Wednesday, November 28, 2018

পথে পথে

একদম অন্ধকার হবার পর পরেই চাঁদ ওঠে না, একটা দুটো তারা ঘুম ভেঙে আড়মোড়া মেলে। টর্চ আছে পকেটে, কিন্তু অন্ধকার গায়ে মেখে হাঁটতে দিব্যি লাগছে। শীত পড়তে শুরু করেছে, বাংলায় এটা কোন সময়? অঘ্রাণ না? হাড় কাঁপানো ঠান্ডা কিছু না, তবে ঠান্ডা আছে। সাপের ভয় নেই, আর মহারাজদের চোর ডাকাতের ভয় থাকার কথাও না, তবে আর টর্চ কী হবে!

হনহন করে হাঁটছিলাম, যেখানে আছি সেই আলো শেষ হলেই অন্ধকার ঘুটঘুটে। অন্ধকারটা চোখে সইলেই আর ঘুটঘুটে থাকেনা, আকাশে একটা আলো থাকেই। সেই আলোতে গাছপালা গুলো বড় অন্যরকম লাগে, বাঁ পাশে একটা জলা, সকালেই দেখেছিলাম। ডান পাশে কী কে জানে! খানিক হেঁটে দেখি একটা পাড়ায় পৌঁছে গেছি। ডান বাম দুদিকে রাস্তা, একদিক ধরে এগোচ্ছি হনহন করে, টুকরো টাকরা কথা কানে আসছে, হিন্দি না, বাংলাই, ডায়ালেক্ট অন্য। সীমান্তবর্তী এই জায়গার লোকগুলো এখনো শহুরে ধুলোয় ঢাকা পড়েনি। তেষ্টা পেয়েছে বেশ, ও কাকা টিউবওয়েল আছে কাছাকাছি?

হুই উদিকে বাঁয়ে আছে, বেসসি না দু কদম দূরে। হুঁ। জল খেয়ে একটু এগিয়েছি, এদিকটা বাড়িগুলোর পিছন দিক, গরু দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে, একটা মুদির দোকান টিমটিমে আলো জ্বলা, সেখানে শাকপাতা থেকে চিপ্স সবই মেলে। মুদির দোকান পেরোলেই একটা মাঠ, মাঠের ওপাশে গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে লাল চাঁদ উঠছে তখন। এরপর আস্তে আস্তে সাদা হবে, মাথার উপর উঠবে।

হাতে বেলুন নিয়ে লোকজন ফিরছে, এদের আজ রাস মেলা আছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে দেখি, মেলা না ঠিক, রাস মন্দিরকে ঘিরে কিছু মাটির মূর্তি বানিয়েছে, অল্প স্বল্প আলো দিয়ে সাজিয়েছে, বাচ্ছা, মেয়ে, পুরুষ সব হামলে পড়ে তাইই দেখছে আনন্দ করে৷ মন্দিরে সংকীর্তন চলছে, খোল করতাল বাজিয়ে, ইস্কনের মন্দিরের মত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে না। আমার ভক্তি নেই, ঘুরে ঘুরে আলগোছে দেখছি। এহে মোবাইলটা আছে বটে কিন্তু ওয়ালেট তো নাই, কিছুই খেতে পাবো না তো তাহলে! ঠিক আছে এমনিতেও কিছু নেই মনে হয়। ওই দিকে কিসের জটলা হচ্ছে? উঁকি মেরে দেখতে গিয়েই হাতে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে পায়েস ধরিয়ে দিলো। চারিদিকে অজস্র খালি কাপ পড়ে আছে এই জন্যেই বুঝি?

পায়েসের কাপ নিয়ে মুশকিলে পড়লাম। আমি খেতে ভালোবাসি, কিন্তু আমি তো হিমু কিংবা নীললোহিত না, ঋকানন্দের সারাদিন না খেলেও চলে কিন্তু ভালোবাসার খাবার খারাপ স্বাদের আমার সয় না। আমার অনেক কিছুই সয় না, সে আলাদা কথা কিন্তু এই পায়েস নিয়ে এখন আমি কী করি? অভিজ্ঞতা থেকে জানি, গরীব মানুষেরা পায়েস যেটা বানায় সে বেশ খারাপ হয়। চাল সেদ্ধ করে পরে দুধ মেশায়। তাও মুখে দিয়ে দেখলাম, হুঁ, খারাপ। এবার? ফেলে দিলেই হয় কিন্তু এতো লোক আহ্লাদ করে করে আগ্রহ নিয়ে যা খাচ্ছে তা ছুঁড়ে ফেলতে পারি এমন জোরও নেই।

আরো খানিক এদিক সেদিক ঘুরে, দেখি একটা কুকুর। যাক একেবারে ফেলা গেলো না। ভীড়টা পেরিয়ে ফিরতি পথ ধরেছি। বাঁধানো রাস্তাটা পার হলেই একা গাছটা দিয়ে চাঁদের আলো নেমেছে। পূর্ণিমার আলোয় জায়গাটা ঝকঝক করছে। খানিকটা গেলেই নদী। শীতকালের নদী, পাথর বেশী জল কম। কিচ্ছু না থাকলেও যেমন জীবন আবার দুহাত ভরা থাকলেও জীবন;তেমনই জল থাকলেও নদী কম থাকলেও নদী...জল একেবারে শুকিয়ে না গেলেই হলো। অবশ্য মরা নদী অত খারাপ না যতটা নোংরায় খাল হয়ে যাওয়া নদী খারাপ।

কুয়াশা নেমেছে রাত বাড়তে, সাদা নদীর চর, এক পৃথিবী চাঁদের আলো। আশেপাশের গাছ গুলো সতর্ক ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে, একটু পরেই পরী নামবে এখানে। সে পরীদের সাথে দেখা হলে মুশকিল, আর ঘোর কাটবে না, ঘুরে ঘুরে মরতে হবে সারা জীবন। কোত্থাও তিষ্ঠানো যাবে না। পরীদের ধরে ফেললে আরো মুশকিল, ধরলেই তারা মানুষ হয়ে একশো হাজার বছর আটকে যাবে। না আমি পরী ধরতে চাইনা, এমন মায়াময় রাতে, নদীর ধারে বন পাহাড়ের উপর যার থাকার কথা, টিউবলাইটের আলোয় ল্যাপটপ দেখবে সে এ আমি ভাবতে পারিনা। আমার হাত ঝলসে যাবে আমার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।

চাঁদের আলোয় নেশা হয়, ঝিম ধরা নেশা, এইরকম খোলা প্রান্তে, নদীর ধারে দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের আওয়াজে, গাছেদের চোখের দৃষ্টিতে সে নেশা বড় তীব্র হয়। মনে হয় সব ফেলে এক্ষুনি বেরিয়ে যাই। আর ফেরার কী দরকার....

কিন্তু আমার সে জীবনও সইবে না আমি জানি, আমায় ফিরে ফিরে আসতে হবে আবার যেতে হবে.....

No comments:

Post a Comment