Wednesday, November 28, 2018

পথে পথে

একদম অন্ধকার হবার পর পরেই চাঁদ ওঠে না, একটা দুটো তারা ঘুম ভেঙে আড়মোড়া মেলে। টর্চ আছে পকেটে, কিন্তু অন্ধকার গায়ে মেখে হাঁটতে দিব্যি লাগছে। শীত পড়তে শুরু করেছে, বাংলায় এটা কোন সময়? অঘ্রাণ না? হাড় কাঁপানো ঠান্ডা কিছু না, তবে ঠান্ডা আছে। সাপের ভয় নেই, আর মহারাজদের চোর ডাকাতের ভয় থাকার কথাও না, তবে আর টর্চ কী হবে!

হনহন করে হাঁটছিলাম, যেখানে আছি সেই আলো শেষ হলেই অন্ধকার ঘুটঘুটে। অন্ধকারটা চোখে সইলেই আর ঘুটঘুটে থাকেনা, আকাশে একটা আলো থাকেই। সেই আলোতে গাছপালা গুলো বড় অন্যরকম লাগে, বাঁ পাশে একটা জলা, সকালেই দেখেছিলাম। ডান পাশে কী কে জানে! খানিক হেঁটে দেখি একটা পাড়ায় পৌঁছে গেছি। ডান বাম দুদিকে রাস্তা, একদিক ধরে এগোচ্ছি হনহন করে, টুকরো টাকরা কথা কানে আসছে, হিন্দি না, বাংলাই, ডায়ালেক্ট অন্য। সীমান্তবর্তী এই জায়গার লোকগুলো এখনো শহুরে ধুলোয় ঢাকা পড়েনি। তেষ্টা পেয়েছে বেশ, ও কাকা টিউবওয়েল আছে কাছাকাছি?

হুই উদিকে বাঁয়ে আছে, বেসসি না দু কদম দূরে। হুঁ। জল খেয়ে একটু এগিয়েছি, এদিকটা বাড়িগুলোর পিছন দিক, গরু দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে, একটা মুদির দোকান টিমটিমে আলো জ্বলা, সেখানে শাকপাতা থেকে চিপ্স সবই মেলে। মুদির দোকান পেরোলেই একটা মাঠ, মাঠের ওপাশে গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লাল চাঁদ উঠছে তখন। এরপর আস্তে আস্তে সাদা হবে, মাথার উপর উঠবে।

হাতে বেলুন নিয়ে লোকজন ফিরছে, এদের আজ রাস মেলা আছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে দেখি, মেলা না ঠিক, রাস মন্দিরকে ঘিরে কিছু মাটির মূর্তি বানিয়েছে, অল্প স্বল্প আলো দিয়ে সাজিয়েছে, বাচ্ছা, মেয়ে, পুরুষ সব হামলে পড়ে তাইই দেখছে আনন্দ করে৷ মন্দিরে সংকীর্তন চলছে, খোল করতাল বাজিয়ে, ইস্কনের মন্দিরের মত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে না। আমার ভক্তি নেই, ঘুরে ঘুরে আলগোছে দেখছি। এহে মোবাইলটা আছে বটে কিন্তু ওয়ালেট তো নাই, কিছুই খেতে পাবো না তো তাহলে! ঠিক আছে এমনিতেও কিছু নেই মনে হয়। ওই দিকে কিসের জটলা হচ্ছে? উঁকি মেরে দেখতে গিয়েই হাতে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে পায়েস ধরিয়ে দিলো। চারিদিকে অজস্র খালি কাপ পড়ে আছে এই জন্যেই বুঝি?

