Thursday, November 1, 2018

সাপব্যাঙ গল্প


"কই একটু চা দেখি, চা খেয়ে ছেলেটার জন্যে একটা ইঁদুর ধরে আনি।"

  - পারবো না যাও তো। সারাদিন খেটে খেটে আমার খোলস ছেড়ে গেলো এই গরমকালেই। সারাদিন জ্বালাতন। এই চা দাও রে, এই ব্যাঙের রোস্ট করে দাও রে, এই একটু পোকা ভাজা দাও রে। কেন যে মরতে তোমায় বিয়ে করেছিলাম, জীবনটা শেষ হয়ে গেলো!

 ত্রিভঙ্গ বাবু, ওনার স্ত্রী আঁকাচোরা দেবী আর ওনাদের ছেলে ক্রিসক্রশ, ছোট্ট সাপ পরিবার, একসাথে একটা নরম গরম গর্তে থাকেন। শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। সকালে একটু চা বিস্কুট খেয়ে খোকা কুশুকে পোকা ধরা,  নেতিয়ে পড়ে থাকা, গাছ বাওয়া,  ছোটা এসব শেখান। বেশী না ওই অল্প আধটু। তারপর বেরোন পোকা ব্যাঙ বা ইঁদুর ধরতে। বলতে নেই, আঁকাচোরা দেবীর রান্নার হাত থুড়ি লেজ ভালো বড়। আজকাল ওনার একটু ভুঁড়ি মতো হয়েছে।

মাথার উপরের খড়ম ছাপটা একটু চুলকে নিয়ে কালো লেজে ঠেস দিয়ে বসে ত্রিভঙ্গ বাবু বললেন," আহা রাগ করছ কেন।থাক থাক,  আচ্ছা কই আমার বাজারের থলেটা দাও। কই রে কুশু, আজ কি পোকা খাবি? "
রান্নাঘর থেকে আঁকাচোরা বেরিয়ে এলো, "কবে এমন হয়েছে যে চা পাওনি, অত কেত নেওয়ার কি হ্যাঁ, চা বসিয়েছি, চা খেয়ে বাজার যাও।"

চা খেয়ে ত্রিভঙ্গ,  ছেলেকে নিয়ে বেরোলো। গরমকালটাই যা ফূর্তির কাল, ছেলেকে নিয়ে আজ সাঁতার কাটতে যাবে। আঁকাচোরাও আসবে খানিক পরে। ছেলেটা হয়েছে অন্যরকম,  ওর বয়সী সব সাপ যখন পাখির ডিম জোগাড় করে আনে ও তখন লেজ বাজিয়ে গান গায়। ত্রিভঙ্গর সমস্যা হলো, ছেলেকে ও বেজায় ভালোবাসে। এতোদিনে অন্য সাপ হলে গর্ত থেকে দূর করে দিতো, কিন্তু কুশু মানুষের রক্ত দিয়ে নেশা করেনা, পাখির ডিমের খোলা পুড়িয়ে নেশাও নেই, খালি নিজের মনে থাকে বলেই দূর করা যায়!

ত্রিভঙ্গরা যেখানে থাকে আশেপাশে সাপ নেই তেমন, বিপদে আপদে ডাক্তার বদ্যির দরকার হলে তারা তিন গাছের ছায়া পেরিয়ে যায়। ওখানে একটা ভাঙা বাড়িতে বদ্যি সাপ থাকে। আশেপাশে আরো অনেকেই থাকে। বেশ পশ এলাকা, শুকনো খটখটে। আসলে ত্রিভঙ্গ নিজেও একটু অন্যরকম, তাই হয়তো পশ এলাকায় আস্তানা মেলেনি।তবে ত্রিভঙ্গ নিজের মতো করে ভালোই আছে। রবিবার করে ভালো পাখির ডিম কিংবা ব্যাঙ পেলে আর নদীতে সাঁতার কাটতে পেলে খারাপ থাকারও কারন নেই খুব কিছু। সাধারণত জলের সাপদের একটু নীচু চোখেই দেখা হয়। কিন্তু ত্রিভঙ্গের এসবে খুব কিছু এসে যায় না, আঁকাচোরারও না। আঁকাচোরাও ভারী ভালো মেয়ে,   বাদলার দিনে গর্তে জল ঢুকে গেলো, কি কোনোদিন  পিঁপড়ে অব্দি মিলল না,  ত্রিভঙ্গকে ও উত্যক্ত করেনা। নেই তো কী আর করা যাবে,  এরকমই মনোভাব।

সেদিন জলে খানিক দাপাদাপি করে পাথরের উপর শুয়ে জল শুকোচ্ছে তিনজনে। কে বেশী লেজ দিয়ে দাপিয়েছে সে নিয়ে খানিক হাসি তামাশাও হচ্ছে। তারপর ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা গেছে জঙ্গলে একটু ঘুরতে। এটা শুধু ওদের নিজেদের সময় কিনা,  কুশুকে নিয়ে যায় না সাথে, আর কুশুও বোকা মানুষের বাচ্ছা না যে চ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে সব জায়গায় বাপ মা এর সাথে যাবে বলে!

