Sunday, October 9, 2022

পুজোয়

হনহন করে হাঁটছিলাম, একটু আগে চড়কতলা পেরিয়ে এসেছি। একটা মুদির দোকানে সস্তার কিছু জিনিস, অল্প ভীড় পেরিয়ে বাঁয়ে ঢুকতেই বাগদি পাড়া। এখানে   বাগদি পাড়া, কুমোর পাড়া,  বাউন পাড়া,  মুসলমান পাড়া,এসব বিস্তর আছে। বাগদি পাড়াটা গরীব মানুষের বাস বোঝাই যায়। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা ওরকম কিছুতে তৈরী হওয়া সংকীর্ণ জায়গায় পলেস্তরা ছাড়া বাড়ি, দু বাড়ির মাঝের সরু রাস্তায় বেঁধে রাখা ছাগল।আজ নবমী। নবমী মানেই সবাই দল বেঁধে স্রেফ ঠাকুর মন্ডপে বসে থাকে বা আড্ডা দিয়ে কাটায় এই কল্পনাটাও শহুরে মধ্যবিত্তের। একটা লোক ঘর ছাইছে, গরুকে খেতে দিচ্ছে একজন। বাগদিপাড়ার পর আবার রাস্তা নেই, মাঠ আর মজা পুকুর৷ মালিক পাড়া মাঠ উন্নয়ন প্রকল্প বলে একটা বোর্ড টাঙানো। লোকজন তেমন নেই, মজা পুকুরেই একটা বউ বাসন মাজছিল, বাঁশবাগানের নীচ দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিল। বৃষ্টি হয়েছে কালকেও,রাস্তা ঘাট কাদা। কোথায় যাচ্ছি কে জানে!  অনেক দূর থেকে মাইকে মন্ত্রের আওয়াজ ভেসে আসছে,নবমীর হোমেরর মন্ত্র। মাঠে এখন ধানগাছের চারা, সবুজে সবুজ হয়ে আছে। একটা দুটো ক্ষেতে, পটল বেগুন হয়েছে। বেড়া আর জাল দিয়ে ঘেরা সেগুলো। খানিক বাদে আর যাবার রাস্তা নেই, মানে আছে হয়ত,মাঠ দিয়ে দিয়ে, সে আলপথ জলে কাদায় আমি চিনতেও পারবো না। 

আবার অন্য রাস্তা নিই একটু পিছিয়ে। চলতে গেলে এই যে নতুন রাস্তা দেখা হয় কিছু রাস্তা ভুল হয় কিছু রাস্তা ঠিক, এ বড় মজার। এর স্বাদ একবার পেলে না চলে থাকা যায়না। এবারে একটা ভালো রাস্তায় পরেছি, এ জায়গাটার নাম খ্যামপুর। আজব নামটা! শ্যামপুরের অপভ্রংশ কি? একজন আমায় দেখে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি, আমি নিজেও কি আর জানি কোথায় যাচ্ছি! সে আমায় বাড়ির দিক দেখালো, আমি তো বাড়ি যাবো না, কোথায় যাবো সেও বলতে পারছিনা, এই হেঁটে আসি একটু বলে কোনোরকমে এগিয়ে যাই। 

কালভার্ট পেরিয়ে বাঁয়ে খাল রেখে এগোচ্ছি। আচ্ছা আশ্বিন মাসে ধানের চারা আরেকটু বড় হবার কথা না? কার্তিকেই তো ধান পাকে নাকি? জীবনানন্দের কবিতায় কার্তিকে ধানের কথা ছিল না? কবিতা অবশ্য পড়িইনি কিছু তেমন। কিই বা করেছি, কবিতা বুঝতে পারি না, রাগ রাগিনী চিনিনা, গাছ, পাখি,  পোকা ফুল, শস্য কিচ্ছু চিনিনা। প্রকৃতিকে স্রেফ হিংস্রে থাবায় ধরেছি, তার কোন তারে কোন সুর কিছুই ধরতে পারিনি। জোর করে সম্ভোগে যে সুখ থাকেনা ছোটবেলা থেকে মানব জীবনের মূল পাঠ হওয়া বড় দরকার ছিল। ভালোবেসে জয় করতে শিখলে অনেক দুর্দশা ঘুচে যেত!