পায়েসের কাপ নিয়ে মুশকিলে পড়লাম। আমি খেতে ভালোবাসি, কিন্তু আমি তো হিমু কিংবা নীললোহিত না, ঋকানন্দের সারাদিন না খেলেও চলে কিন্তু ভালোবাসার খাবার খারাপ স্বাদের আমার সয় না। আমার অনেক কিছুই সয় না, সে আলাদা কথা কিন্তু এই পায়েস নিয়ে এখন আমি কী করি? অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গরীব মানুষেরা পায়েস যেটা বানায় সে বেশ খারাপ হয়। চাল সেদ্ধ করে পরে দুধ মেশায়। তাও মুখে দিয়ে দেখলাম, হুঁ, খারাপ। এবার? ফেলে দিলেই হয় কিন্তু এতো লোক আহ্লাদ করে করে আগ্রহ নিয়ে যা খাচ্ছে তা ছুঁড়ে ফেলতে পারি এমন জোরও নেই।

আরো খানিক এদিক সেদিক ঘুরে, দেখি একটা কুকুর। যাক একেবারে ফেলা গেলো না। ভীড়টা পেরিয়ে ফিরতি পথ ধরেছি। বাঁধানো রাস্তাটা পার হলেই একা গাছটা দিয়ে চাঁদের আলো নেমেছে। পূর্ণিমার আলোয় জায়গাটা ঝকঝক করছে। খানিকটা গেলেই নদী। শীতকালের নদী, পাথর বেশী জল কম। কিচ্ছু না থাকলেও যেমন জীবন আবার দুহাত ভরা থাকলেও জীবন;তেমনই জল থাকলেও নদী কম থাকলেও নদী...জল একেবারে শুকিয়ে না গেলেই হলো। অবশ্য মরা নদী অত খারাপ না যতটা নোংরায় খাল হয়ে যাওয়া নদী খারাপ।

কুয়াশা নেমেছে রাত বাড়তে, সাদা নদীর চর, এক পৃথিবী চাঁদের আলো। আশেপাশের গাছ গুলো সতর্ক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে, একটু পরেই পরী নামবে এখানে। সে পরীদের সাথে দেখা হলে মুশকিল, আর ঘোর কাটবে না, ঘুরে ঘুরে মরতে হবে সারা জীবন। কোত্থাও তিষ্ঠানো যাবে না। পরীদের ধরে ফেললে আরো মুশকিল, ধরলেই তারা মানুষ হয়ে একশো হাজার বছর আটকে যাবে। না আমি পরী ধরতে চাইনা, এমন মায়াময় রাতে, নদীর ধারে বন পাহাড়ের উপর যার থাকার কথা, টিউবলাইটের আলোয় ল্যাপটপ দেখবে সে এ আমি ভাবতে পারিনা। আমার হাত ঝলসে যাবে আমার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।

চাঁদের আলোয় নেশা হয়, ঝিম ধরা নেশা, এইরকম খোলা প্রান্তে, নদীর ধারে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের আওয়াজে, গাছেদের চোখের দৃষ্টিতে সে নেশা বড় তীব্র হয়। মনে হয় সব ফেলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাই। আর ফেরার কী দরকার....

কিন্তু আমার সে জীবনও সইবে না আমি জানি, আমায় ফিরে ফিরে আসতে হবে আবার যেতে হবে.....

Tuesday, November 20, 2018

একদিন বেলায়

এদিকটা কেউ আসেনা। ভাঙা জিনিসপত্র পড়ে থেকে থেকে ঘাস বেড়ে উঠেছে এলোমেলো। কদম গাছের ডালে একটা পাখি বাসা বেধেছে, পার্থেনিয়ামের ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ছে দিব্যি। আচ্ছা প্রজাপতিদের শ্বাসকষ্ট হয়না, এলার্জি হয়না? এই হলুদ প্রজাপতি গুলোর টাইগার প্রিন্ট ছাপ, লাল সুতোর বিড়ি না কি যেন নাম। যাকগে আমার কি! দুটো সারস লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ভাবছে আজ কাবাব খাবো না কাচের বয়ামের কেক খাবো?