শুয়ে শুয়ে একটা নতুন সুর ধরার চেষ্টা করছে কুশু, গাছের সাথে হাওয়ার কথা বলার শব্দটা যদি সুরে ধরা যায়, তার সাথে নদীর মিউজিক এরেঞ্জমেন্ট করলে জমে যাবে না ব্যাপারটা? কুশুর গলায় সুর টুর নেই তেমন, তাই একা একা থাকলেই সে গান গায়। এই করেই তার বন্ধু বান্ধবও কম। একে মূল শহরের থেকে দূরে থাকে, তায় রোগাটে ছোটখাটো চেহারা, তায় আসর জমাতে পারেনা বন্ধু হবে কেমন করে? বন্ধু তো হয় খেলার মাঠে না হলে শিকার করতে গিয়ে রাস্তায়। পাখির ডিম বা ইঁদুর সে বেশীর ভাগ সময়পারে না ধরতে, ছড়িয়ে লাট করে ফেলে, লজ্জায় সে বাকিদের থেকে আড়ালে শিকার করার চেষ্টা করে। আর নিজেকে সঙ্গ দিতে গান শোনায়। গান গাইতে তার ভালো লাগে এদিকে সুর নেই বলে তার ধারনা। যদিও সে ধারনা ভুল। গান বাজনা সে ভালোই করে।

গান গাইতে গাইতে খেয়াল ছিলোনা আশেপাশে কি হচ্ছে,হটাৎ দেখে, পাশের পাথরেই একটা কালোকোলা ব্যাঙ যে!!ব্যাঙটাও ভারী ভ্যাবলা তো! দেখছিস পাশে সাপ বসে আছে, তুই কি বলে তার গান শুনতে এসেছিস!! শুধু তাই না, আস্পদ্দা দেখো একবার, ব্যাঙটা সাপের দিকে তাকিয়ে বলে কিনা, "আহা থামলে কেন, সুরটা তো প্রায় ধরে ফেলেইছিলে, আরেকটু হলেও বোঝা যেত গাছেদের গান!

কুশু হতভম্ব হয়ে বলল," হ্যাঁ আসলে ওই মনটা একটু সরে গেলো, ব্যাস সুরটাও পাশ কাটিয়ে গেলো। কিন্তু তুমি মানে তোমার ভয় করছে না? "

-ভয় করবে কেন হে খোকা!! তোমার থেকে বয়সে বড় কিনা আমি অত তোমার মতো ভয় পাই না।  এই তো কাল রাতে হিসি পেলো, একাই একাই কাজ সেরে এলাম। তুমি নির্ঘাত এখনো, মাকে ডেকে নিয়ে যাও? খ্যা খ্যা গ্যাঙোর গ্যাঙা গ্যাঙ।

- আহ থামো তুমি। আমি মোটেও মাকে ডাকিনা। আমি রাতে উঠিইনা। এই তো মা বাবা  মিলে জঙ্গলে গেছে, আমি কি ভয় পাচ্ছি?

- হুঁ তা অবশ্য পাওনি বটে।

-তবে? ভয় পাচ্ছোনা কেন এই কারনেই জিজ্ঞেস করছি, তুমি ব্যাঙ আমি সাপ, কপ করে খেয়ে নিলে কি করবে হ্যাঁ?

- ওহো! এই জন্যে! দূর! ওতে ভয় পাবার কি! তুমি খেতে এলে আমিও ফাইট দেবো! তারপর না হয় মরেই যাবো। এতো ভেবে লাভ আছে নাকি! আজই তো একটা পোকা খেতে গিয়ে একটা বিষ মাকড়সার কামড় খাচ্ছিলাম প্রায়, আরেকটু হলেই প্যারালাইসিস  হয়ে যেত। তাহলে আর ভয় করে কি করবো হে, তার চেয়ে বরং ফূর্তিতে কাটাই যটা দিন পাই।
তা মারবে নাকি?  হবে নাকি ফাইট?

- ইয়ে না মানে আমার আর তোমায় মারতে ইচ্ছে করছে না। বলছি চলো এক কাপ কফি খাওয়া যাক নাকি?

-আরে! বলো কি নন্দলাল! বন্ধু মিলে গেলো সুরের সাথে? এ যে বড় ভালো ব্যাপার হলো।  তোমার মনটা বেশ তো। চলো, আমিই খাওয়াবো কফি, তা নাম কি তোমার?

- আমার নাম ক্রিসক্রশ, ডাক নাম কুশু। তোমার নাম কি? তুমিও গান গাও মনে হচ্ছে। কফি খেতে খেতে একটা গান শোনাও না?