চলতে চলতে আবার একটা কোন পাড়ায় ঢুকেছি। যদিও রাস্তা চওড়া এখান৷  আমাদের এক চাষীর সাথে দেখা, নারকেল গাছের পাতা কাটছিল ছেলের সাথে মিলে। পাশেই তার ঘরে তার বউটি রান্না করছে। দূরে শীতলাতলা থেকে খুব ঢাকের আওয়াজ আসছে। এর নাম কী যেন? কাশী না? আমি ভালো চিনিনা, ও  চেনে খুব। ' বাড়ি এসবেনে দাদা, বসে জল টুক খেয়ে যাও।' আমি কারো বাড়ি যেতে ভারী অস্বস্তি বোধ করি। গরীব বড়লোক, আত্মীয়, বন্ধু ব্যপার না, আমার ভারী সংকোচ হয়। তাই কোনো মতে সে ডাক সরিয়ে এগোই। আসার আগে, ' আসবেনে এখন তাহলে?  ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছ বুঝি, তাহলে সামনের শীতলাতলায় খুব বড় পুজো হয় দেখে এসোগে যাও", বলে আগিয়ে দিলো খানিক।

শীতলাতলার পুজোর ঢাকের আওয়াজ, থেমে থেমে পড়া মন্ত্রের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম খুব। খুব সেজে গুজে একটা ছোট্ট নেয়ে চলেছে আমার সামনে সামনে। একটা ছোট ছেলেও সাইকেল বাগিয়ে চলেছে ওইদিকেই। পিছন থেকে তার মায়ের ডাক ভেসে আসছে, "দেবুউউ কোথায় যাচ্ছিস খেয়ে যা আগে"। পথের ধারে টিউবওয়েলে ন্যাংটা খোকা চান করছে, দু চারজন বাঁশের মাচায় বসে তাস খেলছে। ঠাকুরপুজো ডাঁয়ে রেখে ফের এগোই। আবার ভুল করে মাঠের মধ্যে খানে এসে পড়েছি, আল পথে পা টিপে টিপে এগোচ্ছি, গ্যাঙোর গ্যাঙোর করে ব্যাঙ ডাকছি ধান জমি থেকে, এখানে কোনো মন্ত্র আওয়াজ কিচ্ছু নেই, স্রেফ, ঝিঁঝিঁ্র আওয়াজ আর ব্যাঙের ডাক। দিনেরবেলা ঝিঁঝিঁ শুনলে ভারী অবাক মতো লাগে না? এইবার রাস্তাটা চেনা,  একটা পুকুরের পৈঠায় এক বুড়ো একা একা বসে, এর উৎসব নেই। ভীমতলায় কুমারী পুজোর পর তাকে নিয়ে বেরিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটা খুব সেজেগুজে অস্বস্তি আর অবাক ভাব নিয়ে বসে আছে ভ্যানে, পিছনে পিছনে একগাদা মেয়ে আর বাচ্ছা নেচে-কুঁদে চলেছে। পরিচিত পুরোনো হিন্দি গানের সুর বাজাচ্ছে একটা লোক আরেকটা ভ্যানে। 


নবমীর বিকেলে খবর পেলাম এক বৌদি মারা গেছে। লড়াই চলছিলই, কষ্ট লাঘব হল আর কি। ব্যাস অশৌচ শুরু হয়ে গেল আমাদের। সে অর্থে শোক তো আমায় বা আমাদের ছোঁয়নি। তাহলে এ অশৌচের মানেই বা কি! আমি মানিনা, মানছিও না আলাদা কথা কিন্তু লোকে যুক্তি দিয়ে ভাবে না কেন একবারও? অবশ্য ঢাক বাজিয়ে পুজো করা, উল্লাস করা দৃষ্টিকটু হত, কিন্তু প্রেতকে পিন্ড দেওয়া হয় বলে একদিন তিল কলা খাওয়া যাবে না এর মানে কি! আমি প্রেত হলে যে আমায় অমন পিন্ড দেবে তাকে ঠাস করে চড় মেরে বলব ইয়ার্কি মারা জায়গা পাস না হতভাগা! ডেকে এনে তিল, কলা দিচ্ছিস!! তাছাড়া প্রেত বলা মানেই মৃতকে অসম্মান করা হয় না?! প্রেত হয়ে তিল কলার লোভে ঘুরছে কেউ এ কেমন কথা! 


পাশের ক্লাবের  ছেলেদের ডেকে ভাসান দেওয়া হলেও, দুঃখটা একই রকম লাগে। প্রতিমার মুখটা আস্তে আস্তে ডুবে যায় জলে,  আর অকারণ মনখারাপ এসে থাবা মারে। ফাঁকা মন্ডপে একা একা আমষট্ বসে বসে পাহারা দেয়, অপেক্ষা করে কি?

বিজয়ার শুভেচ্ছা রইলো। ভালো হোক,শুভ হোক। মিষ্টি  খেয়ে জিভ এলিয়ে গেলে, জল খেয়ে ফের মিষ্টি খাওয়া হোক।