Sunday, November 18, 2018

গুঁড়ো গুঁড়ো রঙ

সারি সারি একইরকম মুখ দেখতে বাকিদের কিরকম লাগে আমি জানিনা, আমার ভারী খারাপ লাগে। এই কারনে, আমি শাটলে যেতে খারাপবাসি, দুপুরে একা খেতে চাই৷ কিন্তু এমন কপাল, বেশীরভাগ দিনই আমার পাশের কিংবা সামনের চেয়ার গুলো আমার চেনা কারোর চোখে পড়ে যায়। চেনা মানে রোজই, "তুমি কোথায় থাকো" টাইপ চেনা, আরো সরেস হয় ম্যানেজার সুলভ কাউকে দেখলে! তাদের এড়িয়ে অন্য জায়গা বসাও মুশকিল আবার তাদের সাথে বসাও.... কত কাঁহা তক, শেয়ার বাজার, ক্লাউড, ডিজিটাল মার্কেট, ইত্যাদির আলোচনা শোনা যায়! 
শাটলে উঠলেও দেখি, অভিব্যক্তিহীন কতকগুলো অবয়ব, চোখ বোঝা,কানে হেডফোন বা হাতের মোবাইলে চোখ! অথবা, কিচ্ছু না করে কেমন উৎসাহহীন চোখে তাকিয়ে, কিছুই চোখে পড়ছে না তাদের বোঝাই যায়, তা সে চোখ যতই বাইরের দিকে মেলে থাক। আমি মানছি রোজ রোজ অফসে ইন্টারেস্টিং কিছুই থাকে না, উৎসাহ নিয়ে আমি নিজেও অফিস যাই না। কিন্তু অফিসের বাইরের সময়টাও যে অফিসের জন্যই বয়ে যাচ্ছে!
যাকগে তার সময় তার চোখ তার জিভ...আমি এত পরিপাটি ভীড়ে ক্লান্ত হয়ে একা একা চা খেতে গেছি সেদিন, বিশুর দোকানে এ সময়টা একটু ফাঁকা। বিস্কুট ডিস্ট্রিবিউটর ছেলেটা খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে দোকানে দোকানে, বৌদির দোকানে এসে ফলওয়ালার নামে নালিশ করছে কচুরির দোকানের লোকটা। একইরকম লোক সেই, পাঁচিলের এপাড়ে আর ওপাড়ে, শুনতে চাইনা তাও কত কথা কানে এসেই যায়, এতো আনইন্টারেস্টিং, মনেও থাকে না। ক্লান্ত হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, হুট করে দেখি আমার বুক পকেটে কী একটা পড়লো!

শিরীষ গাছটা থেকে, একটা হলুদ রঙের ফুল, পাতা টাতা ঝরিয়ে, সে ব্যাটা এখন সন্ন্যাসী হচ্ছে, তারই মাঝে একটা হলুদ ছোট্ট ফুল, আমায় দিয়েছে, গিফট। বেশ কাকা বেশ, থ্যাংক ইউ। আমি যত্ন করে বুক পকেটটা সামলে আপিস ঢুকলাম ফের।

মেট্রোয় বসে আছি ঠ্যাঙ মেলে। তেমন ভীড় নেই, দুপুরের মেট্রো। এক সার অর্ধমৃত লোক বসে, হেডফোন গুঁজে, ফোনের দিকে তাকিয়ে, চোখ মেলে কিন্তু মরা মাছের চোখের মত তাকিয়ে...এরই মাঝে দেখি একটা মোটামুটি মলিন জামা পরা, একটা দাঁত নেই, বিস্মিত চোখে মেট্রোর স্টপেজ লেখা আলো জ্বলা বোর্ডটা দেখছে। প্রতিটা সবুজ থেকে নীল হয়ে লাল এর জার্ণিটা দেখছে আর খুশীতে একশো আলো জ্বলে উঠছে চোখে, ছেলেকে ডেকেও দেখালো একবার। ছেলে দেখলো বটে, তেমন আনন্দ পেলো না, কারনটাও বুঝিয়ে গেলো, হ্যাঁ এরকমই তো হবে! 
বাবা একটু অপ্রতিভ হলো বটে, কিন্তু বিস্ময়টা গেল না। দেখতে দেখতে আমার স্টপেজ এসে গেল। আগের দিনের গেঞ্জিটাই পরেছিলাম। পাশ দিয়ে যাবার সময়, বিস্ময় না মরে যাওয়া একটা লোককে ভাবলাম আমার কালকের গিফটটা দিয়ে যাই, পকেটে হাত দিয়ে দেখি সে গিপ্ট কখন পড়ে গেছে কোথায়!

আরো অজস্র উপহারের মত এ উপহারটাও হারিয়ে গেছে কখন। হলুদ ফুলটায় কী লেখা ছিলো কে জানে, আর জানার কোনো উপায়ও রইলো না! 
ময়দানে তখন সূর্য ডুবছে, একটা একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে দেখছে, প্রেমিক প্রেমিকাদের উত্যক্ত করা চা ওলা কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এদিক থেকে ওদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, যত্রতত্র পাপড়ি চাট খেয়ে ময়দানটাকে ডাস্টবিন বানানো লোকজন কেমন ময়দানের ঘাস গুলো থেকে দূরে চলে যাচ্ছে একটু একটু করে।

তার মধ্যেই একটা বুড়ো গাছ হাঁ করে সূর্য ডুবে যাওয়া দেখছিলো, কেমন করে মানুষগুলো আবছা হয়ে আসছে, গাছে গাছে পাখিগুলো সন্ধ্যেবেলার আসর বসাতে শুরু করছে....
আমার হাতের মুঠো থেকে মেট্রোয় পাওয়া বিস্ময়টা বুড়োর মুখে ঢেলে দিলাম। আমার কাছে থাকলে ফের হারিয়ে যাবে হয়ত, তার আগেই বুড়ো র কাছে জমা থাক। যদি কেউ আসে কোনোদিন নিতে...কিংবা একদিন রাতে হয়তো শ্বাস ছাড়ার সাথে উড়িয়ে দেবে, আর পরদিন কোলকাতার সবার মধ্যে রেনুর মতো বিস্ময় গুঁড়ো মিশে মিশে যাবে....


2 comments:

  1. খুব ভালো লাগল লেখাটা, প্রদীপ্ত। অনেকদিন পর পোস্ট পেয়ে আরও ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. থ্যাংক ইউ কুন্তলাদি। ইয়ে এর আগের পোস্টটা খুব আগের না তো, তোমার কি চোখ এড়িয়ে গেছিলো বাই চান্স?

    ReplyDelete