রোদের তেজ আছে, আবার নেইও। মানে ফেসবুকের মতন আলগা সম্পর্কে থাকলে গায়ে লাগে না তেমন কিন্তু একটু বেশীক্ষন থাকলে গা চিড়বিড় করে। দুটো কাঠবিড়ালী ব্যস্ত ভঙ্গীতে বাদাম না কী যেন খাচ্ছে, কদম গাছের ডাল থেকে টুপ করে একটা কদম পড়লো। কদম বর্ষাকালের ফুল না? 
অথচ নোংরা নেই তেমন, সাধারনত পিছন দিক গুলোয় যা হয়েই থাকে। আমার একটু ভীড় এড়ানো দিকগুলোয় হেঁটে বেড়াতে দিব্যি লাগে, ঝুম হয়ে বসে থাকলেও মন্দ না। দূরে ফ্লাইওভার দিয়ে বাস গাড়ি সাঁই সাঁই বেরিয়ে যাচ্ছে....এমন সময় সে এলো।

খুব ভয়ানক বুড়ো একজন। মনে হয় দু কদম হেঁটে তিন কদম পা দিলেই মরে যাবে এক্ষুনি। খক খক করে কাশছে, মাঝে মাঝে থুতু ফেলছে। এ কেন এলো এখানে! আমার একার রাজত্বে দখলদারী! চলে যাবে ভেবে সরে এসে বসলাম। গেলো না। ভালো করে তাকিয়ে দেখি লোকটার সারা গায়ের মাকড়সার ঝুলের মতো কুয়াশা। নভেম্বরের রোদ সে কুয়াশা ভেদ করতে পারে না যেন। থুতু, বুড়ো, কুয়াশা কিছুই ভাল্লাগেনা আমার, আমি সরে এসে বসি।

তাতে লাভ কিছুই হয়না দেখি। কুয়াশাটা দিব্যি ডালপালা লাভ করেছে পাশের ছাতিম গাছটা জড়িয়ে, ধোঁয়ার মত করে। কুয়াশার সাথে কথা বলা মুশকিল, তায় সে যদি আবার জ্যান্ত কুয়াশা হয়। আমি তবু যেতে পারছি না এখান থেকে। ওইদিকে একটা চা এর দোকান আছে, তার পাশে একটা ছানা নেড়ি কুকুর এসে উঁকি মারছে কুয়াশার পাশ দিয়ে।

বুড়ো মাথা নীচু করে চা এর ভাঁড়ে বিস্কুট ডুবোচ্ছে, লাঠি আঁকাবাঁকা, পাশে শোয়ানো। পুরো জায়গাটার পাশ থেকে একফালি রোদ উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে কী ব্যাপার। দু হাত দিয়ে দিয়ে কুয়াশা সরিয়ে ভাবছে একটু চা এ চুমুক দেবে কিনা। কিন্তু এন্ট্রি পাচ্ছে না মোটেও।

এদিকে কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে ঘাস গুলো, গাছগুলো বিরক্ত করছে আমায় বেজায়। রোদের এন্ট্রি নেই যেখানে, ঋকানন্দও নেই সেখানে। কিন্তু জ্যান্ত কুয়াশা তো সোজা জিনিস না, সে এতোক্ষনে বেশ স্বাস্থ্য বানিয়েছে। বুড়ো আরো যেন বুড়ো হয়ে গেছে। পাঁচিল এর শেষ সীমায় একটা বন্ধ ঘর আছে, বুড়োর পাশটাতেই। ব্যাটা কুয়াশাটা বুড়োর দাড়ি, ঝোলা, বন্ধ ঘর পেয়ে মাথা নেড়ে গান গাইছে আবার। ধুত্তোর ছাই ওদিকে আবার ছানা কুকুরটা তাকাচ্ছে দেখো! কুকুর আমি মোট্টে ভালোবাসিনা। তায় আমার এমন সাধের জায়গায়। কিন্তু অমন খিদে খিদে, দাওনা চোখে, ছোট কুকুর ছানাও মোটে ভালোনা।

একিরে বাবা! এ ব্যাটা তো খেতেও পারেনা। ওই দেখো, ওর মা টা তো সব খেয়েই নিলো। আর বোকাটা গুঁড়ো গুলো খাচ্ছে। মা কুকুরটার পেটে মনে হয় এক কুয়ো সমান খিদে। যা তুইই খা।
আরে রোদটার একটু গায়ে গত্তি লেগেছে , বুড়োটার জামা থেকে কুয়াশা গলে চাএর ভাঁড়ে পড়ছে....

