিয়ে দেখছে, রঙ পছন্দ করছে, নাকে বেঁধে দেখে নিচ্ছে ঠিক মতো না লাগলে রেখে দিয়ে আরেকটা তুলছে। 
 ৬.৬% ইন্টারেস্ট রেট কিংবা অদেখা ভাইরাস এদের এই ভরসার দেখে অবাক হয় কিনা জানিনা।

এপ্রিল ১১,  ২০২০

 দুপুরবেলাটা নিঝুম হয়ে যায় একদম। একদম মানে একদমই, একটাও কাক অব্দি নেই চৈত্রের দুপুরে। বিকেল বেলা হলেই মোড়ের মাথায় সিমেন্টের স্ল্যাবে দুজন লোক এসে বসবে, রাত নটা সাড়ে নটা অব্দি থাকে৷ আমি বারান্দা থেকে দেখি,  বিকেল হলেই কিছু লোক এমনিই দাঁড়িয়ে থাকে দুধের দোকানের সামনে, গলির মুখে, চুপিচুপি একটা পুচকে চায়ের দোকান খোলে....প্রথম প্রথম রাগ হত ভারী, এত করে সবাই বলছে শুনতে পারে না একটু, বেরোনোর কি দরকার টা কি৷ তারপর দেখলাম, আমার না হয় চিলতে বারান্দা আছে, সেখানে দাঁড়াতে পারি হাঁফ ধরে গেলে, আমি না হয় ভার্চুয়াল জগতে আড্ডা মেরে বেড়াতে পারি ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ফাঁকে কিন্তু যে লোকটা একটা ঘরে চার পাঁচজনে থাকে তাকে সারাদিন অদৃশ্য কিছুর ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা সোজা না। 
কাল অনেক রাতে "পঞ্চায়েত" দেখে বারান্দায় গেছিলাম। পঞ্চায়েতটা দেখলে বেশ তৃপ্তি হয়,  লড়াই টড়াই নেই,শহুরে স্মার্টনেস নেই হয়ত ডিকোড করে শত্রু মারা নেই হয়ত কিন্তু বেশ একটা মাটির গন্ধ আছে। রাতেও পাড়াটা একদম নিঝুম হয়ে যায়। কাল অবাক ব্যপার দেখছিলাম। আমাদের পাড়ায় দশটা পনেরোটা তাগড়া তাগড়া কুকুর আছে। মাংসওলা ওদের ছাঁট দেয় রোজ, সাড়ে এগারোটা বারোটার সময় তারস্বরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। ঝাঁট ফাট জ্বলে যাবার মতো, ইচ্ছে করে মাংসওয়ালার বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসতে। কাল তারা ফর আ চেঞ্জ ঘুমোচ্ছিলো, একটাও ভোঁ গ্রুম গ্রুম করে চলে যাওয়া বাইকও নেই, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে চাঁদের আলো পড়েছে, সমস্ত পাড়ায় একটা বা দুটো বাড়িতে আলো জ্বলছে তখন। হুট করে দেখি একটা ফিঙে দোল খাচ্ছে তারেতে। এই মাঝরাতে কি করিস রে ব্যাটা! এটা তো তোর সময় না। নাকি তুইও ওয়েব সিরিজ দেখে ফুরফুরে হাওয়ায় দোল খেতে বেরিয়েছিস? 

এ বড় সাংঘাতিক দোলাচল,  বেশীদিন এই অবস্থা চললে রিসেশনের কবলে মরে যাব যদি বা করোনায় বাঁচি। অথচ এটাও তো ঠিক আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব চেয়েছি বলেই এই অবস্থা, প্রকৃতি এখন ভালো আছে অনেক, আর । এই দিনকাল তো আমাদের দেখতেই হতনা যদি প্রথম থেকেই কেউ রোগ না লুকিয়ে ঘুরতো, নামাজে না গিয়ে ঘরে, মলে বা পার্টিতে না গিয়ে বাড়িতে কিংবা শুরুতেই এয়ারপোর্ট বা বন্দরে ফোর্স কোয়ারেন্টাইন করত যদি....যদি আমরা আরেকটু সহমর্মিতা দেখাতাম...

তপতীদি,  ভারতীতিদি প্রায়ই ফোন করে, ওদের উৎকন্ঠাটা বুঝি, যতই অভয় দিই, বসে বসে মাইনে পাবে এটা বুঝি ওদের হজম করতে ভরসা হয়না, ওদিকে ফিঙেটা রোজ রাত হলেই আরাম করে দোল খেতে আসছে। ল্যাম্বরগিনি, যুদ্ধবিমান আর লোডশেডিং এ ভাত রান্নার মাঝে কোনো একটা মঝঝিম পন্থা থাকার দরকার ছিলো খুব.....

এপ্রিল ১৪,  ২০২০

আমার পয়লা বৈশাখ মানে মিষ্টির বাক্স,বন্ধুদের সাথে আড্ডা, প্যারামাউন্টে সরবত খেয়ে বই বাজারে ঢুঁ.....। কোনোবার নেহাতই অফিস যেতে হলেও উৎসবের সুরটা থাকেই। এবারে এই মহামারী  আমাদের নতুন বছরের শুরুর রুটিন্টা ঘেঁটে দিয়েছে। এমনিতেই বেচারি পয়লা বৈশাখ ছাড়া বাকি দিনগুলো ন্যালাক্ষেপার মতো পড়ে থাকে তাতে এটাও গেল। কাল এক বন্ধুকে বলছিলাম কাক গুলো কমে গেছে কেমন দেখেছিস। সে জীবনানন্দ পড়তে দিচ্ছিলো, কবিতা আমি খুবই ভয় পাইবতায় সিলেবাসে থাকা, তাই আঁতকে উঠে বললাম, ক এ ক এ মিল আছে বলে কবিদের কাক বলতে চাস? সে আবার বিদুষী রমনী, কবিদের নিয়ে এসব বাজে কথা বলার পরেও বেঁচে আছি নেহাত লকডাউন চলছে বলেই। যাই হোক সে বলল, মহামারীতে কাকেরা মানুষদের ছেড়ে যায়। 

নতুন বছরে কাকেরা ফিরে আসুক, বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারে না সামনে বসে আড্ডা হোক, সবার জীবন থেকে এই আতঙ্ক মুছুক, ভালো হোক সবার।

No comments:

Post a Comment