Tuesday, July 19, 2022

পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা(৪)

গরম কমার মুখে ঠিক হল এদিককার ছোট আর ভাঙাচোরা বাড়ি ছেড়ে ওইদিকের বড় ভালো বাড়িতে যাবো। যাবো যাবো করছিলাম অনেকদিন ধরেই,  নানান টালবাহানায় আটকে ছিল। যাবো ঠিক হতেই যেন আরো মায়া পড়ে যায় এই ঘর খানাতেই৷ বিকেলের পড়ন্ত সূর্য,  নিস্তব্ধ দুপুরে আসা কাঠবিড়ালি সবাই এসে জমা হয় পকেটে।সেদিন হল কি, যে কুকুরটা মাছের  কাঁটাকুটি,মাংসের হাড়গোড় খায় সে যথারীতি এসেছে।এদিকে আমাদের সেদিন তরমুজ দিয়ে লাঞ্চ হয়েছে। সে অবশিষ্টাংটা ওকে ছুঁড়ে দিয়ে দেখছিলাম খায় কিনা। ও বাবা তাকালো,  "এ তুমি কী দিলে!" বললাম আজ নেই যা পালা, তাতেও তাকিয়ে, "কিছুই কি নেই" ভাব।
শেষে দুটো বিস্কুট দেওয়া হল। একটা খেয়ে তাকাচ্ছে, "এটাই দিলে হত আগে, তা আর একটু হবে নাকি?"
হেংলু কাঠবিড়ালিটার নাম দেওয়া হয়েছে টংলু। তিনি সকালে এসেছিলেন দেখে চাট্টি মুড়ি দিয়েছি, ও বাবা সে কী ভয়! তুড়তুড় করে পালালো। মুড়ি এলোমেলো হয়ে গেল তাও এলো না। যেই ময়ূরাক্ষী কলেজে বেরিয়েছে, অমনি আবার এসেছে।কুড়কুড় করে খাচ্ছে। ঘরেতেও চলে আসছে দিব্যি।  
এখানে দিন শুরু হয় খুব সকালে। আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য যে লোক ঠিক করেছি তারা সাতসকালেই হাজির! সমস্ত মোটামুটি গুছিয়ে নেবার পর চারপাশ তাকিয়ে আনন্দই হল।এদিকটাও বেশ গাছপালায় ঘেরা।নিম, শিমূল, বট। কিন্তু টংলু? তার তো বেশ মুড়ির নেশা হয়েছিল, সে এখনো ঘুরে ঘুরে খুঁজে চলেছে নাকি? 

কোকিল, বুলবুলি, কাঠঠোকরা, দোয়েল, পায়রা ওদিকেও ছিল, এদিকে এর সাথে কাক, ছাতারেদের ভীড় আছে দেখছি। সকালবেলা থেকে হরেক পাখির আওয়াজে ঘুম ভাঙে। কোকিল গুলোর বর্ষা যেন শুরুই হয়না। একেকদিন হনুমানের দল আসে৷ ছানা কোলে মা হনুমান লাফাতে না পারলে গোদাটা এসে সাহায্য করবে কিনা জানতে চেয়ে পাশে বসে। তার ভারে গাছের ডাল ভেঙে যায়, মা হনুমান ছানাটাকে নিয়ে লাফ মেরে অন্য গাছে যায়। ও বাড়িতে থাকতে একটা বুলবুলি সকাল বেলা আমাদের চা খাবার সময় বারান্দার তারে এসে বসতো, সেদিন দেখি এ বাড়ির বারান্দাতেও এসে বসে ডেকে চলে গেল। কি জানি খোঁজ নিতেই এসেছিল কিনা৷ আমার কাজের টেবিলের ওপাশে জানলা দিয়ে দেখা যায়, নিম গাছের ডালের দাঁড়কাক,কিংবা কার্নিশে বসা ছাতারের ঝগড়াঝাটি৷ কাঠবিড়ালি গুলোও খুব খেলে তুড়তুড় করে৷ তাদের ভয় একটু কমেছে, আমাদের কার্নিশে এসে মুড়ি খেয়ে যায়। 



লেখালেখি আজকাল আর করা হয়না তেমন,কাজ,পড়াশোনা আর গল্পে সময় কেটে যায়। একেকদিন সকাল সকাল বাজারে যাই। স্টেশনের মাছওয়ালাকে বললেই দিয়ে যায়, তাও যাই কখনো। পথ ভুলে এলোমেলো হয়, কেমন সব পুরোনো পুরোনো বাড়ি।সকাল সকাল কচুরির দোকানে ভীড়। রোয়াকে বসে সকাল সকাল খেয়ে কাজ বেরোনো লোকজনের সাথে আমিও বসে জিলিপি খাই৷ ড্রামের জল আলগোছে গলায় ঢালে তারা আমার শৌখিন মজদুরি ওখানেই থেমে যায়। দেখতে দেখতে রথ চলে এলো। গ্রামের দিকের মেলার আলাদা একটা ধরন থাকে, আমাদের গ্রামের বাড়ির ওখানে শীতে ভীমমেলা হত। এক সপ্তাহ ধরে, সে কি আনন্দ আমাদের তখন। সে সময়, আনন্দের উপকরন বাক্সবন্দী এত থাকতো না তাই এই সব মেলার অপেক্ষা আলাদাই ছিল।  সারারাত ধরে যাত্রা হত, আর এমনি মেলার হরেক মজা, নাগরদোলা, বন্দুক, আদ হাত লম্বা রঙীন জিভেগজা।  এ জায়গাটা গ্রাম না হলেও ছোট গঞ্জ বটে। এখানেও সপ্তাহব্যাপী রথের মেলা হয়৷ একদিন গেছিলাম, রথের মেলায় যা যা থাকে,  ফুলের গাছ, জিলিপি, পাশকুঁড়ার চপ, হরেক রোল চাউমিনের দোকান। গৃহস্থালির জিনিসের  দোকানে ভীড়, মাইকে সতর্কবার্তা,  সব পেরিয়ে একটা কম আলো পৌঁছনো জায়গায় এখানকার ভূমীজ এক বুড়ি বসে আছে তার পসরা নিয়ে। ছোট ছোট অ্যালুমিনিয়ামের বাসন, কী হয় ওগুলো দিয়ে কে জানে!
মথুরা কেক, রথের মেলায় 

একদিন পূর্নিমায় ছাদে গিয়ে দেখি চাঁদ উঠলো এই বড় একটা। শ্রাবন মাসের চাঁদ, নিম গাছের মাথায় উঠে চারদিন সাদা করে আলো দিচ্ছিলো। সে আলো গায়ে মেখে গাছগুলো খুব রসস্থ হয়েছে। আরো রাতে পরীরা নেমে আসবে আমি জানি, সে সময় গাছেদের সাথে পরীদের কথা হয়, মানুষদের করা সব বোকামো, সব বজ্জাতি, সব ভালো সপাটে উড়িয়ে দেয়,,পাত্তাও পায়না মানুষে সেখানে। সেই আলো সেই হাওয়া গায়ে লেগে গেলে মানুষ হালকা হয়ে যায়। তার শিকড় ছড়িয়ে যায় অনেএএক দূর। ছোট খাটো না পাওয়া কিংবা পাওয়ার বাইরে দুহাত বাড়িয়ে চাঁদ ছুঁয়ে দেয়।