Sunday, November 18, 2018

গুঁড়ো গুঁড়ো রঙ

সারি সারি একইরকম মুখ দেখতে বাকিদের কিরকম লাগে আমি জানিনা, আমার ভারী খারাপ লাগে। এই কারনে, আমি শাটলে যেতে খারাপবাসি, দুপুরে একা খেতে চাই৷ কিন্তু এমন কপাল, বেশীরভাগ দিনই আমার পাশের কিংবা সামনের চেয়ার গুলো আমার চেনা কারোর চোখে পড়ে যায়। চেনা মানে রোজই, "তুমি কোথায় থাকো" টাইপ চেনা, আরো সরেস হয় ম্যানেজার সুলভ কাউকে দেখলে! তাদের এড়িয়ে অন্য জায়গা বসাও মুশকিল আবার তাদের সাথে বসাও.... কত কাঁহা তক, শেয়ার বাজার, ক্লাউড, ডিজিটাল মার্কেট, ইত্যাদির আলোচনা শোনা যায়! 
শাটলে উঠলেও দেখি, অভিব্যক্তিহীন কতকগুলো অবয়ব, চোখ বোঝা,কানে হেডফোন বা হাতের মোবাইলে চোখ! অথবা, কিচ্ছু না করে কেমন উৎসাহহীন চোখে তাকিয়ে, কিছুই চোখে পড়ছে না তাদের বোঝাই যায়, তা সে চোখ যতই বাইরের দিকে মেলে থাক। আমি মানছি রোজ রোজ অফসে ইন্টারেস্টিং কিছুই থাকে না, উৎসাহ নিয়ে আমি নিজেও অফিস যাই না। কিন্তু অফিসের বাইরের সময়টাও যে অফিসের জন্যই বয়ে যাচ্ছে!
যাকগে তার সময় তার চোখ তার জিভ...আমি এত পরিপাটি ভীড়ে ক্লান্ত হয়ে একা একা চা খেতে গেছি সেদিন, বিশুর দোকানে এ সময়টা একটু ফাঁকা। বিস্কুট ডিস্ট্রিবিউটর ছেলেটা খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে দোকানে দোকানে, বৌদির দোকানে এসে ফলওয়ালার নামে নালিশ করছে কচুরির দোকানের লোকটা। একইরকম লোক সেই, পাঁচিলের এপাড়ে আর ওপাড়ে, শুনতে চাইনা তাও কত কথা কানে এসেই যায়, এতো আনইন্টারেস্টিং, মনেও থাকে না। ক্লান্ত হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, হুট করে দেখি আমার বুক পকেটে কী একটা পড়লো!

শিরীষ গাছটা থেকে, একটা হলুদ রঙের ফুল, পাতা টাতা ঝরিয়ে, সে ব্যাটা এখন সন্ন্যাসী হচ্ছে, তারই মাঝে একটা হলুদ ছোট্ট ফুল, আমায় দিয়েছে, গিফট। বেশ কাকা বেশ, থ্যাংক ইউ। আমি যত্ন করে বুক পকেটটা সামলে আপিস ঢুকলাম ফের।

মেট্রোয় বসে আছি ঠ্যাঙ মেলে। তেমন ভীড় নেই, দুপুরের মেট্রো। এক সার অর্ধমৃত লোক বসে, হেডফোন গুঁজে, ফোনের দিকে তাকিয়ে, চোখ মেলে কিন্তু মরা মাছের চোখের মত তাকিয়ে...এরই মাঝে দেখি একটা মোটামুটি মলিন জামা পরা, একটা দাঁত নেই, বিস্মিত চোখে মেট্রোর স্টপেজ লেখা আলো জ্বলা বোর্ডটা দেখছে। প্রতিটা সবুজ থেকে নীল হয়ে লাল এর জার্ণিটা দেখছে আর খুশীতে একশো আলো জ্বলে উঠছে চোখে, ছেলেকে ডেকেও দেখালো একবার। ছেলে দেখলো বটে, তেমন আনন্দ পেলো না, কারনটাও বুঝিয়ে গেলো, হ্যাঁ এরকমই তো হবে! 
বাবা একটু অপ্রতিভ হলো বটে, কিন্তু বিস্ময়টা গেল না। দেখতে দেখতে আমার স্টপেজ এসে গেল। আগের দিনের গেঞ্জিটাই পরেছিলাম। পাশ দিয়ে যাবার সময়, বিস্ময় না মরে যাওয়া একটা লোককে ভাবলাম আমার কালকের গিফটটা দিয়ে যাই, পকেটে হাত দিয়ে দেখি সে গিপ্ট কখন পড়ে গেছে কোথায়!