- আমার ভাই একটাই নাম, ভালো নাম ডাক নাম সব একটা। ঘাপুস। হবে হবে, গান তো হবেই।

তারপর তারা দু মক্কেলে কফি খেয়ে আড্ডা দিয়ে গান গেয়ে,  যখন আইস্ক্রীম খাচ্ছে,  কুশু দেখে ওর বাপ মা ফিরছে। ওদিকে অন্ধকার নামলো বলে। কুশু মহা বিপদে পড়েছে, ঘাপুসকে কোথায় লুকোবে? পালিয়ে গিয়েও লাভ হবে না, ঘাপুসের থাকাটা ওরা টের পেয়েছে তো বটেই।

"বুঝলি ঘাপুস, পালিয়ে না গিয়ে,  চল ফেস করি, আমার বন্ধুকে আমি মরতে দেবো না। তাছাড়া বাবা মা ভালো, ঠিক বুঝবে।"

ত্রিভঙ্গ আর আঁকাচোরা এসে পড়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে একবার ঘুপুসকে দেখেই, আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কুশু তাড়াতাড়ি আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, "বাবা, প্লিজ ওকে মেরো না। ও আমার বন্ধু। ঘুপুস নাম ওর। দারুন ভালো গান গায়।"

ত্রিভঙ্গবাবু তো অবাক! "বন্ধু!! সে আবার কি কথা! খাদ্য খাদক কখনো বন্ধু হয় নাকি! "

- তা হয়না। কিন্তু  ঘাপুস তো আমার খাদ্য না৷

-ঘুপুস না হোক, ওর বাপ মা ভাই বেরাদর তারা তো আমাদের খাদ্য?

 -বেশ,আমি আজ থেকে ব্যাঙ খাওয়া ছেড়ে দিলাম।

- আরে সে কি কথা! প্রোটিন পাবি কোত্থেকে তাহলে? গায়ে জোর হবে কি করে? খাবি কি?

- সে না হয় আমি পোকা খেয়ে চালাবো। আর ইয়ে বাবা,  আমি ভাবছি,  ধান আর ডাল চাষ করবো। ভাত ডাল খেলেই গায়ে জোর হবে, কার্বস, প্রোটিন দুইই পাবো।

শুনে তো আঁকাচোরা আর ত্রিভঙ্গ মুচ্ছো যায় প্রায়!  আঁকাচোরা গালে লেজ দিয়ে অবাক হয়ে বলে, "ওরে,  সে তো মানুষের কাজ!  কোনোদিন শুনেছিস সাপে চাষ করে? বেকার অত খাটবি যদি আনন্দ করবি কখন? "

কুশু বলে, "কেউ করেনি তো কি? আমরা করি। তাছাড়া আমরা কি জমাব নাকি, একটু করে চাষ করে খেয়ে নেবো ব্যাস।তারপর তো শীতকাল চলেই আসবে। আর একদম কিছু না হলে, ইঁদুরকে বলবো, ওকে খাবোনা বদলে চাল ডাল দিক। ব্যাস।"
ঘাপুস এতোক্ষন চুপ ছিলো, এবার সে বলল, খারাপ আইডিয়া না কিন্তু কাকু, চলো ট্রাই নিয়ে দেখাই যাক না? কি বলো? না পোষালে তো আমি রইলামই,  খেয়ে নিও।

ত্রিভঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলল, " থাক,  ছেলের বন্ধুকে খাবো এমন উচ্ছন্নেও যাই নি আমরা।রাত হচ্ছে, চলো সব ঘরে যাই, তুমি যাও বাড়ি আজ। কাল বাকি কথা হবে।"

ঘাপুস গ্যাঙোর গ্যাঙা করে হেসে বলে, "ও কাকু, বাড়ি থেকে তো চলে এসেছি। আমি এখন বড় হয়েছি কিনা,  তাই দেশভ্রমণে বেরিয়েছিলাম, এমন সময় কুশুর সাথে দেখা।"

আঁকাচোরা এগিয়ে এসে বললেন, "উদ্ধার করেছ, এই টুকু বয়স বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন! চল ঘরে চল। রাতে পোকা টোকা যা আছে খেয়ে উদ্ধার করো।

অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষনে। নদীর জলে সূর্যের লাল আভাটা মিলিয়ে গেছে। এক ঝাঁক পাখি সারাদিনের কথা বার্তা সারছে গাছে। কে কোথায় কী দেখেছে, কী খেয়েছে এসব।মাছেদের দল ঘুমাবার জন্য বিছানা খুঁজছে শ্যাওলার ফাঁকে।চারজনের দলটা গর্তে ফিরে গেলো।

ত্রিভঙ্গ বাবুরও এখন চাষবাসে মন হয়েছ।

2 comments:

  1. Khub mishti golpo.. kolpona y dekhte pelam Kush-Ghapush ar Kush er Baba Maa eksathe bari phirche!

    ReplyDelete