Sunday, August 4, 2019

লালচাঁদের বন্ধু

ফ্রেন্ডশিপ ডে তে একটা গল্প রইল বন্ধুদের জন্যে

********************


সে অনেকদিন আগের কথা না। এখনকারই কথা।  একটা বাতিল হওয়া মোবাইলের গল্প। বাতিল তো হয়ে গেছিল, কারন সে তেমন নতুন মডেলের না।  সে টুজি মোবাইল, নেটের স্পীড কম স্বাভাবিক তাকে দিয়ে আর হবে না। আমরা ভাবি বটে মোবাইলের আবার আলাদা করে প্রাণ কি। জড় পদার্থের প্রাণ নেই এতো ছোটবেলার স্কুল বইতেই থাকে! কিন্তু সে সবের বাইরে বেরোলেই দেখা যায় এই যে আমাদের চারপাশে বই, জিনস, গেঞ্জি, কফিমগ, মোবাইল এ সব কিছুর প্রাণ আছে। আমাদের র‍্যাডারে ধরা পড়ে না। সে এক অন্য দুনিয়া। আমি জানলাম কেমন করে? র‍্যাডারের কিছু গন্ডগোল হয়ে থাকবে, অন্য ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে ফেলেছিল।

তো সেবার সেই বাতিল মোবাইল,  ধরা যাক তার নাম লালচাঁদ। লালচাঁদ  তো মনের দুঃখে ধূলো মেখে শুয়েছিল পুরোনো বাতিল জিনিস রাখার তাকে। সে আর কি করে,  সুস্থ সবল মোবাইল স্রেফ নতুন জিনিস পারেনা বলে তাকে কেউ আর পাত্তা দিচ্ছে না, নতুন মোবাইলদের থেকে শুনতে পারে সে কত কিছু। কত রকম খবর, কত আশ্চর্য দৃশ্য সবই দেখে, নিজেদের মধ্যে গোপনে আদান প্রদানও হয় নানান রকম জিনিসের। লালচাঁদ শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হয়ে গেল। এরকম ভাবে হয়না। সে যখন কাজে যেত, সে দেখেছিল পূর্নিমার চাঁদে হিমালয়ের চূড়ো, সে দেখেছিল বর্ষায় উথালপাথাল  নদী, ঝরনা, জোয়ারের উচ্ছ্বাসে থাকা সমুদ্র, সে ভেবেছিল একদিন সামনাসামনি দেখবে এসব কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল দেখো!  এত সব শখ অপূর্ণ রেখেই মরে যাবে নাকি একদিন ওই সাদা মোবাইল ক্যানুর মত? 

সুতরাং লালচাঁদ একদিন রাতে গুটগুট করে বারান্দায় এলো।  নিঝুম রাত। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে খানিক আগেই। রাস্তায় আলো গুলো গম্ভীর মুখে পাহারা দিচ্ছে। ওরা খুব একটা আলাপী না, কথাও বলেনা নিজেদের মধ্যে। দু চারটে গাছ মাথা ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে মাঝে মাঝে,  জল ঝাড়াও হচ্ছে গানের তালও হচ্ছে। গাছেরা দিব্যি আছে বাপু, ভাবে লালচাঁদ, মারো কাটো পাত্তাও দেবেনা। নিজেদের মত করে বাঁচবে, জ্ঞান নেবে কিন্তু অযথা দিতে যাবেনা, আশ্রয় দেবে, আর বর্ষার রাতে সবাই ঘুমোলে জলসা বসিয়ে দেবে গানের, আড্ডার। লালচাঁদ ভাবে, সে একটা চেষ্টা করবেই করবে। হয়ত মরে যাবে, সে এখনও তো মরেই আছে প্রায়। 

"আরে আরে করো কি, ঝাঁপ দেবে নাকি!"

চমকে তাকায় লালচাঁদ, এত রাতে কে! ঝিম ধরা রাস্তা শুয়ে আছে খালি। ঘরের ভিতর মানুষগুলো ঘুমোচ্ছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ইলেকট্রিক তারে বসে ঝিমোনো একটা কাক।  ডানা ঝাপটে তাকেই বলছে। লালচাঁদ গম্ভীর মুখে বলে,  'দেখি কি করি। তুমি এসময় জেগে?' 

-আর বাপু বোলোনা। মানুষগুলোর জ্বালায় নিশ্চিন্দি ঘুম কি আর আছে হে। সারা রাত গাড়ি চলে, আর কুকুরগুলোর কাজ তো জানোই হাউমাউ করে চেঁচানো আর সারা পাড়া মাত করা। ঘুমের আর থাকে কি! 

- হুঁ সে সত্যি বটে। আমি যখন কাজ করতাম, মানুষগুলোর হয়ে, তখন তো নেটের এত বেশী রমরমা ছিল না, তাতেই মাঝে মাঝে রাতে কাজ করতে হত আমায়। আর এখন তো দেখি, যারা কাজ করে তাদের রাত দিন বলে কিছু নেই। চব্বিশঘন্টায় দশ এগারো ঘন্টা খালি বিশ্রাম। তা তারা সব ইয়ং জেনারেশন মোবাইল, স্মার্ট, ক্যারিয়ারিস্টিক, তারা ভাবছে তাদের ছাড়া মানুষ বুঝি অচল। তারা গেলে অন্য কিছু আসতে একদিন লাগবে মানুষের আর এই এক্সট্রা খেটে আসলে তাদেরই শক্তিক্ষয়, জীবনক্ষয় হচ্ছে সে আর বোঝে না। যাক,  বেশী বলব না এ নিয়ে ভাববে হিংসে করে বলছি। হাজার হোক আমি তো বেকার অচল। 

- আরে তুমি দেখি বেজায় মুষড়ে পড়েছ। একথা ঠিক তোমার কথাগুলো অসফলের অজুহাত ভাববে সবাই, তাই না বলে ভালো করেছ কিন্তু তাই বলেই তুমি বেকার অচল হবে কেন? দেখো দেখি কেমন চমৎকার গান ধরেছে ওই কোনার নিমগাছ, কেমন ঝিম ধরা রাত দেখো এসব মনের মধ্যে অনুভব করতে পারছ যখন অচল হবে কেন তুমি?