আরো অজস্র উপহারের মত এ উপহারটাও হারিয়ে গেছে কখন। হলুদ ফুলটায় কী লেখা ছিলো কে জানে, আর জানার কোনো উপায়ও রইলো না! 
ময়দানে তখন সূর্য ডুবছে, একটা একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে দেখছে, প্রেমিক প্রেমিকাদের উত্যক্ত করা চা ওলা কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, যত্রতত্র পাপড়ি চাট খেয়ে ময়দানটাকে ডাস্টবিন বানানো লোকজন কেমন ময়দানের ঘাস গুলো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে।

তার মধ্যেই একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখছিলো, কেমন করে মানুষগুলো আবছা হয়ে আসছে, গাছে গাছে পাখিগুলো সন্ধ্যেবেলার আসর বসাতে শুরু করছে....
আমার হাতের মুঠো থেকে মেট্রোয় পাওয়া বিস্ময়টা বুড়োর মুখে ঢেলে দিলাম। আমার কাছে থাকলে ফের হারিয়ে যাবে হয়ত, তার আগেই বুড়ো র কাছে জমা থাক। যদি কেউ আসে কোনোদিন নিতে...কিংবা একদিন রাতে হয়তো শ্বাস ছাড়ার সাথে উড়িয়ে দেবে, আর পরদিন কোলকাতার সবার মধ্যে রেনুর মতো বিস্ময় গুঁড়ো মিশে মিশে যাবে....


Thursday, November 1, 2018

সাপব্যাঙ গল্প


"কই একটু চা দেখি, চা খেয়ে ছেলেটার জন্যে একটা ইঁদুর ধরে আনি।"

  - পারবো না যাও তো। সারাদিন খেটে খেটে আমার খোলস ছেড়ে গেলো এই গরমকালেই। সারাদিন জ্বালাতন। এই চা দাও রে, এই ব্যাঙের রোস্ট করে দাও রে, এই একটু পোকা ভাজা দাও রে। কেন যে মরতে তোমায় বিয়ে করেছিলাম, জীবনটা শেষ হয়ে গেলো!

 ত্রিভঙ্গ বাবু, ওনার স্ত্রী আঁকাচোরা দেবী আর ওনাদের ছেলে ক্রিসক্রশ, ছোট্ট সাপ পরিবার, একসাথে একটা নরম গরম গর্তে থাকেন। শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। সকালে একটু চা বিস্কুট খেয়ে খোকা কুশুকে পোকা ধরা,  নেতিয়ে পড়ে থাকা, গাছ বাওয়া,  ছোটা এসব শেখান। বেশী না ওই অল্প আধটু। তারপর বেরোন পোকা ব্যাঙ বা ইঁদুর ধরতে। বলতে নেই, আঁকাচোরা দেবীর রান্নার হাত থুড়ি লেজ ভালো বড়। আজকাল ওনার একটু ভুঁড়ি মতো হয়েছে।

মাথার উপরের খড়ম ছাপটা একটু চুলকে নিয়ে কালো লেজে ঠেস দিয়ে বসে ত্রিভঙ্গ বাবু বললেন," আহা রাগ করছ কেন।থাক থাক,  আচ্ছা কই আমার বাজারের থলেটা দাও। কই রে কুশু, আজ কি পোকা খাবি? "
রান্নাঘর থেকে আঁকাচোরা বেরিয়ে এলো, "কবে এমন হয়েছে যে চা পাওনি, অত কেত নেওয়ার কি হ্যাঁ, চা বসিয়েছি, চা খেয়ে বাজার যাও।"

চা খেয়ে ত্রিভঙ্গ,  ছেলেকে নিয়ে বেরোলো। গরমকালটাই যা ফূর্তির কাল, ছেলেকে নিয়ে আজ সাঁতার কাটতে যাবে। আঁকাচোরাও আসবে খানিক পরে। ছেলেটা হয়েছে অন্যরকম,  ওর বয়সী সব সাপ যখন পাখির ডিম জোগাড় করে আনে ও তখন লেজ বাজিয়ে গান গায়। ত্রিভঙ্গর সমস্যা হলো, ছেলেকে ও বেজায় ভালোবাসে। এতোদিনে অন্য সাপ হলে গর্ত থেকে দূর করে দিতো, কিন্তু কুশু মানুষের রক্ত দিয়ে নেশা করেনা, পাখির ডিমের খোলা পুড়িয়ে নেশাও নেই, খালি নিজের মনে থাকে বলেই দূর করা যায়!

ত্রিভঙ্গরা যেখানে থাকে আশেপাশে সাপ নেই তেমন, বিপদে আপদে ডাক্তার বদ্যির দরকার হলে তারা তিন গাছের ছায়া পেরিয়ে যায়। ওখানে একটা ভাঙা বাড়িতে বদ্যি সাপ থাকে। আশেপাশে আরো অনেকেই থাকে। বেশ পশ এলাকা, শুকনো খটখটে। আসলে ত্রিভঙ্গ নিজেও একটু অন্যরকম, তাই হয়তো পশ এলাকায় আস্তানা মেলেনি।তবে ত্রিভঙ্গ নিজের মতো করে ভালোই আছে। রবিবার করে ভালো পাখির ডিম কিংবা ব্যাঙ পেলে আর নদীতে সাঁতার কাটতে পেলে খারাপ থাকারও কারন নেই খুব কিছু। সাধারণত জলের সাপদের একটু নীচু চোখেই দেখা হয়। কিন্তু ত্রিভঙ্গের এসবে খুব কিছু এসে যায় না, আঁকাচোরারও না। আঁকাচোরাও ভারী ভালো মেয়ে,   বাদলার দিনে গর্তে জল ঢুকে গেলো, কি কোনোদিন  পিঁপড়ে অব্দি মিলল না,  ত্রিভঙ্গকে ও উত্যক্ত করেনা। নেই তো কী আর করা যাবে,  এরকমই মনোভাব।

সেদিন জলে খানিক দাপাদাপি করে পাথরের উপর শুয়ে জল শুকোচ্ছে তিনজনে। কে বেশী লেজ দিয়ে দাপিয়েছে সে নিয়ে খানিক হাসি তামাশাও হচ্ছে। তারপর ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা গেছে জঙ্গলে একটু ঘুরতে। এটা শুধু ওদের নিজেদের সময় কিনা,  কুশুকে নিয়ে যায় না সাথে, আর কুশুও বোকা মানুষের বাচ্ছা না যে চ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে সব জায়গায় বাপ মা এর সাথে যাবে বলে!

শুয়ে শুয়ে একটা নতুন সুর ধরার চেষ্টা করছে কুশু, গাছের সাথে হাওয়ার কথা বলার শব্দটা যদি সুরে ধরা যায়, তার সাথে নদীর মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট করলে জমে যাবে না ব্যাপারটা? কুশুর গলায় সুর টুর নেই তেমন, তাই একা একা থাকলেই সে গান গায়। এই করেই তার বন্ধু বান্ধবও কম। একে মূল শহরের থেকে দূরে থাকে, তায় রোগাটে ছোটখাটো চেহারা, তায় আসর জমাতে পারেনা বন্ধু হবে কেমন করে? বন্ধু তো হয় খেলার মাঠে না হলে শিকার করতে গিয়ে রাস্তায়। পাখির ডিম বা ইঁদুর সে বেশীর ভাগ সময়পারে না ধরতে, ছড়িয়ে লাট করে ফেলে, লজ্জায় সে বাকিদের থেকে আড়ালে শিকার করার চেষ্টা করে। আর নিজেকে সঙ্গ দিতে গান শোনায়। গান গাইতে তার ভালো লাগে এদিকে সুর নেই বলে তার ধারনা। যদিও সে ধারনা ভুল। গান বাজনা সে ভালোই করে।