- আরে ভায়া ওইটেই তো কথা। আমি দুনিয়া দেখতে চাই। কাজের সময় কত দেখেছি ছবি, এবার নিজের চোখে সামনে থেকে দেখতে চাই। আমি আকাশের নীল ঘুড়ির সাথে উড়তে তো পারব না কিন্তু খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সেই ঘুড়ির লড়াই দেখতে চাই, ঝরণার জলে চান করতে পারব না কিন্তু বর্ষায় কেমন ঝপাং করে পড়ে একরাশ জল, নদীতে তাই দেখতে চাই। সেটাই ভাবছিলাম তো এখানে দাঁড়িয়ে, যে যাব কিভাবে।

- ওহ এই কথা! শোনো ভায়া আমার নিজেরও আর ভালো লাগে না এখানে। এত নোংরা খুঁজে খাবার জোগাড় করতে করতে কেমন যেন ওইটাই আমার পরিচয় হয়ে গেছে, কিন্তু আমি তো পাখি বলো। আমি উড়াল দিতে চাই, ঘাসের ফাঁকে পোকা ধরতে চাই, গরুর পিঠে বসে খুনসুটি করতে চাই। আমিও ভাবছিলাম পালাবো বুঝলে।

- তোমার তো সুবিধে,  তুমি উড়ে চলে যেতে পারবে যেখান খুশি। আমার তো তেমন সুবিধে নেই, তাই ভাবছিলাম কেমন করে যাই।

- না বাপু অত সোজাও না যত ভাবছ। আমাদের সমাজ আছে না, তারা অন্যরকম হওয়া পছন্দ করে না। আমায় পকলাতে হবে। জানি পালাবার পর ছিছিক্কার পড়ে যাবে। তাছাড়া টান অনেক কিছুর হে, কাটানো মুশকিল হয়।

-তা মিথ্যে বলব না আমারও কি মনে হচ্ছে না কাজ কাম না করে বেশ আছি তো। শুধু শুধু চাপ নিয়ে আর লাভ কি! তবে ওই আর কদিন বাঁচবোকে জানে, যদ্দিন পারি ঘুরেই নিই।  যা হবে দেখা যাবে।

- তবে চলো।

-  অ্যাঁ তুমিও যাবে বুঝি?  কিন্তু তুমি তো উড়েই চলে যাবে।  আমি যাব কেমন করে? 

- শোনো এক কাজ করি, সেদিন একটা মালা মত জোগাড় করেছিলাম। ওটা তোমার জামায় আটকে দিই, তারপর গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ব।

- সে তো খুবই ভালো প্রস্তাব আমার জন্যে,  কিন্তু তোমার বড় কষ্ট হবে।  তুমি এতটা পথ বইবে আমায়.....

- আরে এত ভাবলে চলে? থামবো না হয় একবারের জায়গায় দুবার। আমাদের তাড়া কি? আর শোনো বন্ধুদের জন্যে এটুকু তো করাই যায় নাকি? তুমি আমায় গান শুনিয়ো, গল্প বোলো ওড়ার কষ্ট দূর হয়ে যাবে।

- আহা বড় আনন্দ পেলাম রে ভাই। তোমার নাম কি? আমি লালচাঁদ।

- আমি?  সে একটা কিছু ছিল ছোটবেলায়, এখন আমি খালি এপম্লয়ি নাম্বার ৩৫৭১৮৬৩।

- অ্যাঁ সে আবার কি?

- সে আছে,  পরে বলব খন। ওসব বাদ দাও।  ধরে নাও আমার নাম লালচাঁদের বন্ধু।

- সে তো বটেই।  তবে আমি কি নিজেকে বলব লালচাঁদের বন্ধুর বন্ধু?  

- হাহাহা আচ্ছা বেশ  আমার নাম দিলাম পলানে। পালাচ্ছি কিনা? কি বলো অ্যাঁ? এবার চলো নইলে ভোর হয়ে যাবে সব চৌপাট হবে।

- হ্যাঁ হ্যাঁ আর শোনো না আমার জন্যে মালাটালা নিতে হবে না। আমার চার্জারটা আছে না ওটার দুমুখ আমার জামায় কায়দা করে আটকে দাও তো। মাঝে মাঝে খাবার দরকার হবে, খুব কম কিন্তু হবে।

- সে আর বেশী কথা কি। এসব আমি পারি ভালো। 

তারপর তারা দুজন পালালো। অদ্ভুত অসম দুই বন্ধু, একটা কাক, তেমন দক্ষ না কাজে, আর একটা মোবাইল যে আজকের দিনে প্রায় অচল, এবং অপদার্থ।  তারা একটু যায় অনেক বিশ্রাম নেই। চলতে চলতে কত লোকের বারান্দা, ঘর, কত পাহাড়, নদী ঝরনা দেখলো। কত লড়াই দেখে মুচকি হাসলো। কতবার রাগারাগি হল নিজেদের মধ্যে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ হল না। কারন ওরা জানতো বন্ধু ছাড়া এমন দুনিয়া দেখা তাদের হত না,  কিংবা আনন্দও হত না হয় একা একা দেখে। 

মাঝে মাঝে হুট করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখতে পেতেও পারো একটা কাক আর তার গলায় একটা মোবাইল  ঝুলিয়ে চলেছে।