গান গাইতে গাইতে খেয়াল ছিলোনা আশেপাশে কি হচ্ছে,হটাৎ দেখে, পাশের পাথরেই একটা কালোকোলা ব্যাঙ যে!!ব্যাঙটাও ভারী ভ্যাবলা তো! দেখছিস পাশে সাপ বসে আছে, তুই কি বলে তার গান শুনতে এসেছিস!! শুধু তাই না, আস্পদ্দা দেখো একবার, ব্যাঙটা সাপের দিকে তাকিয়ে বলে কিনা, "আহা থামলে কেন, সুরটা তো প্রায় ধরে ফেলেইছিলে, আরেকটু হলেও বোঝা যেত গাছেদের গান!

কুশু হতভম্ব হয়ে বলল," হ্যাঁ আসলে ওই মনটা একটু সরে গেলো, ব্যাস সুরটাও পাশ কাটিয়ে গেলো। কিন্তু তুমি মানে তোমার ভয় করছে না? "

-ভয় করবে কেন হে খোকা!! তোমার থেকে বয়সে বড় কিনা আমি অত তোমার মতো ভয় পাই না।  এই তো কাল রাতে হিসি পেলো, একাই একাই কাজ সেরে এলাম। তুমি নির্ঘাত এখনো, মাকে ডেকে নিয়ে যাও? খ্যা খ্যা গ্যাঙোর গ্যাঙা গ্যাঙ।

- আহ থামো তুমি। আমি মোটেও মাকে ডাকিনা। আমি রাতে উঠিইনা। এই তো মা বাবা  মিলে জঙ্গলে গেছে, আমি কি ভয় পাচ্ছি?

- হুঁ তা অবশ্য পাওনি বটে।

-তবে? ভয় পাচ্ছোনা কেন এই কারনেই জিজ্ঞেস করছি, তুমি ব্যাঙ আমি সাপ, কপ করে খেয়ে নিলে কি করবে হ্যাঁ?

- ওহো! এই জন্যে! দূর! ওতে ভয় পাবার কি! তুমি খেতে এলে আমিও ফাইট দেবো! তারপর না হয় মরেই যাবো। এতো ভেবে লাভ আছে নাকি! আজই তো একটা পোকা খেতে গিয়ে একটা বিষ মাকড়সার কামড় খাচ্ছিলাম প্রায়, আরেকটু হলেই প্যারালাইসিস  হয়ে যেত। তাহলে আর ভয় করে কি করবো হে, তার চেয়ে বরং ফূর্তিতে কাটাই যটা দিন পাই।
তা মারবে নাকি?  হবে নাকি ফাইট?

- ইয়ে না মানে আমার আর তোমায় মারতে ইচ্ছে করছে না। বলছি চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক নাকি?

-আরে! বলো কি নন্দলাল! বন্ধু মিলে গেলো সুরের সাথে? এ যে বড় ভালো ব্যাপার হলো।  তোমার মনটা বেশ তো। চলো, আমিই খাওয়াবো কফি, তা নাম কি তোমার?

- আমার নাম ক্রিসক্রশ, ডাক নাম কুশু। তোমার নাম কি? তুমিও গান গাও মনে হচ্ছে। কফি খেতে খেতে একটা গান শোনাও না?

- আমার ভাই একটাই নাম, ভালো নাম ডাক নাম সব একটা। ঘাপুস। হবে হবে, গান তো হবেই।

তারপর তারা দু মক্কেলে কফি খেয়ে আড্ডা দিয়ে গান গেয়ে,  যখন আইস্ক্রীম খাচ্ছে,  কুশু দেখে ওর বাপ মা ফিরছে। ওদিকে অন্ধকার নামলো বলে। কুশু মহা বিপদে পড়েছে, ঘাপুসকে কোথায় লুকোবে? পালিয়ে গিয়েও লাভ হবে না, ঘাপুসের থাকাটা ওরা টের পেয়েছে তো বটেই।

"বুঝলি ঘাপুস, পালিয়ে না গিয়ে,  চল ফেস করি, আমার বন্ধুকে আমি মরতে দেবো না। তাছাড়া বাবা মা ভালো, ঠিক বুঝবে।"

ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা এসে পড়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে একবার ঘুপুসকে দেখেই, আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কুশু তাড়াতাড়ি আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, "বাবা, প্লিজ ওকে মেরো না। ও আমার বন্ধু। ঘুপুস নাম ওর। দারুন ভালো গান গায়।"

ত্রিভঙ্গবাবু তো অবাক! "বন্ধু!! সে আবার কি কথা! খাদ্য খাদক কখনো বন্ধু হয় নাকি! "

- তা হয়না। কিন্তু  ঘাপুস তো আমার খাদ্য না৷

-ঘুপুস না হোক, ওর বাপ মা ভাই বেরাদর তারা তো আমাদের খাদ্য?

 -বেশ,আমি আজ থেকে ব্যাঙ খাওয়া ছেড়ে দিলাম।

- আরে সে কি কথা! প্রোটিন পাবি কোত্থেকে তাহলে? গায়ে জোর হবে কি করে? খাবি কি?

- সে না হয় আমি পোকা খেয়ে চালাবো। আর ইয়ে বাবা,  আমি ভাবছি,  ধান আর ডাল চাষ করবো। ভাত ডাল খেলেই গায়ে জোর হবে, কার্বস, প্রোটিন দুইই পাবো।

শুনে তো আঁকাচোরা আর ত্রিভঙ্গ মুচ্ছো যায় প্রায়!  আঁকাচোরা গালে লেজ দিয়ে অবাক হয়ে বলে, "ওরে,  সে তো মানুষের কাজ!  কোনোদিন শুনেছিস সাপে চাষ করে? বেকার অত খাটবি যদি আনন্দ করবি কখন? "

কুশু বলে, "কেউ করেনি তো কি? আমরা করি। তাছাড়া আমরা কি জমাব নাকি, একটু করে চাষ করে খেয়ে নেবো ব্যাস।তারপর তো শীতকাল চলেই আসবে। আর একদম কিছু না হলে, ইঁদুরকে বলবো, ওকে খাবোনা বদলে চাল ডাল দিক। ব্যাস।"
ঘাপুস এতোক্ষন চুপ ছিলো, এবার সে বলল, খারাপ আইডিয়া না কিন্তু কাকু, চলো ট্রাই নিয়ে দেখাই যাক না? কি বলো? না পোষালে তো আমি রইলামই,  খেয়ে নিও।

ত্রিভঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলল, " থাক,  ছেলের বন্ধুকে খাবো এমন উচ্ছন্নেও যাই নি আমরা।রাত হচ্ছে, চলো সব ঘরে যাই, তুমি যাও বাড়ি আজ। কাল বাকি কথা হবে।"

ঘাপুস গ্যাঙোর গ্যাঙা করে হেসে বলে, "ও কাকু, বাড়ি থেকে তো চলে এসেছি। আমি এখন বড় হয়েছি কিনা,  তাই দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, এমন সময় কুশুর সাথে দেখা।"

আঁকাচোরা এগিয়ে এসে বললেন, "উদ্ধার করেছ, এই টুকু বয়স বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন! চল ঘরে চল। রাতে পোকা টোকা যা আছে খেয়ে উদ্ধার করো।

অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষনে। নদীর জলে সূর্যের লাল আভাটা মিলিয়ে গেছে। এক ঝাঁক পাখি সারাদিনের কথা বার্তা সারছে গাছে। কে কোথায় কী দেখেছে, কী খেয়েছে এসব।মাছেদের দল ঘুমাবার জন্য বিছানা খুঁজছে শ্যাওলার ফাঁকে।চারজনের দলটা গর্তে ফিরে গেলো।

ত্রিভঙ্গ বাবুরও এখন চাষবাসে মন হয়েছ।